by dayli passenger (Read full story here)
“বাবা ট্রেনে সাবধানে থাকিস। লোকজনের সাথে একটু বুঝে শুনে কথা বলিস, আর বেশী মেলামেশা বা মাখা মাখি একদম নয়। আর হ্যাঁ, পৌঁছেই আমার বা তোর মার মোবাইলে কল করে জানাবি কেমন আছিস। “ মাথা নেড়ে হুম মতন একটা শব্দ করে বুঝিয়ে দিলাম যে আমার চিন্তিত বাবার সব কটা কথা আমার মাথার সেলে গেঁথে গেছে। ট্রেনের সেকন্ড ক্লাস এসির দরজার পাদানিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার বাবা, মা আর আমাকে সি-অফ করতে আসা প্রায় জনা পনের লোকের সাথে হেঁসে হেঁসে কথা বলে বিদায় নিচ্ছি কোলকাতার উদ্দেশ্যে। কোলকাতার বড় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তে যাচ্ছি। পড়তে যাচ্ছি না কি করতে যাচ্ছি সেটা...আপাতত ফ্যাক্ট বলতে গেলে এটাই বলতে হয় যে জয়েন্ট এন্ট্রান্সের রেজাল্ট বোর্ডে আমার নামের পাশে খুব ভাল র্যাঙ্ক ছেপে দিয়েছে সরকার। অগত্যা কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে পড়াশুনা করতে হবে। ট্রেন ছাড়তে আর বেশী দেরী নেই, তাই সবার কাছ থেকে সাবধানে থাকার জ্ঞানের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আমার মনেও যে কোনও উদ্বেগের ভাব নেই সেটা সত্য নয়। আমিও ভেতরে ভেতরে চিন্তিত আর উদ্বিগ্ন। তবে, এই রকম মানসিক অবস্থা আমার কাছে নতুন কিছু নয়। “এত বড় কলেজে পড়তে যাচ্ছি…” জানি না, আমার কি গর্বিত হওয়া উচিৎ ছিল না?
ভাবনায় ছেদ পড়ল কারণ একজন লোক সপরিবারে এসে আমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে ট্রেনের পাদানি থেকে টেনে নিচে নামিয়ে দিল। তার সাথে আবার পাঁচটা লাগেজ। তিনটে ইয়া বড় বড় সুটকেস। আর, লাগেজ বলতে একটা ষণ্ডা মার্কা বউ, আর একটা ততধিক কুৎসিত মেয়ে। প্রথমেই ওনার গিন্নী আর মেয়ে উঠে গেল কামড়ায়। তারপর উনি একে একে সুটকেস গুলিকে দরজার উপরে রাখার কসরত শুরু করলেন। বোধহয় সব থেকে দামী লাগেজ দুটোকে অর্থাৎ স্ত্রী আর কন্যাকে কামড়ার নিরাপত্তায় উঠিয়ে দিতে পেরে অনেকটা স্বস্তি বোধ করছেন।আর সেই জন্যই হয়ত ওনার ভদ্রতা বোধটায় একটু জোয়ার এসেছে। আমাকে যে এক রকম প্রায় ধাক্কা দিয়েই ট্রেনের পাদানি থেকে একটু আগে নামিয়ে দিয়েছিলেন সেটা মনে করে এতক্ষনে বোধহয় ওনার মনে একটু লজ্জার ভাবও জেগে উঠেছে। আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে হাঁপ ধরা গলায় একটা “সরি” বলে কোনও মতে গায়ের সব জোড় খাটিয়ে প্রথম সুটকেসটাকে দরজার ভেতর চালান করে দিলেন। আমি আশা করেছিলাম যে ওনার স্ত্রী বা কন্যার মধ্যে অন্তত একজন ওনাকে এই ট্রেনের মধ্যে মাল ওঠানোর ব্যাপারে সাহায্য করবেন। কিন্তু আদপেও তেমন কিছু হল না। তারা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেই কোথায় যেন গায়েব হয়ে গেলেন, বোধহয় নিজেদের সিটের সন্ধানে এগিয়ে গেছেন ওরা। কি বিচিত্র রে বাবা এই দুটো মেয়ে ছেলে। পেছনে ভদ্রলোক ট্রেনের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সুটকেসের ভারে হিমশিম খাচ্ছেন আর ওদের সিটের টেনশন। আরে ক্ষ্যাপা সিট কি কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে না কি! লোকটার হাবভাব দেখে বুঝতে পারছি যে সুটকেসগুলো সত্যিই বেশ ভারী। সুটকেসের নিচে চাকা থাকায় ষ্টেশন দিয়ে দৌড়ে আসার সময় তিনজনের কোনও অসুবিধা হয়নি। কিন্তু এখানে কামড়ার উচ্চতা বেশ বেশী। সুতরাং একটা সুটকেস ওঠাতেই লোকটার প্রায় অক্কা পাবার অবস্থা। দুটো সুটকেস কোনও মতে দরজার ভেতরে রেখে উনি পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন।
আমার অন্য দিকে অবশ্য “ভালো থাকিস, সাবধানে থাকিস, টাকা লাগলে সাথে সাথে কল করে জানাবি, হোটেলের বুকিং হয়ে গেছে, চেক ইন করে জানাবি” ইত্যাদি ভাষণের বন্যা অবিরল হয়েই চলেছে। এ সব কথাই আমার জানা। কিভাবে সবাধানে থাকতে হয় তাও মনে হয় আমি জানি। আর হোটেল সংক্রান্ত বা কলেজ সংক্রান্ত যে সব তথ্য বারবার আমার সামনে তুলে ধরছে ওরা সেই সবই আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। যদিও আমি ওদের সব কথা ভীষণ মন দিয়ে শোনার ভান করে ঘাড় নাড়িয়ে চলেছি, আমার চোখ আর মন, দুইই কিন্তু পড়ে আছে এই অসহায় লোকটার কার্য কলাপের দিকে। মনে মনে বেশ একটা কৌতুক অনুভব করছি ওর হাবভাব দেখে তাতে সন্দেহ নেই। লোকটা শেষ সুটকেসটা কোন মতে দরজার মুখে রাখতে যাবেন, ঠিক এমন সময় ভেতর থেকে একটা অল্প বয়সী ছেলে দৌড়ে এসে দরজার মুখে হাজির হল। ছেলেটার বয়স প্রায় আমারই মতন। দুটো সুটকেস দরজার মুখ আগলে দাঁড়িয়ে থাকায় ছেলেটা যে যারপরনাই বিরক্ত হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। “দূর বাল গান্ডু, দরজার মুখটা আঁটকে রেখে দিয়েছে” বলেই একটা সুটকেস লাথি মেরে দরজার মুখ থেকে পেছন দিকে সরিয়ে দিল, আর আরেকটা সুটকেস ততধিক বিরক্তির সাথে লাথি মেরে উপুড় করে কামড়ার মেঝেতে ফেলে দিল। লোকটা কোনও মতে ততক্ষণে থার্ড সুটকেসটা মাটি থেকে তুলে ধরেছেন। কিন্তু সেটাকে আর দরজার মুখে রাখা হল না ওনার। ছেলেটা লোকটাকে তার সুটকেস সমেত প্রায় ধাক্কা মেরে দরজার মুখ থেকে সরিয়ে দিয়ে কামরার দরজা দিয়ে নেমে ষ্টেশনের ক্যান্টিনের দিকে দৌড় মারল। সুটকেস সমেত লোকটা সশব্দে ধাই করে ষ্টেশনের মেঝেতে পড়তেই গার্ডের হুইসেল বেজে উঠল। লোকটা যে বেজায় ব্যথা পেয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। হুইসেলের শব্দে যেন কিছুটা ব্যস্ত হয়েই ওঠার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। সুটকেসটা এখনও তার হাঁটুর ওপর শুয়ে রয়েছে। ডান পায়ের হাঁটুটা ভেঙ্গে যায় নি তো? কিন্তু এই মুহূর্তে আর সময় নেই ওনার দিকে তাকানোর। বাবা, মা আর বাকি গুরুজনদের পা ছুয়ে প্রনাম করতে করতেই আড়চোখে দেখে নিলাম যে সেই অল্প বয়সী ছেলেটা ক্যান্টিনের বাইরের একটা বড় সিগারেটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকটা প্যাকেট সিগারেট, কেক, চিপস, ক্যাডবেরি ইত্যাদি একটা প্লাস্টিকে পুড়ছে, ওরও সতর্ক চোখ কিন্তু সামনের সিগন্যালের দিকে। এই লোকটার আর ওই ছেলেটা্র, দুজনেরই ট্রেন মিস করার ভয় এখন পুরো মাত্রায়। প্রনাম পর্ব শেষ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম চটপটে ছেলেটা দুটো প্লাস্টিকের থলি হাতে কোনও মতে দৌড়ে এসে আবার আমাদের সামনে দিয়ে কামড়ার ভেতরে ঢুকে ভ্যানিশ হয়ে গেল। লোকটা এতক্ষনে কোনও মতে উঠে দাঁড়িয়েছেন, সুটকেসটা যদিও ষ্টেশনের ধুলায় এখনও লুটোপুটি খাচ্ছে। উনি আমাকে সরি বলেছেন, তাই আমারও উচিৎ ওনাকে একটু সাহায্য করা। ট্রেনের শরীরে এদিকে সশব্দ কম্পন জেগে উঠেছে। ট্রেন সামনের দিকে এগোতে শুরু করেছে। আমি লোকটাকে মৃদু স্বরে বললাম, “উঠে পড়ুন। আমি ওইটা উঠিয়ে নিচ্ছি।” উনিও একটা ছোট থ্যাংকস মতন শব্দ করে চলতি ট্রেনে উঠে পড়লেন, আর আমিও ওনার পিছন পিছন ওনার ভারী সুটকেসটাকে দরজার পাদানির ওপর উঠিয়ে এক লাফে ট্রেনে উঠে পড়লাম। হাত নেড়ে সবাইকে গুডবাই জানিয়ে দরজাটা টেনে দিলাম। সবার মুখে যে গভীর দুশ্চিন্তার ছবি আঁকা হয়ে রয়েছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না। উনি আরেকবার আমাকে থ্যাংকস জানিয়ে আবার পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছতে শুরু করলেন। ওনাকে এই বিপদের সময় সাহায্য করেছি ঠিকই কিন্তু আমি ওনার কুলি নই, তাই কি ভাবে উনি এই তিনটে সুটকেস নিয়ে সিট অব্দি পৌছাবেন সে চিন্তা আমার নয়।, ওনার শেষ সুটকেসটা দরজার মুখেই ছেড়ে দিয়ে আমি ভেতরে ঢুকে গেলাম। ঝপ করে গিয়ে বসে পড়লাম জানলার ধারে। এটাই আমার সিট। আমার সামনে এখন নতুন জীবনের হাতছানি, অনেক কাজ সামনে। চিন্তায় ডুবে গেলাম।
ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে করতে একটু যেন তন্দ্রা মতন এসে গেছিল। ছোটবেলা থেকেই আমার অভ্যেস আছে যে কোনো পরিস্থিতিতে বসে ঘুমিয়ে নেওয়ার। মাঠে বসে পাথরের ওপর পিঠ দিয়ে কতবার ঘুমিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই, আর এখানে তো বদ্ধ কামড়ার মধ্যে সুন্দর এসি চলছে। কিছুক্ষণ পর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটল। খাবার অর্ডার নিতে এসেছে। একটা নন ভেজ চিকেন মিল বলে দিয়ে আবার মাথাটা ঠাণ্ডা জানলার কাঁচের ওপর নামিয়ে রেখে ঘুম লাগালাম। আমার সহ যাত্রী একটা তামিল ফ্যামিলি। আমাদের মফস্বলে ওরা কি করতে এসেছিল তা অবশ্য বুঝতে পারলাম না। কিন্তু এখন ওরা সপরিবারে ধেয়ে চলেছে কোলকাতার উদ্দেশ্য। ওনারা তামিলেই কথা চালিয়ে গেলেন। আমি তামিল বুঝি। কেন তামিল বুঝি, কি বৃত্তান্ত, সেটা বলতে গেলে লেখা বেড়ে যাবে। তাই আপাতত কাটিয়ে দিচ্ছি। ওনার আর ওনার স্ত্রীর মধ্যে যে কথা বার্তা হল সেটা থেকে বুঝলাম যে উনি কোলকাতার কোনও বড় কোম্পানিতে চাকরি করেন আর ওনার কাজের ভীষণ চাপ। আর হ্যাঁ পরে অবশ্য জানতে পেরেছিলাম যে উনি ওনার এক কুটুম্বের সাথে দেখা করতে আমাদের মফস্বলে এসেছিলেন। ওনার সেই আত্মীয় একটা বড় পাওয়ার প্ল্যান্টের ফ্লোর ম্যানেজার এই আমাদেরই মফস্বল শহরে।
রাতে খেয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার বার্থ নিচেই। ট্রেন কলকাতা পৌঁছাবে খুব ভোরে। মোবাইলে অ্যাঁলার্ম দেওয়া আছে। তবে অ্যাঁলার্মের দরকার হয়নি। ষ্টেশনে গাড়ি ঢুকবার অনেক আগেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। আসলে ঘুমটা তেমন ডিপ হয়নি। চোখ খুলে দেখলাম পুরো কামরা তখনও নিদ্রামগ্ন। চুপচাপ ব্রাশ হাতে বাথরুমের দিকে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলাম তখনও আমার কুপের সব কটা সহযাত্রী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ষ্টেশন আসতে কিন্তু আর বেশী দেরী নেই। সমস্ত কুপ জুড়ে প্রবল নাক ডাকার শব্দ। অবশ্য ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে ফিরে আসার সময় খেয়াল করলাম যে আমাদের কুপে না হলেও ভেতরের দিকে কোনও কোনও কুপের ভেতর আলো জ্বলতে শুরু করেছে।
“বাবা ট্রেনে সাবধানে থাকিস। লোকজনের সাথে একটু বুঝে শুনে কথা বলিস, আর বেশী মেলামেশা বা মাখা মাখি একদম নয়। আর হ্যাঁ, পৌঁছেই আমার বা তোর মার মোবাইলে কল করে জানাবি কেমন আছিস। “ মাথা নেড়ে হুম মতন একটা শব্দ করে বুঝিয়ে দিলাম যে আমার চিন্তিত বাবার সব কটা কথা আমার মাথার সেলে গেঁথে গেছে। ট্রেনের সেকন্ড ক্লাস এসির দরজার পাদানিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার বাবা, মা আর আমাকে সি-অফ করতে আসা প্রায় জনা পনের লোকের সাথে হেঁসে হেঁসে কথা বলে বিদায় নিচ্ছি কোলকাতার উদ্দেশ্যে। কোলকাতার বড় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তে যাচ্ছি। পড়তে যাচ্ছি না কি করতে যাচ্ছি সেটা...আপাতত ফ্যাক্ট বলতে গেলে এটাই বলতে হয় যে জয়েন্ট এন্ট্রান্সের রেজাল্ট বোর্ডে আমার নামের পাশে খুব ভাল র্যাঙ্ক ছেপে দিয়েছে সরকার। অগত্যা কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে পড়াশুনা করতে হবে। ট্রেন ছাড়তে আর বেশী দেরী নেই, তাই সবার কাছ থেকে সাবধানে থাকার জ্ঞানের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আমার মনেও যে কোনও উদ্বেগের ভাব নেই সেটা সত্য নয়। আমিও ভেতরে ভেতরে চিন্তিত আর উদ্বিগ্ন। তবে, এই রকম মানসিক অবস্থা আমার কাছে নতুন কিছু নয়। “এত বড় কলেজে পড়তে যাচ্ছি…” জানি না, আমার কি গর্বিত হওয়া উচিৎ ছিল না?
ভাবনায় ছেদ পড়ল কারণ একজন লোক সপরিবারে এসে আমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে ট্রেনের পাদানি থেকে টেনে নিচে নামিয়ে দিল। তার সাথে আবার পাঁচটা লাগেজ। তিনটে ইয়া বড় বড় সুটকেস। আর, লাগেজ বলতে একটা ষণ্ডা মার্কা বউ, আর একটা ততধিক কুৎসিত মেয়ে। প্রথমেই ওনার গিন্নী আর মেয়ে উঠে গেল কামড়ায়। তারপর উনি একে একে সুটকেস গুলিকে দরজার উপরে রাখার কসরত শুরু করলেন। বোধহয় সব থেকে দামী লাগেজ দুটোকে অর্থাৎ স্ত্রী আর কন্যাকে কামড়ার নিরাপত্তায় উঠিয়ে দিতে পেরে অনেকটা স্বস্তি বোধ করছেন।আর সেই জন্যই হয়ত ওনার ভদ্রতা বোধটায় একটু জোয়ার এসেছে। আমাকে যে এক রকম প্রায় ধাক্কা দিয়েই ট্রেনের পাদানি থেকে একটু আগে নামিয়ে দিয়েছিলেন সেটা মনে করে এতক্ষনে বোধহয় ওনার মনে একটু লজ্জার ভাবও জেগে উঠেছে। আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে হাঁপ ধরা গলায় একটা “সরি” বলে কোনও মতে গায়ের সব জোড় খাটিয়ে প্রথম সুটকেসটাকে দরজার ভেতর চালান করে দিলেন। আমি আশা করেছিলাম যে ওনার স্ত্রী বা কন্যার মধ্যে অন্তত একজন ওনাকে এই ট্রেনের মধ্যে মাল ওঠানোর ব্যাপারে সাহায্য করবেন। কিন্তু আদপেও তেমন কিছু হল না। তারা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেই কোথায় যেন গায়েব হয়ে গেলেন, বোধহয় নিজেদের সিটের সন্ধানে এগিয়ে গেছেন ওরা। কি বিচিত্র রে বাবা এই দুটো মেয়ে ছেলে। পেছনে ভদ্রলোক ট্রেনের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সুটকেসের ভারে হিমশিম খাচ্ছেন আর ওদের সিটের টেনশন। আরে ক্ষ্যাপা সিট কি কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে না কি! লোকটার হাবভাব দেখে বুঝতে পারছি যে সুটকেসগুলো সত্যিই বেশ ভারী। সুটকেসের নিচে চাকা থাকায় ষ্টেশন দিয়ে দৌড়ে আসার সময় তিনজনের কোনও অসুবিধা হয়নি। কিন্তু এখানে কামড়ার উচ্চতা বেশ বেশী। সুতরাং একটা সুটকেস ওঠাতেই লোকটার প্রায় অক্কা পাবার অবস্থা। দুটো সুটকেস কোনও মতে দরজার ভেতরে রেখে উনি পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন।
আমার অন্য দিকে অবশ্য “ভালো থাকিস, সাবধানে থাকিস, টাকা লাগলে সাথে সাথে কল করে জানাবি, হোটেলের বুকিং হয়ে গেছে, চেক ইন করে জানাবি” ইত্যাদি ভাষণের বন্যা অবিরল হয়েই চলেছে। এ সব কথাই আমার জানা। কিভাবে সবাধানে থাকতে হয় তাও মনে হয় আমি জানি। আর হোটেল সংক্রান্ত বা কলেজ সংক্রান্ত যে সব তথ্য বারবার আমার সামনে তুলে ধরছে ওরা সেই সবই আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। যদিও আমি ওদের সব কথা ভীষণ মন দিয়ে শোনার ভান করে ঘাড় নাড়িয়ে চলেছি, আমার চোখ আর মন, দুইই কিন্তু পড়ে আছে এই অসহায় লোকটার কার্য কলাপের দিকে। মনে মনে বেশ একটা কৌতুক অনুভব করছি ওর হাবভাব দেখে তাতে সন্দেহ নেই। লোকটা শেষ সুটকেসটা কোন মতে দরজার মুখে রাখতে যাবেন, ঠিক এমন সময় ভেতর থেকে একটা অল্প বয়সী ছেলে দৌড়ে এসে দরজার মুখে হাজির হল। ছেলেটার বয়স প্রায় আমারই মতন। দুটো সুটকেস দরজার মুখ আগলে দাঁড়িয়ে থাকায় ছেলেটা যে যারপরনাই বিরক্ত হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। “দূর বাল গান্ডু, দরজার মুখটা আঁটকে রেখে দিয়েছে” বলেই একটা সুটকেস লাথি মেরে দরজার মুখ থেকে পেছন দিকে সরিয়ে দিল, আর আরেকটা সুটকেস ততধিক বিরক্তির সাথে লাথি মেরে উপুড় করে কামড়ার মেঝেতে ফেলে দিল। লোকটা কোনও মতে ততক্ষণে থার্ড সুটকেসটা মাটি থেকে তুলে ধরেছেন। কিন্তু সেটাকে আর দরজার মুখে রাখা হল না ওনার। ছেলেটা লোকটাকে তার সুটকেস সমেত প্রায় ধাক্কা মেরে দরজার মুখ থেকে সরিয়ে দিয়ে কামরার দরজা দিয়ে নেমে ষ্টেশনের ক্যান্টিনের দিকে দৌড় মারল। সুটকেস সমেত লোকটা সশব্দে ধাই করে ষ্টেশনের মেঝেতে পড়তেই গার্ডের হুইসেল বেজে উঠল। লোকটা যে বেজায় ব্যথা পেয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। হুইসেলের শব্দে যেন কিছুটা ব্যস্ত হয়েই ওঠার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। সুটকেসটা এখনও তার হাঁটুর ওপর শুয়ে রয়েছে। ডান পায়ের হাঁটুটা ভেঙ্গে যায় নি তো? কিন্তু এই মুহূর্তে আর সময় নেই ওনার দিকে তাকানোর। বাবা, মা আর বাকি গুরুজনদের পা ছুয়ে প্রনাম করতে করতেই আড়চোখে দেখে নিলাম যে সেই অল্প বয়সী ছেলেটা ক্যান্টিনের বাইরের একটা বড় সিগারেটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকটা প্যাকেট সিগারেট, কেক, চিপস, ক্যাডবেরি ইত্যাদি একটা প্লাস্টিকে পুড়ছে, ওরও সতর্ক চোখ কিন্তু সামনের সিগন্যালের দিকে। এই লোকটার আর ওই ছেলেটা্র, দুজনেরই ট্রেন মিস করার ভয় এখন পুরো মাত্রায়। প্রনাম পর্ব শেষ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম চটপটে ছেলেটা দুটো প্লাস্টিকের থলি হাতে কোনও মতে দৌড়ে এসে আবার আমাদের সামনে দিয়ে কামড়ার ভেতরে ঢুকে ভ্যানিশ হয়ে গেল। লোকটা এতক্ষনে কোনও মতে উঠে দাঁড়িয়েছেন, সুটকেসটা যদিও ষ্টেশনের ধুলায় এখনও লুটোপুটি খাচ্ছে। উনি আমাকে সরি বলেছেন, তাই আমারও উচিৎ ওনাকে একটু সাহায্য করা। ট্রেনের শরীরে এদিকে সশব্দ কম্পন জেগে উঠেছে। ট্রেন সামনের দিকে এগোতে শুরু করেছে। আমি লোকটাকে মৃদু স্বরে বললাম, “উঠে পড়ুন। আমি ওইটা উঠিয়ে নিচ্ছি।” উনিও একটা ছোট থ্যাংকস মতন শব্দ করে চলতি ট্রেনে উঠে পড়লেন, আর আমিও ওনার পিছন পিছন ওনার ভারী সুটকেসটাকে দরজার পাদানির ওপর উঠিয়ে এক লাফে ট্রেনে উঠে পড়লাম। হাত নেড়ে সবাইকে গুডবাই জানিয়ে দরজাটা টেনে দিলাম। সবার মুখে যে গভীর দুশ্চিন্তার ছবি আঁকা হয়ে রয়েছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না। উনি আরেকবার আমাকে থ্যাংকস জানিয়ে আবার পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছতে শুরু করলেন। ওনাকে এই বিপদের সময় সাহায্য করেছি ঠিকই কিন্তু আমি ওনার কুলি নই, তাই কি ভাবে উনি এই তিনটে সুটকেস নিয়ে সিট অব্দি পৌছাবেন সে চিন্তা আমার নয়।, ওনার শেষ সুটকেসটা দরজার মুখেই ছেড়ে দিয়ে আমি ভেতরে ঢুকে গেলাম। ঝপ করে গিয়ে বসে পড়লাম জানলার ধারে। এটাই আমার সিট। আমার সামনে এখন নতুন জীবনের হাতছানি, অনেক কাজ সামনে। চিন্তায় ডুবে গেলাম।
ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে করতে একটু যেন তন্দ্রা মতন এসে গেছিল। ছোটবেলা থেকেই আমার অভ্যেস আছে যে কোনো পরিস্থিতিতে বসে ঘুমিয়ে নেওয়ার। মাঠে বসে পাথরের ওপর পিঠ দিয়ে কতবার ঘুমিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই, আর এখানে তো বদ্ধ কামড়ার মধ্যে সুন্দর এসি চলছে। কিছুক্ষণ পর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটল। খাবার অর্ডার নিতে এসেছে। একটা নন ভেজ চিকেন মিল বলে দিয়ে আবার মাথাটা ঠাণ্ডা জানলার কাঁচের ওপর নামিয়ে রেখে ঘুম লাগালাম। আমার সহ যাত্রী একটা তামিল ফ্যামিলি। আমাদের মফস্বলে ওরা কি করতে এসেছিল তা অবশ্য বুঝতে পারলাম না। কিন্তু এখন ওরা সপরিবারে ধেয়ে চলেছে কোলকাতার উদ্দেশ্য। ওনারা তামিলেই কথা চালিয়ে গেলেন। আমি তামিল বুঝি। কেন তামিল বুঝি, কি বৃত্তান্ত, সেটা বলতে গেলে লেখা বেড়ে যাবে। তাই আপাতত কাটিয়ে দিচ্ছি। ওনার আর ওনার স্ত্রীর মধ্যে যে কথা বার্তা হল সেটা থেকে বুঝলাম যে উনি কোলকাতার কোনও বড় কোম্পানিতে চাকরি করেন আর ওনার কাজের ভীষণ চাপ। আর হ্যাঁ পরে অবশ্য জানতে পেরেছিলাম যে উনি ওনার এক কুটুম্বের সাথে দেখা করতে আমাদের মফস্বলে এসেছিলেন। ওনার সেই আত্মীয় একটা বড় পাওয়ার প্ল্যান্টের ফ্লোর ম্যানেজার এই আমাদেরই মফস্বল শহরে।
রাতে খেয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার বার্থ নিচেই। ট্রেন কলকাতা পৌঁছাবে খুব ভোরে। মোবাইলে অ্যাঁলার্ম দেওয়া আছে। তবে অ্যাঁলার্মের দরকার হয়নি। ষ্টেশনে গাড়ি ঢুকবার অনেক আগেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। আসলে ঘুমটা তেমন ডিপ হয়নি। চোখ খুলে দেখলাম পুরো কামরা তখনও নিদ্রামগ্ন। চুপচাপ ব্রাশ হাতে বাথরুমের দিকে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলাম তখনও আমার কুপের সব কটা সহযাত্রী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ষ্টেশন আসতে কিন্তু আর বেশী দেরী নেই। সমস্ত কুপ জুড়ে প্রবল নাক ডাকার শব্দ। অবশ্য ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে ফিরে আসার সময় খেয়াল করলাম যে আমাদের কুপে না হলেও ভেতরের দিকে কোনও কোনও কুপের ভেতর আলো জ্বলতে শুরু করেছে।