‘করোনা মহামারির শুরুর দিকে যখন প্রথম অনলাইন ক্লাস শুরু হলো, তখন আসলে ক্লাসে অনেক ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ থাকত। দেখা যেত, ক্লাসের মধ্যেই ফেসবুক ব্রাউজ করছি, ম্যাসেজ করছি। লম্বা ছুটির পর যখন সশরীর ক্লাস শুরু হলো, তখনো এর প্রভাব রয়ে গেল। এখন দেড় ঘণ্টা ক্লাসের মধ্যে আধা ঘণ্টা পর ফেসবুকে ঢুকলে মনে হয় অনেক কিছু মিস করে ফেলছি,’ সরল স্বীকারোক্তি দিলেন আঞ্জুমান আরা। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের এই শিক্ষার্থীর সঙ্গে হয়তো অনেকের অভিজ্ঞতাই মিলে যাবে।
গেজেটনির্ভরতার কারণে ক্লাসরুমে কিংবা পড়ালেখায় শিক্ষার্থীদের মনোযোগ কমে যাওয়ার বিষয়টি কয়েক বছর আগেই নানা গবেষণায় উঠে এসেছে। তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, করোনাকালে এই সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। একসময় যেখানে ক্লাসে মোবাইল নেওয়া নিষেধ ছিল, এখন সেখানে ক্লাসই ঢুকে পড়েছে মোবাইলে। তাই শিক্ষার্থীদের মনোযোগ কমেছে আরও।
গবেষণা বলছে, শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে কাটানো সময়ের এক-পঞ্চমাংশ ডিজিটাল যন্ত্রের পেছনে ব্যয় করে, যা তাদের ক্লাসরুমের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ক্লাসে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ করার পর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফলেও ইতিবাচক পরিবর্তন হয় বলে জানায় লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস। ইংল্যান্ডের চারটি শহরের স্কুলে মোবাইল নিষিদ্ধের আগে ও পরে শিক্ষার্থীদের ফলাফল পর্যালোচনা করে এ তথ্য প্রকাশ করে তারা। যুক্তরাজ্যের টেলিকম নিয়ন্ত্রক সংস্থা অফকমের ২০১৮ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদন একই ধরনের কথা বলছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, মানুষ জাগ্রত অবস্থায় গড়ে প্রতি ১২ মিনিটে একবার তাদের স্মার্টফোন চেক করে। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির এডুকেশনাল সাইকোলজি বিভাগের এক গবেষণায় শিখনের সঙ্গে স্মার্টফোনে আসক্তির ‘নেতিবাচক সম্পর্ক’ খুঁজে পাওয়া গেছে। ১৬টি দেশের প্রায় দেড় লাখ শিক্ষার্থীর ওপর গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়। আলাবামা স্টেট ইউনিভার্সিটির আরেকটি গবেষণায় দেখা যায়, ৬২ শতাংশ মানুষ ভার্চ্যুয়াল দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ভয়ে নিয়মিত ফোন চেক করে। যদিও এর মধ্যে ৮৮ শতাংশ মানুষই ফোন কাছে থাকলে নিজেকে নিরাপদ মনে করেন।
শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা
ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীরা মনোযোগ না দিলে শিক্ষকেরা চট করে সেটা ধরে ফেলতে পারেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সে কথাই বললেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আক্তার বানু। তিনি বলেন, ‘ক্লাসে এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে, যাদের প্রায়ই মনোযোগ থাকে না। অনেক সময়ই দেখা যায় তারা ফোন ব্যবহার করে বা করার চেষ্টা করে।’
যদিও কিছুটা ভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শাহাদাৎ হোসেন সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আসলে নির্ভর করে শিক্ষকদের ডেলিভারির ওপর। শিক্ষক যদি ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের ইনভলভ রাখতে পারেন, তাহলে অমনোযোগী হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। আমি আমার ক্লাসে সব সময় সেই চেষ্টা করি। তাই আমার ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই ধরনের প্রবণতা খুব একটা চোখে পড়ে না। যদিও মহামারির শুরুর দিকে অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই প্রবণতা ছিল।’
মনোযোগ বাড়াতে করণীয়
প্রযুক্তির প্রতি অতিরিক্ত আসক্তিই শিক্ষার্থীদের মনোযোগ নষ্ট করছে, এ ব্যাপারে দ্বিমত করার সুযোগ কম। কিন্তু এ থেকে উত্তরণের উপায় কী? মনোযোগ বাড়ানোর উপায় কী? অধ্যাপক আক্তার বানু বলেন, ‘এখনকার শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে অনেক কম। পরীক্ষা ছাড়া তারা পড়তে বসতে চায় না। তাই পরীক্ষা বা শিখন সম্পর্কিত অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত রাখা গেলে তারা আরও বেশি মনোযোগী হবে।’ যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে রুটিনমাফিক চলারও পরামর্শ দেন এডুকেশনাল সাইকোলজির এই শিক্ষক।
মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট মাইন্ডটুলসের মতে, মানুষের কাজের পরিবেশ, মানসিক অবস্থা ও পুষ্টি—এই কয়েকটি বিষয়ই মূলত মনোযোগের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। মনোযোগ বাড়াতে কাজের সময় ছোট ছোট বিরতি, নিজেকে পুরস্কার দেওয়া, কাজের গুরুত্ব নির্ধারণ, একই সময়ে শুধু একটি কাজের ওপর মনোযোগ নিবিষ্ট রাখার কথা বলা হয়েছে এই ওয়েবসাইটে। এ ছাড়া নিয়মিত ব্যায়াম, পরিমিত ঘুম, পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম মনোযোগ বৃদ্ধি করে বলে বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়।
[FA]pen[/FA] লেখক: ফুয়াদ পাবলো