প্রথম পর্ব শেষ করেছিলাম বাজরার রুটি দিয়ে। বাজরা ছাড়া রাজস্থানের খাবারে যে জিনিসটা বেশি ব্যবহার হয় সেটা হলো, বেসন। কৃষি ও শিল্প কম বলে পশ্চিম রাজস্থানের মানুষ বেশ গরিব। তাই এদের খাওয়াদাওয়া খুবই সাধারণ। পরিচিত খাবারের মধ্যে আছে ‘গাট্টে কা সাবজি’। বেসনকে আটার মতো মেখে, ছোট ছোট টুকরো তেলে ভেজে ঝোল করা। আর একটা জিনিস হলো ‘সেও টমাটর’। পেঁয়াজ টমেটো দিয়ে একটা লাল ঝোল বানিয়ে তার মধ্যে বেশ কিছুটা ‘সেও ভাজা’ ছড়িয়ে দেওয়া। এসব খাবার বাঙালিদের তেমন ভালো লাগবে না।
থর মরুভূমির কাঁটা ঝোপ
তবে উৎকৃষ্ট খাবারের মধ্যে রয়েছে, ডাল-বাটি-চুরমা ও লাল মাস। বাটি জিনিসটা অনেকটা বিহারের লিট্টি গোছের। গোল গোল মসলা আটার বলকে গরম আগুনে রোস্ট করা। সঙ্গে হলুদ ঘন ডাল ও সুজি দিয়ে বানানো মিষ্টি মিষ্টি খেতে চুরমা। আর লাল মাস হলো মাটন। যা রান্না হয় রাজস্থানের লাল মরিচ দিয়ে, তাই ঝোলের রং হয় আগুন লাল। ঝাল খাওয়ার অভ্যাস থাকলে লাল মাস আপনার ভালো লাগবে। গরমের কারণে এখানে মুরগি বাঁচে না। তাই মাংস মানেই মটন।
শুকনো পাথুরে জমিতে চাষ হয় না। হয় পশুপালন। তাই বেশির ভাগ মানুষ এখানে ছাগল বা ভেড়া পালন করেন। যেহেতু এখানে ৪-৫ বছর পরে একবার বৃষ্টি হয় তাই পাথুরে জমিতে ঘাস বিশেষ মেলে না। পশুরা কাঁটা ঝোপ খায়। রোদ বাড়লেই বড় গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে শরীর শীতল করে। পশু পালনের জন্য অনেক বড় জায়গার প্রয়োজন বলেই এখানে একটা গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম প্রায় ৮-১০ কিলোমিটার দূরে দূরে হয়ে থাকে। গ্রামের লোকসংখ্যা কোথাও ৫০, কোথাওবা ১০০ জন মাত্র। বড়ই কঠিন এই মরুভূমির জীবন।
এখানে শুকনো পাথুরে জমিতে চাষ হয় না, হয় পশুপালন। খাবা গ্রাম, রাজস্থান, ভারত
লঙ্গেওয়ালা ও টানট মাতা মন্দির দেখে খুরি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। পথে সূর্য ডুবে যাওয়ার অপূর্ব দৃশ্য দেখলাম। রাতে রিসোর্টে দেখলাম রাজস্থানি লোকসংগীতের সুন্দর অনুষ্ঠান। একবার দেখলে এ গানের অনুষ্ঠান ভোলা যাবে না।
জিপ গাড়িতে সাফারি হয় মরুভূমিতে
পরদিন সকালে সিদ্ধান্ত হলো মরুভূমির বালিয়াড়িতে যাব। খুরি গ্রাম থেকে বালিয়াড়ি মাত্র তিন কিলোমিটার। জিপ গাড়িতে সাফারি হয়। উঁচু-নিচু বালুর ওপর দিয়ে প্রবল গতিতে ছুটে চলে গাড়ি। দারুণ একটা মজার বিষয়। ১ হাজার ২০০ টাকায় ঘণ্টা দু-একের সাফারি। হোটেলের জিপে আমরা বেরিয়ে পড়লাম আটটা নাগাদ। বেলা বাড়লে বালিয়াড়িতে গরম বেড়ে যায়। তখন সাফারির মজা থাকে না।
জিপচালক ভানু প্রথমে আমাদের খুরি গ্রামটা ঘুরিয়ে দেখাল। গ্রাম পেরিয়ে আমরা এসে পড়লাম বিরাট এক খোলা মাঠে। তাতে জায়গায় জায়গায় বেশ কয়েকটা কুয়া দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। গ্রামের নারীরা কুয়া থেকে পানীয় জল নিয়ে দল বেঁধে চলেছেন নিজেদের ঘরের দিকে। প্রশ্ন করতে ভানু বলল, ‘এই একটি জায়গাতেই পান করার মতো মিঠা পানীয় জল পাওয়া যায়। সরকার তাই এই মাঠের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ৫০টি কুয়া বানিয়ে দিয়েছে। ৫-৬ কিলোমিটার দূরের গ্রাম থেকেও এখানে জল নিতে আসে মানুষ।’
কুয়া থেকে জল তুলে ট্যাংকার ভর্তি করছেন কমল সিং
বিরাট সেই মাঠের মধ্যে তখন ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেক ময়ূর। দেখলাম একজন কুয়া থেকে জল তুলে উটের গাড়িতে রাখা একটা ট্যাংকার ভর্তি করছেন। আলাপ করিয়ে দিল ভানু। লোকটির নাম কমল সিং। ভানু বলল, কমল সিং মোটামুটি ধনী। বাড়িতে কিছুর অভাব নেই। রোজ উটের গাড়ি নিয়ে এসে এখান থেকে জল তুলে গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দেয়, বিনা পয়সায়। যাদের বয়স হয়ে গেছে, জল নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা নেই, গ্রামের এমন অনেক মানুষ সারা বছর বেঁচে থাকে কমল ভাইয়ের জলসেবার দৌলতে।
আমার মনে হলো এমন একজন মানুষকে সামনে থেকে দেখাও একটা পবিত্র কাজ। কথা হলো কমল সিংয়ের সঙ্গে। বললেন, ‘আমার বাপ–দাদা সবাই জলসেবা করেছেন। তাই আমিও করছি।’ প্রশ্ন করতে বললেন, এখানে এক একটা কুয়ো প্রায় ১০০ বছরের পুরোনো। জল খুব ভালো। এখন শীতকাল, তাই সমস্যা নেই। গরমকালে খুব ভোরে বা রাতের দিকে আসতে হয়। দুপুরে সব কুয়া শুকিয়ে যায়। কথা বলতে বলতে দেখলাম কমল সিং কুয়ার পাশে বানানো নিচু চৌবাচ্চাতে ঢেলে দিচ্ছেন জল। বললেন, ‘শুধু মানুষের কথা ভাবলে চলবে কেন। ময়ূর, উট, গরু, ছাগল কিংবা হরিণদের কথাও তো ভাবতে হবে।’ তাঁর কথা শুনে চোখে জল এসে গেল। মরুভূমির এই গ্রাম্য মানুষটির নিষ্ঠার সামনে মাথা নত না করে পারলাম না। তারপর এগিয়ে গেলাম বালিয়াড়ির দিকে।
বন্য প্রাণির জন্য চৌবাচ্চায় জল রাখছেন কমল সিং
খানিকটা যেতে না যেতেই দেখা পেলাম কৃষ্ণমৃগ, হরিণ। ভানু বলল, কাছেই ডেজার্ট ন্যাশনাল পার্ক। তার ভেতরেও অনেক হরিণ আছে। কেউ ওদের কিছু বলে না, তাই গ্রামের মধ্যেও ঘুরে বেড়ায় মাঝেমধ্যে। আমি তাকিয়ে দেখতে লাগলাম তাদের চলাচল। তবে এই দেখা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। ভানু গতি বাড়াতেই আমরা বালিয়াড়ির মধ্যে এসে পড়লাম। তারপর নিজেকে হারিয়ে ফেললাম মরুভূমির মধ্যে।
জিপ সাফারি শেষ করে আমরা নিজেদের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম দুটি জায়গা দেখতে। প্রথমটা ‘খাবা কেল্লা’ আর দ্বিতীয়টা ‘কুলধারা’। এই দুটি গ্রামই ৪০০-৫০০ বছর ধরে জনশূন্য। সেই জন্য ভৌতিক তকমাও লেগেছে গ্রাম দুটির গায়ে। তবে পাথরের ফলক দেখে ও স্থানীয় লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই এলাকায় এক কালে পালিবাল ব্রাহ্মণদের ৮৪টি গ্রাম ছিল।
খাবা কেল্লা
এ অঞ্চলের রাজপুত রাজা নানাভাবে পালিবালদের ওপর অত্যাচার করতেন। অত্যাচার চরমে ওঠে যখন রাজার ভাই পালিবাল গ্রামপ্রধানের মেয়েকে ভোগ করতে চায়। তখন এক রাতের অন্ধকারে পালিবালরা সবাই একসঙ্গে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। এরপর এই গ্রামে আর কেউ আসেনি। সরকারি মতে, পালিবালদের চলে যাওয়ার পেছনে ভূমিকম্পও কারণ হতে পারে।
কুলধারা
যাহোক, গ্রাম ও কেল্লা দেখে আমরা হোটেলে ফিরে এসে লাল মাস আর ভাত খেয়ে বিশ্রাম করে নিলাম। বিকেল সাড়ে চারটায় চেতন রাম উটের গাড়ি নিয়ে এসে উপস্থিত হলো। সে আমাদের নিয়ে যাবে মরুভূমিতে সূর্যাস্ত দেখাতে। আবার গ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা চললাম বালিয়াড়ির দিকে। তবে এই বালিয়াড়ি অন্য দিকে। সকালে গাড়িতে যেখানে গিয়েছিলাম সেই বালিয়াড়ি এত উঁচু ছিল না।
বিকেলের ঢলে পড়া সূর্যের আলোয় ধীরে ধীরে মরুভূমি হয়ে উঠল মোহময়। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে শোভা দেখছি এমন সময় কানে গান ভেসে এল। স্থানীয় লোকসংগীত শিল্পীরাও এসেছেন। গান শুনিয়ে কিছু টাকা নিচ্ছেন। তাদের গান শুনতে শুনতে সন্ধ্যা হয়ে গেল মরুভূমিতে। আমাদেরও ফেরার সময় হলো। রাতটা খুরিতে কাটিয়ে পরের দিন সকালে দিল্লি ফেরার পথ ধরলাম।
কয়েকটি জরুরি তথ্য
রাতের মরুভূমিতে রাজস্থানী লোকসংগীতের আসর
মরুভূমি ভ্রমণের সবচেয়ে ভালো সময় নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস। ঢাকা থেকে বিমানযোগে দিল্লি এসে এখান থেকে ট্রেনে, এসি বাস বা বিমান ধরে চলে আসতে হবে জয়সলমির। পুরোনো দিল্লি স্টেশন থেকে ট্রেন এবং আইএসবিটি থেকে মিলবে বাস। প্রথম দিন জয়সলমির শহরে থেকে সোনার কেল্লা, পাটয়া কি হাভেলি ও সুরসাগর লেক দেখে নিয়ে পরের দিন খুরি গ্রামে এসে থাকুন।
রাজস্থানী লোকসংগীতের আসর
দিল্লি থেকে ট্রেনে বা বাসে যাতায়াত করলে চার দিনের মরুভূমি ভ্রমণের খরচ দুজনের জন্য মোটামুটিভাবে ২০ হাজারের মধ্যেই থাকবে। বাংলাদেশ থেকে অনেকেই রাজস্থানের আজমির শরিফ ঘুরতে আসেন। তাঁরা সেই ভ্রমণের সঙ্গে জয়সলমিরকে যোগ করে নিলে রথ দেখা কলা বেচা—দুই–ই হয়ে যাবে।