একজন সৈনিক যে যুদ্ধের ময়দানে লড়ছে, অস্ত্র হাতে নয়, ফাস্ট এইডের ব্যাগ হাতে! কাউকে মারার জন্য সে যুদ্ধ করছে না, সে যুদ্ধ করছে অসহায়-আহত মানুষকে বাঁচানোর জন্য। তার শরীরে হয়তো একজন সাধারণ সৈনিকের মতো শারীরিক সামর্থ্য নেই, কিন্তু তার আছে পাহাড়ের সমান দৃঢ় মানসিকতা। ঠিক তেমন একজন সৈনিক হচ্ছেন ডেসমন্ড ডস। না, এটা কোন মুভির কাহিনী নয়। ডেসমন্ড ডস ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউএস আর্মির একজন কম্ব্যাট মেডিক। তার জীবন ও সেসময়কার কিছু ঘটনা নিয়ে নির্মিত হয়েছে হ্যাকসও রিডজ নামের মুভিটি।
হ্যাকসও রিডজ – দা হেল অন আর্থ
সংক্ষিপ্ত কাহিনী
ডেসমন্ড ডস ছিলেন একজন ‘কনসিয়েন্সেস অবজেক্টর’, যার মানে তিনি আর্মির নিয়মকানুন না মেনে নিজের কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন তার মুক্তচিন্তা বা ধর্মের কারণে। ডেসমন্ড ডস বাইবেলের সিক্সথ কমান্ডমেন্ট ‘কাউকে হত্যা করা যাবে না’, এই নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। যার ফলে আর্মিতে যেতে চাইলেও, তিনি কখনো অস্ত্রধারণ বা যুদ্ধক্ষেত্রে হত্যা করতে পারবেন না, এই দাবী করেন। যে কারনে তার বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শালও জারি হয়েছিল। কিন্তু ‘কনসিয়েন্সেস অবজেক্টর’ নিয়ম এর আওতায় থাকার ফলে তিনি পুনরায় কাজ করতে থাকেন। অতঃপর আসে ‘হ্যাকস রিজ’ এর মুহূর্তগুলি। সংক্ষেপে এই হচ্ছে হ্যাকসও রিডজ – দ্যা হেল অন আর্থ এর কাহিনী।
অভিনয়
মুভির মূল চরিত্র ডেসমন্ড ডজ এর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অ্যামাজিং স্পাইডারম্যান খ্যাত এন্ড্রু গারফিল্ড। আর ‘হ্যাকস রিজ’ এর মাধ্যমে দশ বছর পরে আবার পরিচালকের আসনে বসলেন শক্তিমান অভিনেতা মেল গিভসন। এই মুভিটি হয়তোবা তার ‘ব্রেভহার্ট’ এর মতো কিংবদোন্তীতূল্য সম্মান পাবে না, কিন্তু এটি ২০১৬ সালের অন্যতম সেরা একটি মুভি। এখানে তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন ‘হেল অন আর্থ’ নামে খ্যাত হ্যাকস রিজের সবচেয়ে ভয়াবহতম দিক তুলে ধরতে। সেই সাথে তিনি চেষ্টা করেছে- মনুষ্যত্ব তুলে ধরতে, জীবনের আসল উদ্দেশ্য খুঁজে বের করতে। বলা যায় যে তিনি সফল ছিলেন এই কাজে।
অ্যান্ড্রু গারফিল্ড যে একজন ভালো অভিনেতা সেটা প্রায় ভুলে যেতে বসার সময়েই গিবসন তার সেরাটা বের করে আনলেন তার ভেতর থেকে। একজন ছেলে, একজন স্বামী, একজন সৈনিক; সবার উপরে একজন মানুষ হিসেবে ডেসমন্ড ডসের সম্পূর্ণ ধারনাটা মেল গিবসন তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। আর তার সাফল্যকে সফল করতে নিজেও অভিনেতা হিসেবে কঠোর কাজ করলেন অ্যান্ড্রু। ডেসমন্ড ডসের সহজ-সারল্য, উচ্চারণ, আর যুদ্ধের ময়দানে ডেসমন্ড ডসের বর্ণনার মতোই অভিনয়। এটি অবশ্যই মনে রাখার মতো এবং অ্যান্ড্রুর সেরা কাজ।
দৃশ্যায়ন এবং মিউজিক
মেল গিবসনের দারুন পরিচালনার পাশাপাশি ক্যামেরার দুর্দান্ত কাজ দেখিয়েছেন সাইমন ডুগ্যান। শুধুমাত্র পাহাড়ের তলা থেকে হ্যাকস রিজ পর্যন্ত দেখানোর সময়টার জন্যই তার আলাদা একটা টুপিখোলা সম্মান প্রাপ্য। আর এই চমৎকার ক্যামেরার কাজের সাথে আছে রুপার্ট গ্রেগসন উইলিয়ামসের অনবদ্য ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। যুদ্ধক্ষেত্র চোখ দেখিয়েছেন মেল গিবসন। আর সেটা একদম মাথায় আঘাত করেছে এই ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক।
কাহিনী রিভিউ এবং মতামত
হ্যাকসও রিডজ মুভির কাহিনী ডেসমন্ড ডস তথা গারফিল্ডকে ঘিরে আবর্তিত হলেও সাপোর্টিং কাস্টে হুগো ওয়েভিং, স্যাম অর্থিংটন, ভিন্স ভন বা রিচার্ড রোক্সবার্গের মতো অভিনেতারা ছিলেন। ডেসমন্ড ডসের স্ত্রী ডরোথি হিসেবে টেরেসা পালমার ভালো অভিনয় করেছেন। তবে সব মিলিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিটি অভিনেতারা দারুণ সাপোর্ট দিয়ে গেছেন কাহিনী এবং অ্যান্ড্রুকে।
‘ব্যাটল অব ওকিনাওয়া’-এর সময়ে ‘মায়েদা’ নামক পাহাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে উপরে উঠে ডেসমন্ড ডসের বাহিনীকে যুদ্ধ করতে হয়। আর তারা এই ঢালের নাম দেন ‘হ্যাকস রিজ।’ ডেসমন্ড ডস যুদ্ধ থেকে ফিরে কখনোই বই লিখা বা মুভি তৈরির প্রতি আগ্রহ দেখাননি। অনেকে তাকে রাজি করার ব্যর্থ চেষ্টার পরে ২০০১ সালে তাকে রাজি করান বিল ক্রসবি এর নাতি চিত্রনাট্যকার গ্রেগরি ক্রসবি। ডকুমেন্টারির চিন্তা এর পরে অবশেষে লাইভ-অ্যাকশন মুভি তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অ্যান্ড্রু নাইট ও রবার্ট শেনক্যানের চিত্রনাট্যে পরিচালনায় আসেন মেল গিবসন।
এখন আসি, কেন ডেসমন্ড ডস বিখ্যাত্ কেনইবা তিনি একটি মুভি পাবার যোগ্যতা রাখেন। তিনি ছিলেন ‘কনসিয়েন্সেস অবজেক্টর’ হিসেবে ইউএস আর্মির সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘মেডেল অব অনার’ পাওয়া প্রথম সৈনিক। আর তিনি এই সম্মাননা পান, ‘ব্যাটল অব ওকিনাওয়া’-তে হ্যাকস রিজে ৭৫ জন সৈন্যকে মেডিক্যাল সহায়তা দিয়ে। কোনো অস্ত্র ছাড়াই তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ৭৫ জনকে উদ্ধার করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠান। এবং আর কারো সাহায্য ছাড়া, সম্পূর্ণ একা। মুভিটি দেখার পরে আরো ভালোভাবে বুঝতে পারবেন অনেক কিছু। বদলে যেতে পারে আপনার চিন্তা।
কেন হ্যাকসও রিডজ মুভিটি অবশ্যই দেখা উচিত?
হ্যাকসাও রিডজ সিনেমার অনেক অংশই অনেকদিন মনে রাখার মতো ছিল। তবে মুভির একটি অংশ কখনোই ভুলতে পারবো না। সেটা বলতে গেলে একটু একটু স্পয়লার হয়ে যাবে। তারপরও বলার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। মুভিতে একটা দৃশ্য আছে যেখানে একজন জাপানী আহত যোদ্ধা ঠিক ডেসমন্ড ডসের পাশে অবস্থান করছে। যেহেতু সে আমাদের শত্রু, তাই সেখানে আমরা থাকলে কী করতাম? অবশ্যই তাকে মেরে ফেলতাম। যেন তার কারণে নিজের গোপনীয়তা প্রকাশ না পায় শত্রুপক্ষের কাছে। কিন্তু ডেসমন্ড ডস তা করেন নি। তিনি তার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। হ্যাঁ, তিনি ভয়ার্ত ছিলেন পুরো সময়টা। কিন্তু সাহস হারান নি।
এইরকমভাবে একজন সাধারণ মানুষের জীবনের অসাধারণ কিছু গল্প তুলে ধরা হয়েছে হ্যাকসও রিডজ মুভিতে। যার পুরষ্কারস্বরূপ এই মুভি গোল্ডেন গ্লোবে পেয়েছে সেরা মুভি, সেরা অভিনেতা ও সেরা পরিচালকের নোমিনেশন। মেল গিবসন হয়তোবা আরেকটা মাস্টারপিস বানাতে পারেননি এখানে। কিন্তু তিনি একটি মাস্টারপিস ধারণাকে তুলে ধরতে পেরেছেন খুব ভালোভাবেই। মুভিটির আইএমডিবি রেটিং ৮.২। কিন্তু আমার মতে এটি আরও বেশি রেটিং পাওয়ায়র যোগ্য। আপনাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে- আপনারা মুভিটি অবশ্যই দেখবেন।
আজকের মত এ পর্যন্তই! ভালো থাকুন সবাই। আগামী অন্য কোন মুভি রিভিউ নিয়ে হাজির হয়ে যাব। বাংলা মুভি শিকারি নিয়ে রিভিউ করেছি। মুভিটা না দেখে থাকলে রিভিউটা অবশ্যই পড়ুন!