শব্দের রয়েছে বিচিত্র রকম অর্থ, বিচিত্র রকম প্রয়োগ। অনেক ক্ষেত্রে এক শব্দ একাধিক অর্থে প্রয়োগ হয়; অনেক ক্ষেত্রে মূল অর্থ ছাপিয়ে ভিন্ন অর্থ প্রধান হয়। কিছু অর্থ, কিছু প্রয়োগ আবার অভিধান সমর্থন করে না। শব্দের উৎস, অর্থ আর প্রয়োগবৈচিত্র্য নিয়ে আমাদের এ আয়োজন...
সৈয়দ ঘণ্টন সন্ধ্যার সময় পৌনে এক ঘণ্টা হাঁটেন। এরপর ঘরে ফেরার আগে কখনো ডাব খান, কখনো খান না। আজ মনে হলো, গরম একটু বেশি পড়েছে। সুতরাং ডাব খাওয়ার জন্য মজনু মিয়ার ভ্যানের কাছে গেলেন। লোকটাকে সন্ধ্যার পর তাদের মহল্লার গলিতে দেখা যায়। দিনের বেলা কোথায় ডাব বেচে কিংবা দিনে আদৌ ডাব বেচে কি না, এটা ঘণ্টন সাহেবের জানা নেই।
অন্যদিন সৈয়দ ঘণ্টনকে দেখে মজনু মিয়া আগেই ডাব কাটা শুরু করে। আজ আঙুলে গুনে গুনে কী যেন হিসাব করছিল। ফলে কখন ঘণ্টন সাহেব ভ্যানের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন, সে খেয়াল করল না। সৈয়দ ঘণ্টন নিজেই আগবাড়িয়ে বললেন, ‘ডাবের হিসাব চলছে বুঝি!’
মজনু মিয়া পানখাওয়া দাঁত বের করে হাসার মতো ভঙ্গি করল। অন্ধকারে অবশ্য তার দাঁত দেখা গেল না। তা ছাড়া যেখানে সে ভ্যান নিয়ে দাঁড়ায়, সেখানে আলোও বেশ কম। তবে সৈয়দ ঘণ্টন ভালোই জানেন, লোকটা পান খায়, আর তার দাঁতগুলোও লাল লাল হয়ে গেছে। মজনু মিয়া এবার দা তুলে নিল ডাব কাটার জন্য। বিড়বিড় করে তখনো সে হিসাব করেই চলেছে। সৈয়দ ঘণ্টন বাড়তি কোনো কথা বললেন না। মজনু মিয়া ডাব কেটে তুলে দিল তার হাতে। এরপর বলল, ‘আমি প্রতিদিন পাই টু পাই হিসাব রাখি। কয়টা ডাব আনলাম, কয়টা বেচলাম, কয়টা আছে, দিন শেষে ঠিক বইলা দিতে পারুম।’
সৈয়দ ঘণ্টন ডাব খেতে খেতে ভাবলেন, সেদিন কোথায় যেন শুনলেন, একজন বলছেন, ‘পইপই করে হিসাব রাখতে হবে...’। কথাটার ভুল তিনি তখনই টের পেয়েছিলেন; কিন্তু ওই টের পাওয়া পর্যন্তই। আজ মজনু মিয়ার ‘পাই টু পাই’ শোনার পর ‘পইপই করে হিসাব’ রাখার কথায় মনে মনে একদফা হেসে নিলেন। এরপর ডাব খাওয়া শেষ করে ডাবের খোসা মজনু মিয়ার হাতে দিলেন। আর বেশ মজা করে বললেন, ‘এই যে বললেন, পাই টু পাই হিসাব রাখেন, কথাটা ঠিক আছে।...কিন্তু আমি জানতে চাচ্ছিলাম, পাই টু পাই মানে কী, জানেন?’
মজনু মিয়া এ প্রশ্নে খুব বেশি অবাক হলো না। কারণ, সৈয়দ ঘণ্টন মাঝেমধ্যেই তাকে শব্দ নিয়ে প্রশ্ন করেন। আজ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মজনু বলল, ‘পাই মানে পয়সা। আমি পোত্তেক পয়সার হিসাব রাখি।’
‘পাই’ মানে পয়সা, এক আনার চার ভাগের এক ভাগ, এটা সৈয়দ ঘণ্টন অভিধান ঘাঁটার সূত্রে আগে থেকেই জানতেন। তবে, ‘পাই টু পাই’ কথাটা লোকমুখে প্রচলিত হয়ে থাকবে। সৈয়দ ঘণ্টনকে চুপ থাকতে দেখে মজনু মিয়ার সন্দেহ হয়। সে প্রশ্ন করে, ‘পাই মানে পয়সা। হয় নাই?’
ঘণ্টন সাহেব বললেন, ‘পাই মানে পয়সা, ঠিক আছে। এই শব্দ হিন্দিতেও আছে। তবে পাই শব্দটা সংস্কৃত “পাদ” থেকেও আসতে পারে, যার অর্থ সিকিভাগ বা পোয়া অংশ।’
সৈয়দ ঘণ্টনের কথার পুরোটা মজনু মিয়ার শোনা হলো না। আর শুনলেও এত কিছু তার বোঝার দরকার নেই। এর মধ্যে একজন এলেন একসঙ্গে কয়েকটা ডাব কিনবেন বলে। মজনু মিয়া এবার সেদিকে মনোযোগ দিল। সৈয়দ ঘণ্টন পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে চলে এলেন।
ঘরে এসে হাতমুখ ধুয়ে তিনি নামলেন ‘পইপই’ শব্দ নিয়ে। কয়েকটি অভিধান ঘেঁটে প্রায় একই রকম ব্যাখ্যা পেলেন। পইপই শব্দ এসেছে সংস্কৃত ‘পদে পদে’ থেকে। এর অর্থ ‘বারবার’, ‘পুনঃপুন’। ফারসি, হিন্দি, মারাঠি ভাষাতেও এ রকম শব্দ আছে। প্রয়োগ উদাহরণ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, কাউকে পইপই করে বলা যায়; কিন্তু প্রত্যেক পয়সার হিসাব রাখা বোঝাতে ‘পইপই’ শব্দ ব্যবহার করলে ভুল হবে।
দেখা শেষ করে অভিধানগুলো বন্ধ করতে যাবেন, এমন সময় তার স্ত্রী সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘মুদির দোকানে কত টাকা বাকি পড়েছে, জিজ্ঞেস করেছিলে?’
সৈয়দ ঘণ্টন দাঁত দিয়ে জিব কাটলেন। সন্ধ্যায় হাঁটতে বের হওয়ার আগে তার স্ত্রী বারবার করে বলে দিয়েছিলেন, মাসের শেষ সপ্তাহে বাকিতে সব জিনিস আনা হয়েছে। টাকার হিসাবটা দেখে আসতে। কিন্তু ঘরে ফেরার আগে মুদির দোকান ঘুরে আসতে ভুলে গেছেন সৈয়দ ঘণ্টন। তার স্ত্রী একটু গলা চড়িয়েই বললেন, ‘তোমাকে না পইপই করে বলে দিলাম, পাই টু পাই হিসাব আনতে...’
আরও কিছু হয়তো বলতেন; কিন্তু তার আগেই সৈয়দ ঘণ্টন ছুটলেন দোকানের দিকে।
[FA]pen[/FA] লেখক: তারিক মনজুর: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক
সৈয়দ ঘণ্টন সন্ধ্যার সময় পৌনে এক ঘণ্টা হাঁটেন। এরপর ঘরে ফেরার আগে কখনো ডাব খান, কখনো খান না। আজ মনে হলো, গরম একটু বেশি পড়েছে। সুতরাং ডাব খাওয়ার জন্য মজনু মিয়ার ভ্যানের কাছে গেলেন। লোকটাকে সন্ধ্যার পর তাদের মহল্লার গলিতে দেখা যায়। দিনের বেলা কোথায় ডাব বেচে কিংবা দিনে আদৌ ডাব বেচে কি না, এটা ঘণ্টন সাহেবের জানা নেই।
অন্যদিন সৈয়দ ঘণ্টনকে দেখে মজনু মিয়া আগেই ডাব কাটা শুরু করে। আজ আঙুলে গুনে গুনে কী যেন হিসাব করছিল। ফলে কখন ঘণ্টন সাহেব ভ্যানের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন, সে খেয়াল করল না। সৈয়দ ঘণ্টন নিজেই আগবাড়িয়ে বললেন, ‘ডাবের হিসাব চলছে বুঝি!’
মজনু মিয়া পানখাওয়া দাঁত বের করে হাসার মতো ভঙ্গি করল। অন্ধকারে অবশ্য তার দাঁত দেখা গেল না। তা ছাড়া যেখানে সে ভ্যান নিয়ে দাঁড়ায়, সেখানে আলোও বেশ কম। তবে সৈয়দ ঘণ্টন ভালোই জানেন, লোকটা পান খায়, আর তার দাঁতগুলোও লাল লাল হয়ে গেছে। মজনু মিয়া এবার দা তুলে নিল ডাব কাটার জন্য। বিড়বিড় করে তখনো সে হিসাব করেই চলেছে। সৈয়দ ঘণ্টন বাড়তি কোনো কথা বললেন না। মজনু মিয়া ডাব কেটে তুলে দিল তার হাতে। এরপর বলল, ‘আমি প্রতিদিন পাই টু পাই হিসাব রাখি। কয়টা ডাব আনলাম, কয়টা বেচলাম, কয়টা আছে, দিন শেষে ঠিক বইলা দিতে পারুম।’
সৈয়দ ঘণ্টন ডাব খেতে খেতে ভাবলেন, সেদিন কোথায় যেন শুনলেন, একজন বলছেন, ‘পইপই করে হিসাব রাখতে হবে...’। কথাটার ভুল তিনি তখনই টের পেয়েছিলেন; কিন্তু ওই টের পাওয়া পর্যন্তই। আজ মজনু মিয়ার ‘পাই টু পাই’ শোনার পর ‘পইপই করে হিসাব’ রাখার কথায় মনে মনে একদফা হেসে নিলেন। এরপর ডাব খাওয়া শেষ করে ডাবের খোসা মজনু মিয়ার হাতে দিলেন। আর বেশ মজা করে বললেন, ‘এই যে বললেন, পাই টু পাই হিসাব রাখেন, কথাটা ঠিক আছে।...কিন্তু আমি জানতে চাচ্ছিলাম, পাই টু পাই মানে কী, জানেন?’
মজনু মিয়া এ প্রশ্নে খুব বেশি অবাক হলো না। কারণ, সৈয়দ ঘণ্টন মাঝেমধ্যেই তাকে শব্দ নিয়ে প্রশ্ন করেন। আজ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মজনু বলল, ‘পাই মানে পয়সা। আমি পোত্তেক পয়সার হিসাব রাখি।’
‘পাই’ মানে পয়সা, এক আনার চার ভাগের এক ভাগ, এটা সৈয়দ ঘণ্টন অভিধান ঘাঁটার সূত্রে আগে থেকেই জানতেন। তবে, ‘পাই টু পাই’ কথাটা লোকমুখে প্রচলিত হয়ে থাকবে। সৈয়দ ঘণ্টনকে চুপ থাকতে দেখে মজনু মিয়ার সন্দেহ হয়। সে প্রশ্ন করে, ‘পাই মানে পয়সা। হয় নাই?’
ঘণ্টন সাহেব বললেন, ‘পাই মানে পয়সা, ঠিক আছে। এই শব্দ হিন্দিতেও আছে। তবে পাই শব্দটা সংস্কৃত “পাদ” থেকেও আসতে পারে, যার অর্থ সিকিভাগ বা পোয়া অংশ।’
সৈয়দ ঘণ্টনের কথার পুরোটা মজনু মিয়ার শোনা হলো না। আর শুনলেও এত কিছু তার বোঝার দরকার নেই। এর মধ্যে একজন এলেন একসঙ্গে কয়েকটা ডাব কিনবেন বলে। মজনু মিয়া এবার সেদিকে মনোযোগ দিল। সৈয়দ ঘণ্টন পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে চলে এলেন।
ঘরে এসে হাতমুখ ধুয়ে তিনি নামলেন ‘পইপই’ শব্দ নিয়ে। কয়েকটি অভিধান ঘেঁটে প্রায় একই রকম ব্যাখ্যা পেলেন। পইপই শব্দ এসেছে সংস্কৃত ‘পদে পদে’ থেকে। এর অর্থ ‘বারবার’, ‘পুনঃপুন’। ফারসি, হিন্দি, মারাঠি ভাষাতেও এ রকম শব্দ আছে। প্রয়োগ উদাহরণ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, কাউকে পইপই করে বলা যায়; কিন্তু প্রত্যেক পয়সার হিসাব রাখা বোঝাতে ‘পইপই’ শব্দ ব্যবহার করলে ভুল হবে।
দেখা শেষ করে অভিধানগুলো বন্ধ করতে যাবেন, এমন সময় তার স্ত্রী সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘মুদির দোকানে কত টাকা বাকি পড়েছে, জিজ্ঞেস করেছিলে?’
সৈয়দ ঘণ্টন দাঁত দিয়ে জিব কাটলেন। সন্ধ্যায় হাঁটতে বের হওয়ার আগে তার স্ত্রী বারবার করে বলে দিয়েছিলেন, মাসের শেষ সপ্তাহে বাকিতে সব জিনিস আনা হয়েছে। টাকার হিসাবটা দেখে আসতে। কিন্তু ঘরে ফেরার আগে মুদির দোকান ঘুরে আসতে ভুলে গেছেন সৈয়দ ঘণ্টন। তার স্ত্রী একটু গলা চড়িয়েই বললেন, ‘তোমাকে না পইপই করে বলে দিলাম, পাই টু পাই হিসাব আনতে...’
আরও কিছু হয়তো বলতেন; কিন্তু তার আগেই সৈয়দ ঘণ্টন ছুটলেন দোকানের দিকে।
[FA]pen[/FA] লেখক: তারিক মনজুর: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক