রবীন্দ্রনাথ ও ফ্রয়েড।ফ্রয়েড পাঁচবছরের বড়ো।মনে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, সমসাময়িক এই দুই ভাবুকের কি দেখা হয়েছিল?
ফ্রয়েডের ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে শোভা পাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের 'সাধনা', এমন একটা খবর পড়ার পর থেকে ভেতর ভেতর খুব আন্দোলিত হয়েছিলাম।
'সাধনা' আসলে ৮ টি বক্তৃতার সঙ্কলন গ্রন্থ।১৯১৩-তে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে থেকেই রবীন্দ্রনাথের কবি খ্যাতি দেশে দেশে পৌঁছে গিয়েছিল।এজরা পাউন্ড তাঁর কবিতা শুনে 'পোয়েট্রি' পত্রিকার সম্পাদক হ্যরিয়েট মনরোকে অনুরোধ করলেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা ছাপাতে।রবীন্দ্রনাথের ৬ টি কবিতা 'পোয়েট্রি' র ডিসেম্বর ১৯১২- তে প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯১২-তে রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত ভ্রমণে প্রথম আমেরিকা যান।তখন ইউনিটারিয়ান চার্চে তাঁর বক্তৃতার আয়োজন করা হয়।প্রথম বক্তৃতা ১০ নভেম্বর ১৯১২!এটি বহুল প্রশংসিত হলে আরও তিনটি বক্তৃতার জন্য অনুরোধ করা হয়।১৭ ও ২৪ নভেম্বর এবং ১ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ তাঁর বক্তৃতা দেন।বিষয়:
World Realisation
Self Realisation
Realisation of Brahma
The Way of Action
এখান থেকেই 'সাধনা' গ্রন্থের সূত্রপাত।১৫ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ অজিত চক্রবর্তীকে লিখছেন, 'একানকার অধ্যাপকরা প্রায় সকলেই উপস্থিত ছিলেন।আমার ভাগ্যক্রমে তাঁদের ভাল লেগে গেল'!
ইউনিটারিয়ান চার্চের বক্তৃতা শেষ হতে না হতেই ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতীয় দর্শনের ওপর দশটি বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ এল।হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বভাগ থেকে এল ছয়টি বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ। এছাড়া শিকাগো, উইসকনসিন, আয়োয়া, মিশিগাননও পারডুয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও আমন্ত্রণ এল।
হার্ভার্ডে প্রথম বক্তৃতাটির দিন ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯১৩-তে নির্ধারিত হলেও কোনও অজানা কারণে তা হল না।রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় বক্তৃতাটি দিলেন ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯১৩!পরেরটি ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯১৩এবং শেষেরটি ৯ এপ্রিল ১৯১৩ রাতে!হার্ভার্ডে তিনটি বক্তৃতার বিষয়বস্তু :
The Problem of Evil
The Problem of Self
Realisation through Love
এদিকে বক্তৃতাগুলোর প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ল।ম্যডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ে 'The Relation of the Individual to the Universe' প্রবন্ধটি পাঠ করলেন।এবার এগুলো প্রকাশ করবার অনুরোধ আসতে লাগল।ম্যাকমিলান কোম্পানি দায়িত্ব নিলেন প্রকাশের।আরনেস্ট রাইস নিলেন প্রুফ দেখবার ভার।১৯১৩-তে প্রকাশিত হল 'Sadhana, the Realisation of Life'!
'সাধনা' নামটির একটি গভীর তাৎপর্য আছে।আধ্যাত্মিক প্রকৃতির মানুষ পারমার্থিক সিদ্ধি চান, মোক্ষলাভ করতে চান ও মুক্তি চান।ভারতীয় সনাতন ধর্মে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই চতুর্বর্গকে সাধনার লক্ষ বলা হয়েছে।রবীন্দ্রনাথ উপনিষদের আলোকে, আটটি প্রবন্ধে এইসব কিছু আলোচনা করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের 'শান্তিনিকেতন' আমার অত্যন্ত প্রিয় একটি বই।আমার মনে হয়েছে 'সাধনা'র প্রবন্ধগুলো মেজাজের দিক থেকে 'শান্তিনিকেতন'- এর কিছু প্রবন্ধের কাছাকাছি।এবং যে জন্য নাস্তিকতা বা আস্তিকতা প্রবন্ধগুলো পাঠে বাধা হয়না।ফ্রয়েডেরও নিশ্চয় হয়নি।
আহা! কী গভীর ও নির্জন এই উচ্চারণ :
'প্রেমের মধ্যে অস্তিত্বের সমস্ত বৈপরীত্য নিজেদের নিমগ্ন করে ও হারিয়ে যায়।একমাত্র প্রেমের মধ্যে অদ্বৈত ও দ্বৈত বিরুদ্ধ হয় না।প্রেমকে একই সময়ে এক ও দুই হতে হয়।'
'আত্মপ্রেম'-এর বিনাশের কথা ফ্রয়েডও বলেছিলেন।আসলে 'অপর' হতে চাওয়া শেষ পর্যন্ত সমস্ত ভাবুকের বুঝি নিয়তি।তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের ছবি যে 'ভলকানিক ব্যাপার এক একটা', তা কি ফ্রয়েডের অবচেতনার তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না?
তো সত্যিই কি দেখা হয়েছিল এই দুই মনিষীর? দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অগ্নিভ ঘোষের সঙ্গে কথা হচ্ছিল।হ্যাঁ, অন্ততপক্ষে একবার দেখা হয়েছিল।
২৫ অক্টোবর ১৯২৬। ভিয়েনাতে কবি ফ্রয়েডকে চায়ের নেমন্তন্নে ডেকেছিলেন।ভিয়েনার হোটেল ইম্পেরিয়ালে সেদিন সন্ধ্যায় অন্তত আরো চারজন এই দুজনের সাক্ষাৎকারের সাক্ষী ছিলেন।তাঁরা হলেন মহলানবীশ দম্পতি,ফ্রয়েড কন্যা তথা পরবর্তীকালে প্রখ্যাত NeoFreudian আনা ফ্রয়েড ও শ্রীমতি মার্থা ফ্রয়েড । প্রশান্ত মহলানবীশই ফ্রয়েড ও কবির একমাত্র যুগ্ম ছবিটি তুলেছিলেন ।
কী কথা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে? আশ্চর্যের বিষয় এই কথোপকথনের কোনও রেকর্ড নেই।রবীন্দ্রনাথ নীরব। ফ্রয়েডের মেয়ে ও নির্মলা মহানবীশের লেখার সূত্রে সামান্যই তথ্য পাই।আনা লিখছেন, 'We found him ailing and tired, but he is a wonderful sight, he really looks like we imagined the lord God looks like...'।
ফ্রয়েডের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ অবশ্য ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেছিলেন।২২ অক্টোবর ১৯৩৯ অমিয় চক্রবর্তীর কাছে লেখা একটি চিঠিতে, কীভাবে অবদমিত ঘটনা লেখকের অবচেতনকে প্রভাবিত করে এবং সাহিত্যে তার প্রতিফলন ঘটে, সেই নিয়ে লিখেছিলেন।
আর এমনটি তো হবেই, দু'টি ইথারতরঙ্গের দ্রাঘিমারেখা একটি বিন্দুতে এসে পরস্পরের মুখ দেখবে।ফ্রয়েড 'সাধনা' পড়বেন আর রবীন্দ্রনাথ হয়তো 'দি ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমস'!
(সংগৃহীত)
ফ্রয়েডের ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে শোভা পাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের 'সাধনা', এমন একটা খবর পড়ার পর থেকে ভেতর ভেতর খুব আন্দোলিত হয়েছিলাম।
'সাধনা' আসলে ৮ টি বক্তৃতার সঙ্কলন গ্রন্থ।১৯১৩-তে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে থেকেই রবীন্দ্রনাথের কবি খ্যাতি দেশে দেশে পৌঁছে গিয়েছিল।এজরা পাউন্ড তাঁর কবিতা শুনে 'পোয়েট্রি' পত্রিকার সম্পাদক হ্যরিয়েট মনরোকে অনুরোধ করলেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা ছাপাতে।রবীন্দ্রনাথের ৬ টি কবিতা 'পোয়েট্রি' র ডিসেম্বর ১৯১২- তে প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯১২-তে রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত ভ্রমণে প্রথম আমেরিকা যান।তখন ইউনিটারিয়ান চার্চে তাঁর বক্তৃতার আয়োজন করা হয়।প্রথম বক্তৃতা ১০ নভেম্বর ১৯১২!এটি বহুল প্রশংসিত হলে আরও তিনটি বক্তৃতার জন্য অনুরোধ করা হয়।১৭ ও ২৪ নভেম্বর এবং ১ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ তাঁর বক্তৃতা দেন।বিষয়:
World Realisation
Self Realisation
Realisation of Brahma
The Way of Action
এখান থেকেই 'সাধনা' গ্রন্থের সূত্রপাত।১৫ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ অজিত চক্রবর্তীকে লিখছেন, 'একানকার অধ্যাপকরা প্রায় সকলেই উপস্থিত ছিলেন।আমার ভাগ্যক্রমে তাঁদের ভাল লেগে গেল'!
ইউনিটারিয়ান চার্চের বক্তৃতা শেষ হতে না হতেই ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতীয় দর্শনের ওপর দশটি বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ এল।হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বভাগ থেকে এল ছয়টি বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ। এছাড়া শিকাগো, উইসকনসিন, আয়োয়া, মিশিগাননও পারডুয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও আমন্ত্রণ এল।
হার্ভার্ডে প্রথম বক্তৃতাটির দিন ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯১৩-তে নির্ধারিত হলেও কোনও অজানা কারণে তা হল না।রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় বক্তৃতাটি দিলেন ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯১৩!পরেরটি ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯১৩এবং শেষেরটি ৯ এপ্রিল ১৯১৩ রাতে!হার্ভার্ডে তিনটি বক্তৃতার বিষয়বস্তু :
The Problem of Evil
The Problem of Self
Realisation through Love
এদিকে বক্তৃতাগুলোর প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ল।ম্যডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ে 'The Relation of the Individual to the Universe' প্রবন্ধটি পাঠ করলেন।এবার এগুলো প্রকাশ করবার অনুরোধ আসতে লাগল।ম্যাকমিলান কোম্পানি দায়িত্ব নিলেন প্রকাশের।আরনেস্ট রাইস নিলেন প্রুফ দেখবার ভার।১৯১৩-তে প্রকাশিত হল 'Sadhana, the Realisation of Life'!
'সাধনা' নামটির একটি গভীর তাৎপর্য আছে।আধ্যাত্মিক প্রকৃতির মানুষ পারমার্থিক সিদ্ধি চান, মোক্ষলাভ করতে চান ও মুক্তি চান।ভারতীয় সনাতন ধর্মে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই চতুর্বর্গকে সাধনার লক্ষ বলা হয়েছে।রবীন্দ্রনাথ উপনিষদের আলোকে, আটটি প্রবন্ধে এইসব কিছু আলোচনা করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের 'শান্তিনিকেতন' আমার অত্যন্ত প্রিয় একটি বই।আমার মনে হয়েছে 'সাধনা'র প্রবন্ধগুলো মেজাজের দিক থেকে 'শান্তিনিকেতন'- এর কিছু প্রবন্ধের কাছাকাছি।এবং যে জন্য নাস্তিকতা বা আস্তিকতা প্রবন্ধগুলো পাঠে বাধা হয়না।ফ্রয়েডেরও নিশ্চয় হয়নি।
আহা! কী গভীর ও নির্জন এই উচ্চারণ :
'প্রেমের মধ্যে অস্তিত্বের সমস্ত বৈপরীত্য নিজেদের নিমগ্ন করে ও হারিয়ে যায়।একমাত্র প্রেমের মধ্যে অদ্বৈত ও দ্বৈত বিরুদ্ধ হয় না।প্রেমকে একই সময়ে এক ও দুই হতে হয়।'
'আত্মপ্রেম'-এর বিনাশের কথা ফ্রয়েডও বলেছিলেন।আসলে 'অপর' হতে চাওয়া শেষ পর্যন্ত সমস্ত ভাবুকের বুঝি নিয়তি।তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের ছবি যে 'ভলকানিক ব্যাপার এক একটা', তা কি ফ্রয়েডের অবচেতনার তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না?
তো সত্যিই কি দেখা হয়েছিল এই দুই মনিষীর? দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অগ্নিভ ঘোষের সঙ্গে কথা হচ্ছিল।হ্যাঁ, অন্ততপক্ষে একবার দেখা হয়েছিল।
২৫ অক্টোবর ১৯২৬। ভিয়েনাতে কবি ফ্রয়েডকে চায়ের নেমন্তন্নে ডেকেছিলেন।ভিয়েনার হোটেল ইম্পেরিয়ালে সেদিন সন্ধ্যায় অন্তত আরো চারজন এই দুজনের সাক্ষাৎকারের সাক্ষী ছিলেন।তাঁরা হলেন মহলানবীশ দম্পতি,ফ্রয়েড কন্যা তথা পরবর্তীকালে প্রখ্যাত NeoFreudian আনা ফ্রয়েড ও শ্রীমতি মার্থা ফ্রয়েড । প্রশান্ত মহলানবীশই ফ্রয়েড ও কবির একমাত্র যুগ্ম ছবিটি তুলেছিলেন ।
কী কথা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে? আশ্চর্যের বিষয় এই কথোপকথনের কোনও রেকর্ড নেই।রবীন্দ্রনাথ নীরব। ফ্রয়েডের মেয়ে ও নির্মলা মহানবীশের লেখার সূত্রে সামান্যই তথ্য পাই।আনা লিখছেন, 'We found him ailing and tired, but he is a wonderful sight, he really looks like we imagined the lord God looks like...'।
ফ্রয়েডের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ অবশ্য ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেছিলেন।২২ অক্টোবর ১৯৩৯ অমিয় চক্রবর্তীর কাছে লেখা একটি চিঠিতে, কীভাবে অবদমিত ঘটনা লেখকের অবচেতনকে প্রভাবিত করে এবং সাহিত্যে তার প্রতিফলন ঘটে, সেই নিয়ে লিখেছিলেন।
আর এমনটি তো হবেই, দু'টি ইথারতরঙ্গের দ্রাঘিমারেখা একটি বিন্দুতে এসে পরস্পরের মুখ দেখবে।ফ্রয়েড 'সাধনা' পড়বেন আর রবীন্দ্রনাথ হয়তো 'দি ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমস'!
(সংগৃহীত)