‘প্রায় দেড় হাজার বছর আগে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে অত্যাচারী শাসক আর শোষকদের অমানবিক নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল নিরীহ সাধারণ মানুষ। আর সেদিন থেকেই শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য তদানীন্তন শাওলিন টেম্পলে সাধারণ মানুষকে শেখানো হয় নূন্যতম উপায়ে আত্মরক্ষার অভিনব কলাকৌশল। প্রাচীন শাওলিন টেম্পলে উত্থাপিত এই কলাকৌশলই একদিন সারাবিশ্বে পরিচিতি পায় মার্শাল আর্ট রূপে। আত্মনক্ষার এই জনপ্রিয় মাধ্যম মার্শাল আর্টের উপর ভিত্তি করে দৈ-বিদেশে নির্মিত হতে থাকে অসংখ্য চলচ্চিত্র।
একদিন সারাবিশ্বের মতো নিজের মাতৃভূমিতেও মার্শাল আর্টকে প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে আসেন মার্শাল আর্টের সর্বোচ্চ পীঠস্থান বার্মাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাংলাদেশের ছেলে ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম। ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম বাংলাদেশে মার্শাল আর্টের প্রথম জাতীয় বীর। তাঁরই উদ্যোগে গড়ে ওঠে অসংখ্য মার্শাল আর্ট স্কুল, প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ফাইটার ক্যারাতে ক্লাব। সারাবিশ্বে বাংলাদেশেও মার্শাল আর্টকে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জনপ্রিয় করতে নির্মিত হয় তাঁর প্রথম প্রযোজিত ছবি ‘মার্শাল হিরো।’ জাহাঙ্গীর আলমের বিশ্বাস মার্শাল আর্টকে জনপ্রিয় করার একমাত্র সহজ মাধ্যম হচ্ছে চলচ্চিত্র।’
‘মাস্টার সামুরাই’ ছবির শুরুর মুহূর্তে জাহাঙ্গীর আলমের পরিচিতি এভাবেই দেয়া হয়। বাংলাদেশে মার্শাল আর্টের প্রতিষ্ঠাতা, গ্র্যান্ড মাস্টার। তাঁরই হাতে প্রশিক্ষিত পরবর্তী মার্শাল আর্টের জনপ্রিয় নায়ক রুবেল।
ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলমের জন্ম ৩০ এপ্রিল ১৯৫৭, কক্সবাজারের উখিয়ায়।
সত্তরের দশকে ব্রুসলীর জনপ্রিয় মার্শাল আর্টভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলো সম্পর্কে আমাদের দেশের মানুষ ততটাও জানত না। ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম মার্শাল চট্টগ্রামে মার্শাল আর্টের স্কুল প্রতিষ্ঠা করে পরিচিত করতে থাকেন এ শিল্পকে। একসময় তিনি পরিচালক, প্রযোজক ও অভিনেতা মাসুদ পারভেজ সোহেল রানার সাথে পরিচিত হলে সোহেল রানাই তাঁকে চলচ্চিত্রে কাজ করার আমন্ত্রণ জানান। এভাবে চলচ্চিত্রে মার্শাল আর্টের যাত্রা শুরু হয়ে যায়। জাহাঙ্গীর আলমের উদ্ভাবিত মার্শাল আর্টের যে ফিল্মি স্বাদ সেটা হিন্দি ছবিতেও তখনকার দর্শকরা দেখেনি তাই সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এ শিল্পটি রাতারাতি জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং একের পর এক ছবি হতে থাকে মার্শাল আর্টকেন্দ্রিক।
জাহাঙ্গীর আলমের উল্লেখযোগ্য ছবি : শরীফ বদমাশ, সিআইডি, লড়াকু, হাইজ্যাক, বিদ্রোহী, মার্শাল হিরো, লিনজা, মাস্টার সামুরাই, ওস্তাদের ওস্তাদ, কুংফু নায়ক, প্রেমিক রংবাজ, মরণ লড়াই, সোহেল রানা, ক্যারাটি মাস্টার, কুংফু কন্যা, ওস্তাদ সাগরেদ, মৃত্যুঘণ্টা, পেশাদার খুনি, সুন্দরী মিস বাংলাদেশ, সাহসী সন্তান, বিদ্রোহী মাস্তান ও লাল চোখ।
জাহাঙ্গীর আলমের অভিনয়দক্ষতা বলতে তেমন কিছু ছিল না। কারণ তিনি অভিনয়ের থেকে মার্শাল আর্টকে প্রাধান্য দিতেন বেশি তাই তার মারপিটই প্রধান হয়ে উঠত। যদিও বেশিরভাগ দর্শকের মতে জাহাঙ্গীর আলমের থেকে রুবেলের মার্শাল আর্টই চলচ্চিত্রে বেশি উপভোগ্য ছিল। তাঁর প্রথমদিকের ছবি যেমন ‘শরীফ বদমাশ’-এ ভালো অভিনয় ছিল। এ ছবিতে তাঁর চরিত্রটির অনুকরণে পরে শহীদুল ইসলাম খোকনের ‘বিষদাঁত’ ছবিতে ইলিয়াস কোবরার একটি চরিত্র দেয়া হয়েছিল। তবে তার সেরা ছবি ছিল ‘মাস্টার সামুরাই।’ ‘ক্যারাটি মাস্টার’ ছবিতে জাহাঙ্গীর আলমের মাটি ফুঁড়ে বের হওয়ার মতো অদ্ভুত কিছু ফিল্মি দৃশ্য দর্শককে দারুণ বিনোদন দিয়েছিল। এমন একটি দৃশ্য পরে রুবেলের ‘লম্পট’ ছবিতেও দেখা গেছে। এ ছবির গল্প, পরিচালনা যেমন ভালো ছিল তার অভিনয়ও তুলনামূলক অন্য ছবির থেকে ভালো ছিল। জাহাঙ্গীর আলম ২০০০ পরবর্তী সময়ে গণহারে অশ্লীল ছবির দিকে ঝুঁকে গেলে ভীষণভাবে সমালোচিত হতে থাকেন যার জন্য এখনো তাঁকে অনেক দর্শক ঠিকমতো নিতে পারেন না। তাঁর পূর্বের এত ভালো অর্জনগুলোকে মাথায় রেখেও তিনি ক্যারিয়ারকে ঠিকমতো সাজাতে পারেননি।
তিনি মার্শাল আর্টের বিভিন্ন টিভি অনুষ্ঠানও করতেন। বিটিভিতে তাঁর এ ধরনের অনুষ্ঠান হত এবং উপস্থাপনায় তাঁর স্ত্রী রাকা থাকত।
ব্যক্তিজীবনে জাহাঙ্গীর আলম প্রথমবার বিয়ে করেন নায়িকা রঞ্জিতাকে। রঞ্জিতার সাথে বিচ্ছেদের পর নায়িকা রাকাকে বিয়ে করেন।
ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলমকে নিয়ে অনেকে সমালোচনা করে। সমালোচনার সুযোগ আছে সেটাও ঠিক কিন্তু একথাও ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে মার্শাল আর্টের প্রতিষ্ঠাতা এবং এটি একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন ছিল দেশের চলচ্চিত্রে। তাই তাঁকে তাঁর যোগ্য সম্মানটাও দিতে হবে।