সপ্তাহান্তিক ছুটিতে আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানা থেকে উজিয়ে পারমেটের ক্যাম্পিং সাইটে আসা প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য আর অচেনা মানুষের সঙ্গ উপভোগের অভিলাষে। ক্ষণিকের আলাপে সবাই সত্যিই বড় আপন হয়ে ওঠে। আবার সময় ফুরিয়ে গেলে তেমনই ভোজবাজির মতো তারা মিলিয়েও যায়। আসা–যাওয়ার পথের মাঝে এভাবেই জমে ওঠে পান্থশালা।
- নাম রাখো ‘পারমিতার পান্থশালা।’
- প্যারামিটার? হোয়াট?
- প্যারামিটার না। পারমিতা! চ্যাংকে জিজ্ঞেস করো। সে বুঝিয়ে বলতে পারবে।
ডনা ও তার মুরগিরা
ডনার চিন্তিত মুখ দেখে কোরিয়ান পর্যটক চ্যাং মুচকি মুচকি হাসছে। সে প্রতিদিন সক্কালবেলা উঠে ঘণ্টা দুয়েক ইয়োগা করে। বৌদ্ধ সাহিত্যের রত্নভান্ডার প্রজ্ঞাপারমিতা সম্পর্কে তার বেশ ভালো ধারণা আছে। এই ক্যাম্পিং সাইটের প্রস্তাবিত নাম হিসেবে তার সমর্থন আছে বলেও মনে হলো। এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী এবং তত্ত্বাবধায়ক ডনা খুব একটা কনভেনসড মনে হলো না। সে অনুনয়ের সুরে বলল, ‘একটু ক্যাচি কোনো নাম বলো, যেটা মানুষের মনে থাকবে, মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়বে।’
আমি বললাম, ‘শোনো, একটা কমপ্লিমেন্টারি বিয়ারের বিনিময়ে এর চেয়ে বেশি কনসালটেন্সি হয় না।’ ‘ওহো, এই নাও আরেকটা, তবু একটা ক্যাচি নাম বের করো।’
ক্যানটা খুলে চ্যাংয়ের দিকে তাকাতেই সে তার তৈরি কোরিয়ান প্যান কেকের প্লেটটা এগিয়ে দিল। এক ঢোক বিয়ার গিলে আবার ধ্যানস্থ হলাম।
প্যানকেক বানাতে ব্যস্ত চ্যাং
পারমেটের (Permet) এই ক্যাম্পিং সাইটটায় এসেছি গতকাল সন্ধ্যাবেলায়। আগামীকাল আবার ফিরে যাব কর্মস্থল তিরানায়। কিন্তু ক্যাম্পের এই পানশালা-কাম-বৈঠকখানা-কাম-রান্নাঘরে গোল হয়ে বসা—সবাই যেন সবার কত চেনা! আজ বিকেলে বৃষ্টি নামল যখন, চ্যাংয়ের তখন খুব দেশের কথা মনে পড়ল। ওর ছোটবেলায় গ্রামের বাড়ির চালে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ হলেই নাকি কড়াইয়ে পিঠা ভাজার পিটপ্যাট শব্দ শোনার জন্য মন কেমন করে। বৃষ্টির দিনে পেঁয়াজু-পাকোড়া খেতে এই বাঙালেরও যেহেতু সাধ হয়, তাই আমিও ক্যারাভান থেকে বেরিয়ে ওর পিছু পিছু রান্নাঘরে চলে এলাম।
আজ শনিবার, ক্যাম্পিং সাইটটা তাই বেশ প্রাণমুখর। কোরিয়ার চ্যাং আর বাংলাদেশের আমি ছাড়াও আছেন জার্মানি থেকে আসা এক পর্যটক দম্পতি আর তাঁদের ১০ মাসের ফুটফুটে পুত্র ইয়োহান। আছে লাতিন আমেরিকার ছয়-সাতজন তরুণীর একটা দল। তাদের ক্যারাভান থেকে সারা দিন রিনঝিন হাসির ঢেউ শোনা যায়। ওরা সেই সুদূর দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আলবেনিয়া চলে এসেছে কী একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে কাজ করতে। সপ্তাহজুড়ে কাজ করে আর উইকেন্ডে ঘুরে বেড়ায়। আমিও তো শুধু সপ্তাহন্তে এখানে আসি। জার্মান দম্পতি মাতৃত্ব–পিতৃত্বকালীন ছুটিতে ক্যারাভান নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। এই সপ্তাহেই ছুটি শেষ। ফিরে যাবেন জার্মানিতে।
পারমিতার পান্থশালায় ক্ষণিকের অতিথিরা (বাঁ থেকে দ্বিতীয় লেখক)
এর মধ্যে অদ্ভুত কিছু মানুষও আসে। এই যেমন যুক্তরাজ্য থেকে এক ছেলে এসেছিল। খুব হইহই করে বারবিকিউ করে খাওয়াল আমাদের সবাইকে। অভাবনীয় স্বাদ হয়েছিল তাতে! যখন জিজ্ঞেস করলাম সে পেশাদার রন্ধনশিল্পী কি না, যে তার স্বনির্মিত শলাকায় লাইটার ছুঁইয়ে বলল, ‘আমিগো, আমি এই জিনিস বেচি।’ বারবিকিউয়ের আগুনের আলোয় আমার অবাক চোখ দেখে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘যেটা নিয়ে রুটিরুজি, সেটা নিয়ে মিথ্যে বলা পাপ, আমিগো।’ আজ চলি বলে ধীরগতিতে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
আমাদের মধ্যে শুধু চ্যাংয়েরই কোথাও ফেরার তাড়া নেই। তেরো-চৌদ্দ মাস আগে সে দেশ ছেড়েছে। সেই থেকে এক দেশ থেকে আরেক দেশ, এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম ঘুরে চলেছে। একবার কোনো গ্রাম ভালো লেগে গেলে সেখানেই থেকে যায় দিনের পর দিন। এখানে কাছাকাছি গ্রামগুলোর খামারিরা ওকে খুব ভালোবাসেন। ওর হাসিটা দেখলে নাকি গ্রামের মানুষের শান্তি শান্তি লাগে। ও গ্রাম দিয়ে হেঁটে গেলেই কেউ না কেউ তাকে বাসায় ডেকে গ্লাস ভরে ছাগলের দুধ খেতে দেন।
ঝুরঝুরে সেই ব্রিজটা
গত সপ্তাহে যখন এসেছিলাম, ও একটা ঝুরঝুরে ব্রিজ পেরিয়ে আমাকে কাছের একটা গ্রামে নিয়ে গিয়েছিল। কোথায় কোন পুরোনো চার্চের উঠানে একটা বেরি ফলের গাছ আছে, যেখানে থোকা থোকা টুসটুসে বেরি ফল ফলে রয়েছে, এসব ওর চেনা। গালভরে বেরি খেয়েছিলাম সেদিন। এই বেরিটা এত নরম তুলতুলে যে মুখে দিতেই গলে যায়। ফলটা এতই নাজুক যে এটা বাজারজাত করা যায় না।
সেই বেরি
একটু চাপ লাগলেই গলে যায়। তাই গাছ থেকে পেড়ে খেতে না পারলে এই স্বাদ কপালে জুটবে না। রং অনেকটা খয়েরি আঙুরের মতো। মৃদু মিষ্টি আর মাদকতাময় একটা ঘ্রাণ। রূপ, রস, গন্ধ ছাড়াও যেকোনো খাবারের আর যে উল্লেখযোগ্য গুণটা আমাদের অবচেতন মনে আরাম দেয়, তা হচ্ছে এর টেক্সচার। এই ফলের টেক্সচারটা অনেকটা স্তনবৃন্তের মতো। আমি তাই এই ফলের নাম দিয়েছি নিপল বেরি।
যাকগে। এই পান্থশালাটার একটু বর্ণনা দেওয়া যাক। পারমিতার পান্থশালা মূলত একটা ফাঁকা মাঠ। ক্যারাভানে করে যাঁরা ঘুরে বেড়ান, তাঁরা এখানে ক্যারাভ্যানটা পার্ক করে রেখে কয়েক দিন থেকে যেতে পারেন। ওহ্, বলে রাখি, ক্যারাভ্যান হলো গাড়ি-বাড়ি। মানে গাড়ির মধ্যেই বাড়ি। এই গাড়ি-বাড়ি থাকার সুবিধে হলো, প্রত্যন্ত যেসব অঞ্চলে অবারিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রয়েছে, কিন্তু হোটেল-মোটেল নেই, সেসব জায়গাতেও অনায়াসে থেকে যাওয়া যায়। মূল শহরের বাইরে, যেখানে চারপাশটা নিরিবিলি, আলোক-দূষণ নেই, সেখানে রাতের ঝকঝকে ছায়াপথ দেখা যায়, আকাশভরা তারার মিরর ইমেজ বা দর্পণ প্রতিবিম্বের মতো উঠান ভরা জোনাক দেখা যায়। মুশকিলটা হয় শৌচব্যবস্থা নিয়ে।
ক্যারাভান
নিজেদের ক্যারাভানে সেই জার্মান দম্পতি
গাড়ি-বাড়ির মালিক যাঁরা, তাঁরা তো বনবাদাড়ে পটি করতে পারবেন না, সেই অবকাশই নেই। সুন্দর প্রকৃতিতে অসুন্দর একটা সভ্যতাজনিত সমস্যা! ডনার এই ক্যাম্পিং সাইটটা সেই সমস্যা দূর করেছে। যাঁরা ক্যাম্পিং করতে চান, তাঁদের জন্য এখানে শৌচালয়ের ব্যবস্থা রয়েছে আর রয়েছে একটি পানশালা। কেউ চাইলে সেখানে টুকটাক রান্নাবান্নাও করে নিতে পারেন। ডনা একটা কাউবয় হ্যাট পরে, ঘোড়ার পিঠে চেপে পুরো জায়গাটা তত্ত্বাবধান করে বেড়ায়। এই ফাঁকা জায়গাটায় বেশ একটা খামারবাড়ির মতো ভাব। ডনার পোষা ভেড়ার আছে একটা। তার নাম ফার্নান্দোজ। সে সারা দিন পোষা মুরগিগুলোকে তাড়া করে বেড়ায়। আর আমাকে দেখলেই তার কচি শিং দিয়ে গুঁতো মারতে আসে। আমি বিরক্ত হচ্ছি দেখে ডনা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুমি ভেড়া পছন্দ করো না?।’ আমি বলেছিলাম, ‘নিশ্চয়ই পছন্দ করি! তবে সেটা কাবাব বানানোর পর।’ নিরামিষাশী ডনা আর কথা বাড়ায়নি।
আলবেনিয়ার দক্ষিণে পারমেট নামের এই পাহাড়ি গ্রামটায় মানুষ আসে মূলত এখানে থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে বেনিয়ের (Benje) উষ্ণ প্রস্রবণটি দেখতে। এই শীত-গ্রীষ্ম সব ঋতুতেই এতে সারা দিন জলে ডুবে থাকতে বেশ লাগে। পাশাপাশি এর কাছে ভিওসা (Vjose) নামের নদীটার অগভীর তলদেশে সালফারসমৃদ্ধ কাদা মেখেও রোদ পোহায় অনেকে। এতে নাকি ‘ত্বক হয়ে ওঠে আরও উজ্জ্বল, মসৃণ আর লাবণ্যময়’। এই নদীর গতিপথ ধরে এগিয়ে গেলে রয়েছে দীর্ঘ এক গিরিখাদ। পাহাড়ি এই পাথুরে নদীর পাড় ধরে ধরে প্রবেশ করা যায় সেই গিরিখাদে।
বয়ে চলেছে ভিওসা
পাশে খাঁজে বসে দু‘দন্ড শান্তির খোঁজে লেখক
সপ্তাহান্তে ছেলে–বুড়ো সবাই চলে আসে এখানে। উষ্ণ প্রস্রবণে স্নানের জায়গাটা মূলত বেড়াতে আসা পরিবারগুলোর দখলে চলে যায় বেশ সকালেই। কিশোর-তরুণদের দল হইহই করে এগিয়ে যায় গিরিখাদটার পথ ধরে। আর ইনস্টাগ্রাম জেনারেশনের তরুণীরা পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বসে বিভিন্ন আঙ্গিকে ছবি তুলতে থাকেন। বেনিয়ে নদীর ওপরে এই ব্রিজটা সেই অটোমান আমলের। পুরো আলবেনিয়ায় অটোমান প্রশাসনের নির্মিত এমন বেশ কয়েকটি সেতু এখনো স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। (কাল শেষ পর্ব)
* লেখক: সৌভিক দাস | মানবতাবাদীকর্মী