মানবজীবনের সবকিছুই আল্লাহর দান। আল্লাহর দেওয়া নিয়ামতগুলোর মধ্যে প্রথম নিয়ামত হলো জীবন। জগতে জীবনের স্থিতিকাল হলো আয়ু। আয়ু হলো সময়ের সমষ্টি। সময় অনাদি–অনন্ত। সময়ের প্রকৃত জ্ঞান সম্পর্কে আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত। বস্তু বা ব্যক্তির সঙ্গে যুক্ত করে সময়কে বিশেষ পরিচয়ে সংজ্ঞায়িত করা হয়। জানা ইতিহাসের ও কল্পিত বিশ্বের নানা বিষয়ের সঙ্গে সময়কে সম্পৃক্ত করা হয়। ব্যবহারিক সুবিধার জন্য চন্দ্র, সূর্য ও গ্রহ–নক্ষত্র নানা প্রাকৃতিক, জাগতিক ও মহাজাগতিক বস্তু ও শক্তির সঙ্গে মিল রেখে সময়ের হিসাব বা ধারণা প্রকাশ করা হয়।
আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে বলেন, ‘সূর্য ও চন্দ্র হিসাব নিমিত্তে।’ (সুরা-৫৫ আর রহমান, আয়াত: ৫)।
মানুষ সময়কে ব্যবহারিক পর্যায়ে বছর, মাস, সপ্তাহ, দিন, দিন-রাত, প্রহর ও ঘড়ি–ঘণ্টায় বিভক্ত করে নিয়েছে। আরবি বর্ষপঞ্জি ও ইসলামি হিজরি সনের চতুর্থ মাস হলো রবিউস সানি। কেউ কেউ একে রবিউল আখির মাস বলে থাকেন। এটি রবিউল আউয়াল মাসের জোড়া মাস। ‘রবি’ অর্থ বসন্ত আর ‘আউয়াল’ অর্থ প্রথম, ‘সানি’ অর্থ দ্বিতীয়, ‘আখির’ অর্থ শেষ বা অন্য। রবিউস সানি অর্থ হলো বসন্তকালের দ্বিতীয় মাস বা অন্য বসন্ত। মহানবী (সা.)-এর দুনিয়াতে আগমনের মাস, হিজরতের মাস ও ওফাতের মাস রবিউল আউয়ালের জোড়া মাস হিসেবে রবিউস সানি মাসও বেশ তাৎপর্যমণ্ডিত।
রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ আখেরি নবী ও সর্বশেষ রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওফাত দিবসকে ‘ফাতেহায়ে দোয়াজ-দাহুম’ বলা হয়। রবিউস সানি মাসের ১১ তারিখ ওলিকুল শিরোমণি পীরানে পীর বড়পীর খ্যাত আওলাদে রাসুল শেখ সৈয়দ মুহিয়ুদ্দিন আবদুল কাদির জিলানি (রহ.)–এর ওফাত দিবসকে ‘ফাতিহায়ে ইয়াজ-দাহুম’ বলা হয়।
সময় মানুষের জীবনের মূলধন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়ু কমতে থাকে। সময়কে কাজে লাগানো তথা সময়ের সদ্ব্যবহারই জীবনের সফলতা এবং সময়ের অপচয় বা অপব্যবহার হলো জীবনের ব্যর্থতা। কোরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সময়ের শপথ! সকল মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। শুধু তারা ক্ষতিগ্রস্ত নয়, যারা ইমান আনয়ন করে, সৎকর্ম করে এবং সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যে উৎসাহিত করে।’ (সুরা-১০৩ আসর, আয়াত: ১-৩)।
বিশেষ সময়ের বিশেষ ফজিলত বর্ণিত আছে কোরআন ও হাদিসে। যেমন রমজান মাস, জিলহজ মাস ও হজের তিনটি মাস, মহররম মাস ও আশহুরে হুররুম বা হারাম ও সম্মানিত চারটি মাস এবং রজব মাস ও শাবান মাস। সপ্তাহের শুক্রবার, সোমবার ও বৃহস্পতিবার। বছরের বিশেষ রাতগুলোর মধ্যে রয়েছে শবে কদর, শবে বরাত, ঈদের রাত ইত্যাদি। কিন্তু এসব ফজিলতপূর্ণ সময়ে কেউ যদি ফজিলতপ্রাপ্তির আমল না করেন, তবে তা তাঁর জন্য ক্ষেত্রবিশেষ ক্ষতির কারণই হবে। যেমন রমজান পেয়ে ক্ষমাপ্রাপ্তি লাভে ব্যর্থ ব্যক্তির জন্য নবী করিম (সা.) আল্লাহর অভিশম্পাতে সম্মতি দিয়ে ‘আমিন’ বলেছেন। (তিরমিজি: ৩৫৪৫, মুসনাদে আহমদ: ১২৯৮, সহিহ আলবানি: ১৬৭৯)।
অতি সাধারণ সময়ও বান্দার ইখলাস ও তাকওয়াপূর্ণ সুন্নাতভিত্তিক নেক আমল ও ত্যাগ–তিতিক্ষা এবং শুভ উদ্যোগ ও সফল সার্থক অবদানের কারণে পুণ্যময় হয়ে ওঠে। হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা পালন করতেন। এই আমল তিনি কখনো পরিত্যাগ করেননি। (জামিউস সগির ও সহিহ বুখারি: ১৯৭৫)। এই রোজাকে ‘আইয়ামে বিদ’–এর রোজা বলা হয়। কারণ এই সময় পৃথিবী জ্যোৎস্নার শুভ্র আলোয় উদ্ভাসিত থাকে এবং এই রোজার মাধ্যমে বান্দার অন্তর আলোকিত হয়। সপ্তাহে প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার প্রায়ই নবীজি (সা.) রোজা রাখতেন। কারণ, এই দুই দিন বান্দার আমল আল্লাহর দরবারে পৌঁছানো হয়। বিশেষত সোমবারে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম ও ওহিপ্রাপ্তির শুকরিয়াস্বরূপ তিনি এই আমল করতেন। (সহিহ মুসলিম: ২৫৬৫, সহিহ আলবানি: ২৩৫৭)।
প্রতিটি মাসের শুরু এবং শেষ বিশেষ দোয়া–কালাম ও নামাজ, রোজা এবং বিশেষ নেক আমলের মাধ্যমে পালন করা নবীজি (সা.)-এর সুন্নাত। আমল দ্বারা সময়কে রঙিন করা ও জীবনকে সাজানো বুদ্ধিমানের কাজ। রাসুলে আকরাম (সা.) বলেন, ‘তোমরা পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিসের পূর্বে মূল্যায়ন করো—যৌবনকে বার্ধক্যের পূর্বে, সুস্থতাকে অসুস্থতার পূর্বে, সচ্ছলতাকে দারিদ্র্যের পূর্বে, অবসরকে ব্যস্ততার পূর্বে, জীবনকে মৃত্যুর পূর্বে।’ (শুআবুল ইমান, বাইহাকি: ১০২৪৮, সহিহ আলবানি: ৩৩৫৫)।
* মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব