কেউ কখনো যুদ্ধ চায় না, তবে শান্তি চায় কে? এই প্রশ্নটি অনেককেই দ্বিধার মধ্যে ফেলে দিতে পারে। আর ঠিক এমনটাই হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে, যুদ্ধ কেউই চায় না তবে একই সাথে শান্তি বজায় রাখতেও কেউ চাচ্ছে না। যুদ্ধ ও শান্তির এই দ্বৈরথে ফিলিস্তিন আজও ভুগছে। অথচ ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন উভয় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা নিয়ে যে প্রস্তাব দেয়, তার অনেকগুলো দিন পার হওয়ার পরে ইসরাইল আজ কেবল মাত্র স্বাধীন রাষ্ট্রই নয় বরং বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী একটি দেশ। অপরদিকে, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আজও অধরাই রয়ে গেল। তবে ফিলিস্তিনের শান্তির জন্য এ পর্যন্ত অনেক পরিকল্পনাই গ্রহণ করা হয়েছে, কিন্তু এত পরিকল্পনার পরেও শান্তির দেখা ফিলিস্তিন আজও কেন পেল না এ প্রশ্নের উত্তর জানতে ইতিহাসের দিকে একটু ইতিউতি তাকিয়ে দেখতেই হচ্ছে। আসুন জেনে নেই ফিলিস্তিনের শান্তির জন্য এ পর্যন্ত করা কিছু শান্তিচুক্তির কথাঃ
রেজুলেশন ২৪২ (সাল—১৯৬৭)
মাত্র ছয়দিনের যুদ্ধে ১৯৬৭ সালে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা দখন করে নিয়েছিল ইসরায়েল। এছাড়া তৎকালীন সময়ে সিনাই উপকূল, পূর্ব জেরুজালেমসহ আরো বেশ কয়েকটি জায়গাও ইসরায়েলের দখলে চলে আসে। এত বছর পার হওয়ার পরেও কেবল মাত্র সিনাই উপকূল অঞ্চল বাদে তৎকালীন দখল করা অঞ্চলগুলো আজও ইসরায়েলের দখলেই রয়ে গেছে। সেই বছরের নভেম্বর মাসের ২২ তারিখ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ “রেজুলেশন ২৪২” নামে একটি প্রস্তাব পাশ করে। সেই রেজুলেশনে বলা হয়েছিল ইসরায়েল যে অঞ্চলগুলো দখল করেছে সেগুলো থেকে নিজেদের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিতে হবে।
রেজুলেশন ২৪২ এর এত বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও এখন পর্যন্ত ইসরায়েল সেই প্রস্তাবের প্রতি কোন ধরনের সম্মান দেখায় নি বরং উল্টো এত বছর ধরে তীব্র সহিংসতার মাধ্যমে ইসরায়েল এই শান্তি চুক্তির জবাব দিয়ে গেছে।
ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি (সাল—১৯৭৮)
১৯৭৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিম কার্টারের মধ্যস্থতার মাধ্যমে মিসর এবং ইসরায়েলের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছিল। সেই সময়ে মিশরের প্রেসিডেন্ট ছিলেন আনোয়ার সাদাত এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মেনাকেম বিগিন। ক্যাম্প ডেভিড শান্তি চুক্তির মধ্য দিয়ে রেজুলেশন ২৪২ এর বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যও নিহিত ছিল। এই চুক্তির একটি অংশে গাজা উপত্যকায় স্থানীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে ইসরায়েল সৈন্যের প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল।
আসলো চুক্তি (সাল—১৯৯৩)
আসলো চুক্তির মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মত ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন একে অন্যকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এই চুক্তির পেছনে একজন মানুষের অবদান ছিল যার কথা না বললেই নয়, আর তিনি হলেন নরওয়ের কূটনীতিক মোনা ইয়ুল। তার দীর্ঘ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই হোয়াইট হাউজে এই চুক্তি সম্পন্ন হয়েছিল। আসলো চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর এবং গাজা অঞ্চল থেকে ইসরায়েল তাদের সেনা প্রত্যাহার করে নেবে। সেনা প্রত্যাহারের পর, ফিলিস্তিনে স্থানীয় সরকার ৫ বছরের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করবে। এর মাধ্যমেই ধীরে ধীরে ফিলিস্তিন একটি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
আরব শান্তি উদ্যোগ (সাল—২০০২)
লেবাননের বৈরুতে ২০০২ সালে আরব সম্মেলনে সৌদি আরবের পক্ষ থেকে একটি শান্তি প্রস্তাব উপস্থাপিত হয়েছিল। এই শান্তি প্রস্তাবের মূল কথা ছিল ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বিনিময়ে ইসরায়েল কি পেতে যাচ্ছে সেটাও তৎকালীন সময়ে দেখার মত একটি বিষয় ছিল। সৌদি রাষ্ট্রের প্রস্তাব ছিল ইসরায়েল তাদের সৈন্য বাহিনী প্রত্যাহার করে ফিলিস্তিনকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে দিবে এবং বিনিময়ে আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিবে।
রোডম্যাপ (সাল—২০০৩)
২০০২ সালেই ইতিহাসের প্রথমবারের মত কোন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফিলিস্তিনকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেন। তৎকালীন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জর্জ বুশ। জর্জ বুশের কথার পরিপ্রেক্ষিতেই ২০০৩ সালে আমেরিকা, রাশিয়া, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ একটি যৌথ উদ্যোগে ফিলিস্তিনে সার্বিক ভাবে শান্তির ব্যাপারে একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়। এই উদ্যোগকেই রোডম্যাপ ২০০৩ বলে উল্লেখ করা হয়।
ওয়াশিংটন পরিকল্পনা (সাল—২০১০)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ক্ষমতায় আসার পরপরই তিনি ফিলিস্তিনের শান্তির জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন তারমধ্যে ওয়াশিংটন পরিকল্পনা অন্যতম। তার উদ্যোগেই মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত মার্কিন দূত জর্জ মিশেল ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা শুরু করেন।
এত উদ্যোগের পরেও কেন ফিলিস্তিনে শান্তি প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না?
এর উত্তরে এই লেখাটির প্রথম অংশে আবার ফিরে যেতে হচ্ছে, আদতে যুদ্ধ কেউ না চাইলেও শান্তি সকলে চায় না। কেননা অশান্তি আর বিগ্রহের মধ্যে প্রত্যেকটি আরব রাষ্ট্রের নিজস্ব কূটনীতিক চিন্তা ভাবনা এবং স্বার্থ রয়েছে। জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী ইসরায়েল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও আজও ধুকে ধুকে চলছে ফিলিস্তিন। মূলত ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের এই বিরোধের সূত্রতা দীর্ঘদিনের আর ইতিহাস লক্ষ্য করলেই দেখা যায় দীর্ঘ দিনের শত্রুতা অতটা সহজে উবে যায় না।
এই সংঘাতের শুরু কীভাবে?
বিংশ শতাব্দীর একদম প্রথম দিকে ইউরোপে বসবাসরত ইহুদীরা চরম আকারে নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। আর সেই নির্যাতনের মাধ্যমেই ইহুদীবাদ আন্দোলনের সূত্রপাত। ইহুদীবাদের মূল লক্ষ্য ছিল একটাই, ইহুদীদের জন্য একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। তৎকালীন সময়ে ফিলিস্তিন তুর্কি সম্রাজ্যের অংশ ছিল আর প্যালেস্টাইন ছিল মুসলিম, ইহুদী এবং খ্রিষ্টান—এই সবগুলো ধর্মের কাছেই পবিত্র ভূমি।
তখন ইহুদীরা ধীরে ধীরে প্যালেস্টাইনে এসে বসবাস করা শুরু করে তবে এই বসবাস স্থানীয় আরব মুসলিমদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে তুর্কি সম্রাজ্য ভেঙে পড়লে ব্রিটেনের উপর দায়িত্ব বর্তায় প্যালেস্টাইন শাসনের। পরবর্তীতে অনেক চড়াই উৎরাই পার হওয়ার পর যেহেতু দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে ইহুদীদের উপর চরম আকারে নির্যাতন করা হয়েছিল তাই ইহুদীদের সাহায্য করার জন্য কিছু চাপ সৃষ্টি হয়। আর তার ফয়ালফল স্বরূপ প্যালেস্টাইনকে ফিলিস্তিন এবং ইহুদীদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। আর সেই উদ্যোগের ফলেই ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা হলেও ফিলিস্তিনের শান্তি ও স্বাধীনতা যেন সোনার হরিণের রূপ ধারণ করে।