What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected প্রিয় বান্ধবী!! (2 Viewers)

dukhopakhi

Global Moderator
Staff member
Global Mod
Joined
Mar 3, 2018
Threads
104
Messages
12,463
Credits
114,796
Calculator
Calculator
Calculator
Mosque
Calculator
LittleRed Car
"সংগৃহীত"

প্রিয় বান্ধবী

মূল লেখকঃ মুস্তাফিজুর রহমান টিটু

কলি
“তোর কলেজেই আগামী মাসে যোগ দিচ্ছি ।
ইতি প্রিয় বান্ধবী ঝরনা “
ক্লাশ শেষে নিজের রুমে ফিরেই টেবিলে চিঠিটা দেখে একটু অবাক হয়েছিলাম । মোবাইল যুগ প্রায় আসন্ন । এখানে এখনো মোবাইল নেটওয়ার্ক নাই । তবুও আজকাল কেউতো চিঠি লিখে না । খামটা খুলে এই এক লাইনের চিঠি পড়ে অবাকের চাইতেও অন্য অনুভুতি প্রবল হলো । দশ বছর নাকি তারও বেশী । এত বছর পরে বান্ধবীর সাথে দেখা হবে ..খুশী হবারইতো কথা । কিন্তু মনটা ছেয়ে গেলো উদ্বেগ আর চিন্তাতে । কেনো ? কোথা থেকে শুরু করি ।

আচ্ছা ঝরনার লেখা ‘প্রিয় বান্ধবী’ কথাটা দিয়েই শুরু করি । আমার আর ঝরনার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সবাই এরকমই জানতো । কিন্তু আসলে এটা একটা মিথ । এর পিছনে একটা গল্পও আছে । ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর আমি আর ঝরনা দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলাম । এক বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়লেই অবশ্য বেশী খুশী হতাম । আমি নিশ্চিত ঝরনাও একই কথা বলবে । তারও লম্বা কাহিনী আছে । ধ্যেত কি কথা থেকে কি কথা বলা শুরু করলাম ।

যাই হোক দুজনে অবশ্য দুই ডিপার্টমেন্টে । আমি ভুগোল আর ঝরনা সোসিওলজি । কিন্তু হল আবার একই । শামসুন্নাহার হল । ক্লাস শুরু হবার কিছুদিন পরের ঘটনা । হল থেকে বের হয়েছি ক্লাসের উদ্দেশ্যে । বেশ কিছুটা দেরী হয়ে গেছে । এই স্যার আবার বেশ কড়া । এমনিতেই মফশ্বল থেকে এসেছি । ‘অন্যরা আমাকে নিয়ে আড়ালে হাসে’ এরকম একটা বাড়তি চাপ নিয়ে সবসময় থাকি । দেরীর কারনে স্যার যদি সবার সামনে বেইজ্জতি করে । কত যে উদ্বেগ ... । এই অবস্থায় হল থেকে বের হয়েই দেখি মিছিল । মিছিল দেখলেই আবার আমার কেমন জানি ভয় করে । সব সময় মিছিল দেখলেই দুরে দুরে থাকি । কিন্তু মিছিল শেষ হবার অপেক্ষায় থাকলে আজকে আরো দেরী হবে । তাই আল্লাহর নাম নিয়ে মিছিলের পিছে পিছে হাটা শুরু করলাম । হঠাৎ সামনে কয়েকটা শব্দ শুনতে পেলাম । মিছিলের লোকজন মুহূর্তেই এদিক সেদিক দৌড়ানো শুরু করলো । কয়েক সেকেন্ড পরেই ধোঁয়া দেখতে পেলাম । সাথে চোখজ্বলা । আমি ততক্ষণে ভয়ে আধমরা । কি করবো কোথায় যাবো বুঝতে পারছিলাম না । সম্বিত ফিরে উল্টোদিকে ফিরে দৌড়ানোর চেষ্টা করলাম । সেদিন আবার একটু হিল জুতা পড়েছিলাম । দুই তিন কদম আগাতেই কিসে জানি হোচট খেলাম । তারপর আর আমার কিছু মনে নাই । জ্ঞান ফিরে দেখি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি । কপালের একপাশে একটু ব্যান্ডেজ । চারপাশে বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব এর মাঝে ঝরনাও আছে । আঘাত তেমন গুরুতর না হওয়াতে ঐ রাতেই হলে ফিরি । ঐ রাতে এবং পরের কয়েকদিন আমাকে দেখলেই সবার একটাই গল্প । আমার আর ঝরনার বন্ধুত্বের গল্প । সেদিন নাকি অজ্ঞান আমাকে কোলে নিয়ে গুলির মাঝেই ঝরনা এক কিলোমিটার হেটেছে । “আহা কি টান । বান্ধবী হলে এমনই হওয়া উচিৎ ।“ শেষ কথাটা বলার সময় অনেকেরই একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস পড়ে ।

কিন্তু ঝরনার আর দেখা পাই না । প্রায় চার পাঁচদিন পরে হলের ডাইনিং থেকে বের হবার সময় দেখি ঝরনা ঢুকতাছে ।
-কিরে আমাকে বাচাইয়া তোর যে আর দেখা নাই । আমি জিজ্ঞেস করি ।
-আজাইরা প্যাচাল রাখ । কি বলবি বল ।
-নাহ এমনি । তোর পাশে বসে একটু কথা বলি ।
-খাওয়ার সময় একজন পাশে হাত গুটাইয়া আমার মুখের দিকে চাইয়া আছে । আমি খাইতে পারুম না ।
-তাইলে তুই খাইয়া আয় । আমি বাইরে অপেক্ষা করি ।
-তোর সময় থাকলে অপেক্ষা কর । বলে ঝরনা চলে যায় । আমি আসলেও অপেক্ষা করি । ঝরনা মনে হয় ইচ্ছা করেই দেরী করে । আমাকে কাটাবার জন্য । অনেকক্ষণ পরে ডাইনিং থেকে বের হয় ।
-তুই এখনো খাড়াইয়া আছস । কি বলবি বল ।

-চল কমনরুমে যাই । আমি বলি ।

কমনরুমে বসতেই ঝরনা বলে তোকে আগে একটা মিথের গল্প বলি শোন ।
-এক লঞ্চে হঠাৎ একটা বাচ্চা পানিতে পড়ে গেলো । একটু পরেই এক যাত্রী পানিতে ঝাপাইয়া পইড়া বাচ্চাটাকে পানি থেকে উঠাইয়া আনলো । সবাই সেই যাত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ । বিভিন্ন সংঘঠন তাকে পুরষ্কার দেবার জন্য ডাকে । প্রতিবার পুরষ্কার নেবার সময় সেই যাত্রী বিড়বিড় করে বলে “কোন হালায় যে পিছন থেকে ধাক্কাটা মারলো এখনো বুঝবার পারলাম না ।“
-এই গল্পের মানে কি ? আমি একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করি ।
-তোর মাথায়তো সারাজীবনই একটু বুদ্ধি শর্ট । তুই বুঝবি না এইটাই স্বাভাবিক । অন্য সময় হলে এই কথা শোনার পরে রেগে যেতাম । কিন্তু সেদিন রাগি না । নরম গলায় বলি …
-তোকে অনেক ধন্যবাদ । আমাকে নিয়ে এক কিলোমিটার হাটছস । তাও আবার গোলাগুলির মধ্যে ।
-হলের ডাইল খাইয়া দেখি শুধু শরীরই মোটা হয় নাই । বুদ্ধিও মোটা হইয়া গেছে । ঝরনা আবারো হুল ফোটানো কথা শুরু করে । আমি আর উত্তর দেই না ।
-শোন পুরা কাহিনী তোরে বলি । একটু নরম গলাতে বলে ঝরনা ।
-আমিও মিছিলের পিছনে পিছনে যাচ্ছিলাম । তুই দেখস নাই কারণ তোরও কিছুটা পিছনে ছিলাম । হঠাৎ দেখি সবাই দৌড়াইতাছে । আর তুই রাস্তার মাঝখানে ব্যাক্কলের মত একা খাড়াইয়া আছস । আমিও দৌড়ানো শুরু করছি এমন সময় দেখি তুই রাস্তায় পইড়া আছস । কাছে যাইয়া দেখি তোর কপাল দিয়া রক্ত বাইর হইতাছে । তোরে পাঁজাকোলা কইরা পনের/বিশ কদম হাটতেই কিছু ছেলে একটা রিক্সা এনে দেয় । এই হলো কাহিনী । আল্লায় দিলে তোর যা ওজন হইছে পনের/বিশ কদম হাটতেই আমার জান বাইর হইয়া গেছে । এক কিলোমিটার হাটলে আমারে আর খুইজা পাওয়া যাইতো না । আর ঐদিন কোনো গোলাগুলি হয় নাই । পুলিশ কয়েক রাউন্ড কাঁদানে গ্যাস মারছিলো মনে হয় । এখন সবাই যখন বিভিন্ন গল্প বানায় তখন আমার লঞ্চের ঐ যাত্রীর কথাই মনে হয় । ঝরনা স্বভাবসুলভভাবে হাল্কা গলাতেই গল্পটা বলে যায় । কিন্তু এই মিথের গল্প শুনেও আমার চোখ দিয়ে পানি চলে আসে । কৃতজ্ঞতায় । ইচ্ছা করে বলতে “যাত্রী পানিতে না হয় ইচ্ছা করে লাফ দেয় নাই । কিন্তু বাচ্চাটাকে না উঠাইয়া নিজেওতো উঠে আসতে পারতো । তুইওতো আমাকে ইচ্ছা করলেই রাস্তায় ফেলে আসতে পারতি । বিশেষ করে তোর সাথে আমার যে সম্পর্ক ।“ কিন্তু এসব অব্যক্তই থাকে ।

ঝরনার সাথে আমার সমস্যা অনেকদিনের পুরোনো । ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন । একই স্কুলে । রোজার ঈদের নতুন জামাটা কি মনে করে ঝরনাকে দেখালাম । ঈদের দিন যেখানেই যাই বান্ধবীরা দেখি একটু কানাঘুষা করছে । একজনকে চেপে ধরতেই যা শুনলাম তাতে আমার সমস্ত ঈদটাই মাটি হয়ে গেলো । ‘আমার জামাটার কি রঙয়ের কেমন এটা নাকি সবাই আগে থেকেই জানে । কারণ এটা নাকি আমাদেরই কোনো এক বান্ধবীর বড় বোনের পুরোনো জামা । ‘ কোন বান্ধবী সেটা অবশ্য বলে নাই । কিন্তু এটা সহজেই বুঝতে পারি । রাগে দুঃখে আমার চোখে পানি চলে আসে ।

সেই শুরু । এরপরে ক্লাসে একবার ঝরনা ফার্স্ট হলে পরেরবার আমাকে ফার্স্ট হতেই হয় । যদি টের পেতাম কোনো ছেলেকে ঝরনার একটু ভালো লেগেছে সাথে সাথেই ঐ ছেলের সাথে নিজে যেচে পরে কথা বলতাম । কথা বলার ফাকে ঝরনা সম্বন্ধে দুই একটা এমন কথা বলতাম যাতে যেকোনো বুদ্ধিমান ছেলে একশ হাত দুরে চলে যায় । একই কাজ ঝরনাও করতো । তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে কখনো কোনোদিন ঝরনার সাথে সামান্য ঝগড়াটাও হয় নাই ।

সেই ঝরনাই ইউনিভার্সিটির প্রথম থেকেই সবার কাছে হয়ে গেলো আমার ‘প্রিয় বান্ধবী’ । অনেক সময়ই মিথ সত্যের চাইতেও বেশী শক্তিশালী । আসল কাহিনী আমিও যেমন কাউকে বলতে পারতাম না ঝরনারও ছিলো একই অবস্থা । তবে এরপরেও আমাদের দ্বৈরথ ঠিকই চলেছে । ছোটগুলি আর না বলি । বড় একটাই বলি ।

ইউনিভার্সিটির শেষের দিকের কাহিনী । রাজনীতি থেকে সবসময়ই দুরে ছিলাম । তারপরও কিভাবে কিভাবে যেনো হল সংসদের একটা ছোট পদে দাঁড়িয়ে গেলাম । মানে অন্যরা জোর করে দাঁড়া করিয়ে দিলো । যে দলের হয়ে দাড়ালাম তারা এমনিতেই সব পদে জিতবে । আমারো না জেতার কোনোই কারণ নাই । কিন্তু ইলেকশনের কয়েকদিন আগে হলের রুমে ঢুকে দেখি তুলি দেখি থম্থমে মুখে বসে আছে । কিছুক্ষণ আগে কান্নাকাটি করেছে সে লক্ষণও স্পষ্ট । তুলি ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ে । আমাদের একই শহর এবং একই কলেজ পাশ করে এসেছে । হলে এখনো সিট পায় নাই বলে আমার সাথে ডাবলিং করছে । এরকম অনেকেই করে । মেয়েটাকে আমার বেশ পছন্দ । আর তুলিও আমাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে ।

-কিরে থোম্বা মুখে বসে আছিস কেনো ? আমি জিজ্ঞেস করি ।
-কলি আপা ড্রয়ার খুলে আমার জিনিষগুলো দেও । আজ রাতেই আমি মামার বাসায় চলে যাবো । যে কয়দিন সিট না পাই ওখান থেকেই ক্লাশ করবো ।
-কেনো কি হয়েছে ?
-কি হয়েছে আমি তোমাকে বলতে পারবো না ।
-ঠিক আছে । আমি একটু কমন্রুম থেকে আসি । তুই একটু শান্ত হয়ে বস । বলে আমি রুম থেকে বের হয়ে আসি । কমনরুমে আসতেই রুমার কাছ থেকে আসল ঘটনা শুনতে পাই । তুলিকে ক্লাসে কে নাকি ‘লেসু’ বলে আওয়াজ দিছে । লেসবিয়ানের সংক্ষেপ হলো ‘লেসু’ । আর ঘটনাটা নাকি আমার সাথে সিট ডাবলিং এর কারনেই । লজ্জায় অপমানে আমিও স্তম্ভিত হয়ে যাই । কোথা থেকে এরকম গসিপ আসতে পারে সেটা সম্বন্ধে আমার স্পষ্ট ধারনা থাকা সত্ত্বেও কাউকে কিছু বলতে পারি না । কারণ একেতো ‘প্রিয় বান্ধবী’ তার উপর দলের জন্য ঝরনা অনেক খাটাখাটনি করে । আমার চাইতে কয়েকগুন বেশী । শুধু এই গুজবের কারনেই আমার দলের বাকি সবাই ইলেকশনে পাশ করলেও আমি ফেল করলাম ।

তবে আমিও শোধ নিয়েছিলাম । লজ্জার মাথা খেয়ে এক ছোট ভাইয়ের কাছে অনেকগুলো পর্ণোগ্রাফিক ম্যাগাজিন আর সিডি যোগাড় করেছিলাম । বলেছিলাম এক বান্ধবীর দরকার ‘সমাজে পর্ণের কুপ্রভাব নিয়ে থিসিস লিখবে’ তাই । ছোট ভাই মিচকা হাসি দিয়েছিলো । তবে ঠিকই যোগাড় করে দিয়েছিলো । তারপর সেগুলো ঝরনার হলের বিছানার নীচে রাখতে তেমন সমস্যা হয় নাই । লোক মারফত প্রভোস্টকে জানাইতেও সমস্যা হয় নাই । প্রভোস্ট এসে হাতেনাতে সেগুলো পেয়েও যায় । হল থেকে শোকজ, সাময়িক সাসপেন্ড অনেক ঝামেলাই যায় ঝরনার উপর দিয়ে ।

এই হলো আমার আর আমার ‘প্রিয় বান্ধবী’ ঝরনার গল্প । ইউনিভার্সিটি শেষ করার পরে বিয়ে, চাকুরী, সন্তান নিয়েই ব্যস্ত হয়ে যাই । সেভাবে যোগাযোগ না থাকলেও জানি ঝরনা আমার মতই বিসিএস দিয়ে কোনো কলেজে পড়ায় । আমি গত চার বছর যাবত স্বামী সন্তানের সাথে এই মফশ্বলে । স্বামীও সরকারী অফিসার । সব মিলিয়ে বেশ কিছুটা নিরুপদ্রব জীবন । সেখানে হঠাৎ এরকম ‘প্রিয় বান্ধবীর’ আগমন !! বাসায় ফিরে শোয়েবকে বললাম । ‘ভালোইতো এরকম মফশ্বল শহরে এতদিনের এক বান্ধবীকে পাবে’ । বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো শোয়েব । আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম । আমার এই সমস্যা আসলে কাউকে বলতেও পারবো না, বোঝানোতো অনেক দুরের ব্যাপার ।

পরের মাসেই ঝরনা এসে পড়ে । স্বামী সন্তান সহ । ওর স্বামীও শোয়েবের মত সরকারী অফিসার । একসাথেই এখানে বদলী হয়েছে । ছেলেটাও আমার সন্তান সায়ান এর বয়সী । দেখা হতেই দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে উচ্ছাস দেখালাম । পুরোনো বান্ধবীরা যেমন দেখায় । কিন্তু এরপর থেকেই খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলাম । একটু মোটা হয়েছে ঝরনা । তবে চেহারায় বাড়তি একটু লাবণ্যও যোগ হয়েছে । তার মানে বেশ সুখেই আছে ঝরনা । স্বামী বেচারাকে অবশ্য একটু গোবেচারা লাগছে । শোয়েবের মত স্মার্ট না । এই সামান্য আবিষ্কারেও কোথা থেকে যেনো একটু সুখের বাতাস লাগে মনে ...
-জানিসতো । বাসা ভাড়া নিয়ে ফেলেছি ।
-বাসাতো নিবিই । কিছুদিন আমার বাসায় থাক না । আমি আন্তরিকভাবেই বলি । শোয়েবও আমার সাথে সায় দেয় ।
-নারে বাবুল ঠিক করে ফেলেছে । ওহ আবার খুব গোছালো স্বভাবের । বাসা, সানির জন্য স্কুল সব ঠিক করে ফেলেছে ।

পরেরদিন সকালেই ঝরনা নিজের বাসায় উঠে যায় । একেবারে নতুন বাসা । অনেকটা খোলামেলা । ঐ বাসা থেকে ফিরেই নিজের বাসা আর ভালো লাগে না । শোয়েবকে রেগে বলি
-একটা বাসাতেই চার বছর হয়ে গেলো । তুমি এত কুইড়ার বাদশা হয়ে গেলা কবে থেকে । একটা সুন্দর বাসা দেখো না ।
-সেদিনই না তুমি বললা যতদিন এই শহরে আছি এই বাসাতেই থাকবো । বাড়িওয়ালা এত ভালো । আলো বাতাসও প্রচুর । শোয়েব অবাক গলায় উত্তর দেয় । আসলেও বলেছিলাম । কিন্তু কিভাবে বুঝাই তখনতো ‘প্রিয় বান্ধবী’ ছিলো না ।

ঝরনার ছেলে সানি আর আমার ছেলে সায়ানের স্কুলও এক । হঠাৎ করেই সায়ানের পড়াশুনার ব্যাপারেও বাড়তি নজর দিতে শুরু করি । ঝরনার ছেলের চাইতে এক নম্বর হলেওতো বেশী পেতে হবে ।

এভাবেই দিন যায় । কলেজেও সবাই জানে আমি আর ঝরনা ‘প্রিয় বান্ধবী’ । এর মাঝেই কলেজের পিকনিক চলে আসে । সবার সাথে আমরাও যাই । আমি সায়ানকে নিয়ে নিজেদের গাড়িতে যাই । ঝরনা সানিকে নিয়ে পিকনিক বাসে । এর মাঝেই সায়ান আর সানি খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেছে । যেখানেই যায় দুজন একসাথে থাকে । পিকনিক শেষে সানি সায়ানের সাথেই আমাদের গাড়িতে উঠে বসলো । ঝরনা সানিকে ডাকাডাকি করলেও আমি বললাম
-তুইও আমার গাড়িতেই আয় না । একসাথে গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে ।
-নারে প্রিন্সিপ্যাল স্যারের সাথে কিছু কথা আছে । পিকনিকের হিসাব নিকাশ নিয়ে । ঝরনা সুযোগ পেয়ে নিজের গুরুত্বটা একটু প্রকাশ করলো । আমার বিরক্ত লাগলো । আমি এই কলেজে আছি চার বছর । আর তুই সেদিন এসে যোগ দিলি । আমার কাছে তোর এসব গল্পের কোনো মানে আছে । তবে মুখে কিছু বললাম না ।
-ঠিক আছে সানিকে তোর বাসাতে পৌছে দেবো । বলে চলে আসলাম । দুই ছেলে গাড়িতে বসে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিলো । সারাদিনের পিকনিকের ধকলে আমি একটু চোখ বুঝেছিলাম । হঠাৎ বিকট শব্দ আর প্রবল ঝাকুনিতে ঝিমানি ভাবটা মুহূর্তেই কেটে যায় । কিভাবে কি হয়েছে কিছুই জানি না । গাড়ি রাস্তার পাশে একটু ঢালুতে থেমে আছে । ড্রাইভারের সাইডের গ্লাস ভাঙ্গা । ঐ সাইডেই সানি বসেছিলো । সেই জানালারও কাঁচ ভাঙ্গা । সানির মনে হয় জ্ঞান নাই । তবে সায়ান কান্নাকাটি করলেও ঠিক আছে । নিজেকে অক্ষতই মনে হয় ।
-ম্যাডাম একটা ট্রাক সাইড দিয়া মাইরা দিছে । ড্রাইভার পিছনে ফিরে আমাকে বললো ।
-তুমি ঠিক আছোতো । আমি জিজ্ঞেস করি ।
-নাহ ম্যাডাম । হাতে আর বুকে খুব ব্যথা । হাত মনে হয় ভাইঙ্গা গেছে ।

মনে মনে আল্লাহকে ডাকি । নিজের দিকের দরজা খুলে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসি । একটু সামনে আসতেই বুকটা ছ্যাত করে উঠে । আর দশ গজ এগোলেই বিশাল খাদ । ওখানে গাড়ি পড়লে কি হতো ভাবতেও ভয় লাগে । সন্ধ্যা হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগেই । এই সময়ে রাস্তায় দুরপাল্লার বাস ছাড়া অন্য গাড়ি আসার সম্ভাবনা কম । আর বাস ড্রাইভাররা সাধারনত হাত তুললেও গাড়ি থামায় না । এভাবে বাস ডাকাতির গল্পওতো কম না । অনেক চেষ্টা করেও ড্রাইভার কিংবা সানির দিকের দরজা খুলতে পারি না । আবার গাড়িতে ফিরে আসি । সানি তখনো জ্ঞানহীন । গাড়ির অল্প আলোতে কেমন নির্জীব লাগে । কেনো যেনো মনে হয় বেশী সময় হাতে নাই । একবার সায়ানের মুখের দিকে একবার সানির মুখের দিকে তাকাই ।
-গাড়ির ইঞ্জিন ঠিক আছে ? আমি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করি ।
-জ্বি ম্যাডাম আছে ।
-তুমি পাশের সিটে সরে আসতে পারবে ।
-জ্বি ম্যাডাম পারবো । বলে অনেক কষ্টে ড্রাইভার পাশের সিটে গিয়ে বসে । অন্ধকার হয়ে গেলেও জায়গাটা আমার চেনা । ছয় সাত কিলোমিটার দুরে একটা প্রাইভেট হাসপাতাল আছে । শুনেছি চিকিৎসা ভালোই । আমি কোনোমতে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলাম । শোয়েবের অনেক পীড়াপীড়িতে দুইদিন ড্রাইভিং শিখতে বসেছিলাম । তাও প্রায় বছরখানেক আগে । আল্লাহ আল্লাহ করে গাড়ির চাবি ঘুরালাম । ইঞ্জিন একবারেই চালু হয়ে গেলো । গিয়ার দিয়ে এক্সিলারেটরে পা দিতেই গাড়ি নড়ে উঠলো । ধীরে ধীরে গাড়িকে রাস্তায়ও নিয়ে আসলাম । যতরকম দোয়া দুরুদ জানি পড়তে পড়তে রওয়ানাও হয়ে গেলাম । রাস্তা একদম ফাঁকা । হেডলাইটের আলো ছাড়া আর কোনো আলো নাই । কতক্ষণ পরে মনে নাই পরিচিত পেট্রোল পাম্পটা চোখে পড়লো । এর একটু পরেইতো হাসপাতালটা । হাসপাতালের গেট দিয়ে ঢুকে ব্রেক করলাম । সাথে সাথে হঠাৎ তীব্র ব্যথা নেমে এলো শরীরজুড়ে । এরপরে আর কিছু আমার মনে নাই ।

যখন জ্ঞান ফিরে তখন দেখি আমার দুই হাতেই সাদা প্লাস্টার । শোয়েব সায়ানসহ আরো অনেকেই দাঁড়িয়ে । সায়ানকে দাঁড়ানো দেখে স্বস্থি পাই । তার মানে ওর কিছু হয় নাই ।
-ইউ আর গ্রেট ম্যাডাম । চোখ মেলতেই একজন বলে । পোশাক দেখে বুঝতে পারি হাসপাতালের ডাক্তার হবেন ।
-দুই হাতে ফ্রাকচার নিয়ে, সেইভাবে ড্রাইভিং না জেনেও এতটা পথ কেউ ড্রাইভ করতে পারে । অবিশ্বাস্য । ছোট ছেলেটাকে আর একটু দেরী করে আনলেই হয়তো বাচানো যেতো না । প্রচুর ইন্টারনাল ব্লিডিং হয়েছিলো ।
-এখন কেমন আছে সানি ? ডাক্তারের কথার মাঝখানেই আমি জিজ্ঞেস করি ।
-এক ব্যাগ রক্ত দিয়েই জেলা সদরে এম্বুলেন্স করে পাঠিয়ে দিয়েছি । কিছুক্ষণ আগেই ফোনে খবর পেয়েছি এখন আশংকামুক্ত ।
-ড্রাইভার ?
-তার শুধু কয়েকটা হাড় ভেঙ্গেছে । এমনিতে ভালো আছে । উত্তর দিয়ে একটু অন্যদিকে যান ডাক্তার ।
-দেখেছো ড্রাইভিংটা শিখে রাখলে কত কাজে লাগে । শোয়েব মৃদু হেসে বলে ।
-তবে পাগলামিটা একটু বেশী করে ফেলেছো । বলে কপালে হাত রাখে শোয়েব । সামান্য স্পর্শ তাতেই কেমন প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে মনে ।

হাসপাতালেই রাতটা কাটাতে হয় । ভোরে ঘুম থেকে উঠেই দেখি ঝরনা বিছানার পাশে বসে আছে ।
-কেমন আছিস তুই ? চোখ মেলতেই আকুল হয়ে প্রশ্ন করে ঝরনা ।
-ধুর আমিতো ভালোই আছি । আমার হাতে যে ফ্রাকচার আমি নিজেই টের পাই নাই । ডাক্তার বানাইয়া বানাইয়া বলছে কিনা কে জানে । সানি কেমন আছে ?
-বিপদমুক্ত । তুই না থাকলে...তুই দুই হাতে ফ্রাকচার নিয়া এতটা পথ ?
-ধুর কতটা পথ ?
-সবাইতো বলে চল্লিশ কিলোমিটার ।
-শোন তোর সেই মিথের গল্প মনে আছে । পনের বিশ কদম হাটলে যেমন এক কিলোমিটার হয় সেরকম ছয় সাত কিলোমিটারও চল্লিশ কিলোমিটার হয় ।
-তারপরো...তুই না থাকলে সানিকে মনে হয় বাচানো... আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে ঝরনা । কথা শেষ করতে পারে না । আমার একটু বিরক্ত লাগে ।
-শোন ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদিস নাতো । ‘প্রিয় বান্ধবী’ অথবা ‘জানি দুশমন’ যাই হই না কেনো আমিওতো একজন মা । আর যেকোনো মা-ই একই কাজ করবে । চিন্তা করে দেখ সায়ানের এমন হলে তুই কি করতি । এত কিছু বলার পরেও ঝরনার কান্নার বেগ কমে না ।

-দুই হাতে ফ্রাকচার, মাথায়ও নাকি ব্যাথা ছিলো । ড্রাইভিং জানে না । পঞ্চাশ কিলোমিটার ড্রাইভ । বিশ্বাস করন যায় । বান্ধবী হইলে এমনই হইতে হয় । একটু দুরেই দুই নার্স নিজেদের মধ্যে গল্প করছে । হায়রে এখানেও সেই বান্ধবীর গল্প । আমি জানি এই গল্প এখন এভাবেই ডালপালা ছড়াবে । আমার অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না । ‘প্রিয় বান্ধবী’ নাকি কলেজের টিচার্স ইলেকশনে দাঁড়াবে । ওকে কিভাবে হারানো যায় সেই বুদ্ধিতো করতে হবে ...
 

Users who are viewing this thread

Back
Top