যে হোটেলে উঠেছি, সেটা আসলে অরবিন্দ আশ্রমের গেস্ট হাউস। বেশ শান্ত। সরকারি গেস্ট হাউসের মতো। পদুচেরিতে হোটেলে থাকার চেয়ে অন্যরকম অভিজ্ঞতা পাওয়ার জন্য এবার উঠেছি আশ্রমের বিশ্রামাগারে৷ গেস্ট হাউসের বাগানের চেয়ারে বসে এখানে থাকতে আসা অতিথিদের দেখতে লাগলাম। বেশির ভাগই বিদেশি অতিথি, যাঁরা হিন্দু ধর্মে বা অরবিন্দের আশ্রমে দীক্ষা নিয়েছেন বা নিতে চান। কিছু আছেন ভারতীয় বৃদ্ধ। আমার বয়সী ভারত উপমহাদেশের কেউ নেই। কারণ, হয়তো এই গেস্ট হাউসে থাকাকালে ধূমপান ও মাদকদ্রব্য সেবন মানা।
সাদা রং এখানে সর্বত্র
ভীষণ নিরিবিলি গেস্ট হাউসটি। রুমে টিভি নেই। হোটেলে ওয়াইফাইও নেই। আমার তেমন অসুবিধা হয় না। টিভি আমি দেখি না। আর ইন্টারনেট না থাকলেও অসুবিধা হয় না। কোনো আশ্রমে এই প্রথম উঠেছি, তা নয়। আগেও এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। শিখদের গুরুদুয়ারায় ছিলাম একবার।
এটাও একপ্রকার আশ্রমই বলা যায়। সস্তা, পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন। রুমে বিছানা, চেয়ার ও টেবিল ছাড়া একখানা মাদুরও আছে। বোধ হয় মেডিটেশন করার জন্য। বহু বছর পর মাদুর দেখলাম। রুমের মেঝে লাল সিমেন্টে গড়া, আমাদের পিতামহের আমলের মতো। তখনকার বেশির ভাগ বাড়ির মেঝে লাল সিমেন্ট দিয়ে পাকা করা থাকত।
পরদিন সকাল থেকে ঘোরাঘুরি করলাম ফরাসি কলোনিতে। এত সুন্দর এই ওল্ড টাউন, মনে হবে ঊনবিংশ শতাব্দীর ফ্রান্সে চলে এসেছি। ধবধবে সাদা অফিস ঘরগুলো কালের সাক্ষী হয়ে শুভ্রতা ছড়াচ্ছে যেন। মাঝেমধ্যে হলুদ ট্রাম্পেটের গাছ হলুদ ফুল দুলিয়ে নকশা কাটছে পথে।
বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি
বাংলো প্যাটার্নের বাড়িগুলো হয় সাদা, নয় ধূসর অথবা হলুদ রঙের। একজন ফিক করে হেসে দেওয়া সাদা মেঘ, অন্যজন গম্ভীর সুরমা পরে পরিণত ধূসর মেঘ, আরেকজন সূর্যের মিহি হলুদগুঁড়া হয়ে আঁকিবুঁকি করছে হোয়াইট টাউনের সুবিন্যস্ত পথে পথে।
দুপুরে অতি অবশ্যি ফরাসি খাবারের লোভ সামলাতে পারলাম না৷ আজকের খাবার কক ও ভাঁ। মুরগির মাংস লাল সসে মাখানো। সঙ্গে ফরাসি ব্রেড। অল্প অল্প মাংস ছুরি দিয়ে কেটে, কাঁটাচামচের মাথায় তুলে মুখে দিতেই গলে গিয়ে সুগন্ধের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। মুখে পুরে একবার চোখ বন্ধ করে ফেললে আর খুলতে ইচ্ছে করবে না। মনে হয় এই স্বাদ, এই খুশবু আটকে রাখি রসনায়। কিন্তু খেতে খেতে একসময় পেট ভরে যায় আর সমাপ্ত হয় আমার ফরাসি খাবারের দেশের লালগালিচা সংবর্ধনা।
ইমাকুলেট কনসেপশন ক্যাথেড্রাল
বিকেলে ইমাকুলেট কনসেপশন ক্যাথেড্রালে গেলাম সানডে মাস বা রবিবারের প্রার্থনা দেখতে। সাদা গির্জা, সামনের আঙিনায় যিশুখ্রিষ্টের মূর্তি। ১৬৯২ সালে ফ্রান্সের রাজা লুইর (১৪) অনুপ্রেরণায় এ গির্জা ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের জন্য নির্মিত হয়।
ভেতরে বেশ ভিড়, ঢুকতে পারছিলাম না। খুব সম্ভবত ফরাসি ভাষায় প্রার্থনা শেষ আর তামিল ভাষায় শুরু হয়েছে। শাড়ি পরিহিত তামিল নারীরা মাথায় ঘোমটা দিয়ে গির্জার দরজা ঘেঁষা মেঝেতে বসে পাদরির কথা শুনছেন। কারণ, এত ভিড় যে স্থানসংকুলান হয়নি গির্জার সারিবদ্ধ বেঞ্চে। ভেতরে পা রাখার জায়গা নেই। প্রার্থনাও হচ্ছিল তামিল ভাষায়। গির্জার চত্বরে কিছুক্ষণ ঘুরে–ফিরে যখন বুঝলাম, ফরাসি কাউকে দেখার সম্ভাবনা নেই আর।
বের হয়ে প্রায় চলেই যাচ্ছিলাম, তখনই দেখলাম এক ফরাসি ভদ্রমহিলা বের হলেন গির্জা থেকে। খানিকটা ভারতীয় মিশেলে পশ্চিমা পোশাক পরেছেন তিনি। সবুজ রঙের থ্রি–কোয়ার্টার প্যান্ট আর ছাপা হাফ হাতা শার্ট, পায়ে স্নিকারস। বয়স ৭০ হবে, লাঠি নিয়ে চলাফেরা করছিলেন। একটা থামে ভর দিয়ে মুঠোফোনে কী যেন দেখছেন। এত রাগী চেহারা যে ভয়ে কাছে গিয়ে কথা বলার সাহস পেলাম না৷ তখনো অপরিচিত রাগী মানুষের সঙ্গে কথা বলার আড়ষ্টতা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তাই বেরিয়ে পড়লাম।
ফরাসি কলোনিতে ঘুরতে লাগলাম আরও ফরাসি যোগাযোগের আশায়। পেয়েও গেলাম কিছু বৃদ্ধ চলাচলরত অবস্থায় বা সাইকেলে। মোটরবাইকেও দেখলাম কাউকে। এই ফরাসি বংশোদ্ভূত মানুষজনের চলাফেরা বিকেলের রোদকে আরও জীবন্ত করে তুলেছে। প্রতিটি বাঁকে ফ্রেঞ্চ ক্যাফে বা রেস্তোরাঁ, যেন ঊনবিংশ শতাব্দীকে ধরে টেনে এই নগরীতে এনে দিয়েছে আর বলেছে এখান থেকে একটিবারের জন্যও নড়বে না, সব আগের মতো থাকা চাই। এই কথায় ফরাসি আবেগে ভরে আছে পথের গাছের ফুল আর এলোমেলো বাতাস।
ফুটপাতে কেনাকাটায় ব্যস্ত ফরাসি বংশদ্ভূত স্থানীয়
ফরাসি এম্বাসি পার হলে সামনে সমুদ্রের বাতাস ধাক্কা দিয়ে যায়। এই সৈকতের নাম রকি বিচ। সমুদ্রের পাড় বড় বড় কালো পাথর ফেলে আটকে রাখা হয়েছে। কারণ, তীরের পাশে মূল সড়ক। সড়কে চলছে গাড়ি আর মানুষ।
সন্ধ্যায় দেখলাম এক ফরাসি মাঝবয়সী ভদ্রলোক ফুটপাত থেকে জামাকাপড় কিনছেন, পোশাকে মধ্যবিত্তের ছাপ প্রকট। ফরাসি বংশোদ্ভূত মানেই যে বড়লোক হতে হবে, তা নয়। ভারতে অনেক অ্যাংলো–ইন্ডিয়ান আছেন, যাঁরা সাধারণ জীবন যাপন করেন, যাঁর যেমন সাধ্য অনুযায়ী।
চল্লিশোর্ধ এক ফরাসিকে দেখলাম তামিল বিবি নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এখানে এখন ফরাসি আর স্থানীয় লোকজনে বিয়েশাদি বেশ হয়। তাঁরা থাকেনও মিলেমিশে একসঙ্গে।
ফরাসি বংশদ্ভূত স্থানীয়
১৬৭৪ সালে পদুচেরির বন্দরে প্রথম ফরাসি দেশের জাহাজ নোঙর ফেলে। সেই দিন থেকে শুরু এই ফরাসি গল্পের যাত্রা। ফ্রেঞ্চ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিস খোলা হয় এ শহরে। অফিস আর কর্মচারীদের থাকার জন্য জায়গা ভাড়া নেওয়া হয়। ফরাসি দেশের দ্রব্যের কদর বাড়তে থাকে ভারতে। এরই মধ্যে বেশ কিছু জায়গা কিনে ফ্রেঞ্চ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বেশ রমরমা ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের অবস্থান ভারতে পাকা করতে থাকে। একসময় হোয়াইট টাউন ও এর আশপাশের জায়গার মালিক হয় এই কোম্পানি। তখনকার ফ্রেঞ্চ গভর্নর ফ্রাংকোয়েস মারটিন ধীরে ধীরে শহরের উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেন। ভারতে সে সময় ইংরেজ আর ওলন্দাজ বণিকদের খুব দাপট। কিন্তু এসব কিছুর মোকাবিলায় পদুচেরিতে ভিত গাঁথতে পারেননি অন্য দেশের নাবিক বা বণিকেরা। পদুচেরি শুধুই ফরাসিদের।
শহরের মধ্যিখানে ক্যানেল নির্মাণ করে দুটি ভাগ করা হলো। ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টার আর ইন্ডিয়ান কোয়ার্টার।
বেশ কয়েক বছর চেষ্টা করেও পদুচেরিকে বাগে আনতে পারছিল না ওলন্দাজ কোম্পানি। অবশেষে ১৬৯৩ সালে এক যুদ্ধ শেষে ফরাসি পাড়া চলে যায় ওলন্দাজদের দখলে। ফরাসিরা কাব্যিক জাতি হলেও মোটেই ভীরু নয়। তাই ঠিক ছয় বছর পর ফরাসি কলোনি ছিনিয়ে নিল ওলন্দাজদের কাছ থেকে।
এর কিছু সময় পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন পুরো ভারতবর্ষ দখলের নেশায় মত্ত। ১৭৬১ সালে দখল করে নিল পদুচেরি। কিন্তু ভারতের ফরাসি কলোনিকে করায়ত্ত করতে পেরেছিল মাত্র দুই বছরের জন্য। এরপর আবার কলোনি চলে গেল ফরাসি সৌরভের দেশের হাতে।
ভারতবর্ষ ইংরেজদের হাত থেকে স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় সাত বছর পদুচেরি শাসন করেছে ফ্রান্স, নিজেদের রাজ্যের একাংশ হিসেবে।
১৯৫৪ সালে সাধারণ ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা চলে যায় ভারত সরকারের হাতে। তবে এমনি এমনি হাজার হাজার ফরাসি নাগরিক ভারতীয় নাগরিক হতে রাজি হয়নি। শর্ত ছিল, তারা যেভাবে জীবনযাপন করছিল, কোনো রকম সামাজিক বা সাংস্কৃতিক আরোপ ছাড়াই তাদের সেভাবে বসবাস করতে দিতে হবে। সেই শর্তের ফলাফল আজকের এই হোয়াইট টাউন।
স্কুল ছুটির পর ছাত্র ও শিক্ষক
ফরাসি শেখার স্কুল যেমন আছে, তেমনি সাধারণ স্কুলের বাচ্চাদের দেখলাম স্কুল থেকে বের হয়ে লাইন ধরে হেঁটে যাচ্ছে। একদম পেছনে এদের শিক্ষিকা, সবাই শর্টস পরে মাঠে যাচ্ছে খেলতে।
পথে পথে হেঁটে বেড়ালে যে একেবারেই পেটে দানাপানি পড়বে না, তা তো নয়। এবারের রেস্তোরাঁ অবশ্যই ফরাসি স্থানীয় লোকজন দ্বারা পরিচালিত, লা রোসিটিসেরি। ‘রাতাতুই’ খাবারের নাম প্রথম শুনেছিলাম একটা সিনেমা দেখে, কার্টুন ছিল, কিন্তু খাবারটা আমার পছন্দের। রাতাতুই খাবার অবশ্য কার্টুনে যা দেখানো হয়েছে, সে রকম নয়। বিভিন্ন সবজি আর টমেটো পেস্ট দিয়ে বেক করা। খাবারের স্বাদ একনিমেষে নিয়ে যাবে প্যারিসে, যেখানে মৃদু আলোয়, হালকা পিয়ানোর সুরে রাতাতুইয়ের ম–ম গন্ধে ভরে উঠেছে ঘর। অতি অবশ্যই দেয়ালজোড়া জানালা দিয়ে দেখা যাবে সন্ধ্যা হতে হতে ঝিমিয়ে যাওয়া বাতাস আর রাতের উদাসীনতা ফুটে ওঠা এক আলোকময় শহর। (চলবে)
* লেখক: ফাতিমা জাহান