‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ দেখতে যাওয়ার আগে আপনাকে মাথায় রাখতে হবে মুভিটার নাম-ঊনপঞ্চাশ বাতাস। বাগধারায় যার অর্থ আদতে ‘পাগলামি’। তবে এখানকার হিসেব ঠিক পাগলামো না, নামটায় যে শিহরণ জাগানিয়া ব্যাপার আছে ওটাই এ সিনেমার ফ্লো।
এই সিনেমা নিয়ে কী কী বলা যায় একসঙ্গে? প্রেম? হিউমার? সায়েন্স ফিকশন? সামাজিক দ্বিচারিতা? সবটাকেই এখানে নিয়ে এসেছেন পরিচালক মাসুদ হাসান উজ্জ্বল।
ঊনপঞ্চাশ বাতাসের আকর্ষণ হলো নীরা-অয়নের প্রেম। সেই প্রেমে ন্যাকামি নেই, অভিজাত অংশগ্রহণ নেই, আরবান মিডল ক্লাস প্রেমের সংজ্ঞার সঙ্গে এই প্রেম যায় না, আবার উচ্চমার্গীয় রোমান্টিসিজমও নেই। এখানে মুগ্ধতা আছে, একটা টান আছে, একটা ইমাজিনেশন আছে, সবাই যে প্রেমের জন্য ছুটে আদতে কিন্তু সবাই যেখানে পৌঁছতে পারে না। আবার এই প্রেমকে পরিচালক এমন একটা ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে বিকশিত করেছেন যেখানে আমাদের সামাজিক জীবনের সবকিছু ফাংশন করছে। ভিড়, কোলাহল, নয়েজ, জীবনের বোঝাপড়া সবকিছুকে একসঙ্গে নিয়েই এই প্রেম হাঁটে।
শার্লিন ফারজানাকে আমি সবচেয়ে সাবলীল পেয়েছিলাম ‘দাস কেবিন’-এ। তিনি তার সেই গণ্ডি পেরিয়ে মূল অর্থেই বড় পর্দায় তার সর্বোচ্চটুকু দিয়েছেন। একজন লাইফ সায়েন্স এর স্টুডেন্ট হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পেরেছেন, থিতু হয়েছেন প্রেমিকা হিসেবে, আকর্ষণ করতে পেরেছেন মানবিক চরিত্রে নিজেকে তুলে ধরে। এই গল্পে আপনি ঢুকতে চাইলে শার্লিন ফারজানার বিকল্প ছিল না।
চরিত্রের প্রয়োজনে তিনি সাবলীল থেকেছেন, কখনো ম্যাচিউরড উচ্ছ্বাসে মেতেছেন, কখনো বা দৃষ্টিপাত করেছেন কৌতূহলী হয়ে।
অয়ন চরিত্রে ইমতিয়াজ বর্ষণের রোলটা ইন্টারেস্টিং। তাকে দেখেই আপনার সবার আগে মনে হবে কোথাও একটা তিনি আপনাকে রিলেট করছেন। মুভির শুরুতে তার রোল প্লে দেখে আমার কোথাও একটা ‘অপুর সংসার’ এর শুরুর কথা মনে পড়ছিল। তিনি আস্তে কথা বলেন যেখানে বিনয় প্রাধান্য পায়, ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই’ ধরনের সন্তুষ্টির জীবন তার, আবার তিনি অন্যের উপকারের জন্য নিজের সামর্থ্যের সবটুকু ঢেলে দিতে জানেন। আপনার মনে হবে এই মাইন্ডসেট এর কথা আপনি কখনো না কখনো একবার হলেও ভেবেছেন নিজের জন্য, নিজের জীবনে।
মাসুদ হাসান উজ্জ্বল অভিনেতা নির্বাচনে ভুল করেননি; এই স্ক্রিপ্টে অন্তত আমি তার বিকল্প দেখছি না। তবে বর্ষণ সম্ভবত তার সেরাটা এই সিনেমাতে দিতে পারেননি। তার অভিনয় শৈলী নিয়ে আমার সন্দেহ নেই। কিন্তু ঊনপঞ্চাশ বাতাসে তিনি আরো কিছু বেশি দিতে পারতেন। কোথাও একটা গিয়ে মনে হচ্ছিল তিনি যেভাবে হাসার চেষ্টা করছেন সেটা তার সাবলীল হাসি নয়; কিংবা যেভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তিনি ডিল করছেন সেটা খানিকটা মেকি৷ এসব ছোটখাটো ত্রুটি মুভির আবেদন কমাবে না। কিন্তু, পরেরবারের ভালো কিছুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
এই সিনেমার গানগুলো দীর্ঘদিন আলোচনায় থাকার মতো। ‘প্রথম ঝরে পড়া শিউলিটা’ কিংবা ‘এই শহর’-এর মতো গানগুলো আর গানের টাইমিংগুলো, কিংবা হৃদয়গ্রাহী লিরিকসমূহ একদম জমে ক্ষীর ধরনের। ওপার বাংলার সংগীতশিল্পী সোমলতার কণ্ঠে ‘যেখানে’ গানটাকেও আলোচনায় রাখতে হয়। ‘মেঘমালা’ গানটি পরিচালক নিজেই লিখেছেন এবং কণ্ঠ দিয়েছেন। সেটা সিনেমাটা দেখার পূর্ব অবধি চমকপ্রদ লাগলেও হলে বসে মনে হয়েছে, ‘প্রথম ঝরে পড়া শিউলিটা’র মতো এটাও বেসবাবা সুমনকে দিয়ে করালে ভালোই হতো। অবশ্য পরিচালক নিজেই স্বীকার করেছেন, এই গানটার সঙ্গে তার আবেগ জড়িয়ে থাকার কথা। সবকিছু মিলিয়ে এই মুভির সংগীত পরিচালনাকে দর্শকের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য অসাধারণ আয়োজন বলা যায়।
সিনেমাটোগ্রাফি যারা করেন তাদের জন্য এক্সপেরিমেন্টাল কাজের প্রকৃষ্ট একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে ঊনপঞ্চাশ বাতাস। কী দারুণ ক্যামেরার কাজ! ড্রোনে অয়ন-নীরার একত্রে কাশফুল বাগানে হেঁটে যাওয়ার শট, হতাশ নীরার ওভারব্রিজ এ দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য, হন্তদন্ত নীরার উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকা আর তার মাথার উপরে পাখিদের আসর ভেঙে ঘরে ফেরা, অয়নের কাপড় কাঁচার ঘরের দরজার ফাঁকে বৃষ্টির ফ্রেমিং সহ আরো কত কত মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।
একটা এস্থেটিক প্রেমের করুণ পরিণতি থেকে এই মুভি একেবারেই ইউটার্ন নিয়ে রূপ নেয় সায়েন্স ফিকশনে। সায়েন্স ফিকশনের পার্টে নীরার এক অন্য রূপ। যা দর্শকের দৃষ্টিগোচর হতে হতে মুভির ডিউরেশন দুই ঘন্টা ৪৫মিনিটে গিয়ে ঠেকে। দর্শকদের সবচেয়ে বেশি ভাবানোর কথা এই সায়েন্স ফিকশন ঘরানার কাজটাই। সেই অর্থে এই মুভির ডিউরেশন দীর্ঘই বলা চলে। দুই ঘণ্টা কিংবা দুই ঘণ্টা ১০মিনিটের একটা সুন্দর চিত্রনাট্য উপস্থাপন করা মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের কাছে চ্যালেঞ্জের ছিল না। মুভির ফিনিশিংকেও খাপে খাপ বলতে পারছি না। নতুন নীরাকে কিংবা জেনেটিকসের ওই থিওরিকে দর্শক কবজায় আনার আগেই যেন সিনেমাটা হুট করে শেষ হয়ে গেল। ‘ইনকমপ্লিট ব্রেথ’ বলেই হয়তো। সাউন্ড মিক্সিংয়েও একটা গম্ভীর পরিবেশনা পাওয়া গেছে। যদিও এই মুভির বড় আয়োজন ইকোলজি আর নয়েজের মিশ্রণে সোসাইটির ফান্ডামেন্টাল ফাংশন। সে অর্থে নয়েজ নেই, গুরুগম্ভীর ডাবিং; তবে তা উপভোগ্য।
ঊনপঞ্চাশ বাতাসের শুরু থেকে শেষ অবধি আমার বারবার মনে পড়ছিল ২০১৮ সালের উজ্জ্বলের ফেসবুকের সেই পোস্ট। যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনারা নায়িকার কোমর দেখাতে থাকেন, আমি উনপঞ্চাশ বাতাসকে সফল করেই ছাড়ব। ’ আমি যেদিন সিনেমাটা দেখতে যাই সেদিন চট্টগ্রাম শহরের সবদিকেই ভারী বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা। তবুও হল ছিল হাউজফুল। আর পরদিন তো দেখলাম টিকেটই পাওয়া যাচ্ছে না। তার মানে ঊনপঞ্চাশ বাতাসকে সাধারণ মানুষ নিজের সিনেমা মনে করতে পেরেছেন। এটাই সিনেমাটির বড় প্রাপ্তি।
ঊনপঞ্চাশ বাতাস আমাদের ঘুণে ধরে শেষ করে দেওয়া ইন্ডাস্ট্রিতে বিশাল পরিবর্তন আনবে না। কিন্তু এই সিনেমা সম্পূর্ণ নতুন এক জনরার প্রচলন ঘটাবে। যেকোনো পরিচালক গৎবাঁধা চিত্রনাট্যের বাইরে কাজ করতে যেখানে সাহস করবেন। যেখানে দর্শককে ভাবানো যায়, হলে পিনপতন নীরবতার মাঝে দর্শক সিনেমা দেখতে আগ্রহী হয় সেরকম এক জনরা।
অয়নের মৃত্যুর পর অঙ্গদান বা চোখ ফিরে পেয়ে চিড়িয়াখানা দেখতে যাওয়া শিশুর উচ্ছ্বাস কিংবা সাংবাদিকের সিগারেট এর ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে ‘সবকিছুর নিউজ করতে নেই’ যেখানে দর্শকের চোখের কোনায় পানি জমায়।
* লিখেছেন: সাইদ খান সাগর