সেলাই মেশিন ছাড়া বড় পরিসরে পোশাক তৈরির কথা আর এখন ভাবাই যায় না। এই যুগান্তকারী যন্ত্রটি আবিষ্কারের আগে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে জীর্ণ আঙুলে ফোঁড়ের পর ফোঁড় দিয়ে পরিধেয় পোশাক তৈরি করতেন পোশাকশ্রমিক ও দর্জির কাজ জানা নারী-পুরুষ। এ ক্ষেত্রে প্রায়ই পোশাকের পারিপাট্য ব্যাহত হতো। আবার একেবারে একই রকম করে একাধিক পোশাক তৈরির কাজটি অত্যন্ত কঠিন ছিল।
তাই তো শিল্পবিপ্লব ঘটার সময়ে ১৭৯০ সালে ইংরেজ আবিষ্কারক থমাস সেইন্ট প্রথম সেলাই মেশিনের পেটেন্ট লাভ করার পরে আর ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি পিছু ফিরেই তাকায়নি। পরবর্তী সময় ১৮২৯ সালে ফ্রেঞ্চ দর্জি বার্থেলেমি থিমোনিয়ারের হাত ধরে এই সেলাই মেশিন বাণিজ্যিক সাফল্য পেলেও সেই ১৭৯০ সালের ১৩ জুন, এই দিনকেই সেলাই মেশিন দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
ফ্যাশনের দুনিয়ায় এই সেলাই মেশিন দিবসের তাৎপর্য বলে শেষ করা যাবে না। আধুনিক সব ডিজাইনের নিখুঁত পোশাক তৈরি করতে এবং বিশেষত মাস প্রোডাকশন বা বড় আকারে একই পোশাক বিভিন্ন সাইজে বহু সংখ্যায় তৈরি করার ক্ষেত্রে সেলাই মেশিনের বিকল্প একেবারেই নেই।
সিঙ্গারের পুরনো মেশিন, ছবি: উইকিপিডিয়া
সেলাই মেশিনের উদ্ভব না ঘটলে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি আজ এই অবস্থানে আসতে পারত কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন। এই যন্ত্রের সঠিক প্রয়োগে বেশি বেশি পোশাক তৈরির সুযোগ থাকায় তুলা, সুতা ও কৃত্রিম তন্তুজ বস্ত্রশিল্পেও জোয়ার আসে ১৮০০ শতকে। কাপড়ে কৃত্রিম রঙের ব্যবহার শুরু হয় ক্রমবর্ধমান কাপড়ের চাহিদার বিশ্বব্যাপী জোগান দিতে। মোদ্দা কথা, সেলাই মেশিনের হাত ধরেই ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে।
হাতে সেলাই করা কাপড়ের আলাদা গুরুত্ব থাকলেও বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রয়োজনীয় পরিধেয় বস্ত্রের জোগান দেওয়া খুবই কঠিন এভাবে। সেলাই মেশিনে নিখুঁতভাবে সেলাই করা যায় খুব কম সময়ে। একেবারে প্রাথমিক ডিজাইনের সেলাই মেশিনগুলোকে আজকাল আর খুঁজে পাওয়া যায় না জাদুঘর ছাড়া। সেলাই মেশিনের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে ১৮৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত মার্কিন কোম্পানি আইএম সিঙ্গার অ্যান্ড কোম্পানি, যা পরে ১৯৬৩ সাল থেকে সিঙ্গার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পায়। এরপরেই আসে জার্মান সেলাই মেশিন কোম্পানি পফ্যাফের নাম, যারা জুতোর স্টিচে সেলাই মেশিনের ব্যবহার শুরু করল।
১৯০০ সালেই জাপানি সেলাই মেশিনের বিশ্বব্যাপী আধিপত্যের সূচনা হয়ে যায়। নিপ্পন, জেনোম ইত্যাদি জাপানি কোম্পানির সেলাই মেশিন এখন স্বয়ংক্রিয় সেলাই, ইলেকট্রিক পাওয়ার, একই মেশিনে সহজে বোতাম টিপে বহু রকম ফোঁড়ের ব্যবস্থা করার মতো বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। বাণিজ্যিক সেলাই মেশিনও জাপানেরই অবদান। এই সময়ে দাঁড়িয়ে, বৈশ্বিক অ্যাপারেল ইন্ডাস্ট্রি এই সেলাই মেশিনের কাছে যারপরনাই ঋণী। বিশ্বের বিশাল তৈরি পোশাকশিল্প এই সেলাই মেশিনের হাত ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের দেশে পঞ্চাশের দশকে অবস্থাপন্ন পরিবারগুলোর স্ট্যাটাস সিম্বল হয়ে ওঠে সিঙ্গার মেশিন। সে সময় বাঙালি নারীর শাড়ির সঙ্গে সোনায় সোহাগাস্বরূপ জ্যাকেট বা ব্লাউজের ছাঁটকাট ও ডিজাইনে আসে অভাবনীয় বিপ্লব। প্রায়ই পরিবারের মেয়েরাই অত্যন্ত দক্ষতাসহকারে নিজেদের ব্লাউজ, সালোয়ার, কামিজ, জ্যাকেট নিজেরাই তৈরি করতেন। শখের বশে এবং ফ্যাশনের প্রয়োজনে বিদেশি ক্যাটালগ এবং কাটিং ডিজাইন সংগ্রহ ও ব্যবহার করতেন সবাই। ঈদ-পার্বণের আগের সময়টিতে মায়েরা রাত জেগে ব্যস্ত থাকতেন বাড়ির বাচ্চাদের পোশাক তৈরি করতে।
সেলাই মেশিনের শব্দে মুখরিত হতো বাড়িগুলো। বারবার ট্রায়াল দেওয়া, আস্তে আস্তে চোখের সামনে রোজ একটু একটু করে রূপ নেওয়া নতুন জামার উত্তেজনার তুলনা কেনা পোশাকের সঙ্গে মেলানো সম্ভব নয়। পাশ্চাত্য কায়দার মিশেল ঘটিয়ে তৈরি করা বেল বটম প্যান্ট, ফ্লায়িং কলারের শার্ট, স্যুট কোট অথবা একেবারে ঐতিহ্যবাহী ডিজাইনের চোগা চাপকান, কুর্তা পায়জামা-পাঞ্জাবি তৈরি করতে বিশেষায়িত সব বিস্পোক টেইলার্স গড়ে উঠল এ দেশেও।
আশির দশক থেকে এই সেলাই মেশিনের বদৌলতেই পোশাকশিল্পে আমাদের বাংলাদেশের সুদক্ষ জনসম্পদের সুবিশেষ খ্যাতি সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে গেল। এখন তো এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত সুদৃঢ়। আমাদের দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তিই এই সেলাই মেশিন।
সেলাই মেশিন অনেক নারীর সয়ম্ভরতার প্রতীক
বর্তমান সময়ে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি, ফ্যাশন হাউস, টেইলারিং শিল্প, বুটিক ছাড়াও ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকেই সেলাই মেশিনের মাধ্যমে ফরমায়েশি পোশাক তৈরি করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। বিশেষ করে করোনাকালে বহু পরিবারে নারীরা উদ্যোগী হয়েছেন সেলাই মেশিনকে সাথি করে উপার্জনের পথ খুঁজে নিতে একটু সচ্ছল, স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের জন্য, দারিদ্র্য থেকে মুক্তির আশায়। তাই তো আজকের সেলাই মেশিন দিবসে সেই সব নারী এবং আমাদের তৈরি পোশাক খাতের সুদক্ষ সেলাইকন্যার প্রতি শ্রদ্ধাময় অভিবাদন।