আমি বোধহয় একমাত্র প্রেমিক যে তার প্রেমিকার বিয়েতে ক্যামেরাম্যানের কাজ করেছে।
তৃপ্তি আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করেছিল সাত দিন আগে। প্রেমিক হিসেবে আমার ব্যর্থতার লম্বা একটা ফিরিস্তি আর আমাকে বিয়ে না করার শ'খানিক কারণ বর্ণনা করে, তৃপ্তি বলেছিল, "তুমি জীবন নিয়ে একদম সিরিয়াস না, নির্জন। আমি ভরসায় থাকতে পারছি না আর। ভাল থেকো!"
ভাল থাকার একমাত্র কারণ আমাকে তাকে ছাড়াই ভাল থাকতে বলে নিজে ভাল থাকতে আরেকজনের সাথে বিয়েতে রাজী হয়ে গেল!
আমি বেশ কিছুদিন ভাল থাকিনি। আমি বেশ কিছুদিন খারাপও থাকিনি। কেমন ছিলাম, জানি না, জানতে চাইও না।
দুদিন আগে রিফাত ভাই যখন বললেন, "একটা খ্যাপ পাইছি। তুই ক্যামেরাটা নিয়ে 'চিরসুখী' কমিউনিটি সেন্টারে যাবি, ফটাফট ফটো তুলবি। খাবি দাবি। পরেরদিন ছবিগুলার সফট কপি আমাকে দিয়ে দুইহাজার টাকা নিবি। ব্যাস!", রাজী হয়ে গিয়েছিলাম আমি।
রিফাত ভাই বিখ্যাত ওয়েডিং ফটোগ্রাফার। তাকে মাসে অন্তত পঞ্চাশটা বিয়ে কভার করতে হয়। বলা বাহুল্য, প্রতিটা বিয়েতে সশরীরে উপস্থিত থাকেননা তিনি। কিছুকিছু জায়গায় আমাদের মতো এমেচারদের পাঠান।
জানি না কেন, সেদিন রাজী হয়েছিলাম তার কথায়, তার দেয়া এর আগের দুইটা প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলাম আমি। সেদিন রাজী না হলে, আমার দিকে বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে থাকা তৃপির মেকাপে মোড়ানো কৃত্রিম ও অস্বাভাবিক মুখটার ছবি তুলতে হতো না!
রিফাত ভাই বলেছিলেন, "তুই যতই ভাল ছবি তুলিস না কেন, টাকা দেয়ার সময় বিয়েবাড়ির লোক ছবি ভালো হয় নাই বলবেই। দুইটা কাজ করলে এমনটা হবে না। এক- কাপলের লাখ লাখ ছবি তুলবি। লাখ লাখ বলতে আমি লাখ লাখই বোঝাচ্ছি। অগুনতি ছবি। বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে যখন বর হাই তুলবে, তখনও ছবি তুলবি, বরের পাশে ভোটকা, চিকনা, সুন্দর, অসুন্দর যেই আসবে, তারই ছবি তুলবি! আর ২ নাম্বার হলো, যে তোর সাথে ডিল করেছে, যে তোকে টাকাটা দিবে, তার আর্টিস্টিক কিছু ছবি তুলবি। চেহারা যেমনই হোক, ছবিতে যেন তাকে উত্তমকুমার লাগে। তাহলেই হবে। বিয়ের ছবি তুলতে যাচ্ছিস, প্রকৃতির না!"
এই হলো, রিফাত ভাইয়ের বিখ্যাত (অন্তত ব্যস্ত! এটা করেই করেই কার কিনেছেন একটা) হওয়ার গুপ্তমন্তর!
রিফাত ভাইয়ের উপদেশ মতো, আমি বরকনের এত ছবি তুললাম যে, নিজেদের ছবির আধিক্য দেখে ওরা হয়তো বিরক্ত হয়ে যাবে। তৃপ্তি আমাকে দেখে খুব ভড়কে গিয়েছিল। পরে একবার কাছে গিয়ে বলে এলাম, আমি আসলেই ছবি তুলতে এসেছি, সিনেমার নায়কের মতো প্রেমিকার বিয়ে বাড়িতে এসে বিয়ে ভাঙ্গতে কিংবা প্রেমিকার ভাই বা বাবা অথবা বাবার "পোষা" "গুণ্ডার" সাথে মারামারি করে ওকে ভাগিয়ে নিতে আসিনি!
এখন বরং বেশ আনন্দের সাথেই পোজ দিচ্ছে তৃপ্তি। আমার উপর ভরসা না করে, আমার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অপেক্ষা না করে একজন প্রতিষ্ঠিত ক্যাডারকে বিয়ে করে আসলেই সে যে বুদ্ধিমানের কাজ করেছে, এই ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে ওর।
+
তৃপ্তির পরিবারের বেশিরভাগ লোককেই আমি চিনি, তারা অবশ্য আমাকে চেনেন না। তৃপ্তির গহনায় মোড়া মা, ভুঁড়িওয়ালা সুখী মুখের বাবা কিংবা আত্মবিশ্বাসী চেহারার ভাই কি কোনদিন ভাবতে পারবে, এই ক্যামেরাম্যানের হাত ধরেই তাদের বিয়েতে বসা মেয়ে কিংবা বোন বৃষ্টিতে ভিজেছে ফুলার রোডে?
[HIDE]
তার তেলতেলে গোলগাল মুখের ক্যাডার বরটিকে দেখে করুণা হচ্ছে আমার। ইচ্ছে হচ্ছে কানে কানে গিয়ে বলি, এত কষ্ট করে রাত জেগে পড়ে, বিশাল বিশাল গাইড আর এমপিথ্রি মুখস্ত করে, ক্যাডার হওয়ার ফলস্বরূপ যাকে বিয়ে করছিস, সেই মেয়ে আমাকে কথা দিয়ে কথা রাখেনি। তুই শালা বিয়ে করছিস একটা লোভীকে, তোর সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ দেখেই এর অর্গাজম হয়ে গেছে, তোর জায়গায় অন্য কেউ এই চাকরিটা নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিলেও রাজী হয়ে যেত!
এই কমিউনিটি সেন্টারে বেশ কয়েকবার খ্যাপ মেরেছি। কর্মচারীরাও চেনা হয়ে গেছে। একটা বুড়ির ছবি তুলছিলাম, কয়েকটা মেয়ে চিংড়ির মতো লাফাতে লাফাতে তৃপ্তির পাশে এসে বসল। ছবি তুলে দিলাম তাদেরও। তৃপ্তির গলা জড়িয়ে, পিছনে, ডাইনে ও বায়ে দাঁড়িয়ে পোজ দিলো ওরা।
খাবার সার্ভ করার আগেই আমি একটা প্লেট নিয়ে বসে পড়লাম টেবিলে, কারণ বরযাত্রীর খাওয়ার ছবিও তুলতে হবে।
মাংসের বড় একটা পিস মুখে পুরেছি, আমার টেবিলে একটা মেয়ে দুম করে বসে বলল, "আপনাকে চেনা চেনা লাগছে। আপনার নামটা জানতে পারি?"
আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম। একটু আগে ফড়িং এর মতো লাফাতে লাফাতে যে মেয়েরা এসে তৃপ্তির সঙ্গে ছবি তুলল, এ তাদেরই একজন। বেশ মর্ডান জামাকাপড়। চুল কোঁকড়ান। মাংসটা না চিবিয়েই গিলে ফেলে বললাম, "আপনার গ্রামের বাড়ি কি দিনাজপুর?"
মেয়েটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, "দিনাজপুর কেন হবে?"
"দিনাজপুর নয়? তাহলে চিনবেন না! আমি নতুন ঢাকায় এসেছি।", মুরগি পা মুখে ঠুসে দিলাম আমি।
আমার কথায় ভড়কালো না মেয়েটা। জিজ্ঞেস করল, "নামটা কী বলা যাবে?"
আমি মুরগীর পায়ের হাড্ডি আমার অত্যন্ত প্রিয়। আমি সময় নিয়ে সেটাকে পেটে চালান করলাম। ভাবলাম, নিজের নামটা বলতে দোষ কী? যদি চিনতে পারে, নাম না বললেও পারবে। বললাম, "নির্জন!"
মেয়েটি বলল, "আমি ঠিকই ধরেছিলাম।"
মেয়েটি উঠে দাঁড়াল। তারপর আবার বসে, জিজ্ঞেস করল, "আপনার খারাপ লাগছে না?"
আমি খাবারের প্লেটটা টেবিলের উপর রাখলাম। বললাম, "খারাপ লাগবে কেন? ক'জন প্রেমিক প্রেমিকার বিয়েতে পেট পুরে খাওয়ার সুযোগ পায়?"
+
মেয়েটির মুখ হাঁ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ কথাই বলল না সে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "তৃপ্তি আপু বিয়েতে রাজী হয়ে ঠিকই করেছে!"
এই মেয়েটাও আমাকে "তৃপ্তির জন্য অযোগ্য" সার্টিফিকেট দিয়ে চলে গেল। খাবারের প্লেটটা শেষ করলাম আমি। আশ্চর্যের বিষয়, এখন আমার খারাপ লাগছে না আর। আজ সন্ধ্যায় ক্যামেরা নিয়ে আসার সময়ও বিমর্ষ ছিলাম। মনে হচ্ছিল, জীবনের আর লক্ষ্য নেই, সামনে যাওয়ার তাগিদ নেই। শীতের স্থবির ভেকের মতো নিশ্চল হয়ে গিয়েছিলাম আমি। এখানে আসার পর সে ভাবটা আর নেই। মজা পাচ্ছি যেন নিজের ভাগ্য দেখেই। হাসি পাচ্ছে। এই মেয়েটাই, যে এতক্ষণ আমাকে জেরা করে চলে গেলো, সেও হাসবে কতো! কতো জনকেই না বলবে আজকের কথা!
খাওয়ার পর বাইরে এলাম সিগারেট টানতে।
"তৃপ্তি তোমাকেও দাওয়াত দিয়েছে নাকি?", আবার চমকে তাকাতে হলো পিছনে। তৃপ্তির বান্ধবী সুপ্ত আমার দিকে তাকিয়ে আছে অবাক চোখে। বেশ সেজেগুজে এসেছে সুপ্ত। ওর পুরা নামটা যেন কী?
+
"উঁহু! ছবি তুলতে এসেছি।"
সুপ্ত কিছু বলল না। সে এতোটাই অবাক হয়েছে, দাঁড়িয়ে আছে সেখানেই, যেন কেউ ওকে জাদুবলে স্থির করে রেখেছে।
বললাম, "তোমার বান্ধবী আমার গোয়ায় অছিলা বাঁশ দিলো!"
সুপ্ত বলল, "ও যে কেন রাজী হলো বিয়েতে! আমাদের ব্যাচের কেউ বিয়ে করছে না!"
[/HIDE]