একাকী বালক
Member
আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় কয়েকজন কোচের নাম বলতে, তাহলে আপনার মাথায় কার কার নাম আসতে পারে? পেপ গার্দিওলা,জিনেদিন জিদান, জোসে মরিনিও, ইউর্গেন ক্লপ,স্যার এলেক্স ফার্গুসন(মিডফিল্ডার নন কিন্তু একজন গ্রেট কোচ),আর্সেন ওয়েঙ্গার,কার্লো আনচেলত্তি,লুইস এনরিকে, এটলেটিকোর নবজাগরণ ঘটানো দিয়েগো সিমিওনে কিংবা হালের সাড়াজাগানো জাভি আলানসো, কিংবা সদ্যই বার্সাকে দিয়ে ইউরোপিয়ান মিশন শুরু করা জাভি হার্নান্দেজ এদের নাম ই হয়তোবা সর্বপ্রথম আসবে৷
আরো বেশি চিন্তাভাবনা করলে হয়তো ম্যানুয়েল পেলেগ্রিনি,লুসিয়ানো স্প্যালেত্তি,এন্টোনিও কন্তে, ম্যাট বাসবি, ববি রবসন কিংবা আর্সেনালের সুদিন ফিরিয়ে আনা তরুণ কোচ মিকেল আর্টেটার কথা ভাবতে পারেন। খেয়াল করলে দেখবেন কয়েকজন বাদে এদের মধ্যে বেশিরভাগ কোচ ই প্লেয়িং ক্যারিয়ারে মিডফিল্ডার ছিলেন। কখনো কি আপনার মনে প্রশ্ন এসেছে যে কেনো মিডফিল্ডার রাই বেশিরভাগ কোচ হয়ে থাকেন? আশা করি উত্তরটা পাবেন।
শুরুটা করি স্পেশাল ওয়ান জোসে মরিনিওর এক উক্তি দিয়ে যিনি নিজেও প্লেয়িং ক্যারিয়ারে একজন মিডফিল্ডার ছিলেন। " একজন কোচের যেসব কোয়ালিটি থাকা দরকার তা জাবির মধ্যে বেশ ভালোভাবেই আছে। আমি নিশ্চিত বুটজোড়া তুলে রাখার পর জাভি আলানসো এক দারুণ কোচ হবে৷ "
এই সিজনে জাবি আলানসোর লেভারকুসেনের রূপকথা রচনার বদৌলতে এ উক্তি অনেকের ই শুনে থাকার কথা।
সর্বকালের সেরা মিডফিল্ডারদের তালিকায় বর্তমান বার্সা কোচ জাভি হার্নান্দেজের নাম নিশ্চিতভাবেই সবার উপরের দিকে থাকবে। বার্সার কোচ হওয়ার ও ২ বছর আগে কাতারের আল সাদে থাকাকালীন , ২০১৯ সালে জাভি মরিনহো সম্পর্কে বলেছেন "তিনি খুবই রক্ষনাত্মক কোচ। আমি তার সমালোচনা করছিনা, কিন্তু আমি এই ধরনের ফুটবল এঞ্জয় করিনা এবং আমার দল কখনো মাঠে এ ধরনের ডিফেন্সিভ এটিচ্যুড শো করবে না। "
জাভি মোটেও মিথ্যে বলেননি। গতো সিজনে বার্সাকে ৩ বছর পর লীগ জিতিয়েছেন প্রায় ৬৪.৩% বল পজিশন নিয়ে। কিন্তু জাভির একটি ডিফেন্সিভ রেকর্ড মরিনহোকে একটু ঈর্ষান্বিত করতে পারে ; বার্সা ১২ টি ম্যাচ ১-০ গোলের ব্যাবধানে জিতেছে এবং ৩৮ ম্যাচে মাত্র ২০ টি গোল কন্সিড করেছে। জাভি যে টাইপ অফ ফুটবলের কথা বলেছেন, হাই বল পজিশন, শর্ট পাসের মাধ্যমে গেম কন্ট্রোলিং এবং প্রতিপক্ষকে ডমিনেট করা ; এ ধরনের ফিলোসফি এখন অনেকটাই বিলুপ্তির পথে।
জাভির মতো অনেক সাবেক মিডফিল্ডারই কোচ হওয়ার পথে হাটছেন। তাদের কোচিং ফিলোসোফি অনেকাংশে তাদের প্লেয়িং ক্যারিয়ার,প্লেয়িং স্টাইল,এবং কোন ট্যাকটিক্স এ খেলোয়াড়ি জীবনে খেলেছেন তার উপর নির্ভর করে। এই ব্যাপারটা বুঝে যাওয়ার কথা পিরলোর সাম্পদোরিয়া, জাভি আলানসোর লেভারকুসেনে রূপকথা, ভিন্সেঞ্জো ইটালিয়ানোর ফিওরেন্টিনা, থিয়াগো মোত্তার বোলোনিয়া, মাইকেল ক্যারিকের মিডলসব্রো, জিনেদিন জিদানের অপ্রতিরোধ্য রিয়াল, রুবেন আমোরিমের স্পোর্টিং সিপি,লুইস এনরিকের স্পেন,বার্সা এবং বর্তমান পিএসজির খেলা দেখে থাকলে তা বেশ ভালোভাবেই বোঝার কথা।
একটি ইম্প্রেসিভ স্ট্যাটস দেই আপনাদের ; সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক স্ট্যাটিস্টিকাল আ্যনালিস্ট এন্ড রিসার্চ গ্রুপ সিআইইএস অবজারভেটরি মার্চ ২০২২ এ একটি চমকপ্রদ স্ট্যাটস সবার সামনে আনে। তারা ৮৯ টি দেশের ১২৬ টি লীগের ১৮৬৬ টি দলের উপর গবেষণা করে বের করে যে ৪২.৪ শতাংশ দলের ম্যানেজার ই কোচিং ক্যারিয়ারে মিডফিল্ডার ছিলেন।
আর্টিকেলের শুরুতেই যে প্রশ্ন টি করা হয়েছিলো তার উত্তর শুনুন স্বয়ং মিডফিল্ডার - কোচ দের মধ্যে ওয়ান অফ দ্যা বেস্ট পেপ গার্দিওলার মুখে। ২০১৯ সালে এক ইন্টারভিউ তে গার্দিওলা অধিকাংশ মিডফিল্ডাররা কেনো ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে তার একটি এক্সপ্লেনেশন দেন। তিনি বলেন, " সাধারণত মিডফিল্ডারদের ভিশন এমন থাকে যে পিচে কি হচ্ছে বা এরপর কি হবে তা বেশ ভালোভাবেই আন্দাজ করতে পারে। আপনি যদি স্ট্রাইকার হন তাহলে শুধু গোল স্কোরিংয়ের দিকে মনোযোগ দেবেন। যদি গোলকিপার বা ডিফেন্ডার হোন তাহলে শট সেভ দেয়া অথবা অপোনেন্ট এর আক্রমণ প্রতিহত করাই আপনার ইন্টেনশন থাকবে৷ কিন্তু আপনি যদি মিডফিল্ডার হন তাহলে আপনার সবদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে, এটাক ডিফেন্স দুইদিকেই সমান মনোযোগ দিতে হবে। আমি মনে করি মিডফিল্ডার হওয়া কোচিং এর জন্য দুর্দান্ত এক লেসন। "
মিডফিল্ডারদের কিছু আলাদা কোয়ালিটি আছে যা তাদের ম্যানেজার ক্যারিয়ারে এটাকার এবং ডিফেন্ডার দের থেকে আলাদা করে।
১. খেলা বিল্ডআপ এবং ধ্বংস করার এবিলিটি
একজন মিডফিল্ডারের অন্যতম প্রধান কাজই হলো অপোনেন্ট এর কাছ থেকে বল কেড়ে নিয়ে কাউন্টার এটাকের মাধ্যমে স্ট্রাইকারদের কাছে পাস করা। কোয়ালিটি মিডফিল্ডাররা এই কাজটি খুব ভালোভাবেই পারে। স্পেশালি ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডাররা। এই কাজটি এফেক্টিভলি করতে একজন মিডির প্রতি মিনিটে গেম রিড করতে হবে। যখন বিপক্ষ দল অন দ্যা বলে থাকে তখন গেম রিডিং এবিলিটি কাজে লাগিয়ে অপোনেন্ট এর মুভ গুলো রিড করে পা থেকে বল ইন্টারসেপ্ট করতে হয়। ফিজিক্যালিটি নয়,ভালো গেম রিডিং এবিলিটি এবং পজিশনিং থাকলে এই কাজটি নিখুঁতভাবে করা যায় এবং তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ পেপ গার্দিওলার সময়ের সার্জিও বুসকেটস। যখন টিকিটাকার দৃষ্টিনন্দন প্রদর্শনী সারাবিশ্বের মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছিলো, তখন বুসকেটস নীরবে নিভৃতে মিডফিল্ডে অবলীলায় ' ডার্টি ওয়ার্ক ' করে জাভি-ইনিয়েস্টা ডুও কে মিডফিল্ড ডমিনেট করতে সাহায্য করেছেন।
২.ম্যান ম্যানেজমেন্ট
ভালো কোচ হওয়ার আরেকটি অন্যতম গুণ হলো প্লেয়ারকে আইডেন্টিফাই করা এবং তার ভেতরকার পটেনশিয়াল রিড করে তা বের করে নিয়ে আসা। মিডফিল্ডারদের একটি অন্যতম কাজ হলো ম্যাচের গতিবিধি আন্দাজ করা এবং তার দলের অন্যান্য পজিশনের প্লেয়ারদের পটেনশিয়ালটি অনুযায়ী খেলা। তারা স্ট্রাইকারদের পেস, স্ট্রং ফুট, হেইট,ফিজিক্যালিটি এবং অন্যান্য প্যারামিটার মাথায় রেখে বল পাস দেয় যেনো তা স্ট্রাইকারের এট্রিবিউট অনুযায়ী গোল স্কোরিংয়ে সুবিধা হয়। প্লেয়ারদের রিড করার এ এবিলিটি তাদের ম্যানেজারিয়াল ক্যারিয়ারে ও হেল্প করে। এই রোলের আদর্শ উদাহরণ হবেন আর্সেনাল বস মিকেল আর্টেটা এবং দিয়েগো সিমিওনে।
৩. আন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্যা গেম
আগেই বলেছি মিডফিল্ডাররা স্বভাবতই ম্যাচের গতিবিধি বুঝতে পারেন এবং খেলা বিল্ডাপ এবং অপোনেন্ট এর এটাক নষ্ট করতে পারেন। এ এবিলিটি তাকে অপোনেন্ট টিমের ট্যাকটিক্স এবং মুভমেন্ট বুঝতে সহায়তা করে। অপোনেন্ট এর থেকে মাইন্ড গেমে এগিয়ে থাকা তাদেরকে কাউন্টার মুভমেন্ট এ সহায়তা করে। এ এবিলিটি থাকার কারণে গার্দিওলা ফার্নান্দিনহোকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করেছেন।
৪. উত্তেজনার মূহুর্তে শান্ত থেকে ট্যাকটিকাল গেম খেলে যাওয়া
একজন ম্যানেজারের অন্যতম গুণ হলো উত্তেজনার মূহুর্তে শান্ত থাকা এবং নিজের মেজাজ কন্ট্রোলে রাখা। মিডফিল্ডাররা যেহেতু সবসময় খেলার মধ্যমণি থাকেন তারা সবসময় নিজেদের এঙ্গার কন্ট্রোলে রাখেন যাতে কার্ড রিসিভ করে দলকে বিপদে না ফেলতে হয় এবং ডিফিকাল্ট সিচুয়েশনেও নিজেদের প্ল্যান ঠিকঠাকমতো এক্সিকিউট করা যায়। ম্যাচের ফ্লো যাই হোক না কেনো ম্যানেজার নিজের মেজাজ হারিয়ে ফেললে ম্যাচের ফলাফল কখনো নিজেদের পক্ষে আসে না। যার উদাহরণ হতে পারেন পিএসজির বিপক্ষে ২য় লেগে জাভি। অনেকে হয়তো বলতে পারেন যে এন্তোনিও কন্তে, দিয়েগো সিমিওনেরা কখনোই নিজেদের মেজাজ ঠিক রাখেননা। এটি আসলে ভুল ধারণা। তারা বেশিরভাগ সময়ই নিজেদের শান্ত রেখে ট্যাকটিকাল মুভ এবং চেঞ্জ আনেন। মাঝে মাঝে উত্তেজিত হয়ে যাওয়ার মুহূর্তগুলোই মিডিয়ার সামনে হাইলাইট হয়।
ভালো মিডফিল্ডার মানেই ভালো কোচ তা কিন্তু নয়। যেমন প্যাট্রিক ভিয়েরা কিংবদন্তি মিডফিল্ডার হওয়া সত্ত্বেও ম্যানেজারিং ক্যারিয়ারে তাকে সফল বলা চলে না। আবার স্ট্রাইকার কিংবা ডিফেন্ডার হলে ভালো কোচ হওয়া যাবেনা এটিও সত্য নয়৷ যেমন জার্মানিকে দুবার বিশ্বকাপ জেতানো কোচ বেকেনবাওয়ার আনডাউটেডলি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ডিফেন্ডার। আবার ডাচ মায়েস্ত্রো জোহান ক্রুইফ ফরওয়ার্ড হওয়া সত্ত্বেও কোচ হিসেবেও সফল ছিলেন। গার্দিওলার একটি উক্তি দিয়েই শেষ করি,
"একজন গ্রেট কোচ হওয়ার আগে সর্বপ্রথম আপনাকে একজন অসাধারণ মানুষ হতে হবে।"
লিখেছেন : ইশতিয়াক হোসেন তাহসিন
পোস্টার : Daud Sabbir
#সংগ্রহীত#সংগ্রহীত