What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected নতুন সকাল (1 Viewer)

Joined
Aug 23, 2020
Threads
74
Messages
111
Credits
7,054
"দড়ি বাধাও প্রায় শেষ। মিনিট খানিক পরই তুমি গলায় দড়ি দিবে। আচ্ছা কি ভেবে মরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে জানতে পারি?"
গলায় ফাঁস দেয়ার জন্য সিলিংয়ের সাথে দড়ি বাধার সময় কারো কথা শুনে ঘুরে তাকালো মিহিকা। খানিক আগে আসা গলার স্বর অনুসরণ করে বারান্দার দরজায় তাকালো। দেখলো বারান্দার দরজায় এক বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে আছে।লোকটাকে চিনে না মিহিকা। এতরাতে কোন আগন্তুককে তার ঘরে দেখে অন্যসময় হলে চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় করতো। কিন্তু আজ মন ভালো নেই, আর চিল্লানোর মুডে নেই তাই শুধু ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন বোধক দৃষ্টিতে আগন্তুকের দিকে তাকালো। যার অর্থ আপনি কে? এখানে এসেছেন কেনো! আর কিভাবে এসেছেন!
আগন্তুক মিহিকার ভ্রু কুঁচকানো দেখে মুচকি হাসলেন। হেসে বললেন,
"আমি গালিব, আহমেদ গালিব। সামনের বিল্ডিংয়ের চতুর্থ তলার দক্ষিণ কর্ণারের ফ্ল্যাটটা থাকি। আমি তোমার প্রতিবেশী ।"
আগন্তুকের কথায় বেশ বিরক্ত হলো মিহিকা। কাঁন্নার কারণে রক্তবর্ণ হওয়া চেহারায় একরাশ বিরক্তি ঢেলে আহমেদ গালিবের দিকে তাকালো। গালিব সাহেব মিহিকার চেহারা পড়ে নিয়ে বললেন,
"তো আমি কি করবো, এটাই ভাবনা তাই তো?"
উত্তরে কিছু না বলে ভাবলেশহীন ভাবে তাকালো মিহিকা। গালিব সাহেব আবারো বললেন,
"আসলে তোমার বয়সী আমার একটা মেয়ে আছে। নাম রুফাইদা। রুফাইদা আর ওর মা আজ বিকেলে রুফাইদার নানুর বাসায় গেছে। বাসায় আমি একা। অফিস থেকে ফিরেছি খানিক আগেই। এসে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় এসেছিলাম সিগারেট খেতে। তখনি সামনের বারান্দা দিয়ে তোমার রুমে চোখ গেলো। দেখলাম বারান্দা বরাবর খাটে তুমি বসে আছো। আমি ভাবলাম প্রতিদিন তো রুফাইদার সাথে গল্প করি, আজ যেহেতু ও নেই তাই তোমার সাথে গল্প করা যাবে। এই ভেবেই বারান্দায় টপকে তোমার বারান্দায় চলে এসেছি। এসে দেখি তুমি সুইসাইড করার প্রস্তুতি নিচ্ছো। ভাবছিলাম ফিরে যাবো। পরে আবার ভাবলাম, আসলাম যখন মেয়েটার সুইসাইডের পিছনের গল্পটা শুনে যাই। "

মিহিকা এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো গালিব সাহেবের দিকে। রাত বারোটায় কোত্থেকে বাবার বয়সী লোক বারান্দা টপকে তার ফ্ল্যাটে হাজির হয়েছে । এসে বলছে কিনা সুইসাইডের পিছনের গল্পটা শুনতে এসেছে! এ কি পাগল নাকি এলিয়েন! তবে দেখে তো তেমন মনে হচ্ছে না। বরং বেশ ভদ্রলোক মনে হচ্ছে।
বয়স কত হবে? পঞ্চাশ কি বায়ান্ন?
পরনে তার ধসূর পতুয়া, আর কালো টাউজার। গায়ের রং তামাটে। চতুর্ভুজাকৃতির চোয়ালে কাচা পাকা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, কালো মনির চোখ দুটোর উপর চতুর্ভুজাকৃতির ফ্রেমলেস চশমা। হাতের তর্জনী আর মধ্যমার মাঝে আধখাওয়া একটা সিগারেট। তবে রুমে আসার পর থেকে সিগারেট হাতেই শোভা পাচ্ছে, তা আর মুখ অব্দি এগুচ্ছে না। হয়তো মেয়ের বয়সী কারো সামনে খেতে চাচ্ছে না। তার চোখে সচ্চ চাহনী, দুষ্টু লোক হলে তার চোখে লালসা কিংবা ভয়ানক চাহনি থাকতো। যা এই লোকের নেই।

মিহিকা নাক টেনে গালে লেগে থাকা নোনাজল হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে গালিব সাহেবের দিকে রক্তরাঙা চোখে তাকালো। তারপর রাগত স্বরে বলল,
"কেনো এসেছেন এখানে? কে পাঠিয়েছে আপনাকে? নিশ্চয়ই ওই তিথি পাঠিয়েছে! তবে যেই পাঠাক না কেনো আপনি চলে যান এখান থেকে। আমাকে শান্তিমতো মরতে দিন। না হলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।"

বলে দড়ি ঠিক করতে শুরু করল মিহিকা। গালিব সাহেব এবারো হাসলেন। বললেন,
"ওকে আমি চলে যাবো। কোন ডিস্টার্ব করবো না তোমাকে। তোমার জীবনের শেষ দশ মিনিট আমাকে দাও। আমার সাথে খানিক গল্প করো। দশমিনিট শেষ হলে আমি চলে যাবো।"

ডিপ্রেশনের প্রভাবে আজকাল মুড সুইং করছে মিহিকার। হুটহাট যার তার উপর চওড়া হওয়া যেন স্বভাবে পরিণত হয়েছে। আজ ও তার ব্যাতিক্রম হলো। গালিব সাহেবের কথায় মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল মিহিকার। এমনিতেই মনটা ভেঙে চুরে খান খান হয়ে গেছে। অসহ্য যন্ত্রণায় আর হৃদবিষাদে চটপট করছে দিন পনেরো যাবত । আর যেন সহ্য হচ্ছে না। কোথায় ভেবেছিলো জীবন নামক ডায়েরিটা নিজ হাতে বন্ধ করে ওপারে পাড়ি জমাবে। মুক্তি পাবে এই যন্ত্রণা থেকে। কিন্তু হলো কি! কোত্থেকে এক বুড়ো লোক এসে তাকে কিসব উদ্ভট কথা বলছে! এক যন্ত্রণা শেষ করতে গিয়ে আরেক যন্ত্রণার সম্মুখীন হলো সে। এ যে মরতে গিয়েও শান্তি নেই! নাহ, এত ভাবলে হবে না। আমাকে মরতে হবে। প্রথমে এই বুড়োকে ভাগাতে হবে তারপর গলায় দড়ি দিতে হবে। এই ভেবেই রাগী গলায় বলল,
"দশমিনিট না আর এক মিনিট যদি আপনি এখানে থাকেন তবে আমি চেঁচিয়ে লোক জড়ো করবো। এই মুহুর্তে চলে যান আমার ফ্ল্যাট থেকে। আমাকে কোন বাধা দিবেন না, ভালো হবে না। "

মিহিকার রাগ দেখে এবার শব্দ করেই হাসলেন গালিব সাহেব। হাসতে হাসতে বললেন,
"তুমি রুফাইদার বয়সী। তাই আমি তোমাকে মেয়ের চোখেই দেখছি। তুমি আমাকে আংকেল ডাকতে পারো। আর হ্যাঁ, এখন তুমি চেঁচিয়ে লোক জড়ো করলে তোমারই ক্ষতি হবে। আমার কিছুই হবে না। আমি তো খোলা বারান্দার রেলিং টপকে চলে যাবো নিজের ফ্ল্যাটে । আমি নিয়মিত ব্যায়াম করি। তাই বয়স হলে ও শরীর ফিট আছে, পালাতে মিনিট খানেক লাগবে। কেউ খুঁজে পাবে না আমাকে। তা ছাড়া তোমার কাছে কোন প্রমাণ নেই যে আমি এখানে এসেছি। সুতারাং মা বলি কি? লোক ডেকে নিজের ক্ষতি না করে আমার সাথে মিনিট দশেক গল্প করো তাতেই হবে।"

গালিব সাহেবের কথা শুনে মিহিকা ভ্রু কুঁচকে বলল,
"লোক জড়ো করলে আমার কি ক্ষতি হবে?"
"এই যে তুমি লোক ডাকবে, আশেপাশের ফ্ল্যাট থেকে তোমার চিৎকার শুনে মানুষ ফ্ল্যাটের বাইরে জড়ো হবে। তারপর তারা সবাই মিলে মালিক সমিতিকে কল করবে, তারা এসে ডুপ্লিকেট চাবি কিংবা দরজা ভেঙে ভিতরে ডুকবে। তারপর তুমি তাদের সব ঘটনা খুলে বলবে। তারা আমাকে খুঁজবে, কেউ কেউ তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। এতসবের মাঝে রাত কেটে যাবে, তোমার সুইসাইড করা আর হবে না। তারচেয়ে বরং আমাকে তোমার সুইসাইড এর পিছনে গল্পটা বলো,আমি চলে যাবো। তারপর তুমি শান্তিমতো সুইসাইড করতে পারবে।"
শান্ত কন্ঠে বললেন গালিব সাহেব। গালিব সাহেবের কথা শুনে মিহিকা খানিক ভাবলো। তারপর বললো,
"সত্যিই আপনি চলে যাবেন তো! কোন বাধা দিবেন না তো!"

"নাহ, আমি কোনপ্রকার বাধা দিবো না। কাউকে এই ব্যাপারে বলবো ও না। "
"সত্যিই?"
অনেকটা বাচ্চাদের মতো করে বললো মিহিকা। গালিব সাহেব হেসে সায় জানালেন। মিহিকা খাটের পাশ ঘেঁষে সাদা আর অরেঞ্জ কম্বিনেশনের টাইলসের ফ্লোরে বসে পড়লো। তারপর হাটুতে থিতুনী রাখলো। মিহিকাকে বসতে দেখে গালিব সাহেব বারান্দা দিয়ে সিগারেট ফেলে দিয়ে মিহিকা থেকে কয়েকগজ দূরে থাকা একটা বিনব্যাগে বসে পড়লেন। তারপর বললেন,
"এবার তোমার গল্প স্টার্ট করো। আমি কিন্তু রুফাইদার সাথে একদম ফ্রি। বাবা মেয়ে নয়, ফ্রেন্ডটাইপ সম্পর্ক আমাদের । তুমি নিজেকে রুফাইদার জায়গায় রেখে সহজভাবে আমাকে সব বলতে পারো। "

মিহিকা ভাবলেশহীন ভাবে গালিব সাহেবের কথা শুনলো। তারপর আনমনে বলতে শুরু করলো,
"আমি মিহিকা, মাইসা রহমান মিহিকা। সবাই মিহি বলেই ডাকে। রাবিতে কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়ছি। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা যমুনা ব্যাংক ঢাকা শাখার কর্মরত একজন ব্যাংকার। মা গৃহিনী। বাবা মাকে নিয়ে ঢাকাতেই থাকেন। আমিও ঢাকা থাকতাম বাবা মায়ের সাথে। কিন্তু এইচএসসির পর রাবিতে চান্স পেয়ে পরিবার ছেড়ে রাজশাহী চলে আসি। থাকার জন্য বাবা এই ফ্ল্যাট কিনে দেন। আমি এখানে থাকতে শুরু করি। মা বাবা আর শ্রাবণকে ছেড়ে এতদূর এসে থাকতে প্রথমে খুব কষ্ট হতো। কিন্তু মাস তিনেকের মাঝে অবশ্য নিজেকে মানিয়ে নিই।"

"শ্রাবণ কে?"
কথার মাঝে ফোঁড়ন কাটেন গালিব সাহেব। মিহিকা শান্ত ভঙ্গিতে বলে,
"শ্রাবণ, আমার প্রথম ভালোবাসা। বর্ষার এক বিকেলে ঝুম বৃষ্টিতে বাস স্টপে তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছে। তখন আমি সবে ক্লাস টেনে পড়ি। প্রাইভেট শেষে কাক ভেজা হয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি৷ শ্রাবন তখন এইচএসসি দিবে। সেও প্রাইভেট পড়ে বাসায় ফেরার তাড়ায় বাস স্টপে দাঁড়িয়ে ছিলো। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে আমার চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিলো। মাইগ্রেনের সমস্যাটা তখন প্রবল ছিলো। চশমা ছাড়া একবারেই চলতে পারতাম না। তাই আমি চশমার কাঁচ মুছার জন্য টিস্যু খুঁজছিলাম। ব্যাগ থেকে টিস্যুর প্যাকেট বের করে দেখি টিস্যু আমার মতো কাকভেজা হয়ে গেছে। এদিক ওদিকে দোকান খুঁজছিলাম। শ্রাবণ হয়তো ব্যাপারটা খেয়াল করেছিলো। সে তার পকেট থেকে একটা টিস্যুর প্যাকেট এগিয়ে দিলো। তার সেই উপকারের পর সৌজন্যে মূলক পরিচয় , তারপর আলাপ, তারপর প্রেম। শ্রাবণের হাত ধরে পার করলাম চারটি শ্রাবণ। সময়গুলো বেশ ভালোই ছিলো। মাস কয়েক আগেই শুরু হলো সমস্যা। সেই সমস্যাই আমাকে এই দড়ির মুখে দাঁড় করিয়েছে।
 
নতুন সকাল

লেখকঃ আফিয়া আপ্পিতা
পর্ব-২

হুট করেই শ্রাবনের আচরণ পালটে গেলো। তার ভালোবাসাটা এবার অবহেলায় রূপ নিলো। ব্যস্ততার অযুহাত দিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে লাগলো এড়িয়ে যেতে। প্রথম প্রথম ব্যাপার গুলোকে নিচকই ব্যস্ততা বলে এড়িয়ে গেলে ও পরবর্তীতে আর পারলাম না। আস্তে আস্তে কিছু জিনিস পরখ করতে লাগলাম। একমাত্র আমার সাথেই কথা বলার সময় ওর শত ব্যস্ততা এসে দাঁড়ায়। আর কারো সাথে না। আমার সাথে কথা বলতে গেলেই ওর কপালে বিরক্তির ভাজ পড়ে বাকি সবার সাথে কথা বলার সময় তার ঠোঁটের কোণ থেকে হাসি সরে না। আমাকে নানা কাজের অযুহাত দিতো। কিন্তু দিন শেষে ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর ঘুরাঘুরির ছবি আপলোড দিতে ভুলতো না। সেই ছবি গুলোতে তার পাশে একটা মেয়েকে দেখতে পেতাম। আমার মনে খটকা লাগে। কোথাও সে অন্য কারো সাথে জড়িয়ে নেই তো! ভাবতেই আমার আত্না কেঁপে উঠলো। আমি এসব আর সহ্য করতে না পেরে ঢাকা চলে যাই। ঢাকা গিয়ে লুকিয়ে ওকে ফলো করি। ওর সম্পর্কে খবর নিই। আর জানতে পারি, আমি চিটাগাং যাওয়ার পরপরই সে অন্য নিলীমা নামের একটা মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে। সব শুনে আমি ওর সাথে কথা বলার চিন্তা করলাম। ফোন করে ওকে আমাদের দেখা করার স্থানে ডাকলাম। ওকে আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে ও সাফ জানিয়ে দিলো, আমার সাথে তার যাচ্ছে না। সে এই সম্পর্কটা রাখতে চায় না।বিশ্বাস করুন আংকেল, সেদিন রেস্টুরেন্টের শত মানুষের সামনে আমি ওর পা পর্যন্ত ধরেছি যাতে ও আমাকে ছেড়ে না যায়। কিন্তু ও আমাকে পা ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিয়েছে। কি বলে জানেন? বলেছে, আমাকে নাকি ও কখনো ভালোই বাসেনি। এসব নাকি জাস্ট টাইমপাস ছিলো। আবেগ ছিলো যা কেটে গেছে। নাহলে আমি নাকি ওর নখের যোগ্য ও না। ও তার যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষকেই বেছে নিয়েছে, তাকে ভালোবাসে। বিয়েও তাকে করবে। আমার মতো মেয়েদের নাকি ভালোবাসা যায় না। জাস্ট ইউজ করে টিস্যুর মতো ফেলে দেয়া যায়। ওর কথায়,ওর বিচ্ছেদে আমি ভেঙে পড়েছিলাম। খুব ভেঙে পড়েছিলাম। বাসার সবাই কারণ জিজ্ঞেস করতো। আমি বলতে পারতাম না। তাই এখানে চলে আসি। আসার পর থেকে ঘুটে ঘুটে মরতে থাকি। ওকে আমি নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি। ওর সাথে কথা না বলে আমি থাকতে পারি না। ঘুমাতে পারি না। খেতে পারি না। আমি প্রতিদিন কম হলেও হাজারবার ওকে কল দিয়ে ফিরে আসার অনুরোধ করি। আর ও আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। আমি এসব আর নিতে পারছিলাম না। আমাকে কষ্ট দেয়া হয়তো আরো বাকি ছিলো তাইতো কাল সে তার গার্লফ্রেন্ডকে বিয়ে করে নিয়েছে ৷ দুজনের একসাথে ছবি তুলে আবার আমাকে পাঠিয়েছে। তারপর ফোন দিয়ে হাসতে হাসতে বলে,'দেখ,কে কোন জায়গায় আছে? তোর মতো মেয়েদের জায়গা আমার লাইফে নেই। আমার তো ভাবতেই ঘৃণা লাগে তোর মতো মেয়ের সাথে আমি এককালে ডেট করেছি। স্মার্ট আর যোগ্যতা দেখতে চাস? তবে আমার বউকে দেখ। সে সব দিক দিয়েই পারফেক্ট। তোর মতো জিরো না।'আমি উত্তরে কেঁদে বলেছিলাম,'আমি মরে যাবো।' শ্রাবণ হেসে বলেছিলো, মর। দেখি কেমন মরতে পারিস? আমাকে দায়ী করিস না আবার।' এত প্রত্যাখ্যান এত অপমানের পর আমার বেঁচে থাকা সাজে? যাকে আমি নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি তাকে অন্যকারো সাথে দেখতে পারছিনা। যেই স্থানে আমি থাকার কথা সেই স্থানে অন্য কাউকে দেখে মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছে। আমার তাই আমি মৃত্যুর পথকেই বেছে নিয়েছি।"

মিহিকা থামলো। মিহিকার কথা শুনে গালিব সাহেব হাসিতে ফেটে পড়লেন। যেন তার সামনে মিহিকা নয় বরং মি.বিন দাঁড়িয়ে আছে। সেই মজার কান্ড করছে আর গালিব সাহেব মজা পাচ্ছেন। মিহিকা গালিব সাহেবের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সে কি হাসার মতো কিছু বলেছে! তবে এই লোক হাসছে কেনো! গালিব সাহেবের হাসি থামছেনা। তিনি নিঃশব্দে হেসে চলেছে। মিহিকার এবার রাগ হলো। সে রাগত স্বরে বলল,
"আংকেল আপনি হাসছেন কেনো! আমার অনুভুতি গুলো আমার কাছে কৌতুক মনে হচ্ছে?"

গালিব সাহেব হাসতে হাসতেই বললেন,
"তুমি যদি তোমার বাবা মায়ের অনুভুতিকে কৌতুক বানাতে পারো তবে আমি কেনো তোমার অনুভুতিকে কৌতুক বানাতে পারবো না? তোমার অনুভুতির মূল্য আছে তোমার বাবা মায়ের অনুভুতির মূল্য নেই! আর কার জন্য মরতে যাচ্ছো যে কিনা তোমার মৃত্যু নিয়েও উপহাস করে!"
গালিব সাহেবের হেসে বলা এই কথা মিহিকার বন্ধ মনের দরজায় টোকা দিলো যেন। মিহিকা করুণ স্বরে তাকালো গালিব সাহেবের দিকে। গালিব সাহেব এবার হাসি থামিয়ে শান্তু হয়ে বসলেন। তারপর মিহিকার দিকে তাকিয়ে বললেন,
"আচ্ছা তোমাকে যদি বলা হয় তোমার ভালোবাসার মানুষটার বিয়ের সাক্ষী হিসেবে তোমাকে থাকতে হবে তখন তুমি কি করবে? তোমায় চোখের সামনেই তোমার ভালোবাসার মানুষ অন্য কারো নামে সাক্ষর করতে দেখতে পারবে?"

মিহিকা চকিতে তাকালো। তারপর গালিব সাহেবের কথা মোতাবেক শ্রাবন আর নীলিমার বিয়েতে নিজেকে সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করাতে গেলো। চোখের সামনে শ্রাবন অন্য কারো নামে সাক্ষর করতে কলম নিলো। কলম বসালো,নাহ সে আর ভাবতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে ভাবনায় আনতেই বুক কেঁপে উঠছে। খুব কঠিন পরিস্থিতি। মিহিকা যেই পরিস্থিতি থেকে গেছে তার থেকেও ভয়ংকর পরিস্থিতি। সেই ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে সে কি করবে এমন ভাবনার সমাধান করতে না পেরে মিহিকা হতাশ কন্ঠে বলল,
" এমন ভয়ংকর পরিস্থিতির সমাধান নেই আমার কাছে। ঘটনাটা ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠছে। আমি পারবো না নিজের ভালোবাসার মানুষকে স্বচোক্ষে অন্যের হতে দেখতে। আমি তার আগেই কেঁদে মরে যাবো।"

গালিব সাহেব বাঁকা হেসে বললেন,
" তুমি কত সহজেই মরা যাবার কথা ভেবে ফেললে। ভয়ংকর পরিস্থিতির কথা ভাবতেই তোমার গা শিউরে উঠছে। অথচ আমি সেই ভয়ংকর পরিস্থিতির নিরব দর্শক ছিলাম। না কাঁদতে পেরেছি, না পালাতে পেরেছি আর না মরতে পেরেছি। আসলে মরে যাবো কথাটা বলা যতটা সহজ মরা অতটা সহজ নয়। যদি সহজ হতো তবে এতদিনে আমার কাফনে মোড়ানো দেহকে পোকা মাকড় খেয়ে শেষ করতো। "

গালিব সাহেবের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। মিহিকা বিস্মিত চোখে গালিব সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভাবতে পারেনি গালিব সাহেব এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। সে ভেবেছিলো গালিব সাহেব হয়তো কথার কথা বলেছে। মিহিকা ভাবতে পারছে না। সে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
"আংকেল আপনি এমন...

গালিব সাহেব মিহিকাকে থামিয়ে বললেন,
" আচ্ছা আমাকে দেখে তোমার কি মনে হয়? আমি খুব সুখী একজন মানুষ তাই না? টাকা পয়সা স্ত্রী পরিবার নিয়ে খুব সুখে আছি তাই তো!"
মিহিকা মাথা নাড়লো। গালিব সাহেব মুচকি হাসলেন। তারপর বললেন,
"সবাই এমনই ভাবে। অথচ কেউ জানে না ক্ষত বিক্ষত ভিতরটা। কেউ জানে না নিয়মিত ডিপ্রেশনের ওষুধ নিতে হয় আমার। কেউ জানে না। তুমি মাত্র অল্প কয়েকদিনে ভালোবাসার মানুষটার বিরহে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলে কত সহজে! অথচ আমি সেই বিরহকে নিজের মাঝে লালন করে আসছি দীর্ঘদিন দুই যুগ ধরে। ভেবে দেখো আমি কি কষ্টে আছি! এই যে সুখে আছি,হাসছি এটা কেবলই ঢং আর অভিনয়। এই অভিনয় করতে করতে আমি হাপিয়ে যাই। অতীত ভেবে মাঝে মাঝে নির্জনে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠি। "

মিহিকা যেন অবাক হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সে তার চেহারায় দিগুন বিস্মিত ভাব মাখিয়ে তাকালো গালিব সাহেবের দিকে। গালিব বললেন,
"কি অবাক হচ্ছো তো? আমার মতো হাসি খুশি একজন মানুষের কিভাবে এত দুঃখ থাকে তাই তো?"
মিহিকা মাথা নাড়ালো। মিহিকা মাথা নেড়ে নড়েচড়ে বসলো। একটু আগের সব ভুলে সে গালিব সাহেবের কথায় মনোনিবেশ করলো। এবং মনোযোগী শ্রোতার মতো প্রশ্ন করলো,
"আংকেল আপনি সেই ভয়ংকর পরিস্থিতির পিছনের ঘটনা কি ছিলো? সবটা বলবেন? "

গালিব সাহেব এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলা শুরু করলেন,
" আমার গল্পের অর্ধেকটা খুবই সুন্দর ছিলো। পুরোটা জুড়েই ছিলাম আমি,আমার প্রেয়সী নিন্তিকা আর আমাদের এক মুঠো ভালোবাসা। সে আমার জীবনে এসেছিলো যখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। আমার ক্লাসের নতুন ছাত্রী ছিলো সে। প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে গিয়েছিলো তাকে। শ্যামবর্ণের সে কি মায়াবী চেহারা ছিলো তার! আস্তে আস্তে তা ভালোবাসায় রূপ নেয়। সেই রূপই আমাদের প্রেমময় অধ্যায় শুরু করেছে । ফোনের ছিলো না তখন। চিঠিতেই আবেগ অনুভূতির আদান প্রদান হতো। ক্লাসের ফাঁকে চোখাচোখি, ক্লাস শেষে যাবার বেলা দুই একটা কথা আর চিঠি বিনিময়। এমনভাবেই কেটে গেলো চারটি হেমন্ত। এরিমাঝে আমার বাবা গত হলো। পিতৃশোকে সবকিছু ভুলে গেলাম। পরিবারে অসুস্থ মা, অবিবাহিত বড় বোন আর এইট পড়ুয়া ছোট ভাই। বড় ছেলে হওয়ায় সংসারের ভার এসে পড়লো আমার কাধে। আমি তখন সবে ইন্টারমেডিয়েটে পড়ি। কাধে আসা সেই ভার থেকেই আমি শহরে এসে টিউশনির খোঁজ শুরু করি। কলেজ কামাই করে দিনে সাতটা টিউশন করতাম। সারাদিন থাকতাম টিউশনে, রাতে থাকতাম পড়ায় ডুবে। ঘুমানোর অব্দি সময় পেতাম না। সেখানে প্রেয়সীকে কথা ভেবে পুরো সপ্তাহে সময় বের করে একটা চিঠি লিখে বন্ধুর মাধ্যমে পাঠাতাম। গ্রামে আসা হতো না আর প্রেয়সীর সাথে দেখা হতো না। আমার টিউশনিরর টাকায় সংসার চলতো। আমার টাকায় আর পরিবার সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছিলাম। তা ছাড়া বাবার চিকিৎসায় বন্ধককৃত ভিড়েও ছাড়ানোর তাড়া ছিলো আমার। এদিকে ইন্টারমিডিয়েটের চূড়ান্ত পরীক্ষা ও কাছাকাছি। তার প্রস্তুতি ও নিতে হচ্ছে। দিনে টাকার দায়ে ছুটোছুটি আর রাত পড়াশোনার চাপে আমার তখন বেহাল দশা। বাস্তবতা কত কঠিন তখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম। "

গালিব সাহেব থামলেন তারপর আবার শুরু করলেন,
" বাস্তবতার কাটাযুক্ত পথে বেঁচে থাকার সংগ্রামে চিঠির মাধ্যমে নিন্তিকা আমাকে সাহস জোগাতো। আমার সব ক্লান্ত প্রহর তার চিঠি পড়েই পার হতো। হুট করেই তার চিঠি আসা বন্ধ হয়ে যায়। দু'মাস পরেই ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা ছিলো। আমি পড়াশুনার চাপ ভেবে এড়িয়ে গেলাম ব্যাপারটা। পরীক্ষার মাস খানেক আগে বাড়ি আসলাম। বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলাম নিন্তিকার খবর। কিন্তু তারা জানালো মাসদুয়েক নিন্তিকা কলেজে আসছে না। কেনো তারা জানে না। নিন্তিকার বান্ধবীকে ডেকে জিজ্ঞেস করতেই সে জানালো নিন্তিকার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে পরদিনই বিয়ে। আমি খুব চেষ্টা করলাম নিন্তিকার সাথে কথা বলতে কিন্তু পারলাম না। নিন্তিকার পরিবার নাকি জেনে গিয়েছিলো নিন্তিকা কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে আছে তাই মেয়েকে ঘরবন্দী করে তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। কোন অঘটনের সম্ভাবনায় কোন বান্ধবীর সাথেও দেখা করতে দিচ্ছে না। আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। বুঝতে পারলাম আমার গল্পের সৌন্দর্য এখানেই শেষ। ভাবলাম খুব ভাবলাম কিন্তু কোন পথ বেরিয়ে এলো না। সেদিন সন্ধ্যায় আমি নিন্তিকার বাড়িতে গিয়েছিলাম একটাবার দেখার আশায়। কিন্তু পাইনি তার দেখা। শুনেছিলাম শুধু তার কান্না। তার ঘরের পাশ কেটে যাবার সময় সে হয়তো বেড়ার ফাঁকে সে আমাকে দেখেছিলো। দেখেই মৃদুস্বরে কেঁদে উঠেছিলো। পরক্ষণেই মুখ চেপে ধরেছিলো। তাও আমার কানে প্রিয়তমার চাপা কান্না ঠিকই এসেছিলো। চোখ বেয়ে দুই এক ফোঁটা জ্বল আমারো গড়িয়ে পড়েছিলো। চোখের পানি মুছে কেউ দেখার আগে গা লুকাতে যাবো তখনই কোথাও থেকে এক টুকরো কাগজ এসে পড়লো আমার গায়ে। কান্নাভুলে সেই কাগজ টুকরো কুড়িয়ে নিয়েছিলাম আমি। এলোমেলো করে মুড়ে বল বানানো কাগজটা নিজ ঘরে এসে হারিকেনের আলোয় খুলেছিলাম। তারপর আবিস্কার করলাম এটা আমার প্রিয়তমার চিঠি। হয়তোবা অন্তিম চিঠি।"

"কি লেখা ছিলো চিঠিতে?" কাঁপা গলায় বলল মিহিকা। গালিব সাহেবের গল্প শুনে কান্না আসছে তার। কিন্তু গালিব সাহেবের চোখ মুখ শক্ত। তিনি চোয়াল শক্ত রেখেই বললেন,'সেই চিঠিতে এলোমেলো করে লেখা ছিলো, ভালো থেকো। বাবা মায়ের মুখের দিকে চেয়ে নিজেকেই বিসর্জন দিচ্ছি।ভালোবাসাটা তোমারই থাকলো।' সেটাই ছিলো নিন্তিকার পক্ষ থেকে শেষ চিঠি। চিঠি পড়ে আমি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম, ইচ্ছে করছিলো নিন্তিকাকে নিয়ে পালিয়ে যাই কিন্তু পরিবার নামক পিছুটানের জন্য পারিনি। মায়ের কাছে বলার অব্দি সাহস হয়নি। যেখানে আমার বড় বোনটার বিয়ে নিয়ে এখনো ভাবার সাহস পাচ্ছি না সেখানে আমার মতো ছেলের এত অল্প বয়সে বিয়ে করবে ভাবাও পাপ। আমি পারিনি মায়ের কাছে বলতে কিংবা নিন্তিকার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। সারারাত আমি কেঁদে পার করেছিলাম। কাঁদতে কাঁদতে হুট করেই সিদ্ধান্ত নিলাম সুইসাইড করবো। কাল নিন্তিকা অন্যকারো হবে আমি তা দেখতে পারবো না। সেই ভেবেই সিলিংয়ের সাথে বাধার জন্য দড়ি আনতে রুমের বাইরে যাবার জন্য পা বাড়ালাম। দড়ি আনতে খাবার ঘরে যেতেই দেখি খাবার ঘরের প্লাস্টিকের টেবিলটায় দুটো প্লেট ভর্তি খাবার সাজানো। পাশেই একটা চেয়ারে মা ঘুমিয়ে আছেন। বুঝলাম মা আমার জন্য অপেক্ষা করতে করতেই ঘুমিয়ে গেছেন। আমি নিঃশব্দে আসায় টের পাননি। আমি দড়ি না নিয়ে ঘরে ফিরে এলাম। ভাবতে লাগলাম, যে মানুষটা আমাকে না খাইয়ে খায় না,যেই মানুষটা সবসময় আমাকে ভালোবেসে আড়কে রেখেছেন, আমার জন্য দশ মাস দশ দিন হাড় ভাঙা কষ্ট সহ্য করেছেন, জন্মের আগ থেকে যে আমাকে ভালোবেসে এসেছেন আমি আর জন্য না ভেবে বছর পাঁচেকের ভালোবাসার জন্য আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি! আমি চলে গেলে তাদের কি হবে! বাবা যাবার সময় তাদের মাথার উপর ছায়া হিসেবে আমাকে রেখে গেছেন। আমি চলে গেলে তো তাদের মাথার ছাদ উঠে যাবে। তাছাড়া আমি যার জন্য মরতে যাচ্ছি আমার মৃত্যুতে তার জীবনে কি বেশি পরিবর্তন আসবে? আসলেও কয়দিন? দুইদিন? দুইমাস? দুইবছর? এর পর তো তার জীবন স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমার পরিবার? তারা কি আদৌ স্বাভাবিক হতে পারবে? হুট করেই মনে পড়লো বছর খানেক আগে একবার আমার জ্বর হয়েছিলো। প্রচন্ড জ্বরে আমি বেহুশ হয়ে গিয়েছিলাম। হুশ হওয়ার পর কারো কান্নার আওয়াজ আসছিলো। খেয়াল করে দেখলাম কান্নাটা আমার মায়ের। মা আমার পাশে জায়নামাজে বসে দু'হাত তুলে অজোরে কাঁদছেন। আর বারবার একটা কথাই বলছেন,'আমাকে ছেলেকে ভালো করে দাও আল্লাহ। ওকে কষ্ট দিও না। আমি সহ্য করতে পারছি না। ওর বদলে আমাকে কষ্ট দাও। তাও ওকে সুস্থ করে দাও। দরকার হলে আমাকে উঠিয়ে নাও তাও আমার ছেলেকে সুস্থ করে দাও।
সেই কথাটা ভাবতেই নিজের উপর রাগ হলো। যেই মানুষটা আমার সামান্য কষ্ট দেখে সহ্য করতে না পেরে মরতে রাজি হয়ে গেলো আমি কিনা তার কথা ভাবছি না! আমার সামান্য জ্বরে যার এমন অবস্থা আমার মৃত্যুতে তার কি হবে! মা তো মনে হয় মরেই যাবে। আমি সন্তান হয়ে অন্য কারো জন্য নিজের মাকে মারতে যাচ্ছিলাম! কিভাবে পারলাম আমি! দুই দিনের ভালোবাসার জন্য আমি জন্মপূর্ব ভালোবাসাকে ভুলে গেলাম! এমন ভালোবাসার জন্য তো সব কিছু বিসর্জন দেয়া যায়। আমিও না হয় মায়ের জন্য নিজের আবেগ আর ভালোবাসাকেই বিসর্জন দিলাম! মায়ের ভালোবাসার কাছে এতটুকু তো খুব নগন্য।
এমন ভাবনা মনে আসতেই আত্মহত্যার ভাবনা বাদ দিলাম।"
"পরদিন কি।হলো? "
 
"ভালোবাসার মানুষটার বিয়ের সাক্ষী হওয়ার মতো ভয়ংকর পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছিলাম পরদিন। সেদিন সকাল সকাল বড় খালা এসে হাজির হলো। জানালো তার একমাত্র ছেলে রবিনের কোর্ট ম্যারেজ। সাক্ষী হিসেবে আমাকে যেতে হবে। আমি আগে জানতাম না বিয়ের কথা। মা ও বলেনি। খালার জোরাজোরিতে গেলাম। যাবার পর খালা যখন রবিন ভাইয়ের হবু বউয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। হবু ভাবিকে দেখে আমার আত্মা কেঁপে উঠলো। কারণ আমি যাকে ভাবি বলে ডাকবো সে আর কেউ না আমার প্রেয়সী নিন্তিকা। আমার সামনেই সে লাল বেনারসি পড়ে বসে আছে। সাজটা আমার জন্য নয় অন্যকারো জন্য। দুজনার চোখাচোখি হলো, জ্বলে জ্বলে ভরে উঠলো দু'জোড়া চোখ। আমি দৃষ্টি সরালাম। বাহানা দিয়ে পালিয়ে বাঁচতে চাইলাম কিন্তু খালার কড়া নজর আর অনুরোধে পারলাম না। আমি লুকিয়ে কাঁদার একটু জায়গা খুঁজছিলাম কিন্তু কাঁদার সুযোগ পাইনি। জড়পদার্থের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আমার কোন পথ ছিলো না। আমি কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যাওয়া মন নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সবাই বিয়ের তাড়া দিলো, আমার সামনেই আমার দিকে তাকিয়ে অশ্রুসজল চোখে কাঁপা হাতে অন্যকারো নামে সে সাক্ষর করলো আমার প্রেয়সী । আমি নিরব দর্শক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম সবটা। গলা পাকিয়ে কান্না আসছিলো কিন্তু কাঁদতে ও পারি নি। আমার অধিকারহীন কান্নার কোন অর্থ নেই। কারণ সে এখন আমার প্রেয়সী নয় আমার ভাবি। আমি কাঁপা হাতে সাক্ষীর সাক্ষর করলাম। আমার তখনকার অনুভূতি কি ছিলো আমি বলে বুঝাতে পারবো না।"

"তারপর? " কান্নারত কন্ঠে বলল মিহিকা। গালিব সাহেব কাঁপা গলায় বললেন,
"আমি কি একটা সিগারেট খেতে পারি?" গালিব সাহেবের কথায় মিহিকা বুঝলো গালিব সাহেব নিজের ভিতরে বয়ে যাওয়া ঝড় ধোঁয়ায় ছাড়তে সিগারেট খেতে চাইছেন। তাছাড়া তিনি সিগারেট খেয়ে নিজেকে কিছুটা রিল্যাক্স করতে চাইছেন। মিহিকা মাথা নাড়িয়ে সিগারেট খাওয়ার অনুমতি দিলো। যদিও সিগারেটের গন্ধ তার সহ্য হয় না। তবু মিহিকা এই মুহুর্তে সব বাদ দিয়ে গালিব সাহেবকে স্বাভাবিক করতে চাইছে। তার যে এখনো গল্পের বাকি অংশ শুনা বাকি!
মিহিকা খুব ঘৃণা করে সিগারেটকে। এই সিগারেট নিয়েও শ্রাবনের সাথে কত খুনসুটির স্মৃতি আছে তার! ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মিহিকা। মিহিকার অনুমতি পেয়ে প্রায় সাথে সাথে পকেট থেকে গোল্ড লিফ আর লাইটার বের করলেন। তারপর সিগারেট ধরালেন। লম্বা এক টান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। মিনিট খানেক পর চোখ খুলে নড়েচড়ে বসলেন। মিহিকার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন। হেসে বললেন,
"তা আমরা কোথায় ছিলাম?"
গালিব সাহেবের নিজেকে সামলে নেয়ার ব্যাপাটায় মিহিকা বেশ অবাক হলো। খানিক আগেই এই মানুষটাকে সবচেয়ে দুঃখী আর হতাশাগ্রস্ত মানুষ মনে হয়েছে। অথচ মিনিট দুয়েকের ব্যবধানে নিজেকে সামলে নিয়ে নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করছেন যেন উনার মনে কোন দুঃখ নেই! স্ট্রেঞ্জ! মিহিকার অবাক চাহনি দেখে হাসলেন গালিব সাহেব। হেসে বললেন,
"অভিনয় করতে করতে পাক্কা অভিনেতা হয়ে গেছি। এখন নিজেকে সুখী দেখাতে পারি অনায়েসেই। তারপর বলো কোথায় ছিলাম আমরা?"
মিহিকা নিজের বিস্ময়ী ভাব চেপে বলল,
"আপনার প্রেয়সীর বিয়েতে ছিলাম।"
গালিব সাহেব শব্দ করে হেসে বললেন,
"তুমি ছিলে না। আমি ছিলাম। তাও আবার সাক্ষী হিসেবে। "
গালিব সাহেবের এই জোকটায় অদ্ভুত এক কষ্টের আভাস পাচ্ছে মিহিকা। এত কষ্ট বুকে চেপে এমন জোকস বলায় বিরক্ত সে। তাই বিরক্ত কন্ঠে বলল,
"বিয়ের পরে কি হলো?"
গালিব সাহেবের তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন,
"কি আর হবে? হাসি খুশি আমিটা অনুভূতিহীন জীবন্ত লাশে পরিণত হলাম। ওই ঘটনার পর অনেকবার মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছিলো কিন্তু মায়ের মুখটা চোখের সামনে ভাসতে আর সাহস হয় নি। ভাবলাম প্রেয়সীর ভালোবাসার বিচ্ছেদে না মরে যে মা জীবন দিয়েছে সেই মায়ের ভালোবাসার জন্য বাঁচি! মায়ের সাথে সময় কাটাতে লাগলাম। প্রচুর সময়। মায়ের সাথে যতক্ষণ থাকতাম মায়ের আন্তরিকতা আর প্রতিটা কথা আমার হৃদয় স্পর্শ করতো। কতটা নিঃস্বার্থ ভালোবাসে মা! নিজের অনুভূতির কথা না ভেবে আমার অনুভুতির কথা ভাবে সবসময়। মায়ের সাথে কাটানো মুহুর্ত গুলোতেই মনে খুব সাহস আসতো। মন একটাই কথা ভাবতো যে নেই তার কথা না ভেবে যে আছে তার কথা ভাবো। আমি নিজেকে নিয়ে ভাবনা ছেড়ে দিলাম। কারণ নিজেকে নিয়ে ভাবতে গেলেই নিন্তিকার কথা মনে উঠতো। দুটো একি সুতোয় বাধা ছিলো! আমি মাকে নিয়ে ভাবতে লাগলাম,ঘুরে দাঁড়ালাম। মনকে শক্ত করে পরীক্ষা দিলাম, ভালো রেজাল্ট করলাম। আমার রেজাল্ট শুনে মা খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। মায়ের সেই খুশিটা আমার নজর কেড়েছিলো সেদিন। আত্মহত্যা না করার সিদ্ধান্তকে স্যালুট জানালাম। মায়ের এই খুশিটা দেখার জন্যই তো এত কিছু। তারপর কেটে গেলো অনেক গুলো বছর। পড়াশোনা শেষ ব্যবসা শুরু করলাম। ভালো পর্যায়ে গিয়ে মাকে আনলাম। মায়ের জোরাজোরিতে বিয়ে নামক ফর্মালিটিতে নিজেকে জড়ালাম। এই তো স্ত্রী সন্তান মাকে নিয়ে খুব সুখে আছি এখন। "
"স্ত্রীকে ভালোবাসেন? আর প্রথম ভালোবাসা ভুলতে পেরেছেন?"
"প্রথম ভালোবাসা ভুলা যায় না। তা মনের কোণে রয়েই যায়। আমি ও ভুলতে পারি নি। আজো তেমনি ভালোবাসা কাজ করে তার জন্য। যদিও তা নিষিদ্ধ। অনুভুতি নামক সিস্টেমটা তার যাওয়ার পর থেকে অনেকটা অকেজো হয়ে গেছে। তবে সীমা মানে আমার স্ত্রীকে আমি নিন্তিকার মতো ভালো না বাসলেও মায়া নামক বন্ধনে জড়িয়ে আছি তার সাথে। মায়ার জাল সেই বিছিয়ে দিয়েছে। সে আমাকে খুব বুঝতে পারে,খুব ভালোবাসে। সুখ দুঃখ সব সময় আমাকে আর আমার পরিবারকে আগলে রাখে। দিনশেষে যখন বাসায় ফিরি তখন স্ত্রীর হাসিমাখা মুখ,মেয়ের বাবা বলে জড়িয়ে ধরা আর মায়ের খোকা বলে আগলে নেয়া দেখে সব ক্লান্ত ভুলে যাই। মৃত অনুভূতি গুলো মাথা চারা দিয়ে উঠে না তখন। একটা,পূর্ণ পরিবার আর সবার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আছে। সুখী হওয়ার জন্য আর কি লাগে!"

গালিন সাহেব শুকনো হাসলেন। মিহিকা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। একটা মানুষ এত দুঃখকে বুকে চেপে মুভ অন করতে পারে!এতটা বছর ধরে অনুভূতি নামক দাবানলের আগুন জ্বলে পুড়ে ও কি সুন্দর হাসিখুশি জীবনযাপন করছেন! মিহিকা ভাবতে লাগলো উনার তুলনায় আমার সমস্যা অতি নগন্য। তাও আমি সইতে পারছিনা। উনি কিভাবে সহ্য করেছেন! উনার জায়গায় থাকলে আমি কি করতাম? আমি তো মরেই যেতাম। এভাবে জীবন্ত লাশের মতো চলা যায়? আমার সাথে এমন কিছু হলে আমি পারতাম সইতে? প্রশ্ন ভাবনায় আসতেই কেঁপে উঠলো মিহিকা। হাকচেকিয়ে উত্তর দিলো,
"না আমি কোনভাবেই সইতে পারতাম না। এই দুঃখ সহ্য করার চেয়ে মৃত্যু অনেক সহজ। আমি মরেই যেতাম।"

মিহিকার কথায় গালিব সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন। তারপর বললেন,
" মরে যাওয়া এত সহজ! এতই! মানুষ নিজেকে হত্যা করে জীবনের কষ্টদায়ক মুহুর্ত থেকে পরিত্রাণ পেতে। অথচ তারা জানেই না তারা সাময়িক কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য স্থায়ী কষ্টকে বেছে নিচ্ছে। মৃত্যু তাদের জন্য কষ্ট লাঘব নয় বরং কষ্ট গ্রহণ, জাহান্নাম নামক উপহার গ্রহন। আত্মহত্যা কারীর শাস্তি কি জানো? আবাদুল আবাদ তেমন ভাবেই জাহান্নামের আগুনে পুড়বে যেমন উপায়ে সে সুইসাইড করছিলো। আচ্ছা একটা কথা বলো তো তোমাকে পায়ে যদি একটা কাটা বিধে তবে তুমি কাটা উঠাবে নাকি পা টাই কেটে ফেলবে?"

"কাটা উঠাবো। এই সামান্য কারণে আমি আমার পা কেনো কাটবো!"
"কাটবে না? "
"না।"
"কেনো!"
"কারণ, এই সমস্যা সমাধান আছে আমার আছে। আমি সমস্যা সমাধান উপায়ই বেছে নিবো। পা কাটলে পরবর্তীতে কষ্টটা আমাকেই করতে হবে। সারাজীবন এই কাটা পা নিয়ে চলতে হবে। খুবই কষ্টদায়ক হবে সেটা।"

মিহিকার কথায় গালিব সাহেব হাসলেন। হেসেই বলল,
"মিহিকা তোমার বলা কথাতেই তোমার সব সমস্যার সমাধান আছে। জীবনের কোন সমস্যাই স্থায়ী এবং সমাধানহীন নয়। সব সমস্যারই সমাধান থাকে। নিকষ কালো ভূতুড়ে আঁধার রাতের পরেই কিন্তু সুন্দর একটা সকাল থাকে। ভয়ংকর রাত পেরুলেই তুমি সেই সকালের দেখা পাবে। অন্যথায় পাবে না। তেমনি আমাদের জীবনে সমস্যা গুলো হচ্ছে আঁধার রাতের মতো খুবই ভয়ংকর। মনে হয় পার করতে পারবো না। কিন্তু খানিক সাহসের সঞ্চার হলে ঠিকই আমরা রাত কাটিয়ে ভোরের দেখা পাই। তুমি বুঝো তোমার পায়ে কাটা ফুটকে কাটা উপড়ে ফেলবে তাও পা কাটবে না। কারণ পা কাটলে পরবর্তীতে তোমাকেই কষ্ট পেতে হবে। পা কাটার পরিণতি ভয়ানক হবে। এটা জেনে তুমি পা কাটার কথা ভাবতে পারছো না। অথচ কাটার মতো সামান্য সমস্যার জন্য তুমি তোমার একটা সুন্দর জীবনকেই উপড়ে ফেলতে চাইছো! মিহিকা তুমি কিন্তু চাইলেই তোমার সমস্যা গুলোকে কাটা ভেবে কাটা উপড়ে ফেলতে পারো। আর আঁধার রাত ভেবে সামান্য শক্তি নিয়ে রাত পার করে সকালের দেখা পেতে পারো। সমাধান কিন্তু তোমার নিকটেই। তুমি পা থেকে কাটা উঠাও,পা কেটো না।এতে কষ্টটা তোমাকেই ভোগ করতে হবে। জ্বলতে পারবে বছরের পর বছর ওই আগুনে?"

আজ মিহিকা মনোযোগী শ্রোতা হিসেবে গালিব সাহেবের সব কথা শুনছে। সে মিনমিনে গলায় গালিব সাহেবের কথার উত্তর দিলো,
"কিন্তু এভাবে কি বাঁচা যায়? "
গালিব সাহেব দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
" বাঁচা যায় বলেই তো আমি আজো বেঁচে আছি।শুনো মিহিকা, মৃত্যু কখনোই কোন কিছু সমাধান হতে পারে না। বরং মৃত্যু থেকে সমস্যার শুরু হয়। তুমি তো একজন মানুষের কথা ভেবে মরে যাবে কিন্তু যারা সবসময় তোমার কথা ভেবে আসছে তাদের কি হবে ভাবতে পারছো? যারা সবসময় তোমাকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসে যাচ্ছে সেই বাবা মায়ের কি হবে? তারা তোমাকে হারিয়ে থাকবে কিভাবে বলতে পারো! মৃত্যুর মতো ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সবাই যদি মিনিট খানেকের জন্য ও তাদের বাবা মায়ের দিকে তাকাতো তবে সে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারতো না। মিহিকা তুমি কি একবারো তোমার বাবা মায়ের জন্য ভাবছো না? তুমি শুধু নিজের ভালোবাসার কথা ভাবলে তোমার জন্মপূর্ব ভালোবাসার কথা ভাবলেনা কেনো! তাদের ভালোবাসার কোন মূল্য নেই? প্রিয়জনের বিচ্ছেদের কষ্ট তো তুমি অনুভব করছো। মৃত্যুর পথ বেছে নিয়ে নিজের বাবা মাকে ও যেই কষ্ট অনুভব করাতে চাইছো? তোমার বাবা মা সেই কষ্ট সইতে পারবে? আর তুমি যার বিচ্ছেদে নিজেকে মারতে চাইছো তোমার মৃত্যুতে সেকি তোমার কাছে ফিরে আসবে? তুমি কার জন্য মরতে চাইছো! যার কাছে কিনা তোমার অনুভূতির কোন মূল্য নেই তার জন্য! যার কাছে তোমার জীবনের মূল্য নেই তার জন্য? তুমি মারা গেলে ক্ষতি তোমারই হবে। সে তো আপদ বিদায় হয়েছে ভেবে চিল করবে। তোমার জানাজায় অব্দি পাবে না তাকে। তুমি এমন একজনের জন্য মরতে চাইছো?"

গালিব সাহেব প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে মিহিকার দিকে তাকিয়ে আছেন। মিহিকা মাথা নিচু করে রইলো কিছুই বললো না। গালিব সাহেব বললেন,
"জীবনটা খুব সুন্দর। এই সৌন্দর্যের পিছনে সুখ দুঃখ দুটোই আছে। দুঃখ গুলোকে চেপে সুখ গুলোকে প্রকাশ করতে পারলেই তুমি সুখী। আজ যদি তুমি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত বাতিল করে সামনে আগাও তবে আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি কম হলেও একশোটা সময় তুমি রিয়ালাইজ করবে যে আত্মহত্যা না করে ভালো করেছো। আত্মহত্যা করলে জীবনের এই সুন্দর মুহুর্তটার সম্মুখীন হতে পারতেনা। আমি যেদিন বাবা হলাম। সন্তান কোলে নেয়ার পর আমি দুই রাকাত নামায পড়েছি। এই জন্য না যে আমার সন্তান হয়েছে। বরং এই জন্য যে আমি সেদিন আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসতে পেরেছি। নাহলে বাবা হওয়ার মতো চমৎকার অনুভূতি পেতাম না। নিশ্চয়ই সেটি সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ অনুভূতি। তুমি আজ যদি আত্মহত্যা সিদ্ধান্ত বাতিল কাল কাল তোমার সামনে হাজারো সুন্দর মুহুর্তে এসে দাঁড়াবে যা দেখে তুমি আজকের দিন নিয়ে আফসোস করবে। শরীরে আগুনের আঁচ লাগলে মানুষ আগুনে ঝাপ দেয় না,বরং আগুন থেকে সরে আসে। তেমনি তুমি জীবনে সামান্যতম সমস্যার সম্মুখীন হয়ে জীবনটাকে শেষ করে দিও না। সমস্যা সমাধান করে ভালো পথে সরে আসো। সমস্যাটাকে বুড়ো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দাও, তোমার মতো সমস্যাকে ফেস করার ক্ষমতা রাখে মিহিকা। দেখবে নিজের বিজয় নিজেই দেখতে পাচ্ছো। "

মিহিকা ঝিম মেরে বসে আছে। গালিব সাহেব তা দেখে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মনে মনে বললেন,আজকালকার ছেলেমেয়েরা বড্ড অবুঝ,হয়তো স্বার্থপর।
গালিব সাহেব আরো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পকেট থেকে ফোন বের করলেন। স্ক্রিন অন করে কিছু একটা দেখলেন। তারপর ফোন থেকে চোখ উঠিয়ে মিহিকাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
"তোমার মা বা বাবার নাম্বারটা দাও তো?"
মিহিকা চমকে তাকালো। আংকেল বাবা মায়ের নাম্বার চাইছে কেনো! তাদের কি জানিয়ে দিবে? এ ভেবেই প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে বলল,
"কেনো! তাদের নাম্বার দিয়ে আপনি কি করবেন? "
"কথা বলবো। "
গালিব সাহেবের কন্ঠ স্বাভাবিক। মিহিকা ভীত কন্ঠে বলল,
"কি বলবেন?"
"এই যে তুমি সুইসাইড করতে যাচ্ছো তা।"
মিহিকা জোর গলায় বলল,
"না না আমি আপনাকে নাম্বার দিবো না। আপনি তাদের জানিয়ে দিলে তারা কষ্ট পাবে। খুব ভেঙে পড়বে। বাবা হার্টের রোগী, এট্যাক করে বসবে। "
গালিব সাহেব হেসে বললেন,
"বাহ! মা বাবা জন্য খুব চিন্তা তোমার। তারা কষ্ট পাবে তাই তাদের সুইসাইডের খবর জানাতে চাইছো না। বাবার হার্ট অ্যাটাক এর চিন্তা আছে। বাবা মায়ের ক্ষতি চাইছো না অথচ নিজে মৃত্যু পথ বেছে নিয়ে তাদের ক্ষতির সাগরে ডুবাতে চাইছো! তোমার এই চিন্তা তখন কোথায় ছিলো। একবারো ভাবলেনা মা বাবার কথা! আজ তুমি সুইসাইড করলে কাল তারা যখন তোমার মৃত্যুর খবর শুনবে, তোমার লাশ দেখবে তখন তাদের কি অবস্থা হবে? হার্টের রুগী তোমার বাবা আদরের মেয়ের লাশ দেখে সহ্য করতে পারবে? একটা সত্য কথা কি জানো মিহিকা? ইয়াং জেনারেশন যারা প্রেমঘটিত কারণে বা ছোটখাটো কারণে সুইসাইড করে তাদের মৃত্যুর আগে যদি বলা হয় তুমি সুইসাইড তোমার বাবা মায়ের চোখের সামনে করো। তোমার বাবা মা থাকবে শিকলে আবদ্ধ। চাইলে তোমাকে বাচাতে পারবেনা। তবুও তারা বাবা মায়ের সামনে সুইসাইড করতে পারবেনা। বাবা মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে গলায় দড়ি দিতে পারবে না। সিদ্ধান্ত বাতিল করবে। তার কারণ কি জানো? তখন তারা বাবা মায়ের চোখ কষ্টমাখা মুখ দেখে সহ্য করতে পারবে না। নিজের ক্ষতি করতে গিয়ে বাবা মায়ের ক্ষতি হতে দিতে পারবে না। নিজের কারণে বাবা মাকে শিকলে আবদ্ধ হতে দেখতে পারবে না। তারা বদ্ধ রুমে সবার আড়ালেই আত্মহত্যা করে। কিন্তু তারা হয়তো ভাবেই না যে তারা নিজেকে কষ্ট থেকে মুক্ত করতে গিয়ে বাবা মাকে কতটা কষ্টের সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সুইসাইড করার আগে যদি সবাই একবার প্রিয়জন হারা পরিবারের আর্তনাদ শুনতো,দেখতো তবে কখনোই সুইসাইড করতো না। তারা যদি সুইসাইড করারা আগে কয়েকঘন্টার জন্য মৃত্যুর ভান করে থাকতো তবে দেখতে পেতো তাদের মৃত্যুতে সবার অনুভূতি। তখন সে মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নেয়ায় নিজেকেই ধিক্কার দিতো। যাক গে, মিহিকা তুমি মৃত্যুর আগে শেষ বারের মতো বাবা মায়ের সাথে কথা বলবে না?"

মাথা নাড়লো মিহিকা। গালিব সাহেব বললেন,
"সাহস নেই তো! আচ্ছা মৃত্যুর কথা বলা লাগবে না। জাস্ট তুমি কল দিয়ে তাদের কন্ঠস্বর শুনবা। জাস্ট কন্ঠস্বর। আমি ও কিছু বলবো না প্রমিজ।"

কি ভেবে যেন মিহিকা রাজি হলো। বিছানা থেকে ফোন নিয়ে কন্টাক্ট লিস্টে সবার উপরের "মা" নামে সেভ করা নাম্বারটা ডায়াল করলো। রাত তখন সাড়ে তিনটা। মিহিকার সময়ের দিকে কোন খেয়াল নেই। সে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। একবার বাজলো ধরলো না। মিহিকা আবার দিলো। দুবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হলো। অপাশ থেকে ভেসে আসলো ঘুমজড়ানো এক নারী কন্ঠ,
"হ্যালো..
মায়ের কন্ঠটা শুনতেই রাজ্যের পানি এসে ভর করলো মিহিকার চোখে। মিহিকা ঠোঁট কামড়ে পানি আটকালো। চুপচাপ মা নামটার দিকে তাকিয়ে রইলো। মিহিকার নিরবরতায় অপাশের কন্ঠটা এবার উদ্ধিগ্নতায় ভরে গেলো,
" মিহি, মিহি আছিস তুই? এত রাতে কল দিলি? তুই ঠিক আছিস? কথা বলছিস না কেনো?"

মায়ের এমন চিন্তা দেখে মিহিকা এবার আর নিজের কান্না চেপে রাখতে পারলো না। শব্দ করে কেঁদে দিলো। মিহিকার কান্নায় মিহিকার মা ভড়কে গেলেন। হাক চেঁকিয়ে বললেন,
"মিহি কাঁদছিস কেনো! মিহি কি হয়েছে?বল কি হয়েছে? তুই ঠিক আছিস? কোথায় আছিস?"
উত্তরে মিহিকা কেঁদেই যাচ্ছে। এতদিনের জমানো সব কষ্ট যেন আজ মায়ের কাছে প্রকাশ করছে। ওদিক থেকে মিহিকার মায়ের কান্নাভেজা চিন্তিত গলা শুনা যাচ্ছে। তিনি চিৎকার করছে। তার মনে হচ্ছে তার মেয়ে কোন বিপদে আছে। খানিক পরেই অপাশে নারী কন্ঠের বদলে পুরুষ কন্ঠ শুনা গেলো।
"মামুনি কি হয়েছে তোমার?কোথায় আছো তুমি? বলো আমরা আসছি।"
মিহিকা বাবা বলে আবারো কেঁদে দিলো। এবার ফোনের অপাশে। মিহিকার বাবার কন্ঠটাও কেঁপে উঠলো। তিনি বারবার বলতে লাগলেন,
"তুমি কোথায় আছো? বাসায় আছো?"

কান্নাভেজা গলায় বলল,
"হু।"
"ওকে আমরা আসছি। কান্না করো না। একটু সময় দাও আমাদের আসছি আমরা। আর তোমার বান্ধবীকে ফোনটা দাও।"
হুট করেই গালিব সাহেব মিহিকার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিলো। মিহিকা আহত কন্ঠে গালিব সাহেবের দিকে তাকালো। গালিব সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
" তুমি সামান্য কেঁদেছো বলে তারা এমন করছে। ভেবে দেখো তোমার লাশ দেখলে তারা কেমন করবে! আর
আমি কিন্তু তোমার বাবা মায়ের কন্ঠস্বর শুনতে বলেছিলাম। অন্য কিছু না। তবে তুমি তাদের কাছে কান্না করে আসতে বাধ্য করছো কেনো! তারা আসলে তুমি সুইসাইড করবে কিভাবে! সুইসাইড করবে তারা এসে তোমার লাশ দেখবে?"

মিহিকা ডুকরে কেঁদে উঠলো। গালিব সাহেব বললেন,
"একি ফোনটা যদি তুমি শ্রাবনকে করো তবে সে বিরক্ত হয়ে তোমাকে গালাগাল দিবে। যদিও তুমি তার জন্যই মরতে যাচ্ছো। কিন্তু তোমার সামান্য কান্না শুনে যাদের চোখের ঘুম উড়ে গেলো তারা তোমার বাবা মা। তোমার চিন্তায় যারা মগ্ন তারা তোমার বাবা মা। তোমার চোখের পানি যাদের সহ্য হয় না তারা তোমার বাবা মা। তোমার মুখে হাসি ফুটাতে যারা সব করতে পারেন তারা তোমার বাবা মা। তোমার বিপদে রাত দিন চিন্তা না করে শত মাইল পাড়ি দিতে পারেন তারা তোমার বাবা মা। তুমি যাদের অনুভূতি আর পৃথিবী জুড়ে আছো তারা তোমার বাবা মা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যাদের পৃথিবী জুড়ে তোমার বাস। সেই তোমার পৃথিবী জুড়ে তাদের চিহ্ন নেই,তাদের জন্য ভালোবাসা নেই,তাদের জন্য চিন্তা নেই। তুমি দুইদিনের ভালোবাসার জন্য তাদের কথা ভুলে মরতে দুবার ভাবো না। তোমার কাছে শ্রাবনই সব, শ্রাবনের ভালোবাসাই সব। বাবা মায়ের ভালোবাসার কোন মূল্য নেই। মূল্য থাকবে কিভাবে তুমি তো তাদের ভালোইবাসো না। তুমি....

গালিব সাহেবকে থামিয়ে মিহিকা উঁচু গলায় বলল,
" আমি মা বাবাকে ভালোবাসি। ভীষন ভালোবাসি। শ্রাবন থেকেও বেশি।"

"এই তোমার ভালোবাসা! ভালোবাসলে মা বাবাকে কষ্ট দিয়ে আত্মহত্যা করবে কিভাবে!"
"করবো না। আমি মা বাবাকে কষ্ট দিতে পারবো না। এতকাল বুঝিনি। এখন বুঝেছি পৃথিবীতে যদি কেউ নিঃস্বার্থ ভালোবেসে থাকে তবে তারা হলো মা বাবা।"

গালিব সাহেব মুচকি হাসলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে মিহিকার কাছে গেলেন। মিহিকার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
" আমি চলে যাচ্ছি। সুইসাইড করা না করাটা তোমার উপর ছেড়ে দিলাম। তবে বলবো, এতকাল নিজের অনুভুতির মূল্য দিয়ে বেঁচেছো এবার না হয় অন্যের অনুভূতির মূল্য দিলে! মা বাবা এবং যারা তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী তাদের অনুভূতির মূল্য দাও। ঘুরে দাঁড়াও। আজ তুমি মারা গেলে শ্রাবনের কিছু আসবে যাবে না। বরং সে তোমার সাথে প্রতারণা করে সুখে থাকবে। আজকাল প্রতারকরক সুখে থাকে। সে সুখে থাকতে পারলে তুমি ও পারবে। তুমি ঘুরে দাঁড়াও নিজেকে শক্ত করো। নিজেকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলে শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাও। আর তাকে দেখিয়ে দাও, তুমি নয় সে তোমার যোগ্য নয়। তুমি আমার লাইফ থেকে চলে যাওয়ার কারণ আমার অযোগ্যতা নয় তোমার অযোগ্যতা। আমি তোমার চেয়ে ব্যাটার কিছু ডিজার্ব করি বলেই তুমি আমার জীবন থেকে চলে গেছো। তুমি নিজেকে মেরে নয় নিজেকে শক্ত করে তার মুখোমুখি হয়ে তাকে জবাব দাও। আমার বিশ্বাস তুমি পারবে। জীবনটা অনেক সুন্দর, জীবনের সৌন্দর্য উপভোগ করো। মিছে মায়ায় পড়ে ধ্বংস করো না। আর হ্যাঁ আমার জীবনের অনেক গোপন কথাই আজ তোমায় বলেছি যা আর কাউকে বলি নি। বেঁচে থাকলে কাউকে বলো না।"

গালিব সাহেব যাবার জন্য পা বাড়ালেন। তিনি মিহিকাকে একা ছেড়ে দিলেন। মেয়েটা ভাবুক,একটা সমাধানে আসুক। তবে যে টুকু বুঝিয়েছে সে টুকুতে কাজ হবে বলে তার আশা। বারান্দার দরজায় গিয়ে থেমে গিয়ে মিহিকা ডাকলেন। মিহিকা তখনো নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে। গালিব সাহেবের ডাকে মিহিকা তার দিকে তাকালো। গালিব সাহেব হেসে বললেন,
"কালো রাত অনেকটা কেটে গেছে। একটা সুন্দর সকাল তোমার অপেক্ষায় আছে। সে চাইছে তুমি তাকে উপভোগ করো। সে তোমার জীবনটাকে তার আলোয় আলোকিত করে দিবে। দুঃখ গুলো গুছিয়ে দিবে। তার আক্ষেপ উপেক্ষা করো না এটা আমার অনুরোধ।"

গালিব সাহেব যেভাবে এসেছিলেন যেভাবেই দেয়াল টপকে চলে গেলেন। রুমে যেতে গিয়ে ও গেলেন না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন। দৃষ্টি তার পাশের বারান্দার দরজা বরবার বসা মিহিকার দিকে। তিনি অপেক্ষা করছেন তার দেয়া জ্ঞান নামক মেডিসিম কেমন কাজ করছে তা দেখার। তার মেডিসিন কাজ করলো ঘন্টাখানেক পর। গালিব সাহেব দেখলেন মিহিকা চোখ মুছতেছে আর সিলিংয়ে আটকানো দড়ি খুলছে। গালিব সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। যাক তবে দেয়াল টপকে ওখানে যাওয়া আর নিজেকের জীবন কাহিনি বলা সার্থক হলো। গালিব সাহেব মুচকি হেসে ঘরে প্রবেশ করলেন।

পরিচিত লোক থাকায় সব ফর্মালিটি পূরণ করে ইমার্জেন্সিতে ভোরের ফ্লাইটে রাজশাহী চলে এলেন মিহিকার বাবা মা। মিহিকার ফ্ল্যাটে যখন আসলে তখন সবে চারদিক আলো ফুটতে শুরু করেছে। মেয়েকে সহি সালামত দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তারা। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে হাজার চুমুতে ভরিয়ে দিলেন তারা। মিহিকা মা বাবা দুজনকেই জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলো। আর বলল,
"সরি। আর খুব ভালোবাসি তোমাদের। কখনো কষ্ট দিবো না। কখনো না।"

সেই সাথে শুরু হলো নতুন একটা সকাল। মিহিকা বাবা মায়ের মাঝে বসে সুন্দর সকালটা উপভোগ করছে। আর খানিক পর পর রাতের সিদ্ধান্তের জন্য আফসোস করছে। আর গালিব সাহেবকে ধন্যবাদ দিচ্ছে সেই সাথে সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য নিজেকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। ভাগ্যিস আত্মহত্যা করি নি। করলে এত সুন্দর একটা সকাল আসতো আমার জীবনে! হয়তো এই সুন্দর সকাল থেকেই আমার জীবনের সৌন্দর্য শুরু হয়েছে। এসব ভাবতেই ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠছে।

(সমাপ্ত)
 
আত্মহত্যা মহা পাপ। এটা কোনো সমস্যা সমাধানের পথ নয়।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top