করোনা অতিমারির প্রভাবে নানা ধরনের সংকটে আক্রান্ত পৃথিবী। মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি এর মধ্যে প্রধান সংকট হলেও, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অর্থনৈতিক ঝুঁকি। জীবন ও জীবিকার টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে বিশ্বের উন্নত দেশ থেকে দরিদ্র দেশগুলোতেও। কারণ, দফায় দফায় লকডাউনের কারণে ক্রমাগত ব্যাহত হচ্ছে মানুষের আয়–রোজগার, যার প্রভাব পড়ছে দেশের ফ্যাশনশিল্পেও। ফ্যাশন উদ্যোক্তাদের অনিশ্চয়তায়ও অনেক বেশি। এর একটি বড় কারণ, বাংলাদেশের মানুষ প্রধানত পোশাক কেনে উৎসবের সময়। যেখানে গত দুই বছর দেশের প্রধান উৎসবগুলো অতিবাহিত করতে হয়েছে লকডাউনের মধ্যে।
এ কারণে ফ্যাশন উদ্যোক্তারা ছিলেন বিক্রিহীন। যার প্রভাব পড়েছে কারিগর থেকে বিক্রয়কর্মী পর্যন্ত। অনেক ছোট ও মাঝারি ফ্যাশন উদ্যোক্তাকে গুটিয়ে নিতে হয়েছে নিজের ব্যবসা। বিশেষ করে যাঁদের ব্যবসা ছিল দোকাননির্ভর। পাশাপাশি প্রডিউসারদের কাজ পুরোপুরি থেমে যায়, কারিগরেরা তাঁদের চাকরি হারান। অন্যদিকে তাঁদের কাছে জমে থাকে অবিক্রীত পণ্য এবং সংশ্লিষ্ট খাতের লোকদের মধ্যে বাড়তে থাকে হতাশা। যেকোনোভাবে তৈরি পণ্য ক্রেতাদের কাছে পৌঁছানোটা ভীষণ জরুরি হয়ে পড়ে। এই আর্থিক দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য কী করা যায়, তা নিয়েই ভাবছিলেন সাবেরা আনোয়ার। কারণ, তিনি দেখছিলেন, একদিকে দেশীয় পণ্য ক্রেতাদের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। অন্যদিকে অনলাইনে বিদেশি পণ্যে বাজার সয়লাব। গত বছরের জুন মাসে সাবেরা আনোয়ার নতুন এক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেন। যার মূল ধারণাটাই ছিল তৈরি দেশীয় পণ্য গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার। পর্যাপ্ত পরিমাণ আর্থিক সহায়তা না থাকায় উদ্যোগটি পুরোপুরি আলোর মুখ দেখেনি।
চলতি বছর আবার লকডাউন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সাবেরা আনোয়ার বুঝতে পারলেন, অবস্থা পরিবর্তন হওয়ার সুযোগ কম। তাই তিনি তাঁর পুরোনো ফেসবুক গ্রুপ পুনরায় শুরু করলেন এবং নাম দিলেন গোদেশি—মেইড ইন বাংলাদেশ (GoDeshi—Made in Bangladesh)। এই গ্রুপের মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশীয় পোশাকের প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ সৃষ্টি করা।
ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সাবেরা আনোয়ারের সম্পর্ক বেশ পুরোনো। এর আগে বিভিন্ন ধর্মীয় এবং দেশীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রদর্শনীর আয়োজন করেন তিনি। যেখানে শুধু দেশীয় ডিজাইনারদের তৈরি পোশাক প্রদর্শন করা হয়। এর মাধ্যমে সে সময় প্রায় ৪০০ ডিজাইনার ও উদ্যোক্তার সঙ্গে কাজ করেন তিনি। গোদেশির শুরুতেই তাঁর পূর্বপরিচিত ডিজাইনারদের আহ্বান জানান এবং পেজে অংশগ্রহণ করার নিয়মাবলি নির্ধারণ করেন।
এ বিষয়ে সাবেরা আনোয়ার জানান, এক সপ্তাহের মধ্যেই বেশ দারুণ সারা পান তিনি। গ্রুপের সদস্যসংখ্যাও এক হাজার ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে বেশ উদ্যমী কিছু উদ্যোক্তা যোগ হন তাঁর এফ কমার্স পেজে। যাঁরা বাসায় থেকেই তৈরি করেন দারুণ কিছু প্রোডাক্ট। যার মধ্যে অধিকাংশই হ্যান্ড মেইড এবং পাইন্টেড। এমনকি দেশের ঐতিহ্যবাহী নানা পণ্য নিয়েও হাজির হন কেউ কেউ। অনেকে আবার পুরোনো ধাঁচের পণ্যগুলো নতুন রূপে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। তাঁতিরাও বেশ উৎসাহের সঙ্গে তাঁদের তৈরি করা কাপড় নিয়ে যোগ দেন এই গ্রুপে।
পরবর্তী সময়ে দেশের স্বনামধন্য ও প্রতিষ্ঠিত ডিজাইনার ও ফ্যাশন হাউসগুলো এই গ্রুপে জয়েন করা শুরু করে। বাড়তে থাকে গ্রুপের জনপ্রিয়তা। একসময় গ্রুপের ফলো রিকোয়েস্ট বাড়তে থাকে এতই দ্রুত যে এই অবস্থাকে অস্বাভাবিক আখ্যা দেন সাবেরা আনোয়ার। এমনকি ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তাঁদের বেশ কিছু মেম্বার বাতিল করে দেয়। ফলে অনেক গ্রাহক সে সময় কারণ ছাড়াই বাদ পড়ে যান। তারপরও দেখতে না দেখতেই গ্রুপ মেম্বারের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫ হাজারে।
সাবেরা আনোয়ার আরও বলেন, ‘বেশ অল্প সময়ের মধ্যেই গোদেশি হয়ে ওঠে সময়ের আলোচিত বিষয়। ডিজাইনার এমদাদ হক তাঁর ঈদ কালেকশন নিয়ে সবার আগে এগিয়ে আসেন। পরবর্তী সময়ে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির জনপ্রিয় নাম, যেমন সারা করিম, লিপি খন্দকার, ফারাহ আঞ্জুম বারিসহ আরও অনেকে একেক করে এই গ্রুপে তাঁদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন এবং এই মানুষগুলো যখন আমাকে বলেন, তাঁরা আমার এই গ্রুপে যোগ দিতে আগ্রহী, তখন আমি ভীষণ আনন্দিত হই।’
শুরুতে গ্রুপে সেল পোস্ট ছিল প্রতিদিন ১৫০। ঈদুল ফিতরের সময় তা গিয়ে দাঁড়ায় দিনে ৬০০ এবং আর্শ্চযের বিষয়, এর ৯০ শতাংশ বিক্রেতা নারী। সবাই তাঁদের বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিক্রি করছেন এই গ্রুপে। যেমন ট্রেন্ডি ফ্যাশন থেকে শুরু করে চামড়ার পণ্য, জুতা, মাটির হাঁড়ি, হ্যান্ড মেইড সিরামিক, গয়না, আসবাব, হ্যান্ড পেইন্টেড কোস্টার, ওয়াল হ্যাঙ্গার, কার্পেট, হ্যান্ডলুম কাপড়, শাড়ি ইত্যাদি। আমি বলতে চাই, প্রতিদিনই এই গ্রুপে যোগ হয় নতুন নতুন পণ্য এবং উদ্যেক্তা। তবে আমাদের মূল শর্তই হচ্ছে, এই গ্রুপে যোগ দিতে হলে পণ্য হতে হবে শতভাগ দেশি।’
এই প্ল্যাটফর্মকে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে সাবেরা আনোয়ার নিয়েছেন নতুন উদ্যোগ। আসছে গোদেশি সাইট এবং মোবাইল অ্যাপ; যা দুই–তিন মাসের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন সাবেরা আনোয়ার। যার মাধ্যমে দেশ-বিদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকেই যে কেউ খুব সহজে দেশীয় পণ্য কিনতে পারবেন।
ছবি: গোদেশির ফেসবুক পেজ