আমার বয়স যখন দশ বছর। তখন পথে-ঘাটে, চা দোকানে, সেলুনে শোভা পাওয়া একটি সিনেমার পোস্টার আমার নজর কাড়তো। এটি ছিল এ জে মিন্টু পরিচালিত ‘প্রতিহিংসা’ ছায়াছবির। প্রথমবার পোস্টারটি দেখার এক অথবা দেড় বছর পর লায়ন সিনেমায় ছবিটি দেখি। তখন বয়সের কারণে গল্পের শিক্ষণীয় দিকগুলো নজরে আসেনি। তবে কাহিনি আমার স্মৃতিতে ছিলো। যখন আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিলাম, তখন মর্মকথা উপলব্ধি করতে পারি। পরে ছবিটি আরো দু-একবার দেখেছিলাম।
অপরাধ জগতের বাসিন্দা জসিম বিয়ের পর ভালো হয়ে যান। স্ত্রী আনোয়ারাকে খুব ভালোবাসেন। আনোয়ারাও চান না জসিম অপরাধজগতে থাকুক। তাই তারা সাধারণ জীবনযাপন করছিল।
জসিমের ছোট ভাই তখনো অপরাধজগতে। খুনের মামলার আসামি। বিচারক আনোয়ার হোসেন। জসিম রায়ের আগেরদিন রাত বিচারকের বাসায় যান। আনোয়ার হোসেনকে বুঝিয়ে বলবেন, যাতে ভাইকে ফাঁসি না দেয়। ভাইকে ভালো পরিবেশে রেখে ভালো মানুষ হিসেবে গড়বে। তার বিশ্বাস— পরিবেশ ভালো হলে যেকোনো মন্দ মানুষ ভালো হতে পারে।
জসিম জানালা দিয়ে উকি দিয়ে দেখে, আনোয়ার হোসেন কয়েজন বন্ধুর সাথে তর্ক করছে। তর্কের বিষয় রক্ত আর পরিবেশ। আনোয়ার হোসেন বিশ্বাস করে, মানুষ মন্দ হয় রক্তের দোষে। অপরাধী পরিবারের সদস্য যত ভালো পরিবেশেই থাকুক, সে অপরাধী হবেই। আনোয়ার হোসেন এই কথা কঠোরভাবে বিশ্বাস করেন। জসিম হতাশ হয়ে যান। আনোয়ার হোসেনের সাথে দেখা না করে বাড়ি ফেরেন।
পরদিন কোর্টের বাহিরে জসিম আনোয়ার হোসেনকে অনুরোধ করে, যেন ভাইয়ের সাজা কমিয়ে সহজ করে দেয়। জসিম বলে, আমি তাঁকে ভালো পরিবেশে রেখে ভালো মানুষ হিসাবে গড়ে তুলবো। কিন্তু আনোয়ার হোসেন মোটেই এই চিন্তাধারায় বিশ্বাসী নয়, তা কঠোরভাবে জানিয়ে দিলো। ফাঁসির রায় হলে জসিমের বুকে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে উঠলো, অন্ধ ভালোবাসা বিবেক অচল হয়ে গেলো।
জসিম আবার অপরাধ জগতে প্রবেশ করলো। স্ত্রীর সত্য ভালোবাসা পরাজিত হলো। অন্ধকার জগতের সর্দার জসিম প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে আনোয়ার হোসেনের সন্তানসম্ভবা স্ত্রী রোজীকে তুলে আনে। রোজী পুত্রসন্তান প্রসব করে। একই সময়ে আনোয়ারাও একটি পুত্রসন্তান প্রসব করে। তখন জসিমের অপরাধী মস্তিষ্কে প্রতিহিংসার নতুন খেলা আসে।
জসিম গোপনে সন্তান বদল করে। বিষয়টি জানতো শুধু তার এক সহযোগী। সন্তান বদল করার পর আনোয়ার হোসেনের কাছ থেকে টাকা দাবি করে। আনোয়ার হোসেন টাকা দিয়ে স্ত্রী-সন্তান মুক্ত করে নিয়ে যায়।
জসিমের উদ্দেশ্য ছিলো, তার সন্তান আনোয়ার হোসেনের কাছে লালিত-পালিত হয়ে সমাজে ভালো হয়ে থাকবে। আর আনোয়ার হোসেনের সন্তান সমাজে দাগী আসামি হবে। আনোয়ার হোসেনকে বুঝিয়ে দেওয়া রক্ত নয়, পরিবেশের কারণে কেউ মন্দ হয় আর কেউ ভালো হয়।
জসিম অন্ধকার জগতে ফিরে যাওয়ায় আনোয়ারা আলাদা থাকে। দর্জি কাজ করে সন্তানকে সমাজে ভালো মানুষ করতে চান। কিন্তু জসিম গোপনে ছেলেক মন্দ কাজে প্ররোচিত করে। যদিও জসিম আনোয়ারার মনে কষ্ট দিতে চান না।
এক সময় জসিমের কাছে থাকা ছেলেটি শহরের সেরা গুণ্ডা হয়, এ চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রবীর মিত্র। আর আনোয়ার হোসেনের কাছে থাকা ছেলেটি হয় পুলিশ অফিসার, এ চরিত্রে আছেন সোহেল রানা।
সোহেল রানা ও ববিতা একে অপরকে ভালোবাসে। ববিতাকে ভালোবাসে প্রবীর মিত্র শুরু হয় ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী, দুই নায়কের দ্বৈরথ। তবে জসিম চায় প্রবীর মিত্র ববিতার জীবন থেকে সরে যাক। আরও চায় প্রবীর মিত্র খুনি আসামি হয়ে আদালতে যাক। আনোয়ার হোসেন তাকে ফাঁসি দিলে প্রতিহিংসা পূরণ হবে।
ববিতার বাবাকে খুন করে জসিম, আর আসামী হয় প্রবীর মিত্র। ততদিনে সন্তান বদলের কথা প্রকাশ পায়। অপরাধী জসিম পালিয়ে যাওয়ার সময় পুত্র সোহেল রানা বারবার থেমে যেতে বলে। জসিম থামে না দৌড়াতে থাকি। বাধ্য হয়ে সোহেল রানা গুলি করে, পুত্রের গুলি খেয়ে জসিম লুটিয়ে পড়ে। সোহেল রানা যখন কাছে আসে, জসিম বলে, আমাকে এতোবার দাঁড়াতে বললি, একবারও বাবা দাঁড়াও বললি না, যদি বাবা বলে ডাকতিস আমি না দাঁড়িয়ে পারতাম? (সম্ভব এমন ছিলো সংলাপটি)সোহেল রানা কথাটি শুনে কাঁদতে থাকে। পুত্রের কোলে বাবার মৃত্যু হয়।
‘প্রতিহিংসা’ আমার প্রিয় ছবি, কারণ এর শিক্ষামুলক কাহিনী। যেখানে আমি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা খুঁজে পেয়েছি।
এক. প্রতিহিংসায় কখনো ভালো ফলাফল আসে না, সমস্যার সমাধান নয়। প্রতিহিংসা আরেকটি প্রতিহিংসা জম্ম দেয় আর ভালোবাসা খুন করে। প্রতিহিংসা বুমেরাং হয়ে নিজেকে আঘাত করে একদিন। জসিমের পরিণতি দেখলে বুঝা যায়, প্রতিহিংসা কতো ভয়ঙ্কর! পৃথিবীতে যা কিছু ভালো তা ভালোবাসার অবদান, যা কিছু মন্দ তা প্রতিহিংসার প্রতিদান।
দুই. রক্তের সম্পর্ক নয়, পরিবেশ তৈরি করে ভালো আর মন্দ!
তিন. কোনো অপরাধীর যদি মৃত্যুদণ্ড বা কঠোর শাস্তি হয়, তাহলে সেই অপরাধীর আত্মীয়দের প্রতি রাষ্ট্রের উচিৎ তাদের সুস্থ্য ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে সহযোগিতা করা। তারা যেন সমাজে তিরস্কার, উপহাসের শিকার না হয়। তাদের বুঝাতে হবে, আপনজনটি অপরাধ করায় শাস্তি পেয়েছে। একই অপরাধ যেন তারা না করে। সর্বোপরি খেয়াল রাখতে হবে, তারা যেন আপনজন হারিয়ে সমাজের তিরস্কার-উপহাস হজম করতে না পেরে প্রতিহিংসাপরায়ণ না হয়ে উঠে।
মূলত অপরাধ শুরু হয় অভাব থেকে, অপরাধ বিস্তার হয় প্রতিহিংসা থেকে। অপরাধের কারণ অভাব দূর করে, প্রতিহিংসা দমাতে হবে।
* লিখেছেন: আকবর খসরু