ঋতু পরিবর্তনের নিয়ম মেনে প্রকৃতিতে এসেছে বসন্তকাল। সময়টা চিকেন পক্স বা জলবসন্তেরও মৌসুম। এটি ভ্যারিসেলা ভাইরাস সৃষ্ট অত্যন্ত ছোঁয়াচে অসুখ। ৯০ শতাংশ জলবসন্ত অনূর্ধ্ব ১০ বছর বয়সীদের হয়ে থাকে। তবে নবজাতক বয়স থেকে যেকোনো বয়সে জলবসন্ত হতে পারে। পরিবারে কেউ আক্রান্ত হলে, অন্য যারা আগে এ রোগে ভোগেনি, তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অত্যন্ত প্রবল। মূলত জানুয়ারি থেকে মে অর্থাৎ শীতের শেষ ও বসন্তের শুরুতে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। রোগ ছড়ায় সরাসরি সংসর্গে, বাতাসে ছড়ানো ড্রপলেট থেকে, হাঁচি, কাশি, লালার সাহায্যে। জলভরা কাঁচা ফোসকায় জীবাণু থাকে। ফেটে গেলে বা খুঁটে ফেললে রোগ ছড়াতে পারে। রোগ ছড়ায় ফুসকুড়ি বেরোনোর ২৪ ঘণ্টা থেকে সমস্ত খোসা উঠে যাওয়া পর্যন্ত, যা সাধারণভাবে সাত-আট দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
এমনিতে জলবসন্ত তেমন গুরুতর রোগ নয়। কিন্তু কোনো শিশুর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল থাকলে যেমন লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত শিশু, স্টেরয়েড-নির্ভর শিশুর জন্য জটিল হতে পারে।
উপসর্গ
সাধারণভাবে ফুসকুড়ি বেরোনোর ২৪ ঘণ্টা পূর্ব থেকে উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন গা ম্যাজম্যাজে ভাব, জ্বর জ্বর ভাব, কাঁপুনি, সামান্য মাথাব্যথা, ক্ষুধামান্দ্য, বমি ভাব, বমি প্রভৃতি। তারপর শরীরে ফুসকুড়ি ওঠে। প্রথমে লালচে দানা, পরে জলভরা ও শেষে পুঁজ ভরা দানার মতো ফোসকা। এই ফুসকুড়ি ভীষণ চুলকায়। তবে এক দিনেই সব ফুসকুড়ি বেরোয় না। প্রথমে শুরু হয় বুকে পিঠে, পরে হাত-মুখ ও সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। মুখের ভেতরে তালুতেও থাকে জলভর্তি দানা, কিন্তু এসব শিগগিরই ভেঙে যায়। ছয়-সাত দিন পর থেকে ফুসকুড়ি শুকাতে শুরু করে। ১৩-১৪ দিন থেকে খোসা ঝরতে শুরু করে। একসময় রোগ সেরে যায়।
জটিলতা
এমনিতে জলবসন্ত তেমন গুরুতর রোগ নয়। কিন্তু কোনো শিশুর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল থাকলে যেমন লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত শিশু, স্টেরয়েড-নির্ভর শিশুর জন্য জটিল হতে পারে। কখনো কখনো এসব শিশুর এনকেফেলাইটিস, ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ, মারাত্মক নিউমোনিয়া, রক্তপাত জটিলতা দেখা যায়।
চিকিৎসা
- লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
- রোগীকে পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে আলাদা রাখুন। বাইরে বা স্কুলে যাওয়া আপাতত বন্ধ রাখুন।
- জলবসন্তে আক্রান্ত শিশু অন্য কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত না হলে সহজেই সেরে ওঠে।
- বেশি করে পানি খেতে হবে। তরল ও পুষ্টিমানসমৃদ্ধ খাবার খাওয়াতে হবে। অনেকে এটা-ওটা খেতে নিষেধ করেন, তবে এসবের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
- চুলকানি কমাতে ওষুধ দেওয়া যেতে পারে। লক্ষ রাখবেন, শিশু নখ দিয়ে যেন ত্বক না চুলকায়। সে কারণে নখ কেটে ছোট রাখতে হবে। নখ ভালো করে সাবান পানিতে ধুয়ে দেওয়া ভালো।
- ত্বক পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য প্রতিদিন বিছানার চাদর পাল্টান। রোগীকে পরিচ্ছন্ন পোশাক পরান।
- রোগীর কফ-কাশ-থুতু, গুটিগুলোর ওপর থেকে খসে পড়া চামড়ার টুকরো ও ব্যবহৃত পোশাক অন্য শিশুর সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখুন। পোশাক-আশাক সাবান-পানি দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
- জলবসন্ত ও অ্যাসপিরিনের সঙ্গে ‘রেয়েস সিনড্রোম’ নামের মারাত্মক অসুখের সম্পর্ক আছে। তাই শিশুদের জ্বর কমাতে অ্যাসপিরিন ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে প্যারাসিটামল দেওয়া যাবে।
- ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের চিকিৎসায় এসাইক্লোভির নামক নির্দিষ্ট ওষুধের আগেভাগে প্রয়োগে সুফল আছে কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত এটা দেওয়া যাবে না। এ ছাড়া বিশেষজ্ঞের পরামর্শে বসন্তের সংসর্গে আসার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ভ্যারিসেলা জসটার ইমিউন গ্লাবুলিন প্রয়োগ করা যায়।
- আক্রান্ত ব্যক্তি শরীরে ফুসকুড়ি দেখা যাওয়ার ২ দিন আগে থেকে ফুসকুড়ি বেরোনোর ৩ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত রোগজীবাণু ছড়াতে সক্ষম। এই কারণে বিদ্যালয়গামী শিশু ফুসকুড়ি দেখা যাওয়ার ন্যূনতম ৬ দিন পর্যন্ত স্কুলে যাবে না।
- জলবসন্ত প্রতিরোধে টিকা পাওয়া যায়, যা প্রায় ৯৫-৯৮ শতাংশ কার্যকর। ১২ মাস থেকে ১২ বছর বয়সের শিশুকে যখনই সম্ভব এই টিকা দিয়ে দেওয়া উচিত। সাধারণভাবে এক ডোজ টিকাতেই কাজ হয়। ১৩ বছরের বেশি বয়সীর ক্ষেত্রে ৬ থেকে ১০ সপ্তাহ বিরতিতে দ্বিতীয় আর এক ডোজ দেওয়া ভালো। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা সাধারণভাবে টিকা দেওয়ার দুই সপ্তাহ পরে অর্জিত হয়। জলবসন্ত রোগের টিকা যথেষ্ট নিরাপদ, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও নগণ্য।
- একবার এই রোগ হয়ে গেলে শরীরে যে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা জন্মায়, তাতে দ্বিতীয়বার আর এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রায় নেই বললেই চলে।
[FA]pen[/FA] লেখক: অধ্যাপক প্রণব কুমার চৌধুরী | সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশু স্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল