পিতা-মাতার খেদমতের মাধ্যমে মানুষ জান্নাত লাভ করে। রমজান যেমন নাজাতের মাধ্যম, পিতা-মাতা তেমনি জান্নাতের বাহন। যারা পিতা-মাতার খেদমত থেকে বঞ্চিত হলো, তারা আল্লাহ তাআলার রহমত থেকে বঞ্চিত হলো। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে বলেন, ‘তোমার রব এই ফয়সালা দিয়েছেন যে আল্লাহ ছাড়া কারও ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। তাঁদের কোনো একজন বা উভয়জন যদি বার্ধক্যে উপনীত হন, তবে (বিরক্তিতে) তাঁদের প্রতি বিরক্তিসূচক “উহ” শব্দটি বলবে না এবং তাঁদের ধমক দেবে না, বরং তাঁদের সঙ্গে স্নেহসিক্ত কথা বলো। তাঁদের জন্য দয়ার্দ্রতা ও বিনয়ে হস্ত সম্প্রসারিত করে দাও, আর বলো হে আমার প্রতিপালক, আপনি তাঁদের প্রতি দয়া করুন, যেভাবে শৈশবে তাঁরা আমাকে প্রতিপালন করেছেন।’ (সুরা-১৭ বনি ইসরাইল, আয়াত: ২৪)।
রমজান মাস ইবাদতের মাস, পিতা-মাতার খেদমত অন্যতম ইবাদত। মিরাজ রজনীতে নামাজ ও রোজা ফরজ হয় এবং মিরাজের ১৪টি সিদ্ধান্তের মধ্যে প্রথম হলো আল্লাহর সঙ্গে শরিক না করা ও দ্বিতীয় হলো পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সঙ্গে শরিক কোরো না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো।’ (সুরা-৪ নিসা, আয়াত: ৩৬)। ‘আর আমি নির্দেশ দিয়েছি মানুষকে, তার পিতা-মাতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার।’ (সুরা-৪৬ আহকাফ, আয়াত: ১৫)। ‘আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি যে তুমি আমার এবং তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে।’ (সুরা-৩১ লুকমান, আয়াত: ১৪)।
পিতা-মাতার খেদমত না করার কারণে যারা জান্নাত থেকে বঞ্চিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের অভিসম্পাত করেছেন। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘একদা জুমার দিনে রাসুলুল্লাহ (সা.) মিম্বারের প্রথম ধাপে পা রেখে বললেন, “আমিন”, অতঃপর দ্বিতীয় ধাপে পা রাখলেন, বললেন, “আমিন”, তারপর তৃতীয় ধাপে পা রাখলেন এবং বললেন, “আমিন” এরপর খুতবা দিলেন ও নামাজ আদায় করলেন। নামাজ শেষে সাহাবায়ে কিরাম প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.), আজ যা দেখলাম তা ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি (আপনি একেক ধাপে পা রেখে, আমিন বলছিলেন), এটা কি কোনো নতুন নিয়ম?
নবী কারিম (সা.) বললেন, না, এটা নতুন কোনো নিয়ম নয়, বরং আমি মিম্বারে ওঠার সময় হজরত জিবরাইল (আ.) এলেন, আমি যখন মিম্বারের প্রথম ধাপে পা রাখি তখন তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যারা পিতা-মাতা উভয়কে বা একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় পেয়েও তাদের খেদমতের মাধ্যমে জান্নাত অর্জন করতে পারল না, তারা ধ্বংস হোক। তখন আমি (রাসুলুল্লাহ সা.) সম্মতি জানিয়ে বললাম আমিন! (তাই হোক)। যখন দ্বিতীয় ধাপে পা রাখি তখন তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যারা রমজান পেল কিন্তু ইবাদতের মাধ্যমে তাদের গুনাহ মাফ করাতে পারল না, তারা ধ্বংস হোক। তখন আমি বললাম আমিন! আমি যখন মিম্বারের তৃতীয় ধাপে পা রাখি তখন তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যারা আপনার পবিত্র নাম মোবারক শুনল কিন্তু দরুদ শরিফ (নবীজির প্রতি শুভকামনা, যেমন: সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পাঠ করল না, তারা ধ্বংস হোক। তখন আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম, আমিন! (মুসলিম শরিফ)।
তিনটি জিনিস দেখলে সওয়াব হয়। যথা: কাবা শরিফ, কোরআন শরিফ ও পিতা-মাতার চেহারা। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘যখন কোনো সন্তান স্বীয় পিতা-মাতার প্রতি অনুগ্রহের নজরে দৃষ্টিপাত করে, আল্লাহ তাআলা তার প্রতিটি দৃষ্টির বিনিময়ে একটি করে কবুল হজের সওয়াব দান করেন।’ (বায়হাকি)।
এক সাহাবি (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)–কে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.), আমার পিতা-মাতা ইন্তেকালের পরও কি তাঁদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহারের কোনো কিছু দায়িত্ব অবশিষ্ট আছে?’ তখন নবী করিম (সা.) বললেন, হ্যাঁ, আছে। তা হলো তাঁদের জন্য দোয়া করা, তাঁদের গুনাহের জন্য তওবা ইস্তিগফার করা, তঁাদের শরিয়তসম্মত অসিয়তগুলো আদায় করা, তঁাদের আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, তঁাদের বন্ধুবান্ধবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। এগুলো পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও তঁাদের সঙ্গে উত্তম আচরণের শামিল।’ (আবু দাউদ)। অন্য হাদিসে আছে, ‘পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি, পিতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি।’ (তিরমিজি)
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম