২০১৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা মুভিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত “শিকারি” মুভিটি। একটু দেরিতে হলেও আমরা থ্রিলার মাস্টার ওয়েব পোর্টাল এর পক্ষ থেকে চলে এসেছি শিকারি মুভি রিভিউ নিয়ে। ব্যবসায়িক ভাবে সফল এই ছবিটিতে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের সুপার স্টার শাকিব খান ও কলকাতার সুইট গার্ল নামে খ্যাত অভিনেত্রি শ্রাবন্তি। যেহেতু শিকারি মূলত একটি থ্রিলার ধর্মী মুভি, তাই আজ আমরা উপস্থিত হয়েছি শিকারি মুভির রিভিউ নিয়ে।
শিকারি মুভি রিভিউ | Shikari Movie Review
প্রথমেই বলে রাখি , যারা মুভিটিকে নকল বলছেন, ভুল করছেন। এটি একটি অফিসিয়াল রিমেক। ১৯৯০ সালে মুক্তি পায় মালয়ালাম মিউজিকাল থ্রিলার মুভি ‘His Highness Abdullah’। এই মুভির কাহিনীর উপর ভিত্তি করে ২০০৯ সালে মুক্তি পায় তামিল অ্যাকশন মুভি ‘Aadhavan’। আধাভান মুভির কপিরাইট নিয়েই তৈরি হয়েছে বাংলা রিমেক মুভি ‘শিকারি’। কপিরাইট কিনে নিয়ে রিমেক করা আর নকল করা এক জিনিস নয়! তাই না বুঝে মুভিটিকে নকল মুভি বলা থেকে বিরত থাকুন। এবার আসুন মুভিটির কাহিনি সংক্ষেপে জেনে নেই-
সংক্ষিপ্ত কাহিনী
কলকাতার একটি স্থানে হঠাৎ করে কিছু নিখোঁজ বাচ্চার লাশের কংকাল, হাড়গোড় খুঁজে পাওয়া গেল। এরপর সেই কেসের তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হলো জজ রুদ্র চৌধুরীর উপর। রুদ্র চৌধুরী একজন সৎ মানুষ ও আইনের প্রতি আস্থাশীল। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সব কিছু করতে পারেন। তাই হত্যাকান্ডের মূল হোতা (সিনেমার মেইন ভিলেন) ভয় পেয়ে গেল যে তার গোমর ফাঁস হয়ে যেতে পারে! তাই নিজের মিশন ঠিক ঠাক রাখতে সে জজকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু ভারতের কোন কন্টাক্ট কিলারকে কাজটা দিলে ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে যেতে পারে, এই ভয়ে জজকে মারা দায়িত্ব দেওয়া হলো বাংলাদেশের কন্ট্রাক্ট কিলার সুলতানকে। এই সুলতানের আসল নাম হচ্ছে রাঘব। ছোটবেলা থেকেই জজ বাবার অবাধ্য ছেলে রঘু ওরফে রাঘব। ঘটনাচক্রে একদিন বাবার হাতেই গুলি করে পালিয়ে যায় বাড়ি থেকে। এবার বন্ধুর মাকে খুন করে শুরু হয় তার কিলিং মিশন! সেখান থেকে পালিয়ে এসে পরে বাংলাদেশে। হয়ে ওঠে সুলতান। নিজেকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলে সুলতান। টার্গেট কিলিংয়ে যার তুল্য আর কেউ নেই। কিন্তু জজকে শ্যূট করতে গিয়ে সে আবিস্কার করে যে এটা তার নিজের বাবা! এরপর মুভির কাহিনীর মোড় ঘুরে গেল! পিতাকে বাঁচানোর জন্য অভিনব কায়দায় জজের বাড়িতে বাবুর্চি হিসেবে আশ্রয় নেয় সুলতান। এগুতে থাকে মুভির কাহিণী। লোক দেখানো একের পর এক টার্গেট মিস চলতে থাকে। এদিকে আস্তে আস্তে বেড়িয়ে আসে ছোটবেলার রঘুর পরিচয়। নায়িকার কাছেই সবার আগে ধরা দেয় সুলতান। বাবার নিকট প্রচন্ড ঘৃণীত রাঘব তার আসল পরিচয় প্রকাশ করতে পারে না পিতার কাছে। চলতে থাকে মুভি। এগুতে থাকে নায়ক-নায়িকার প্রেম। বাড়তে থাকে কাহিণীর গভীরতা… কাহিনী আর বেশিদূর বলবো না। বাকিটা মুভিতে দেখে নেবেন।
অভিনয়
এবারে মুভির অভিনেতা অভিনেত্রিদের পারফর্মেন্স নিয়ে কিছু কথা বলি-
খুবই সাধারণ গল্পের প্লটকে অসাধারণ রূপ দিয়েছেন শাকিব খান। নিজেকে ভেঙ্গে নতুন করে গড়েছেন। তার লুক, অভিনয়, এক্সপ্রেশন, প্রেজেন্টেশন সবই ছিল পারফেক্ট। একই মুভিতে তাকে দেখা গেছে ভিন্ন ভিন্ন রূপে, কখনো প্রফেশনাল কিলার সুলতান, কখনো রাঘব ওরফে রঘু।
সাকিব-শ্রাবন্তী জুটি নিয়ে আলাদা করে না বললেই নয়। এই প্রথম দুজনে জুটি করলেও তাদের ভিতরের বোঝাপড়া ছিলো অসাধারণ। শ্রাবন্তীর গ্লামার সাকিবের বিপরীতে ফুটে উঠেছে বলেই এই একশন মুভিতে রোমাঞ্চকর অনুভূতি সত্যিই পুলকিত করে। দুই জন দুজনের জায়গায় ছিল একদম পারফেক্ট। এই মুহুর্তে একে সমগ্র বাংলার পারফেক্ট জুটিও বলাও যেতে পারে!
মুভির প্রথমার্ধে শাকিবকে দারুণ সাপোর্ট দিয়েছেন খরাজ মুখার্জী তার অনবদ্য কমেডি পারফর্মেন্স দিয়ে। প্রতিটা মানুষ হাসতে বাধ্য তার এই অভিনয় দেখে। রাহুল দেব এবং সব্যসাচীর মত শক্তিমান অভিনেতা তাদের সেরাটাই দিয়েছেন। তবে ভিলেন হিসেবে রাহুল দেবের স্ক্রিনটাইম খুব কম ছিল, তাই তার ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট খুব একটা হয়নি এই মুভিতে।
বরাবরের মতই শিকারি মুভিতে শ্রাবন্তীকে মিষ্টি লেগেছে। একটু মুটিয়ে গেছেন, কিন্তু তারপরও গ্লামার ছিল অক্ষুন্ন। যেহেতু মুভির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে নায়ককে ঘিরে, তাই তার তেমন কিছু করার ছিল না আসলে। তবে নিজের অভিনয়ের জায়গাটুকুতে শ্রাবন্তি ছিলেন সাবলীল। নায়কের দাদীর চরিত্রে লিলি চক্রবর্তী চমৎকার অভিনয় করেছেন। অমিত হাসান কিংবা সুব্রতর বিশেষ কোন ভূমিকা ছিলো না মুভিতে। যেহেতু যৌথ প্রযোজনার মুভি, তাই বাংলাদেশের দুইচার জনকে না নিলে হয় না। এই কারনেই আসলে তাদেরকে নেয়া।
গান, কস্টিউম এবং দৃশ্যায়ন
মুভিতে মোট ৪টা গান আছে, প্রথমেই বলব ‘মমচিত্ত্বে’ গানটির কথা। মুভিতে রবীন্দ্র সঙ্গীতের এত ভাল ব্যবহারের দেখা খুব কমই পাওয়া যায়। গতানুগতিক কমার্শিয়াল মুভিতে এত চমৎকারভাবে একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত মিশে যেতে পারে তা গানের দৃশ্যায়ন না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করতে পারতো না। নিঃসন্দেহে মুভির সেরা গান ছিল এটি। এরপর ‘উঠ ছুড়ি তোর বিয়ে’- গানটাও চমৎকার লেগেছে। ‘আর কোন কথা’ গানে শাকিব শ্রাবন্তীর কেমিস্ট্রি ভাল ছিল, আর ‘হারাবো তোকে’ –তো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পুরো ছবির পাশাপাশি গানগুলোতেও কস্টিউম, গেটআপ আর লোকেশন ভাল ছিল। তবে রোম্যান্টিক গানদুটোতে শাকিব খানের টাইট ফিট লেডিস জাতীয় প্যান্ট একটু দৃষ্টিকটু ছিল। শাকিব খানকে বিভিন্ন গানে এই ধরণের প্যান্ট কেন পড়ানো হয় তা আজও বুঝতে পারলাম না!
তবে ওভারল বলা যায় যে, মুভির প্রেজেন্টেশন বেশ ভাল ছিলো। আড়াই ঘন্টারও বেশি দীর্ঘ এ মুভি দেখে একবারের জন্যেও মনে হয়নি বিরক্ত লাগছে কিংবা উঠে যাই। মেকিং, ক্যামেরা এঙ্গেল, এডিটিং, ইফেক্টের কাজ, কালার কারেকশন, ড্রোনের শট- সবকিছুই ভাল হয়েছে। পরিচালক এই জন্য একটা ধন্যবাদ পেতেই পারেন (যদিও এখানে একটা “কিন্তু” আছে। সে কথায় একটু পরে আসছি)।
শিকারি মুভি রিভিউ – কিছু সমালোচনা
অনেক তো হলো মুভির প্রশংসা। এবার কিছু সমালোচনাও করি। কারণ, শিকারি মুভিটি বেশ ভাল হলেও সমালোচনার উর্ধে যেতে পারেনি।
সবকিছু ভালো হওয়ার পরেও কিছু অপূর্ণতা থেকেই গেছে মুভিটি দেখার পর। এক্ষেত্রে প্রথমেই বলব- মুভির পরিচালক কে- এটা নিয়ে এত জল ঘোলা করা হল কেন? তাছাড়া, কপিরাইট করে রিমেক করা হয়েছে মুভি, অথচ চিত্রনাট্যে আব্দুল্লাহ জহির বাবু এবং পেলের নাম দেখলাম। করাইট আমি কিনেছি তার মানে এই না যে আসল লেখকের বদলে অন্যের নাম বসিয়ে দেওয়া যাবে! মুভির একটা অন্যতম সমস্যা হচ্ছে- ভিলেনকে পেয়েছি আমরা একদম অল্প সময়ের জন্য। ভিলেনের স্ক্রিনটাইম আরেকটু বাড়ানো যেত।
বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগে হলেও আমাদের অভিনয় শিল্পীর ব্যবহার এখানে মাত্র ২ জন! মূল চরিত্র সাকিব খান এবং পুলিশ কমিশনারের “দুধ-ভাত” চরিত্রে অভিনীত অমিত হাসান ছাড়া বাকি সব অভিনয় শিল্পীই ছিলেন ওপার বাংলার।
দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত মুভির ক্ষেত্রে আমরা যেটা দেখি- এর কিছু অংশের চিত্রায়ন উভয় দেশেই হয়ে থাকে। কিন্তু এই মুভিটিতে মাত্র ১০ সেকেন্ড এর (সেটাও বাংলাদেশ কি না তা বোঝা কষ্টসাধ্য!) মতো সময় মাত্র চিত্রায়ন হয়েছে বাংলাদেশে । বাকি সম্পূর্ণ চিত্রায়নের প্রেক্ষাপট “ভারত”! এই অসংগতি খুব সহজেই চোখে ভেসে ওঠে। ব্যাপারটা মোটেও ভাল লাগেনি এপাড় বাংলার দর্শকদের।
মুভির গানগুলো গাওয়ার জন্য একজনও আমাদের দেশীয় সিঙ্গার নেই! এটা মেনে নিতে কষ্টই হয় বটে । Jaaz কর্তৃপক্ষ মনে হচ্ছে এখানে টাকা পয়সা ঢেলে ননীর পুতুলের মত বসে থাকা ছাড়া কিছুই করেনি। এখানে তারা ভূমিকা রাখতে পারতো। বাংলাদেশের কণ্ঠশিল্পীরা দুই চার পয়সা আয় করুক, এটা কি তারা চায় না? “আর কোন কথা না হবে” টাইটেলের গানটা অরিজিত্ সিং থেকেও আমাদের হাবিব, হৃদয় খান বা আরেফিন রুমির কণ্ঠে আরো বেশি ভাল হতো মনে করি। তাছাড়া “হারাবো তোকে” গান টা শুনেই মনে হচ্ছিল এই গান হাবিবের গাওয়ার জন্য সৃষ্টি হয়েছে! এই বিষয়টাতে আমি সত্যিই খুব বেশি হতাশ হয়েছি।
Shikari Movie Review শেষে কিছু কথা
কিছু ভুল ভ্রান্তি থাকা সত্ত্বেও নিঃসন্দেহে শিকারি ২০১৬ সালের বেস্ট বাংলা মুভি।
কারণ শিকারি প্রমাণ করেছে শাকিবের মত একজন দক্ষ অভিনেতা থাকার পরেও শুধুমাত্র ভালো প্রেজেন্টেশন আর ডিরেকশনের অভাবে দেশের এই ১ নম্বর সুপারস্টারকে সবমহলের মন জয় করতে আগে দেখা যায়নি। যেটা এবারে হয়েছে। এর থেকেই বোঝা যায় সব মহলেই চলছে শাকিবের শিকারি উন্মাদনা। এটি সম্পূর্ণ কমার্শিয়াল মুভি হলেও নিরেট পারিবারিক বিনোদনের উদাহরণ। তাছাড়া মুভিটি IMDB রেটিং পেয়েছে ৭.১।
মশলাদার, অশ্লীলতা কিংবা আইটেম সং ছাড়াও যে এসময়ে ফুল কমার্শিয়াল হিট মুভি হয় তার প্রমাণ শিকারি। আমি কোন কালে শাকিব হেটার ছিলাম না, তাই বলে শাকিব লাভারও ছিলাম না। এর প্রধান কারণ তার মুভিগুলোর গল্প আমার ভাল লাগতো না একদমই। কিন্তু এ কথা বলতেই হয় যে, ‘শিকারি’ মুভিটা দেখে সত্যিই আমরা নড়েচড়ে বসেছি। সব শেষে মুভির ফিনিশিংটা দেখার পর মনে একটা ভালো লাগার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য। শেষ ভাল যার সব ভাল তার! কিন্তু মুভি শেষ হয়ে যাওয়ার পর সেখানে একটা গান দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে কি না সে বিষয়ে খানিকটা সন্দিহান আমি। অনেক আগের পুরনো বাংলা ছবিতে এই ধরণের প্র্যাকটিস দেখতাম আমরা। তার একটা স্বাদ পাওয়া গেল।
এই ছিল শিকারি মুভির বিস্তারিত রিভিউ। আশাকরি আপনারা মুভিটা দেখবেন। আজকের মত বিদায় নিচ্ছি। আগামীতে অন্য কোন মুভির রিভিউ নিয়ে হাজির হব। জয় হোক বাংলা চলচ্চিত্রের- এই প্রত্যাশা করি।