ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন না, এমন বাঙালির সংখ্যা সত্যিই খুব কম। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা দেশের নাগরিক এই বাঙালিকে তাই আজ পাওয়া যায় পৃথিবীর বিভিন্ন কোনায়। এই ভ্রমণপিয়াসী বাঙালির পছন্দের তালিকায় যেমন পাহাড়, জঙ্গল, সমুদ্র রয়েছে, তেমনই রয়েছে মরুভূমি। ‘দুরন্ত আশা’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘ইহার চেয়ে হতেম যদি/ আরব বেদুয়িন!/ চরণতলে বিশাল মরু/ দিগন্তে বিলীন’।
ভারতে রয়েছে বিশাল থর মরুভূমি
না, মরুভূমি দেখতে বড় খরচ করে আরব দেশে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ভারতেই রয়েছে বিশাল থর মরুভূমি। পশ্চিম ভারতের রাজস্থানের জয়সলমির জেলার এক বিশাল অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এই শুকনো মরুপ্রান্তর। যেখানে চার–পাঁচ বছর পরে একবার বৃষ্টি হয়। ভাবতেই কেমন লাগে, তাই না? এই জেলার ৪৬৪ কিলোমিটার বর্ডার আছে পাকিস্তানের সঙ্গে। বিরাট এই জয়সলমিরের জনসংখ্যা কত জানেন, মাত্র ৭ লাখ। প্রতি বর্গকিলোমিটার অঞ্চলে মোটে ১৭ জন মানুষ বাস করেন। তাই রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দুই দিকে আপনি দেখতে পাবেন বিশাল জনশূন্য শুষ্ক পাথুরে জমি। হয়তো রাস্তা পেরিয়ে যাবে জংলি উট কিংবা কৃষ্ণমৃগ অথবা ময়ূরের দল। সম্প্রতি ঘুরতে গিয়েছিলাম এই মরুপ্রান্তরে। সে গল্পই বলা যাক আজ।
আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম দিল্লি থেকে। উদ্দেশ্য ছিল কয়েকটা রাত মরুভূমিতে কাটানো। ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে যে মরু গ্রাম দুটি গড়ে উঠেছে, তার একটির নাম সাম, অন্যটা খুরি। জনপ্রিয়তার নিরিখে সাম অনেক বেশি জমজমাট। আগে আমি সামে গিয়েছিলাম। তাই এবার বেছে নিলাম খুরি। আপনি যদি হোটেলে না থেকে খোলা আকাশের নিচে মরুভূমির মধ্যে রাত কাটাতে চান তাহলে সেটা খুরিতেই সম্ভব। সামে থাকতে আমি নিষেধ করব।
দিল্লি থেকে প্রায় ৮৫০ কিলোমিটার পথ পার করে খুরি গ্রামের পথে
এ বছরের ২৪ জানুয়ারি ভোরে দিল্লি থেকে নিজেই ১৪ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে প্রায় ৮৫০ কিলোমিটার পথ পার করে যখন খুরি গ্রামে আমরা পৌঁছালাম, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। পথ খুবই ভালো এবং নিরাপদ। তবে আপনি গাড়িতে আসতে না চাইলে দিল্লি থেকে জয়সলমির পর্যন্ত আসতে পারেন ট্রেনে, বাস কিংবা বিমানযোগে। খুরি গ্রামটি জয়সলমির শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার পশ্চিমে। স্থানীয় ট্যাক্সি ১ হাজার ২০০ রুপি ভাড়া নেয় জয়সলমির থেকে খুরি আসতে। হাতে সময় থাকলে আপনি লোকাল বাসেও আসতে পারেন।
খুরিতে বেশ কিছু হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে। আগে থেকে অনলাইন বুকিং করে নেওয়া যায়। খানিকটা ইন্টারনেট ঘেঁটে আমরা ঠিক করলাম ‘খুরি রিসোর্ট’-এ থাকব। এখানে তিন রকমের থাকার ব্যবস্থা। পাথরের ঘর, মাটির ঘর এবং রাজকীয় টেন্ট বা তাঁবু।
খুরি রিসোর্ট
আমরা তাঁবুতে থাকাই ঠিক করলাম। এবার করোনার জন্য বিদেশি ট্যুরিস্ট নেই। দেশের ট্যুরিস্টও খুব কম। তাই বুকিং পেলাম নামমাত্র দামে। দুজনের সকালের নাশতা এবং রাতের খাবারসহ টেন্ট ভাড়া মাত্র ১ হাজার ২০০ রুপি। সঙ্গে রয়েছে প্রতি সন্ধ্যায় রাজস্থানি লোকসংগীতের অনুষ্ঠান।
তাঁবুতে থাকাই ঠিক হলো
২৪ তারিখ রিসোর্টে পৌঁছে বিশেষ কিছু করার মতো অবস্থায় ছিলাম না। তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। মরুভূমিতে দিনের বেলা গরম আর রাতে ঠান্ডা। আমরা দিল্লির কঠিন শীতের সঙ্গে পরিচিত। তবু ভোরের দিকে তাঁবুর মধ্যে কম্বলের নিচে বেশ ঠান্ডা অনুভব করছিলাম। এখানে সকাল হয় অনেক দেরিতে—প্রায় ৭টা নাগাদ। সকালে রিসোর্টের লোকেরাই পৌঁছে দিল গরম পানি আর চা। শীতে অনেকেই স্নান করতে পছন্দ করেন না। তবে এখানে নিয়মিত স্নান ও বেশি পানি পান করা জরুরি।
সকাল ১০টা নাগাদ নাশতা শেষ করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম ভারত পাকিস্তানের বর্ডার লঙ্গেওয়ালার দিকে। খুরি থেকে প্রায় ১৬৫ কিলোমিটার রাস্তা। যেতে সময় লাগবে প্রায় তিন ঘণ্টা। ১৯৭১ সালে ভারত বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করেছিল বলে পাকিস্তান এই লঙ্গেওয়ালায় আক্রমণ চালায়। তবে এখানেও তারা ভারতীয় সেনার কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে ট্যাংক থেকে শুরু করে বাকি যুদ্ধবহর ছেড়ে পাড়িয়ে যায়। সে গল্প না হয় অন্য একদিন হবে।
লঙ্গেওয়ালায় ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের স্মৃতি
এখন বলি খুরি থেকে লঙ্গেওয়ালা যাওয়ার পথের কথা। মরুভূমি যে এতটা সুন্দর হতে পারে, সত্যি বলছি এই জায়গাতে না আসলে আমি কোনো দিন জানতে পারতাম না। পথে যেতে যেতে হঠাৎ থামতে হলো এক জায়গায়। রাস্তা পার করছে জংলি উটের দল। মাইলের পর মাইল ধরে লাগানো রয়েছে বিদ্যুৎ তৈরির হাজার হাজার হাওয়া কল।
রাস্তার পাশে চরে বেড়াচ্ছে ভেড়ার পাল
রাস্তার পাশে কোথাও ঘোড়া কোথাও গাধা দেখা যাচ্ছে। হলুদ পাথুরে জমির মধ্যে কোথাও কোথাও সবুজ গাছপালা। চরে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার ছাগল, ভেড়া ও গরু। সুন্দরকে লিখে কিংবা ছবিতে বোঝানো যায় না। আমরা তাই মাঝেমধ্যেই গাড়ি থামিয়ে দুই চোখ ভরে উপভোগ করছিলাম সৃষ্টিকর্তার সৌন্দর্য লীলা।
লঙ্গেওয়ালা বর্ডারে পৌঁছে দেখলাম লম্বা গাড়ির লাইন। কাগজপত্র চেক করছেন বিএসএফ জওয়ানেরা। আমাদের গাড়ির দিকে যিনি এগিয়ে এলেন, তার জামায় নাম লেখা রয়েছে, অনুপ রায়। আমি বললাম, দাদা নমস্কার, কেমন আছেন? কলকাতা থেকে প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরে বাংলায় দুটো কথা বলতে পেরে রায় বাবু গদগদ হয়ে গেলেন মুহূর্তে। বললেন, আপনাদের আর কাগজপত্র চেক করছি না; চলে যান। সাগরমালা নামে ভারত সরকার একটা প্রোজেক্ট করছেন। এর উদ্দেশ্য ভারতের উত্তর সীমান্ত থেকে শুরু করে দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত মালার মতো রাস্তা বানানো।
মরুভূমি মানেই উট। প্রাকৃতিক পরিবেশে এখানে চরে বেড়ায় উট
লঙ্গেওয়ালা থেকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে। আমরা সাগরমালার রাস্তা দিয়ে লঙ্গেওয়ালা থেকে এগিয়ে যেতে লাগলাম টানট মাতা মন্দিরের দিকে। প্রায় ৪০ কিলোমিটার এই পথ এত সুন্দর যে ১২০-১৪০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালানো একেবারে সাধারণ ব্যাপার। স্বীকার করতে বাধা নেই, এত সুন্দর ও নির্জন পথে আমি আগে কোনো দিন গাড়ি চালাইনি।
টানট মাতা মন্দিরের থেকে আন্তর্জাতিক বর্ডার মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে। তবে একে ভারত-বাংলাদেশ বর্ডারের সঙ্গে একেবারেই তুলনা করা যায় না। এখানে বর্ডার মানে মাইলের পর মাইল কাঁটাতারের বেড়া। দুই দিকে পাহারারত বাহিনী আর আকাশ থেকে নজর রাখতে মাঝেমধ্যেই টহল দিচ্ছে হেলিকপ্টার। ভারত-পাকিস্তানের দীর্ঘ বর্ডারের মধ্যে একমাত্র পাঞ্জাবের অমৃতসর দিয়েই মানুষ ও মালপত্র চলাচল করে।
টানট মাতা মন্দির
যাহোক, আমরা টানট মাতা মন্দির নিয়ে কথা বলছিলাম। ১৯৭১–এর বাংলাদেশে যুদ্ধে হেরে যাওয়ার ফলে এখানে পাকিস্তানি সেনা প্রচুর গোলা বর্ষণ করে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, মন্দিরের আশপাশে যে ৪০০টি গোলা এসে পড়েছিল, তার কোনোটাই ফাটেনি। সেখান থেকেই জন্মায় ধর্মীয় বিশ্বাস। সেই গোলাগুলোকে অকেজো করে মন্দিরের পাশে একটা প্রদর্শনী করা হয়েছে। এখানে মন্দিরে ধর্মীয় পূজা অর্চনা করেন বিএসএফ জওয়ানেরা।
এখানে প্রাকৃতিক পরিবেশে ছুটে বেড়ায় কৃষ্ণসার হরিণ
মন্দিরের সামনে কয়েকটা ঝুপড়ি গোছের দোকানে ম্যাগি, পরোটা ইত্যাদি খাওয়ার ব্যবস্থা আছে দেখলাম। তবে দোকানের তুলনায় এখানে ট্যুরিস্ট অনেক বেশি হওয়ায় আমাদের খাবার জুটল না। তখন বেলা দুটো বাজে। পেটে খিদে নিয়েই আমরা ফেরার পথ ধরলাম। ঘণ্টাখানেক গাড়ি চালিয়ে ১০০ কিলোমিটার পার করে রামগড় বলে একটা জায়গা পাওয়া গেল। এখানে বেশ জমজমাট বাজার দোকান রেস্টুরেন্ট পেলাম। রামগড় জায়গাটার নাম আমি প্রথম শুনেছিলাম সোলে ছবিতে। অমিতাভ বচ্চন, ধর্মেন্দ্র ও হেমা মালিনী অভিনীত ১৯৭৫ সালের ছবি ‘সোলে’ হয়তো অনেকেই দেখেছেন। সেই ছবির গল্প এই রামগড়ের ওপরেই লেখা। যাহোক, ছবির কথা ভাবার সময় তখন আমাদের নেই। তাড়াতাড়ি কিছু খেতে হবে।
পশ্চিম রাজস্থান শুকনো ও গরমের জায়গা। তাই লোকেরা এখানে প্রচুর ঝাল দেওয়া খাবার খায়। প্রতিবার তাই খাওয়ার সময় হোটেলে আপনাকে কম ঝালের ব্যাপারটা বলে দিতে হবে। আমরা মটর–পনির দিতে বললাম সঙ্গে বাজরার রুটি। বাজরা শর্ষের মতো কালো কালো গোল গোল একটা দানা। তাকে ভাঙলে গমের মতোই আটা হয়। এই অঞ্চলে বাজরা চাষ হয়। এই চাষে গমের মতো সেচের প্রয়োজন হয় না। তা ছাড়া বাজরার রুটি শরীর গরম রাখে। এ জন্য শীতকালে এখানে বাজরার রুটি বেশ চলে। তবে এই রুটি সাধারণ আটার মতো পাতলা করা যায় না। বেশ মোটা মোটা হয়। তাই একটার বেশি রুটি খেতে পারলাম না। রুটির দাম ৪০ রুপি পিস।
থর, ভারতের মরুভূমি
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ভাবলাম এই বাজারে নিশ্চয়ই বাজরার আটা পাওয়া যাবে। পেয়েও গেলাম, মাত্র ২০ রুপি কেজি। দিল্লি ফিরে বানাতে হবে একদিন।
* লেখক: দীপারুণ ভট্টাচার্য, দিল্লি