What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

শুভঙ্করের ফাঁকি – প্রবাদটির পিছনের ইতিহাস (1 Viewer)

SoundTrack

Board Senior Member
Elite Leader
Joined
Mar 2, 2018
Threads
530
Messages
13,427
Credits
283,140
Recipe pizza
Loudspeaker
‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ কথাটি তো আমরা হরহামেশাই শুনে থাকি৷ হিসেব নিকেশের মারপ্যাঁচে আসল বিষয় রেখে কর্তৃপক্ষ কিংবা সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে ফায়দা হাসিল করার কৌশলকে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ বলা হয়ে থাকে ৷ এই অর্থটিও কমবেশি অনেকেরই জানা ৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে শুভঙ্কর আসলে কে? আর শুভঙ্করের ফাঁকির ইতিহাসটাই বা কি? কি ফাঁকি দিয়ে সে বাংলা ভাষার প্রবাদের সাথে জড়িয়ে গেল?

আজকের পর্বে আমরা এই প্রশ্নগুলোরই উত্তর জানার চেষ্টা করবো৷ জানবো শুভঙ্করের ইতিহাস ৷

শুভঙ্কর সম্পর্কে সবচেয়ে প্রচলিত যে গল্পটি পাওয়া যায় সেটি হচ্ছে, প্রাচীন বাংলার এক বিখ্যাত গণিতজ্ঞ শুভঙ্কর যিনি শুভঙ্করী নামক পাটিগণিতের রচয়িতা ৷ কিছুদিন আগেও যখন ক্যালকুলেটর ছিল না, মানুষ মুখে মুখেই জটিল সব অঙ্ক করে ফেলতে পারতো, যা মানসাঙ্ক নামে পরিচিত ৷ এই মানসাঙ্ক আর এর সাথে জমির হিসেব, জিনিসের দাম ও রাজস্ব সংক্রান্ত কঠিন সব অঙ্ক কবিতার ছন্দে প্রকাশ করে গিয়েছিলেন গণিতজ্ঞ শুভঙ্কর। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মানুষ তার সঠিক অঙ্কগুলো ভুলভাবে প্রয়োগ করে তথা হিসেবে ফাঁক বা কোন হিসেবের ধার না ধেরে মানুষজনকে ঠকাতে শুরু করলো। আর এরই সাথে শুভঙ্করের ফাঁকির প্রচলনও হয়ে গেল ৷ সহজ সরল ভাবে বলতে গেলে এটাই শুভঙ্করের পরিচয় ৷ তবে এখানেই শেষ নয় ৷ এই প্রবাদ পুরুষের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় রয়েছে নানা ভিন্নমত ৷

অন্য আরেকটি মতানুসারে, শুরুতেই তার নাম শুভঙ্কর ছিল না। গণিতশাস্ত্র এক সময় সংস্কৃত ভাষায় লেখা হতো যার ফলে সাধারণ মানুষের জন্য গণিতশাস্ত্র পড়া কঠিন ব্যাপার ছিল। তখন ভৃগুরাম দাস নামে এক গণিতবিদ সহজ পদাবলির মাধ্যমে গণিতকে প্রকাশ করা শুরু করেন। লোকজনের মাঝে জনপ্রিয়তা পায় তার এই গণিত বিষয়ক সহজ পদাবলি। লোকের কাছে এই পদাবলিগুলোকে মনে হতে থাকে শুভকর অর্থাৎ উপকারী। শুভকর থেকে ভৃগুরাম দাসের নাম হয় শুভঙ্কর। শুভঙ্কর গণিতকে যেভাবে কবিতার মতো করে তুলে ধরতেন, শিক্ষার্থীদের কাছে তা মনে হতো কবিতা। তাছাড়া সেই সময়ে তিনি গণিতের এমন কিছু নিয়ম বের করেছিলেন যেগুলোতে গোঁজামিল দিয়ে ভরা আর সেই থেকে গোঁজামিলপূর্ণ বিভ্রান্তিকর নয়-ছয় গলদ জাতীয় কোন কিছুকেই ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ হিসেবে বলা হয়। তিনিই মূলত এই বঙ্গে ঐকিক নিয়মকে জনপ্রিয় করেন।

SFPH_001.gif


গণিতের এইসব হিসাব-নিকাশের ধারণাটা বেশ পুরনো ৷ মোটামুটি ষাটের দশক পর্যন্ত এদেশে শুভঙ্করী ধারাপাত ও হিসেব নিকেশের পদ্ধতি বেশ চালু ছিল ৷ আজও প্রবীণ মানুষেরা ছোটবেলার গল্প শোনাতে গিয়ে একের পর এক শুভঙ্করের আর্যা মুখস্থ বলে যান৷ নবীন শ্রোতারা হতবাক হয় কারণ আনা, পাই, বিঘা, কাঠা, ছটাক, কড়া, ক্রান্তি, যব, তিল, কাহন, পণ, গণ্ডা, কড়া, বুড়ি, চোক, সের, পোয়া, তোলা, রতি ইত্যাদির হিসেব এবং মানসাঙ্ক শুভঙ্করের আর্যার মাধ্যমে সমাধানের নিয়ম-কানুন আধুনিক সমাজে অপ্রচলিত৷ তাছাড়া যেসব চিহ্ন দিয়ে এগুলো লেখা হতো তাও এখন অপরিচিত হয়ে গেছে ৷

এবারে আর্যা কি সে সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়া যাক ৷

আর্যা সম্পর্কে সুকুমার সেন (১৯০০-১৯৯২খ্রি.) বলেছেন- ‘ষোড়শ শতাব্দীর পূর্ব হইতে জ্ঞানগর্ভ হেঁয়ালি ও সংক্ষিপ্ত ছড়াকে বলা হইত আর্যা ও তরজা ৷

SFPH_002.jpg


সুকুমার সেন - Source: The Caravan

আর্যা বুঝাইত জ্ঞানগর্ভ হেঁয়ালি রচনা, আর তরজা (আরবি শব্দ) বুঝাইত সহজবোধ্য প্রবচন৷ পরবর্তীকালে (অর্থাৎ অষ্টাদশ-উনবিংশ শতাব্দীতে) আর্যা নামটি গণিতের ছড়াকেই বুঝাইত৷ সবচেয়ে পুরাতন যে গণিতের ছড়া পাওয়া গিয়াছে তাহাকে বলিত শুভঙ্করী আর্যা অথবা শুভঙ্করী দাঁড়া (দাঁড়া মানে বাঁধা গৎ অর্থাৎ তরজা) ৷’

সুবলচন্দ্র মিত্রের (১৮৭২-১৯১৩) খ্রি. সরল বাঙ্গালা অভিধান অনুযায়ী ‘শুভঙ্কর একজন বিখ্যাত গণিতজ্ঞ ও শুভঙ্করী নামক পাটিগণিতের রচয়িতা ৷ বঙ্গদেশে কায়স্থ বংশে তার জন্ম ৷ গণিতবিদ্যায় তিনি নিত্য-ব্যবহার্য অঙ্কসমূহ সমাধান করার সহজ সরল সঙ্কেত নির্ধারণ করে জনসাধারণের অশেষ উপকার করে গেছেন ৷’

নগেন্দ্রনাথ বসু ( ১৮৬৬-১৯৩৮ খ্রি.) সঙ্কলিত বিশ্বকোষে দেখা যায় যে, শুভঙ্কর ছিলেন একজন বিখ্যাত মানসাঙ্কবেত্তা ৷ অঙ্কের কঠিন নিয়ম সংক্ষিপ্তভাবে সুললিত ভাষায় হৃদয়গ্রাহী কবিতার ছন্দে প্রকাশ করেছিলেন তিনি৷ ঐ ছন্দোবদ্ধ নিয়মগুলোই আর্যা নামে পরিচিত৷ তার আসল নাম শুভঙ্কর দাস৷ তিনি জাতিতে কায়স্থ ছিলেন বলে জানা যায়৷ নবাবি আমলে অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রাজকীয় বিভিন্ন বিভাগে কী রূপ বন্দোবস্ত ছিল এবং কী নিয়মে নবাব সরকারের কাজকর্ম পরিচালিত হতো তা শুভঙ্কর দাস তার লেখা ‘ছত্রিশ কারখানা’ নামক পুস্তকে বিবৃত করেছেন৷ ‘ছত্রিশ কারখানা’ পুস্তকে দুই হাজার শ্লোক ছিল বলে জানা যায়৷ এতে বহু ফারসি শব্দ আছে ৷ তার অঙ্কশাস্ত্রের নাম শুভঙ্করী ৷

সুবোধকুমার মুখোপাধ্যায় তার প্রাকপলাশী বাংলা গ্রন্থে বলেছেন যে, বাংলাদেশে মুখে মুখে অঙ্ক শেখানোর রেওয়াজ শুভঙ্করের আগে থেকেই প্রচলিত ছিল৷ শুভঙ্কর তার অতি পরিচিত মানসাঙ্কের ছড়াগুলোতে এ রেওয়াজকে আরো সুন্দরভাবে সুগঠিত রূপ দিয়েছেন৷ ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের পলাশীর যুদ্ধের আগেও বাংলাদেশে ছাত্ররা শুভঙ্করের আর্যা মুখস্থ করতো বলে জানা যায়৷ শুভঙ্কর এবং ভৃগুরাম দাস একই ব্যক্তি বলে মনে করেন বেশিরভাগ পন্ডিত৷ ভৃগুরাম দাসের ভণিতাযুক্ত অনেক আর্যা এদেশে পাওয়া গেছে ৷

অন্যদিকে সুকুমার সেন (১৯০০-১৯৯২ খ্রি.) শুভঙ্কর ও ভৃগুরাম দাসকে এক ব্যক্তি হিসেবে মেনে নেননি৷ শুভঙ্কর নামে আদৌ কোন বিশেষ আর্যালেখক ছিলেন কিনা সে সম্পর্কেও সুকুমার সন্দেহ পোষণ করেছেন৷ যদি থেকেও থাকেন তবে পঞ্চদশ শতাব্দীর আগে তিনি জীবিত ছিলেন এবং অপভ্রংশে লিখেছেন বলে সুকুমারের মন্তব্য।

ভূদেব চৌধুরী শুভঙ্করের আর্যাবলিকে সামাজিক মঙ্গলবোধের উৎকৃষ্ট নিদর্শন হিসেবে দেখেছেন৷ শুভঙ্করকে তিনি আদি যুগের অর্থাৎ চতুর্দশ শতাব্দীর আগের মানুষ বলে মনে করেন৷

শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯২-১৯৭০খ্রি.) বলেছেন, ‘শুভঙ্করীর আর্যা ও ডাকের অবহট্টের কিছু কিছু চিহ্ন ভাষাতাত্ত্বিক নিদর্শনরূপে রক্ষিত হইয়াছে৷’ তিনি মনে করেন যে, এগুলো চর্যাপদের সমকালীন ৷
 
SFPH_003.jpg


Source: Infinit Edu

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একনিষ্ঠ ভক্ত রেভারেন্ড জেমস লঙ (১৮১৪- ১৮৮৭ খ্রি.) শুভঙ্করকে The Cocker of Bengal হিসেবে চিহ্নিত করে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বলেছেন, ‘১৪০ বছর যাবৎ শুভঙ্করের আর্যার আবৃত্তিতে অনুমান ৪০,০০০ বঙ্গবিদ্যালয় মুখরিত হইয়া আসিয়াছে৷’

এই হচ্ছে শুভঙ্কর সম্পর্কে প্রচলিত কিছু তথ্য৷ এবারে শুভঙ্করের কয়েকটি আর্যার নমুনা দেখে নেওয়া যাক:-

১. ত্রিশ হাত উচ্চ বৃক্ষ ছিল এক স্থানে

চূড়ায় উঠিবে এক কীট করে মনে।

দিবাভাগে দশ হাত উঠিতে লাগিলো

নিশাযোগে অষ্ট হাত নীচেতে নামিলো

না পায় যাবৎ চূড়া করে সে অটন

কত দিনে উঠেছিল কর নিরূপণ!

উত্তর: এখানে এক কীট পুরো দিনে (দিন ও রাত) বৃক্ষের মোট দু’হাত ওঠে। তার ওঠার শেষ দিকে দিবাভাগে শেষ দশ হাত উঠলে চূড়ান্ত ওঠা হবে । বাকি (বিশ) হাত কীট ওঠা-নামা করেছিল ১০ দিন।

অতএব, মোট সময় লাগবে পুরো ১০ দিন + একটি দিবাভাগ = ১০ দিন।

২. সরোবরে বিকশিত কমল নিকর

মধুলোভে এল তথা অনেক ভ্রমর

প্রতি পদ্মে বসে যদি ভ্রমর যুগল

অলিহীন রহে তবে একটি কমল

একেক ভ্রমর বসে প্রত্যেক কমলে

বাকী রহে এক অলি, সংখ্যা দেহ বলে।

উত্তর: পদ্ম সংখ্যা X ও ভ্রমর সংখ্যা Y হলে, প্রশ্নানুসারে —

Y=2(X-1)… (i)

Y=X+1…… (ii)

(i) ও (ii) সমাধান করে, x=3, y=4

অর্থাৎ, সরোবরে ৩ টি পদ্ম ও ৪ টি ভ্রমর এসেছিল।

শুরুতে বিষয়টির সঙ্গে ইতিবাচক বিষয় জড়িত ছিল, কঠিন গণিতকে সহজ করে তুলে ধরার ব্যাপার ছিল। কিন্তু কালক্রমে ব্যবহারে ব্যবহারে এই শব্দগুচ্ছের অর্থ পাল্টে যেতে থাকে। এখন নেতিবাচক অর্থেই এটি বেশি ব্যবহৃত হয়। শব্দের ব্যবহার নেতিবাচক অর্থে হওয়ার পেছনে বোধ হয় ‘ফাঁকি’ শব্দটির ভূমিকা হয়েছে। ফাঁকি মানে প্রতারণা বা ছলনা। আর প্রতারণার বিষয়টিই হয়ে গেছে এখন ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’৷ শুভঙ্করের হিসেবের আর্যা অপব্যবহার করে কিংবা বিকৃত করে ভুল হিসেব শুদ্ধ দেখিয়ে কোনো ধুরন্ধর যদি সরল মানুষকে প্রতারণা করে তবে সেই দায়ভার প্রবাদপুরুষ শুভঙ্করের কাঁধে চাপানো নিশ্চয়ই সুবিবেচনার কথা নয়৷ বাঙালির মেধাশক্তির অপচয় ও অবক্ষয় শুভঙ্কর কিংবা শুভঙ্করীর হিসেবের কারণে হয়েছে বলে মনে হয় না৷ অনেক তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ হরহামেশা নিয়ম-কানুন, বিধিবিধান ও হিসেবের খুঁটিনাটি বুঝে বলে প্রায়শই সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে তাদের প্রতারণা করে থাকে নানা কৌশলে৷ এ অবস্থা ততদিন থাকবে যতদিন সচেতনতার ধারা সৃজনে বঞ্চিত মানুষেরা নিজেরা এগিয়ে না আসবে৷

ইন্টারনেট এবং সমর পালের ‘প্রবাদের উৎসসন্ধান’ (পৃষ্ঠা ১৫৩-১৫৭) অবলম্বনে ৷
 
একজনের সৎ চেষ্টার অপব্যবহার যে কিভাবে হতে পারে, তার এক অনন্য উদাহরণ |
 
মানুষ ভালর জন্য কিছু করে আর অন্যরা তা ভুল কাজে লাগায়।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top