"তুমি রাত জেগে ফোন হাতে নিয়ে কি করো আমি বুঝি না? আমাকে বোকা ভাবো তুমি? লুচ্চা কোথাকার! রাতদিন মেয়েদের সাথে চ্যাটিং না করলে চলে না তাই না? ছিঃ !" চিৎকার করে কথা বলেই যাচ্ছে রিমি। আকিবও কম যায় না। আকিব বলে,
-আমি লুচ্চা? আর তুমি? তুমি যে কেমন তা আমি ভালো ভাবেই জানি। তোমার চৌদ্দ গুষ্ঠিকে চিনি আমি। নষ্টা মেয়ে কোথাকার! তোমার অফিসের কলিগ হালিমের সাথে কি করো সবই আমার জানা।
রিমি আর সহ্য করতে পারছে না আকিবকে। ওর মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়ে গিয়েছে। রিমি ইদানিং উল্টা পাল্টা কথা একদমই সহ্য করতে পারে না। এক দৌড়ে রান্না ঘরে যেয়ে বটি নিয়ে এসে বলে,
-মুখ সামলে কথা বলো আকিব। আর একটা বাজে কথা বললে বটি দিয়ে জবাই করে ফেলবো তোমাকে। ছোটলোক ইতর কোথাকার! দাও তোমার ফোন দাও আমাকে, দাও।না না ফোন চাই না। তোমার ফেসবুক পাসওয়ার্ড দাও। দেখি একসাথে কতজনের সাথে প্রেমলীলা চলছে তোমার!
রাত তখন প্রায় দুটো বাজে। রিমির বড় মেয়ে আদিবার অভ্যাস রাত জেগে পড়ালেখা করার। এদিকে মেয়েটার ভর্তি পরীক্ষাও সামনে। মন দিয়ে পড়ে একটা নাম করা পাবলিক
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে এমনটা আশা করে আদিবা। প্রায় প্রতিদিন মা বাবার এমন চিৎকার ঝগড়া ফ্যাসাদে ওর মনটা বড্ড খারাপ হয়ে যায়। আদিবা মনে মনেই বলে, " আল্লাহ একটা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে চান্স পাইয়ে দিও। যেন এই দুজনের থেকে দুরে থাকতে পারি।" এদিকে পড়ালেখা শেষ করে রাত এগারোটার দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলো রিমির ছোট মেয়ে আনিকা। হঠাৎ এই রাত দুপুরে মায়ের চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গে ওর। অবশ্য এমন ঘটনা প্রায় রাতেই ঘটে। আনিকা হাত দিয়ে দু'চোখ ডলতে ডলতে বড় বোনকে বলে,
-এই আপা কিরে কি হয়েছে? নতুন করে কি হলো রে? নাকি বাবার ফেসবুকিং চ্যাটিং...!
-নতুন কোন ঘটনা না। রোজ যা হয় তাই। হ্যাঁ মা আবারও বাবার পাসওয়ার্ড চাচ্ছে। রাত জেগে কার সাথে কি করে না করে মা দেখবে। আচ্ছা তুই বল আনিকা, বাবা তার পাসওয়ার্ড দিয়ে দিলেই তো পারে নাকি? শুধু শুধু মায়ের সন্দেহ বাড়ে আর এই রাত বিরাতে ঝগড়া ফ্যাসাদ দেখতে হয় আমাদেরকে। সামনে আমার পরীক্ষা। এরা ভুলেই যায় সন্তানরা বড় হয়েছে। দুজনের কেউই ভালো না।
-ইশ বাবা যে কেন এমন করে। ঘোড়ার ডিমের
পাসওয়ার্ড দিয়ে দিলেই তো পারে মাকে। তাহলেতো মা শান্তি পায়। এই আপা বাবা আবার কারো সাথে প্রেম ট্রেম করে নাতো? ধ্যাত আমার আর ভালো লাগে না এসব। চল আমরা যাই মা বাবার কাছে।
-নাহ আমি যাবো না। ঘেন্না লাগে আমার। বুইড়া বয়সে ভীমরতি বলে একটা কথা আছে না, সেটাই হয়েছে বাবার।
আনিকা বড় বোনের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে,
-আমার আর তোর যে বয়স আপা, এই বয়সে আমরা যদি দুষ্টামি করি তবে সেটা মানায়। কিন্তু বাবা বা মা যেটা করছে তা মোটেও ঠিক করছে না। স্বামী স্ত্রী কেউই কাউকে বিশ্বাস করে না। ফেসবুক পাসওয়ার্ড নিয়ে তারা অশান্তি করে নিজেদের মধ্যে। এই আপা, বাবা কি সত্যি কোন মহিলার সাথে ইটিসপিটিস করে নাকি রে? মাকেও তো দেখি রাত বিরাতে মায়ের কলিগ হালিম আংকেলের সাথে ননস্টপ কথা বলেই যাচ্ছে। তা কিসের এত কথা বলতো আপা? অফিসে তো দেখা হয় কথা হয়, বাড়িতে আসলেও এত কিসের কথা থাকে রে এদের?
আদিবার চোখ ছলছল করছে। ছোট বোনকে বলে,
-সব দোষ ঐ মোবাইলের আর ফেসবুকের। আমি তো বুঝি, সব বুঝি।জানিস আনিকা ফেসবুকের আগে মা বাবা দুজনেই খুব হাসি আনন্দে ছিলো। কোন ঝামেলা ছিলো না দুজনের। যখনই স্মার্ট ফোন কিনলো দুজন, তারপরই শুরু হলো অশান্তি। মায়ের কলিগ হালিম আংকেলই তো মাকে ফেসবুক আইডি খুলে দিয়েছে। মা নিজেই সে কথা বলছিলো।
রিমি, আকিবের বিয়ে হয়েছে প্রায় বিশ বছর আগে।রিমির বড় মামা আর আকিবের বাবা ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন।সেই সূত্রেই দুই পরিবারের সম্মতিতে দেখাশোনা করেই বিয়ে হয় ওদের। বিয়ের সময় রিমির বয়স ছিলো বিশ বছর। সরকারী কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়তো ও। আকিব তখন পিডিবির সাব এ্যাসিসট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার। বিয়ের পরই আকিবের সাথে রিমি চলে যায় আকিবের কর্মস্থল পটুয়াখালিতে। নানান প্রতিকুলতার মাঝে রিমি অনার্স পাশ করে। তারপর আর পড়ালেখাটা করতে পারেনি। দুটো বাচ্চাকে নিয়ে সংসার সামলে পড়াটা আর হয়ে ওঠেনি।
অনার্স পাশ করেই রিমি পূবালী ব্যাংকে ভালো একটা চাকরী পেয়ে যায়। তারপর থেকেই রিমি দুই মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় থাকে। আকিব বেশ ক'বছর বিভিন্ন জেলা শহরে থাকার পর এক সময় ঢাকাতেই স্থায়ী হয়। ওর অফিসের অনেকেই আশ্চর্য্য হয়, কিভাবে একটানা ছয় সাত বছর একই জায়গায় থাকে সে। অন্য কোথাও পোষ্টিং হয় না কেন ওর !
দিনকে দিন রিমি আকিবের ঝগড়া বিবাদ বাড়তেই থাকে। দিন চারেক আগে রিমি আদিবাকে বলে,
-যতদিন তোর বাপ শয়তানটা বাহিরে বাহিরে চাকরী করেছে ততদিনই আমি শান্তিতে ছিলাম। অন্ততঃ ওর মুখ দেখতে হতো না আমাকে।
আদিবা বলেই ফেলে মাকে,
-তুমিতো চাকরী করো, তুমি এসব সহ্য করলে কেন? যারা অসহায় তারা মুখ বুজে এসব অন্যায় অত্যাচার হজম করে।
বড় মেয়ের কথা শুনে রিমি কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-তোদের দুই বোনের জন্যই সব সহ্য করেছি। সে সময় রাগ করে মায়ের বাড়ি চলে গেলে আমার ভায়েরা বুঝিয়ে শুনিয়ে আবার আমাকে তোর বাপের কাছে পাঠিয়ে দিতো। তখনতো আমি চাকরী করতাম নারে।
মায়ের কথা শুনে আদিবার চোখ ছলছল করে।সামনে ওর ভর্তি পরীক্ষা। এত অশান্তি আর ভালো লাগছে না ওর। প্রতিটা মেয়ের নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বিয়ে করা উচিত বলে মনে করে আদিবা। আদিবা বলে,
-মা বিশটা বছর তো সহ্য করলে, এখন তোমার যা ভালো মনে হয় তাই করো। ভালো চাকরী করো, ভালো বেতন পাও তুমি।
রিমিও বলে,
-থাক তোরা তোদের বাপের সাথে। আমি মায়ের বাড়ি চলে যাবো। এই নষ্ট লোকের সাথে থাকলে আমার মাথা নষ্ট হয়ে যাবে।সারাজীবন এই শয়তান লোক অনেক যন্ত্রণা করেছে আমাকে। আর এখনতো ঘরের মধ্যে নষ্টামি করছে মোবাইল হাতে নিয়ে। বাহিরে কি করে সে খবরও আমার জানা আছে।
আকিব অনেক চেষ্টা করেও রিমিকে আটকাতে পারলো না। আজই রিমি মায়ের বাড়ি চলে গেলো। যাবার সময় আকিবকে বলে গেলো,
-এখন সারাদিন রাত মোবাইলে মা*দের নিয়ে পড়ে থাক।যত পারিস মজা লুট এখন। পারলে বাড়িতেও নিয়ে আসিস মা*দেরকে।
আকিবও বলে,
-তুইও থাক তোর হালিম নাগরকে নিয়ে। হালিমের জন্যই তোর সাহসটা এত বেড়েছে। পারলে হালিমকে বিয়ে কর যাহ। শোন শোন তোর ফেসবুকের পাসওয়ার্ডটা দিয়ে যা আমাকে। আমিও ঢুকে দেখবো কি করিস হালিমের সাথে।
মায়ের বাড়ি এসেও শান্তি নেই রিমির। মা নিজের মত করে কোন রকমে নামাজ কালাম পড়ে দিন গুজরান করছেন ছেলেদের সংসারে। বাবা মারা গিয়েছে বেশ ক'বছর আগে। রিমির বাবা ব্যবসা করতেন। অনেক সম্পত্তির মালিক ছিলেন। রিমির বড় দুই ভাই এখন সেই সম্পদ বিক্রী করছে আর বসে বসে খাচ্ছে।
"এভাবে বসে বসে খেলে তো রাজা বাদশাহর ভান্ডারও শেষ হয়ে যাবে।" রিমি ওর বড় ভাইকে বলে। অমনি রিমির ভাবী রাগে গজগজ করতে করতে বলে,
-নিজের সংসারে তো ভালো ভাবে থাকতে পারো না। এতই যখন জ্ঞানের কথা জানো তখন যাও না তোমার স্বামীকে জ্ঞান দাও। তবুও যদি স্বভাব চরিত্র ভালো হয়। বেশরম যত্তসব! নিজের সংসারে অশান্তি বাঁধিয়ে এখন এখানে এসেছে আমাদের জীবনকে জ্বালিয়ে দিতে।
সন্তানদের কথা কাটাকাটি শুনে রিমির মা ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। উনি কার দিকে হয়ে কথা বলবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না। তবে সব দিক থেকেই অন্যায়টা যে তার মেয়ের সাথে হচ্ছে সেটা উনি ভালোই বোঝেন।যেহেতু ছেলেদের সংসারে মা থাকেন তাই উনি নিজের মেয়েকেই বলেন,
-মারে এই বাড়িতে অশান্তি করিস না। এত লেখাপড়া শিখলি, চাকরী করিস তবুও কেন তোর এত যন্ত্রণা। দুটা দিন ও কি ভাই ভাবীদের সাথে মিলেমিশে থাকতে পারিস না?
রিমির মাথায় তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। রিমি মা মা বলে চিৎকার করতে করতেই জ্ঞান হারায়। দ্রুত ওর ভায়েরা রিমিকে ল্যাব এইড হাসপাতালে নিয়ে যায়। তবে ডাক্তাররা রিমির স্বজনদের বলেছেন ভয়ের কোন কারন নেই।আজকাল মেন্টাল স্ট্রেস থেকেও এমনটা হয়। এরই মধ্যে রিমির কতগুলো টেষ্ট করতে দিয়েছেন ডাক্তার। যার মধ্যে সিটি স্ক্যানও আছে।
আকিব দুই মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে রিমির পাশে বসে আছে। রিমি চোখ মেলে স্বামী সন্তানদের দেখছে। আকিব রিমির হাত দুটো ধরে বার বার ক্ষমা চাইছে আর বলছে,
-আমাকে মাফ করে দাও রিমি। আল্লাহ তোমাকে সুস্থ করে দিন। তুমি না থাকলে আমার বাড়ি অন্ধকার। তুমি চলে যাবার পর বুঝেছি তোমাকে আমাদের কত দরকার। মেয়েদের জন্য হলেও তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো জলদি।আমি মেয়েদের সামনেই কথা দিচ্ছি মোবাইল ব্যবহার করবো শুধু প্রয়োজনে কথা বলার জন্য।
আকিবের কথা শুনে রিমির মুখে হাসি ফুটে উঠে।রিমি বলে,
-তুমি ফেসবুক ব্যবহার না করলে ঝগড়া করবো কার সাথে? অবশ্যই ফেসবুক করবে তুমি। তবে সব কিছুরই একটা সীমা আছে। অতিরিক্ত কোন কিছুই ভালো না। যখন মোবাইল ফেসবুক ছিলো না তখন অনেক সুখে ছিলাম আমরা। আমাদের সেসব সুখ শান্তি কেড়ে নিয়েছে এই বাজে জিনিসগুলো।
মা বাবার কথা শুনতে শুনতে আদিবা এক ফাঁকে বলে,
-মা ফেসবুক শুধু সুখ শান্তি কেড়ে নিয়েছে বলছো কেন? মানুষের ঘুম নাওয়া খাওয়া সবই শেষ করে দিয়েছে ফেসবুক। ইদানিং কতজনের সংসার ভাঙছে এই ফেসবুক নামক জঘন্য জিনিসের জন্য। অবশ্য ভালো যাঁরা, তাঁরা আবার সব জায়গায় ঠিকই ভালোটা খুঁজে নেন। মন্দরা সব কিছুর মাঝেই মন্দটা দেখেন।
বোনের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আনিকা বলে,
-মানুষের জীবনে সব চেয়ে বেশি জরুরী হচ্ছে নিয়ম মেনে কাজ করা। সুস্থ শরীরে বাঁচতে হলে একটা মানুষকে দৈনিক নির্দিষ্ট একটা সময়ের মধ্যেই ঘুমাতে হবে। এতে চেহারাও সুন্দর থাকবে। তা না সব রাত জেগে জেগে চোখের নীচে কালি ফেলে ফেসবুকিং! আমি বাবা সুন্দর থাকতে পছন্দ করি। তাই সময় মত পড়া শেষ করে রাত এগারোটার মধ্যে বিছানায় যায়।
মেয়েদের কথা শুনে আকিব সত্যি সত্যি ভীষণ লজ্জা পায়। রিমির হাতের সাথে দুই মেয়ের হাত ধরে আকিব বলে,
-আমাদের দুই মা আমাদেরকে এক করে দিয়েছে, তাই না বলো রিমি? মানুষই ভুল করে। আমাদের অজান্তেই হয়তো আমরাও কিছু ভুল করছিলাম। গুরুতর ভুল না হলেও কিছু ভুল তো হচ্ছিলো। মায়েরা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে।
রিমির ছোট মেয়ে আনিকা মা বাবার দিকে চেয়ে বলে,
"তোমরা দুদিন পর পর কিসের পাসওয়ার্ড চাও? এই পাসওয়ার্ড এর কি মুল্য আছে? সামান্য এই পাসওয়ার্ডকে তোমরা এত ভয় পাও! শোনো বাবা, মা শোনো সব সময় জেনো আমাদের সকলের পাসওয়ার্ড একজনের হাতে আছে। আর তিনি হলেন মহান আল্লাহ। ভয় করলে তাঁকেই করো।"
আদিবাও বলে,
"মা বাবা তোমরা প্লিজ আর বিবাদ করো না। তোমাদের নিয়ে আগে যেমন গর্ব হতো, এখনও তেমনই গর্ব করতে চাই।"
(সমাপ্ত)
-আমি লুচ্চা? আর তুমি? তুমি যে কেমন তা আমি ভালো ভাবেই জানি। তোমার চৌদ্দ গুষ্ঠিকে চিনি আমি। নষ্টা মেয়ে কোথাকার! তোমার অফিসের কলিগ হালিমের সাথে কি করো সবই আমার জানা।
রিমি আর সহ্য করতে পারছে না আকিবকে। ওর মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়ে গিয়েছে। রিমি ইদানিং উল্টা পাল্টা কথা একদমই সহ্য করতে পারে না। এক দৌড়ে রান্না ঘরে যেয়ে বটি নিয়ে এসে বলে,
-মুখ সামলে কথা বলো আকিব। আর একটা বাজে কথা বললে বটি দিয়ে জবাই করে ফেলবো তোমাকে। ছোটলোক ইতর কোথাকার! দাও তোমার ফোন দাও আমাকে, দাও।না না ফোন চাই না। তোমার ফেসবুক পাসওয়ার্ড দাও। দেখি একসাথে কতজনের সাথে প্রেমলীলা চলছে তোমার!
রাত তখন প্রায় দুটো বাজে। রিমির বড় মেয়ে আদিবার অভ্যাস রাত জেগে পড়ালেখা করার। এদিকে মেয়েটার ভর্তি পরীক্ষাও সামনে। মন দিয়ে পড়ে একটা নাম করা পাবলিক
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে এমনটা আশা করে আদিবা। প্রায় প্রতিদিন মা বাবার এমন চিৎকার ঝগড়া ফ্যাসাদে ওর মনটা বড্ড খারাপ হয়ে যায়। আদিবা মনে মনেই বলে, " আল্লাহ একটা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে চান্স পাইয়ে দিও। যেন এই দুজনের থেকে দুরে থাকতে পারি।" এদিকে পড়ালেখা শেষ করে রাত এগারোটার দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলো রিমির ছোট মেয়ে আনিকা। হঠাৎ এই রাত দুপুরে মায়ের চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গে ওর। অবশ্য এমন ঘটনা প্রায় রাতেই ঘটে। আনিকা হাত দিয়ে দু'চোখ ডলতে ডলতে বড় বোনকে বলে,
-এই আপা কিরে কি হয়েছে? নতুন করে কি হলো রে? নাকি বাবার ফেসবুকিং চ্যাটিং...!
-নতুন কোন ঘটনা না। রোজ যা হয় তাই। হ্যাঁ মা আবারও বাবার পাসওয়ার্ড চাচ্ছে। রাত জেগে কার সাথে কি করে না করে মা দেখবে। আচ্ছা তুই বল আনিকা, বাবা তার পাসওয়ার্ড দিয়ে দিলেই তো পারে নাকি? শুধু শুধু মায়ের সন্দেহ বাড়ে আর এই রাত বিরাতে ঝগড়া ফ্যাসাদ দেখতে হয় আমাদেরকে। সামনে আমার পরীক্ষা। এরা ভুলেই যায় সন্তানরা বড় হয়েছে। দুজনের কেউই ভালো না।
-ইশ বাবা যে কেন এমন করে। ঘোড়ার ডিমের
পাসওয়ার্ড দিয়ে দিলেই তো পারে মাকে। তাহলেতো মা শান্তি পায়। এই আপা বাবা আবার কারো সাথে প্রেম ট্রেম করে নাতো? ধ্যাত আমার আর ভালো লাগে না এসব। চল আমরা যাই মা বাবার কাছে।
-নাহ আমি যাবো না। ঘেন্না লাগে আমার। বুইড়া বয়সে ভীমরতি বলে একটা কথা আছে না, সেটাই হয়েছে বাবার।
আনিকা বড় বোনের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে,
-আমার আর তোর যে বয়স আপা, এই বয়সে আমরা যদি দুষ্টামি করি তবে সেটা মানায়। কিন্তু বাবা বা মা যেটা করছে তা মোটেও ঠিক করছে না। স্বামী স্ত্রী কেউই কাউকে বিশ্বাস করে না। ফেসবুক পাসওয়ার্ড নিয়ে তারা অশান্তি করে নিজেদের মধ্যে। এই আপা, বাবা কি সত্যি কোন মহিলার সাথে ইটিসপিটিস করে নাকি রে? মাকেও তো দেখি রাত বিরাতে মায়ের কলিগ হালিম আংকেলের সাথে ননস্টপ কথা বলেই যাচ্ছে। তা কিসের এত কথা বলতো আপা? অফিসে তো দেখা হয় কথা হয়, বাড়িতে আসলেও এত কিসের কথা থাকে রে এদের?
আদিবার চোখ ছলছল করছে। ছোট বোনকে বলে,
-সব দোষ ঐ মোবাইলের আর ফেসবুকের। আমি তো বুঝি, সব বুঝি।জানিস আনিকা ফেসবুকের আগে মা বাবা দুজনেই খুব হাসি আনন্দে ছিলো। কোন ঝামেলা ছিলো না দুজনের। যখনই স্মার্ট ফোন কিনলো দুজন, তারপরই শুরু হলো অশান্তি। মায়ের কলিগ হালিম আংকেলই তো মাকে ফেসবুক আইডি খুলে দিয়েছে। মা নিজেই সে কথা বলছিলো।
রিমি, আকিবের বিয়ে হয়েছে প্রায় বিশ বছর আগে।রিমির বড় মামা আর আকিবের বাবা ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন।সেই সূত্রেই দুই পরিবারের সম্মতিতে দেখাশোনা করেই বিয়ে হয় ওদের। বিয়ের সময় রিমির বয়স ছিলো বিশ বছর। সরকারী কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়তো ও। আকিব তখন পিডিবির সাব এ্যাসিসট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার। বিয়ের পরই আকিবের সাথে রিমি চলে যায় আকিবের কর্মস্থল পটুয়াখালিতে। নানান প্রতিকুলতার মাঝে রিমি অনার্স পাশ করে। তারপর আর পড়ালেখাটা করতে পারেনি। দুটো বাচ্চাকে নিয়ে সংসার সামলে পড়াটা আর হয়ে ওঠেনি।
অনার্স পাশ করেই রিমি পূবালী ব্যাংকে ভালো একটা চাকরী পেয়ে যায়। তারপর থেকেই রিমি দুই মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় থাকে। আকিব বেশ ক'বছর বিভিন্ন জেলা শহরে থাকার পর এক সময় ঢাকাতেই স্থায়ী হয়। ওর অফিসের অনেকেই আশ্চর্য্য হয়, কিভাবে একটানা ছয় সাত বছর একই জায়গায় থাকে সে। অন্য কোথাও পোষ্টিং হয় না কেন ওর !
দিনকে দিন রিমি আকিবের ঝগড়া বিবাদ বাড়তেই থাকে। দিন চারেক আগে রিমি আদিবাকে বলে,
-যতদিন তোর বাপ শয়তানটা বাহিরে বাহিরে চাকরী করেছে ততদিনই আমি শান্তিতে ছিলাম। অন্ততঃ ওর মুখ দেখতে হতো না আমাকে।
আদিবা বলেই ফেলে মাকে,
-তুমিতো চাকরী করো, তুমি এসব সহ্য করলে কেন? যারা অসহায় তারা মুখ বুজে এসব অন্যায় অত্যাচার হজম করে।
বড় মেয়ের কথা শুনে রিমি কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-তোদের দুই বোনের জন্যই সব সহ্য করেছি। সে সময় রাগ করে মায়ের বাড়ি চলে গেলে আমার ভায়েরা বুঝিয়ে শুনিয়ে আবার আমাকে তোর বাপের কাছে পাঠিয়ে দিতো। তখনতো আমি চাকরী করতাম নারে।
মায়ের কথা শুনে আদিবার চোখ ছলছল করে।সামনে ওর ভর্তি পরীক্ষা। এত অশান্তি আর ভালো লাগছে না ওর। প্রতিটা মেয়ের নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বিয়ে করা উচিত বলে মনে করে আদিবা। আদিবা বলে,
-মা বিশটা বছর তো সহ্য করলে, এখন তোমার যা ভালো মনে হয় তাই করো। ভালো চাকরী করো, ভালো বেতন পাও তুমি।
রিমিও বলে,
-থাক তোরা তোদের বাপের সাথে। আমি মায়ের বাড়ি চলে যাবো। এই নষ্ট লোকের সাথে থাকলে আমার মাথা নষ্ট হয়ে যাবে।সারাজীবন এই শয়তান লোক অনেক যন্ত্রণা করেছে আমাকে। আর এখনতো ঘরের মধ্যে নষ্টামি করছে মোবাইল হাতে নিয়ে। বাহিরে কি করে সে খবরও আমার জানা আছে।
আকিব অনেক চেষ্টা করেও রিমিকে আটকাতে পারলো না। আজই রিমি মায়ের বাড়ি চলে গেলো। যাবার সময় আকিবকে বলে গেলো,
-এখন সারাদিন রাত মোবাইলে মা*দের নিয়ে পড়ে থাক।যত পারিস মজা লুট এখন। পারলে বাড়িতেও নিয়ে আসিস মা*দেরকে।
আকিবও বলে,
-তুইও থাক তোর হালিম নাগরকে নিয়ে। হালিমের জন্যই তোর সাহসটা এত বেড়েছে। পারলে হালিমকে বিয়ে কর যাহ। শোন শোন তোর ফেসবুকের পাসওয়ার্ডটা দিয়ে যা আমাকে। আমিও ঢুকে দেখবো কি করিস হালিমের সাথে।
মায়ের বাড়ি এসেও শান্তি নেই রিমির। মা নিজের মত করে কোন রকমে নামাজ কালাম পড়ে দিন গুজরান করছেন ছেলেদের সংসারে। বাবা মারা গিয়েছে বেশ ক'বছর আগে। রিমির বাবা ব্যবসা করতেন। অনেক সম্পত্তির মালিক ছিলেন। রিমির বড় দুই ভাই এখন সেই সম্পদ বিক্রী করছে আর বসে বসে খাচ্ছে।
"এভাবে বসে বসে খেলে তো রাজা বাদশাহর ভান্ডারও শেষ হয়ে যাবে।" রিমি ওর বড় ভাইকে বলে। অমনি রিমির ভাবী রাগে গজগজ করতে করতে বলে,
-নিজের সংসারে তো ভালো ভাবে থাকতে পারো না। এতই যখন জ্ঞানের কথা জানো তখন যাও না তোমার স্বামীকে জ্ঞান দাও। তবুও যদি স্বভাব চরিত্র ভালো হয়। বেশরম যত্তসব! নিজের সংসারে অশান্তি বাঁধিয়ে এখন এখানে এসেছে আমাদের জীবনকে জ্বালিয়ে দিতে।
সন্তানদের কথা কাটাকাটি শুনে রিমির মা ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। উনি কার দিকে হয়ে কথা বলবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না। তবে সব দিক থেকেই অন্যায়টা যে তার মেয়ের সাথে হচ্ছে সেটা উনি ভালোই বোঝেন।যেহেতু ছেলেদের সংসারে মা থাকেন তাই উনি নিজের মেয়েকেই বলেন,
-মারে এই বাড়িতে অশান্তি করিস না। এত লেখাপড়া শিখলি, চাকরী করিস তবুও কেন তোর এত যন্ত্রণা। দুটা দিন ও কি ভাই ভাবীদের সাথে মিলেমিশে থাকতে পারিস না?
রিমির মাথায় তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। রিমি মা মা বলে চিৎকার করতে করতেই জ্ঞান হারায়। দ্রুত ওর ভায়েরা রিমিকে ল্যাব এইড হাসপাতালে নিয়ে যায়। তবে ডাক্তাররা রিমির স্বজনদের বলেছেন ভয়ের কোন কারন নেই।আজকাল মেন্টাল স্ট্রেস থেকেও এমনটা হয়। এরই মধ্যে রিমির কতগুলো টেষ্ট করতে দিয়েছেন ডাক্তার। যার মধ্যে সিটি স্ক্যানও আছে।
আকিব দুই মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে রিমির পাশে বসে আছে। রিমি চোখ মেলে স্বামী সন্তানদের দেখছে। আকিব রিমির হাত দুটো ধরে বার বার ক্ষমা চাইছে আর বলছে,
-আমাকে মাফ করে দাও রিমি। আল্লাহ তোমাকে সুস্থ করে দিন। তুমি না থাকলে আমার বাড়ি অন্ধকার। তুমি চলে যাবার পর বুঝেছি তোমাকে আমাদের কত দরকার। মেয়েদের জন্য হলেও তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো জলদি।আমি মেয়েদের সামনেই কথা দিচ্ছি মোবাইল ব্যবহার করবো শুধু প্রয়োজনে কথা বলার জন্য।
আকিবের কথা শুনে রিমির মুখে হাসি ফুটে উঠে।রিমি বলে,
-তুমি ফেসবুক ব্যবহার না করলে ঝগড়া করবো কার সাথে? অবশ্যই ফেসবুক করবে তুমি। তবে সব কিছুরই একটা সীমা আছে। অতিরিক্ত কোন কিছুই ভালো না। যখন মোবাইল ফেসবুক ছিলো না তখন অনেক সুখে ছিলাম আমরা। আমাদের সেসব সুখ শান্তি কেড়ে নিয়েছে এই বাজে জিনিসগুলো।
মা বাবার কথা শুনতে শুনতে আদিবা এক ফাঁকে বলে,
-মা ফেসবুক শুধু সুখ শান্তি কেড়ে নিয়েছে বলছো কেন? মানুষের ঘুম নাওয়া খাওয়া সবই শেষ করে দিয়েছে ফেসবুক। ইদানিং কতজনের সংসার ভাঙছে এই ফেসবুক নামক জঘন্য জিনিসের জন্য। অবশ্য ভালো যাঁরা, তাঁরা আবার সব জায়গায় ঠিকই ভালোটা খুঁজে নেন। মন্দরা সব কিছুর মাঝেই মন্দটা দেখেন।
বোনের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আনিকা বলে,
-মানুষের জীবনে সব চেয়ে বেশি জরুরী হচ্ছে নিয়ম মেনে কাজ করা। সুস্থ শরীরে বাঁচতে হলে একটা মানুষকে দৈনিক নির্দিষ্ট একটা সময়ের মধ্যেই ঘুমাতে হবে। এতে চেহারাও সুন্দর থাকবে। তা না সব রাত জেগে জেগে চোখের নীচে কালি ফেলে ফেসবুকিং! আমি বাবা সুন্দর থাকতে পছন্দ করি। তাই সময় মত পড়া শেষ করে রাত এগারোটার মধ্যে বিছানায় যায়।
মেয়েদের কথা শুনে আকিব সত্যি সত্যি ভীষণ লজ্জা পায়। রিমির হাতের সাথে দুই মেয়ের হাত ধরে আকিব বলে,
-আমাদের দুই মা আমাদেরকে এক করে দিয়েছে, তাই না বলো রিমি? মানুষই ভুল করে। আমাদের অজান্তেই হয়তো আমরাও কিছু ভুল করছিলাম। গুরুতর ভুল না হলেও কিছু ভুল তো হচ্ছিলো। মায়েরা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে।
রিমির ছোট মেয়ে আনিকা মা বাবার দিকে চেয়ে বলে,
"তোমরা দুদিন পর পর কিসের পাসওয়ার্ড চাও? এই পাসওয়ার্ড এর কি মুল্য আছে? সামান্য এই পাসওয়ার্ডকে তোমরা এত ভয় পাও! শোনো বাবা, মা শোনো সব সময় জেনো আমাদের সকলের পাসওয়ার্ড একজনের হাতে আছে। আর তিনি হলেন মহান আল্লাহ। ভয় করলে তাঁকেই করো।"
আদিবাও বলে,
"মা বাবা তোমরা প্লিজ আর বিবাদ করো না। তোমাদের নিয়ে আগে যেমন গর্ব হতো, এখনও তেমনই গর্ব করতে চাই।"
(সমাপ্ত)