রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের ডালি নিয়ে রমজান এসেছিল। আমরা তা কতটুকু অর্জন করতে পেরেছি, আমাদের জীবনে এর প্রভাব কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে, এই হিসাব কষার সময় এসেছে।
রমজান পেয়েও যারা নাজাত লাভ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের অভিসম্পাত করেছেন। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘একদা জুমার দিনে রাসুলুল্লাহ (সা.) মিম্বরের প্রথম ধাপে পা রেখে বললেন, আমিন! অতঃপর দ্বিতীয় ধাপে পা রাখলেন, বললেন আমিন! তারপর তৃতীয় ধাপে পা রাখলেন এবং বললেন আমিন! এরপর খুতবা দিলেন ও নামাজ আদায় করলেন। নামাজ শেষে সাহাবায়ে কিরাম প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)! আজ যা দেখলাম তা ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি (আপনি একেক ধাপে পা রেখে আমিন! বলছিলেন); এটা কি কোনো নতুন নিয়ম নাকি? নবীয়ে করিম (সা.) বললেন: না, এটা নতুন কোনো নিয়ম নয়; বরং আমি মিম্বরে ওঠার সময় হজরত জিবরাইল (আ.) আসলেন, আমি যখন মিম্বারের প্রথম ধাপে পা রাখি তখন তিনি বললেন—আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যারা পিতা–মাতাকে বার্ধক্য অবস্থায় পেয়েও তাদের খেদমতের মাধ্যমে জান্নাত অর্জন করতে পারল না, তারা ধ্বংস হোক। তখন আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম আমিন! যখন দ্বিতীয় ধাপে পা রাখি তখন তিনি বললেন—আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যারা রমাদান পেল কিন্তু ইবাদতের মাধ্যমে তাদের গুনাহ মাফ করাতে পারল না, তারা ধ্বংস হোক। তখন আমি বললাম আমিন! আমি যখন মিম্বরের তৃতীয় ধাপে পা রাখি তখন তিনি বললেন—আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যারা আপনার পবিত্র নাম মোবারক শুনল কিন্তু দরুদ শরিফ পাঠ করল না, তারা ধ্বংস হোক। তখন আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম আমিন!’ (মুসলিম শরিফ)
রমজান হলো তাকওয়ার জন্য, তাকওয়ার মূল কথা হলো নিয়ন্ত্রিত সুশৃঙ্খল জীবন। রমজান শেষে আমাদের দেখা দরকার আমরা রমজানের লক্ষ্য কতটুকু অর্জন করতে পেরেছি।
রমজানে আমরা এক মাস রোজা পালন করলাম, বাকি এগারো মাস রোজার আদর্শে চলতে পারব কি না? আমার বাকি জীবন নামাজের আদলে পরিচালিত করতে পারব কি না?
প্রিয় নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমার হিসাব নেওয়ার আগে নিজের হিসাব নিজে করে রাখো।’ (বুখারি ও মুসলিম)। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মানুষের হিসাব নিকটে এসে গেছে, তবু তারা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে আছে।’ (সুরা-২১ আম্বিয়া, আয়াত: ১)। কিয়ামতের দিনে আল্লাহ তাআলা বলবেন, ‘তোমার হিসাব কিতাব পাঠ করো; আজ তোমার হিসাবের জন্য তুমি নিজেই যথেষ্ট।’ (সুরা-১৭ বনি ইসরাইল, আয়াত: ১৪)।
রমজান এল, রমজান চলে গেল, আত্মমূল্যায়নের সময় হলো। মাহে রমজানের ফজিলতসংক্রান্ত তিনটি হাদিসে এর সুফলপ্রাপ্তির জন্য ‘ইমান’ এবং ‘ইহতিসাব’ শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইমান (পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস) এবং ইহতিসাবের (আত্মজিজ্ঞাসা) সঙ্গে রমাদান মাসে রোজা রাখবে, তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ ‘যে ব্যক্তি ইমান (পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস) এবং ইহতিসাবের (আত্মপর্যালোচনা বা আত্মসমালোচনা) সঙ্গে রমাদান মাসে রাত জাগবে (তারাবিহ পড়বে, ইবাদত করবে); তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ ‘যে ব্যক্তি ইমান (পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস) এবং ইহতিসাবের (আত্মমূল্যায়ন) সঙ্গে কদরের রাত জেগে ইবাদত করবে; তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি, ইমান অধ্যায়, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২৯-৩১, পরিচ্ছেদ: ২৮, ২৭ ও ২৫, হাদিস: ৩৭, ৩৬ ও ৩৪)।
অনেকেই রমজানে রোজা রাখেন, তারাবিহ পড়েন; ঈদের চাঁদ উঠলেই মনে করেন ইবাদতের সমাপ্তি ঘটেছে, ছুটি হয়েছে। এই ছুটির অলীক আনন্দে অনেকের সেদিনের মাগরিবের ফরজ নামাজও ছুটে যায়। সাতাশ দিন অতি যত্নে খতম তারাবিহ পড়ে আটাশতম দিনে তারাবিহর নামাজকেই ছুটি দিয়ে দেন কেউ কেউ; কারও কারও এশার নামাজও তরক হয়ে যায়। এক মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদের রাতে ইবাদতে মশগুল না হয়ে, অন্যায় রকম আনন্দ ফুর্তি করা রমজানে তার ব্যর্থতারই বহিঃপ্রকাশ। যাঁর রমজানের ইবাদত সফল হবে, কবুল হবে; তিনি রমজানের শেষে ফরজ তরক করা, সুন্নাত বর্জন করা এবং গর্হিত অন্যায় গুনাহের কাজে লিপ্ত হওয়া থেকে অবশ্যই বিরত থাকবেন।
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম