রাত ৩টা ৩০ মিনিট। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল এরিনের। একটা অসহনীয় অথচ অস্বস্তিকর অনুভূতি হতে থাকল তার। বুকের কাছে হাত দিয়ে দেখল হৃৎপিণ্ড প্রচণ্ড গতিতে লাফাচ্ছে। মুহূর্তেই ঘেমে গেল কপাল, মুখ, হাতসহ সারা শরীর। তীব্রভাবে কাঁপতে থাকল সে। মনে হলো কেউ যেন জোরালোভাবে তার গলা চেপে ধরেছে; প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হতে শুরু করল। বাতাসের প্রয়োজনে হাঁপাতে থাকল সে। হঠাৎ বুকে ব্যথা শুরু হলো।
পেটে মোচড় দিয়ে বমি হওয়ার উপক্রম হলো। তীব্র গরম লাগতে থাকল তার। হাত-পা অবশ হয়ে আসতে লাগল। মাথা ঘোরা শুরু হলো; তার মনে হলো সে পড়ে যাবে। চারপাশের সবকিছু অবাস্তব লাগতে থাকল। সে আর নিজের ভেতরে নেই, এমন অনুভব করতে থাকল। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে বলে মনে হলো তার। মনে হতে থাকল, এই বুঝি হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাবে। প্রচণ্ড মৃত্যুভীতি তাকে গ্রাস করতে থাকল।
এই ঘটনা যে কারও ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে। এটা মূলত প্যানিক অ্যাটাক। প্যানিক অ্যাটাক একধরনের মানসিক সমস্যা। আমেরিকার একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রতিবছর প্রতি ৯ জনের মধ্যে একজনকে প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত পাওয়া যায়। ইউরোপ বা অন্যান্য জায়গায় এই সংখ্যাটা একটু কম।
প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যাঁদের বয়স কম, তাঁদের মধ্যেই এটি বেশি দেখা যায়। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের মধ্যে এটি প্রায় দ্বিগুণ বেশি। মস্তিষ্কের কিছু রাসায়নিক উপাদান যেমন সেরোটোনিন, নরএপিনেফ্রিন, গামা অ্যামিনো বিউটাইরিক অ্যাসিড (গাবা) ইত্যাদির স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়া এবং ভয় নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সম্পর্কিত স্থান যেমন অ্যামিগডালা, হাইপোথ্যালামাস, হিপপোক্যাম্পাস, প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স ইত্যাদির কাজের ত্রুটির জন্য এটি হয়ে থাকে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এটি সাধারণত ৩০ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয় না। এটি ঘুমের মধ্যেও হতে পারে আবার জেগে থাকা অবস্থায়ও হতে পারে।
হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হয়ে যাচ্ছে ভেবে রোগী প্রচণ্ড আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। কিন্তু বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তেমন কিছু ধরা পড়ে না। একবার প্যানিক অ্যাটাক হলে পরবর্তী অ্যাটাকের সময় ও পরিণতি নিয়ে অনেকের মধ্যে একটা ভয় বা উদ্বেগ কাজ করে। অনেকের মধ্যে আবার অ্যাগোরাফোবিয়া দেখা যায়।
এ ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি যেসব স্থানে বিপদ হলে সাহায্য পাওয়া বা মুক্তি পাওয়া কঠিন মনে করেন, সেসব স্থানে গেলে বা যাওয়ার কথা ভাবলে প্রচণ্ড উদ্বেগ অনুভব করেন। এ জন্য তাঁরা সেসব স্থান যেমন বাসা থেকে দূরে কোনো জায়গা, আবদ্ধ জায়গা (লিফট, বাস, ট্রেন ইত্যাদি), ভিড় কিংবা খোলা জায়গা ইত্যাদি এড়িয়ে চলেন। এ ছাড়া সঙ্গে অন্য মানসিক রোগও থাকতে পারে।
ব্যক্তির জন্য প্যানিক অ্যাটাক একটি ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। এর ফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে কর্মক্ষমতাও হ্রাস পায়। কিন্তু উপযুক্ত চিকিৎসা পেলে এই সমস্যা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া সম্ভব। ওষুধ ও সাইকোথেরাপির মাধ্যমে এর চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। তাই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় শারীরিক কোনো রোগ পাওয়া না গেলে দ্রুত মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
* লেখক: ডা. মো. আরিফুজ্জামান | এমডি রেসিডেন্ট, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা