মারি আঁতোয়ান কারেম: রাজার শেফ, শেফের রাজা, ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স
এ মোটেই রূপকথা নয়, বানানো কোনো গল্প নয়। একটি সত্যিকারের কাহিনি। যাঁকে নিয়ে এমন কাহিনি, তাঁর নাম মারি আঁতোয়ান কারেম। জন্ম ৮ জুন ১৭৮৪ প্যারিসের এক বস্তিতে, হতদরিদ্র পরিবারে। ফরাসি বিপ্লবের পাঁচ বছর আগে। দিনমজুর বাবা-মায়ের ঘরে ইতিমধ্যে চৌদ্দটি সন্তানের সঙ্গে যোগ হলে আরও একটি অনাহূত সন্তান। আঁতোয়ানের যখন আট বছর বয়স, তখন সন্তানদের খাবার জোটাতে অক্ষম পিতা নিজে সঙ্গে করে তাঁকে দূরে এক রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আসেন। তারপর থেকে আর কোনো দিন পরিবারের আর কারও সঙ্গে কোনো দিনই তাঁর দেখা হয়নি।
ভাগ্যক্রমে এক ব্যক্তি তাঁকে রাস্তা থেকে তুলে নেন এবং অসহায় শিশুটির আশ্রয় হয় প্যারিসের সস্তার এক রেস্তোরাঁয়। এখানে সবার ফাইফরমাশ খাটে। বিনিময়ে দুমুঠো খাবার আর জোটে মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই জোটে। তখনো কেউ ভাবতেই পারেনি যে এই ফাইফরমাশ খাটা শিশুটিই একদিন উজ্জ্বল নক্ষত্রে হয়ে রন্ধনশিল্পের আকাশে দ্যুতি ছড়াবে। দীপ্ত পায়ে দাপিয়ে বেড়াবে অভিজাত মহলে, রাজরাজড়াদের প্রাসাদে, আঙিনায়। কেউ কেউ এ কথা বলতেও দ্বিধা করেনি যে তিনি জন্ম না নিলে ‘শেফ’ শব্দটি অভিধানে লেখা হতো না এবং ফরাসি রন্ধনশৈলী, রন্ধনপ্রণালি আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হতো পারত না।
তেরো বছর বয়স তাঁর। হঠাৎ করেই ভাগ্যের আকাশে জমে থাকা কালো মেঘ কেটে যেতে শুরু করে। এক জোড়া উজ্জ্বল চোখের এই শিশু-বালকটি ছিল ভীষণ বুদ্ধিদীপ্ত, করিতকর্মা এবং কর্মঠ। চমৎকার সব গুণের জন্য অল্পদিনের মধ্যেই সে অনেকেরই সুনজর কাড়তে সমর্থ হন। বিশেষ করে প্যারিসের নামকরা কেক-পেস্ট্রি প্রস্তুতকারক এবং বিক্রেতা সিলভান বেয়ই তাঁকে খুব পছন্দ করেন। মারি আঁতোয়ানকে তাঁর পেস্ট্রি শপে নিজের হাতে কাজ শেখাতে শুরু করেন।সিলভান এই বিস্ময় বালকটির মধ্যে আলো দেখেছিলেন, বুঝতে পেরেছিলেন, সুযোগ পেলে একদিন সে দ্যুতি ছড়াবে।
মারি আঁতোয়ান কারেমের সৃষ্ট কিছু কেক-পেস্ট্রি, ছবি: ইসাবেল মেরি বিটন সম্পাদিত মিসেস বিটন’স হাউস অব ম্যানেজমেন্ট (১৮৬১) বই থেকে
সিলভান তৎকালীন প্যারিসের রাজপরিবার, অভিজাত, শৌখিন এবং নব্য-ধনীদের কাছে একটি অতি পরিচিত নাম। প্যারিসের অভিজাত এলাকায়, রাজপ্রাসাদের কাছেই ছিল তাঁর কেক-পেস্ট্রির বনেদি দোকান। সেখানেই মারি আঁতোয়ান কেক-পেস্ট্রি তৈরির কাজ শিখতে শুরু করেন। তিনি দ্রুত রপ্ত করেন কেক-পেস্ট্রি তৈরি করার নানা খুঁটিনাটি, নানা কৌশল। পরিচিত হলেন হরেক রকমের উপাদানের সঙ্গে। তাঁর জাদুর হাতের ছোঁয়ায় কেক-পেস্ট্রি পরিণত হলো নান্দনিক শিল্পকর্মে।
অথচ জীবনের বিরূপ স্রোতের প্রতিকূলে টিকে থাকার লড়াই করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করা হয়নি। তাই তাঁর ঐকান্তিক আগ্রহ এবং অধ্যবসায় লক্ষ্য করে আবারও এগিয়ে আসেন সিলভান বেয়ই। যার হাত ধরে তিনি প্রবেশ করেছিলেন রন্ধনশিল্পের রূপকথার অলৌকিক জগতে। তাঁর হাত ধরেই খুঁজে পান আরেক জগতের ঠিকানা। বিস্মিত কিশোর আবিষ্কার করেন বইয়ের আলোকিত জগৎ-জাতীয় গ্রন্থাগার। হঠাৎ করেই তাঁর সম্মুখে পৃথিবীর আরেকটি ভেড়ানো দ্বার উম্মোচিত হয়। চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়, আনন্দের হাসি ফোটে বিষণ্ন মুখে। সারা দিনের প্রচণ্ড পরিশ্রমের পর যখনই খানিকটা সময় নিজের হয়, তখনই ছুটে আসেন থরে থরে সাজানো বইয়ের জগতে। রন্ধনশিল্প, ইতিহাস, স্থাপত্যবিদ্যা তাঁর প্রিয় বিষয়। প্রচুর পড়াশোনা করে নিজেকে শাণিত করেন।
তখন তাঁর কিশোর বয়স, দক্ষতায়, পারদর্শিতায় অনেককে ছাড়িয়ে গেলেন। আর তাই মাত্র সতেরো বছর বয়সে চমৎকার এবং দায়িত্বপূর্ণ কাজ জুটে গেল ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। অতিথি আপ্যায়নে রন্ধন এবং কেক-পেস্ট্রি তৈরির দায়িত্ব পেলেন তিনি। এরপর আর তাঁকে ফিরে তাকাতে হয়নি।
দেশ-বিদেশের নানা বরেণ্য অভ্যাগত, অতিথিদেরকে আপ্যায়নে, সান্নিধ্যে দিন কাটে তাঁর। শিখে নেন উঁচু সমাজের চাল-চলন। তিনি পছন্দ করতেন নানা উপাদানে তৈরি ধাপে ধাপে সাজানো বেশ বড় আকারের সুদৃশ্য কেক তৈরি করতে। বিশেষ করে কেক-পেস্ট্রি তৈরি করতে বিভিন্ন নামকরা স্থাপত্য যেমন পিরামিড, দুর্গ বা প্রাচীন স্থাপত্যকীর্তির ধ্বংসাবশেষ নিপুণ দক্ষতায় তাঁর ক্ষুদ্র সংস্করণ ফুটিয়ে তুলতেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আপ্যায়িত অতিথিবৃন্দের খাবার টেবিলের প্রধান আকর্ষণ ছিল তাঁর তৈরি এমন দৃষ্টিনন্দন কেক। অচিরেই প্যারিসের অভিজাত মহলে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। পেয়ে যান বিদগ্ধ মহলে প্রবেশের অবাধ ছাড়পত্র এবং সেই সঙ্গে হয়ে উঠতে থাকেন তাঁদেরই একজন।
মারি আঁতোয়ান কারেম, ছবি: উইকিপিডিয়া ফ্রান্স
মাত্র আট বছর বয়সে নিজের পিতা-মাতা, পরিবার–বিচ্ছিন্ন সেই বালক সবেমাত্র তারুণ্যের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়েছেন। সমাজের সবচেয়ে উঁচু মহলের সিঁড়ির অনেক অনেক কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। একদিকে পড়াশোনা এবং সেই সঙ্গে কাজের ক্ষেত্রে নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে। রন্ধনশিল্পকে স্থাপত্যের একটি শাখা হিসেবে বিবেচনা করে, তিনি তাঁর ইতিহাস, স্থাপত্যবিদ্যার জ্ঞান দিয়ে কেক-পেস্ট্রিতে নামকরা সব স্থাপত্য ফুটিয়ে তুলতে পারদর্শী হন। প্রতিভার দীপ্তিময় বিকাশ, প্রকাশ ঘটে তাঁর সুনিপুণ নান্দনিক সৃষ্টিতে। অনুজদের জন্য, শিক্ষানবিশদের জন্য যত্ন করে করে লিখে রাখেন প্রতিটি সৃষ্টির খুঁটিনাটি। এমন করেই কেক-পেস্ট্রিকে শিল্পের উচ্চমাত্রায় নিয়ে যেতে সচেষ্ট হন।
প্রথম কনসাল নেপোলিয়নে মুগ্ধ হয়েছেন এমন শিল্পকর্মে। তিনি নিজে খাবারদাবার নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতেন না। তবে অতিথি আপ্যায়ন, রাজকীয় ভোজের আয়োজনে সৌহার্দ্য বিনিময় কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে, তা তিনি ঠিকই বুঝতেন। আর তাই শুধু রাষ্ট্রীয় অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য নিজে উদ্যোগে ১৮০৩ সালে প্যারিস থেকে দক্ষিণে প্রায় দু শ পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে ভ্যালেন্সেতে প্রাসাদসম একটি দুর্গ কিনে নেন। সেখানে অতিথিদের আপ্যায়নের গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয় মাত্র উনিশ বছরের সুদর্শন এবং গুণী এই তরুণ আঁতোয়ানকে। এখানে কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হয় দেশ-বিদেশের রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে। সখ্য গড়ে ওঠে অনেক যশস্বী বিশিষ্টজনের সঙ্গে। প্যারিসের উচ্চমহলে ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ।
রাষ্ট্রীয় অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য প্রথম নাপোলিয়ান ভ্যালেন্সেতে প্রাসাদসম এই দুর্গ পুরোটাই কিনে নেন, ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স
দেশের সীমানা ছাড়িয়ে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। বিশেষ করে ইউরোপের রাজরাজড়ারা এক নামেই তাঁকে চিনতেন, সমাদর করতেন। মাথায় মুকুট না নিয়েই রন্ধনশিল্পের রাজার মুকুটটি ছিল তাঁর মাথাতেই। তাঁকে উপাধি দেওয়া হলো ‘রাজার শেফ, শেফের রাজা’ এবং তিনি প্রথম ব্যক্তি, যিনি এমন অসামান্য সম্মানের শিরোপা অর্জন করেছিলেন। প্রাচুর্য, অর্থ, খ্যাতি তাঁর নিত্যসঙ্গী। তাচ্ছিল্য, অভাব তখন বিষণ্ন অতীত।
নেপোলিয়নের পতনের পরে, তিনি লন্ডনে ভবিষ্যতের চতুর্থ জর্জের শেফের কাজ করেন। পরে তিনি রাশিয়ার প্রথম আলেকজান্ডারের আমন্ত্রণে সেন্ট পিটার্সবার্গে কিছুদিন কাটান। তিনি অস্ট্রিয়ার সম্রাট প্রথম ফ্রাঁসোয়া এবং প্রিন্সেস ক্যাথরিন বাগ্রেসনের প্রাসাদেও নিজের প্রতিভা এবং শিল্পকর্মে প্রশংসিত হন। সমাদৃত হন সর্বত্র।
তিনি রন্ধনবিষয়ক বেশ কিছু বই লিখেছেন। এগুলোর মধ্যে তাঁর বিখ্যাত বই ‘উনিশ শতকে প্যারিসের রান্না বা ফরাসি রন্ধনশিল্প’ প্রকাশিত হয় ১৮২৮ সালে। এটি সাধারণ কোনো গ্রন্থ নয়। এতে তিনি বিবৃত করেছেন চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতালব্ধ নিজের উদ্ভাবিত সৃজনশৈলী, কৌশল, উপাদান নির্বাচন এবং এর গুণাবলি। চিত্রিত করেছেন নিজের সৃষ্টি, কর্ম। রন্ধনশিল্পের জগতে এ গ্রন্থ একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন, একটি চমৎকার নির্দেশিকা।
স্থাপত্যবিদ্যায় লব্ধ জ্ঞান একান্ত নিপুণতায় কাজে লাগাতেন কেক-পেস্ট্রি তৈরি করতে নামকরা স্থাপত্যের জটিল ক্ষুদ্র সংস্করণ নির্মাণে
তা ছাড়া তাঁর বিশেষ অবদান ‘ফরাসি রান্না’ নামে পাঁচ খণ্ডের একটি বিশ্বকোষ। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক শিল্পী। একজন শিল্পীর যেমন অনেক গুণ থাকে, তেমনি তাঁর আরেকটি খুব ভালো গুণ ছিল, তা হলো, খুব ভালো ছবি আঁকতে পারতেন। নিজের বইয়ের নিজের সব সৃষ্টির ছবি সেই সঙ্গে খাবার টেবিলসজ্জা খুব যত্ন করে এঁকেছেন। তিনিই প্রথম শেফদের পোশাক আধুনিকীকরণ করেন। বিশেষ করে পোশাকের সঙ্গে মাথা ঢাকার উঁচু টুপির প্রচলন করেন তিনিই।
প্রচণ্ড পরিশ্রমের কারণে তাঁর শরীর ভেঙে পড়ছিল। অনেকেই মনে করেন, সে আমলে রান্নায় জ্বালানি হিসেবে বেশির ভাগ সময়ে কয়লা ব্যবহার করা হতো। আর রান্নাঘরে বাতাস চলাচলের ব্যাপারটি বেশির ভাগ সময়ই উপেক্ষিত থাকত বলেই বিষাক্ত বাতাসে দীর্ঘদিন, দীর্ঘ সময় কাটানোর জন্য তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১২ জানুয়ারি ১৮৩৩-তে প্যারিসে রন্ধনশিল্পের এই বরপুত্রের বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটে।
মারি আঁতোয়ান কারেমের সমাধি, ছবি: উইকিপিডিয়া
ফ্রান্সের রন্ধনশিল্পকে যাঁরা দিয়েছেন অনন্য মাত্রা, যাঁরা তুলেছেন অনন্য উচ্চতায়, মারি আঁতোয়ান কারেম তাঁদেরই একজন। ফ্রান্সের কুলিনারি একাডেমি যে মেডেলটি দিয়ে যশস্বী শেফদেরকে সম্মানিত করে থাকে, তাতে রয়েছে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শেফ, আইকন মারি আঁতোয়ান কারেমের প্রতিকৃতি।
রাস্তা থেকে উঠে এসে প্রবল ইচ্ছাশক্তি, সংসক্তি, পরিশ্রম আর বিস্ময়কর প্রতিভার আলোকে জীবনকে করেছেন অর্থবহ, সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাতে পেরেছিলেন তিনি। স্থান করে নিয়েছিলেন একেবারে রাজপ্রাসাদে। তিনিই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন, পথশিশু থেকে হয়েছিলেন রন্ধনশিল্পী, শিল্পের জগতের কিংবদন্তির রাজপুত্র, সর্বকালের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মুকুটহীন রাজা।
* লেখক: মইনুল হাসান, ফ্রান্স