আল্লাহ তাআলা জিন ও ইনসান বানিয়েছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। মানুষকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন প্রতিনিধি হিসেবে। মানুষের কল্যাণ পথে রয়েছে তিনটি বাধাদানকারী শক্তি—জিন শয়তান, মানব শয়তান ও নফস শয়তান। বিষয়টি কোরআন করিমে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তুমি বলো—“আমি আশ্রয় লই মানুষের প্রতিপালক, মানুষের মালিক, মানুষের মাবুদের (আল্লাহর) নিকট, প্ররোচনাদাতা খান্নাসের (শয়তান) অনিষ্ট থেকে; যে মানুষের অন্তরে ওয়াছওয়াছা দেয়। সে জিন হতে এবং মনুষ্য হতে।”’ (সুরা-১১৪ নাস, আয়াত: ১-৬)। ‘আর অবশ্যই আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি এবং আমি জানি তাকে তার নফস যে বিষয়ে প্ররোচনা দেয়।’ (সুরা-৫০ কাফ, আয়াত: ১৬)।
সব মানুষের সঙ্গে শয়তান নিযুক্ত আছে, আর জীবনে-মরণে ও ইহকালে-পরকালে একান্ত সঙ্গী হিসেবে নফস রয়েছে। নফস হলো ষড়্রিপু, যথা কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য। নবী–রাসুল মাসুম বা নিষ্পাপ হওয়ার কারণে তাঁরা শয়তানি কুমন্ত্রণা ও রিপুর তাড়না থেকে মুক্ত। এ ছাড়া যেসব মুমিন মুসলিম শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব ধরনের পাপ থেকে মুক্ত থাকার সৌভাগ্য লাভ করেন, তাঁদের মাদারজাদ (আজন্ম) অলি বলা হয়।
রমাদান মাসে জিন শয়তানকে বন্দী করা হয়। কিন্তু মানুষ শয়তান ও নফস শয়তান তখনো সক্রিয় থাকে। তাই মানুষ পাপাচার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারে না। পাপতাপ থেকে পরিপূর্ণভাবে মুক্তির জন্য প্রথমে ষড়্রিপুর তাড়নামুক্ত হয়ে নফস শয়তানকে পরাভূত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, মনুষ্য শয়তানের প্রভাবমুক্ত হওয়ার জন্য অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করে সৎ সঙ্গ অর্জন করতে হবে। এই দুটি সুসম্পন্ন হলেই জিন শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আত্মরক্ষা করা যাবে।
মানবসত্তা বা রিপুর সমন্বয়ে গঠিত নফসের তিন অবস্থা—নাফসে আম্মারা, নাফসে লাউওয়ামা ও নাফসে মুৎমাইন্না। নাফসে আম্মারা ‘পাপাকৃষ্ট সত্তা’; যে পাপে অনুরক্ত ও পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত। নাফসে লাউওয়ামা ‘অনুতপ্ত সত্তা’; যে শয়তানের ধোঁকায় বা রিপুর তাড়নায় অথবা পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রভাবে সাময়িক পাপ করে এবং লজ্জিত, অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে। অর্থাৎ কখনো পাপে অনুরাগ ও কখনো অনুতাপ হয়। নাফসে মুৎমাইন্না হলো ‘প্রশান্ত আত্মা’; যার পাপের প্রতি বিরাগ এবং নেকির প্রতি অনুরাগ থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতঃপর তাকে তার অসৎ ও সৎ কর্মের জ্ঞান দান করেছেন। সে সফল হলো যে তার নফসকে পবিত্র করেছে; আর সে ব্যর্থ হলো যে নফসকে কলুষিত করেছে।’ (সুরা-৯১ শামস, আয়াত: ৮-১০)। নাজাতের অর্থ হলো ওই সব দোষত্রুটি থেকে নিজেকে মুক্ত ও পবিত্র করা এবং সদ্গুণাবলি অর্জন করে স্থায়ী মুক্তি নিশ্চিত করা, যাতে নাফস মুৎমাইন্না অবস্থা থেকে পুনরায় লাউওয়ামা বা আম্মারার দিকে ফিরে না যায়।
রমাদান মুক্তির মাস; সব ধরনের কলুষতা, মলিনতা, আবিলতা ও পাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করা বা মুক্ত হওয়াই এই মাসে সিয়াম সাধনার মূল উদ্দেশ্য। রমাদান মাসের প্রথম দশক রহমত; দ্বিতীয় দশক মাগফিরাত; শেষ দশক নাজাত। নাজাত মানে মুক্তি, মুক্তি পাওয়া, মুক্তি দেওয়া, মুক্ত হওয়া। রমাদানের শেষ দশকের নাজাতের অর্থ হলো এই দশকে মানুষ পাপ–পঙ্কিলতা, গুনাহ ও আবিলতা থেকে মুক্ত হবে, জাহান্নাম থেকে মুক্ত হবে, পাপের আকর্ষণ থেকে মুক্ত হবে। আল্লাহর আজাব ও গজব থেকে মুক্ত হবে; আসমানি, জমিনি ও রুহানি জিসমানি (আত্মিক শারীরিক) রোগশোক, জরা, ব্যাধি থেকে মুক্ত হবে।
নাজাত বা মোহমুক্তির উপায় হলো তাওবাহ ও ইস্তিগফার করা। তওবা মানে হলো পাপ ছেড়ে পুণ্যে মনোনিবেশ করা। ইস্তিগফার হলো কৃত অপরাধের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং পুনরায় পাপ না করার অঙ্গীকার করা ও দৃঢ়সংকল্প হওয়া।
তাওবাহ ও ইস্তিগফারের চমৎকার একটি মাধ্যম হলো ইতিকাফ। এতে বান্দা দুনিয়ার সব মোহ, মায়া ও আকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে একাত্মভাবে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। আল্লাহ তাআলা কোরআন করিমে বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর দিকে পালিয়ে আসো।’ (সুরা-৫১ জারিয়াত, আয়াত: ৫০)। পাপ থেকে পাপের অকল্যাণ ও অমঙ্গল থেকে, পাপের ভয়ংকর ভয়াবহ মন্দ পরিণতি থেকে, সর্বোপরি পাপের আকর্ষণ ও মোহ থেকে আত্মরক্ষার জন্য এবং মুক্ত হওয়ার জন্যই ইতিকাফ। হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম মহিমান্বিত রজনী শবে কদর প্রাপ্তির জন্য ইতিকাফ। রমাদানের বিশেষ সুন্নতে মুআক্কাদা কিফায়া আমল ইতিকাফ। তাকওয়ার রুদ্ধদ্বার প্রশিক্ষণ ইতিকাফ।
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম