| পেনশান প্রার্থী |
স্যার, ভদ্রমহিলা আবারো এসেছেন । ভেতরে আসতে বলবো ?
ডি আই সাহেব একটু বিরক্তির সুরে বললেন, বল ।
ভেতরে ঢুকলেন এক বৃদ্ধা । দক্ষিণ কলকাতায় এক স্কুল থেকে দশ বছর আগে রিটায়ার করেছেন । এখনো পেনশান পাননি । তদ্বির করতে এসেছেন বৃদ্ধা ।
ভেতরে ঢুকতেই ডি আই অব স্কুল তাঁর ফাইলে কৃত্রিম মনোযোগ নিক্ষেপ করে বললেন , যা বলবার তাড়াতাড়ি বলুন । মহিলা তাঁর আঁচলে মুখের ঘাম মুছলেন । চশমার কাঁচ মুছলেন । তারপর ক্ষীণকন্ঠে একটা চেয়ারের কোনা ধরে দাঁড়িয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন , স্যার ! আমার ফাইলটা মুভ করেছে ?
টেবিলের অপর প্রান্তে ফাইলে মুখ গুঁজে ডি আই এর উত্তর ভেসে এলো , কী করে করবে ? এ জি বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছে । যথাযথ রিপ্লাই না পেলে আপনার ফাইল পাঠিয়ে কোন লাভ হবে না ।
প্রৌঢ়া বললো , কী প্রশ্ন জানতে চান ?
ডি আই বিরক্তির সুরে বললেন , আপনার সার্ভিস বুক থরোলি চেক করে আপনাকে আমি আগেও যে প্রশ্ন করেছিলাম এ জি ঠিক সেই প্রশ্নই করেছে ... তবুও আপনি আমায় রিকোয়েস্ট করেছিলেন এ জি-তে ফাইলটা পাঠাতে । আই হ্যাভ ডান মাই ডিউটি । নাও আই হ্যাভ নাথিং টু ডু । আপনার সার্ভিস বুকে আপনার কোয়ালিফিকেশানের কোন উল্লেখ নেই । আপনি যে বি এ পাশ করেছেন তার প্রমাণ কোথায় ? আপনাকে স্কুল কমিটি সিলেক্ট করেছিল কমপ্যাশানাট গ্রাউন্ডে । সার্ভিস বুকে শুধু লেখা রয়েছে , সী হ্যাস বীন সিলেক্টেড অন রেকমেনডেশান অব এ সিনিয়র ক্যাবিনেট মিনিস্টার এন্ড দ্যা স্কুল কমিটি হ্যাজ বীন কমপেলড টু রিক্রুট হার অন কমপ্যাশানেট গ্রাউন্ড দ্যাট সি ওয়াজ এ ফ্রীডাম ফাইটার এন্ড হ্যাড বীন ইন জেল ফর এ সেভারেল লঙ ইয়ার্স ।
বৃদ্ধার মুখে এবারে ফুটে উঠলো অপমানের ছাপ ।
সত্যিই তো , তিনি যে বি এ পাশ করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে প্রমাণ কোথায় ? তিনি বি এ পাশ করার পর একটা চোথা কাগজ পেয়েছিলেন বটে যেটাকে মার্কশিট বলে । কিন্তু সেটাই বা কোথায় ? ১৯৩১ সালে বি এ পাশ করলেন ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে । পরের বছরে হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব । সেই সমাবর্তনে তাঁর সার্টিফিকেট পাওয়ার কথা ছিল । কিন্তু তা আর হল কৈ ? সেদিনই যে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করলো । তারপর দীর্ঘ কারাবাস । কারাবাস থেকে বাড়ি ফিরে এসে দেখলেন পুলিশ ঘরে ঢুকে তাঁর বইপত্র সবকিছু তছনছ করে চলে গেছে । অনেক খুঁজেও পাওয়া গেলো না তাঁর সেই মার্কশিট । আর সেনেট হলের সেই ঘটনার পরেই তো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর সার্টিফিকেট বাতিল করে দিল । তাঁর তখন মনে হয়নি ঐ সার্টিফিকেটের মূল্য কতখানি । জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার কিছুদিন পর আবারো জেলে গেলেন ভারত-ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে । দেশ স্বাধীন হল । তাঁর মনে হল , এই স্বাধীনতাই কি তাঁরা চেয়েছিল ? পেটের দায়ে নেতাদের দয়ায় দক্ষিণ কলকাতার এক স্কুল থেকে অন্য স্কুলে চাকরি করলেন ক'বছর । তখন কি করে বুঝবেন যে এ দেশে কমপ্যাসানেট গ্রাউন্ডে চাকরি পাওয়া যেতে পারে কিন্তু ইউনিভার্সিটির বাজেয়াপ্ত সার্টিফিকেট পাওয়া যায় না ! এই সার্টিফিকেটের জন্যে তিনি বহুবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে রেজাল্ট সেকশানে তদ্বির করেছেন । শেষে একজন এসিস্ট্যান্ট কন্ট্রোলার অনেক ফাইল ঘেঁটে-ঘুটে তাঁকে শেষে বলেছিলেন , আপনার সম্পর্কে সে সময় সিনেটে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তা বর্তমান সিনেট কনডোন করে আপনাকে সার্টিফিকেট দেওয়ার সুপারিশ না করা পর্যন্ত আপনাকে কোন সার্টিফিকেট দেওয়া যাবে না । অনেক চেষ্টা করে বৃদ্ধা একবার ভাইস চ্যান্সেলারের সাথে গিয়েও দেখা করেছিলেন । ভি সি যদিও খুব ভদ্র ব্যবহার করেছিলেন কিন্তু তিনিও তাঁকে সেই একই কথা বলেছিলেন । বিশ্ববিদ্যালয়ের রুলস অনুযায়ী সিনেটের পারমিশান ছাড়া কাউকে সারটিফিকেট দেওয়ার কোন প্রভিশান নেই । একজন সিনেট সদস্য একবার ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাঁকে ইউনিভার্সিটির তরফে সার্টিফিকেট দেওয়ার ব্যাপারে একটা প্রস্তাব তুলেছিলেন । কিন্তু সিনেট তো আসলে দলীয় রাজনীতির আখড়া । যিনি প্রস্তাব তুলেছিলেন তিনি তো দলীয় রাজনীতির বিচারে মাইনরিটি । তা তাঁর প্রস্তাব বাকিরা মানবে কেন ? ফলে প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান হল । আফটার অল , বৃদ্ধা একজন কংগ্রেসি মন্ত্রীর রেকমনডেশনে স্কুলের চাকরিটা পেয়েছিলেন । কংগ্রেসিরা রাজ্য শাষণ থেকে বিদায় নিয়েছে । বৃদ্ধা আজও মনে-প্রাণে কংগ্রেসি । ক্ষমতায় এখন বামপন্থীরা । তাদের সেনেটররা এটা মানবেন কেন ? কংগ্রেসিদের যত কিছু ছলাকলা সেসব গঙ্গাজলে ধুয়েমুছে শিক্ষাক্ষেত্রকে স্যানিটাইজ করার জন্যেই তো বামপন্থীরা ক্ষমতায় এসেছেন ।
দোরে দোরে ঘুরেও সমস্যার কোন সুরাহা হল না । উপরন্তু যারা তাঁকে কর্মসূত্রে চেনে বা জানে তারা আড়ালে-আবডালে বলতে লাগলো , মন্ত্রীর সুপারিশে কোন সার্টিফিকেট ছাড়া এতো বছর চাকরি করেও ক্ষিদে মেটেনি । এখন আবার পেনশনের জন্যে বুড়ি তদ্বির করতে শুরু করেছেন এখানে ওখানে । একদিন কথাটা কানে গেলো বৃদ্ধার । তাঁর স্বামীও ছিলেন একজন প্রাক্তন স্বাধীনতা সংগ্রামী । তিনিও গত হয়েছেন । নিঃসন্তান , সহায়সম্বলহীন বৃদ্ধার দু-চোখে তখন শুধু অন্ধকার । মনে করে দেখলেন , যেদিন তিনি কলকাতা ইউনিভারসিটির সার্টিফিকেটের পরোয়া না করে শহিদ বিনয় বসুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ইউনিভারসিটির চ্যান্সেলর স্টানলি জ্যাকসনের দিকে তাক করে রিভলবার চালিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সেদিন কিন্তু তাঁর দু-চোখে একটুও অন্ধকার ছিল না । ছিল শুধু স্বপ্ন ! সে স্বপ্ন হল একদিন না একদিন দেশ স্বাধীন হবেই হবে । সে সব কোন যুগের কথা । আর কেই বা সেসব কথা মনে রেখেছে ?
হতাশায় নিমজ্জিত , আশাহীন বৃদ্ধা চোখের জল ফেলতে ফেলতে একদিন মনের দুঃখে চলে গেলেন হরিদ্বারে । তারপর হরিদ্বার থেকে একদিন এলেন হৃষীকেশে । কবে গেলেন হরিদ্বার আর কবেই বা এলেন হৃষীকেশে ---- সেসব এখন ডাস্টবিনের জঞ্জাল !
কলকাতা শহরটাকে তাঁর নিশ্চয়ই তখন মনে হয়েছিল এক জেলখানা । যে জেলখানার চেয়ে ইংরেজের জেলেখানায় কষ্ট এবং গর্ব ---- দুইই ছিল ঢের ঢের বেশি । এই গর্বই একদিন সব দুঃখ-কষ্ট ভোলাতে সাহায্য করেছিল তাঁকে । কিন্তু এখন এখানে থাকবেন কার ভরসায় আর কীসের আকর্ষণে ? এখানে তো দুহাত ভরে কুড়িয়েছেন শুধু অপমান আর অপমান ।
হৃষীকেশে কার কাছে গেলেন তিনি ? কে তাঁকে আশ্রয় দিল ? হয়তো দেখা যাবে কোন আশ্রমে সকালে ও সন্ধ্যায় অনাথ ভিখিরিদের সাথে পাত-পেরে তিনিও বসে গেছেন দুটো অন্নের লোভে ! মানুষের পেটের দায় যে বড় বেশি !
কতদিন হৃষীকেশে ছিলেন তার কোন প্রমাণ নেই । কে রাখবে সে খোঁজ ? কত মানুষ সেখানে নিত্য আসে যায় ! তবে হ্যাঁ , একদিন হৃষীকেশের পুলিশের কাছে খবর এলো যে অমৃতবাহিনী গঙ্গার কোলে এক নির্জন স্থানে এক বেওয়ারিশ লাশ দেখা গেছে । স্থানীয় মানুষেরা কেউ তাকে চেনে না । পুলিশ গিয়ে সেই লাশ উদ্ধার করলো । পুলিশ দেখলো লাশটি এক মহিলার । বয়েস আনুমানিক সত্তর । তাঁর কাপড় পরার ধরণ দেখে পুলিশের মনে হল মহিলা সম্ভবত বাঙালি । শরীরে কোন অলংকার নেই । লোক্যাল পেপারে মহিলার মুখের ছবি ছাপা হল । পেপারের খবরটা নজরে এলো ড ত্রিগুণা সেনের । তিনি তখন কনখলে আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম রয়েছেন । ড ত্রিগুণা সেন ফোন করলেন তাঁর এক ছাত্রকে হৃষীকেশে । সেই ছাত্রের কাছে সংবাদের সত্যতা যাচাই করে ছুটে এলেন নিজে । হৃষীকেশে ।
এসে কী দেখলেন ত্রিগুণা সেন ? পুলিশ মর্গে গিয়ে দেখলেন কীভাবে নিশ্চিন্তে ' ঘুমের দেশে ' চলে গেছেন এক বীরাঙ্গনা যিনি একদিন বাংলার ছোটলাটকে সেনেট হলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গুলি চালিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন । যিনি ছিলেন বাঙালির শ্রেষ্ঠ বীর ও দেশপ্রেমিক সুভাষচন্দ্রের জীবনে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে পরিচিত বেণীমাধব দাসের কন্যা । যিনি কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া স্বাধীনতা সংগ্রামীর পেনশান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন নীতিগত কারণে । অথচ যিনি বহু চেষ্টা করেও আইনের বজ্রআঁটুনির জন্যে নিজের প্রাপ্য পেনশান আদায় করতে পারেননি সরকারের থেকে । বঞ্চিত হয়েছিলেন ন্যায্য অধিকার থেকে । বলা বাহুল্য যে , ত্রিগুণা সেন বীণাকে চিনতেন ।যাদবপুরে যখন তিনি ভি সি তখন অনেক অনুষ্ঠানেই বীণার সাথে তাঁর দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে ।
বীরাঙ্গনা বীণা দাস ! তোমায় আমরা তোমার ন্যায্য অধিকার থেকে সেদিন বঞ্চিত করে যে অন্যায় করেছিলাম তার জন্যে তুমি আমাদের মতো এই অধম , অধঃপতিত ও নির্বোধ জাতিকে ক্ষমা করো।
কলমে অধ্যাপক শুভেন্দু মজুমদার
স্যার, ভদ্রমহিলা আবারো এসেছেন । ভেতরে আসতে বলবো ?
ডি আই সাহেব একটু বিরক্তির সুরে বললেন, বল ।
ভেতরে ঢুকলেন এক বৃদ্ধা । দক্ষিণ কলকাতায় এক স্কুল থেকে দশ বছর আগে রিটায়ার করেছেন । এখনো পেনশান পাননি । তদ্বির করতে এসেছেন বৃদ্ধা ।
ভেতরে ঢুকতেই ডি আই অব স্কুল তাঁর ফাইলে কৃত্রিম মনোযোগ নিক্ষেপ করে বললেন , যা বলবার তাড়াতাড়ি বলুন । মহিলা তাঁর আঁচলে মুখের ঘাম মুছলেন । চশমার কাঁচ মুছলেন । তারপর ক্ষীণকন্ঠে একটা চেয়ারের কোনা ধরে দাঁড়িয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন , স্যার ! আমার ফাইলটা মুভ করেছে ?
টেবিলের অপর প্রান্তে ফাইলে মুখ গুঁজে ডি আই এর উত্তর ভেসে এলো , কী করে করবে ? এ জি বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছে । যথাযথ রিপ্লাই না পেলে আপনার ফাইল পাঠিয়ে কোন লাভ হবে না ।
প্রৌঢ়া বললো , কী প্রশ্ন জানতে চান ?
ডি আই বিরক্তির সুরে বললেন , আপনার সার্ভিস বুক থরোলি চেক করে আপনাকে আমি আগেও যে প্রশ্ন করেছিলাম এ জি ঠিক সেই প্রশ্নই করেছে ... তবুও আপনি আমায় রিকোয়েস্ট করেছিলেন এ জি-তে ফাইলটা পাঠাতে । আই হ্যাভ ডান মাই ডিউটি । নাও আই হ্যাভ নাথিং টু ডু । আপনার সার্ভিস বুকে আপনার কোয়ালিফিকেশানের কোন উল্লেখ নেই । আপনি যে বি এ পাশ করেছেন তার প্রমাণ কোথায় ? আপনাকে স্কুল কমিটি সিলেক্ট করেছিল কমপ্যাশানাট গ্রাউন্ডে । সার্ভিস বুকে শুধু লেখা রয়েছে , সী হ্যাস বীন সিলেক্টেড অন রেকমেনডেশান অব এ সিনিয়র ক্যাবিনেট মিনিস্টার এন্ড দ্যা স্কুল কমিটি হ্যাজ বীন কমপেলড টু রিক্রুট হার অন কমপ্যাশানেট গ্রাউন্ড দ্যাট সি ওয়াজ এ ফ্রীডাম ফাইটার এন্ড হ্যাড বীন ইন জেল ফর এ সেভারেল লঙ ইয়ার্স ।
বৃদ্ধার মুখে এবারে ফুটে উঠলো অপমানের ছাপ ।
সত্যিই তো , তিনি যে বি এ পাশ করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে প্রমাণ কোথায় ? তিনি বি এ পাশ করার পর একটা চোথা কাগজ পেয়েছিলেন বটে যেটাকে মার্কশিট বলে । কিন্তু সেটাই বা কোথায় ? ১৯৩১ সালে বি এ পাশ করলেন ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে । পরের বছরে হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব । সেই সমাবর্তনে তাঁর সার্টিফিকেট পাওয়ার কথা ছিল । কিন্তু তা আর হল কৈ ? সেদিনই যে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করলো । তারপর দীর্ঘ কারাবাস । কারাবাস থেকে বাড়ি ফিরে এসে দেখলেন পুলিশ ঘরে ঢুকে তাঁর বইপত্র সবকিছু তছনছ করে চলে গেছে । অনেক খুঁজেও পাওয়া গেলো না তাঁর সেই মার্কশিট । আর সেনেট হলের সেই ঘটনার পরেই তো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর সার্টিফিকেট বাতিল করে দিল । তাঁর তখন মনে হয়নি ঐ সার্টিফিকেটের মূল্য কতখানি । জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার কিছুদিন পর আবারো জেলে গেলেন ভারত-ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে । দেশ স্বাধীন হল । তাঁর মনে হল , এই স্বাধীনতাই কি তাঁরা চেয়েছিল ? পেটের দায়ে নেতাদের দয়ায় দক্ষিণ কলকাতার এক স্কুল থেকে অন্য স্কুলে চাকরি করলেন ক'বছর । তখন কি করে বুঝবেন যে এ দেশে কমপ্যাসানেট গ্রাউন্ডে চাকরি পাওয়া যেতে পারে কিন্তু ইউনিভার্সিটির বাজেয়াপ্ত সার্টিফিকেট পাওয়া যায় না ! এই সার্টিফিকেটের জন্যে তিনি বহুবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে রেজাল্ট সেকশানে তদ্বির করেছেন । শেষে একজন এসিস্ট্যান্ট কন্ট্রোলার অনেক ফাইল ঘেঁটে-ঘুটে তাঁকে শেষে বলেছিলেন , আপনার সম্পর্কে সে সময় সিনেটে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তা বর্তমান সিনেট কনডোন করে আপনাকে সার্টিফিকেট দেওয়ার সুপারিশ না করা পর্যন্ত আপনাকে কোন সার্টিফিকেট দেওয়া যাবে না । অনেক চেষ্টা করে বৃদ্ধা একবার ভাইস চ্যান্সেলারের সাথে গিয়েও দেখা করেছিলেন । ভি সি যদিও খুব ভদ্র ব্যবহার করেছিলেন কিন্তু তিনিও তাঁকে সেই একই কথা বলেছিলেন । বিশ্ববিদ্যালয়ের রুলস অনুযায়ী সিনেটের পারমিশান ছাড়া কাউকে সারটিফিকেট দেওয়ার কোন প্রভিশান নেই । একজন সিনেট সদস্য একবার ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাঁকে ইউনিভার্সিটির তরফে সার্টিফিকেট দেওয়ার ব্যাপারে একটা প্রস্তাব তুলেছিলেন । কিন্তু সিনেট তো আসলে দলীয় রাজনীতির আখড়া । যিনি প্রস্তাব তুলেছিলেন তিনি তো দলীয় রাজনীতির বিচারে মাইনরিটি । তা তাঁর প্রস্তাব বাকিরা মানবে কেন ? ফলে প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান হল । আফটার অল , বৃদ্ধা একজন কংগ্রেসি মন্ত্রীর রেকমনডেশনে স্কুলের চাকরিটা পেয়েছিলেন । কংগ্রেসিরা রাজ্য শাষণ থেকে বিদায় নিয়েছে । বৃদ্ধা আজও মনে-প্রাণে কংগ্রেসি । ক্ষমতায় এখন বামপন্থীরা । তাদের সেনেটররা এটা মানবেন কেন ? কংগ্রেসিদের যত কিছু ছলাকলা সেসব গঙ্গাজলে ধুয়েমুছে শিক্ষাক্ষেত্রকে স্যানিটাইজ করার জন্যেই তো বামপন্থীরা ক্ষমতায় এসেছেন ।
দোরে দোরে ঘুরেও সমস্যার কোন সুরাহা হল না । উপরন্তু যারা তাঁকে কর্মসূত্রে চেনে বা জানে তারা আড়ালে-আবডালে বলতে লাগলো , মন্ত্রীর সুপারিশে কোন সার্টিফিকেট ছাড়া এতো বছর চাকরি করেও ক্ষিদে মেটেনি । এখন আবার পেনশনের জন্যে বুড়ি তদ্বির করতে শুরু করেছেন এখানে ওখানে । একদিন কথাটা কানে গেলো বৃদ্ধার । তাঁর স্বামীও ছিলেন একজন প্রাক্তন স্বাধীনতা সংগ্রামী । তিনিও গত হয়েছেন । নিঃসন্তান , সহায়সম্বলহীন বৃদ্ধার দু-চোখে তখন শুধু অন্ধকার । মনে করে দেখলেন , যেদিন তিনি কলকাতা ইউনিভারসিটির সার্টিফিকেটের পরোয়া না করে শহিদ বিনয় বসুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ইউনিভারসিটির চ্যান্সেলর স্টানলি জ্যাকসনের দিকে তাক করে রিভলবার চালিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সেদিন কিন্তু তাঁর দু-চোখে একটুও অন্ধকার ছিল না । ছিল শুধু স্বপ্ন ! সে স্বপ্ন হল একদিন না একদিন দেশ স্বাধীন হবেই হবে । সে সব কোন যুগের কথা । আর কেই বা সেসব কথা মনে রেখেছে ?
হতাশায় নিমজ্জিত , আশাহীন বৃদ্ধা চোখের জল ফেলতে ফেলতে একদিন মনের দুঃখে চলে গেলেন হরিদ্বারে । তারপর হরিদ্বার থেকে একদিন এলেন হৃষীকেশে । কবে গেলেন হরিদ্বার আর কবেই বা এলেন হৃষীকেশে ---- সেসব এখন ডাস্টবিনের জঞ্জাল !
কলকাতা শহরটাকে তাঁর নিশ্চয়ই তখন মনে হয়েছিল এক জেলখানা । যে জেলখানার চেয়ে ইংরেজের জেলেখানায় কষ্ট এবং গর্ব ---- দুইই ছিল ঢের ঢের বেশি । এই গর্বই একদিন সব দুঃখ-কষ্ট ভোলাতে সাহায্য করেছিল তাঁকে । কিন্তু এখন এখানে থাকবেন কার ভরসায় আর কীসের আকর্ষণে ? এখানে তো দুহাত ভরে কুড়িয়েছেন শুধু অপমান আর অপমান ।
হৃষীকেশে কার কাছে গেলেন তিনি ? কে তাঁকে আশ্রয় দিল ? হয়তো দেখা যাবে কোন আশ্রমে সকালে ও সন্ধ্যায় অনাথ ভিখিরিদের সাথে পাত-পেরে তিনিও বসে গেছেন দুটো অন্নের লোভে ! মানুষের পেটের দায় যে বড় বেশি !
কতদিন হৃষীকেশে ছিলেন তার কোন প্রমাণ নেই । কে রাখবে সে খোঁজ ? কত মানুষ সেখানে নিত্য আসে যায় ! তবে হ্যাঁ , একদিন হৃষীকেশের পুলিশের কাছে খবর এলো যে অমৃতবাহিনী গঙ্গার কোলে এক নির্জন স্থানে এক বেওয়ারিশ লাশ দেখা গেছে । স্থানীয় মানুষেরা কেউ তাকে চেনে না । পুলিশ গিয়ে সেই লাশ উদ্ধার করলো । পুলিশ দেখলো লাশটি এক মহিলার । বয়েস আনুমানিক সত্তর । তাঁর কাপড় পরার ধরণ দেখে পুলিশের মনে হল মহিলা সম্ভবত বাঙালি । শরীরে কোন অলংকার নেই । লোক্যাল পেপারে মহিলার মুখের ছবি ছাপা হল । পেপারের খবরটা নজরে এলো ড ত্রিগুণা সেনের । তিনি তখন কনখলে আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম রয়েছেন । ড ত্রিগুণা সেন ফোন করলেন তাঁর এক ছাত্রকে হৃষীকেশে । সেই ছাত্রের কাছে সংবাদের সত্যতা যাচাই করে ছুটে এলেন নিজে । হৃষীকেশে ।
এসে কী দেখলেন ত্রিগুণা সেন ? পুলিশ মর্গে গিয়ে দেখলেন কীভাবে নিশ্চিন্তে ' ঘুমের দেশে ' চলে গেছেন এক বীরাঙ্গনা যিনি একদিন বাংলার ছোটলাটকে সেনেট হলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গুলি চালিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন । যিনি ছিলেন বাঙালির শ্রেষ্ঠ বীর ও দেশপ্রেমিক সুভাষচন্দ্রের জীবনে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে পরিচিত বেণীমাধব দাসের কন্যা । যিনি কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া স্বাধীনতা সংগ্রামীর পেনশান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন নীতিগত কারণে । অথচ যিনি বহু চেষ্টা করেও আইনের বজ্রআঁটুনির জন্যে নিজের প্রাপ্য পেনশান আদায় করতে পারেননি সরকারের থেকে । বঞ্চিত হয়েছিলেন ন্যায্য অধিকার থেকে । বলা বাহুল্য যে , ত্রিগুণা সেন বীণাকে চিনতেন ।যাদবপুরে যখন তিনি ভি সি তখন অনেক অনুষ্ঠানেই বীণার সাথে তাঁর দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে ।
বীরাঙ্গনা বীণা দাস ! তোমায় আমরা তোমার ন্যায্য অধিকার থেকে সেদিন বঞ্চিত করে যে অন্যায় করেছিলাম তার জন্যে তুমি আমাদের মতো এই অধম , অধঃপতিত ও নির্বোধ জাতিকে ক্ষমা করো।
কলমে অধ্যাপক শুভেন্দু মজুমদার