প্রযুক্তিগত উন্নয়ন শুধুমাত্র উন্নত দেশের মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নেই। একটি কথা এখন বেশ প্রচলিত, “তোমার কাছে যদি একটি ইন্টারনেট সংযুক্ত কম্পিউটার থাকার পরেও তুমি অর্থ উপার্জন করতে না পারো, তবে সেটা তোমার দুর্ভাগ্য।” প্রযুক্তির অগ্রগতি যেকোন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উপরেও বেশ প্রভাব বিস্তার করে। কেননা প্রযুক্তির ছোঁয়া দেশে প্রচুর পরিমাণে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, যা কি না অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে জোরালো করে।
নিজ দেশে শ্রমের ব্যয় অনেক বেশি থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশগুলোর অনেক বড় কর্পোরেশন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আইটি আউটসোর্সিংয়ের দিকে ঝুঁকছে। আর এই সুযোগে বাংলাদেশের মেধাবী ফ্রিলান্সাররাও তাদের মেধার জোরে বিদেশি কোম্পানিগুলোর আস্থা খুব ভালোভাবেই অর্জন করতে পেরেছে।
ফ্রিল্যান্সিং কাজের মধ্যে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং থেকে শুরু করে ওয়েব ডিজাইন, গ্রাফিক্স ডিজাইন, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন, কনটেন্ট রাইটিং সহ আরো অনেক কিছুই অন্তর্গত। আর প্রযুক্তির সহজলভ্যতা থাকার কারণে যে কেউ মনোযোগের সাথে যদি সঠিক নির্দেশনা সহ বেশ কিছুদিন কোন নির্দিষ্ট কাজে শেখায় সময় দেয় তাহলে বছর খানেকের মধ্যেই সেই ব্যক্তি নির্দিষ্ট বিষয়টি নিয়ে ফ্রিল্যান্স কাজ করা শুরু করে দিতে পারেন।
এছাড়া নিত্য নতুন আরো অনেক কিছু চলে আসার কারণে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে যা ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটকে আরো বিস্তৃত এবং সমৃদ্ধ করে চলেছে। আর এসব দিক থেকে শ্রম ব্যয় অল্প হওয়ার কারণে বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ এই দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলটি ফ্রিল্যান্সিং এর দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে এবং ইতোমধ্যেই নিজেদের একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশের যুব সমাজের মধ্যে অনেকেই চাকরি করার থেকে স্বাধীনভাবে অনলাইনে কাজ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। এক সেমিনারে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) এর সভাপতি আলমাস কবির বলেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সারে ছয় লাখেরও বেশি ফ্রিল্যান্সার কাজ করে চলেছেন। এই বিশাল সংখ্যার অধিকাংশরাই বয়সের দিক থেকে একদমই তরুণ।
বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিং জগতে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ ভালো হওয়ায় এই ফ্রিল্যান্স বাজারকে আরো সমৃদ্ধ করতে বেশ কিছু ব্যাংক বেশ সচেষ্ট ভূমিকা পালন করছে। ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপক আরফান আলী এই প্রসঙ্গে বলেন, ফ্রিল্যান্সারদের সুবিধা দেয়ার জন্য তারা একটি প্রিপেইড কার্ড চালু করেছেন। এই কার্ডের মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সাররা দেশ থেকে বিদেশে লেনদেন করতে পারবেন। এছাড়াও ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের একুয়া প্রিপেইড কার্ড এবং লাইফস্টাইল কার্ডও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে দিনদিন। আবার গুগুল এবং পেয়োনিয়ার থেকে বাংলাদেশে টাকা নিয়ে আসার ব্যাপারে বর্তমানে অনেক ব্যাংক এগিয়ে আসলেও প্রথম এই সুবিধা দেয়া শুরু করেছিল ডাচ বাংলা ব্যাংক। যার ফলে ফ্রিল্যান্সারদের মধ্যে এই ব্যাংকটি বহুল জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইন্সটিটিউট এর তথ্য অনুযায়ী ফ্রিল্যান্সিং জগতে বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয় স্থানটি দখল করে আছে এবং বর্তমানে প্রায় পাঁচ লাখ ফ্রিল্যান্সাররা সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এই পরিমাণ ফ্রিল্যান্সাররা প্রতি বছর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একশ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণে অর্থ যোগ করে যাচ্ছেন। তবে ফ্রিল্যান্সিং এর দিক থেকে প্রথম স্থানটি দখল করে আছে ভারত। বিশ্বের সর্বমোট ফ্রিল্যান্সারদের ২৪ শতাংশ ফ্রিল্যান্সাররাই ভারতীয়। ভারত সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের দিকে অনেক এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশ মার্কেটিং এর দিক থেকে বেশ সফল ভাবে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
বেকার সমস্যার সমাধান ফ্রিল্যান্সিং?
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের করা একটি গবেষণা হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় চল্লিশ লক্ষেরও বেশি যুবক বর্তমানে বেকার। সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা অনেকেই পছন্দের এবং সুবিধা অনুযায়ী চাকরিক্ষেত্রে যোগদান করতে পারছেন না। এতে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাই সরকারের উচিৎ ভবিষ্যতে কাজে আসবে না এমন অযাযিত তথ্য মুখস্ত করার পড়াশোনা থেকে যুব সমাজকে বের করে সময়ের চাহিদা অনুযায়ী কারিগরি শিক্ষার মডেল অনুযায়ী সময়পযোগী কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষিত গড়ে তোলা।
নারী উন্নয়নে ফ্রিল্যান্সিং এর ভূমিকা
যেহেতু ফ্রিল্যান্সিং আপনি বাসায় বসেই করে ফেলতে পারছেন, তাই বাংলাদেশের অনেক নারীরাই বাসার কাজের ফাঁকে ফ্রিল্যান্সিংয়ে নিজেদের ক্যারিয়ার গঠন করে চলেছেন। বাংলাদেশের নারী ফ্রিল্যান্সাররা ইতোমধ্যেই সফল ভাবে নিজেদের স্বকীয়তা বিশ্ব বাজারে তুলে ধরতে পেরেছেন। একজন নারী যখন স্বনির্ভর হয়ে উঠবে এবং পরিবারে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতে পারবে তখন সমাজে নারীদের সম্মান অনেকাংশেই বৃদ্ধি পাবে।
সরকারের সহযোগিতা ও চ্যালেঞ্জ!
সরকার বর্তমানে যুব সমাজকে প্রশিক্ষণ করার জন্য তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকেই ফ্রিলান্সিং সংক্রান্ত ফেসবুক গ্রুপে সফল ফ্রিলান্সারদের থেকেও সঠিক নির্দেশনা পেতে পারছেন খুব সহজেই।
তবে ইন্টারনেট সার্ভিসকে আরো সহজতর এবং গতিশীল করার জন্য সরকারকে আরো অনেক বেশি মনোনিবেশ করতে হবে। এছাড়া ডলার দিয়ে পেমেন্ট করার জন্য বেশ কিছু ব্যাংক প্রিপ্রেইড কার্ড তৈরি করলেও মূলত ডলার বাংলাদেশের ব্যাংকে নিয়ে আসাটা অনেক ক্ষেত্রেই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে এবং ফ্রিল্যান্সাররা বাড়তি ভোগান্তিতে পড়ছেন। এর সমাধান হতে পারে পেপাল। পাশের দেশ ভারতে বর্তমানে পেপাল চালু হলেও বাংলাদেশে এখনো পেপাল সার্ভিসটি চালু করা হয় নি। এদিক থেকে বাংলাদেশ সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ হতে পারে লাখো ফ্রিল্যান্সারের জন্য অনুপ্রেরণা।