'চঞ্চল হাওয়া রে, ধীরে ধীরে চল রে, গুন গুন গুঞ্জনে ঘুম দিয়ে যা রে, পরদেশি মেঘ রে, আর কোথা যাসনে। বন্ধু ঘুমিয়ে আছে, দে ছায়া তারে। বন্ধু ঘুমায় রে...।' সিনেমার দৃশ্যে গানটি গেয়ে হাত নেড়ে ঘুমন্ত বন্ধুর জন্য মেঘেদের ডাকছেন অলিভিয়া। রুনা লায়লার কণ্ঠে গানটিতে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন তিনি। গত রাতে অলিভিয়ার সেই বন্ধু চলে গেছেন চিরঘুমে। তিনি রাজপুত্রের বেশে টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলা বাংলা সিনেমার সোনালি যুগের অন্য এক রাজপুত্র, ওয়াসিম। মিষ্টি মেয়ে কবরীর চিরবিদায়ের শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ঢালিউডের স্বর্ণালি যুগের আরেক সুপারস্টার কিছু না বলেই শেষবারের মতো বললেন বিদায়। চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক সাপখোপ, পরি, রাজা-রাজকন্যা, রাক্ষসদের রুপালি জগতের 'লার্জার দ্যান লাইফ' হিরো ওয়াসিমের এক জীবনে। একইসঙ্গে তিনি সাদাকালো, কিছুটা রঙিন আর রঙিন যুগের হিরো।
১৯৫০ সালের (মতান্তরে ১৯৪৭ সাল) ২৩ মার্চ চাঁদপুরে জন্ম নেওয়া মেজবাহ উদ্দিন আহমেদের ওয়াসিম হয়ে ওঠার তখনো ঢের বাকি। পড়াশোনা করতেন ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে। ছোটবেলা থেকেই বডিবিল্ডিং নিয়ে ছিল তুমুল আগ্রহ। স্কুলে তিনি তুখোড় খেলোয়াড় ছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি বডিবিল্ডিংয়ের জন্য 'মিস্টার ইস্ট পাকিস্তান' খেতাব অর্জন করেন। আনন্দ মোহন কলেজে পড়ার সময় থেকেই বডিবিল্ডার হিসেবে লোকে চিনত। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে পড়াশোনা শেষ করতে করতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাঁর নামডাক ছড়িয়ে পড়ে।
সহকর্মীদের সঙ্গে আড্ডায় ওয়াসিম, সংগৃহীত
বাংলা সিনেমার নামকরা পরিচালক এস এম শফী পারিবারিকভাবে মেজবাহর আত্মীয়, বন্ধু ছিলেন। ইচ্ছা ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন। অথবা হবেন পুলিশ অফিসার। সেসবের জন্য চেষ্টা চলছিল। হাতে তেমন কাজকর্ম ছিল না। শফী বললেন, 'তোমার তো আপাতত ব্যস্ততা নেই। আমার সঙ্গে ছবিতে কাজ করো।' শফীর 'ছন্দ হারিয়ে গেল' সিনেমায় নায়ক রাজ্জাককে ইংরেজিতে একটি সংলাপ বলতে হবে। সে জন্য কাছেপিঠে কাউকে পাচ্ছিলেন না এই পরিচালক। হঠাৎ মেজবাহকে সামনে দেখে সেই দৃশ্যে অভিনয় করতে বললেন। এক কাটেই অবলীলায় দৃশ্যটি করে ফেলেন মেজবাহ। সেদিন সেটে উপস্থিত সবাই বেশ প্রশংসা করেছিলেন তাঁর।
শাবানার সঙ্গে
তারপর থেকেই নিয়মিত এফডিসিতে আসা–যাওয়া মেজবাহর। অবশ্য অন্য কারণও ছিল। নায়ক খসরু, সোহেল রানা—তাঁদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই বন্ধুত্ব ছিল। একদিন এফডিসিতে 'ওরা ১১ জন' ছবির শুটিং দেখতে এসেছিলেন মেজবাহ। একে তো সুঠাম দেহের অধিকারী, উপরি পাওনা হিসেবে ছিলেন সুদর্শন। সেদিন অনেক পরিচালকের নজর কাড়েন সুদর্শন মেজবাহ। প্রায়ই এস এম শফীর শুটিং দেখতে আসতেন মেজবাহ। একদিন এফডিসিতে এলেন সুখবর দিতে। শফীকে বলবেন বলবেন, এমন সময় পরিচালক মোহসিন তাঁকে 'রাতের পর দিন' ছবির নায়ক হওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। আর সুখবরটা ছিল, মেজবাহ সেনাবাহিনী থেকে ডাক পেয়েছিলেন। আর তিনি সব সময় সেনাবাহিনীতে চাকরি করতে চেয়েছিলেন। সেই খবরই শফীকে দিতে এসেছিলেন এফডিসিতে। তাই সিনেমায় একেবারে নায়ক হওয়ার প্রস্তাব পেয়ে ঠিক কী বলবেন, বুঝতে পারছিলেন না।
ওয়াসিম, সংগৃহীত
শেষমেশ দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে পরিবারকে না জানিয়েই চুপিচুপি নায়ক হবেন বলেই সিদ্ধান্ত নিলেন। তড়িঘড়ি করে এস এম শফীও তাঁর পরের সিনেমা 'ছন্দ হারিয়ে গেলো'তে মেজবাহকে চুক্তিবদ্ধ করেন। 'রাতের পর দিন' সিনেমার শুটিং শুরুর আগেই পরিচালক মহসিন নাম বদলে রাখলেন ওয়াসিম। আর সেই থেকে মেজবাহ হয়ে গেলেন ওয়াসিম। ববিতাকে সঙ্গী করে বড় পর্দায় তুমুল হিট করল 'রাতের পর দিন'। এটি ওয়াসিমের প্রথম চুক্তিবদ্ধ ছবি। আর 'ছন্দ হারিয়ে গেলো' ওয়াসিমের প্রথম মুক্তি পাওয়া ছবি। এটিও দারুণ ব্যবসাসফল।
১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় ওয়াসিমের তিনটি সিনেমা। শাবানার সঙ্গে 'ডাকু মনসুর', সুচরিতার সঙ্গে 'কে আসল কে নকল' ও ববিতার সঙ্গে 'জিঘাংসা'। এই 'জিঘাংসা' সিনেমা নিয়ে একটা মজার গল্প আছে। 'জিঘাংসা' সিনেমার পরিচালক ইবনে মিজান। শুরুতে এ ছবিতে ওয়াসিমের জায়গায় অভিনয় করার কথা ছিল সেই সময়ের সেরা আরেক সুপারস্টার নায়কের। কিন্তু শুটিং শুরুর আগে গোঁ ধরলেন এই পরিচালক। তাঁর ওয়াসিমকে চাই। কিন্তু ওয়াসিম অন্য কোনো নায়ককে সরিয়ে কাজ করতে রাজি নন, কিন্তু পরিচালক নাছোড়বান্দা। তিনি ওয়াসিমকে নিয়েই ছবি করবেন। তাই তিনি ওই নায়কের কাছে গিয়ে তাঁকে দিয়ে একটি চিঠি লিখিয়ে নেন। চিঠিতে লেখা ছিল, 'আমি এই সিনেমা করব না। আমি আপনাকে এই সিনেমায় অভিনয় করার জন্য অনুরোধ করছি।' শেষমেশ ছবিটি করেছিলেন ওয়াসিম।
ওয়াসিমের সিনেমার পোস্টার, সংগৃহীত
যাহোক, ওয়াসিমের জনপ্রিয়তা দেখে এস এম শফী তাঁকে নিয়ে বানালেন তাঁর পরের সিনেমা 'দি রেইন'। তুমুল প্রেমের সিনেমা। অনেকে বলে, বাংলাদেশের রোমান্টিক সিনেমায় 'খোলামেলা দৃশ্য' এসেছিল 'শফী-অলিভিয়া-ওয়াসিম', এই তিনের হাত ধরে 'দি রেইন' সিনেমায়। তখন অলিভিয়া এস এম শফীর স্ত্রী। এই ছবিতে শফী অলিভিয়ার চরিত্রকে দিয়ে দেখিয়েছেন, ঢাকার সিনেমার নায়িকা কতটা গ্ল্যামারাস আর আবেদনময়ী হতে পারেন! 'দি রেইন'কে বলা হয়ে থাকে ঢালিউডের সর্বকালের সবচেয়ে সফল সিনেমাগুলোর একটি। ৪৬টি দেশে মুক্তি পেয়েছিল এই সিনেমা। তবে বাংলা সিনেমার ভক্তরা বলেন, 'রেইন'-এর বাংলাদেশি সংস্করণ নাকি চোখ ও মনের জন্য তেমন ক্ষতিকর ছিল না।
'দি রেইন'কে বলা হয়ে থাকে ঢালিউডের সর্বকালের সবচেয়ে সফল সিনেমাগুলোর একটি
পাহাড়ি ঢলে দুজনের পরিণতি 'দি রেইন' নামের সার্থকতা ঝরিয়েছে দর্শকের চোখে। সিনেমার গানগুলো তো বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে দর্শকের মুখে মুখে। এসব গানের শিল্পীরা পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। আর দর্শকেরা পেয়েছিলেন অলিভিয়া-ওয়াসিম জুটি। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন ওয়াসিম-অলিভিয়া জুটি। ২০১৯ সালে শেষবার মেরিল–প্রথল আলো পুরস্কার অনুষ্ঠানেও পরীমনি নীল–সাদা পরী হয়ে নেচেছেন এই ছবির 'চঞ্চল হাওয়া রে' গানে।
গাঁওগেরামের মানুষের চোখে রাজপুত্র, 'চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা'র যোগ্য সঙ্গী ওয়াসিম ঠিকই রাজ্জাক, ফারুকদের রাজত্বে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। তবে তাঁদের রাস্তায় হাঁটেননি তিনি। ফোক ফ্যান্টাসি ও অ্যাকশন ঘরানার সিনেমা দিয়ে দর্শক মাতাচ্ছিলেন ওয়াসিম। ঘোড়া চালানোয় পারদর্শী ছিলেন বাংলা সিনেমার এই রাজপুত্র। প্রায়ই তাঁর সিনেমায় দেখা গেছে, বীরের বেশে টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছেন তিনি।
অলিভিয়া ছাড়া শাবানা আর অঞ্জু ঘোষের সঙ্গেও তাঁর জুটি জমে ক্ষীর। ফোক ঘরানার পরিচালক ইবনে মিজানের তুরুপের তাস ছিলেন ওয়াসিম। মিজান-অঞ্জু-ওয়াসিম—এই ত্রয়ীর সাপের বিনের তালে তালে কোমর দুলিয়ে নাচ, সাপের ফিরে এসে নায়িকার পা থেকে বিষ ফেরত নেওয়া, ঝাঁ–চকচকে রুপালি কোটের রাজকুমার—এসব সিনেমা বাংলার মানুষ চোখের পলক না ফেলে হাঁ করে 'গিলেছেন'।
চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা সিনেমার পোস্টার
'চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা' সিনেমার শুটিং হয়েছিল সিলেটে। সেই স্মৃতি আওড়ে ২০১৭ সালের এক সাক্ষাৎকারে ওয়াসিম বলেছিলেন, 'কখনো গলাসমান, কখনো হাঁটুসমান পানি। তলোয়ারের ফাইট। বেশ সময় লাগল শুটিং করতে। পরে যখন পানি থেকে উঠলাম, দেখি নাভির মধ্যে কালো কী যেন একটা দেখা যাচ্ছে! স্থানীয় এক ছেলে দেখে চিৎকার দিয়ে উঠল। মিজান ভাই দৌড়ে এলেন। বললেন, “হায় হায়, এ তো জোঁক! আরেকটু হলে তো পেটের ভেতর ঢুকে যেত।” মিজান ভাই (পরিচালক) বললেন, “তোমার তো অনেক বড় ক্ষতি হতে পারত!”'
ওয়াসিম তাঁর দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ১৩৩টির বেশি সিনেমায় অভিনয় করেন। 'রাতের পর দিন', 'ছন্দ হারিয়ে গেলো', 'বাহাদুর', 'আলাদিন আলিবাবা সিন্দবাদ', 'নিশান', 'দি রেইন', 'বন্দুক', 'ডাকু মনসুর', 'তুফান', 'ঈমান', 'দখল', 'দোস্ত দুশমন', 'বারুদ', 'আসামী হাজির', 'ওস্তাদ সাগরেদ', 'নুরী', 'সওদাগর', 'গঙ্গা যমুনা', 'রাজদুলারি', 'আলিফ লায়লা', 'আবে হায়াত', 'বানজারান', 'রঙিন অরুন বরুন কিরণমালা', 'চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা', 'অচল পয়সা', 'জীবনধারা', 'দিনকাল', 'ডাকাত', 'মাটির দুর্গ' উল্লেখযোগ্য। যদিও একটিও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নেই এই অভিনেতার। শোনা যায়, ১৯৭৯ সালে 'ঈমান' ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু সে বছর কাউকেই সেরা অভিনেতার পুরস্কার দেওয়া হয়নি।
ওয়াসিমের মৃত্যুর পর ফেসবুকে সিনেমার গ্রুপগুলোতে লেখা হচ্ছে তাঁকে নিয়ে। সেখানে আবেগপ্রবণ ভক্তরা বলছেন, রাজ্জাক, আলমগীর কিংবা জসীম নন; বাংলা সিনেমার সবচেয়ে ব্যবসাসফল নায়ক ওয়াসিম। কেউ কেউ সেটি আবার শতাংশ আকারে প্রকাশ করে লিখেছেন, ওয়াসিমের ৯৮ শতাংশ সিনেমাই নাকি হিট। ওয়াসিম ন্যাশনাল স্পোর্টস কাউন্সিলের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন।
শোনা যায়, সেই সময় তাঁর উদ্যোগেই কিংবদন্তি বক্সার মোহাম্মদ আলী ১৯৭৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পাঁচ দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেই সফরে তাঁকে বাংলাদেশ সরকার সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করে। অড্রে হেপবার্ন ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে এলেন। এফডিসিতে সুশিক্ষিত, ভালো ইংরেজি জানা, সুদর্শন, স্মার্ট ওয়াসিমের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে বলেছিলেন, 'তুমি তো হলিউডে অভিনয় করলেই পারো। চলে আসো।' শুনে ওয়াসিম হেসে বলেছিলেন, 'সময় কোথায়? দেশের ছবি করেই কূল পাচ্ছি না।'
ওয়াসিম, সংগৃহীত
১৯৭০ থেকে ১৯৯০ সাল—অভিনয়ে তুমুল ব্যস্ত ছিলেন ওয়াসিম। দুই দশকে দাপুটে নায়ক হিসেবে পর্দা কাঁপিয়েছেন। আক্ষেপ ছিল, দীর্ঘ ক্যারিয়ারে মেলেনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের কোনো স্বীকৃতি। সেই আক্ষেপ নিয়ে চলে যান না–ফেরার দেশে। গতকাল দুপুরে বনানী কবরস্থানে তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়।