মোল্লা ভাইয়ের হেকমত
মূল লেখকঃ জনাব ডাঃ আফতাব হোসেন।
এক মনে স্যান্ডেল ব্রাশ করছিলেন মোল্লা ভাই। চামড়ার স্যান্ডেল। চার বছর আগে কেনা। একমাত্র ঈদের নামাজ ও বিয়ে জাতীয় বিশেষ উপলক্ষ ছাড়া এই স্যান্ডেল পরেন না তিনি। তাই এখনও নতুনের মতোই আছে। তবে চামড়ার জিনিষ, সারা বছর জুতার বাক্সের মধ্যে পড়ে থেকে থেকে ফাঙ্গাস পড়ে গেছে। ব্রাশ করে সেটাই তুলছেন মোল্লা ভাই। তারপর রোদে দেবেন। দুদিন রোদে শুকিয়ে তবেই কালি করবেন। মুচিদের সব সরঞ্জামই মজুদ আছে ঘরে। আগে তাও গলির মোড়ে, বাজারের মুখে, মুচিদের বসে থাকতে দেখা যেত। এখন মানুষের জুতো স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেলে ফেলে দিয়ে নতুন এক জোড়া কিনে নেয়। মুচিদের কাজ নাই। তাই তাদের দেখাও মেলে না। অপব্যয় মোটেই পছন্দ নয় মোল্লা ভাইয়ের। নিজের, বউয়ের, ছেলের, ছেলে বউয়ের, জুতো স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেলে ভোমর দিয়ে নিজেই সেলাই করে দেন। কালি, ব্রাশ করে চকচকে করে দেন। নিজের কাজ নিজে করার মাঝে কোনো লজ্জা নাই। টুকটাক কাজ করলে বরং অবসরে যাওয়া শরীরটা ফিট থাকে।মূল লেখকঃ জনাব ডাঃ আফতাব হোসেন।
- এই যে হুনছেন ? দোকান পাট সব খুইল্যা দিছে। আমারে শপিং এ নিয়া যাইবেন না ?
শুনে চমকে ওঠেন মোল্লা ভাই। কখন স্ত্রী সায়রা বানু এসে দাঁড়িয়েছেন, টের পাননি। মোল্লা ভাইয়ের সম্পূর্ণ বিপরীত সে। দশাসই দেখতে। সারা জীবন সরকারি চাকরী করায় মোল্লা ভাইয়ের ব্যাংকে টাকা যেমন উপচে পড়ছে, সারা জীবন শুয়ে বসে খেয়ে খেয়ে সায়রা বানুর শরীরের মেদও তেমন উপচে পড়ছে। এক শাড়ি দিয়ে তারে বেঁধে রাখা দায়। শরীর হাতীর মতো হলেও মুখখানা তার ভারি মিষ্টি। ঐ মুখের দিকে তাকালে মোল্লা ভাই বউয়ের সব অপচয়ের কষ্ট ভুলে যান। সেই বউয়ের মুখে আজ খুশির সুনামি। দেখে মোল্লা ভাইয়ের গলা শুকিয়ে ছাই। ধড়ফড় করে ওঠে বুক। একবার মোল্লা ভাবি শপিঙে গেলে তিন মাস মোল্লা ভাইয়ের বুকে ব্যথা থাকে। অথচ বউয়ের মুখের উপর না বলার সাহস নেই তার। সব রাগ যেয়ে পড়ে সরকারের উপর। ক্যানো রে বাপু ? এই লক ডাউনের মধ্যে দোকান পাট খোলার কী দরকার ছিল ? এই যে করোনায় লোক মরছে হাজারে হাজার, সে খেয়াল আছে ? তিনি মিনমিন করে বলেন,
- না, মানে বলছিলাম কী, এই করোনার মধ্যে মার্কেটে যাবা ?
- মর জ্বালা। তাতে আমাগো কী ? আমরা তো দুই ডোজই টিকা লিয়া লইছি। আপনেই তো কইছিলেন, টিকা নিলে করোনার বাপেও কাছে আইবো না। অহন আবার করোনার ভয় দেখাইতাছেন ক্যালা ? নাকি শপিঙের কতা হুইন্যা গলা হুকাইয়া গ্যাছে গা ?
মোক্ষম জবাব। সায়রা বানুর ইনজেকশনে খুব ভয়। “টিকা নিলে জীবনে আর করোনা হবে না” এই পট্টি পড়িয়ে টিকা নিতে রাজী করিয়েছিলেন। এখন তো আর করোনার ভয় দেখালে চলবে না। চিকন বুদ্ধির মানুষ মোল্লা ভাই। বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রাখেন। তিনি তার সুন্নতী দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,
- হে হে হে, কী যে কও সায়রা বানু। তুমি হইলা গিয়া এই রাজ্যের রাণী। আমি কামলা, গোলাম মানুষ। তোমার রাজত্বে বাস করে তোমার হুকুম তামিল না করে পারি ?
- পট্টি মাইরেন না মোল্লা সাব। ঝাঁইরা কাশেন দিহি। অসুবিধা কোন হানে ?
- না, না। কোনো অসুবিধা নাই। তয় জানো তো, দোকান পাট খুললেও দেশে এখনও কঠোর লক ডাউন চলছে।
- কিয়ের কলার লক ডাউন ? আমারে বেকুব পাইছেন ? গার্মেন্টস খোলা, মিল কারখানা খোলা, ব্যাংক খোলা, হাট বাজার খোলা, আর এখন তো দোকান পাটও সব খুইল্যা দিছে। টেলিভিশন খুললে তো দেহি পিঁপড়ার লাহান পিলপিল করতাছে মানুষ। বাস ছাড়া সব গাড়ি রাস্তায়। লক ডাউন তো এহন বাস, লঞ্চ আর ট্রেন ডাউনে আইস্যা ঠেকছে। দেহেন মিয়াঁ, এই লক ডাউনের ডর আমারে দেহাইয়েন না। শপিঙে নিবেন কিনা হেইডা কন ?
মোল্লা ভাইয়ের বুঝতে অসুবিধা হয় না, বেশ আট ঘাট বেঁধেই এসেছে সায়রা বানু। বেশি গাইগুই করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তিনি সতর্ক হয়ে যান। উৎসাহের ভাব নিয়ে বলেন,
- বেশক শপিঙে নিয়া যাব। তয় আমার দু’খান কথা আছে।
- দুইখান ক্যান, চাইর খান কন।
- না, মানে, শপিঙে কি রিকসায় যাবা না গাড়িতে যাবা ? যদি রিকসায় যাও, তাহলে কোনো কথা নাই। আর যদি গাড়িতে যাও, তাহলে দুটো কথা আছে।
- মর জ্বালা। নিজের গাড়ি থাকতে রিকসায় যামু ক্যালা ? গাড়িতেই যামু।
এই ভয়টাই করছিলেন মোল্লা ভাই। সরকারি চাকরিতে সরকারী গাড়ি ছিল। ইচ্ছে মতো সরকারী তেলে ঘোরা যেত। অবসরে যাবার পর স্ট্যাটাস মেইনটেইন করার জন্য গাড়ি একটা কিনলেও সব সময় সেটা গ্যারেজেই পড়ে থাকে। নিজে ড্রাইভিং জানেন না মোল্লা ভাই। একজন পার্ট টাইম ড্রাইভার আছে। সপ্তায় একদিন আসে। গাড়ির ইঞ্জিন গরম করে। সায়রা বানু কোথাও যেতে চাইলে নিয়ে যায়। নিজে পারতে সাধ্যে গাড়িতে চড়েন না। কী লাভ শুধু শুধু নিজের তেল পুড়িয়ে আর টায়ার ক্ষয় করে ? গাড়ির বদ্ধ জায়গার চাইতে রিকসার খোলা হাওয়াতেই বেশি আনন্দ। তাছাড়া সপ্তার মাঝখানে ড্রাইভার কল করলে এক্সট্রা পয়সা দিতে হবে। কোনো মানে হয় এই অযথা অপচয়ের ? কিন্তু এ সব কথা সায়রা বানুকে বলতে গেলে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যাবে। তিনি একটু ভেবে নিয়ে বলেন,
- দ্যাখো, রিকসায়, স্কুটারে গেলে পুলিশ ঠেক দেয় না। মুভমেন্ট পাশও দেখতে চায় না। তাদের যত রাগ এই গাড়ি আলাদের উপর। মুভমেন্ট পাশ দেখাও। আইডি কার্ড দেখাও। পারলে তো কাপড় খুলেও চেক করে।
- চেক করলে করুক। আপনে মুভমেন্ট পাশ বাইর করেন।
- চাইলেই তো আর বের করা যায় না বউ। সেদিন কাঁচা বাজারে যাওয়ার জন্য পাশ বের করতে পাকা তিন ঘণ্টা লাগল। পাশ তো পেলাম, কিন্তু বাজারে যেয়ে কাঁচা তরকারি আর পেলাম না। কড়া রোদে সব পেকে গেছে। আর এবার তো তিন তিনটে পাশ বের করতে হবে। তবে তুমি কোনো চিন্তা কইরো না বউ। পাশ না পেলেও আমরা যাব। বড় জোর মামলা দেবে। জেল জরিমানা হবে। হোক। তাতে কী ? বউয়ের জন্য এইটুকুন তো করতেই পারি।
- না না, মামলা টামলা খাইতে হইব না। পাশ পাইলেই যামু। নাইলে না।
- কিন্তু পাশ নিয়ে গেলি একটু অসুবিধা আছে।
- আবার কী অসুবিধা ?
- দেখো, পাশ ছাড়া গেলে কেউ জানতে পারবে না, কতক্ষণ বাজারে ছিলা। কিন্তু মুভমেন্ট পাশের মেয়াদ তো মাত্র তিন ঘণ্টা। আসতে যেতে দুই ঘণ্টা। মাঝ খানে এক ঘণ্টায় শপিং করতে হবে। পারবা ?
- কী আর করমু ? পারতেই হইব।
- আচ্ছা, শপিং কি ফুটপাতে করবা না শপিং মলে করবা ?
- আপনের কি মাথা খারাপ হইয়া গ্যাছে মোল্লা সাব ? আমি যামু ফুটপাতে? আমার একটা ইজ্জত আছে না ? আলবৎ শপিং মলে যামু।
- ফুটপাতে হলে কোনো কথা ছিল না। কারণ ফুটপাতে স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই নাই। কিন্তু শপিং মলে গেলে “কঠোর স্বাস্থ্যবিধি” মানতে হবে।
- মানে কী ? কী স্বাস্থ্যবিধি?
- স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এক সাথে অনেক লোক মলে ঢুকানো যাবে না। সে ক্ষেত্রে, ব্যাংকের মতো মলের বাইরে তোমাকে লাইনে দাঁড়ায়ে থাকতে হতে পারে।
- অসুবিধার দেহি শ্যাষ নাইকা। আচ্ছা, থাকুমনে লাইনে খাড়াইয়া। আর কিছু ?
- লাইনে দাঁড়ানো তো মুশকিল না সায়রা বানু। মুশকিল হল সময়। কতক্ষণ লাইনে দাঁড়ায়ে থাকতে হবে, নির্ভর করছে লোক সমাগমের উপর। আচ্ছা, তুমি কি সালোয়ার কামিজ কিনবা না শাড়ি কিনবা ?
- মর জ্বালা। মোল্লা সাবের মাথাটা কী পুরাই গ্যালো ? আমার যা স্বাস্থ্য মাশ আল্লাহ, কামিজ দিয়া কি ঢাকোন যাইব? শাড়ি, তাই ব্লাউজ পিস না কাইটা পিন্ধন লাগে।
- সালোয়ার কামিজ কিনলে কোনো কথা ছিল না। বড় বড় ব্রান্ডের দোকানে সব সালোয়ার কামিজ ড্রেস স্ট্যান্ডে ঝুলানো থাকে। তুমি সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পছন্দ করতে পারতা। সাইজ বললে সেলস গার্ল তোমাকে আনকোরা নতুন প্যাকেট দিয়ে দিত। কিন্তু শাড়ি কিনতে হলে তো তোমাকে একটু ছোট দোকানে ঢুকতে হবে।
- তাতে আর অসুবিধা কী ? সব সময় সেই রকম দোকান থনই তো শাড়ি কিনি।
- অসুবিধা আছে। ছোট দোকানের যে সাইজ, তাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গেলে বড় জোর এক সাথে তিন জন খদ্দের ঢুকাতে পারবে। তোমার হাতে আছে বড় জোর আধ ঘণ্টা সময়। আগের মতো দশ দোকান ঘুরে, একশো শাড়ি দেখে, একটা কেনার সময় পাবা না। তুমি এক দোকান থেকেই শাড়ি কেনার সময় পাবে।
- এক দোকান থনই কিনমু। হইছে ? নাকি আরও কিছু কইবেন ?
- আর মাত্র অল্প কিছু। শাড়ি কি তুমি শুধু রঙ দেখেই প্যাকেট অবস্থায় কিনবা নাকি আগের মতো খুলে, দেখে শুনে কিনবা ?
- কী সব আউলা ঝাউলা কথা কন মোল্লা সাব ? শাড়ি কি কেউ শুধু রঙ দেইখা কেনে ? শাড়ি পুরা খুইলা দেখতে হয়, জমিন কেমুন ? ছাপার ডিজাইন কেমুন ? সেলস ম্যান নিজের গায়ে জড়াইয়া দেখাইবো, পড়লে দেখায় কেমুন? এই রকম দশটা শাড়ি দেইখাই না একটা কিনতে হয়। আপনে তো জানেন, আমার আবার সহজে কিছু পছন্দ হয় না।
- সে কথা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে ? তবে ছোট্ট একটু মুশকিল যে রয়েই গেল সায়রা বানু।
- আবার কী মুশকিল ?
- আল্লাহই জানেন, কত জনকে দোকানদার একই শাড়ি খুলে দেখিয়েছে। কত জন সেই শাড়ি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখেছে ? কত জন সেলস ম্যান সেই শাড়ি নিজের গায়ে জড়িয়ে দেখিয়েছে। কে জানে, এই এত মানুষের মধ্যে কত জনের হাতে, কত জনের নিশ্বাসে ছিল করোনা। সেই করোনা তো শাড়ির সুতোর ফাঁকে ফাঁকে গেঁথে গেছে। জীবাণু মুক্ত না করে তো পরা যাবে না। আর জীবাণু মুক্ত করতে হলে কমপক্ষে আধ ঘণ্টা ওয়াশিং পাউডার দিয়ে শাড়ি সিদ্ধ করতে হবে।
- আয় হায়, কন কী ? সিদ্ধ করলে কি আর শাড়ি নতুন থাকে নিকি ? সবাই তো কইব, ঈদের দিন সায়রা বানু পুরান শাড়ি পরছে ?
- এ ছাড়া তো আর কোনো উপায় দেখি না বউ।
- তাইলে অমন শাড়ি আমার কিননের দরকার নাই। শপিং টপিং সব বন্ধ।
বলে রাগে গজরাতে গজরাতে থপ থপ করে পা ফেলে চলে যায় সায়রা বানু। মোল্লা ভাই এবার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আয়েশ করে বউয়ের চলে যাওয়া দেখেন। তার ঠোঁটের ফাঁকে এক চিলতে হেকমতি হাসি ঝুলে থাকে, বেচারা সায়রা বানু তা জানতেও পারেন না।