১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুন সারাজেভোতে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ এবং তার স্ত্রীকে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এবং ২৩ জুলাই অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রদূতের পক্ষ থেকে সার্বিয়াকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করে চরমপত্র প্রদানের মধ্য দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। পরবর্তীতে ২৮ জুলাই অস্ট্রিয়ার অস্ট্রো-হাঙ্গেরী সাম্রাজ্য সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে সার্বিয়াও পাল্টা যুদ্ধের পথ বেছে নেয়। কিন্তু এ যুদ্ধ ক্রমেই সমগ্র বিশ্বের মধ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বীজ
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিলো বিশ্বের অভূতপূর্ব ধ্বংসযজ্ঞ। এর প্রেক্ষাপট একদিনে সৃষ্টি হয়নি। বরং বহুদিন ধরে রাষ্ট্রব্যবস্থার ভেতর পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকে এ সংঘাত সৃষ্টি হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পেছনে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের মরক্কো অঞ্চলে ফরাসি অনুপ্রবেশ এবং ১৯১২ থেকে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের বলকান সংকটকে অনেকে প্রধান নিয়ামক হিসেবে অনেকে মনে করলেও এর বীজ ছিলো বহু পূর্বে। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে বার্লিনে এক সম্মেলনে জার্মানি, রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি ছিলো গোপন চুক্তি যাকে ইতিহাসে ‘ত্রিশক্তি আঁতাত বলেও অভিহিত করা হয়।
এরপর ঘটে যায় ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের মরক্কো সংকট এবং ১৯১২-১৩ খ্রিস্টাব্দের স্বল্পস্থায়ী দুটি বলকান যুদ্ধ। মূলত ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের বসনিয়া নিয়ে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।
এতে করে সমগ্র বিশ্বে সৃষ্টি হয় চরম গোলযোগ। অস্ট্রিয়ার উগ্র স্বাদেশিকতা এবং ইউরোপীয় বর্ণবাদও এ যুদ্ধের পেছনে ছিলো। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুন অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্চ ডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ এবং তার স্ত্রী সোফিয়া হোয়াইট অস্ট্রিয়ার সারাজেভোতে বেড়াতে এলে সেখানে তাদের দুজনকে গ্যাবরিয়েল প্রিন্সেপ নামে একজন সার্ব আততায়ী গুলি করে হত্যা করে। এর প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুলাই অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রদূত সার্বিয়ার রাজার কাছে এক চরমপত্র পাঠান যা পাঠ করে সার্বিয়ার রাজা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন। ফলে এর ঠিক দু’দিন পরেই রাশিয়া তার সামরিক বাহিনীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেয়। এরপর ২৮ জুলাই অস্ট্রো-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট
ওদিক থেকে জার্মানরা রাশিয়াকে বারংবার সতর্ক করে আসছিলো। কিন্তু রাশিয়ার সামরিক বাহিনী রণে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে। একইভাবে জার্মানি ফ্রান্সকেও সতর্ক করতে থাকে। কিন্তু উভয় দেশই জার্মানিকে পাত্তা না দেয়ার ফলে ১ আগস্ট রাশিয়ার বিরুদ্ধে এবং ৩ আগস্ট ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে জার্মানি। শুরুতে ব্রিটেন কোনো যুদ্ধে বিবদমান কোনো পক্ষে না গেলেও পরবর্তীতে তারা কেবল জার্মানিকে শাসিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত থাকে। জার্মানি ব্রিটেনের সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে সৈন্যসমাবেশ চালিয়ে গেলে ব্রিটেন ৪ আগস্ট জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এরপর যুদ্ধ বেধে যায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভৎস হত্যাযজ্ঞ ছিলো অভূতপূর্ব। যুদ্ধে যত মানুষ পঙ্গু হয়, তার চেয়ে বেশি হয় পিতৃ-মাতৃহারা। এ ছাড়া যুদ্ধে লিপ্ত ছিলো ৭০ টিরও বেশি দেশ। এই দেশগুলোর বাইরে বর্তমানে স্বাধীন বেশ কয়েকটি দেশও সেসময় উপনিবেশ হিসেবে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধে ফ্রান্সের ৮০ লক্ষ, জার্মানির এক কোটি ৩০ লক্ষ, অস্ট্রো-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের ৯০ লক্ষ এবং ইতালির ৬০ লক্ষ সৈন্য অংশ নেয়। অন্যদিকে ব্রিটেন ৯০ লক্ষ এবং যুক্তরাষ্ট্র ৪০ লক্ষ সৈন্য পাঠিয়েছিলো। এ যুদ্ধের এক কোটি সৈনিক নিহত হয়। বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর আয়তনের হিসাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির স্বীকার হয় সার্বিয়া। সার্বিয়ায় মৃতের সংখ্যা এক লক্ষ ৩০ হাজার এবং আহতের সংখ্যা ছিলো এক লক্ষ ৩৫ হাজার। ভয়াবহ এ যুদ্ধে ৫০ হাজার থেকে এক লক্ষ বেসামরিক লোকের প্রাণহানি ঘটে। অনুমান করা হয়, শুধু অটোমান সাম্রাজ্যেই ১২ থেকে ১৫ লক্ষ আর্মেনীয়কে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া যুদ্ধবন্দী হয় ৬০ লক্ষ মানুষ, গৃহহারা হয় এক কোটি মানুষ, ৩০ লক্ষ নারী তাদের স্বামীকে হারায় এবং ৬০ লক্ষ শিশু অনাথ হয়ে পড়ে।