সমকালে মানুষের মুখে আজও উচ্চারিত হয় একটি নাম—বড় পীর আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)। তাঁকে নিয়ে অনেক কথা, কিংবদন্তি বিদ্যমান সমাজে। গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় ভক্তরা তাঁকে স্মরণ করেন। প্রচলিত পীরের যে ধারণা, তার সঙ্গে প্রকৃতপক্ষে শায়খ আবদুল কাদের জিলানির মিল নেই। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ও বুদ্ধিদীপ্ত এক আলোর সারথী। হজরত হাসান (রা.)–এর বংশের অত্যুজ্জ্বল এই মানুষটিকে নিয়ে এই লেখা।
হিজরি পঞ্চম শতকে এসে মুসলিম জাহান এক চরম দুর্বিপাকে পড়ে। কেন্দ্রীয় শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ায় খিলাফতের মধ্যে গড়ে ওঠে বহু স্বাধীন রাজ্য। এর মধ্যে আবার একদিকে চলতে থাকে গৃহযুদ্ধ ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, অন্যদিকে চলতে থাকে খ্রিষ্টান শক্তি কর্তৃক বহিরাক্রমণ। এই নাজুক রাজনৈতিক অবস্থার পাশাপাশি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ও নেমে এসেছিল চরমভাবে। গ্রিক ও অন্যান্য অমুসলিম দর্শন নির্বিচারে আমদানি ও তার ব্যাপক চর্চার কারণে মুসলিম মানসে ছড়িয়ে পড়েছিল এর মারাত্মক কুফল। তাঁদের চিন্তা ও বিশ্বাসে ইসলামবিরোধী ভাবধারার অনুপ্রবেশ ঘটে। ইসলামের নির্ভেজাল তৌহিদি দর্শন কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনৈসলামি দর্শনের সংমিশ্রণে হারিয়ে ফেলে তার স্বকীয়তা। এর ফল ছিল যেমন মারাত্মক, তেমনি সুদূরপ্রসারী। ‘আমাদের সূফীয়ায়ে কিরাম’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, জাতির এই চরম দুর্দিনে ইসলামের আঁধার আকাশে উদিত হয়েছিল এক রওশন আফতাব, যার বিমল জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়েছিল দিগদিগন্ত। তিনি হচ্ছেন মুহিউদ্দীন আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)।
তিনি মুসলিম মিল্লাতের, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধঃপতন দূর করে তাদের সিরাতুল মুস্তাকিমে পুনঃস্থাপনের জন্য চালিয়েছিলেন বিরামহীন সংগ্রাম। বিভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে ইসলামি দর্শনকে মুক্ত করার জন্য করেছিলেন আমরণ সাধনা। প্রমাণ করেছিলেন এর শ্রেষ্ঠত্ব। গ্রিক ও ভারতীয় অনৈসলামি পরিবেশ থেকে ইসলামি তাসাউফকে উদ্ধার করে ভাস্বর করে তুলেছিলেন স্বকীয় মহিমায়। শরিয়তকে তিনি পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। তরিকত, হাকিকত ও মারেফাতের সহিহ পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। শতধাবিচ্ছিন্ন জাতির মধ্যে জাগিয়ে তুলেছিলেন ঐক্যের চেতনা। আসলে তিনি মুসলিম মিল্লাতের একজন অনিবার্য পুরুষ ছিলেন। তিনি বিপর্যস্ত, বিপন্ন মুসলিম উম্মাহকে নতুন পথ দেখিয়েছেন, আশার আলো জ্বালিয়েছেন।
প্রতিবছর এই মনীষীর মৃত্যুর দিনটি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। দিনটি ফাতেহা ই ইয়াজ দাহম হিসেবে পালিত হয়।
শামসুল আলম তাঁর ‘ABDUL QUADER GHILANI’ গ্রন্থে বলেন, আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) জিলান শহরের নাইফে ৪৭০ হিজরির রমজানে/১০৭৭ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। জিলান শহর হচ্ছে কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ তীরবর্তী পর্বতঘেরা অঞ্চল।
তাঁর পিতার নাম ছিল সৈয়দ আবু সালেহ মুসা জেঙ্গি এবং মাতার নাম ছিল সৈয়দা উম্মুল খায়ের ফাতিমা। পিতার দিক দিয়ে তিনি ছিলেন হজরত ইমাম হাসান (রা.)–এর বংশধর আর মায়ের দিক থেকে ছিলেন হজরত ইমাম হুসাইন (রা.)–এর বংশধর। হাসানি ও হুসাইনি দুই পবিত্র রক্তধারার সম্মিলন ঘটেছিল তাঁর মধ্যে।
তাঁকে নিয়ে অনেক কথা বইপুস্তকে পাওয়া যায়। এখানে তাঁর প্রতিভাদীপ্ত সৃজনশীল কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা যাক। সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নাদভি লিখেছেন, ইমাম গাজালি (রহ.)–এর ইহয়াউল উলুমুদ্দিন-এর পরে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিবিশিষ্ট রচনারীতির প্রতিকৃতি হিসেবে এবং যথাযথভাবে যুগের চাহিদা পূরণে সফল ও বরকতময় প্রচেষ্টা হিসেবে যে গ্রন্থটির উল্লেখ করতে হয়, সেটি হলো শায়খ আবদুল কাদের জিলানির ‘গুনইয়াতুত তালিবিন’। যারা নিজেকে সংশোধন করতে আগ্রহী, তাদের জন্য বিশেষ করে মুরিদদের পথপ্রদর্শনের মূল্যবান দিকদর্শন রয়েছে এটিতে।
হজরত শায়খ জিলানির শিষ্যমণ্ডলীভুক্ত ব্যক্তিগণ এবং যাঁরা কোরআন, সুন্নাহ এবং সালফে সালিহীন ও সুমহান পূর্বসূরিদের অনুসৃত আকিদা ও প্রত্যয়ের আলোকে নিজেদের জীবনকে সুগঠিত করতে অভিলাষী, যাঁরা নিজের চরিত্র শোধন ও অভ্যন্তরীণ পরিশুদ্ধি লাভে আগ্রহী, তাঁদের সবার কাছেই এই মহান গ্রন্থটি নীতিমালা হিসেবে গৃহীত হয়েছে। এশিয়া ও আফ্রিকা—উভয় মহাদেশে এই গ্রন্থটির মাধ্যমে উপকৃত লোকদের সংখ্যা হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ।
স্বভাব–চরিত্র
তিনি ছিলেন রাসুলে করিম (সা.)–এর পূর্ণ অনুসারী। মানুষে মানুষে তিনি কোনো পার্থক্য করতেন না। বাদশাহ-ফকিরকে দেখতেন একই নজরে। এমনকি গরিবকে দিতেন তিনি প্রাধান্য। আমির লোকদের হাদিয়া তিনি গ্রহণ করতেন না। তবে গরিবের হাদিয়া গ্রহণ করতেন সন্তুষ্টচিত্তে। জীবনে শাহি–দরবারে কখনো গমন করেননি। তাঁর দরবারে যত হাদিয়া উপস্থিত, হতো তিনি দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত লোকদের মধ্যে তা বিলিয়ে দিতেন। মানুষের দুঃখ সহ্য করতে পারতেন না। তা দূর করার জন্য ব্যাকুল ছিলেন। তিনি বন্ধুবৎসল, বিনয়ী, মিষ্টভাষী ও অমায়িক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। অপরের সালামের অপেক্ষা তিনি করতেন না। আগেই সালাম দিতেন, মুসাফাহার জন্য আগেই হাত বাড়িয়ে দিতেন।
উপদেশ
গাউসুল আজম বড় পীর আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) উপদেশের এমন সব মণি-মুক্তা ছড়িয়ে রেখে গেছেন, যার ঔজ্জ্বল্য কোনো দিনই হারাবে না। যেমন:
তিনি বলেন, মুমিনের কাজ তিনটি: আল্লাহর হুকুম পালন করা, তাঁর নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকা এবং তাঁর ইচ্ছা–সিন্ধুতে নিজেকে বিলীন করে দেওয়া।
প্রথমে ফরজ, পরে সুন্নত ও তারপরে নফল। ফরজ ছেড়ে সুন্নত–নফল নিয়ে মশগুল থাকা আহম্মকি। সুন্নত আদায় বাকি রেখে নফল আদায়ের চেষ্টারও কোনো মূল্য নেই। ফরজ ছেড়ে দিয়ে সুন্নত ও নফল নিয়ে থাকা বাদশাহকে পরিত্যাগ করে গোলামের খিদমতে আত্মনিয়োগের শামিল। শুধু প্রতিমাপূজার নামই শিরক নয়, প্রবৃত্তির দাসত্ব করাও শিরকের শামিল।
শায়খের ইন্তেকাল
হিজরি ৬৬২ সালের ১১ রবিউস সানি তাঁর মাশুকে আলার নিকট গমন করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। তাঁর চার স্ত্রীর গর্ভে ২৭ পুত্র ও ২২ কন্যা জন্মগ্রহণ করেন।
ইসলামের খিদমতের জন্য তিনি যেসব কাজ করেছেন, সারা দুনিয়ার মুসলমানদের জন্য অনাগতকাল ধরে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। তাঁর ইন্তেকালের দিনকেই ফাতেহা ই ইয়াজ দাহম বলা হয়।
একটা কথা মনে রাখতে হবে, শায়খ জিলানি দুনিয়াতে বৈরাগ্যসাধনের শিক্ষা দেননি। তিনি জগৎকে ব্যবহার ও পরিমাণমতো উপভোগ করতে নিষেধ করেননি। তবে এর উপাসনা ও দাসত্ব এবং আন্তরিক সম্পর্ক ও ভালোবাসা স্থাপন করতে নিষেধ করেছেন। তাঁর উপদেশাবলি ও মূলতত্ত্ব রাসুলের হাদিস দ্বারা প্রমাণ করেছেন। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, অবশ্যই জগৎ তোমাদের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে আর তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে পরকালের জন্য।
*মিরাজ মোহাইমেন: ইসলাম ধর্মীয় গবেষক