দুই পর্বের লেখার শেষ পর্ব। প্রথম পর্ব।
স্বর্ণালি দিনের ফোক-ফ্যান্টাসি ছবির প্রতি আগ্রহ ছিল না সে সময়ের বাংলা সিনেমার দর্শকদের মাঝে এমন কাউকে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। বড় বড় রাজপ্রাসাদ, নায়ক-নায়িকাদের বাহারী পোশাক, হাতি-ঘোড়া দৈত্য-দানব থেকে তলোয়ার ঝনঝনানির সঙ্গে নাচে-গানে যেন পুরো ছবি জুড়েই থাকত শুধুই বিনোদনে ঠাসা। এক কথায় বলে নাচে-গানে-অ্যাকশনে ভরা পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র।
এসব ছবির কথা আসলেই যাদের নামগুলো সবার আগে চলে আসবে তাদের অন্যতম পরিচালক ইবনে মিজান। আকাশে উড়ে যাওয়া কোন দৈত্য, পানির নিচে মানুষের বসবাস, পরিদের দেশ, দৈত্যদের মহল উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া, শূন্যে চাদর বিছিয়ে নায়ক-ভিলেনের তলোয়ারের ঝনঝনানিসহ আরও অনেক বিস্ময়কর দৃশ্যর সঙ্গে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। হলের বিশাল পর্দায় ওই সব দৃশ্য দেখে দর্শকেরা মিটিয়ে নিয়েছিলেন তাদের বিনোদনের জ্বালা। এত দিন যা ছিল কল্পনার রাজ্যে তা-ই নেমে আসলো আলো ঝিলমিল রুপালি পর্দায়। যেন চোখের পলক পড়াই দায় হয়ে যায়!
হয়তো এসব কথা এখনকার জেনারেশনের কাছে হাসির খোরাক হবে, তবে আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগের দর্শকেরা এসব দৃশ্যগুলো দেখার কথা চিন্তাও করতো না। যা ছিল তাদের কল্পনার রাজ্যে, এই ইবনে মিজানদের মতো আরও কিছু মেধাবীরাই তাদের দেখিয়েছিল এমন ফ্যান্টাসি সব দৃশ্য। আরও ছিলেন এফ কবির চৌধুরী, ফকরুল হাসান বৈরাগী, শামসুদ্দিন টগর, তোজাম্মল হোসেন বকুল, দেলোয়ার জাহান ঝন্টুসহ অনেকে, বাংলা সিনেমার ইতিহাসে যাদের ফোক-ফ্যান্টাসি চলচ্চিত্রগুলোর কথা লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে।
মূলত এ ধারার শুরু হয়েছিল ‘ফোক’ ছবিকে কেন্দ্র করে, পরবর্তীতে যা যোগ হয়েছিল ফ্যান্টাসিতে। ঢাকায় প্রথম ফোক ধারার ছবিটি আসে ইবনে মিজানের হাত ধরে ’একালের রূপকথা’ (২৬/০২/১৯৬৫) নামে। পরের ছবিটিই ছিল ইতিহাস, সালাউদ্দিন পরিচালিত ‘রূপবান’ (০৫/১১/১৯৬৫)। যার অভাবনীয় সাফল্যেই শুরু হয়ে যায় এ ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ। শুধু তাই নয়, ওই সময়টায় যখন উর্দু ও কলকাতার ছবির দাপট ছিল তখন এই ‘রূপবান’-এর তুমুল সাফল্যই বাংলা চলচ্চিত্রের মোড়টাই ঘুরে দিয়েছিল। শুরু হয় একের পর এক চলচ্চিত্র নির্মাণ, যা পরবর্তীতে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিকে মজবুত জায়গায় নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল।
যাই হোক, এই ফোক ফ্যান্টাসি ছবিতে শুধু যে পরিচালকের অবদান থাকবে তা নয়, কলাকুশলীদের নামও লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। কেননা একটি সাধারণ ছবির থেকে প্রায় দশ গুন বেশি পরিশ্রম আর ভয়ংকর সব দৃশ্যে সাহসের সঙ্গে অভিনয় করতে হতো তাদের। অনেক সময় শুটিংয়ে অনেকেই আহত হতেন, তবুও দর্শকদের সুস্থ বিনোদন ও চলচ্চিত্রকে ভালোবেসে একের পর এক ছবিতে অভিনয় এবং শ্রম দিয়ে গেছেন। এ ঘরানার ছবির অন্যতম পাত্র-পাত্রী ছিলেন ওয়াসিম, জাভেদ, সোহেল রানা, জসিম, শাবানা, অঞ্জু ঘোষ, রোজিনা, দিলারা, নূতন ও জিনাত। ভিলেনদের মধ্যে ছিলেন রাজ, আদিল, জসিম, বাবরের মতো অভিনেতা। কিন্তু একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে ভেতরের দিকে আরও যাদের কঠোর পরিশ্রমের অবদান থাকতো তাদের মধ্যে অন্যতম একজন এমএ সবুর সাহেব, যিনি ছিলেন মূলত একজন সেট ডিজাইনার। এ রকম ছবির বাহারি সব সেট ডিজাইন এসেছিল তার মতো মেধাবীর হাত ধরেই। অবশ্য এই ধারায় অনেকেই ছিলেন তবে এই মুহূর্তে তাদের সবার নাম মনে আসছে না, এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। এসব ছবিতে দক্ষ ক্যামেরা চালাতেন হারুন অর রশীদ, আবুল খায়ের সাহেবসহ আরও কয়েকজন।
ফোক ফ্যান্টাসিতে খুব লক্ষণীয় ছিল সংগীত। যা নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই বেরিয়ে আসবে সফল এক অধ্যায়। যে অধ্যায়ের সাক্ষী হয়ে থাকবেন সুবল দাস, আলম খান, আজাদ রহমান, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ও আবু তাহেরদের মতো গুণী সুর সম্রাটদের নাম।
তবে সবার আগে আসবে সুবল দাসের নাম। বলতে গেলে এ ধরনের বেশির ভাগ ছবিরই সফল সুরকার ছিলেন তিনি। ‘নরম গরম’ ছবির ‘এই বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেওনা’, ‘ওরে ও বাঁশিওয়ালা আমার এই মনের জ্বালা সইতে আর পারি না’, ‘জলসা ঘরে মাতাল হাওয়ার তুফান জেগেছে’, ‘রাজ নন্দিনী’ ছবির ‘আরে লাল গোলাপী অঙ্গ আমার গোরা গোরা গাল’, ‘রাজকন্যা’ ছবির ‘চন্দ্র তারার নিচে খুঁজেছি তোমায়’, ‘মর্জিনা’ ছবির ‘একটি রাতের গল্প তুমি’, ‘সওদাগর’ ছবির ‘মনেরও ছোট্ট ঘরে আগুন লেগেছে হায়রে’, ‘পদ্মাবতী’ ছবির ‘নয়ন জুড়ে আছে স্বপন’, ‘শিশ মহল’ ছবির ‘মনের বনে রঙ্গ লেগেছে’সহ আরও অসংখ্য জনপ্রিয় গান এসেছে তার সুর থেকে। আলম খানের সুরে ‘নাগ পূর্ণিমা’ ছবির ‘তুমি যেখানে আমি সেখানে’, ‘ও প্রেম দাও না’, ‘যাদু নগর’ ছবিতে ‘খোলা খোলা আকাশে’, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ‘চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা’ ছবিতে ‘মনটা যদি খোলা যেতো সিন্দুকেরই মতো’, ‘আমি তোমারই প্রেম ভিখারি’, আবু তাহের সাহেবের ‘বাঁশিওয়ালা’ ছবিতে ‘পান খাইতে চুন লাগে’, ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবির ‘বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়েছে’র মতো সুপার হিট সব গানগুলো এসেছে তাদের কাছ থেকে।
একটি চলচ্চিত্র দেখে যেমন দর্শকেরা বিনোদিত হন ঠিক তেমনি সেসব চলচ্চিত্রের মনকাড়া পোস্টার আর হল ব্যানার দেখেই কিন্তু দর্শকেরা আগ্রহী হন। এই সব দর্শকপ্রিয় পোস্টার আর ব্যানারের কাজ করতেন ঝন্টু আর্টের ঝন্টু, রূপায়ণ, রফিক, গিরিন দাস (বিকেডি)-র বিদেশ কুমার ধর বাবুরা। কী সব নান্দনিক আর মনকাড়া পোস্টার আর ব্যানার যে তৈরি করতেন তারা, যেন পোস্টারের দিকে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়।
উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পোস্টার: গিরিন দাসের বিজয়িনী সোনাভান (১৯৭৯), রাজ নর্তকী (১৯৮১), বেদের মেয়ে জোসনা (১৯৮৯), দস্যু বনহুর (১৯৭৮); বিদেশ কুমার ধরের আলাদীন (১৯৬৭), বাগদাদের চোর (১৯৮০), আলাদীন আলীবাবা সিন্দাবাদ (১৯৮১), আসমান জমিন (১৯৯০), মহুয়া সুন্দরী (১৯৮৭)।
৩৫ মিমি-এ নির্মিত ১৭/১৮ রিলের একেকটি চলচ্চিত্রকে ২৭”x৪১” ইঞ্চির একেকটি পোস্টারে যেন পুরো সিনেমাটাকেই নান্দনিকতার সঙ্গে তুলে ধরতেন এই সব গুণী মানুষেরা। যা দেখে সাধারণ দর্শকেরা ছুটে যেতো হল ঘরে।
এই সব গুণী মানুষদের অক্লান্ত পরিশ্রমেই সে-সময়ের দর্শকেরা পেতো একেকটি মন-মাতানো চোখ-ধাঁধানো স্বর্ণালি চলচ্চিত্র।
এ ধারার কিছু চলচ্চিত্র হলো: রহিম বাদশা ও রূপবান (১৯৬৬), হীরামন (১৯৬৭), সাইফুল মূলক বদিউজ্জামান (১৯৬৭), মধুমালা (১৯৬৮), রাখাল বন্ধু (১৯৬৮), বাহরাম বাদশা (১৯৭২), ডাকু মনসুর (১৯৭৪), দুই রাজকুমার (১৯৭৫), টারজান অব বেঙ্গল (১৯৭৬), বাহাদুর (১৯৭৬), মতি মহল (১৯৭৭), নিশান (১৯৭৭), রাজ দুলারী (১৯৭৮), নাগ নাগিনী (১৯৭৯), রাজ নন্দিনী (১৯৮০), বাগদাদের চোর (১৯৮০), আলিবাবা আলাদিন সিন্দাবাদ (১৯৮১), বে-রহম (১৯৮৫), মহুয়া সুন্দরী (১৯৮৭), আসমান জমিন (১৯৯০), বাহাদুর (১৯৭৬), বে-দ্বীন (১৯৮০), আলিবাবা (১৯৮০), সুলতানা ডাকু (১৯৮১), আবে হায়াত (১৯৮৩), শাহী চোর (১৯৮৩), সওদাগর (১৯৮২), বিষকন্যার প্রেম (১৯৮৬), রাজরানী (১৯৭৬), লুটেরা (১৯৮০), তাজ ও তলোয়ার (১৯৮০), জংলী রানী (১৯৮০), আকাশপরী (১৯৮১), আলতা বানু (১৯৮২), ওমর শরীফ (১৯৮০), মধু মালতী (১৯৮২), রসের বাইদানী (১৯৮৪), হাসান তারেক (১৯৮৪), চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা (১৯৮৪), রাজিয়া সুলতানা (১৯৮৪), সালতানাৎ (১৯৮৪), রসিয়া বন্ধু (১৯৮৫), সতী নাগকন্যা (১৯৮৫), চাঁদ সওদাগর (১৯৮৬), বাহাদুর মেয়ে (১৯৮৬), জারকা (১৯৮৬), নওজোয়ান (১৯৮৬), বসন্ত মালতী (১৯৮৬), সতী কমলা (১৯৮৬), নাগ পূর্ণিমা (১৯৮৩), বানজারান (১৯৮৩), নাগরাণী (১৯৮৩), বেদের মেয়ে জোছনা (১৯৮৯), রাজ দুলারী (১৯৭৮) ও শিশ মহল (১৯৯১)।