‘মুক্কাবাজ’ একটি সোশিও পলিটিকাল স্পোর্টস ড্রামা ফিল্ম। বেশ কিছু বছর ধরে বলিউডে স্পোর্টস ফিল্ম বানানোর একটা ধুম লেগেছে। বাংলায় যেমন প্রাণপাত করে গোয়েন্দা চরিত্রদের খুঁজে বের করা হচ্ছে, মুম্বাইতে তেমনই খুঁজে খুঁজে বের করা হচ্ছে খেলোয়াড়দের। একের পর এক বানানো হচ্ছে তাঁদের বায়োপিক। মিলখা সিংহ, মেরি কম, পান সিংহ তোমার, আজহারউদ্দিন, ধোনি, মহাবীর সিংহ ফোগাট। এর পর আসছে কপিল দেব, সাইনা নেহওয়াল ইত্যাদি ইত্যাদি।
কেন জানি না মনে করা হচ্ছে, খেলোয়াড়দের বায়োপিক দেখে মানুষ অনুপ্রেরণা পাবেন। তাঁদের বিজয়গাথা দেখে উদ্বুদ্ধ হবে জাতি। এ দিকে বাস্তব পরিস্থিতি কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত। ভারতে অ্যাথলেটিক্স খুবই অবহেলিত একটি বিষয়। সব ফোকাস থাকে শুধু ক্রিকেটে। অ্যাথলেটিক্সে যা পদক আসে সেগুলো সবই প্রায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে। অর্থাৎ পি ভি সিন্ধু, সাইনা নেহওয়াল, গীতা কুমারী ফোগাট (দঙ্গল), সাক্ষী মালিকের মত খেলোয়াড়দের উঠে আসার পিছনে হয় কোনও একজন প্যাশনেট কোচ থাকেন, যিনি ব্যক্তিগত ভাবে তাদের ট্রেনিং-এর দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেন। নইলে থাকেন খেলোয়াড় বাবা, যিনি তাঁর ঘটি-বাটি বেচে সন্তানের কোচিং করান। এ ভাবেই হাতে গোনা কিছু খেলোয়াড় তৈরি হন। যাঁরা বিদেশের মাটিতে দেশের নাম উজ্জল করেন।
সব থেকে অপ্রিয় সত্য কথা যেটা, সেটা হল যে সরকারি ইনফ্রাস্ট্রাকচারের মধ্যে দিয়ে তৈরি হয়ে প্রায় কোনও খেলোয়াড় সর্বোচ্চ পর্যায়ে যেতে পারেন না। দেশের স্পোর্টস সিস্টেম কোনও ভাবেই একজন কমপ্লিট স্পোর্টস ম্যান তৈরি করতে পারে না। বরং উল্টে তাকে ধ্বংস করে। কিছু খেলোয়াড় ডিস্ট্রিক্ট খেলেন, কিছু স্টেট খেলেন, তার থেকে কিছু ভাগ্যবান ন্যাশনাল খেলেন। এখানেই ইতি। কোনও রকমে একটা সরকারি চাকরি পেয়ে আর ছোটখাটো জায়গায় কোচিং করিয়ে তাঁরা তাঁদের হতাশ খেলোয়াড়ি জীবন কাটিয়ে দেন। অনেকের ভাগ্যে আবার সেটাও জোটে না।
এই হল আমাদের দেশের অ্যাথলেটিক্সের অবস্থা। এমত অবস্থায় একজন খেলোয়াড়ের বিজয়গাথা দেখিয়ে দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার মত ছবি বানানো এক ধরণের কপটতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু ‘মুক্কাবাজ’ দেশের এই বাস্তব চিত্রকে সততার সঙ্গে দেখিয়েছে। ছবি খুবই প্রাণোচ্ছ্বল। খুবই ইমোশনাল প্রেমের ছবি। মানুষের অনুভূতিকে প্রবল ভাবে স্পর্শ করে। এবং সাথে সাথে অসহায়তার একটা তীব্র আন্ডার কারেন্ট চলতে থাকে ছবির অবচেতনে। কথায় আছে, যে গান সবাই বাঁধেন মহাজনেরা সেই গান বাঁধেন না। সে রকমই, যে ছবি সবাই বানান সেই ছবি অনুরাগ কাশ্যপ বানান না। কারণ ছবি তো অনেকেই বানান, কিন্তু চলচ্চিত্রের বরপুত্র সবাই হন না। কেউ কেউ হন। আর তাঁরা যখন ছবি বানান, তখন বাকি ফিল্মমেকারদের সেটা দেখা ছাড়া কিছু করার থাকে না। কেউ দেখে শেখেন। অনেকের ভাগ্যে আবার সেটাও জোটে না।
‘মুক্কাবাজ’ ছবিতে উত্তরপ্রদেশের এক বক্সার শ্রবণ কুমার সিংহের কথা বলা হয়েছে। শ্রবণ প্রেমে পড়ে এক ব্রাহ্মণ মেয়ের (সুনয়না)। যে মেয়ে আবার ভগবান দাস মিশ্র (জিমি শেরগিল) নামক একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তির ভাইঝি। কেন ক্ষমতাবান? কারণ তিনি একাধারে সরকারি দলের একজন বাহুবলী নেতা, সেই ক্ষমতায় উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের বক্সিং-এর ডিসট্রিক্ট কোচ এবং একাধারে একজন ‘নিচু জাত’ বিদ্বেষী ব্যক্তি। ছবির শুরুতেই শ্রবণের সাথে ভগবান দাসের ব্যক্তিগত শত্রুতা তৈরি হয়। তার উপর ভাইঝির সঙ্গে নিচু জাতের শ্রবণের সম্পর্কের দরুন তাঁর অহং-এ বড়সড় আঘাত লাগে। যার ফলস্বরূপ তিনি শ্রবণের ব্যক্তিগত জীবন এবং বক্সিং কেরিয়ার পুরপুরি ধ্বংস করে দেওয়ার এক অমানুষিক উদ্যোগ নেন। এ পর্যন্ত বলে থামতে হবে। কারণ গল্পে অস্বাভাবিক নতুন কিছু নেই। পৃথিবীর কোনও ছবির গল্পেই একেবারে নতুন কিছু থাকে না। আর যাঁরা এটা ক্লেইম করেন, হয় তাঁরা বোকা নইলে কপট। কারণ কোথাও না কোথাও সেই গল্প নিয়ে অন্য ছবি হয়ে আছে। তা হলে এই ছবিকে ভাল ছবি কেন বলা হবে। বলা হবে কারণ, একটা ভাল ছবি হল সেই ছবি যেটি আর একটি খারাপ ছবির থেকে ভাল করে বানানো হয়েছে। কনফিউজড? সহজ করে দিচ্ছি। শুধু গল্পে ছবি হয় না। ছবি বানাতে হয়। আর এই বানানোর মুনশিয়ানা না থাকার জন্যই কোনও কোনও ছবি খারাপ হয়। আর সেটা থাকার জন্য কোনও কোনও ছবি ভাল হয় আর কোনও ছবি হয় মহান।
‘মুক্কাবাজ’ ছবির একটি দৃশ্য।
আমি বলছি না যে ‘মুক্কাবাজ’ কোন মহান ছবি। সেই বিচার আপনারা করবেন। আপনারা যারা ছবির দর্শক। ফিল্ম মেকারদের মা-বাপ। আপনারা দেখলে ছবি চলে। না দেখলে ছবি চলে না। একজন সমালোচক হিসেবে আমি শুধু রিকোয়েস্ট করতে পারি যে ছবিটা আপনারা দেখুন। এই ছবি বারবার হয় না। কখনও বছরে একবার হয়, কখনও দশকে আর কখনও শতকে। ছবিতে শ্রবণ (বিনীত) একজন প্যাশনেট বক্সার। বক্সিং ছাড়া আর কিছু সে জানে না। অন্য দিকে ছবির পরিচালক অনুরাগ একজন ফিল্মমেকার। ছবি তৈরি করা ছাড়া আর কিছু সে জানে না। ফলে এ রকম একজন ফিকশন চরিত্রের সাথে ছবিতে যখন একজন বাস্তব চরিত্রে মিলন হয়, তখন সেটা শিল্পের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একটা সঙ্গমস্থল হয়ে ওঠে।
ছবির প্রক্ষাপট উত্তরপ্রদেশ। রাম জন্মভুমি। যেখানে একদা দশরথের হাতে মৃত্যু ঘটেছিল অন্ধ মুনিপুত্র শ্রবণের। আজও তার পুনরাবৃত্তই ঘটে চলেছে। ফলে ফ্যাক্ট, ফিকশন আর মহাকাব্যের এই মিলনের সাক্ষী হয় মা গঙ্গা। কবির ভাষায় ‘তিন পাগলে হল মেলা নদে এসে, তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে”। যাস না বলার কারণ, এই মিলন আপনাকে ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। যদি কলিজায় জোর থাকে, তাহলে দেখতে জান। সাক্ষী হন এই ধ্বংসলীলার।
এ দেশে বক্সিং, কুস্তি, কবাডি দেখে হাততালি দেওয়ার লোকের সংখ্যা কম। সব হাততালি ক্রিকেটের জন্য বরাদ্দ। আর বিগ বাজেট বাণিজ্যিক ছবির সামনে এই ধরনের ছবিও খুব সীমিত হাততালিই পেয়ে থাকে। কিন্তু যদি কখনও চটকদার বাণিজ্যিক ছবি দেখতে দেখতে আপনার স্নায়ুতে এক ফোঁটা ক্লান্তিও এসে থাকে, যদি আপনাদের মনে চলচ্চিত্রের প্রতি এতটুকুও ভালবাসা থেকে থাকে, যদি কখনও মনে হয়ে থাকে যে আপনার সুখ-দুঃখ-আবেগ-অনুভুতিকে সিনেমা নামক এই সামান্য মাধ্যমটি কখনও এক চিলতে হলেও স্পর্শ করতে পেরেছিল, তা হলে এই ছবিটি দেখুন। দেখুন আর হাততালি দিতে শুরু করুন। যত ক্ষণ না পর্যন্ত হাতের তালু লাল হয়ে যায়, যত ক্ষণ না পর্যন্ত সেই তালি বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে না পারে, যত ক্ষণ না পর্যন্ত সেই বিদ্যুৎ সমস্ত ছল, কপটতায় ভরা রাজনীতিকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে না পারে।
পুনশ্চঃ অভিযোগ উঠতে পারে যে সমালোচনায় ছবির কন্টেন্টের থেকে আবেগ ও ব্যক্তিগত মনোভাবের প্রকাশ কেন বেশি। ফলে আরও কটা কথা বলার প্রয়োজন অভুভব করছি। এমনিতেও কথাগুলো না বললে লেখা অসম্পুর্ণ থেকে যেত। ছবিতে বিনীত যা অভিনয় করেছে, অনেক নমস্য মানুষের নাম মাথায় রেখেও বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, এই অভিনয় আমি গত ১০ বছরে আর কোথাও দেখিনি। ছবির সংগীত অনবদ্য। ‘মুশকিল হ্যাঁ আপনা মেল প্রিয়ে’, ‘বহুত হুয়া সাম্মান’ (এটা ছবির ট্যাগলাইনও) , ‘প্যাঁতরা’ গানগুলির ব্যবহার ও পিকচারাইজেশন প্রতিটা লোমকূপ খাঁড়া করে দেয়। ছবির সংলাপ এক কথায় অপূর্ব। সেন্স অফ হিউমারের কোন তুলনা নেই। যাকে বলে সিচুয়েশনাল কমেডি। জোর করে হাসানো নয়, মানুষের অন্তর্স্থল থেকে এই হাস্যরসের উদ্ভব হয়। যে রস ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। শুধু অনুভব করা যায় মাত্র।