Tyrion Lannister
Member
"দড়ি বাধাও প্রায় শেষ। মিনিট খানিক পরই তুমি গলায় দড়ি দিবে। আচ্ছা কি ভেবে মরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে জানতে পারি?"
গলায় ফাঁস দেয়ার জন্য সিলিংয়ের সাথে দড়ি বাধার সময় কারো কথা শুনে ঘুরে তাকালো মিহিকা। খানিক আগে আসা গলার স্বর অনুসরণ করে বারান্দার দরজায় তাকালো। দেখলো বারান্দার দরজায় এক বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে আছে।লোকটাকে চিনে না মিহিকা। এতরাতে কোন আগন্তুককে তার ঘরে দেখে অন্যসময় হলে চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় করতো। কিন্তু আজ মন ভালো নেই, আর চিল্লানোর মুডে নেই তাই শুধু ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন বোধক দৃষ্টিতে আগন্তুকের দিকে তাকালো। যার অর্থ আপনি কে? এখানে এসেছেন কেনো! আর কিভাবে এসেছেন!
আগন্তুক মিহিকার ভ্রু কুঁচকানো দেখে মুচকি হাসলেন। হেসে বললেন,
"আমি গালিব, আহমেদ গালিব। সামনের বিল্ডিংয়ের চতুর্থ তলার দক্ষিণ কর্ণারের ফ্ল্যাটটা থাকি। আমি তোমার প্রতিবেশী ।"
আগন্তুকের কথায় বেশ বিরক্ত হলো মিহিকা। কাঁন্নার কারণে রক্তবর্ণ হওয়া চেহারায় একরাশ বিরক্তি ঢেলে আহমেদ গালিবের দিকে তাকালো। গালিব সাহেব মিহিকার চেহারা পড়ে নিয়ে বললেন,
"তো আমি কি করবো, এটাই ভাবনা তাই তো?"
উত্তরে কিছু না বলে ভাবলেশহীন ভাবে তাকালো মিহিকা। গালিব সাহেব আবারো বললেন,
"আসলে তোমার বয়সী আমার একটা মেয়ে আছে। নাম রুফাইদা। রুফাইদা আর ওর মা আজ বিকেলে রুফাইদার নানুর বাসায় গেছে। বাসায় আমি একা। অফিস থেকে ফিরেছি খানিক আগেই। এসে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় এসেছিলাম সিগারেট খেতে। তখনি সামনের বারান্দা দিয়ে তোমার রুমে চোখ গেলো। দেখলাম বারান্দা বরাবর খাটে তুমি বসে আছো। আমি ভাবলাম প্রতিদিন তো রুফাইদার সাথে গল্প করি, আজ যেহেতু ও নেই তাই তোমার সাথে গল্প করা যাবে। এই ভেবেই বারান্দায় টপকে তোমার বারান্দায় চলে এসেছি। এসে দেখি তুমি সুইসাইড করার প্রস্তুতি নিচ্ছো। ভাবছিলাম ফিরে যাবো। পরে আবার ভাবলাম, আসলাম যখন মেয়েটার সুইসাইডের পিছনের গল্পটা শুনে যাই। "
মিহিকা এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো গালিব সাহেবের দিকে। রাত বারোটায় কোত্থেকে বাবার বয়সী লোক বারান্দা টপকে তার ফ্ল্যাটে হাজির হয়েছে । এসে বলছে কিনা সুইসাইডের পিছনের গল্পটা শুনতে এসেছে! এ কি পাগল নাকি এলিয়েন! তবে দেখে তো তেমন মনে হচ্ছে না। বরং বেশ ভদ্রলোক মনে হচ্ছে।
বয়স কত হবে? পঞ্চাশ কি বায়ান্ন?
পরনে তার ধসূর পতুয়া, আর কালো টাউজার। গায়ের রং তামাটে। চতুর্ভুজাকৃতির চোয়ালে কাচা পাকা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, কালো মনির চোখ দুটোর উপর চতুর্ভুজাকৃতির ফ্রেমলেস চশমা। হাতের তর্জনী আর মধ্যমার মাঝে আধখাওয়া একটা সিগারেট। তবে রুমে আসার পর থেকে সিগারেট হাতেই শোভা পাচ্ছে, তা আর মুখ অব্দি এগুচ্ছে না। হয়তো মেয়ের বয়সী কারো সামনে খেতে চাচ্ছে না। তার চোখে সচ্চ চাহনী, দুষ্টু লোক হলে তার চোখে লালসা কিংবা ভয়ানক চাহনি থাকতো। যা এই লোকের নেই।
মিহিকা নাক টেনে গালে লেগে থাকা নোনাজল হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে গালিব সাহেবের দিকে রক্তরাঙা চোখে তাকালো। তারপর রাগত স্বরে বলল,
"কেনো এসেছেন এখানে? কে পাঠিয়েছে আপনাকে? নিশ্চয়ই ওই তিথি পাঠিয়েছে! তবে যেই পাঠাক না কেনো আপনি চলে যান এখান থেকে। আমাকে শান্তিমতো মরতে দিন। না হলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।"
বলে দড়ি ঠিক করতে শুরু করল মিহিকা। গালিব সাহেব এবারো হাসলেন। বললেন,
"ওকে আমি চলে যাবো। কোন ডিস্টার্ব করবো না তোমাকে। তোমার জীবনের শেষ দশ মিনিট আমাকে দাও। আমার সাথে খানিক গল্প করো। দশমিনিট শেষ হলে আমি চলে যাবো।"
ডিপ্রেশনের প্রভাবে আজকাল মুড সুইং করছে মিহিকার। হুটহাট যার তার উপর চওড়া হওয়া যেন স্বভাবে পরিণত হয়েছে। আজ ও তার ব্যাতিক্রম হলো। গালিব সাহেবের কথায় মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল মিহিকার। এমনিতেই মনটা ভেঙে চুরে খান খান হয়ে গেছে। অসহ্য যন্ত্রণায় আর হৃদবিষাদে চটপট করছে দিন পনেরো যাবত । আর যেন সহ্য হচ্ছে না। কোথায় ভেবেছিলো জীবন নামক ডায়েরিটা নিজ হাতে বন্ধ করে ওপারে পাড়ি জমাবে। মুক্তি পাবে এই যন্ত্রণা থেকে। কিন্তু হলো কি! কোত্থেকে এক বুড়ো লোক এসে তাকে কিসব উদ্ভট কথা বলছে! এক যন্ত্রণা শেষ করতে গিয়ে আরেক যন্ত্রণার সম্মুখীন হলো সে। এ যে মরতে গিয়েও শান্তি নেই! নাহ, এত ভাবলে হবে না। আমাকে মরতে হবে। প্রথমে এই বুড়োকে ভাগাতে হবে তারপর গলায় দড়ি দিতে হবে। এই ভেবেই রাগী গলায় বলল,
"দশমিনিট না আর এক মিনিট যদি আপনি এখানে থাকেন তবে আমি চেঁচিয়ে লোক জড়ো করবো। এই মুহুর্তে চলে যান আমার ফ্ল্যাট থেকে। আমাকে কোন বাধা দিবেন না, ভালো হবে না। "
মিহিকার রাগ দেখে এবার শব্দ করেই হাসলেন গালিব সাহেব। হাসতে হাসতে বললেন,
"তুমি রুফাইদার বয়সী। তাই আমি তোমাকে মেয়ের চোখেই দেখছি। তুমি আমাকে আংকেল ডাকতে পারো। আর হ্যাঁ, এখন তুমি চেঁচিয়ে লোক জড়ো করলে তোমারই ক্ষতি হবে। আমার কিছুই হবে না। আমি তো খোলা বারান্দার রেলিং টপকে চলে যাবো নিজের ফ্ল্যাটে । আমি নিয়মিত ব্যায়াম করি। তাই বয়স হলে ও শরীর ফিট আছে, পালাতে মিনিট খানেক লাগবে। কেউ খুঁজে পাবে না আমাকে। তা ছাড়া তোমার কাছে কোন প্রমাণ নেই যে আমি এখানে এসেছি। সুতারাং মা বলি কি? লোক ডেকে নিজের ক্ষতি না করে আমার সাথে মিনিট দশেক গল্প করো তাতেই হবে।"
গালিব সাহেবের কথা শুনে মিহিকা ভ্রু কুঁচকে বলল,
"লোক জড়ো করলে আমার কি ক্ষতি হবে?"
"এই যে তুমি লোক ডাকবে, আশেপাশের ফ্ল্যাট থেকে তোমার চিৎকার শুনে মানুষ ফ্ল্যাটের বাইরে জড়ো হবে। তারপর তারা সবাই মিলে মালিক সমিতিকে কল করবে, তারা এসে ডুপ্লিকেট চাবি কিংবা দরজা ভেঙে ভিতরে ডুকবে। তারপর তুমি তাদের সব ঘটনা খুলে বলবে। তারা আমাকে খুঁজবে, কেউ কেউ তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। এতসবের মাঝে রাত কেটে যাবে, তোমার সুইসাইড করা আর হবে না। তারচেয়ে বরং আমাকে তোমার সুইসাইড এর পিছনে গল্পটা বলো,আমি চলে যাবো। তারপর তুমি শান্তিমতো সুইসাইড করতে পারবে।"
শান্ত কন্ঠে বললেন গালিব সাহেব। গালিব সাহেবের কথা শুনে মিহিকা খানিক ভাবলো। তারপর বললো,
"সত্যিই আপনি চলে যাবেন তো! কোন বাধা দিবেন না তো!"
"নাহ, আমি কোনপ্রকার বাধা দিবো না। কাউকে এই ব্যাপারে বলবো ও না। "
"সত্যিই?"
অনেকটা বাচ্চাদের মতো করে বললো মিহিকা। গালিব সাহেব হেসে সায় জানালেন। মিহিকা খাটের পাশ ঘেঁষে সাদা আর অরেঞ্জ কম্বিনেশনের টাইলসের ফ্লোরে বসে পড়লো। তারপর হাটুতে থিতুনী রাখলো। মিহিকাকে বসতে দেখে গালিব সাহেব বারান্দা দিয়ে সিগারেট ফেলে দিয়ে মিহিকা থেকে কয়েকগজ দূরে থাকা একটা বিনব্যাগে বসে পড়লেন। তারপর বললেন,
"এবার তোমার গল্প স্টার্ট করো। আমি কিন্তু রুফাইদার সাথে একদম ফ্রি। বাবা মেয়ে নয়, ফ্রেন্ডটাইপ সম্পর্ক আমাদের । তুমি নিজেকে রুফাইদার জায়গায় রেখে সহজভাবে আমাকে সব বলতে পারো। "
মিহিকা ভাবলেশহীন ভাবে গালিব সাহেবের কথা শুনলো। তারপর আনমনে বলতে শুরু করলো,
"আমি মিহিকা, মাইসা রহমান মিহিকা। সবাই মিহি বলেই ডাকে। রাবিতে কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়ছি। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা যমুনা ব্যাংক ঢাকা শাখার কর্মরত একজন ব্যাংকার। মা গৃহিনী। বাবা মাকে নিয়ে ঢাকাতেই থাকেন। আমিও ঢাকা থাকতাম বাবা মায়ের সাথে। কিন্তু এইচএসসির পর রাবিতে চান্স পেয়ে পরিবার ছেড়ে রাজশাহী চলে আসি। থাকার জন্য বাবা এই ফ্ল্যাট কিনে দেন। আমি এখানে থাকতে শুরু করি। মা বাবা আর শ্রাবণকে ছেড়ে এতদূর এসে থাকতে প্রথমে খুব কষ্ট হতো। কিন্তু মাস তিনেকের মাঝে অবশ্য নিজেকে মানিয়ে নিই।"
"শ্রাবণ কে?"
কথার মাঝে ফোঁড়ন কাটেন গালিব সাহেব। মিহিকা শান্ত ভঙ্গিতে বলে,
"শ্রাবণ, আমার প্রথম ভালোবাসা। বর্ষার এক বিকেলে ঝুম বৃষ্টিতে বাস স্টপে তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছে। তখন আমি সবে ক্লাস টেনে পড়ি। প্রাইভেট শেষে কাক ভেজা হয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি৷ শ্রাবন তখন এইচএসসি দিবে। সেও প্রাইভেট পড়ে বাসায় ফেরার তাড়ায় বাস স্টপে দাঁড়িয়ে ছিলো। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে আমার চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিলো। মাইগ্রেনের সমস্যাটা তখন প্রবল ছিলো। চশমা ছাড়া একবারেই চলতে পারতাম না। তাই আমি চশমার কাঁচ মুছার জন্য টিস্যু খুঁজছিলাম। ব্যাগ থেকে টিস্যুর প্যাকেট বের করে দেখি টিস্যু আমার মতো কাকভেজা হয়ে গেছে। এদিক ওদিকে দোকান খুঁজছিলাম। শ্রাবণ হয়তো ব্যাপারটা খেয়াল করেছিলো। সে তার পকেট থেকে একটা টিস্যুর প্যাকেট এগিয়ে দিলো। তার সেই উপকারের পর সৌজন্যে মূলক পরিচয় , তারপর আলাপ, তারপর প্রেম। শ্রাবণের হাত ধরে পার করলাম চারটি শ্রাবণ। সময়গুলো বেশ ভালোই ছিলো। মাস কয়েক আগেই শুরু হলো সমস্যা। সেই সমস্যাই আমাকে এই দড়ির মুখে দাঁড় করিয়েছে।
গলায় ফাঁস দেয়ার জন্য সিলিংয়ের সাথে দড়ি বাধার সময় কারো কথা শুনে ঘুরে তাকালো মিহিকা। খানিক আগে আসা গলার স্বর অনুসরণ করে বারান্দার দরজায় তাকালো। দেখলো বারান্দার দরজায় এক বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে আছে।লোকটাকে চিনে না মিহিকা। এতরাতে কোন আগন্তুককে তার ঘরে দেখে অন্যসময় হলে চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় করতো। কিন্তু আজ মন ভালো নেই, আর চিল্লানোর মুডে নেই তাই শুধু ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন বোধক দৃষ্টিতে আগন্তুকের দিকে তাকালো। যার অর্থ আপনি কে? এখানে এসেছেন কেনো! আর কিভাবে এসেছেন!
আগন্তুক মিহিকার ভ্রু কুঁচকানো দেখে মুচকি হাসলেন। হেসে বললেন,
"আমি গালিব, আহমেদ গালিব। সামনের বিল্ডিংয়ের চতুর্থ তলার দক্ষিণ কর্ণারের ফ্ল্যাটটা থাকি। আমি তোমার প্রতিবেশী ।"
আগন্তুকের কথায় বেশ বিরক্ত হলো মিহিকা। কাঁন্নার কারণে রক্তবর্ণ হওয়া চেহারায় একরাশ বিরক্তি ঢেলে আহমেদ গালিবের দিকে তাকালো। গালিব সাহেব মিহিকার চেহারা পড়ে নিয়ে বললেন,
"তো আমি কি করবো, এটাই ভাবনা তাই তো?"
উত্তরে কিছু না বলে ভাবলেশহীন ভাবে তাকালো মিহিকা। গালিব সাহেব আবারো বললেন,
"আসলে তোমার বয়সী আমার একটা মেয়ে আছে। নাম রুফাইদা। রুফাইদা আর ওর মা আজ বিকেলে রুফাইদার নানুর বাসায় গেছে। বাসায় আমি একা। অফিস থেকে ফিরেছি খানিক আগেই। এসে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় এসেছিলাম সিগারেট খেতে। তখনি সামনের বারান্দা দিয়ে তোমার রুমে চোখ গেলো। দেখলাম বারান্দা বরাবর খাটে তুমি বসে আছো। আমি ভাবলাম প্রতিদিন তো রুফাইদার সাথে গল্প করি, আজ যেহেতু ও নেই তাই তোমার সাথে গল্প করা যাবে। এই ভেবেই বারান্দায় টপকে তোমার বারান্দায় চলে এসেছি। এসে দেখি তুমি সুইসাইড করার প্রস্তুতি নিচ্ছো। ভাবছিলাম ফিরে যাবো। পরে আবার ভাবলাম, আসলাম যখন মেয়েটার সুইসাইডের পিছনের গল্পটা শুনে যাই। "
মিহিকা এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো গালিব সাহেবের দিকে। রাত বারোটায় কোত্থেকে বাবার বয়সী লোক বারান্দা টপকে তার ফ্ল্যাটে হাজির হয়েছে । এসে বলছে কিনা সুইসাইডের পিছনের গল্পটা শুনতে এসেছে! এ কি পাগল নাকি এলিয়েন! তবে দেখে তো তেমন মনে হচ্ছে না। বরং বেশ ভদ্রলোক মনে হচ্ছে।
বয়স কত হবে? পঞ্চাশ কি বায়ান্ন?
পরনে তার ধসূর পতুয়া, আর কালো টাউজার। গায়ের রং তামাটে। চতুর্ভুজাকৃতির চোয়ালে কাচা পাকা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, কালো মনির চোখ দুটোর উপর চতুর্ভুজাকৃতির ফ্রেমলেস চশমা। হাতের তর্জনী আর মধ্যমার মাঝে আধখাওয়া একটা সিগারেট। তবে রুমে আসার পর থেকে সিগারেট হাতেই শোভা পাচ্ছে, তা আর মুখ অব্দি এগুচ্ছে না। হয়তো মেয়ের বয়সী কারো সামনে খেতে চাচ্ছে না। তার চোখে সচ্চ চাহনী, দুষ্টু লোক হলে তার চোখে লালসা কিংবা ভয়ানক চাহনি থাকতো। যা এই লোকের নেই।
মিহিকা নাক টেনে গালে লেগে থাকা নোনাজল হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে গালিব সাহেবের দিকে রক্তরাঙা চোখে তাকালো। তারপর রাগত স্বরে বলল,
"কেনো এসেছেন এখানে? কে পাঠিয়েছে আপনাকে? নিশ্চয়ই ওই তিথি পাঠিয়েছে! তবে যেই পাঠাক না কেনো আপনি চলে যান এখান থেকে। আমাকে শান্তিমতো মরতে দিন। না হলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।"
বলে দড়ি ঠিক করতে শুরু করল মিহিকা। গালিব সাহেব এবারো হাসলেন। বললেন,
"ওকে আমি চলে যাবো। কোন ডিস্টার্ব করবো না তোমাকে। তোমার জীবনের শেষ দশ মিনিট আমাকে দাও। আমার সাথে খানিক গল্প করো। দশমিনিট শেষ হলে আমি চলে যাবো।"
ডিপ্রেশনের প্রভাবে আজকাল মুড সুইং করছে মিহিকার। হুটহাট যার তার উপর চওড়া হওয়া যেন স্বভাবে পরিণত হয়েছে। আজ ও তার ব্যাতিক্রম হলো। গালিব সাহেবের কথায় মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল মিহিকার। এমনিতেই মনটা ভেঙে চুরে খান খান হয়ে গেছে। অসহ্য যন্ত্রণায় আর হৃদবিষাদে চটপট করছে দিন পনেরো যাবত । আর যেন সহ্য হচ্ছে না। কোথায় ভেবেছিলো জীবন নামক ডায়েরিটা নিজ হাতে বন্ধ করে ওপারে পাড়ি জমাবে। মুক্তি পাবে এই যন্ত্রণা থেকে। কিন্তু হলো কি! কোত্থেকে এক বুড়ো লোক এসে তাকে কিসব উদ্ভট কথা বলছে! এক যন্ত্রণা শেষ করতে গিয়ে আরেক যন্ত্রণার সম্মুখীন হলো সে। এ যে মরতে গিয়েও শান্তি নেই! নাহ, এত ভাবলে হবে না। আমাকে মরতে হবে। প্রথমে এই বুড়োকে ভাগাতে হবে তারপর গলায় দড়ি দিতে হবে। এই ভেবেই রাগী গলায় বলল,
"দশমিনিট না আর এক মিনিট যদি আপনি এখানে থাকেন তবে আমি চেঁচিয়ে লোক জড়ো করবো। এই মুহুর্তে চলে যান আমার ফ্ল্যাট থেকে। আমাকে কোন বাধা দিবেন না, ভালো হবে না। "
মিহিকার রাগ দেখে এবার শব্দ করেই হাসলেন গালিব সাহেব। হাসতে হাসতে বললেন,
"তুমি রুফাইদার বয়সী। তাই আমি তোমাকে মেয়ের চোখেই দেখছি। তুমি আমাকে আংকেল ডাকতে পারো। আর হ্যাঁ, এখন তুমি চেঁচিয়ে লোক জড়ো করলে তোমারই ক্ষতি হবে। আমার কিছুই হবে না। আমি তো খোলা বারান্দার রেলিং টপকে চলে যাবো নিজের ফ্ল্যাটে । আমি নিয়মিত ব্যায়াম করি। তাই বয়স হলে ও শরীর ফিট আছে, পালাতে মিনিট খানেক লাগবে। কেউ খুঁজে পাবে না আমাকে। তা ছাড়া তোমার কাছে কোন প্রমাণ নেই যে আমি এখানে এসেছি। সুতারাং মা বলি কি? লোক ডেকে নিজের ক্ষতি না করে আমার সাথে মিনিট দশেক গল্প করো তাতেই হবে।"
গালিব সাহেবের কথা শুনে মিহিকা ভ্রু কুঁচকে বলল,
"লোক জড়ো করলে আমার কি ক্ষতি হবে?"
"এই যে তুমি লোক ডাকবে, আশেপাশের ফ্ল্যাট থেকে তোমার চিৎকার শুনে মানুষ ফ্ল্যাটের বাইরে জড়ো হবে। তারপর তারা সবাই মিলে মালিক সমিতিকে কল করবে, তারা এসে ডুপ্লিকেট চাবি কিংবা দরজা ভেঙে ভিতরে ডুকবে। তারপর তুমি তাদের সব ঘটনা খুলে বলবে। তারা আমাকে খুঁজবে, কেউ কেউ তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। এতসবের মাঝে রাত কেটে যাবে, তোমার সুইসাইড করা আর হবে না। তারচেয়ে বরং আমাকে তোমার সুইসাইড এর পিছনে গল্পটা বলো,আমি চলে যাবো। তারপর তুমি শান্তিমতো সুইসাইড করতে পারবে।"
শান্ত কন্ঠে বললেন গালিব সাহেব। গালিব সাহেবের কথা শুনে মিহিকা খানিক ভাবলো। তারপর বললো,
"সত্যিই আপনি চলে যাবেন তো! কোন বাধা দিবেন না তো!"
"নাহ, আমি কোনপ্রকার বাধা দিবো না। কাউকে এই ব্যাপারে বলবো ও না। "
"সত্যিই?"
অনেকটা বাচ্চাদের মতো করে বললো মিহিকা। গালিব সাহেব হেসে সায় জানালেন। মিহিকা খাটের পাশ ঘেঁষে সাদা আর অরেঞ্জ কম্বিনেশনের টাইলসের ফ্লোরে বসে পড়লো। তারপর হাটুতে থিতুনী রাখলো। মিহিকাকে বসতে দেখে গালিব সাহেব বারান্দা দিয়ে সিগারেট ফেলে দিয়ে মিহিকা থেকে কয়েকগজ দূরে থাকা একটা বিনব্যাগে বসে পড়লেন। তারপর বললেন,
"এবার তোমার গল্প স্টার্ট করো। আমি কিন্তু রুফাইদার সাথে একদম ফ্রি। বাবা মেয়ে নয়, ফ্রেন্ডটাইপ সম্পর্ক আমাদের । তুমি নিজেকে রুফাইদার জায়গায় রেখে সহজভাবে আমাকে সব বলতে পারো। "
মিহিকা ভাবলেশহীন ভাবে গালিব সাহেবের কথা শুনলো। তারপর আনমনে বলতে শুরু করলো,
"আমি মিহিকা, মাইসা রহমান মিহিকা। সবাই মিহি বলেই ডাকে। রাবিতে কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়ছি। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা যমুনা ব্যাংক ঢাকা শাখার কর্মরত একজন ব্যাংকার। মা গৃহিনী। বাবা মাকে নিয়ে ঢাকাতেই থাকেন। আমিও ঢাকা থাকতাম বাবা মায়ের সাথে। কিন্তু এইচএসসির পর রাবিতে চান্স পেয়ে পরিবার ছেড়ে রাজশাহী চলে আসি। থাকার জন্য বাবা এই ফ্ল্যাট কিনে দেন। আমি এখানে থাকতে শুরু করি। মা বাবা আর শ্রাবণকে ছেড়ে এতদূর এসে থাকতে প্রথমে খুব কষ্ট হতো। কিন্তু মাস তিনেকের মাঝে অবশ্য নিজেকে মানিয়ে নিই।"
"শ্রাবণ কে?"
কথার মাঝে ফোঁড়ন কাটেন গালিব সাহেব। মিহিকা শান্ত ভঙ্গিতে বলে,
"শ্রাবণ, আমার প্রথম ভালোবাসা। বর্ষার এক বিকেলে ঝুম বৃষ্টিতে বাস স্টপে তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছে। তখন আমি সবে ক্লাস টেনে পড়ি। প্রাইভেট শেষে কাক ভেজা হয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি৷ শ্রাবন তখন এইচএসসি দিবে। সেও প্রাইভেট পড়ে বাসায় ফেরার তাড়ায় বাস স্টপে দাঁড়িয়ে ছিলো। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে আমার চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিলো। মাইগ্রেনের সমস্যাটা তখন প্রবল ছিলো। চশমা ছাড়া একবারেই চলতে পারতাম না। তাই আমি চশমার কাঁচ মুছার জন্য টিস্যু খুঁজছিলাম। ব্যাগ থেকে টিস্যুর প্যাকেট বের করে দেখি টিস্যু আমার মতো কাকভেজা হয়ে গেছে। এদিক ওদিকে দোকান খুঁজছিলাম। শ্রাবণ হয়তো ব্যাপারটা খেয়াল করেছিলো। সে তার পকেট থেকে একটা টিস্যুর প্যাকেট এগিয়ে দিলো। তার সেই উপকারের পর সৌজন্যে মূলক পরিচয় , তারপর আলাপ, তারপর প্রেম। শ্রাবণের হাত ধরে পার করলাম চারটি শ্রাবণ। সময়গুলো বেশ ভালোই ছিলো। মাস কয়েক আগেই শুরু হলো সমস্যা। সেই সমস্যাই আমাকে এই দড়ির মুখে দাঁড় করিয়েছে।