নব্বই দশকের বাণিজ্যিক ছবির পট পরিবর্তনকারী নায়ক নাঈম। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ছবির যে ধারা ছিল তার থেকে নব্বই দশক হতে সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারা শুরু হয়। এই ধারা শুরুর প্রথম নায়ক ছিল নাঈম। তার মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন একটি প্রজন্মের শুরু হয় যারা সেই সময়ের তরুণ প্রজন্মের পছন্দকে প্রতিনিধিত্ব করেছিল। জেনারেশন ডিমান্ড যাকে বলে নাঈম ছিল সেই ধারার প্রথম নায়ক এবং সেই ধারার সেরা আবিষ্কার পরে আসে সালমান শাহ। এভাবেই সম্পূর্ণ নতুন একটি সময় শুরু হয় বাণিজ্যিক ছবিতে।
১৯৯১ সালের ৪ অক্টোবর ‘চাঁদনী’ ছবি মুক্তি পায়। পরিচালক এহতেশাম ছবির নতুন একজোড়া নায়ক-নায়িকা নাঈম-শাবনাজ। নতুন প্রজন্মের নতুন জুটি দেশের তখনকার তরুণ সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ছবির গানগুলো সুপারহিট হয়। শাবনাজের বিপরীতে নাঈমের জুটির জনপ্রিয়তায় একের পর এক ছবি হতে থাকে। ছবির পরিচালক এহতেশাম তাঁদের দুজনেরই আবিষ্কারক।
মূলনাম খাজা নাঈম উদ্দিন মুরাদ। জন্ম ৮ মে, ১৯৭০। নাঈমকে পরিচালক এহতেশাম একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখেন। নাঈমকে দেখে তিনি একজনকে বলেন-‘বাহ, ছেলেটাকে তো সালমান খানের মতো দেখতে লাগছে ডাকো তো কথা বলি।’ প্রথম সাক্ষাতেই চলচ্চিত্রে কাজ করার অফার দেন তিনি। নাঈম মা-বাবার সম্মতির কথা জানায়। পরে পারিবারিকভাবেই তাকে অনুমতি পাইয়ে নেয়া হয়। এহতেশামের সাথে নাঈমের পর পর কয়েকটি ছবি হতে থাকে। শাবনাজের সাথে তার জুটির জনপ্রিয়তার কারণে তার সাথেই ছবি বেশি হয়েছে। নব্বই দশকের শুরুর দিকে নাঈমের মারাত্মক ক্রেজ ছিল বিশেষ করে কলেজ-ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের মধ্যে ছিল। তখন বাংলা ছবির প্রতি মানুষের ভালোবাসা ছিল তাই নতুনদের লুফে নিত।
নাঈম-শাবনাজ জুটি প্রেম থেকে বিয়ে করে ১৯৯৪ সালের ৫ অক্টোবর। তাদের ঘরে দুটি মেয়ে আছে। মেয়েদের মধ্যে একজন গানের সাথে যুক্ত। নাঈম সম্ভবত একমাত্র নায়ক যে ২০টিরও কম ছবিতে অভিনয় করে দেশের চলচ্চিত্রের অপরিহার্য অংশ হয়েছে।
তার ছবিগুলো : চাঁদনী, দিল, অনুতপ্ত, জিদ, সাক্ষাত, টাকার অহংকার, লাভ, ফুল আর কাঁটা, আগুন জ্বলে, বিষের বাঁশি, চোখে চোখে, ঘরে ঘরে যুদ্ধ, সোনিয়া, লড়াই, সুখের আশায়, মেয়েরাও মাস্তান। ন্যারেটর – নীল আঁচল।
নাঈমের সবচেয়ে জনপ্রিয় ছবি অবশ্যই ‘চাঁদনী।’ রোমান্টিক ও ফ্যামিলি ড্রামা বেশি করেছে। শাবনাজের বিপরীতে তার দারুণ রসায়নে রোমান্টিক ছবি বেশি হয়েছে তবে ছবিগুলোতে তাদের রোমান্টিকতার পাশাপাশি পারিবারিক গল্পের প্রাধান্য ছিল। এ জুটির ছবির সংখ্যা ১৩টি। এর মধ্যে বেশিরভাগ ছবিই সুপারহিট ছিল। তরুণ প্রজন্মের আকর্ষণ বেশি ছিল এ জুটির প্রতি তাই ছবি সফল হত। গল্পের দিক থেকে এ জুটির বেস্ট ছবি ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ।’ তাদের জুটির জনপ্রিয়তার পেছনে কালজয়ী গানেরও প্রভাব আছে। শাবনাজ ছাড়া নাঈম মুক্তির বিপরীতে ‘লড়াই’, অন্তরার বিপরীতে ‘সুখের আশায়’ এবং মুনমুনের বিপরীতে ‘মেয়েরাও মাস্তান’ ছবিতে অভিনয় করেছে। ন্যারেটর হিসেবে ছিল ‘নীল আঁচল’ ছবিতে। শাহরুখ খান যেমন ‘সিলসিলে’ মুভিতে ন্যারেট করে মুভির চরিত্রগুলোকে ঠিক ঐ স্টাইলে ‘নীল আঁচল’ ছবিতে নাঈমকে এমন ভূমিকায় দেখা গেছে।
নাঈমের জনপ্রিয় গান :
ও আমার জান তোর বাঁশি যেন – চাঁদনী
কতদিন পরে দেখা হলো দুজনাতে – চাঁদনী
বন্ধুর বাঁশি বাজে রে- চাঁদনী
এলোমেলো বাতাসে উড়িয়েছি শাড়ির আঁচল – আগুন জ্বলে
তুমি এসেছিলে পরশু – অনুতপ্ত
তোমার নাম লিখে দাও – অনুতপ্ত
ওগো মা তুমি শুধু মা – দিল
চোখেতে চোখ রেখে – দিল
তোমায় আপন করে রাখব বলে – দিল
আমি পাগল প্রেমে পাগল – দিল
চোখে চোখে চোখ রেখে – চোখ
বড় মিষ্টি লাগে – চোখে চোখে
আমি আজ তোমাকে ভাবছি – জিদ
ছাড়ব না তোমায় ছাড়ব না – অনুতপ্ত
সুন্দর মেয়ে কাছে এলে – সোনিয়া
আমি জেনেশুনে প্রেমে পড়েছি – সাক্ষাত
নাঈম অভিনেতা হিসেবে দুর্বল। তাকে নায়কই বলা যায়। নায়ক হওয়াটাও সহজ নয়। নায়ক হিসেবে তার অভিনয় চলনসই। মানিয়ে যেত তার চরিত্রগুলোতে। খুব বেশি ভালো অভিনয় বলার মতো ছিল না তবে কিছুটা নেগেটিভ রোলে ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’ ছবিতে বেশ ভালো অভিনয় করেছিল।
নাঈমের বর্তমান সময়ের লুককে দক্ষিণী নায়ক অজিত কুমারের লুকের সাথে অনেককেই মেলাতে দেখা যায়। নাঈম প্রচারবিমুখ। মিডিয়াতে তাকে দেখা যায় না, নিজের পরিবার নিয়েই ব্যস্ত। ইদানিং তাকে তার গ্রামে দেখা যায় অনেক। কৃষির দিকে তার ভালো মনোযোগ আছে এবং এটি অবশ্যই প্রশংসনীয়।
নাঈম নব্বই দশকে একটা নতুন সময়ের শুরুর উল্লেখযোগ্য নায়ক। কম ছবি করে, কালজয়ী জুটি তৈরি করে নিজের চিরস্থায়ী অবস্থান করে গেছে দেশীয় চলচ্চিত্রে। অন্তত এজন্য নাঈম স্মরণীয় থাকবে।