ব্রাদার আইল্যান্ড সম্পর্কে জানার আগে চলুন আমরা একটু ভুত বিষয়ে কিছু কথা বলে নেই-
ভুত শব্দটি শুনলে আপনার কেমন অনুভূতি হয়? যারা একটু ভিতু আছেন, নিশ্চয়ই তাদের মনের ভেতর একটা আতংকের সৃষ্টি হয়! অনেকেই হয়তো ভুত বলে কিছু নেই বলে ব্যাপারটা উড়িয়ে দেয়, কিন্তু ভুতের ভয় পায় না এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। মানুষের ধারণা ভুত-প্রেত সাধারনত কবরস্থান, শ্মশান, বড় গাছ কিংবা পুরনো বাড়ি ইত্যাদি যায়গায় অবস্থান করে। কিন্তু আপনাকে যদি বলা হয় ভুত বাস করে একটি দ্বীপে? তাহলে আপনি কি তা বিশ্বাস করবেন? হয়তো বিশ্বাস করবেন না, আবার বিশ্বাস করতেও পারেন কারণ দ্বীপে তো ভুত থাকতেই পারে।
কিন্তু যদি বলা বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কোনও একটা দ্বীপে ভুত বাস করে, তাহলে নিশ্চই আপনি বিশ্বাস করবেন না। ভাববেন- আমেরিকার মত আলো ঝলমলে পরিবেশে ভুত আসবে কোত্থেকে! কিন্তু আপনাকে আরও চমকে দেয়ার মত তথ্য আছে আমার কাছে। আমি যে ভুতুড়ে দ্বীপের কথা বলছি সেটা আর কোথাও নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটিরই একেবারে প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত। এই দ্বীপের নাম ব্রাদার আইল্যান্ড।
ব্রাদার আইল্যান্ড এর অবস্থানঃ
আলো ঝলমলে আধুনিক নিউইয়র্ক শহর থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ। কোনও মানব বসতি নেই সেখানে। অবাক হয়ে যাবেন এই দ্বীপের সুনসান নীরবতা দেখলে! শহর থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপটির নাম হচ্ছে উত্তর ব্রাদার আইল্যান্ড (North Brother Island)। এর আরেক নাম অ্যাবানডন্ড আইল্যান্ড (Abandoned Island)।
এই ব্রাদার আইল্যান্ডকে ঘিরে নানা ধরনের কল্প কাহিনী প্রচলিত আছে। অনেক বছর আগে এই দ্বীপে মানুষ বসবাস করতো এবং নিউইয়র্ক সিটির মতো আলো ঝলমল করতো এখানেও। তাহলে প্রশ্ন জাগে- কি এমন কী ঘটনা ঘটেছিল যার কারনে দ্বীপের মানুষজন দ্বীপটিকে ছেড়ে চলে গেল? অনেকেই মনে করেন এই দ্বীপে মহামারির আক্রমণ হয়েছিল। যার কারণে জনমানব শূন্য হয়ে গিয়েছিল এই দ্বীপটি। কেউ কেউ আবার বলেন অদৃশ্য আত্মারা ঘুরে বেড়াতো এই দ্বীপে। তাদের উৎপাতের কারনেই মানুষ এই দ্বীপ ছেড়ে পালায়। আবার অনেকই মনে করেন সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়েছিল এই দ্বিপ। সেই ঝড়েই উধাও হয়ে গেছে দ্বীপবাসী।
ব্রাদার আইল্যান্ড এর ইতিহাসঃ
গবেষণা করে জানা গেছে এই দ্বীপের বয়স খুব বেশি নয়। এই দ্বীপে মানুষের চলাচল ছিল ১৮৮৫ সালের দিকে। তখন নিউইয়র্কে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। চিকিৎসার যথাযথ উপায় না পেয়ে রোগীকে সরিয়ে আনা হতো এই দ্বীপে। নির্জন এই দ্বীপে তখন গড়ে তোলা হয়েছিল একটি হাসপাতাল। বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করা হত সেই হাসপাতালে। টাইফয়েডের চিকিৎসাও দেওয়া হতো সেই হাসপাতালে। অনেক রোগী চিকিৎসা চলাকালিন সময়ে তাদের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই দ্বীপে। আর তাদের আত্মারাই অভিশপ্ত করে এই দ্বীপটিকে।তারপর থেকেই ব্রাদার আইল্যান্ডের সম্পর্কে মানুষের কৌতূহল ও ভীতি দুটোই বেড়ে যায়।
ব্রাদার আইল্যান্ড এ কি আসলেও ভুত আছে?
মার্কিনীরা এই দ্বীপকে মৃত্যুপুরী বলে মানা শুরু করেন। তারা মনে করতেন মৃতদের আত্মারা এ দ্বীপের নির্জনতায় লুকিয়ে আছে। রাতের আঁধারে এরা মানুষের প্রান হরনের নেশায় জেগে ওঠে। ভয়ংকর এসব ঘটনা ছরিয়ে পড়ার পর থেকে মানুষের আনাগোনা কমতে শুরু করে এই দ্বীপে। দলে দলে সবাই এই দিপ ছেড়ে চলে যেতে শুরু করে। হাসপাতালটাও একসময় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।
এরপর এই দ্বীপ সম্পর্কে মানুষের মাঝে ভীতি দূর করার জন্য অনেক চেষ্টা করা হয়। যার ফলস্রুতিতে ১৯৫০ সালের দিকে এই দ্বীপে একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র তৈরি করা হয়। তখন মাদক আসক্ত মানুষের চিকিৎসা ব্যাবস্থা করা হয় এখানে। কিন্তু এই দ্বীপে আনার পর রোগীরা উদ্ভট আচরন করতো। তারা এতোটাই ভয়ংকর আচরন করতো যে ভয়ে অনেক চিকিৎসকই পালিয়ে যান এই দ্বীপ ছেড়ে। আবারও পরিত্যক্ত হয়ে যায় হাসপাতালটি। এবং ধিরে ধিরে আবারো মানব শূন্য হয়ে পড়ে ব্রাদার আইল্যান্ড দ্বীপটি।
যারা এই দ্বীপ ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন তাদের মুখ থেকে শোনা যেত ভয়ংকর সব ঘটনার বর্ণনা। অনেকে আবার অশুভ আত্মার ভয়ানক সব কর্মকাণ্ডের গল্প বলতে শুরু করেন যা শুনে সাধারণের মনে ভয় আরও বেড়ে যায়। এবং একটা সময় শেষে ব্রাদার আইল্যান্ড স্থায়ীভাবে প্রেতের দ্বীপ বলে পরিচিত পায় এক হেরোইন আসক্ত ব্যক্তির কথায়। চিকিৎসা চলাকালীন অনেক ভয়ানক সব ঘটনার শাক্ষি হয়েছিলেন তিনি। তার বর্ণনায় ফুটে ওঠে রাত্রিকালীন মৃত মানুষের চলাফেরা আর রাত ভর তাদের কান্নার আওয়াজ। এসব ঘটনা তিনি নিজ চোখে দেখেছেন। দ্বীপের আনাচে-কানাচে জ্বলতো আগুন। স্বপ্নপুরীর মত দেখতে এই দ্বীপে ঢুখলে হঠাত নেমে আসতো অন্ধকার। সেই অন্ধকার পেরিয়ে দ্বীপে চলাচলের রাস্তা খুঁজে পাওয়া ছিল মুশকিল। অনেকেই রাস্তা ভুল করে ক্লান্ত হয়ে ঢুকে পড়তো পাথুরে গুহায়। পাথুরে গুহাগুলো যেন এই সুযোগের আশায় অন্ধকারেই মুখ খুলে বসে থাকতো। আর যখন কেউ এ গুহায় ঢুকত তখনই বন্ধ হয়ে যেত গুহার মুখ!
ব্রাদার আইল্যান্ড নিয়ে সর্বশেষ তথ্যঃ
১৯৬৩ সালের দিকে মানুষজন সম্পূর্ণভাবে ব্রাদার আইল্যান্ড ছেড়ে চলে যায়। অযত্ন অবহেলায় পড়ে থাকে হাসপাতালটি। বসতবারি আসবাব যা ছিল সব পড়ে আছে এখনও ঠিক আগের মত। ১৯৭০ সালের দিকে দ্বীপটি বিক্রি করার দেয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এই দ্বীপটি কিনতে কেউই আগ্রহ দেখায়নি। আসলে এমন অভিশপ্ত আর ভুতুড়ে দ্বীপ কিনে কেউ বিপদে পড়তে চায়নি কেউ। তারপর থেকে কয়েক দশক ধরে দ্বীপটি পরিত্যক্ত অবস্থাতেই ছিল। কিন্তু ২০১০ সালের দিকে ব্রাদার আইল্যান্ডকে হঠাৎ করেই আবার আলোচনার শীর্ষে চলে আসে। ঘোরা ফেরার মধ্যে দিয়ে এক পর্যটক পথ ভুলে পৌঁছে যান এই দ্বীপের কাছে। তিনি তুলে আনেন এই পরিত্যাক্ত এই দ্বীপের একের পর এক রোমহর্ষক ছবি। নতুন এই ছবিগুলো দেখে অনেকেই আগ্রহী হন নতুন করে এই দ্বীপ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে।
অনেকেই অবশ্য তাদের এই আগ্রহকে বাড়াবাড়ি বলে অভিযোগ করছেন। তাদের মতে ব্রাদার আইল্যান্ড দ্বীপের ক্ষুধা আবারও জেগে উঠেছে। সে ভুলিয়ে ভালিয়ে মানুষদেরকে আবারও তার তীরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সুযোগে বুঝে কোন একসময় সে আবারও তার পেট ভরবে এই সব মানুষদের রক্ত-মাংস দিয়ে।