কোরআন অর্থ পড়া, পাঠ করা, পাঠযোগ্য, যা বারবার পাঠ করা হয়। কোরআন মাজিদ দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি পঠিত গ্রন্থ। কোরআন অর্থ কাছে যাওয়া, নিকটবর্তী হওয়া। কোরআন পঠন ও অনুশীলনের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নৈকট্য ও সান্নিধ্য লাভ করে। পঠন-পাঠন ও বিদ্যার্জন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার নির্দেশ দিয়েই কোরআন মাজিদের প্রথম আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। ‘পড়ো তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃজন করেছেন মানব আলাক হতে। পড়ো তোমার রব মহা সম্মানিত, যিনি লিপির মাধ্যমে শিক্ষাদান করেছেন; শিখিয়েছেন মানুষকে, যা তারা জানত না।’ (সুরা-৯৬ কলম, আয়াত: ১-৫)।
কোরআন শরিফ, কাবা শরিফ এবং পিতা-মাতার চেহারা মোবারক—এই তিন জিনিস শুধু দেখলেই সওয়াব হয়। কোরআন শরিফ তিলাওয়াতে তিনটি ফরজ রয়েছে: হরফ বা বর্ণসমূহ সঠিকভাবে উচ্চারণ করা, হরকত বা স্বরচিহ্ন তাড়াতাড়ি পড়া, মাদ বা দীর্ঘস্বর হলে টেনে পড়া। কোরআন শরিফ পড়তে তিনটি কাজ করতে হয়: পবিত্র হওয়া (ফরজ), আউজুবিল্লাহ পড়া (ওয়াজিব) ও বিসমিল্লাহ পড়া (সুন্নাত)। তিনটি কাজে পবিত্রতা প্রয়োজন বা ফরজ হয়—নামাজ পড়া, কাবা শরিফ তাওয়াফ করা, কোরআন শরিফ স্পর্শ করা।
কোরআন মাজিদ শিক্ষা করা ফরজ, শিখে ভুলে গেলে মারাত্মক গুনাহ; অশুদ্ধ বা ভুল পাঠ করলে কঠিন পাপের কারণ হতে পারে। তাই কোরআন বিশুদ্ধভাবে শেখা ও সুন্দরভাবে তিলাওয়াত করা জরুরি। যাঁরা পড়তে জানেন না তাঁদের শিখতে হবে, যাঁরা শিখে ভুলে গেছেন তাঁদের পুনরায় পড়তে হবে এবং যাঁরা ভুল পড়েন তাঁদের সহিহ্ শুদ্ধ করতে হবে। তিন প্রকার লোকের তিলাওয়াতের ভুল মাফ হবে: যাঁরা সহিহ্ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন, যাঁরা সহিহ্ করার চেষ্টায় রত আছেন, যাঁদের সহিহ্ শিক্ষার সুযোগ নেই বা সহিহ্ ও ভুলের জ্ঞান নেই।
কোরআন কারিম অধ্যয়ন, অনুশীলন ও প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দিয়েই পাঠানো হয়েছিল প্রিয় নবী (সা.)–কে। হজরত ইবরাহিম (আ.) দোয়া করেছিলেন, ‘হে আমাদের রব! আপনি তাদের মাঝে তাদের মধ্য থেকে এমন রাসুল পাঠান, যিনি আপনার আয়াত পাঠ করে শোনাবেন, কিতাব ও হিকমত শেখাবেন এবং তাদের পরিশুদ্ধ করবেন। নিশ্চয়ই আপনি স্নেহশীল ও মহা কৌশলী।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১২৯)। কোরআন তিলাওয়াত করাও ইবাদত এবং তিলাওয়াত শোনা এবং শোনানোও ইবাদত। নবী আকরাম (সা.) নিজে পাঠ করে সাহাবিদের শোনাতেন এবং সাহাবিদের তিলাওয়াতও শুনতেন। প্রতি রমজান মাসের আগে যতটুকু কোরআন নাজিল হয়েছে, তা নবীজি (সা.) হজরত জিবরাইল (আ.)–কে শোনাতেন এবং হজরত জিবরাইল (আ.) ও তা নবীজিকে শোনাতেন। নবীজি (সা.) জীবনের শেষ রমজানে উভয়ে উভয়কে দু-দুবার করে পূর্ণ কোরআন পাঠ করে শোনান। (তাফসিরে ইবনে কাসির)।
কোরআন কারিম নাজিলের কারণেই রমজানের ও শবে কদরের ফজিলত, মক্কা-মদিনার ফজিলতও কোরআন নাজিলের কারণেই। কোরআনের পরশেই গিলাফ ও রেহালের সম্মান। যে মানুষ যত কোরআনের ধারক-বাহক হবে, তার সম্মানও তত বেশি হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোরআনওয়ালাই আল্লাহওয়ালা এবং আল্লাহর খাস পরিবারভুক্ত।’ ‘যে অন্তরে কোরআন নেই, তা যেন পরিত্যক্ত বিরান বাড়ি।’ ‘হাশরে বিচারের দিনে কোরআন তোমার পক্ষে বা বিপক্ষে হুজ্জত হবে।’ (মুসলিম)। যারা কোরআন তিলাওয়াত, চর্চা ও অনুশীলন করবে না, তাদের বিরুদ্ধে রোজ কিয়ামতে আল্লাহর আদালতে প্রিয় রাসুল (সা.) অভিযোগ করবেন, ‘রাসুল আকরাম (সা.) বলবেন, হে আমার রব! এই লোকেরা কোরআন পরিত্যাগ করেছিল।’ (সুরা-২৫ ফুরকান, আয়াত: ৩০)।
কোরআন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ আসমানি কিতাব, যা সর্বশ্রেষ্ঠ ফেরেশতা হজরত জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে সর্বশেষ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর নাজিল হয়েছে। এরপর কিয়ামত পর্যন্ত আর নতুন কোনো কিতাব ও নতুন কোনো নবী বা রাসুল আসবেন না; এটিই কিয়ামত পর্যন্ত সব মানুষের জন্য দুনিয়ার শান্তি ও পরকালীন মুক্তির একমাত্র পথ। কোরআনের অংশবিশেষ পাঠ ব্যতিরেকে প্রধান ইবাদত নামাজও আদায় হয় না। এ জন্যই সহিহ্ভাবে কোরআন তিলাওয়াত শিখতে হবে। কমপক্ষে নামাজ পড়তে যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু শেখা ফরজে আইন।
কোরআন নাজিলের মাস রমজান। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘রমজান মাস, যে মাসে নাজিল করা হয়েছে আল কোরআন, মানুষের জন্য হিদায়াতরূপে এবং পথনির্দেশনার প্রমাণ ও সত্য-মিথ্যা পার্থক্য নির্ণয়কারী।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৮৫)।
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম