আজ অনেক দিন পর ময়মনসিংহ পার্কে হাঁটতে
বের হয়েছি । হাঁটতে ভালই লাগছে। সেই সাথে
এক ধরনের শূন্যতাও গ্রাস করছে। কাউকে
হারানোর শূন্যতা।
ময়মনসিংহ পার্কের এই পরিচিত রাস্তাগুলোতে
অনেকবার টুসির হাত ধরে হেঁটেছি । আজ আর টুসি
নেই । তাই একাই হাঁটতে হচ্ছে ।
টুসিকে আমার জীবন থেকে হারিয়ে
ফেলেছি,প্রায় ছয় মাস হয়ে গেল ।
পার্কের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে কালামের
ছোট চায়ের দোকানটা চোখে পড়লো ।
অনেকদিন এই দোকানটাতে চা খাওয়া হয় না । ১২-১৩
বছরের কালাম নামের এই ছেলেটা অসাধারণ চা
বানায় ।
টুসি আর আমি এই দোকানটাতে অনেকবার চা
খেয়েছি । টুসি যে স্যার এর কাছে Physics
প্রাইভেট পড়তো সেই স্যার এর বাসা ছিল
পার্কের কাছেই । বিকালবেলা ওর প্রাইভেট শেষ
হলে মাঝে মাঝেই আমাকে ফোন দিয়া পার্কে
আসতে বলতো । বিকালবেলা ওর সাথে পার্কে
হাঁটতে এসে প্রায়ই কালামের দোকানে চা খাওয়া
হতো ।
দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কালাম ডাকল,
`শাফিন ভাই,কই যান?’
এইতো, হাঁটতেছি ।‘
চা খায়া যান । অনেকদিন ধরে তো আসেন না ।
আফা আহে নাই ?’
কালামের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে দোকানে
গিয়ে বসলাম ।
দোকানে গিয়ে বসতেই কালাম এক কাপ চা বানিয়ে
হাতে দিল ।
চা খেতে গিয়ে টুসির কথা প্রবলভাবে মনে
হচ্ছিলো ।
ও আমার জীবনে কেন এলো , আর কেনইবা
কষ্ট দিয়ে চলে গেলো ?
মনে হচ্ছে , এইতো সেদিনের ঘটনা । পাশের
বাসায় আসা নতুন ভাড়াটিয়ার সুন্দরী মেয়েটিকে হঠাৎ
আমার নজরে পড়লো । সে দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার ।
কলেজ শেষ করে যখন বাসায় ফিরি তখন পাশের
বাসার ২য় তলার বারান্দায় চোখ চলে যায় । দেখলাম ,
উদাস উদাস ভাব নিয়ে একটি মেয়ে আকাশের
দিকে তাকিয়ে আছে । প্রথম দেখাতেই
মেয়েটিকে কেমন যেন ভালো লেগে
গেলো । তারপর মাঝে মাঝেই মেয়েটির সাথে
রাস্তায় দেখা হতো । কখনও দেখতাম বিকালে
প্রাইভেটে যাচ্ছে , কখনও দেখেছি স্কুল টাইম
এ রিকসার জন্য দাড়িয়ে আছে ।
একদিন হঠাৎ মাথায় ভূত চাপল টুসিকে রিকসার পেছন
পেছন ফলো করে ওর স্কুল পর্যন্ত যাবো ।
যেই ভাবা সেই কাজ । ওর স্কুল টাইম এ বাসা
থেকে সাইকেল নিয়ে বের হলাম । কিছুক্ষন
পরই টুসি বাসা থেকে বের হয়ে রিকসায় উঠলো ।
আমিও সাইকেল নিয়ে ফলো করে ওর স্কুল
পর্যন্ত গেলাম । ও স্কুলে ঢুকে গেলে আমি
আবার বাসায় চলে আসলাম । এভাবে মাঝে মাঝেই
ফলো করতাম । একদিন ফলো করছি এমন সময়
দেখলাম , টুসি বারবার রিকসার পেছন দিকে তাকিয়ে
আমাকে দেখছে । বুঝতে পারলাম ফলো করার
বেপারটা ও ধরে ফেলেছে । তাই , ওই দিনের
পর থেকে ভয়ে আর ফলো করি নাই । কিন্তু আমি
যে টুসির প্রতি কিছুটা দুর্বল হয়ে পরেছি সেটা
আস্তে আস্তে অনুভব করলাম । মনে মনে ছিন্তা
করছিলাম , কিছু একটা অবশ্যই করতে হবে ।
আল্লাহের রহমতে একটা রাস্তা পেয়েও গেলাম ।
আমার এক মেয়ে ফ্রেন্ড টুসিদের বাসার নিচের
তলার ফ্ল্যাট এ থাকতো । সুযোগ বুঝে আমার
ফ্রেন্ডকে একদিন সব খুলে বললাম । ওর
সাহায্যেই আমি পরে টুসির মোবাইল নাম্বারটা
পেয়ে গেলাম । শুরু হল মেসেজ পাঠানো ।
টুসিকে মাঝে মাঝেই মেসেজ পাঠাতাম । একদিন
সাহস করে কল করে বসলাম । ও ফোন রিসিভ করার
পর ভদ্র ভাষায় কিছু গালি শুনতে হল । তবুও
নাছোড়বান্দার মত লেগেই রইলাম । মাঝে মাঝেই
কল করতাম ।কিন্তু ও রিসিভ করতো না । তারপর
কলেজ এ পরীক্ষা শুরু হুএ যাওয়ায় ব্যস্ততায় টুসির
কথা ভুলেই গিয়েছিলাম । ওকে পাবার আশাও প্রায়
ছেড়ে দিয়েছিলাম । পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর
হঠাৎ একদিন টুসির নাম্বার থেকে আমার মোবাইল এ
একটা কল আসে ।
আমিতো আকাশ থেকে পড়লাম । ভয়ে ভয়ে
কলটা রিসিভ করলাম । রিসিভ করার পর টুসি যে
কথাগুলো বলেছিল সে কথাগুলো হচ্ছে :
আপনি কে সে সম্পর্কে আমি জানতে পেরেছি
। তিথি আপু (আমার সেই মেয়ে ফ্রেন্ড ,যে
টুসিদের বাসার নিচের ফ্ল্যাট এ থাকে) আমাকে সব
বলেছে ।
কাউকে ভালো লাগলে সেটা বলতে হয় ।
কাপুরুষের মত ফোন দিয়ে কাউকে বিরক্ত করে
ভালবাসা আদায় করা যায় না । আর কাউকে ভালবাসতে
হলে তাকে বুঝতে হয় , ভালো লাগতে হয় , যাচাই
করতে হয় । তারপর তো ভালবাসা । হুট করে
ভালবাসার কথা বললেই ভালবাসা যায় না । ‘
এই কথাগুলো বলে ও লাইন কেটে দেয় ।
এভাবেই আমাদের রঙিন স্বপ্ন বোনা শুরু হয়ে
ছিল । ওই দিনের ফোন কলের পর থেকে আমি
সব সময় টুসির পাশে থাকার চেষ্টা করেছি । মাঝে
মাঝেই ওর স্কুল এ যাওয়ার সময় সাইকেল দিয়ে
রিকসার সাথে সাথে ওর স্কুল পর্যন্ত গিয়েছি ।
বিকালেও প্রায়ই ওর প্রাইভেট এ যাওয়ার সময় সাথে
সাথে গিয়েছি । ও শুধু পিছনে ফিরে মুচকি হাসত ।
এই মুচকি হাসিটাই আমার কাছে চাদের আলো মনে
হতো ।
এভাবে চলার দুই মাস পর টুসিকে সরাসরি প্রপোজ
করলাম । ও কিছু না বলে শুধু একটু হেসেছিল । ২
দিন পর ও যখন আমার প্রস্তাবে হ্যাঁ’ বলল তখন আমি
যে কি খুশি হয়েছিলাম সেটা বলে বোঝানো
যাবে না ।
আমাদের দিনগুলো স্বপ্নের মত এগিয়ে যেতে
লাগলো । টুসির ভালবাসায় নিজেকে পৃথিবীর
সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হতো ।
আমার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝেই টুসি
জিজ্ঞেস করতো , আমাকে ছেড়ে কখনো
যাবে নাতো ?’
আমি ওর হাতটা আরও শক্ত করে ধরে বলতাম ,
আমার এই লক্ষ্মী পাগলীটাকে ছেড়ে আমি
কখনোই যাবোনা ।‘
এইভাবে স্বপ্নের ঘোরে অনেকগুল দিন
কেটে গেলো । টুসি এস .এস .সি তে জি .পি . এ
- ৫ পেয়ে ভিকারুন্নিসা কলেজ এ ভর্তি হল । ও ঢাকা
চলে যাওয়ার আগের দিন আমাকে জড়িয়ে ধরে
অনেক কেদেছিল । ও ঢাকায় ওর খালার বাসায়
থাকতো । কলেজ বন্ধ হলে ও যখন ময়মনসিংহ
আসতো তখনি শুধু আমাদের দেখা হতো । আর
ফোন এবং ফেসবুক এ তো সব সময়
যোগাযোগ থাকতোই ।
আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়লাম এইচ .এস . সি পরীক্ষা
নিয়ে । কেটে যেতে লাগলো দিনগুলো
..........
এইচ.এস.সি পরীক্ষা হয়ে গেল । জি .পি . এ – ৫
পেয়ে ভালোভাবেই উত্তীর্ণ হলাম । তারপর শুরু
হয়ে গেল ভর্তি যুদ্ধ । চান্স পেলাম শাহজালাল
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে । নতুন
বিশ্ববিদ্যালয়ের সোনালি দিন আর টুসির ভালবাসা নিয়ে
মুহূর্তগুলো ভালই কাটছিল । কিন্তু আমাদের সুখটা
আর বেশি দিন স্থায়ী হল না । আমাদের
সম্পর্কের ব্যাপারে টুসির ফ্যামিলিতে জানাজানি হয়ে
গেল । ফ্যামিলির চাপে এক সময় টুসি আমার সাথে
যোগাযোগ করা বন্ধ করে দিল । ভেবেছিলাম
সব ঠিক হয়ে যাবে । কিন্তু , কিছুই ঠিক হল না ।
জীবনটা কালো অন্ধকারে ঢেকে গেলো
হঠাৎ করেই । দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছিলো ।
মোবাইলে কল আসলে মনে হতো এই বুঝি টুসি
ফোন করলো । কিন্তু , সেই আশা আশাতেই
থেকে যেতো । শুধু ভাবতাম , ফ্যামিলির চাপে ও
আমাকে এত সহজেই ভুলে গেলো ।
প্রায় দেড় মাস পর যখন সত্যি ঘটনাটা জানতে পারলাম
তখন আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো ।
আসলে , টুসি আরেকটি ছেলের সাথে
সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল । তাই , ফ্যামিলির
চাপের অজুহাত দেখিয়ে ও আমার কাছ থেকে
দূরে সরে যাচ্ছিলো । হিমি নামে টুসির এক
বান্ধবীর কাছ থেকে যেদিন কথা গুলো
শুনেছিলাম সেদিন কিছুতেই নিজের কানকে বিশ্বাস
করাতে পারছিলাম না । মনে হচ্ছিলো এটা একটা
স্বপ্ন , আর স্বপ্নটা বুঝি এখনি ভেঙে যাবে ।
যেই মানুষটাকে এত বেশি বিশ্বাস করতাম , এত
বেশি ভালবাসতাম সেই মানুষটা আমাকে আজ এভাবে
কষ্ট দিলো ।
ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে সেদিনই টুসিকে ফোন
দিয়েছিলাম । ভেবেছিলাম সবই মিথ্যা বলে প্রমাণিত
হবে । কিন্তু , সব কিছু ভুল প্রমাণিত করে টুসি যখন
সত্যি ঘটনাটি স্বীকার করলো তখন আমি
কিছুক্ষনের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম । ইচ্ছা
হচ্ছিলো দৌড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাই ।
‘ কি দোষ ছিল আমার ? কি ভুল করেছিলাম আমি ?
আমিতো শুধু ভালবেসেছিলাম । ‘
‘ হে আল্লাহ , আমার ভালোবাসাটাই কি দোষ ছিল ।
এটাই কি আমার ভুল ছিল । ‘
আসলে , এরকম দুঃখ পাওয়াটাই মনে হয় ভালোবাসা ।
কথাগুলো চিন্তা করতে করতে কখন যে
অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে বুঝতেই পারলাম
না । ঘর ভাঙল কালামের ডাকে ।
-শাফিন ভাই , আপনের চা তো অনেক আগেই
ঠাণ্ডা হইয়া গেছে । আরেক কাপ চা বানায়া দেই ?
-না থাক । আজকে আর লাগবে না । আরেকদিন
এসে খাবো ।
চায়ের কাপটা রেখে টাকা দিয়ে যখন চলে
আসছিলাম , তখন আবার পিছন থেকে কালাম ডাক
দিলো ।
-শাফিন ভাই , একটু শুইনা যান ।
যাওয়ার পর কালাম আমাকে ওর দোকানের পিছনে
একটা গোলাপ গাছ দেখাল । গাছটাতে একটা
গোলাপ ফুটে আছে । তখনি আমার গাছটার কথা
মনে পড়লো । আমিতো একবারে ভুলেই
গিয়েছিলাম । গত বছর , বৃক্ষ মেলা থেকে এই
গোলাপ গাছটা কিনে টুসি এখানে এনে রোপণ
করেছিলো । বলেছিল , আমাদের ভালোবাসার
নিদর্শনস্বরূপ গাছটা এখানে থাকবে । গাছটা ঠিকই
রয়ে গেছে , কিন্তু আমাদের ভালোবাসাটা হারিয়ে
গেছে ।
-শাফিন ভাই , আরেকদিন আসার সময় আফারে সাথে
কইরা নিয়া আইসেন । আফা গাছে ফুল দেখলে
অনেক খুশি হইব ।
সে কি আর কখনো আসবে এই দোকানে চা
খেতে ? হয়তো আসবে অন্য কারো হাত ধরে
......... কথাগুলো চিন্তা করতে করতে হেঁটে
যাচ্ছি পার্কের সেই চিরচেনা পথটি
ধরে...............
...The End...
বের হয়েছি । হাঁটতে ভালই লাগছে। সেই সাথে
এক ধরনের শূন্যতাও গ্রাস করছে। কাউকে
হারানোর শূন্যতা।
ময়মনসিংহ পার্কের এই পরিচিত রাস্তাগুলোতে
অনেকবার টুসির হাত ধরে হেঁটেছি । আজ আর টুসি
নেই । তাই একাই হাঁটতে হচ্ছে ।
টুসিকে আমার জীবন থেকে হারিয়ে
ফেলেছি,প্রায় ছয় মাস হয়ে গেল ।
পার্কের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে কালামের
ছোট চায়ের দোকানটা চোখে পড়লো ।
অনেকদিন এই দোকানটাতে চা খাওয়া হয় না । ১২-১৩
বছরের কালাম নামের এই ছেলেটা অসাধারণ চা
বানায় ।
টুসি আর আমি এই দোকানটাতে অনেকবার চা
খেয়েছি । টুসি যে স্যার এর কাছে Physics
প্রাইভেট পড়তো সেই স্যার এর বাসা ছিল
পার্কের কাছেই । বিকালবেলা ওর প্রাইভেট শেষ
হলে মাঝে মাঝেই আমাকে ফোন দিয়া পার্কে
আসতে বলতো । বিকালবেলা ওর সাথে পার্কে
হাঁটতে এসে প্রায়ই কালামের দোকানে চা খাওয়া
হতো ।
দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কালাম ডাকল,
`শাফিন ভাই,কই যান?’
এইতো, হাঁটতেছি ।‘
চা খায়া যান । অনেকদিন ধরে তো আসেন না ।
আফা আহে নাই ?’
কালামের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে দোকানে
গিয়ে বসলাম ।
দোকানে গিয়ে বসতেই কালাম এক কাপ চা বানিয়ে
হাতে দিল ।
চা খেতে গিয়ে টুসির কথা প্রবলভাবে মনে
হচ্ছিলো ।
ও আমার জীবনে কেন এলো , আর কেনইবা
কষ্ট দিয়ে চলে গেলো ?
মনে হচ্ছে , এইতো সেদিনের ঘটনা । পাশের
বাসায় আসা নতুন ভাড়াটিয়ার সুন্দরী মেয়েটিকে হঠাৎ
আমার নজরে পড়লো । সে দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার ।
কলেজ শেষ করে যখন বাসায় ফিরি তখন পাশের
বাসার ২য় তলার বারান্দায় চোখ চলে যায় । দেখলাম ,
উদাস উদাস ভাব নিয়ে একটি মেয়ে আকাশের
দিকে তাকিয়ে আছে । প্রথম দেখাতেই
মেয়েটিকে কেমন যেন ভালো লেগে
গেলো । তারপর মাঝে মাঝেই মেয়েটির সাথে
রাস্তায় দেখা হতো । কখনও দেখতাম বিকালে
প্রাইভেটে যাচ্ছে , কখনও দেখেছি স্কুল টাইম
এ রিকসার জন্য দাড়িয়ে আছে ।
একদিন হঠাৎ মাথায় ভূত চাপল টুসিকে রিকসার পেছন
পেছন ফলো করে ওর স্কুল পর্যন্ত যাবো ।
যেই ভাবা সেই কাজ । ওর স্কুল টাইম এ বাসা
থেকে সাইকেল নিয়ে বের হলাম । কিছুক্ষন
পরই টুসি বাসা থেকে বের হয়ে রিকসায় উঠলো ।
আমিও সাইকেল নিয়ে ফলো করে ওর স্কুল
পর্যন্ত গেলাম । ও স্কুলে ঢুকে গেলে আমি
আবার বাসায় চলে আসলাম । এভাবে মাঝে মাঝেই
ফলো করতাম । একদিন ফলো করছি এমন সময়
দেখলাম , টুসি বারবার রিকসার পেছন দিকে তাকিয়ে
আমাকে দেখছে । বুঝতে পারলাম ফলো করার
বেপারটা ও ধরে ফেলেছে । তাই , ওই দিনের
পর থেকে ভয়ে আর ফলো করি নাই । কিন্তু আমি
যে টুসির প্রতি কিছুটা দুর্বল হয়ে পরেছি সেটা
আস্তে আস্তে অনুভব করলাম । মনে মনে ছিন্তা
করছিলাম , কিছু একটা অবশ্যই করতে হবে ।
আল্লাহের রহমতে একটা রাস্তা পেয়েও গেলাম ।
আমার এক মেয়ে ফ্রেন্ড টুসিদের বাসার নিচের
তলার ফ্ল্যাট এ থাকতো । সুযোগ বুঝে আমার
ফ্রেন্ডকে একদিন সব খুলে বললাম । ওর
সাহায্যেই আমি পরে টুসির মোবাইল নাম্বারটা
পেয়ে গেলাম । শুরু হল মেসেজ পাঠানো ।
টুসিকে মাঝে মাঝেই মেসেজ পাঠাতাম । একদিন
সাহস করে কল করে বসলাম । ও ফোন রিসিভ করার
পর ভদ্র ভাষায় কিছু গালি শুনতে হল । তবুও
নাছোড়বান্দার মত লেগেই রইলাম । মাঝে মাঝেই
কল করতাম ।কিন্তু ও রিসিভ করতো না । তারপর
কলেজ এ পরীক্ষা শুরু হুএ যাওয়ায় ব্যস্ততায় টুসির
কথা ভুলেই গিয়েছিলাম । ওকে পাবার আশাও প্রায়
ছেড়ে দিয়েছিলাম । পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর
হঠাৎ একদিন টুসির নাম্বার থেকে আমার মোবাইল এ
একটা কল আসে ।
আমিতো আকাশ থেকে পড়লাম । ভয়ে ভয়ে
কলটা রিসিভ করলাম । রিসিভ করার পর টুসি যে
কথাগুলো বলেছিল সে কথাগুলো হচ্ছে :
আপনি কে সে সম্পর্কে আমি জানতে পেরেছি
। তিথি আপু (আমার সেই মেয়ে ফ্রেন্ড ,যে
টুসিদের বাসার নিচের ফ্ল্যাট এ থাকে) আমাকে সব
বলেছে ।
কাউকে ভালো লাগলে সেটা বলতে হয় ।
কাপুরুষের মত ফোন দিয়ে কাউকে বিরক্ত করে
ভালবাসা আদায় করা যায় না । আর কাউকে ভালবাসতে
হলে তাকে বুঝতে হয় , ভালো লাগতে হয় , যাচাই
করতে হয় । তারপর তো ভালবাসা । হুট করে
ভালবাসার কথা বললেই ভালবাসা যায় না । ‘
এই কথাগুলো বলে ও লাইন কেটে দেয় ।
এভাবেই আমাদের রঙিন স্বপ্ন বোনা শুরু হয়ে
ছিল । ওই দিনের ফোন কলের পর থেকে আমি
সব সময় টুসির পাশে থাকার চেষ্টা করেছি । মাঝে
মাঝেই ওর স্কুল এ যাওয়ার সময় সাইকেল দিয়ে
রিকসার সাথে সাথে ওর স্কুল পর্যন্ত গিয়েছি ।
বিকালেও প্রায়ই ওর প্রাইভেট এ যাওয়ার সময় সাথে
সাথে গিয়েছি । ও শুধু পিছনে ফিরে মুচকি হাসত ।
এই মুচকি হাসিটাই আমার কাছে চাদের আলো মনে
হতো ।
এভাবে চলার দুই মাস পর টুসিকে সরাসরি প্রপোজ
করলাম । ও কিছু না বলে শুধু একটু হেসেছিল । ২
দিন পর ও যখন আমার প্রস্তাবে হ্যাঁ’ বলল তখন আমি
যে কি খুশি হয়েছিলাম সেটা বলে বোঝানো
যাবে না ।
আমাদের দিনগুলো স্বপ্নের মত এগিয়ে যেতে
লাগলো । টুসির ভালবাসায় নিজেকে পৃথিবীর
সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হতো ।
আমার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝেই টুসি
জিজ্ঞেস করতো , আমাকে ছেড়ে কখনো
যাবে নাতো ?’
আমি ওর হাতটা আরও শক্ত করে ধরে বলতাম ,
আমার এই লক্ষ্মী পাগলীটাকে ছেড়ে আমি
কখনোই যাবোনা ।‘
এইভাবে স্বপ্নের ঘোরে অনেকগুল দিন
কেটে গেলো । টুসি এস .এস .সি তে জি .পি . এ
- ৫ পেয়ে ভিকারুন্নিসা কলেজ এ ভর্তি হল । ও ঢাকা
চলে যাওয়ার আগের দিন আমাকে জড়িয়ে ধরে
অনেক কেদেছিল । ও ঢাকায় ওর খালার বাসায়
থাকতো । কলেজ বন্ধ হলে ও যখন ময়মনসিংহ
আসতো তখনি শুধু আমাদের দেখা হতো । আর
ফোন এবং ফেসবুক এ তো সব সময়
যোগাযোগ থাকতোই ।
আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়লাম এইচ .এস . সি পরীক্ষা
নিয়ে । কেটে যেতে লাগলো দিনগুলো
..........
এইচ.এস.সি পরীক্ষা হয়ে গেল । জি .পি . এ – ৫
পেয়ে ভালোভাবেই উত্তীর্ণ হলাম । তারপর শুরু
হয়ে গেল ভর্তি যুদ্ধ । চান্স পেলাম শাহজালাল
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে । নতুন
বিশ্ববিদ্যালয়ের সোনালি দিন আর টুসির ভালবাসা নিয়ে
মুহূর্তগুলো ভালই কাটছিল । কিন্তু আমাদের সুখটা
আর বেশি দিন স্থায়ী হল না । আমাদের
সম্পর্কের ব্যাপারে টুসির ফ্যামিলিতে জানাজানি হয়ে
গেল । ফ্যামিলির চাপে এক সময় টুসি আমার সাথে
যোগাযোগ করা বন্ধ করে দিল । ভেবেছিলাম
সব ঠিক হয়ে যাবে । কিন্তু , কিছুই ঠিক হল না ।
জীবনটা কালো অন্ধকারে ঢেকে গেলো
হঠাৎ করেই । দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছিলো ।
মোবাইলে কল আসলে মনে হতো এই বুঝি টুসি
ফোন করলো । কিন্তু , সেই আশা আশাতেই
থেকে যেতো । শুধু ভাবতাম , ফ্যামিলির চাপে ও
আমাকে এত সহজেই ভুলে গেলো ।
প্রায় দেড় মাস পর যখন সত্যি ঘটনাটা জানতে পারলাম
তখন আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো ।
আসলে , টুসি আরেকটি ছেলের সাথে
সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল । তাই , ফ্যামিলির
চাপের অজুহাত দেখিয়ে ও আমার কাছ থেকে
দূরে সরে যাচ্ছিলো । হিমি নামে টুসির এক
বান্ধবীর কাছ থেকে যেদিন কথা গুলো
শুনেছিলাম সেদিন কিছুতেই নিজের কানকে বিশ্বাস
করাতে পারছিলাম না । মনে হচ্ছিলো এটা একটা
স্বপ্ন , আর স্বপ্নটা বুঝি এখনি ভেঙে যাবে ।
যেই মানুষটাকে এত বেশি বিশ্বাস করতাম , এত
বেশি ভালবাসতাম সেই মানুষটা আমাকে আজ এভাবে
কষ্ট দিলো ।
ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে সেদিনই টুসিকে ফোন
দিয়েছিলাম । ভেবেছিলাম সবই মিথ্যা বলে প্রমাণিত
হবে । কিন্তু , সব কিছু ভুল প্রমাণিত করে টুসি যখন
সত্যি ঘটনাটি স্বীকার করলো তখন আমি
কিছুক্ষনের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম । ইচ্ছা
হচ্ছিলো দৌড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাই ।
‘ কি দোষ ছিল আমার ? কি ভুল করেছিলাম আমি ?
আমিতো শুধু ভালবেসেছিলাম । ‘
‘ হে আল্লাহ , আমার ভালোবাসাটাই কি দোষ ছিল ।
এটাই কি আমার ভুল ছিল । ‘
আসলে , এরকম দুঃখ পাওয়াটাই মনে হয় ভালোবাসা ।
কথাগুলো চিন্তা করতে করতে কখন যে
অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে বুঝতেই পারলাম
না । ঘর ভাঙল কালামের ডাকে ।
-শাফিন ভাই , আপনের চা তো অনেক আগেই
ঠাণ্ডা হইয়া গেছে । আরেক কাপ চা বানায়া দেই ?
-না থাক । আজকে আর লাগবে না । আরেকদিন
এসে খাবো ।
চায়ের কাপটা রেখে টাকা দিয়ে যখন চলে
আসছিলাম , তখন আবার পিছন থেকে কালাম ডাক
দিলো ।
-শাফিন ভাই , একটু শুইনা যান ।
যাওয়ার পর কালাম আমাকে ওর দোকানের পিছনে
একটা গোলাপ গাছ দেখাল । গাছটাতে একটা
গোলাপ ফুটে আছে । তখনি আমার গাছটার কথা
মনে পড়লো । আমিতো একবারে ভুলেই
গিয়েছিলাম । গত বছর , বৃক্ষ মেলা থেকে এই
গোলাপ গাছটা কিনে টুসি এখানে এনে রোপণ
করেছিলো । বলেছিল , আমাদের ভালোবাসার
নিদর্শনস্বরূপ গাছটা এখানে থাকবে । গাছটা ঠিকই
রয়ে গেছে , কিন্তু আমাদের ভালোবাসাটা হারিয়ে
গেছে ।
-শাফিন ভাই , আরেকদিন আসার সময় আফারে সাথে
কইরা নিয়া আইসেন । আফা গাছে ফুল দেখলে
অনেক খুশি হইব ।
সে কি আর কখনো আসবে এই দোকানে চা
খেতে ? হয়তো আসবে অন্য কারো হাত ধরে
......... কথাগুলো চিন্তা করতে করতে হেঁটে
যাচ্ছি পার্কের সেই চিরচেনা পথটি
ধরে...............
...The End...