"সংগৃহীত"
প্রিয় বান্ধবী
মূল লেখকঃ মুস্তাফিজুর রহমান টিটু
কলি
“তোর কলেজেই আগামী মাসে যোগ দিচ্ছি ।
ইতি প্রিয় বান্ধবী ঝরনা “
ক্লাশ শেষে নিজের রুমে ফিরেই টেবিলে চিঠিটা দেখে একটু অবাক হয়েছিলাম । মোবাইল যুগ প্রায় আসন্ন । এখানে এখনো মোবাইল নেটওয়ার্ক নাই । তবুও আজকাল কেউতো চিঠি লিখে না । খামটা খুলে এই এক লাইনের চিঠি পড়ে অবাকের চাইতেও অন্য অনুভুতি প্রবল হলো । দশ বছর নাকি তারও বেশী । এত বছর পরে বান্ধবীর সাথে দেখা হবে ..খুশী হবারইতো কথা । কিন্তু মনটা ছেয়ে গেলো উদ্বেগ আর চিন্তাতে । কেনো ? কোথা থেকে শুরু করি ।
আচ্ছা ঝরনার লেখা ‘প্রিয় বান্ধবী’ কথাটা দিয়েই শুরু করি । আমার আর ঝরনার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সবাই এরকমই জানতো । কিন্তু আসলে এটা একটা মিথ । এর পিছনে একটা গল্পও আছে । ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর আমি আর ঝরনা দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলাম । এক বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়লেই অবশ্য বেশী খুশী হতাম । আমি নিশ্চিত ঝরনাও একই কথা বলবে । তারও লম্বা কাহিনী আছে । ধ্যেত কি কথা থেকে কি কথা বলা শুরু করলাম ।
যাই হোক দুজনে অবশ্য দুই ডিপার্টমেন্টে । আমি ভুগোল আর ঝরনা সোসিওলজি । কিন্তু হল আবার একই । শামসুন্নাহার হল । ক্লাস শুরু হবার কিছুদিন পরের ঘটনা । হল থেকে বের হয়েছি ক্লাসের উদ্দেশ্যে । বেশ কিছুটা দেরী হয়ে গেছে । এই স্যার আবার বেশ কড়া । এমনিতেই মফশ্বল থেকে এসেছি । ‘অন্যরা আমাকে নিয়ে আড়ালে হাসে’ এরকম একটা বাড়তি চাপ নিয়ে সবসময় থাকি । দেরীর কারনে স্যার যদি সবার সামনে বেইজ্জতি করে । কত যে উদ্বেগ ... । এই অবস্থায় হল থেকে বের হয়েই দেখি মিছিল । মিছিল দেখলেই আবার আমার কেমন জানি ভয় করে । সব সময় মিছিল দেখলেই দুরে দুরে থাকি । কিন্তু মিছিল শেষ হবার অপেক্ষায় থাকলে আজকে আরো দেরী হবে । তাই আল্লাহর নাম নিয়ে মিছিলের পিছে পিছে হাটা শুরু করলাম । হঠাৎ সামনে কয়েকটা শব্দ শুনতে পেলাম । মিছিলের লোকজন মুহূর্তেই এদিক সেদিক দৌড়ানো শুরু করলো । কয়েক সেকেন্ড পরেই ধোঁয়া দেখতে পেলাম । সাথে চোখজ্বলা । আমি ততক্ষণে ভয়ে আধমরা । কি করবো কোথায় যাবো বুঝতে পারছিলাম না । সম্বিত ফিরে উল্টোদিকে ফিরে দৌড়ানোর চেষ্টা করলাম । সেদিন আবার একটু হিল জুতা পড়েছিলাম । দুই তিন কদম আগাতেই কিসে জানি হোচট খেলাম । তারপর আর আমার কিছু মনে নাই । জ্ঞান ফিরে দেখি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি । কপালের একপাশে একটু ব্যান্ডেজ । চারপাশে বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব এর মাঝে ঝরনাও আছে । আঘাত তেমন গুরুতর না হওয়াতে ঐ রাতেই হলে ফিরি । ঐ রাতে এবং পরের কয়েকদিন আমাকে দেখলেই সবার একটাই গল্প । আমার আর ঝরনার বন্ধুত্বের গল্প । সেদিন নাকি অজ্ঞান আমাকে কোলে নিয়ে গুলির মাঝেই ঝরনা এক কিলোমিটার হেটেছে । “আহা কি টান । বান্ধবী হলে এমনই হওয়া উচিৎ ।“ শেষ কথাটা বলার সময় অনেকেরই একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস পড়ে ।
কিন্তু ঝরনার আর দেখা পাই না । প্রায় চার পাঁচদিন পরে হলের ডাইনিং থেকে বের হবার সময় দেখি ঝরনা ঢুকতাছে ।
-কিরে আমাকে বাচাইয়া তোর যে আর দেখা নাই । আমি জিজ্ঞেস করি ।
-আজাইরা প্যাচাল রাখ । কি বলবি বল ।
-নাহ এমনি । তোর পাশে বসে একটু কথা বলি ।
-খাওয়ার সময় একজন পাশে হাত গুটাইয়া আমার মুখের দিকে চাইয়া আছে । আমি খাইতে পারুম না ।
-তাইলে তুই খাইয়া আয় । আমি বাইরে অপেক্ষা করি ।
-তোর সময় থাকলে অপেক্ষা কর । বলে ঝরনা চলে যায় । আমি আসলেও অপেক্ষা করি । ঝরনা মনে হয় ইচ্ছা করেই দেরী করে । আমাকে কাটাবার জন্য । অনেকক্ষণ পরে ডাইনিং থেকে বের হয় ।
-তুই এখনো খাড়াইয়া আছস । কি বলবি বল ।
-চল কমনরুমে যাই । আমি বলি ।
কমনরুমে বসতেই ঝরনা বলে তোকে আগে একটা মিথের গল্প বলি শোন ।
-এক লঞ্চে হঠাৎ একটা বাচ্চা পানিতে পড়ে গেলো । একটু পরেই এক যাত্রী পানিতে ঝাপাইয়া পইড়া বাচ্চাটাকে পানি থেকে উঠাইয়া আনলো । সবাই সেই যাত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ । বিভিন্ন সংঘঠন তাকে পুরষ্কার দেবার জন্য ডাকে । প্রতিবার পুরষ্কার নেবার সময় সেই যাত্রী বিড়বিড় করে বলে “কোন হালায় যে পিছন থেকে ধাক্কাটা মারলো এখনো বুঝবার পারলাম না ।“
-এই গল্পের মানে কি ? আমি একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করি ।
-তোর মাথায়তো সারাজীবনই একটু বুদ্ধি শর্ট । তুই বুঝবি না এইটাই স্বাভাবিক । অন্য সময় হলে এই কথা শোনার পরে রেগে যেতাম । কিন্তু সেদিন রাগি না । নরম গলায় বলি …
-তোকে অনেক ধন্যবাদ । আমাকে নিয়ে এক কিলোমিটার হাটছস । তাও আবার গোলাগুলির মধ্যে ।
-হলের ডাইল খাইয়া দেখি শুধু শরীরই মোটা হয় নাই । বুদ্ধিও মোটা হইয়া গেছে । ঝরনা আবারো হুল ফোটানো কথা শুরু করে । আমি আর উত্তর দেই না ।
-শোন পুরা কাহিনী তোরে বলি । একটু নরম গলাতে বলে ঝরনা ।
-আমিও মিছিলের পিছনে পিছনে যাচ্ছিলাম । তুই দেখস নাই কারণ তোরও কিছুটা পিছনে ছিলাম । হঠাৎ দেখি সবাই দৌড়াইতাছে । আর তুই রাস্তার মাঝখানে ব্যাক্কলের মত একা খাড়াইয়া আছস । আমিও দৌড়ানো শুরু করছি এমন সময় দেখি তুই রাস্তায় পইড়া আছস । কাছে যাইয়া দেখি তোর কপাল দিয়া রক্ত বাইর হইতাছে । তোরে পাঁজাকোলা কইরা পনের/বিশ কদম হাটতেই কিছু ছেলে একটা রিক্সা এনে দেয় । এই হলো কাহিনী । আল্লায় দিলে তোর যা ওজন হইছে পনের/বিশ কদম হাটতেই আমার জান বাইর হইয়া গেছে । এক কিলোমিটার হাটলে আমারে আর খুইজা পাওয়া যাইতো না । আর ঐদিন কোনো গোলাগুলি হয় নাই । পুলিশ কয়েক রাউন্ড কাঁদানে গ্যাস মারছিলো মনে হয় । এখন সবাই যখন বিভিন্ন গল্প বানায় তখন আমার লঞ্চের ঐ যাত্রীর কথাই মনে হয় । ঝরনা স্বভাবসুলভভাবে হাল্কা গলাতেই গল্পটা বলে যায় । কিন্তু এই মিথের গল্প শুনেও আমার চোখ দিয়ে পানি চলে আসে । কৃতজ্ঞতায় । ইচ্ছা করে বলতে “যাত্রী পানিতে না হয় ইচ্ছা করে লাফ দেয় নাই । কিন্তু বাচ্চাটাকে না উঠাইয়া নিজেওতো উঠে আসতে পারতো । তুইওতো আমাকে ইচ্ছা করলেই রাস্তায় ফেলে আসতে পারতি । বিশেষ করে তোর সাথে আমার যে সম্পর্ক ।“ কিন্তু এসব অব্যক্তই থাকে ।
ঝরনার সাথে আমার সমস্যা অনেকদিনের পুরোনো । ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন । একই স্কুলে । রোজার ঈদের নতুন জামাটা কি মনে করে ঝরনাকে দেখালাম । ঈদের দিন যেখানেই যাই বান্ধবীরা দেখি একটু কানাঘুষা করছে । একজনকে চেপে ধরতেই যা শুনলাম তাতে আমার সমস্ত ঈদটাই মাটি হয়ে গেলো । ‘আমার জামাটার কি রঙয়ের কেমন এটা নাকি সবাই আগে থেকেই জানে । কারণ এটা নাকি আমাদেরই কোনো এক বান্ধবীর বড় বোনের পুরোনো জামা । ‘ কোন বান্ধবী সেটা অবশ্য বলে নাই । কিন্তু এটা সহজেই বুঝতে পারি । রাগে দুঃখে আমার চোখে পানি চলে আসে ।
সেই শুরু । এরপরে ক্লাসে একবার ঝরনা ফার্স্ট হলে পরেরবার আমাকে ফার্স্ট হতেই হয় । যদি টের পেতাম কোনো ছেলেকে ঝরনার একটু ভালো লেগেছে সাথে সাথেই ঐ ছেলের সাথে নিজে যেচে পরে কথা বলতাম । কথা বলার ফাকে ঝরনা সম্বন্ধে দুই একটা এমন কথা বলতাম যাতে যেকোনো বুদ্ধিমান ছেলে একশ হাত দুরে চলে যায় । একই কাজ ঝরনাও করতো । তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে কখনো কোনোদিন ঝরনার সাথে সামান্য ঝগড়াটাও হয় নাই ।
সেই ঝরনাই ইউনিভার্সিটির প্রথম থেকেই সবার কাছে হয়ে গেলো আমার ‘প্রিয় বান্ধবী’ । অনেক সময়ই মিথ সত্যের চাইতেও বেশী শক্তিশালী । আসল কাহিনী আমিও যেমন কাউকে বলতে পারতাম না ঝরনারও ছিলো একই অবস্থা । তবে এরপরেও আমাদের দ্বৈরথ ঠিকই চলেছে । ছোটগুলি আর না বলি । বড় একটাই বলি ।
ইউনিভার্সিটির শেষের দিকের কাহিনী । রাজনীতি থেকে সবসময়ই দুরে ছিলাম । তারপরও কিভাবে কিভাবে যেনো হল সংসদের একটা ছোট পদে দাঁড়িয়ে গেলাম । মানে অন্যরা জোর করে দাঁড়া করিয়ে দিলো । যে দলের হয়ে দাড়ালাম তারা এমনিতেই সব পদে জিতবে । আমারো না জেতার কোনোই কারণ নাই । কিন্তু ইলেকশনের কয়েকদিন আগে হলের রুমে ঢুকে দেখি তুলি দেখি থম্থমে মুখে বসে আছে । কিছুক্ষণ আগে কান্নাকাটি করেছে সে লক্ষণও স্পষ্ট । তুলি ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ে । আমাদের একই শহর এবং একই কলেজ পাশ করে এসেছে । হলে এখনো সিট পায় নাই বলে আমার সাথে ডাবলিং করছে । এরকম অনেকেই করে । মেয়েটাকে আমার বেশ পছন্দ । আর তুলিও আমাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে ।
-কিরে থোম্বা মুখে বসে আছিস কেনো ? আমি জিজ্ঞেস করি ।
-কলি আপা ড্রয়ার খুলে আমার জিনিষগুলো দেও । আজ রাতেই আমি মামার বাসায় চলে যাবো । যে কয়দিন সিট না পাই ওখান থেকেই ক্লাশ করবো ।
-কেনো কি হয়েছে ?
-কি হয়েছে আমি তোমাকে বলতে পারবো না ।
-ঠিক আছে । আমি একটু কমন্রুম থেকে আসি । তুই একটু শান্ত হয়ে বস । বলে আমি রুম থেকে বের হয়ে আসি । কমনরুমে আসতেই রুমার কাছ থেকে আসল ঘটনা শুনতে পাই । তুলিকে ক্লাসে কে নাকি ‘লেসু’ বলে আওয়াজ দিছে । লেসবিয়ানের সংক্ষেপ হলো ‘লেসু’ । আর ঘটনাটা নাকি আমার সাথে সিট ডাবলিং এর কারনেই । লজ্জায় অপমানে আমিও স্তম্ভিত হয়ে যাই । কোথা থেকে এরকম গসিপ আসতে পারে সেটা সম্বন্ধে আমার স্পষ্ট ধারনা থাকা সত্ত্বেও কাউকে কিছু বলতে পারি না । কারণ একেতো ‘প্রিয় বান্ধবী’ তার উপর দলের জন্য ঝরনা অনেক খাটাখাটনি করে । আমার চাইতে কয়েকগুন বেশী । শুধু এই গুজবের কারনেই আমার দলের বাকি সবাই ইলেকশনে পাশ করলেও আমি ফেল করলাম ।
তবে আমিও শোধ নিয়েছিলাম । লজ্জার মাথা খেয়ে এক ছোট ভাইয়ের কাছে অনেকগুলো পর্ণোগ্রাফিক ম্যাগাজিন আর সিডি যোগাড় করেছিলাম । বলেছিলাম এক বান্ধবীর দরকার ‘সমাজে পর্ণের কুপ্রভাব নিয়ে থিসিস লিখবে’ তাই । ছোট ভাই মিচকা হাসি দিয়েছিলো । তবে ঠিকই যোগাড় করে দিয়েছিলো । তারপর সেগুলো ঝরনার হলের বিছানার নীচে রাখতে তেমন সমস্যা হয় নাই । লোক মারফত প্রভোস্টকে জানাইতেও সমস্যা হয় নাই । প্রভোস্ট এসে হাতেনাতে সেগুলো পেয়েও যায় । হল থেকে শোকজ, সাময়িক সাসপেন্ড অনেক ঝামেলাই যায় ঝরনার উপর দিয়ে ।
এই হলো আমার আর আমার ‘প্রিয় বান্ধবী’ ঝরনার গল্প । ইউনিভার্সিটি শেষ করার পরে বিয়ে, চাকুরী, সন্তান নিয়েই ব্যস্ত হয়ে যাই । সেভাবে যোগাযোগ না থাকলেও জানি ঝরনা আমার মতই বিসিএস দিয়ে কোনো কলেজে পড়ায় । আমি গত চার বছর যাবত স্বামী সন্তানের সাথে এই মফশ্বলে । স্বামীও সরকারী অফিসার । সব মিলিয়ে বেশ কিছুটা নিরুপদ্রব জীবন । সেখানে হঠাৎ এরকম ‘প্রিয় বান্ধবীর’ আগমন !! বাসায় ফিরে শোয়েবকে বললাম । ‘ভালোইতো এরকম মফশ্বল শহরে এতদিনের এক বান্ধবীকে পাবে’ । বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো শোয়েব । আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম । আমার এই সমস্যা আসলে কাউকে বলতেও পারবো না, বোঝানোতো অনেক দুরের ব্যাপার ।
পরের মাসেই ঝরনা এসে পড়ে । স্বামী সন্তান সহ । ওর স্বামীও শোয়েবের মত সরকারী অফিসার । একসাথেই এখানে বদলী হয়েছে । ছেলেটাও আমার সন্তান সায়ান এর বয়সী । দেখা হতেই দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে উচ্ছাস দেখালাম । পুরোনো বান্ধবীরা যেমন দেখায় । কিন্তু এরপর থেকেই খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলাম । একটু মোটা হয়েছে ঝরনা । তবে চেহারায় বাড়তি একটু লাবণ্যও যোগ হয়েছে । তার মানে বেশ সুখেই আছে ঝরনা । স্বামী বেচারাকে অবশ্য একটু গোবেচারা লাগছে । শোয়েবের মত স্মার্ট না । এই সামান্য আবিষ্কারেও কোথা থেকে যেনো একটু সুখের বাতাস লাগে মনে ...
-জানিসতো । বাসা ভাড়া নিয়ে ফেলেছি ।
-বাসাতো নিবিই । কিছুদিন আমার বাসায় থাক না । আমি আন্তরিকভাবেই বলি । শোয়েবও আমার সাথে সায় দেয় ।
-নারে বাবুল ঠিক করে ফেলেছে । ওহ আবার খুব গোছালো স্বভাবের । বাসা, সানির জন্য স্কুল সব ঠিক করে ফেলেছে ।
পরেরদিন সকালেই ঝরনা নিজের বাসায় উঠে যায় । একেবারে নতুন বাসা । অনেকটা খোলামেলা । ঐ বাসা থেকে ফিরেই নিজের বাসা আর ভালো লাগে না । শোয়েবকে রেগে বলি
-একটা বাসাতেই চার বছর হয়ে গেলো । তুমি এত কুইড়ার বাদশা হয়ে গেলা কবে থেকে । একটা সুন্দর বাসা দেখো না ।
-সেদিনই না তুমি বললা যতদিন এই শহরে আছি এই বাসাতেই থাকবো । বাড়িওয়ালা এত ভালো । আলো বাতাসও প্রচুর । শোয়েব অবাক গলায় উত্তর দেয় । আসলেও বলেছিলাম । কিন্তু কিভাবে বুঝাই তখনতো ‘প্রিয় বান্ধবী’ ছিলো না ।
ঝরনার ছেলে সানি আর আমার ছেলে সায়ানের স্কুলও এক । হঠাৎ করেই সায়ানের পড়াশুনার ব্যাপারেও বাড়তি নজর দিতে শুরু করি । ঝরনার ছেলের চাইতে এক নম্বর হলেওতো বেশী পেতে হবে ।
এভাবেই দিন যায় । কলেজেও সবাই জানে আমি আর ঝরনা ‘প্রিয় বান্ধবী’ । এর মাঝেই কলেজের পিকনিক চলে আসে । সবার সাথে আমরাও যাই । আমি সায়ানকে নিয়ে নিজেদের গাড়িতে যাই । ঝরনা সানিকে নিয়ে পিকনিক বাসে । এর মাঝেই সায়ান আর সানি খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেছে । যেখানেই যায় দুজন একসাথে থাকে । পিকনিক শেষে সানি সায়ানের সাথেই আমাদের গাড়িতে উঠে বসলো । ঝরনা সানিকে ডাকাডাকি করলেও আমি বললাম
-তুইও আমার গাড়িতেই আয় না । একসাথে গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে ।
-নারে প্রিন্সিপ্যাল স্যারের সাথে কিছু কথা আছে । পিকনিকের হিসাব নিকাশ নিয়ে । ঝরনা সুযোগ পেয়ে নিজের গুরুত্বটা একটু প্রকাশ করলো । আমার বিরক্ত লাগলো । আমি এই কলেজে আছি চার বছর । আর তুই সেদিন এসে যোগ দিলি । আমার কাছে তোর এসব গল্পের কোনো মানে আছে । তবে মুখে কিছু বললাম না ।
-ঠিক আছে সানিকে তোর বাসাতে পৌছে দেবো । বলে চলে আসলাম । দুই ছেলে গাড়িতে বসে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিলো । সারাদিনের পিকনিকের ধকলে আমি একটু চোখ বুঝেছিলাম । হঠাৎ বিকট শব্দ আর প্রবল ঝাকুনিতে ঝিমানি ভাবটা মুহূর্তেই কেটে যায় । কিভাবে কি হয়েছে কিছুই জানি না । গাড়ি রাস্তার পাশে একটু ঢালুতে থেমে আছে । ড্রাইভারের সাইডের গ্লাস ভাঙ্গা । ঐ সাইডেই সানি বসেছিলো । সেই জানালারও কাঁচ ভাঙ্গা । সানির মনে হয় জ্ঞান নাই । তবে সায়ান কান্নাকাটি করলেও ঠিক আছে । নিজেকে অক্ষতই মনে হয় ।
-ম্যাডাম একটা ট্রাক সাইড দিয়া মাইরা দিছে । ড্রাইভার পিছনে ফিরে আমাকে বললো ।
-তুমি ঠিক আছোতো । আমি জিজ্ঞেস করি ।
-নাহ ম্যাডাম । হাতে আর বুকে খুব ব্যথা । হাত মনে হয় ভাইঙ্গা গেছে ।
মনে মনে আল্লাহকে ডাকি । নিজের দিকের দরজা খুলে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসি । একটু সামনে আসতেই বুকটা ছ্যাত করে উঠে । আর দশ গজ এগোলেই বিশাল খাদ । ওখানে গাড়ি পড়লে কি হতো ভাবতেও ভয় লাগে । সন্ধ্যা হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগেই । এই সময়ে রাস্তায় দুরপাল্লার বাস ছাড়া অন্য গাড়ি আসার সম্ভাবনা কম । আর বাস ড্রাইভাররা সাধারনত হাত তুললেও গাড়ি থামায় না । এভাবে বাস ডাকাতির গল্পওতো কম না । অনেক চেষ্টা করেও ড্রাইভার কিংবা সানির দিকের দরজা খুলতে পারি না । আবার গাড়িতে ফিরে আসি । সানি তখনো জ্ঞানহীন । গাড়ির অল্প আলোতে কেমন নির্জীব লাগে । কেনো যেনো মনে হয় বেশী সময় হাতে নাই । একবার সায়ানের মুখের দিকে একবার সানির মুখের দিকে তাকাই ।
-গাড়ির ইঞ্জিন ঠিক আছে ? আমি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করি ।
-জ্বি ম্যাডাম আছে ।
-তুমি পাশের সিটে সরে আসতে পারবে ।
-জ্বি ম্যাডাম পারবো । বলে অনেক কষ্টে ড্রাইভার পাশের সিটে গিয়ে বসে । অন্ধকার হয়ে গেলেও জায়গাটা আমার চেনা । ছয় সাত কিলোমিটার দুরে একটা প্রাইভেট হাসপাতাল আছে । শুনেছি চিকিৎসা ভালোই । আমি কোনোমতে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলাম । শোয়েবের অনেক পীড়াপীড়িতে দুইদিন ড্রাইভিং শিখতে বসেছিলাম । তাও প্রায় বছরখানেক আগে । আল্লাহ আল্লাহ করে গাড়ির চাবি ঘুরালাম । ইঞ্জিন একবারেই চালু হয়ে গেলো । গিয়ার দিয়ে এক্সিলারেটরে পা দিতেই গাড়ি নড়ে উঠলো । ধীরে ধীরে গাড়িকে রাস্তায়ও নিয়ে আসলাম । যতরকম দোয়া দুরুদ জানি পড়তে পড়তে রওয়ানাও হয়ে গেলাম । রাস্তা একদম ফাঁকা । হেডলাইটের আলো ছাড়া আর কোনো আলো নাই । কতক্ষণ পরে মনে নাই পরিচিত পেট্রোল পাম্পটা চোখে পড়লো । এর একটু পরেইতো হাসপাতালটা । হাসপাতালের গেট দিয়ে ঢুকে ব্রেক করলাম । সাথে সাথে হঠাৎ তীব্র ব্যথা নেমে এলো শরীরজুড়ে । এরপরে আর কিছু আমার মনে নাই ।
যখন জ্ঞান ফিরে তখন দেখি আমার দুই হাতেই সাদা প্লাস্টার । শোয়েব সায়ানসহ আরো অনেকেই দাঁড়িয়ে । সায়ানকে দাঁড়ানো দেখে স্বস্থি পাই । তার মানে ওর কিছু হয় নাই ।
-ইউ আর গ্রেট ম্যাডাম । চোখ মেলতেই একজন বলে । পোশাক দেখে বুঝতে পারি হাসপাতালের ডাক্তার হবেন ।
-দুই হাতে ফ্রাকচার নিয়ে, সেইভাবে ড্রাইভিং না জেনেও এতটা পথ কেউ ড্রাইভ করতে পারে । অবিশ্বাস্য । ছোট ছেলেটাকে আর একটু দেরী করে আনলেই হয়তো বাচানো যেতো না । প্রচুর ইন্টারনাল ব্লিডিং হয়েছিলো ।
-এখন কেমন আছে সানি ? ডাক্তারের কথার মাঝখানেই আমি জিজ্ঞেস করি ।
-এক ব্যাগ রক্ত দিয়েই জেলা সদরে এম্বুলেন্স করে পাঠিয়ে দিয়েছি । কিছুক্ষণ আগেই ফোনে খবর পেয়েছি এখন আশংকামুক্ত ।
-ড্রাইভার ?
-তার শুধু কয়েকটা হাড় ভেঙ্গেছে । এমনিতে ভালো আছে । উত্তর দিয়ে একটু অন্যদিকে যান ডাক্তার ।
-দেখেছো ড্রাইভিংটা শিখে রাখলে কত কাজে লাগে । শোয়েব মৃদু হেসে বলে ।
-তবে পাগলামিটা একটু বেশী করে ফেলেছো । বলে কপালে হাত রাখে শোয়েব । সামান্য স্পর্শ তাতেই কেমন প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে মনে ।
হাসপাতালেই রাতটা কাটাতে হয় । ভোরে ঘুম থেকে উঠেই দেখি ঝরনা বিছানার পাশে বসে আছে ।
-কেমন আছিস তুই ? চোখ মেলতেই আকুল হয়ে প্রশ্ন করে ঝরনা ।
-ধুর আমিতো ভালোই আছি । আমার হাতে যে ফ্রাকচার আমি নিজেই টের পাই নাই । ডাক্তার বানাইয়া বানাইয়া বলছে কিনা কে জানে । সানি কেমন আছে ?
-বিপদমুক্ত । তুই না থাকলে...তুই দুই হাতে ফ্রাকচার নিয়া এতটা পথ ?
-ধুর কতটা পথ ?
-সবাইতো বলে চল্লিশ কিলোমিটার ।
-শোন তোর সেই মিথের গল্প মনে আছে । পনের বিশ কদম হাটলে যেমন এক কিলোমিটার হয় সেরকম ছয় সাত কিলোমিটারও চল্লিশ কিলোমিটার হয় ।
-তারপরো...তুই না থাকলে সানিকে মনে হয় বাচানো... আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে ঝরনা । কথা শেষ করতে পারে না । আমার একটু বিরক্ত লাগে ।
-শোন ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদিস নাতো । ‘প্রিয় বান্ধবী’ অথবা ‘জানি দুশমন’ যাই হই না কেনো আমিওতো একজন মা । আর যেকোনো মা-ই একই কাজ করবে । চিন্তা করে দেখ সায়ানের এমন হলে তুই কি করতি । এত কিছু বলার পরেও ঝরনার কান্নার বেগ কমে না ।
-দুই হাতে ফ্রাকচার, মাথায়ও নাকি ব্যাথা ছিলো । ড্রাইভিং জানে না । পঞ্চাশ কিলোমিটার ড্রাইভ । বিশ্বাস করন যায় । বান্ধবী হইলে এমনই হইতে হয় । একটু দুরেই দুই নার্স নিজেদের মধ্যে গল্প করছে । হায়রে এখানেও সেই বান্ধবীর গল্প । আমি জানি এই গল্প এখন এভাবেই ডালপালা ছড়াবে । আমার অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না । ‘প্রিয় বান্ধবী’ নাকি কলেজের টিচার্স ইলেকশনে দাঁড়াবে । ওকে কিভাবে হারানো যায় সেই বুদ্ধিতো করতে হবে ...
প্রিয় বান্ধবী
মূল লেখকঃ মুস্তাফিজুর রহমান টিটু
কলি
“তোর কলেজেই আগামী মাসে যোগ দিচ্ছি ।
ইতি প্রিয় বান্ধবী ঝরনা “
ক্লাশ শেষে নিজের রুমে ফিরেই টেবিলে চিঠিটা দেখে একটু অবাক হয়েছিলাম । মোবাইল যুগ প্রায় আসন্ন । এখানে এখনো মোবাইল নেটওয়ার্ক নাই । তবুও আজকাল কেউতো চিঠি লিখে না । খামটা খুলে এই এক লাইনের চিঠি পড়ে অবাকের চাইতেও অন্য অনুভুতি প্রবল হলো । দশ বছর নাকি তারও বেশী । এত বছর পরে বান্ধবীর সাথে দেখা হবে ..খুশী হবারইতো কথা । কিন্তু মনটা ছেয়ে গেলো উদ্বেগ আর চিন্তাতে । কেনো ? কোথা থেকে শুরু করি ।
আচ্ছা ঝরনার লেখা ‘প্রিয় বান্ধবী’ কথাটা দিয়েই শুরু করি । আমার আর ঝরনার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সবাই এরকমই জানতো । কিন্তু আসলে এটা একটা মিথ । এর পিছনে একটা গল্পও আছে । ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর আমি আর ঝরনা দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলাম । এক বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়লেই অবশ্য বেশী খুশী হতাম । আমি নিশ্চিত ঝরনাও একই কথা বলবে । তারও লম্বা কাহিনী আছে । ধ্যেত কি কথা থেকে কি কথা বলা শুরু করলাম ।
যাই হোক দুজনে অবশ্য দুই ডিপার্টমেন্টে । আমি ভুগোল আর ঝরনা সোসিওলজি । কিন্তু হল আবার একই । শামসুন্নাহার হল । ক্লাস শুরু হবার কিছুদিন পরের ঘটনা । হল থেকে বের হয়েছি ক্লাসের উদ্দেশ্যে । বেশ কিছুটা দেরী হয়ে গেছে । এই স্যার আবার বেশ কড়া । এমনিতেই মফশ্বল থেকে এসেছি । ‘অন্যরা আমাকে নিয়ে আড়ালে হাসে’ এরকম একটা বাড়তি চাপ নিয়ে সবসময় থাকি । দেরীর কারনে স্যার যদি সবার সামনে বেইজ্জতি করে । কত যে উদ্বেগ ... । এই অবস্থায় হল থেকে বের হয়েই দেখি মিছিল । মিছিল দেখলেই আবার আমার কেমন জানি ভয় করে । সব সময় মিছিল দেখলেই দুরে দুরে থাকি । কিন্তু মিছিল শেষ হবার অপেক্ষায় থাকলে আজকে আরো দেরী হবে । তাই আল্লাহর নাম নিয়ে মিছিলের পিছে পিছে হাটা শুরু করলাম । হঠাৎ সামনে কয়েকটা শব্দ শুনতে পেলাম । মিছিলের লোকজন মুহূর্তেই এদিক সেদিক দৌড়ানো শুরু করলো । কয়েক সেকেন্ড পরেই ধোঁয়া দেখতে পেলাম । সাথে চোখজ্বলা । আমি ততক্ষণে ভয়ে আধমরা । কি করবো কোথায় যাবো বুঝতে পারছিলাম না । সম্বিত ফিরে উল্টোদিকে ফিরে দৌড়ানোর চেষ্টা করলাম । সেদিন আবার একটু হিল জুতা পড়েছিলাম । দুই তিন কদম আগাতেই কিসে জানি হোচট খেলাম । তারপর আর আমার কিছু মনে নাই । জ্ঞান ফিরে দেখি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি । কপালের একপাশে একটু ব্যান্ডেজ । চারপাশে বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব এর মাঝে ঝরনাও আছে । আঘাত তেমন গুরুতর না হওয়াতে ঐ রাতেই হলে ফিরি । ঐ রাতে এবং পরের কয়েকদিন আমাকে দেখলেই সবার একটাই গল্প । আমার আর ঝরনার বন্ধুত্বের গল্প । সেদিন নাকি অজ্ঞান আমাকে কোলে নিয়ে গুলির মাঝেই ঝরনা এক কিলোমিটার হেটেছে । “আহা কি টান । বান্ধবী হলে এমনই হওয়া উচিৎ ।“ শেষ কথাটা বলার সময় অনেকেরই একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস পড়ে ।
কিন্তু ঝরনার আর দেখা পাই না । প্রায় চার পাঁচদিন পরে হলের ডাইনিং থেকে বের হবার সময় দেখি ঝরনা ঢুকতাছে ।
-কিরে আমাকে বাচাইয়া তোর যে আর দেখা নাই । আমি জিজ্ঞেস করি ।
-আজাইরা প্যাচাল রাখ । কি বলবি বল ।
-নাহ এমনি । তোর পাশে বসে একটু কথা বলি ।
-খাওয়ার সময় একজন পাশে হাত গুটাইয়া আমার মুখের দিকে চাইয়া আছে । আমি খাইতে পারুম না ।
-তাইলে তুই খাইয়া আয় । আমি বাইরে অপেক্ষা করি ।
-তোর সময় থাকলে অপেক্ষা কর । বলে ঝরনা চলে যায় । আমি আসলেও অপেক্ষা করি । ঝরনা মনে হয় ইচ্ছা করেই দেরী করে । আমাকে কাটাবার জন্য । অনেকক্ষণ পরে ডাইনিং থেকে বের হয় ।
-তুই এখনো খাড়াইয়া আছস । কি বলবি বল ।
-চল কমনরুমে যাই । আমি বলি ।
কমনরুমে বসতেই ঝরনা বলে তোকে আগে একটা মিথের গল্প বলি শোন ।
-এক লঞ্চে হঠাৎ একটা বাচ্চা পানিতে পড়ে গেলো । একটু পরেই এক যাত্রী পানিতে ঝাপাইয়া পইড়া বাচ্চাটাকে পানি থেকে উঠাইয়া আনলো । সবাই সেই যাত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ । বিভিন্ন সংঘঠন তাকে পুরষ্কার দেবার জন্য ডাকে । প্রতিবার পুরষ্কার নেবার সময় সেই যাত্রী বিড়বিড় করে বলে “কোন হালায় যে পিছন থেকে ধাক্কাটা মারলো এখনো বুঝবার পারলাম না ।“
-এই গল্পের মানে কি ? আমি একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করি ।
-তোর মাথায়তো সারাজীবনই একটু বুদ্ধি শর্ট । তুই বুঝবি না এইটাই স্বাভাবিক । অন্য সময় হলে এই কথা শোনার পরে রেগে যেতাম । কিন্তু সেদিন রাগি না । নরম গলায় বলি …
-তোকে অনেক ধন্যবাদ । আমাকে নিয়ে এক কিলোমিটার হাটছস । তাও আবার গোলাগুলির মধ্যে ।
-হলের ডাইল খাইয়া দেখি শুধু শরীরই মোটা হয় নাই । বুদ্ধিও মোটা হইয়া গেছে । ঝরনা আবারো হুল ফোটানো কথা শুরু করে । আমি আর উত্তর দেই না ।
-শোন পুরা কাহিনী তোরে বলি । একটু নরম গলাতে বলে ঝরনা ।
-আমিও মিছিলের পিছনে পিছনে যাচ্ছিলাম । তুই দেখস নাই কারণ তোরও কিছুটা পিছনে ছিলাম । হঠাৎ দেখি সবাই দৌড়াইতাছে । আর তুই রাস্তার মাঝখানে ব্যাক্কলের মত একা খাড়াইয়া আছস । আমিও দৌড়ানো শুরু করছি এমন সময় দেখি তুই রাস্তায় পইড়া আছস । কাছে যাইয়া দেখি তোর কপাল দিয়া রক্ত বাইর হইতাছে । তোরে পাঁজাকোলা কইরা পনের/বিশ কদম হাটতেই কিছু ছেলে একটা রিক্সা এনে দেয় । এই হলো কাহিনী । আল্লায় দিলে তোর যা ওজন হইছে পনের/বিশ কদম হাটতেই আমার জান বাইর হইয়া গেছে । এক কিলোমিটার হাটলে আমারে আর খুইজা পাওয়া যাইতো না । আর ঐদিন কোনো গোলাগুলি হয় নাই । পুলিশ কয়েক রাউন্ড কাঁদানে গ্যাস মারছিলো মনে হয় । এখন সবাই যখন বিভিন্ন গল্প বানায় তখন আমার লঞ্চের ঐ যাত্রীর কথাই মনে হয় । ঝরনা স্বভাবসুলভভাবে হাল্কা গলাতেই গল্পটা বলে যায় । কিন্তু এই মিথের গল্প শুনেও আমার চোখ দিয়ে পানি চলে আসে । কৃতজ্ঞতায় । ইচ্ছা করে বলতে “যাত্রী পানিতে না হয় ইচ্ছা করে লাফ দেয় নাই । কিন্তু বাচ্চাটাকে না উঠাইয়া নিজেওতো উঠে আসতে পারতো । তুইওতো আমাকে ইচ্ছা করলেই রাস্তায় ফেলে আসতে পারতি । বিশেষ করে তোর সাথে আমার যে সম্পর্ক ।“ কিন্তু এসব অব্যক্তই থাকে ।
ঝরনার সাথে আমার সমস্যা অনেকদিনের পুরোনো । ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন । একই স্কুলে । রোজার ঈদের নতুন জামাটা কি মনে করে ঝরনাকে দেখালাম । ঈদের দিন যেখানেই যাই বান্ধবীরা দেখি একটু কানাঘুষা করছে । একজনকে চেপে ধরতেই যা শুনলাম তাতে আমার সমস্ত ঈদটাই মাটি হয়ে গেলো । ‘আমার জামাটার কি রঙয়ের কেমন এটা নাকি সবাই আগে থেকেই জানে । কারণ এটা নাকি আমাদেরই কোনো এক বান্ধবীর বড় বোনের পুরোনো জামা । ‘ কোন বান্ধবী সেটা অবশ্য বলে নাই । কিন্তু এটা সহজেই বুঝতে পারি । রাগে দুঃখে আমার চোখে পানি চলে আসে ।
সেই শুরু । এরপরে ক্লাসে একবার ঝরনা ফার্স্ট হলে পরেরবার আমাকে ফার্স্ট হতেই হয় । যদি টের পেতাম কোনো ছেলেকে ঝরনার একটু ভালো লেগেছে সাথে সাথেই ঐ ছেলের সাথে নিজে যেচে পরে কথা বলতাম । কথা বলার ফাকে ঝরনা সম্বন্ধে দুই একটা এমন কথা বলতাম যাতে যেকোনো বুদ্ধিমান ছেলে একশ হাত দুরে চলে যায় । একই কাজ ঝরনাও করতো । তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে কখনো কোনোদিন ঝরনার সাথে সামান্য ঝগড়াটাও হয় নাই ।
সেই ঝরনাই ইউনিভার্সিটির প্রথম থেকেই সবার কাছে হয়ে গেলো আমার ‘প্রিয় বান্ধবী’ । অনেক সময়ই মিথ সত্যের চাইতেও বেশী শক্তিশালী । আসল কাহিনী আমিও যেমন কাউকে বলতে পারতাম না ঝরনারও ছিলো একই অবস্থা । তবে এরপরেও আমাদের দ্বৈরথ ঠিকই চলেছে । ছোটগুলি আর না বলি । বড় একটাই বলি ।
ইউনিভার্সিটির শেষের দিকের কাহিনী । রাজনীতি থেকে সবসময়ই দুরে ছিলাম । তারপরও কিভাবে কিভাবে যেনো হল সংসদের একটা ছোট পদে দাঁড়িয়ে গেলাম । মানে অন্যরা জোর করে দাঁড়া করিয়ে দিলো । যে দলের হয়ে দাড়ালাম তারা এমনিতেই সব পদে জিতবে । আমারো না জেতার কোনোই কারণ নাই । কিন্তু ইলেকশনের কয়েকদিন আগে হলের রুমে ঢুকে দেখি তুলি দেখি থম্থমে মুখে বসে আছে । কিছুক্ষণ আগে কান্নাকাটি করেছে সে লক্ষণও স্পষ্ট । তুলি ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ে । আমাদের একই শহর এবং একই কলেজ পাশ করে এসেছে । হলে এখনো সিট পায় নাই বলে আমার সাথে ডাবলিং করছে । এরকম অনেকেই করে । মেয়েটাকে আমার বেশ পছন্দ । আর তুলিও আমাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে ।
-কিরে থোম্বা মুখে বসে আছিস কেনো ? আমি জিজ্ঞেস করি ।
-কলি আপা ড্রয়ার খুলে আমার জিনিষগুলো দেও । আজ রাতেই আমি মামার বাসায় চলে যাবো । যে কয়দিন সিট না পাই ওখান থেকেই ক্লাশ করবো ।
-কেনো কি হয়েছে ?
-কি হয়েছে আমি তোমাকে বলতে পারবো না ।
-ঠিক আছে । আমি একটু কমন্রুম থেকে আসি । তুই একটু শান্ত হয়ে বস । বলে আমি রুম থেকে বের হয়ে আসি । কমনরুমে আসতেই রুমার কাছ থেকে আসল ঘটনা শুনতে পাই । তুলিকে ক্লাসে কে নাকি ‘লেসু’ বলে আওয়াজ দিছে । লেসবিয়ানের সংক্ষেপ হলো ‘লেসু’ । আর ঘটনাটা নাকি আমার সাথে সিট ডাবলিং এর কারনেই । লজ্জায় অপমানে আমিও স্তম্ভিত হয়ে যাই । কোথা থেকে এরকম গসিপ আসতে পারে সেটা সম্বন্ধে আমার স্পষ্ট ধারনা থাকা সত্ত্বেও কাউকে কিছু বলতে পারি না । কারণ একেতো ‘প্রিয় বান্ধবী’ তার উপর দলের জন্য ঝরনা অনেক খাটাখাটনি করে । আমার চাইতে কয়েকগুন বেশী । শুধু এই গুজবের কারনেই আমার দলের বাকি সবাই ইলেকশনে পাশ করলেও আমি ফেল করলাম ।
তবে আমিও শোধ নিয়েছিলাম । লজ্জার মাথা খেয়ে এক ছোট ভাইয়ের কাছে অনেকগুলো পর্ণোগ্রাফিক ম্যাগাজিন আর সিডি যোগাড় করেছিলাম । বলেছিলাম এক বান্ধবীর দরকার ‘সমাজে পর্ণের কুপ্রভাব নিয়ে থিসিস লিখবে’ তাই । ছোট ভাই মিচকা হাসি দিয়েছিলো । তবে ঠিকই যোগাড় করে দিয়েছিলো । তারপর সেগুলো ঝরনার হলের বিছানার নীচে রাখতে তেমন সমস্যা হয় নাই । লোক মারফত প্রভোস্টকে জানাইতেও সমস্যা হয় নাই । প্রভোস্ট এসে হাতেনাতে সেগুলো পেয়েও যায় । হল থেকে শোকজ, সাময়িক সাসপেন্ড অনেক ঝামেলাই যায় ঝরনার উপর দিয়ে ।
এই হলো আমার আর আমার ‘প্রিয় বান্ধবী’ ঝরনার গল্প । ইউনিভার্সিটি শেষ করার পরে বিয়ে, চাকুরী, সন্তান নিয়েই ব্যস্ত হয়ে যাই । সেভাবে যোগাযোগ না থাকলেও জানি ঝরনা আমার মতই বিসিএস দিয়ে কোনো কলেজে পড়ায় । আমি গত চার বছর যাবত স্বামী সন্তানের সাথে এই মফশ্বলে । স্বামীও সরকারী অফিসার । সব মিলিয়ে বেশ কিছুটা নিরুপদ্রব জীবন । সেখানে হঠাৎ এরকম ‘প্রিয় বান্ধবীর’ আগমন !! বাসায় ফিরে শোয়েবকে বললাম । ‘ভালোইতো এরকম মফশ্বল শহরে এতদিনের এক বান্ধবীকে পাবে’ । বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো শোয়েব । আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম । আমার এই সমস্যা আসলে কাউকে বলতেও পারবো না, বোঝানোতো অনেক দুরের ব্যাপার ।
পরের মাসেই ঝরনা এসে পড়ে । স্বামী সন্তান সহ । ওর স্বামীও শোয়েবের মত সরকারী অফিসার । একসাথেই এখানে বদলী হয়েছে । ছেলেটাও আমার সন্তান সায়ান এর বয়সী । দেখা হতেই দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে উচ্ছাস দেখালাম । পুরোনো বান্ধবীরা যেমন দেখায় । কিন্তু এরপর থেকেই খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলাম । একটু মোটা হয়েছে ঝরনা । তবে চেহারায় বাড়তি একটু লাবণ্যও যোগ হয়েছে । তার মানে বেশ সুখেই আছে ঝরনা । স্বামী বেচারাকে অবশ্য একটু গোবেচারা লাগছে । শোয়েবের মত স্মার্ট না । এই সামান্য আবিষ্কারেও কোথা থেকে যেনো একটু সুখের বাতাস লাগে মনে ...
-জানিসতো । বাসা ভাড়া নিয়ে ফেলেছি ।
-বাসাতো নিবিই । কিছুদিন আমার বাসায় থাক না । আমি আন্তরিকভাবেই বলি । শোয়েবও আমার সাথে সায় দেয় ।
-নারে বাবুল ঠিক করে ফেলেছে । ওহ আবার খুব গোছালো স্বভাবের । বাসা, সানির জন্য স্কুল সব ঠিক করে ফেলেছে ।
পরেরদিন সকালেই ঝরনা নিজের বাসায় উঠে যায় । একেবারে নতুন বাসা । অনেকটা খোলামেলা । ঐ বাসা থেকে ফিরেই নিজের বাসা আর ভালো লাগে না । শোয়েবকে রেগে বলি
-একটা বাসাতেই চার বছর হয়ে গেলো । তুমি এত কুইড়ার বাদশা হয়ে গেলা কবে থেকে । একটা সুন্দর বাসা দেখো না ।
-সেদিনই না তুমি বললা যতদিন এই শহরে আছি এই বাসাতেই থাকবো । বাড়িওয়ালা এত ভালো । আলো বাতাসও প্রচুর । শোয়েব অবাক গলায় উত্তর দেয় । আসলেও বলেছিলাম । কিন্তু কিভাবে বুঝাই তখনতো ‘প্রিয় বান্ধবী’ ছিলো না ।
ঝরনার ছেলে সানি আর আমার ছেলে সায়ানের স্কুলও এক । হঠাৎ করেই সায়ানের পড়াশুনার ব্যাপারেও বাড়তি নজর দিতে শুরু করি । ঝরনার ছেলের চাইতে এক নম্বর হলেওতো বেশী পেতে হবে ।
এভাবেই দিন যায় । কলেজেও সবাই জানে আমি আর ঝরনা ‘প্রিয় বান্ধবী’ । এর মাঝেই কলেজের পিকনিক চলে আসে । সবার সাথে আমরাও যাই । আমি সায়ানকে নিয়ে নিজেদের গাড়িতে যাই । ঝরনা সানিকে নিয়ে পিকনিক বাসে । এর মাঝেই সায়ান আর সানি খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেছে । যেখানেই যায় দুজন একসাথে থাকে । পিকনিক শেষে সানি সায়ানের সাথেই আমাদের গাড়িতে উঠে বসলো । ঝরনা সানিকে ডাকাডাকি করলেও আমি বললাম
-তুইও আমার গাড়িতেই আয় না । একসাথে গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে ।
-নারে প্রিন্সিপ্যাল স্যারের সাথে কিছু কথা আছে । পিকনিকের হিসাব নিকাশ নিয়ে । ঝরনা সুযোগ পেয়ে নিজের গুরুত্বটা একটু প্রকাশ করলো । আমার বিরক্ত লাগলো । আমি এই কলেজে আছি চার বছর । আর তুই সেদিন এসে যোগ দিলি । আমার কাছে তোর এসব গল্পের কোনো মানে আছে । তবে মুখে কিছু বললাম না ।
-ঠিক আছে সানিকে তোর বাসাতে পৌছে দেবো । বলে চলে আসলাম । দুই ছেলে গাড়িতে বসে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিলো । সারাদিনের পিকনিকের ধকলে আমি একটু চোখ বুঝেছিলাম । হঠাৎ বিকট শব্দ আর প্রবল ঝাকুনিতে ঝিমানি ভাবটা মুহূর্তেই কেটে যায় । কিভাবে কি হয়েছে কিছুই জানি না । গাড়ি রাস্তার পাশে একটু ঢালুতে থেমে আছে । ড্রাইভারের সাইডের গ্লাস ভাঙ্গা । ঐ সাইডেই সানি বসেছিলো । সেই জানালারও কাঁচ ভাঙ্গা । সানির মনে হয় জ্ঞান নাই । তবে সায়ান কান্নাকাটি করলেও ঠিক আছে । নিজেকে অক্ষতই মনে হয় ।
-ম্যাডাম একটা ট্রাক সাইড দিয়া মাইরা দিছে । ড্রাইভার পিছনে ফিরে আমাকে বললো ।
-তুমি ঠিক আছোতো । আমি জিজ্ঞেস করি ।
-নাহ ম্যাডাম । হাতে আর বুকে খুব ব্যথা । হাত মনে হয় ভাইঙ্গা গেছে ।
মনে মনে আল্লাহকে ডাকি । নিজের দিকের দরজা খুলে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসি । একটু সামনে আসতেই বুকটা ছ্যাত করে উঠে । আর দশ গজ এগোলেই বিশাল খাদ । ওখানে গাড়ি পড়লে কি হতো ভাবতেও ভয় লাগে । সন্ধ্যা হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগেই । এই সময়ে রাস্তায় দুরপাল্লার বাস ছাড়া অন্য গাড়ি আসার সম্ভাবনা কম । আর বাস ড্রাইভাররা সাধারনত হাত তুললেও গাড়ি থামায় না । এভাবে বাস ডাকাতির গল্পওতো কম না । অনেক চেষ্টা করেও ড্রাইভার কিংবা সানির দিকের দরজা খুলতে পারি না । আবার গাড়িতে ফিরে আসি । সানি তখনো জ্ঞানহীন । গাড়ির অল্প আলোতে কেমন নির্জীব লাগে । কেনো যেনো মনে হয় বেশী সময় হাতে নাই । একবার সায়ানের মুখের দিকে একবার সানির মুখের দিকে তাকাই ।
-গাড়ির ইঞ্জিন ঠিক আছে ? আমি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করি ।
-জ্বি ম্যাডাম আছে ।
-তুমি পাশের সিটে সরে আসতে পারবে ।
-জ্বি ম্যাডাম পারবো । বলে অনেক কষ্টে ড্রাইভার পাশের সিটে গিয়ে বসে । অন্ধকার হয়ে গেলেও জায়গাটা আমার চেনা । ছয় সাত কিলোমিটার দুরে একটা প্রাইভেট হাসপাতাল আছে । শুনেছি চিকিৎসা ভালোই । আমি কোনোমতে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলাম । শোয়েবের অনেক পীড়াপীড়িতে দুইদিন ড্রাইভিং শিখতে বসেছিলাম । তাও প্রায় বছরখানেক আগে । আল্লাহ আল্লাহ করে গাড়ির চাবি ঘুরালাম । ইঞ্জিন একবারেই চালু হয়ে গেলো । গিয়ার দিয়ে এক্সিলারেটরে পা দিতেই গাড়ি নড়ে উঠলো । ধীরে ধীরে গাড়িকে রাস্তায়ও নিয়ে আসলাম । যতরকম দোয়া দুরুদ জানি পড়তে পড়তে রওয়ানাও হয়ে গেলাম । রাস্তা একদম ফাঁকা । হেডলাইটের আলো ছাড়া আর কোনো আলো নাই । কতক্ষণ পরে মনে নাই পরিচিত পেট্রোল পাম্পটা চোখে পড়লো । এর একটু পরেইতো হাসপাতালটা । হাসপাতালের গেট দিয়ে ঢুকে ব্রেক করলাম । সাথে সাথে হঠাৎ তীব্র ব্যথা নেমে এলো শরীরজুড়ে । এরপরে আর কিছু আমার মনে নাই ।
যখন জ্ঞান ফিরে তখন দেখি আমার দুই হাতেই সাদা প্লাস্টার । শোয়েব সায়ানসহ আরো অনেকেই দাঁড়িয়ে । সায়ানকে দাঁড়ানো দেখে স্বস্থি পাই । তার মানে ওর কিছু হয় নাই ।
-ইউ আর গ্রেট ম্যাডাম । চোখ মেলতেই একজন বলে । পোশাক দেখে বুঝতে পারি হাসপাতালের ডাক্তার হবেন ।
-দুই হাতে ফ্রাকচার নিয়ে, সেইভাবে ড্রাইভিং না জেনেও এতটা পথ কেউ ড্রাইভ করতে পারে । অবিশ্বাস্য । ছোট ছেলেটাকে আর একটু দেরী করে আনলেই হয়তো বাচানো যেতো না । প্রচুর ইন্টারনাল ব্লিডিং হয়েছিলো ।
-এখন কেমন আছে সানি ? ডাক্তারের কথার মাঝখানেই আমি জিজ্ঞেস করি ।
-এক ব্যাগ রক্ত দিয়েই জেলা সদরে এম্বুলেন্স করে পাঠিয়ে দিয়েছি । কিছুক্ষণ আগেই ফোনে খবর পেয়েছি এখন আশংকামুক্ত ।
-ড্রাইভার ?
-তার শুধু কয়েকটা হাড় ভেঙ্গেছে । এমনিতে ভালো আছে । উত্তর দিয়ে একটু অন্যদিকে যান ডাক্তার ।
-দেখেছো ড্রাইভিংটা শিখে রাখলে কত কাজে লাগে । শোয়েব মৃদু হেসে বলে ।
-তবে পাগলামিটা একটু বেশী করে ফেলেছো । বলে কপালে হাত রাখে শোয়েব । সামান্য স্পর্শ তাতেই কেমন প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে মনে ।
হাসপাতালেই রাতটা কাটাতে হয় । ভোরে ঘুম থেকে উঠেই দেখি ঝরনা বিছানার পাশে বসে আছে ।
-কেমন আছিস তুই ? চোখ মেলতেই আকুল হয়ে প্রশ্ন করে ঝরনা ।
-ধুর আমিতো ভালোই আছি । আমার হাতে যে ফ্রাকচার আমি নিজেই টের পাই নাই । ডাক্তার বানাইয়া বানাইয়া বলছে কিনা কে জানে । সানি কেমন আছে ?
-বিপদমুক্ত । তুই না থাকলে...তুই দুই হাতে ফ্রাকচার নিয়া এতটা পথ ?
-ধুর কতটা পথ ?
-সবাইতো বলে চল্লিশ কিলোমিটার ।
-শোন তোর সেই মিথের গল্প মনে আছে । পনের বিশ কদম হাটলে যেমন এক কিলোমিটার হয় সেরকম ছয় সাত কিলোমিটারও চল্লিশ কিলোমিটার হয় ।
-তারপরো...তুই না থাকলে সানিকে মনে হয় বাচানো... আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে ঝরনা । কথা শেষ করতে পারে না । আমার একটু বিরক্ত লাগে ।
-শোন ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদিস নাতো । ‘প্রিয় বান্ধবী’ অথবা ‘জানি দুশমন’ যাই হই না কেনো আমিওতো একজন মা । আর যেকোনো মা-ই একই কাজ করবে । চিন্তা করে দেখ সায়ানের এমন হলে তুই কি করতি । এত কিছু বলার পরেও ঝরনার কান্নার বেগ কমে না ।
-দুই হাতে ফ্রাকচার, মাথায়ও নাকি ব্যাথা ছিলো । ড্রাইভিং জানে না । পঞ্চাশ কিলোমিটার ড্রাইভ । বিশ্বাস করন যায় । বান্ধবী হইলে এমনই হইতে হয় । একটু দুরেই দুই নার্স নিজেদের মধ্যে গল্প করছে । হায়রে এখানেও সেই বান্ধবীর গল্প । আমি জানি এই গল্প এখন এভাবেই ডালপালা ছড়াবে । আমার অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না । ‘প্রিয় বান্ধবী’ নাকি কলেজের টিচার্স ইলেকশনে দাঁড়াবে । ওকে কিভাবে হারানো যায় সেই বুদ্ধিতো করতে হবে ...