আমাদের জাতীয় জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশকে পাওয়া। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশী চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সেসব উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র নিয়ে আজকের আয়োজন।
১. ওরা ১১ জন
১৯৭২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ ছবিটি মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছায়াছবি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে ছবির গল্প তৈরি হয়েছে। পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম। প্রযোজক ছিলেন মাসুদ পারভেজ যাকে আমরা সোহেল রানা বলে জানি। ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি দৃশ্যও ধারণ করা হয়েছিল। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের কিছু দৃশ্যও ধারণ করা হয়েছিল ছবিতে। অভিনয় করেছিল খসরু, রাজ্জাক, মুরাদ, হেলাল, নান্টু, আলতাফ, শাবানা, নূতন, হাসান ইমাম, খলিল, এটিএম শামসুজ্জামান প্রমুখ। ছবিতে খসরু-ই হাইলাইটেড হয়েছে সবচেয়ে বেশি। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং ফিরে আসার মতো ভাগ্য নিয়ে চরিত্রটি তৈরি। বীরাঙ্গনা চরিত্রে নূতন অসাধারণ অভিনয় করেছিল। রাজাকারের চরিত্রে এটিএম শামনুজ্জামানও দারুণ অভিনয় করেছিল। ছবিটি ১৯৭২ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে।
২. অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী
১৯৭২ সালে মুক্তি পায়। পরিচালক সুভাষ দত্ত। ছবির শ্লোগান ছিল ‘লাণ্ঞ্ছিত নারীদের মর্যাদা দাও, নিষ্পাপ শিশুদের বরণ করো।’ পাকবাহিনীর হাতে লাণ্ঞ্ছিত নারী ববিতার গল্প থেকে ছবির গল্প ফ্ল্যাশব্যাকে শুরু হয়। উজ্জ্বলের সাথে তার সুখের সংসার ছিল। আনোয়ার হোসেন গ্রামে শ্যুটিং করতে এসেছিল। তারপর অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি ঘটে। পাকবাহিনী আক্রমণ চালায়। আনোয়ার হোসেন কলকাতা ফিরে গেলেও মুক্তিযুদ্ধের খবর রাখতে থাকে। একসময় বাংলাদেশ স্বাধীন হয় এবং কলকাতায়ও আনন্দ উৎসব দেখতে পান। তারপর আবার আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশে আসে। ববিতার ছেলেকে কোলে তুলে নেয়। যুদ্ধাহত সৈনিকদের পুনর্বাসনের কাজ শুরু করেন। ববিতার ক্যারিয়ারে অন্যতম সেরা অভিনয় ছিল এ ছবিতে। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন দেশ আর নতুন করে দেশ গড়ার কাজ এ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিককে দেখানোতে এ ছবিটি অন্যতম সেরা দলিল মুক্তিযুদ্ধের। ছবিতে ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়।
৩. রক্তাক্ত বাংলা
১৯৭২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি। পরিচালক মমতাজ আলী। একজন ভাস্করের মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠা এবং মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ছবির গল্প। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিল পশ্চিমবঙ্গের অভিনেতা বিশ্বজিৎ চ্যাটার্জি। বিশ্বজিৎ ছিল জনপ্রিয় অভিনেতা প্রসেনজিতের বাবা। বিপরীতে কবরী। তার বোনের চরিত্রে সুলতানা। সুলতানার লিপে ‘ও দাদাভাই মূর্তি বানাও’ গানটি তখন ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল। গোলাম মোস্তফা, খলিল, রওশন জামিল তিনটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে ছিল। রওশন জামিল তার ছেলেকে ফিরে পায় না কিন্তু বিশ্বজিৎ ফিরে আসে মুক্তিযুদ্ধ থেকে। বিশ্বজিৎকে নিয়ে ছেলে হারানোর বেদনা ভুলতে চায়। ছবিতে ধর্ষণের দীর্ঘ দৃশ্যে দেখানোতে সমালোচিত হয়েছিল।
৪. ধীরে বহে মেঘনা
১৯৭৩ সালে মুক্তি পায়। পরিচালক আলমগীর কবির। ২০০২ সালে ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের দক্ষিণ এশীয় চলচ্চিত্র তালিকায় অষ্টম অবস্থানে ছিল এ ছবিটি। অভিনয়ে ববিতা, হাসু ব্যানার্জী, গোলাম মোস্তফা, খলিল প্রমুখ।
৫. আবার তোরা মানুষ হ
১৯৭৩ সালে মুক্তি পায়। পরিচালক খান আতাউর রহমান। অভিনয়ে ববিতা, ফারুক, আসাদ, খান আতা, রোজী আফসারী, রওশন জামিল প্রমুখ। ছবিটি ছিল স্যাটায়ার। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার পরেও স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই নিজেদের সুবিধা আদায় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদেরকে প্রতীকীভাবে দেখানোর মাধ্যমে পরিচালক আবার তাদের মানুষ হবার আহবান জানিয়েছিলেন। ছবির গল্পে বঙ্গবাণী কলেজের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া তরুণদের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী নৈতিক সমস্যা দেখানো হয়েছে। ছবিটি বিতর্কিত হয়েছিল এবং পরিচালকের অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল।
৬. সংগ্রাম
১৯৭৪ সালে মুক্তি পায়। পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম। পরিচালকের ভাষ্যমতে এটাই তাঁর নির্মিত সেরা ছবি। অভিনয়ে খসরু, সুচন্দা, নূতন, ফারুক, হাসান ইমাম, দারাশিকো, খলিল প্রমুখ। এ ছবিতে মুক্তিযুদ্ধে অপারেশন ও মহড়ার সরেজমিন দৃশ্য দেখানো হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে এ প্রক্রিয়াগুলো ছবিতে দেখানো হয়েছে যাতে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। একদল দামাল ছেলের মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠা, মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পের বাস্তবতা, পাকবাহিনীর হাতে নারীদের বন্দি অবস্থা, কৌশলে তাদের পরাস্ত করা দেখানো হয়েছে। কাঁটাতারে মুক্তিযোদ্ধার লাশ ঝুলে থাকার একটি মর্মস্পর্শী দৃশ্য আছে। ছবিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অভিনয় করেছিলেন। তাঁকে রাজি করানো হয়েছিল। ঢাকার পিলখানায় শ্যুটিং হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু স্যালুট নেবেন আর খসরুসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে স্যালুট দেবে এটাই ছিল দৃশ্য। বঙ্গবন্ধুর অভিনয় করার জন্য ছবিটি বিশেষত্ব পেয়েছে।
৭. মেঘের অনেক রঙ
১৯৭৬ সালে মুক্তি পায়। এটি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম রঙিন ছবি। পরিচালক হারুনর রশীদ। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত এক নারী তার ছেলেকে তার বাবার কাছে পাঠিয়ে নিজে আত্মহত্যা করে। বাবা ছিল মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের ডাক্তার। ছেলেকে নিয়ে বাবার নতুন জীবন শুরু হলে দ্বিতীয় স্ত্রী তা মানতে পারে না। ভুল বোঝাবুঝি হলে ছেলে চলে যেতে থাকে তারপর আবার ফিরে আসে তাদেরই মাধ্যমে। শিশুশিল্পীর ভূমিকায় আদনান অসাধারণ অভিনয় করে এবং শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পীর জাতীয় পুরস্কার জেতে। ছবিটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে।
৮. কলমিলতা
১৯৮১ সালে মুক্তি পায়। পরিচালক শহীদুল হক খান। অভিনয়ে সোহেল রানা, বুলবুল আহমেদ, কবরী, সুচন্দা, ইলিয়াস কাঞ্চন, মাস্টার শাকিল, রোজী আফসারী, রওশন জামিল, গোলাম মোস্তফা প্রমুখ। শান্ত সুনিবিড় গ্রামে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। অসীম সাহসিকতা দেখিয়ে একটি ছোট্ট ছেলে পাকবাহিনীর ব্রিজ উড়িয়ে দিতে যায়। তারপর নদী থেকে ওঠার সময় গুলি খেয়ে মারা যায়। তার লাশ নিয়ে কমান্ডার সোহেল রানা আসে মায়ের কাছে। শিশুশিল্পীর ভূমিকায় মাস্টার শাকিল অনবদ্য ছিল।
৯. একাত্তরের যীশু
১৯৯৩ সালে মুক্তি পায়। পরিচালক নাসির উদ্দিন ইউসুফ। প্রধান চরিত্রে হুমায়ুন ফরীদি অন্যান্য চরিত্রে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, জহির উদ্দিন পিয়ার, আবুল খায়ের, শহীদুজ্জামান সেলিম প্রমুখ। গ্রামে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চার্চের কেয়ারটেকার ডেসমন্ড মুক্তিযোদ্ধাদের দেখাশোনা করে। যুদ্ধ শেষের দিকে আসলে অ্যামবুশের সময় মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। তাদের পরিচয় জানতে চাইলে ডেসমন্ড জীবন বাঁচাতে মিথ্যা বলে। তখন তারই চোখের সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। ডেসমন্ড তা দেখে নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না। ডেসমন্ড চরিত্রে হুমায়ুন ফরীদি অসাধারণ ছিল। ক্রুশবিদ্ধ করার সময়টা ছবির সবচেয়ে টাচি অংশ। ছবিটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় শ্রেষ্ঠ সংলাপ ক্যাটাগরিতে। এছাড়া মনোনয়ন পায় বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে।
১০. আগুনের পরশমনি
১৯৯৪ সালে মুক্তি পায়। পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ। নিজের রচিত উপন্যাস থেকে একই নামে ছবিটি নির্মিত। মুক্তিযুদ্ধে এক সরকারি কর্মকর্তার বাড়িতে অবরুদ্ধ পরিবারের গল্প নিয়ে ছবির কাহিনী। সেখানে একসময় মুক্তিযোদ্ধা আসে এবং ছবির গল্প অসাধারণভাবে বদলে যায়। মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূর অসাধারণ ছিল। অন্যান্য চরিত্রে আবুল হায়াত, বিপাশা হায়াত, শিলা আহমেদ, ডলি জহুর, পুতুল, মোজাম্মেল হোসেন, দিলারা জামান, সালেহ আহমেদ সবাই অনবদ্য। ছবির নির্মাণ ছিল নিখুঁত। সাসপেন্স ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের পারফেক্ট ব্যবহার ছিল। ছবিটি ৮টি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিল। কলকাতায় বাংলাদেশী চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছিল ২০১১ সালে।
১১. নদীর নাম মধুমতি
১৯৯৫ সালে মুক্তি পায়। পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল। অভিনয়ে তৌকীর আহমেদ, আলী যাকের, সারা যাকের, আসাদ, আফসানা মিমি, আবুল খায়ের, রামেন্দু মজুমদার, আমিরুল হক চৌধুরী প্রমুখ। মুক্তিযোদ্ধা তৌকীর যখন দেশের জন্য সংগ্রাম করছে অন্যদিকে তারই বাবা আলী যাকের হাত মেলায় পাকবাহিনীর সাথে। রাজাকার বাবাকে শেষে নিজেই গুলি করে মারে তৌকীর তারপর পার হয় মধুমতি। চমৎকার ছবি। তিন ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়।
১২. এখনো অনেক রাত
১৯৯৭ সালে মুক্তি পায়। পরিচালক ও প্রযোজক খান আতাউর রহমান। অভিনয়ে ফারুক, সুচরিতা, আলীরাজ, আগুন, ববিতা, খান আতা, বুলবুল আহমেদ, শর্মিলী আহমেদ প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সাসাজিক বাস্তবতা নিয়ে ছবির গল্প। স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা কতটুকু আছে এটাই ছিল ছবির উপজীব্য। ছবির গুরুত্বপূর্ণ অংশের শ্যুটিং হয়েছিল পাবনা মানসিক হাসপাতালে। সেন্সর বোর্ড ছবিটির ৭টি দৃশ্য ফেলে দিলে পরিচালক খানআতা ক্ষুব্ধ হন। তিনি ছবিটির মুক্তি দেখে যেতে পারেননি। ছবিটি দুটি ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়।
১৩. হাঙর নদী গ্রেনেড
১৯৯৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেরা ছবি। পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম। সেলিনা হোসেনের উপন্যাস থেকে একই নামে নির্মিত ছবি। যশোরের এক মায়ের জীবনের সত্য ঘটনায় উপন্যাসটি লেখা হয়। সত্যজিৎ রায় একবার চিঠিতে সেলিনা হোসেনের এ উপন্যাসের প্রশংসা করেন এবং চলচ্চিত্র করার কথা বলেন কিন্তু রাজনৈতিক কারণে সম্ভব হয়নি। পরে চাষী নজরুল ইসলাম কাজটি করেন। একজন মায়ের জীবনকালে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নিজের সন্তানকে মুক্তিযোদ্ধার জন্য বিসর্জন দেয়াই ছিল গল্প। মায়ের ভূমিকায় সুচরিতা অনবদ্য অভিনয় করেন এবং তাঁর সেরা ছবি এটাই। প্রতিবন্ধী ছেলের ভূমিকায় বিজয় চৌধুরীও অসাধারণ ছিল। অন্যান্য চরিত্রে সোহেল রানা, শর্মিলী আহমেদ, দোদুল, অন্তরা, মিজু আহমেদ সবাই চমৎকার। ছবিটি সে বছর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। শ্রেষ্ঠ পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম, অভিনেত্রী সুচরিতা, শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার সেলিনা হোসেন। তবে বিজয় চৌধুরীও শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার ডিজার্ভ করত তার চরিত্রে।
১৪. মাটির ময়না
২০০২ সালে মুক্তি পায়। পরিচালক তারেক মাসুদ। আন্তর্জাতিকভাবে মুক্তিপ্রাপ্ত ও প্রশংসিত ছবি। অভিনয়ে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, রোকেয়া প্রাচী, নুরুল ইসলাম বাবলু, রাসেল ফরাজী। ছবিটি পরিচালকের নিজের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে নির্মিত। গোঁড়া ধর্মীয় চেতনার সমস্যাকে ছবিতে প্রধানভাবে দেখানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। আনু চরিত্রের ছেলেটি মাদ্রাসায় পড়ার সময় সেখানেও সে মধ্যমপন্থী সুবিধাবাদী অবস্থানের মানুষকে দেখে। একইভাবে বাড়িতে বাবা ও মায়ের ভিন্ন মতাদর্শ দেখা দেয়। বাবা জয়ন্ত গোঁড়া ধর্মীয় চেতনায় থাকে আর স্ত্রী রোকেয়া প্রাচী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। ধর্ম ও চেতনার দ্বন্দ্বে ছবির চরিত্রগুলো দুর্দান্ত। সেন্সর বোর্ড ছবিটিকে বিতর্কিত ঘোষণা করে, মামলা পর্যন্ত হয়। পরে আদালতের রায়ে ছবিটি প্রদর্শিত হয়। অস্কারের জন্য বাংলাদেশ থেকে মনোনীত প্রথম ছবি ছিল।
১৫. জয়যাত্রা
২০০৪ সালের ছবি। আমজাদ হোসেনের ‘অবেলার অসময়’ উপন্যাস থেকে নির্মিত হয় তৌকীর আহমেদের পরিচালনায়। অভিনয়ে মাহফুজ আহমেদ, বিপাশা হায়াত, আজিজুল হাকিম, আবুল হায়াত, হুমায়ুন ফরীদি, তারিক আনাম, সালেহ আহমেদ, শাহেদ, ইন্তেখাব দিনার, রোমানা, চাঁদনী প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধে নৌপথে জীবনের সাথে যুদ্ধ করা একদল মানুষের গল্প নিয়ে ছবির কাহিনী। ছবিটি ৮টি ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়।
১৬. শ্যামল ছায়া
২০০৪ সালের ছবি। পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ। নিজের উপন্যাস থেকেই নির্মাণ করেন ছবিটি। ‘জয়যাত্রা’-র মতোই ছবির গল্প মুক্তিযুদ্ধে নৌপথে একদল মানুষের জীবনযুদ্ধ। অভিনয়ে চ্যালেণ্ঞ্জার, তানিয়া আহমেদ, রিয়াজ, শাওন, শিমুল, ফারুক আহমেদ, এজাজুল ইসলাম, স্বাধীন খসরু, হুমায়ুন ফরীদি, শামীমা নাজনীন, রহমত আলী প্রমুখ। ছবিতে ব্যবহৃত বোটটি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের জন্য উপযুক্ত ছিল কিনা এটা নিয়ে বিতর্ক করতে দেখা যায় অনেককে।
১৭. মেঘের পরে মেঘ
২০০৪ সালের ছবি। পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম। রাবেয়া খাতুনের ‘ফেরারী সূর্য’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ছবি। মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধার গল্প নিয়ে ছবির কাহিনী। রাজাকার মাজেদ আর মুক্তিযোদ্ধা সেজানের দুই ধরণের বাস্তবতা নিয়ে ছবিটি এগিয়েছে। দ্বৈত চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছে রিয়াজ। অন্যান্য চরিত্রে পূর্ণিমা, মাহফুজ, খালেদা আক্তার কল্পনা, শহীদুল আলম সাচ্চু প্রমুখ।
১৮. ধ্রুবতারা
২০০৬ সালের ছবি। পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরের অবস্থা নিয়ে পারিবারিক গল্প। ছবির ‘যদি জানতে চাও’ গানটি জনপ্রিয় হয়েছিল। ছবিতে ফেরদৌস, মৌসুমী, হেলাল খান প্রধান চরিত্রে আছে।
১৯. অস্তিত্বে আমার দেশ
২০০৭ সালের ছবি। পরিচালক খিজির হায়াত খান। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের জীবনী নিয়ে নির্মিত ছবি। ছবিতে প্যারালাল স্টোরিতে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান এবং একজন স্বপ্নবাজ তরুণের সাহসী পদক্ষেপ দেখানো হয়েছে। বীরশ্রেষ্ঠের ভূমিকায় খিজির হায়াত খান ছিল। স্ত্রী মিলির ভূমিকায় শশী। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের স্ত্রী মিলি রহমানও ছবিতে অভিনয় করেছেন।
২০. রাবেয়া
২০০৮ সালের ছবি। পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল। মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ের মৃত্যুর পর তার লাশ দাফন হতে বাধা দেয়া হয়। তারপর বোন রাবেয়া ভাইয়ের লাশ দেখতে যায় এবং পরিস্থিতিক্রমে তাকে গুলিতে শহীদ হতে হয়। মূল চরিত্রে বন্যা মির্জা। অন্যান্য ভূমিকায় সাঈদ বাবু, মাসুম আজিজ প্রমুখ।
২১. গেরিলা
২০১১ সালে নির্মিত ছবি। টেকনিকের দিক থেকে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের সেরা ছবি। পরিচালক নাসির উদ্দিন ইউসুফ। মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা বাহিনীর ভূমিকার পাশাপাশি অনেক বাস্তবতা দেখানো হয়েছে। রাজাকার বাহিনীরা পাকবাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে ধর্ষণ, লুটপাট, জবাইয়ের মতো অনেক অপকর্মে লিপ্ত ছিল সেসব দেখানো হয়েছে। জয়া আহসান, এটিএম শামসুজ্জামান, শতাব্দী ওয়াদুদ অসাধারণ অভিনয় করেছে। ছবিটি ১০টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার এবং ৪ টি শাখায় মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার পায়।
২২. আমার বন্ধু রাশেদ
২০১১ সালের ছবি। পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম। মুহাম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাস থেকে নির্মিত ছবি। মুক্তিযুদ্ধে এক সাহসী ছাত্রের ভূমিকা নিয়ে ছবির কাহিনী। ছাত্রটির কিশোরবেলার বন্ধুর বয়ানে ছবিটি এগিয়ে যায় যেখানে তার ছেলের কাছে তার বন্ধু রাশেদের গল্প শোনানো হচ্ছে। মূল চরিত্রে চৌধুরী জাওয়াতা আফনান। অন্যান্য চরিত্রে আসাদ, ড. ইনামুল হক, হোমায়রা হিমু, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ওয়াহিদা মল্লিক জলি প্রমুখ। ছবিটি নিয়ে দর্শকের মধ্যে মিশ্র অনুভূতি দেখা যায়।
২৩. মেহেরজান
২০১১ সালের ছবি। পরিচালক রুবাইয়াৎ হোসেন। মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর এক সদস্য নিজের আদর্শের লড়াই করতে এসে ভিন্ন বাস্তবতা দেখে থমকে যায়। সে এক নির্যাতিত মেয়ের জীবন বাঁচায় এবং তার সাথে তার প্রেম হয়। ছবিটি এ গল্পের কারণে সমালোচিত হয়। অভিনয়ে জয়া বচ্চন, শায়না আমিন, হুমায়ুন ফরীদি, ভিক্টর ব্যানার্জী প্রমুখ।
২৪. মেঘমল্লার
২০১৪ সালের ছবি। পরিচালক জাহিদুর রহিম অণ্ঞ্জন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প ‘রেইনকোট’ থেকে নির্মিত ছবি। এ নামে ঋতুপর্ণ ঘোষের হিন্দি সিনেমা থাকায় ছবির নাম পরিবর্তন করানো হয়। ছবির বিশেষত্ব হচ্ছে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের চিত্র না দেখিয়ে আকারে-ইঙ্গিতে বোঝানো হয়েছে। ছবিটি ৫ টি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়।
২৫. জীবনঢুলী
২০১৪ সালের ছবি। পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল। মুক্তিযুদ্ধে একজন ঢুলীর জীবনের গল্প থেকে ছবিটি নির্মিত হয়েছে। ঢুলী তার জীবিকার জন্য ঢোল বাজায় বিভিন্ন আয়োজনে। মুক্তিযুদ্ধে তার জীবনটা বদলে যায়। প্রধান চরিত্রে শতাব্দী ওয়াদুদ অন্যান্য ভূমিকায় জ্যোতিকা জ্যোতি, চিত্রলেখা গুহ, ওয়াহিদা মল্লিক জলি প্রমুখ।
২৬. অনিল বাগচীর একদিন
২০১৫ সালের ছবি। হুমায়ূন আহমেদের গল্প থেকে মোরশেদুল ইসলামের নির্মিত ছবি। হিন্দু ধর্মের অনিল মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। তার সাথের একজন তাকে মুসলমান পরিচয় দিতে বললে সে রাজি হয় না, নিজের পরিচয়ই দেয় এবং পরিণতিতে তার মৃত্যু হয়। ছবির শেষ দৃশ্যে মৃত্যুর আগে অনিল জোছনা দেখতে চায়। প্রধান চরিত্রে আরেফ সৈয়দ অসাধারণ অভিনয় করে। অন্যান্য চরিত্রে গাজী রাকায়েত, মিশা সওদাগর ছিল। ছবিটি ৬টি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ২ টি শাখায় মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার পায়।
২৭. রূপসা নদীর বাঁকে
তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত ২০২০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ ছবিতে আংশিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে। চার দশকের ইতিহাসের এ ছবিতে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গক্রমে এসেছে।
এগুলো ছাড়াও আরো ছবি নির্মিত হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। এর মধ্যে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদের পরিচালনায় ‘মুক্তির গান’ ও ‘মুক্তির কথা’ দুটি প্রামাণ্য চিত্র অন্যতম। ১৯৭১-এ ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ নামের একটি সাংস্কৃতিক দলের প্রতিদিনের কার্যক্রমকে সেলুলয়েডে ধারণ করেন মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন। ১৯৯০ সালে উদ্ধার করা সেসব ফুটেজ নিয়ে এটি নির্মিত। সেটাই ১৯৯৫ সালে মুক্তি পায় ‘মুক্তির গান’ নামে।
১৯৯৯ সালে ‘মুক্তির কথা’ মুক্তি পায়। ৪ বছর ধরে একদল তরুণ প্রজেকশনিস্ট দেশের গ্রামে গ্রামে ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের ছবির প্রদর্শনী করেছিল। দেখাতে গিয়ে অনেক মানুষের মুখে আরো অজানা ইতিহাস বেরিয়ে আসে। সেসব কথার প্রামাণ্য চিত্র হয়ে ওঠে ‘মুক্তির কথা।’ মৃত্যুণ্ঞ্জয় দেবব্রত পরিচালিত ‘যুদ্ধশিশু’ (২০১৪) ছবিটি বিতর্কিত হয়। মানিক মানবিক পরিচালিত ‘শোভনের স্বাধীনতা’ (২০১৫), শামীম আখতারের ‘রীনা ব্রাউন’ (২০১৭) সর্বশেষ দুটি ছবি।
মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র থেকে নেয়া কিছু গান :
ও আমার দেশের মাটি – ওরা ১১ জন
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে – ওরা ১১ জন
আমায় একটি ক্ষুদিরাম দাও – ওরা ১১ জন
বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা – সংগ্রাম
মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে – অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী
এক নদী রক্ত পেরিয়ে – আবার তোরা মানুষ হ
এদেশ এদেশ আমার এ দেশ – রক্তাক্ত বাংলা
ফিরে আয় বাছা আমার – রক্তাক্ত বাংলা
ধনধান্যে পুষ্পেভরা – আমার জন্মভূমি
আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে – আগুনের পরশমনি
শিকল ভাঙার গান গেয়ে যা – হাঙর নদী গ্রেনেড
এই পদ্মা এই মেঘনা – নদীর নাম মধুমতি
আমরা সূর্যটা কেড়ে এনেছি – এখনো অনেক রাত
যদি আর দেখা নাই হয় – এখনো অনেক রাত
যদি জানতে চাও আমার কি চাই – ধ্রুবতারা
অস্তিত্বে আমার দেশ – অস্তিত্বে আমার দেশ
বলো বীর বলো উন্নত মম শির – গেরিলা
যদি জানতে চাও আমার কি চাই – ধ্রুবতারা
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সর্বোচ্চ জাতীয় অর্জন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো সম্পর্কে দর্শকের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। স্বাধীনতার এত বছর পরেও এ ক্যাটাগরির চলচ্চিত্র সার্বিকভাবে কম এবং এর মধ্য মান নিয়েও আছে সমালোচনা। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে চ্যালেণ্ঞ্জিংও হয়ে দাঁড়িয়েছে এ ধরনের ছবির নির্মাণ। তারপরেও মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রজন্মের দাবি।