আজ শক্তি চাটুজ্জের জন্মদিন। আমার এই লেখাটা আপনাদের সংগে আর একবার ভাগ করে নিই।সতেরো সালে লেখা৷ মেঘমালা আর সৌগতকে দেখি নি আর।
পড়ুন --
সরস্বতী পুজোর দিন বইমেলায় গেছি। আমার প্রকাশিত বই "তোমার পরশ আসে" নেই আর স্টলে। গিয়েছিলাম শুধু " দেবাংশু সম্মাননা " পুরস্কার অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। আর আমার দুটি বই কোনমতে সংগ্রহ করে মল্লিকা আর ওঙ্কার কে দেবার জন্যে। প্রচুর ভীড় হয়েছিল সেদিন।
দাঁড়িয়ে আছি, এক যুবক আর এক যুবতী এসে প্রণাম করলো। বললো ওদের নাম সৌগত আর মেঘমালা ( কি সুন্দর নাম!)। আরো বললো - জেঠু, আপনার বইটা পেলাম না তবে আমরা দুজন আপনাকে একটা বই উপহার দিতে চাই।ভাবলাম ওদেরই লেখা কোন বই। নেওয়ার পর দেখলাম বইটির নাম - " আমার বন্ধু শক্তি"। লিখেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের দীর্ঘদিনের বন্ধু সমীর সেনগুপ্ত। কিন্তু বইটির কথায় পরে আসি আগে বলি মেঘমালা আর সৌগতর কথা।
এরা দুজনেই আমার ফেসবুক বন্ধু। প্রোফাইল দেখে ঠিক বোঝা যায় না কিন্তু এরা বয়েসে আমার সন্তানতুল্য। ফেসবুকে আসার পর আমি এমন অনেক অনেক তরুন তরুনী দেখলাম যাদের দেখে আমার নিজের যৌবনের কথা মনে পড়ে যায়। সেই সময়ের বন্ধুদের (আমাদের বান্ধবী ছিল না) কথা মনে পড়ে যায়। এদের দুজনকে দেখেও একই অনুভুতি হল। মেঘমালা কে দেখে মনে পড়লো। একদিন হঠাৎ দেখি নোটিফিকেশন " মেঘমালা হ্যাজ অ্যাক্সেপ্টেড ইওর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট "। কি হল? আমি তো সাধারনত কাউকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাই না। জিজ্ঞাসা করাতে মেঘমালা উত্তর দিয়েছিল - সে তো আমিও জানি কিন্তু আপনি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছেন আর আমি অ্যাকসেপ্ট করবো না! তাও কি হয়। সেই থেকে আমরা বন্ধু। মেঘমালা বা সৌগত কেউই খুব বেশী কমেন্ট করে না আমার লেখায় কিন্তু কথা বলে দেখলাম আমার সব লেখা পড়ে ওরা দুজন। অনেক অনেকক্ষন কথা বলেছি ওদের সংগে। খুব খুব ভাল লেগেছে ওদের সংগে কথা বলে।
এবার আসি বইটির কথায়। অপুর্ব লিখেছেন সমীরবাবু। অন্তরঙ্গ শক্তিকে পেলাম ওঁর লেখায়। কত কত অজানা ঘটনা জানলাম বইটি পড়ে।
দুটি ঘটনা বলি আপনাদের।
এক - "একদিন মধ্যরাতে আমি আর শক্তি ফিরছি ট্যাক্সিতে। ট্যাক্সি থেকে নেমে দেখা গেল চারটাকা কম পড়েছে ( আজকের চারটাকা নয়,মধ্যসত্তরের চার টাকা)--- শক্তি ট্যাক্সিচালকের দুগাল ধরে বললো- আর তো নেই রে আজ,এই নিয়ে খুশী হয়ে যা, কেমন? বাঙালী ট্যাক্সিচালক বিনা বাক্যব্যয়ে প্রণাম করে চলে গেল --- হ্যাঁ, প্রণাম করে চলে গেল।
দ্বিতীয় ঘটনাটি আরো চমকপ্রদ। এক বিহারী বন্ধু ছিল শক্তির। হিন্দী ভাষায় কবিতা লিখে তার কিছু কবিখ্যাতি হয়েছিল। কলকাতার কালিঘাট অঞ্চলে তার বাড়িতে প্রায়ই মধ্যরাত্রে শক্তি হানা দিত আর তার স্ত্রীকে বলতো -" লছমি, খিদে পেয়েছে। দুটো রুটি খাওয়া তো। ক্রমে এমন হল লছমি রোজই দুটো রুটি আর তরকারি রেখে দিত। বলা যায় না, শক্তিদা যদি চলে আসেন। প্রায়ই যেত শক্তি। লছমির রুটি তরকারী কাজে লেগে যেত।
সেই বন্ধু তারপর বদলি হয়ে গেল ধানবাদ বা পাটনায়। লছমি থেকে গেল। বাচ্ছাদের ইস্কুল আছে। শক্তির যাওয়া কমে গেল। তবু যেত মাঝে মাঝে। রুটি তরকারি খেয়ে আসতো। লছমির কিন্তু এটা ব্রতপালনের মত হয়ে গেল। রোজই রাত্রে সে রুটি তরকারি করে রেখে দেয়। সকালে তা দিয়ে দেয় ভিখারি কে। এমনও হয়েছে মধ্যরাত্রে বন্ধু ফিরেছে ধানবাদ থেকে। লছমি আবার রুটি তরকারি বানাতে বসে গেছে। বন্ধু বলেছে - আবার বানাচ্ছো কেন? শক্তিদার জন্যে বানানো রুটি তরকারি দিয়ে দাও। এত রাতে শক্তিদা আসবেন না। আসেনও তো না আজকাল।হেসে মাথা নেড়েছে লছমি। বলেছে -" তা হবে না। ও শক্তিদার জন্যে রাখা আছে। ও কাউকে দেওয়া যাবে না। তোমাকেও নয়। নতুন বানিয়ে দিচ্ছি তোমাকে। " দুদিন চারদিন নয়, পুরো বারো বছর ধরে রোজ তার শক্তিদার জন্যে রুটি তরকারি বানিয়ে রেখে দিয়েছে লছমি।সকালে উঠে ভিখারি কে দিয়ে দিয়েছে। কী দেখেছিল অর্ধশিক্ষিত লছমি শক্তিদার মধ্যে!!কী দেখেছিল সেই ট্যাক্সিচালক তার আধঘন্টার সওয়ারির মধ্যে! "
এমন অনেক অন্তরঙ্গ ঘটনা আছে বইটিতে শক্তিকে নিয়ে। তবে শক্তি বলতেই আমার মনে হয় গভীর রাত্রে বা সকালে শক্তি ঢুকছেন আমার পাশের ফ্লাটের অবনীদার বাড়ি। অবনীদা সংগে থাকলেও হাঁক পাড়ছেন তাঁর জলদগম্ভীর গলায় - " অবনী, বাড়ি আছো?
না অবনী দা আর নেই। বাড়িতে তো নেইই ইহলোকেই নেই আর। শক্তিবাবুও নেই কোথাও তবু " অবনী বাড়ি আছো? ভীষণ ভাবে থেকে গেছে আমাদের মধ্যে।
মেঘমালা, সৌগত। ভাগ্গিস তোমরা সেদিন বইটি দিয়েছিলে! তাই তো এই অপুর্ব বইটি পড়তে পারলাম।
খুব ভাল থাকো। দুজনেই।
সংগ্রহে থাকা এই কবিতাটিও দিই এই লেখাটির সংগে। ওই গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো আর কী...।
যাবার সময় হলো
শক্তি চট্টোপাধ্যায়
জীবনযাপনে কিছু ঢিলেঢালা ভাব এসে গেছে।
চেতনার ক্ষিপ্র কাজ এখন তেমন ক্ষিপ্র নয়---
কেমন আলস্যে আমি শুয়ে থাকি, আর দেখি চাঁদ,
বাঘের মুড়োর মতো চাঁদ পড়ে আমার বাগানে।
আমার ক্ষিপ্রতা গেছে, তার সঙ্গে গেছে হিংসা লোভ,
কবি হয়ে দাঁড়াবার আর কোনো সাধ নেই মনে।
শেষ হয়ে গেছে লোকটা, এও শুনে লাগে না আঁচড় গায়ে, সব শুনে এই পাশ ফিরে সম্ভ্রান্ত বিশ্রামে।
গতরাতে শেষকরা পদ্যটির তুমুল উত্তাপ
এখন পারি না দিতে সভাঘরে, বিশিষ্ট শ্রোতাকে।
পুরনো প্রাক্তন লেখা সেকালীন দুর্গন্ধে জড়ানো---
সেইসব পাঠ করে কোনোমতে আত্মতৃপ্তি পাই!
সুতরাং ভালো নেই, পরিপার্শ্ব চাপ তৈরি করে...
" বাঘের মুড়োর মত চাঁদ পড়ে আমার বাগানে "। আর কেউ আছেন/ ছিলেন এমন লাইন লিখতে পারেন/ পেরেছেন!!!
শক্তি চাটুজ্জে জিন্দাবাদ।
বিমোচন ভট্টাচার্যের কলমে।(সংগৃহীত)
পড়ুন --
সরস্বতী পুজোর দিন বইমেলায় গেছি। আমার প্রকাশিত বই "তোমার পরশ আসে" নেই আর স্টলে। গিয়েছিলাম শুধু " দেবাংশু সম্মাননা " পুরস্কার অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। আর আমার দুটি বই কোনমতে সংগ্রহ করে মল্লিকা আর ওঙ্কার কে দেবার জন্যে। প্রচুর ভীড় হয়েছিল সেদিন।
দাঁড়িয়ে আছি, এক যুবক আর এক যুবতী এসে প্রণাম করলো। বললো ওদের নাম সৌগত আর মেঘমালা ( কি সুন্দর নাম!)। আরো বললো - জেঠু, আপনার বইটা পেলাম না তবে আমরা দুজন আপনাকে একটা বই উপহার দিতে চাই।ভাবলাম ওদেরই লেখা কোন বই। নেওয়ার পর দেখলাম বইটির নাম - " আমার বন্ধু শক্তি"। লিখেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের দীর্ঘদিনের বন্ধু সমীর সেনগুপ্ত। কিন্তু বইটির কথায় পরে আসি আগে বলি মেঘমালা আর সৌগতর কথা।
এরা দুজনেই আমার ফেসবুক বন্ধু। প্রোফাইল দেখে ঠিক বোঝা যায় না কিন্তু এরা বয়েসে আমার সন্তানতুল্য। ফেসবুকে আসার পর আমি এমন অনেক অনেক তরুন তরুনী দেখলাম যাদের দেখে আমার নিজের যৌবনের কথা মনে পড়ে যায়। সেই সময়ের বন্ধুদের (আমাদের বান্ধবী ছিল না) কথা মনে পড়ে যায়। এদের দুজনকে দেখেও একই অনুভুতি হল। মেঘমালা কে দেখে মনে পড়লো। একদিন হঠাৎ দেখি নোটিফিকেশন " মেঘমালা হ্যাজ অ্যাক্সেপ্টেড ইওর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট "। কি হল? আমি তো সাধারনত কাউকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাই না। জিজ্ঞাসা করাতে মেঘমালা উত্তর দিয়েছিল - সে তো আমিও জানি কিন্তু আপনি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছেন আর আমি অ্যাকসেপ্ট করবো না! তাও কি হয়। সেই থেকে আমরা বন্ধু। মেঘমালা বা সৌগত কেউই খুব বেশী কমেন্ট করে না আমার লেখায় কিন্তু কথা বলে দেখলাম আমার সব লেখা পড়ে ওরা দুজন। অনেক অনেকক্ষন কথা বলেছি ওদের সংগে। খুব খুব ভাল লেগেছে ওদের সংগে কথা বলে।
এবার আসি বইটির কথায়। অপুর্ব লিখেছেন সমীরবাবু। অন্তরঙ্গ শক্তিকে পেলাম ওঁর লেখায়। কত কত অজানা ঘটনা জানলাম বইটি পড়ে।
দুটি ঘটনা বলি আপনাদের।
এক - "একদিন মধ্যরাতে আমি আর শক্তি ফিরছি ট্যাক্সিতে। ট্যাক্সি থেকে নেমে দেখা গেল চারটাকা কম পড়েছে ( আজকের চারটাকা নয়,মধ্যসত্তরের চার টাকা)--- শক্তি ট্যাক্সিচালকের দুগাল ধরে বললো- আর তো নেই রে আজ,এই নিয়ে খুশী হয়ে যা, কেমন? বাঙালী ট্যাক্সিচালক বিনা বাক্যব্যয়ে প্রণাম করে চলে গেল --- হ্যাঁ, প্রণাম করে চলে গেল।
দ্বিতীয় ঘটনাটি আরো চমকপ্রদ। এক বিহারী বন্ধু ছিল শক্তির। হিন্দী ভাষায় কবিতা লিখে তার কিছু কবিখ্যাতি হয়েছিল। কলকাতার কালিঘাট অঞ্চলে তার বাড়িতে প্রায়ই মধ্যরাত্রে শক্তি হানা দিত আর তার স্ত্রীকে বলতো -" লছমি, খিদে পেয়েছে। দুটো রুটি খাওয়া তো। ক্রমে এমন হল লছমি রোজই দুটো রুটি আর তরকারি রেখে দিত। বলা যায় না, শক্তিদা যদি চলে আসেন। প্রায়ই যেত শক্তি। লছমির রুটি তরকারী কাজে লেগে যেত।
সেই বন্ধু তারপর বদলি হয়ে গেল ধানবাদ বা পাটনায়। লছমি থেকে গেল। বাচ্ছাদের ইস্কুল আছে। শক্তির যাওয়া কমে গেল। তবু যেত মাঝে মাঝে। রুটি তরকারি খেয়ে আসতো। লছমির কিন্তু এটা ব্রতপালনের মত হয়ে গেল। রোজই রাত্রে সে রুটি তরকারি করে রেখে দেয়। সকালে তা দিয়ে দেয় ভিখারি কে। এমনও হয়েছে মধ্যরাত্রে বন্ধু ফিরেছে ধানবাদ থেকে। লছমি আবার রুটি তরকারি বানাতে বসে গেছে। বন্ধু বলেছে - আবার বানাচ্ছো কেন? শক্তিদার জন্যে বানানো রুটি তরকারি দিয়ে দাও। এত রাতে শক্তিদা আসবেন না। আসেনও তো না আজকাল।হেসে মাথা নেড়েছে লছমি। বলেছে -" তা হবে না। ও শক্তিদার জন্যে রাখা আছে। ও কাউকে দেওয়া যাবে না। তোমাকেও নয়। নতুন বানিয়ে দিচ্ছি তোমাকে। " দুদিন চারদিন নয়, পুরো বারো বছর ধরে রোজ তার শক্তিদার জন্যে রুটি তরকারি বানিয়ে রেখে দিয়েছে লছমি।সকালে উঠে ভিখারি কে দিয়ে দিয়েছে। কী দেখেছিল অর্ধশিক্ষিত লছমি শক্তিদার মধ্যে!!কী দেখেছিল সেই ট্যাক্সিচালক তার আধঘন্টার সওয়ারির মধ্যে! "
এমন অনেক অন্তরঙ্গ ঘটনা আছে বইটিতে শক্তিকে নিয়ে। তবে শক্তি বলতেই আমার মনে হয় গভীর রাত্রে বা সকালে শক্তি ঢুকছেন আমার পাশের ফ্লাটের অবনীদার বাড়ি। অবনীদা সংগে থাকলেও হাঁক পাড়ছেন তাঁর জলদগম্ভীর গলায় - " অবনী, বাড়ি আছো?
না অবনী দা আর নেই। বাড়িতে তো নেইই ইহলোকেই নেই আর। শক্তিবাবুও নেই কোথাও তবু " অবনী বাড়ি আছো? ভীষণ ভাবে থেকে গেছে আমাদের মধ্যে।
মেঘমালা, সৌগত। ভাগ্গিস তোমরা সেদিন বইটি দিয়েছিলে! তাই তো এই অপুর্ব বইটি পড়তে পারলাম।
খুব ভাল থাকো। দুজনেই।
সংগ্রহে থাকা এই কবিতাটিও দিই এই লেখাটির সংগে। ওই গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো আর কী...।
যাবার সময় হলো
শক্তি চট্টোপাধ্যায়
জীবনযাপনে কিছু ঢিলেঢালা ভাব এসে গেছে।
চেতনার ক্ষিপ্র কাজ এখন তেমন ক্ষিপ্র নয়---
কেমন আলস্যে আমি শুয়ে থাকি, আর দেখি চাঁদ,
বাঘের মুড়োর মতো চাঁদ পড়ে আমার বাগানে।
আমার ক্ষিপ্রতা গেছে, তার সঙ্গে গেছে হিংসা লোভ,
কবি হয়ে দাঁড়াবার আর কোনো সাধ নেই মনে।
শেষ হয়ে গেছে লোকটা, এও শুনে লাগে না আঁচড় গায়ে, সব শুনে এই পাশ ফিরে সম্ভ্রান্ত বিশ্রামে।
গতরাতে শেষকরা পদ্যটির তুমুল উত্তাপ
এখন পারি না দিতে সভাঘরে, বিশিষ্ট শ্রোতাকে।
পুরনো প্রাক্তন লেখা সেকালীন দুর্গন্ধে জড়ানো---
সেইসব পাঠ করে কোনোমতে আত্মতৃপ্তি পাই!
সুতরাং ভালো নেই, পরিপার্শ্ব চাপ তৈরি করে...
" বাঘের মুড়োর মত চাঁদ পড়ে আমার বাগানে "। আর কেউ আছেন/ ছিলেন এমন লাইন লিখতে পারেন/ পেরেছেন!!!
শক্তি চাটুজ্জে জিন্দাবাদ।
বিমোচন ভট্টাচার্যের কলমে।(সংগৃহীত)