What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected প্রদোষের দাদুর কাহিনী (1 Viewer)

BRICK

Board Senior Member
Elite Leader
Joined
Dec 12, 2019
Threads
355
Messages
10,071
Credits
81,248
Sari
Strawberry
Glasses sunglasses
T-Shirt
Calculator
Watermelon
প্রদোষের দাদু নীলকন্ঠ বসুর বিয়ের পরে ৬০ বছর কেটে গেল। নিজের বয়স ৮৪, স্ত্রীর বয়স ৭৭ এর মত । ছেলে মেয়ের বয়স ৫৫-৫৬ এর আশে পাশে । কিন্তু বুড়োর মনের থেকে আয়না খাতুন নামটা এখনো গেল না!

আয়না নাকি ফরিদপুরে নীলকন্ঠ দাদুর বাড়ির উল্টো দিকে পুলিশ লাইনে থাকত। আয়নার বাবা পুলিশ ইন্সপেক্টর ছিল। কথায় কথায় দাদু এটাও বলত যে আয়না দাদুর থেকে বয়সে ছিল ২ বছরের ছোট। দাদু ১৯৪৭ সনে দেশ ছেড়েছে তখন ওনার বয়স ছিল ১৫, তাহলে দাদুর ভালোবাসার পাত্রী আয়না খাতুন তখন ১৩ বছরের বালিকা। শালা বুড়োর রগর দেখলে পিত্তি জ্বলে যায়। ওই জমানায় একটা কচি মাল তুলেছিল নীলকন্ঠ বসু, ভাগ্যবান লোক মাইরি!

ভালোলাগা এবং ভালোবাসার এই কাহিনী পরিবারের সকলের'ত বটেই, বন্ধু বান্ধবদেরও অজানা ছিল না। আয়নার কথা শুনতে শুনতে কান পেঁকে গেছিল সবার। কিন্তু দাদু তাও বলতে থামেননি। কেউ কিছু বললেই দাদুর প্রতিক্রিয়া,

- অন্তরের ভালোবাসা দূরে ছুড়ে ফেলে দেয়া খুব মুস্কিল। তোরা ছাগলের দল, এই যুগের স্বার্থপর পোলাপান, এইসব বুঝবি না। তোদের ভালোবাসা এই আসে, এই যায়।

নাতি প্রদোষ একদিন জাস্ট একটা মন্তব্য করে কেঁচিয়ে দেয়,

- তোমার আয়না নিশ্চয় এতদিনে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। মানে কবরের মধ্যে শুয়ে পড়েছে। এত বছর পরে আয়না পাওয়ার বায়না আর করো না দাদুন। এখন তুমিও দিন গুনতে শুরু করো। বয়স ৮৪ হয়েছে। পরের জন্মে বাংলাদেশে আবার জন্ম নিও। মনের ইচ্ছে হয়ত পুরণ হবে।

এটা শোনার পরে দাদুর বিষণ্ণ মুখটা দেখতে প্রদোষের একটুও ভালো লাগেনি। ও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বলেছিল,

- দাদুন, আমার মাস্টার্স ডিগ্রীর পরে চাকরি বাকরি না পাওয়া পর্যন্ত ফ্রিই থাকব। তখন তোমায় আমি নিশ্চয় ফরিদপুরে নিয়ে যাব।

দাদুর চোখ চিক চিক করে উঠল,

- আমারে কবে ফরিদপুরে নিয়া যাবি বাবাই ?

- আরতো মাত্র দু বছর বাকি আমার মাস্টার্স কমপ্লিট হতে। আমারও ইচ্ছে হয় বাংলাদেশ ঘুরে দেখতে। সবাই এত কিছু বলে, তোমায় তোমার আয়না ম্যাডামের কাছে গ্যারেজ করে দিয়ে আমি স্টিমারে চড়ব, স্টিমারের ছাদে বসে পদ্মা দেখব, ইলিশ মাছের হালকা ঝোল আর আমন চালের ভাত খেতে খেতে কবিতা লিখব। দারুন হবে!!

নীলকন্ঠ বসুর এসব শুনে যে কী হাসি। এর পরের থেকে ৮৪ বছর বয়সের বুড়ো লেগে গেল দিনে দুবেলা রুটিন করে যোগা করতে। সময় করে খাওয়া, সকাল সন্ধ্যায় পদভ্রমন, সময় করে দাঁড়ি কাটা, ফুল বাগানে জল দেয়া .....

প্রদোষ নিজের এবং দাদুর জন্য পাসপোর্টের এপ্লিকেশন দেয়ায়, মার মার করে ছুটে এসেছে ওর মা এবং মামা,

- এসব কি পাগলামি হচ্ছে বাবাই? তুমি কি দাদুর মতই পাগল হয়ে গেছ? বাবা জন্ম থেকেই পাগল, ৭০ বছর আগে দেশ ছেড়েছে। কিন্তু মূর্খের মত এখনো তার ভালোবাসার পাত্রীকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। যাচ্ছেতাই !! লজ্জা শরম বলে কিছু নেই। লোকজন জানলে কি বলবে!

প্রদোষ জবাব দেয়নি। কিন্তু দমে যায়নি ওর মা আর মামা,

- দেখ বাবাই, বাবার বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরেছে। কিন্তু তুমি'ত নিশ্চয় বুঝতে পারবে যে কলকাতা থেকে ফরিদপুরে যাতায়াত, হোটেলে কয়েকদিন থাকা খাওয়ায় কত বিরাট খরচ। আর বাবার বয়স হয়েছে। এই ধকল সহ্য করতে পারবে বাবা ?

প্রদোষ বেফাঁস,

- যতটা বুঝতে পারি, তোমরা পুত্র কন্যা দুজনে তো অপেক্ষাই করছ দাদুন আর দিদুন কবে ফুটে যাবে, আর ওদের জমির উপরে চার ফ্লোরের বিল্ডিং বানাবে। সে যাইহোক, ফরিদপুরের ট্র্যাভেল তো দাদুর জমানো টাকা থেকেই হবে। তোমাদের কাছে দাদু টাকা চাইছে নাকি ? তাহলে কেন এত গলা শুকাচ্ছ ?

অগ্নিশর্মা প্রদোষের মা এবং মামা,

- বাহ, প্রেসিডেন্সি কলেজে তাহলে তোমাদের এসবই শেখায়? তোমার মনে মা মামার প্রতি এতটা প্রেম দেখে আমরা অভিভূত। আগে জানলে, গলা ধাক্কা দিয়ে সাধারণ একটা কলেজে ভর্তি করে দিতাম তোমায়! এই প্রেসিডেন্সিই যত নষ্টের গোড়া। তোমায় বিপ্লবী বানাচ্ছে!

প্রদোষ আর কিছু বলেনি। ২০১৬ তেই পাসপোর্ট এসে গেছে। নীলকন্ঠ বাবুর খুশি আর ধরে না। ওনার স্ত্রী কিন্তু ফুঁসছে,

- বুড়োটাকে আয়নার কাছেই রেখে আসিস। এই নামটা বিয়ের পরে ষাট বছর ধরে হাজার বার শুনে শুনে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বাবাই, ওই আয়না খাতুনের একটা ফটোও তুলে আনবি। আমি দেখতে চাই, ওটার মধ্যে এমন কি বিশেষ আকর্ষণ আছে!

- ঠিক আছে দিদুন আয়না খাতুনের ফটো তুলে আনব। কিন্তু তুমি তো চোখে এতটা ভালো দেখ না ! তাহলে ......

দিদা বেশ চিন্তিত,

- হ্যাঁ, সেটাও তো ঠিক। যাইহোক আলোর নিচে দাঁড়িয়ে কিছুটা তো আঁচ করতে পারব।

২০১৮ তে ভিসা বানিয়ে প্রদোষ চললো দাদুকে ফরিদপুরে তার ভালোবাসার পাত্রী আয়না খাতুনের সাথে দেখা করাবার প্রয়াসে। মাথায় হাজার হাজার প্রশ্ন ছিল, 'আয়না খাতুন বেঁচে আছে কিনা ? বেঁচে থাকলেও কোথায় থাকে?' কিন্তু চ্যালেঞ্জ নিয়েছে প্রদোষ। ওর প্রেসিডেন্সির বন্ধুরা বনগাঁর পেট্রাপোল পর্যন্ত এসেছিল ওকে সাহস জোগাতে, শুভেচ্ছা জানাতে।
 
পর্ব-২
------------

ফরিদপুর শহরে পৌঁছে দাদুর সাথে হোটেলে রুম নিয়েছে প্রদোষ। বেনাপোল বর্ডার থেকে ট্যাক্সিতে বসে ১০২ কিলোমিটার একটাও কথা বলেনি দাদু। একটুও ঝিমোয়নি, একটুও চোখ লাগেনি দাদুর। অপলক দৃষ্টিতে দেখে চলছিল তার মাতৃভূমিকে। চোখে জলের ধারা বইছে। মনে হচ্ছিল, গান্ধী নেহেরু জিন্নাহ মাউন্ট ব্যাটেনকে কাছে পেলে তাদের সাথে দাদুর আজ একহাত হয়েই যাবে।

প্রদোষ আগেও দাদুকে অনেকবার গুণ গুণ করে গাইতে শুনেছে। যে গানে ফুটে উঠেছে দাদুর আন্তরিক মনষ্কামনা স্বপ্ন ও আশা ,

ভাইয়ের সাথে ভাইরে তোরা লড়াইছিস
ঘরের থিকা বেঘর করছিস

দেখিস তোরা শেষটা
আবার এক হবে এই দেশটা

আমি কি, আর ততদিন বাঁচব
ফটোর থিকা দেইখ্যা দেইখ্যা হাসব

হোটেলে পৌঁছে প্রদোষ দাদুকে বলেছিল,

- আজ বিকেল চারটা বেজে গেছে। বিদেশ বিভূঁই জায়গা, আজ হোটেলে রেস্ট নিয়ে কাল সকালে তোমার পুরনো বাড়ি খুঁজতে যাবো।

কিন্তু দাদুর যেন আর তর সইছে না,

- শোন ব্যাক্কল, এইটা তোর জন্মভূমি না। এইটা ফরিদপুর, বাংলাদেশ। এইখানকার লোকেরা স্বার্থপর না, লোকজনের মন আছে, হৃদয় আছে। ঘন্টা দুই তিন ঘুইরা আয়। দ্যাখ, শয়তান চেংড়িটার যদি কোন খোঁজ খবর পাইস!

প্রদোষ আমতা আমতা করছে দেখে, নীলকন্ঠ বাবু বাকি শব্দ গুলোও বলেই দিলেন,

- যদি শুনিস, আয়না বাঁইচ্যা নাই, তাইলে ওর কবরের ঠিকানাটা নিয়া আসবি । কলকাতায় ফেরার আগে ওর কবরের পাশে বইস্যা ওর সাথে দুইটা কথা কইয়া আসব।

একটুক্ষন চুপ করে থেকে নীলকন্ঠ বাবু আবার বলতে লাগলেন,

- তবে আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি, আয়না আমার সাথে দ্যাখা না কইরা যাইতেই পারে না। ও নিশ্চয় আমার অপেক্ষায় আছে, যেমনি আমি ওর সাথে দেখা না কইরা মরতে পারতাছি না।

প্রদোষ বেরিয়ে পড়ল। দাদুর কথা মত ফরিদপুর রেল স্টেশন থেকে ট্যাপাখোলা মসজিদের দিকে হাঁটছে। রাস্তায় এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করল,

- দাদা, আশে পাশে কি কোনও পুলিশ স্টেশন আছে ?

- জনাবের পাসপোর্ট হারাইছে নাকি?

- কি করে বুঝলেন যে , আমি বাংলাদেশের নাগরিক না?

- মিয়াঁ ভাই, আপনার খেয়েছি দেয়েছি শুইনাই বুইঝ্যা গেছি আপনি সুন্দরবনের লোক। থুড়ি, কলকাতার লোক।

- বুঝতে পারলুম না দাদা!

লোকটা হাসছে,

- আসলে, আপনারা খেলুম গেলুম হালুম কইরা বাঘের ভাষায় কথা কন তো, তাই কইলাম। এইবার কন , পুলিশ স্টেশনে কি কাম?

লোকটাকে প্রদোষ সব কিছু খুলে বলতেই, উনি বেশ উত্তেজিত হয়ে বললেন,

- স্টেশন আর ট্যাপাখোলা মসজিদের মাঝামাঝি একটা পুলিশ লাইন আছে। আমার ভটভটিতে বসেন। ঐখানে গিয়া দেখি, কিছু লাভ হয় কি না!

পুলিশ ফাঁড়িতে লোকটা বাইক নিয়ে সটান ঢুকে গেছে। সাহস আছে বলতে হবে। এক কনস্টেবল তেড়ে এল,

- এত শব্দ কইরা পুলিশ থানায় ঢুকতাছ ক্যান মিয়াঁ?

লোকটা দমবার পাত্র নয়,

- আরে মিয়াঁ, তোমরা সারাদিন ঘুমাইয়া থাকো। শব্দ না করলে জাগবা কি কইরা। তোমাগো জাগানোই তো আমার মত খ্যাপা পাবলিকের কাম ।

যাইহোক, একটু পরেই বোঝা গেল এই পুলিশটি এবং ভটভটিয়ালা বেশ ভালো বন্ধু। ছোট ছোট শহরে যা হয়ে থাকে, ফরিদপুর তার ব্যতিক্রম নয়। এখানে বোঝা যাচ্ছে, হৃদ্যতার অভাব নেই। আকাশে বাতাসে প্রাণের ছড়াছড়ি।

এই পুলিশ ভদ্রলোক আদ্যপান্ত শুনে বেশ নিরাশাজনক শব্দ শোনাল,

- এখানে গত ৮০-৯০ বছর ধরে পুলিশ থানা আছে। কিন্তু ৭০-৭১ বছর আগে কে ইন্সপেক্টর ছিল কাগজ পত্র দেখে সেটা বলা গেলেও, এটা জানা মুস্কিল যে, রিটায়ারমেন্টের পরে ওই ইন্সপেক্টর কোথায় চলে গেছে। এখন ওই ইন্সপেক্টর ভদ্রলোকের বেঁচে থাকার কোনই চান্স নেই বলেই ওনার দৃঢ় বিশ্বাস।

নীলকন্ঠ দাদুর কথা মত, পুলিশ থানার সামনে একটা কদম গাছ ছিল। যেটার ডালে পাটের দড়ির দোলনা বেঁধে ওনার বন্ধু বান্ধবরা বিকেলে দুলতেন। কিন্তু, প্রদোষ কোনো কদম গাছ দেখতেই পেল না। থানার ডান পাশেই নাকি নীলকন্ঠ বসুদের বাড়ি ছিল। এখন ওখানে দেখা গেল, বিল্ডিং হয়েছে, ফ্ল্যাট বানিয়ে বিক্রী হচ্ছে।

প্রদোষকে হোটেলে পৌঁছে ইছানুল হক (ভটভটি মিয়াঁ) চলে গেছে। প্রদোষের কোনও লোক্যাল নম্বর নেই। তাই হোটেলের ম্যানেজারের নম্বরটা নিয়ে গেছে ইছানুল। আর নিজের মোবাইল নম্বর দিয়ে গেছে প্রদোষকে। আপদে বিপদে জরুরি হলে, যেন প্রদোষ হোটেলের লোক্যাল নম্বর থেকে ওনাকে ফোন করে। দাদু ঠিকই বলে, বাংলাদেশের লোকেরা আতিথেয়তা এবং বন্ধুত্ব মনে প্রাণে পালন করতে জানে। না হলে ইছানুল হক প্রদোষকে জেনেছে মাত্র দু-তিন ঘন্টা আগে। তারই মধ্যে এতটা হৃদ্যতা হয়েছে। কারো মনে হতেই পারে, জানা শোনা এবং বন্ধুত্বটা বেশ পুরোনো।

হোটেলের রুমে পৌঁছেই দাদুর প্রশ্নের সম্মুখিন,

- কিছু খবর পাইলি ?

দাদু হতাশ না হয়, সেটা ভেবে প্রদোষ উত্তর দিল,

- আমি তোমার বাড়ি পর্যন্ত যেতেই পারিনি। সন্ধ্যে হয়ে গেছিল। তাই কাল যাবো !

দাদু কী ভেবে নিল কে জানে। একদম চুপ মেরে গেল। রাতে প্রদোষের ঘুম হয়নি। ভোরের দিকে জাস্ট চোখ লেগেছে, রুমের দরজায় ঠক ঠক শুনে দরজা খুলতেই এক রুম বয় জানাল,

- কেউ এক ইছানুল মিয়াঁ আইছে আপনার সাথে দেখা করার জন্য!

প্রদোষ মুখ না ধুয়ে , দাঁত না মেজেই হোটেলের লবিতে দৌঁড়েছে,

- সালাম ওয়ালেকম ইছানুল ভাই! কি খবর ?

- ওয়ালেকম সালাম। একটা ছোট্ট ক্লু পাইছি। আমার সাথে চলেন আপনি।

- আমি তো দাঁত মাজিনি, মুখ ধুইনি, পটি করিনি!

- আরে বাদ দ্যাও মিয়াঁ ভাই। বাঘ সিংহরা দাঁত মাজে নাকি? আর রাস্তায় হাগা পাইলে, জঙ্গলের ধারে বইসা পড়বা। খেতের উর্বরতা বৃদ্ধি পাবে ! কিছুটা সমাজ সেবার কাম হইয়া যাবে, হি হি হি হি .......

- কিন্তু দাদুর সকালের খাবার দাবার?

ইছানুল হক নিজেই হোটেলের ম্যানেজারকে ডেকে বলে দিল,

- এই মিয়াঁ শোনেন, ১০২ নম্বর রুমে যেই বুইড়া লোকটা আছে, ওনার দেখ ভাল কইরেন। যা খাইতে চায় বানাইয়া দিয়েন। টাকা পয়সা নিয়া ভাববেন না!

প্রদোষ রাতে ঘুমোবার হাফ প্যান্ট টিশার্ট পরে, পকেটে পার্স না নিয়েই ভটভটিতে বসে গেল,

- ইছানুল দা, আমি কিন্তু টাকা পয়সা আনতে পারিনি!

ইছানুল বেশ ধমকে দিল,

- আল্লা আমার পয়সা কড়ির কোন অভাব রাখে নাই। চুপ কইরা পিছনে বইসা থাকেন মিয়াঁ।

ভোঁ ভোঁ করে বাইক ছুটছে। দুজনের কারো হেলমেট নেই। পুলিশ ধরেছিল। ইছানুল কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভটভটি থামিয়ে বেশ রাগের স্বরে পুলিশকে জেরা করতে লাগল,

- কি মিয়াঁ, থামাইলা ক্যান?

- বিনা হেলমেটে বাইক চালাইতাছ? যদি দুর্ঘটনা হয়, তাইলে কি হবে?

ইছানুল বেশ ক্রোধান্বিত,

- মিয়াঁ, এমন একটা ভাব দ্যাখাইতাছ যে বঙ্গবন্ধুর মত দেশবাসীকে নিয়া তোমারও কত চিন্তা। বোকা বানাইও না। সকাল থিকা বউনি হয় নাই নাকি?

বলেই ইছানুল ভটভটি স্টার্ট করে চলতে শুরু করল। এ গলি সে গলি দিয়ে একে বেঁকে এক বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রদোষ হাঁ করে বাড়িটা দেখছিল। প্রাসাদসম বাড়ি। ইছানুল মনে হয় প্রদোষের মনের কথা ধরে নিয়েছে,

- ঘাবড়াইও না মিয়াঁ। এই দেশে নেতা, পুলিশ আর সরকারি অফিসাররা রাজপ্রাসাদে থাকে। বাকি দেশবাসীর জায়গা রাস্তা কিংবা আল্লার মসজিদের চত্ত্বর।

- ইছানুল ভাই, আমাদের দেশও কিন্তু ব্যতিক্রমী নয়।

- কি কইরা ব্যতিক্রম হবে? রক্ত তো একই। দেওয়াল দিলেই কি বংশগতি শেষ হয় নাকি মিয়াঁ। যাইহোক, ভীতরে চলেন। এই রিট্যায়ার্ড পুলিশ অফিসারটা কালকে যেই থানাতে গেছিলাম, সেইখানে ১৯৯৫ সন পর্যন্ত কাজ করছে। ইনসাল্লা, উনি যদি কিছু হেল্প করতে পারেন।

রিট্যায়ার্ড পুলিশ অফিসার, ৮২ বছর বয়স্ক মতিন আহমেদ জানালেন যে উনি আয়না খাতুনের বাবার সাথে প্রায় ৪-৫ বছর কাজ করেছেন,

- আয়নার বিয়ে এই ফরিদপুরেই হয়েছে। আয়নার মা মারা গেছে ১৯৬৩-৬৪ এর দিকে। একই মেয়ে হওয়ার কারনে, ওর বাবা রিট্যায়ারমেন্টের পরে ১৯৬৬ এর দিকে আয়নার বাড়িতেই থাকত। আয়নার বাবা মারা গেছে বছর ত্রিশেক হলো। ওনার পেনশন যে ঠিকানায় যেত, সেটা তোমরা দপ্তর থেকে বের করে নিও। সেটাই আয়নার ঠিকানা হবে।

অবশ্য রিট্যায়ার্ড পুলিশ অফিসার এটা বলতে পারেননি, আয়না খাতুন বেঁচে আছেন না বেঁচে নেই। মনে আংশিক আনন্দ নিয়ে হোটেলে ফিরে প্রদোষ প্রাতঃকৃত্য স্নান খাওয়া সেরেছে। কিন্তু দাদুকে লেটেস্ট ডেভেলপমেন্ট জানায়নি। দাদুও কেমন যেন চিন্তিত মনে হলো। সারাদিন বাংলা খবরের কাগজে মুখ গুঁজে পড়ে চলছে। দাদু ফরিদপুরে পৌঁছেই 'বেঙ্গল টাইমস' খবরের কাগজ চেয়েছিল। কিন্তু ওই খবরের কাগজটা আর ছাপা হয় না শুনে খুব মর্মাহত। তবে 'বাংলাদেশ প্রতিদিন' পড়েও কিন্তু বেজায় খুশি।

এরই মধ্যে দুপুর তিনটের দিকে হোটেলের ম্যানেজার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল,

- দাদা, ইছানুল ভাই ফোন করছিল। আপনারে ডাকছে !

- কোথায় ?

- তাড়াতাড়ি বনলতা সিনেমা হলের সামনে যাইতে হবে। চলেন, আপনারে আমি গাড়ি কইরা পৌঁছাইয়া দিয়া আসি।

প্রদোষকে নিয়ে হোটেল ম্যানেজার পৌঁছেছে বনলতা সিনেমা হলের সামনে। দেখল, ইছানুল গতকালের দেখা ওই পুলিশ কনস্টেবলের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। সাথে আরো দু তিন জন যুবক ।

ইছানুল হাসছে, এক ২০-২২ বছর বয়স্ক যুবককে দেখিয়ে বললো,

- এই চ্যাংড়াটা আয়না খালার নাতি। ওর নাম হইতাছে রনি!

প্রদোষ কোনও মতে কান্না চেপে রেখেছিল। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, রনির চোখে কিন্তু আনন্দাশ্রু,

- নানীর মুখে ছোট বেলার থেকে নীলকন্ঠ বসুর কথা শুনে আসছি। কোনদিন যে নানীর পক্ষে আবার ওনাকে দেখা সম্ভব হবে জানতাম না। আমাদের কাছে নীলকন্ঠ বসুর ঠিকানাও ছিল না, নানী ৭০-৭১ বছর ধরে প্রত্যেকটা মুহূর্ত নীলকন্ঠ দাদুকে মিস করেছেন ......

প্রদোষ জানবার জন্য উদগ্রীব,

- আয়না নানী বেঁচে আছেন তো?

- আলবাত !! নানী মৃত্যুর সামনে জেদ ধরে বসে আছেন, নীলকন্ঠ বসুকে দেখেই উনি মরবেন। না হলে নানী মৃত্যুর কাছে নিজেকে কোনমতেই সমর্পণ করবেন না!

প্রদোষ রনি ইছানুল আনন্দে আত্মহারা। ঠিক হলো, আয়না নানী কিংবা নীলকন্ঠ বসু কাউকেই এই আশ্চর্য সংযোগের ব্যাপারটা জানান হবে না। কাল শুক্রবার, সকাল ১০ টায় রনি গাড়ি নিয়ে হোটেলে আসবে। প্রদোষ আর ইছানুল নীলকন্ঠ বাবুকে নিয়ে নানীর বাড়িতে পৌঁছাবে।
 
পর্ব-৩
----------

পরের দিন গাড়িতে বসে বুড়োর হাজার প্রশ্ন,

- আমরা কই যাইতাছি?

- তোমার পুরোনো বাড়িতে!

- আয়নার খোঁজ পাইলি?

প্রদোষ হাসি চেপে বললো,

- তোমার বাড়ির ওখানে পৌঁছে খুঁজব!

- তাইলে, গত দুই দিন ধইরা কি ছিঁড়লি তুই? প্রেসিডেন্সি কলেজে তুই নাকি আবার কম্মুনিস্ট ছাত্র নেতা। তোগো দেখলে হাসি পায়, কত গুলা ছাগল পাঁঠা যত্তসব !

কথায় কথায় আয়না নানীর বাড়িতে পৌঁছেছে ওরা। বাড়ির সামনে লোকে লোকারণ্য। প্রায় ৭১ বছর পরে এই পুনর্মিলনের খবর চাউড় হয়ে গেছে ছোট্ট ফরিদপুর শহরে । মতিন আহমেদ স্যারও দাঁড়িয়ে আছেন। জানা গেল, আয়না নানীর বাড়ি খোঁজার পিছনে ওনারও একটা সক্রিয় ভূমিকা আছে।

ক্যামেরা হাতে সাংবাদিক, টিভির রিপোর্টারে ছয়লাপ। প্রদোষ উত্তেজিত। নীলকন্ঠ দাদু কিন্তু কিছু না জানা সত্বেও বেশ চুপ, একদম টেনশন ফ্রি। বা অধিক টেনশনে গান্ধীজি হয়ে গেছেন। রনিদের ড্রইং রুমে তিল ধারণের জায়গা নেই। সবাই দাঁড়িয়ে, কিন্তু একটি শীর্ণকায় বৃদ্ধা শুধু মহারানীর মত বসে আছেন। বয়স আশির উপরে, কিন্তু এখনো যথেষ্ট সুন্দরী। ওনার সামনের চেয়ারটা খালি, সেখানেই প্ল্যান মোতাবেক নীলকন্ঠ বাবুকে ধরে ধরে বসান হলো।

চারিদিক থেকে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলকাচ্ছে, কিন্তু বৃদ্ধ বৃদ্ধা দুজনেই নিশ্চুপ। আয়না দিদুর চোখে জলের ধারা। বোঝা গেল আয়না দিদুর কাছে যে ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, তার একটু আভাস হয়ত ছিল।

উনিই প্রথমে মুখ খুললেন,

- নীল ভাইজান, ৭১ বছর সময় নিলা তোমার ছোট বোনটার কাছে আসতে ।

নীলকন্ঠ বসু শুধু ধীরে মাথা নোয়ালেন। আয়না দিদু বলে চলেছেন,

- মনে আছে ভাইজান, ১৯৪৭ এর ৩১ আগস্ট, রবিবার ছিল রাখী বন্ধনের দিন। আমাদের বাড়িতে সকাল দশটায় তুমি আর খালাম্মা মানে তোমার আম্মিজানের আসার কথা ছিল। প্রত্যেক রাখী বন্ধনের দিন আমার আব্বা ছুটি নিত। তোমার আম্মা আমার আব্বারে রাখি পরাইতো, আমি তোমারে রাখী পরাইতাম। কিন্তু ৭১ বছর আগে ১৯৪৭ এর ৩০ আগস্ট শনিবার মধ্যরাত্রে আমার নীল ভাইজানকে ধর্মান্ধ লোক গুলা আমার থিকা দূরে সরাইয়া দিল ......

সবাই এক রোমান্টিক সিচুয়েশনের কথা ভেবে নিয়েছিল, বাস্তবে যে ব্যাপারটা এই ভাবে টার্ন নেবে কেউ ভাবতে পারেনি। ভাই বোনের পুনর্মিলনের এই দৃশ্য সরাসরি টিভিতে দেখান হচ্ছিল। নীলকন্ঠ দাদু প্রদোষ'কে বলত যে, কিশোরী আয়না খুব বক বকম করতো। সেই স্বভাব কিন্তু এখনো যায়নি,

- মনে আছে ভাইজান, আগস্ট মাসের মাঝামাঝি দেশ স্বাধীন হইল বইল্যা আমরা কত মিষ্টি বিতরণ করছিলাম। কিন্তু, আমাদের খুশিতে শয়তানের নজর লাগল। দাঙ্গা শুরু হইল। রাখী বন্ধনের আগের দিন মধ্যরাতে তোমাদের বাড়িতে ওরা লুঠ কইরা আগুন লাগাইল ........

চারিদিক নিস্তব্ধ। নীলকন্ঠ বসুও শেষমেশ ঘোর কাটিয়ে মুখ খুলেছেন,

- আমার বাবা, আমাকে আর মাকে নিয়া বাড়ির পিছনে আমবাগানের মধ্যে দিয়া তোদের বাড়িতে লুকাইল। আমি আর মা চুপ কইরা কাঁদতাছিলাম, লুটেরা গুলা আবার শুইনা না নেয়। তোর আব্বাজান ভোর হওয়ার আগে আমাদেরকে পুলিশের গাড়িতে নিয়া বর্ডার পার কইরা দিয়া আসল।

- হ্যাঁ ভাইজান, আমি অনেক দিন তোমার জন্য কান্দছি। আব্বু বুঝাইত যে তোমরা এইখানে থাকলে আর বাঁচতে পারতা না।

আয়না দিদু এরই মাঝে তার মেয়ে মানে রনির মাকে কিছু একটা আনতে বললো। দিদুর সোনা গয়নার বাক্স এল। তার থেকে বের হলো, ১৯৪৭ এ কেনা একটা রাখী, পুরোনো হলেও রং বদলায়নি, জৌলুশ বদলায়নি। রাখীটির দীর্ঘ ৭১ বছর বয়স অতিক্রান্ত, কিন্তু স্নেহ ভালোবাসা যেন আজো ঠিকরে পড়ছে,

- এইটা তোমার জন্য এখনো যত্ন কইরা রাখছি। তুমি আসলে পরাইয়া দিব। তারপর আমি কবরের দিকে পা বাড়াইতে পারি। আজকে আমি মুক্ত । আল্লা আমার প্রার্থনা শুনেছেন।

শীর্ণ হাতে পাঞ্জাবির পকেট থেকে খবরের কাগজে মোড়া ছোট্ট একটা প্যাকেট বের করে আয়নার দিকে বাড়িয়ে দিল বড় ভাই নীলকন্ঠ বসু,

- এই রোল্ড গোল্ডের কানের দুলটা তোরে রাখীর দিন দিব বইল্যা কিনছিলাম, নিজের জমানো ২ নয়া পয়সায়।

- তুমি ভাইজান, এইটা এখনো রাইখ্যা দিছ?

- ভারতে গিয়া এইদিক ওইদিকের বেশ কয়েকটা উদ্বাস্তু ক্যাম্পে তিন চাইর বছর গেছে। তারপর বাবার সাথে হোটেলে কাজ করছি। অনেক ঝড় জল মাথার উপর দিয়া গ্যাছে । প্রত্যেকটা দিন আমার বোনটার কথা ভাবছি। এই কানের দুলটা যত্নে রাখছিলাম। এইটা দেখলে মনে কিছুটা শান্তি আসত। মনে হইত বোনটা আমার কাছেই আছে।

আয়না দিদু তো বটেই, ওখানে উপস্থিত এমন কেউ ছিল না যার ওই মুহূর্তে চোখ নরম হয়নি।

দিদু অভিমানের সাথে জানতে চেয়েছে,

- ভাইজান, তুমি এইখানে একবারও আসো নাই কেন? আমার তো দশটা পাঁচটা ভাই বোন ছিল না। কেবল একটাই ভাইজান ছিল। নীল ভাইজান !

- শোন, আমি ফরিদপুরে যতটা লেখা পড়া করছি, ততটুকুই। ভারতে গিয়া, দুইটা খাইয়া বাঁইচ্যা থাকার চেষ্টাতেই ১৫-২০ বছর গেছে। আমার কোন সময়ই এমন আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল না যে আমি পাশপোর্ট বানাইয়া ফরিদপুরে আসব, আর তোরে খুঁইজা বাইর করব। এখন সবটাই আমার নাতির দৌলতে সম্ভব হইল। এইবার আমি শান্তিতে মরতে পারি।

এদিক ওদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রদোষকে খুঁজছিল নীলকন্ঠ দাদু। প্রদোষ একটু সরে গিয়ে কাঁদছে,

- আয়না, ওই দ্যাখ ওইটা আমার নাতি। কম্মুনিস্ট পার্টি করে। সবার সাথে লড়াই কইরা আমারে এইখানে নিয়া আসল। এখন নিজেই মেয়েদের মত কাঁন্দতাছে !! ---------//-------–---- সূত্র:-দিল্লি নিবাসী শ্রী কল্যাণ গোষ্যামি মহাশয়ের থেকে শোনা ও সত্য ঘটনা গল্পকারে লেখা হল,। এখানে স্থান, কাল,পাত্র পাত্রীর নাম পরিবর্তিত।
 
পর্ব-৩
----------

পরের দিন গাড়িতে বসে বুড়োর হাজার প্রশ্ন,

- আমরা কই যাইতাছি?

- তোমার পুরোনো বাড়িতে!

- আয়নার খোঁজ পাইলি?

প্রদোষ হাসি চেপে বললো,

- তোমার বাড়ির ওখানে পৌঁছে খুঁজব!

- তাইলে, গত দুই দিন ধইরা কি ছিঁড়লি তুই? প্রেসিডেন্সি কলেজে তুই নাকি আবার কম্মুনিস্ট ছাত্র নেতা। তোগো দেখলে হাসি পায়, কত গুলা ছাগল পাঁঠা যত্তসব !

কথায় কথায় আয়না নানীর বাড়িতে পৌঁছেছে ওরা। বাড়ির সামনে লোকে লোকারণ্য। প্রায় ৭১ বছর পরে এই পুনর্মিলনের খবর চাউড় হয়ে গেছে ছোট্ট ফরিদপুর শহরে । মতিন আহমেদ স্যারও দাঁড়িয়ে আছেন। জানা গেল, আয়না নানীর বাড়ি খোঁজার পিছনে ওনারও একটা সক্রিয় ভূমিকা আছে।

ক্যামেরা হাতে সাংবাদিক, টিভির রিপোর্টারে ছয়লাপ। প্রদোষ উত্তেজিত। নীলকন্ঠ দাদু কিন্তু কিছু না জানা সত্বেও বেশ চুপ, একদম টেনশন ফ্রি। বা অধিক টেনশনে গান্ধীজি হয়ে গেছেন। রনিদের ড্রইং রুমে তিল ধারণের জায়গা নেই। সবাই দাঁড়িয়ে, কিন্তু একটি শীর্ণকায় বৃদ্ধা শুধু মহারানীর মত বসে আছেন। বয়স আশির উপরে, কিন্তু এখনো যথেষ্ট সুন্দরী। ওনার সামনের চেয়ারটা খালি, সেখানেই প্ল্যান মোতাবেক নীলকন্ঠ বাবুকে ধরে ধরে বসান হলো।

চারিদিক থেকে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলকাচ্ছে, কিন্তু বৃদ্ধ বৃদ্ধা দুজনেই নিশ্চুপ। আয়না দিদুর চোখে জলের ধারা। বোঝা গেল আয়না দিদুর কাছে যে ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, তার একটু আভাস হয়ত ছিল।

উনিই প্রথমে মুখ খুললেন,

- নীল ভাইজান, ৭১ বছর সময় নিলা তোমার ছোট বোনটার কাছে আসতে ।

নীলকন্ঠ বসু শুধু ধীরে মাথা নোয়ালেন। আয়না দিদু বলে চলেছেন,

- মনে আছে ভাইজান, ১৯৪৭ এর ৩১ আগস্ট, রবিবার ছিল রাখী বন্ধনের দিন। আমাদের বাড়িতে সকাল দশটায় তুমি আর খালাম্মা মানে তোমার আম্মিজানের আসার কথা ছিল। প্রত্যেক রাখী বন্ধনের দিন আমার আব্বা ছুটি নিত। তোমার আম্মা আমার আব্বারে রাখি পরাইতো, আমি তোমারে রাখী পরাইতাম। কিন্তু ৭১ বছর আগে ১৯৪৭ এর ৩০ আগস্ট শনিবার মধ্যরাত্রে আমার নীল ভাইজানকে ধর্মান্ধ লোক গুলা আমার থিকা দূরে সরাইয়া দিল ......

সবাই এক রোমান্টিক সিচুয়েশনের কথা ভেবে নিয়েছিল, বাস্তবে যে ব্যাপারটা এই ভাবে টার্ন নেবে কেউ ভাবতে পারেনি। ভাই বোনের পুনর্মিলনের এই দৃশ্য সরাসরি টিভিতে দেখান হচ্ছিল। নীলকন্ঠ দাদু প্রদোষ'কে বলত যে, কিশোরী আয়না খুব বক বকম করতো। সেই স্বভাব কিন্তু এখনো যায়নি,

- মনে আছে ভাইজান, আগস্ট মাসের মাঝামাঝি দেশ স্বাধীন হইল বইল্যা আমরা কত মিষ্টি বিতরণ করছিলাম। কিন্তু, আমাদের খুশিতে শয়তানের নজর লাগল। দাঙ্গা শুরু হইল। রাখী বন্ধনের আগের দিন মধ্যরাতে তোমাদের বাড়িতে ওরা লুঠ কইরা আগুন লাগাইল ........

চারিদিক নিস্তব্ধ। নীলকন্ঠ বসুও শেষমেশ ঘোর কাটিয়ে মুখ খুলেছেন,

- আমার বাবা, আমাকে আর মাকে নিয়া বাড়ির পিছনে আমবাগানের মধ্যে দিয়া তোদের বাড়িতে লুকাইল। আমি আর মা চুপ কইরা কাঁদতাছিলাম, লুটেরা গুলা আবার শুইনা না নেয়। তোর আব্বাজান ভোর হওয়ার আগে আমাদেরকে পুলিশের গাড়িতে নিয়া বর্ডার পার কইরা দিয়া আসল।

- হ্যাঁ ভাইজান, আমি অনেক দিন তোমার জন্য কান্দছি। আব্বু বুঝাইত যে তোমরা এইখানে থাকলে আর বাঁচতে পারতা না।

আয়না দিদু এরই মাঝে তার মেয়ে মানে রনির মাকে কিছু একটা আনতে বললো। দিদুর সোনা গয়নার বাক্স এল। তার থেকে বের হলো, ১৯৪৭ এ কেনা একটা রাখী, পুরোনো হলেও রং বদলায়নি, জৌলুশ বদলায়নি। রাখীটির দীর্ঘ ৭১ বছর বয়স অতিক্রান্ত, কিন্তু স্নেহ ভালোবাসা যেন আজো ঠিকরে পড়ছে,

- এইটা তোমার জন্য এখনো যত্ন কইরা রাখছি। তুমি আসলে পরাইয়া দিব। তারপর আমি কবরের দিকে পা বাড়াইতে পারি। আজকে আমি মুক্ত । আল্লা আমার প্রার্থনা শুনেছেন।

শীর্ণ হাতে পাঞ্জাবির পকেট থেকে খবরের কাগজে মোড়া ছোট্ট একটা প্যাকেট বের করে আয়নার দিকে বাড়িয়ে দিল বড় ভাই নীলকন্ঠ বসু,

- এই রোল্ড গোল্ডের কানের দুলটা তোরে রাখীর দিন দিব বইল্যা কিনছিলাম, নিজের জমানো ২ নয়া পয়সায়।

- তুমি ভাইজান, এইটা এখনো রাইখ্যা দিছ?

- ভারতে গিয়া এইদিক ওইদিকের বেশ কয়েকটা উদ্বাস্তু ক্যাম্পে তিন চাইর বছর গেছে। তারপর বাবার সাথে হোটেলে কাজ করছি। অনেক ঝড় জল মাথার উপর দিয়া গ্যাছে । প্রত্যেকটা দিন আমার বোনটার কথা ভাবছি। এই কানের দুলটা যত্নে রাখছিলাম। এইটা দেখলে মনে কিছুটা শান্তি আসত। মনে হইত বোনটা আমার কাছেই আছে।

আয়না দিদু তো বটেই, ওখানে উপস্থিত এমন কেউ ছিল না যার ওই মুহূর্তে চোখ নরম হয়নি।

দিদু অভিমানের সাথে জানতে চেয়েছে,

- ভাইজান, তুমি এইখানে একবারও আসো নাই কেন? আমার তো দশটা পাঁচটা ভাই বোন ছিল না। কেবল একটাই ভাইজান ছিল। নীল ভাইজান !

- শোন, আমি ফরিদপুরে যতটা লেখা পড়া করছি, ততটুকুই। ভারতে গিয়া, দুইটা খাইয়া বাঁইচ্যা থাকার চেষ্টাতেই ১৫-২০ বছর গেছে। আমার কোন সময়ই এমন আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল না যে আমি পাশপোর্ট বানাইয়া ফরিদপুরে আসব, আর তোরে খুঁইজা বাইর করব। এখন সবটাই আমার নাতির দৌলতে সম্ভব হইল। এইবার আমি শান্তিতে মরতে পারি।

এদিক ওদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রদোষকে খুঁজছিল নীলকন্ঠ দাদু। প্রদোষ একটু সরে গিয়ে কাঁদছে,

- আয়না, ওই দ্যাখ ওইটা আমার নাতি। কম্মুনিস্ট পার্টি করে। সবার সাথে লড়াই কইরা আমারে এইখানে নিয়া আসল। এখন নিজেই মেয়েদের মত কাঁন্দতাছে !! ---------//-------–---- সূত্র:-দিল্লি নিবাসী শ্রী কল্যাণ গোষ্যামি মহাশয়ের থেকে শোনা ও সত্য ঘটনা গল্পকারে লেখা হল,। এখানে স্থান, কাল,পাত্র পাত্রীর নাম পরিবর্তিত।
কি সুন্দর ও অসাধারন গল্প, এত সুন্দর গল্প উপহার দেওয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
 
কি সুন্দর ও অসাধারন গল্প, এত সুন্দর গল্প উপহার দেওয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
সুন্দর মন্ত্যব্যের জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top