মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। আল্লাহ তাআলা আমাদের মহান সৃষ্টিকর্তা। তিনি যদি তাঁকে সৃষ্টি না করতেন, তাহলে জগতের কিছুই আর সৃষ্টি করতেন না। মহামহিম আল্লাহর যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, তাঁর আখলাকও নিশ্চয়ই শ্রেষ্ঠতম। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে রাসুল (সা.) প্রশিক্ষিত হন। এ জন্য মহানবীর চরিত্র সম্পর্কে একবার জিজ্ঞাসা করা হলে উম্মুল মুমেনিন আয়েশা (রা.) সংক্ষেপে বলেন, তাঁর চরিত্র ছিল আল-কোরআন। এর মর্মার্থ হচ্ছে পবিত্র কোরআনে উত্তম চরিত্র ও মহান নৈতিকতার যে বৈশিষ্ট্য প্রদর্শিত হয়েছে, রাসুলের মধ্যে সবই বিদ্যমান ছিল।
এ কথা আজ সর্বজনস্বীকৃত, আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মহানবী (সা.)-কে উসওয়াতুন হাসানা বা সুন্দরতম আদর্শ হিসেবেই পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। তিনি তাঁর চরিত্র, আচার-আচরণ ও সব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তাঁর প্রমাণই দিয়েছেন। সাহাবায়ে কিরাম প্রিয় নবী (সা.)-এর সব সুন্দরতম আচার-আচরণ, স্বভাব-চরিত্র ও রীতিনীতি যথাযথভাবে বিশ্বস্ততার মাধ্যমে পরবর্তীদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর এই অতুলনীয় চরিত্রমাধুরী বিশ্বমানবের জন্য অনুকরণীয়। আল্লাহ পাক এ কারণে কোরআন মজিদে ঘোষণা করেছেন, ‘রাসুল তোমাদের যা দেন, তা তোমরা গ্রহণ করো এবং যা থেকে তোমাদের বিরত থাকতে বলেন, তা থেকে বিরত থাকো।’ (৫৯: ৭)
আসলে নবী (সা.) তাঁর জীবনে এমন কিছু করেননি, যার ত্রুটি বা খুঁত চোখে পড়ে কিংবা সমালোচনা করা যায়।
প্রতিটা বিষয়ে নবী (সা.) অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। এসব বিষয়-আশয় শামায়েল ও আখলাক-সম্পর্কিত গ্রন্থগুলোতে পাওয়া যায়। এখানে আমরা নবীর জীবনের একটি অপূর্ব অধ্যায় সম্পর্কে দৃষ্টিপাত করব। নবী (সা.) আসলে কী ধরনের রং পছন্দ করতেন, সে সম্পর্কেই বলা হবে এ প্রবন্ধে। তার আগে রঙের প্রভাব সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক।
আসলে মানবজীবনে রঙের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। আলোকরশ্মি প্রতিবিম্বিত হলেই বস্তুতে রং পরিস্ফুট হয়। আমরা রং তখনই দেখি, যখন বস্তুতে এক বা একাধিক আলোকরশ্মি প্রতিবিম্বিত হয় এবং অবশিষ্ট রশ্মিগুলো শোষিত হয়। যে রশ্মিগুলো শোষিত হয়, সেগুলো সম্পূর্ণ হারিয়ে যায় এবং আমাদের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। যে আলোকরশ্মি বস্তুতে আপতিত হয়ে শোষিত হচ্ছে না অথবা বস্তুর মধ্য দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারছে না, তার প্রতিক্ষেপ ঘটবে, অর্থাৎ বস্তু সে রশ্মিকে বিক্ষিপ্ত করবে। যে কৌণিকরূপে রশ্মি বস্তুর ওপর নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, বস্তুও একই কৌণিক পরিমাপে তাকে নিক্ষেপ করবে। কোনো বস্তুর বহির্দেশ যদি অসমতল থাকে, তবে তা নিস্তেজ বা অনুজ্জ্বল দেখাবে। তার কারণ, আপতিত আলো তীক্ষ্ণভাবে প্রতিবিম্বিত না হয়ে যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়ে, অর্থাৎ তা বহুকৌণিকতায় বিভক্ত হয়ে তীক্ষ্ণতা হারিয়ে ফেলে।
অন্যপক্ষে সুমসৃণ বস্তুর ওপর নিক্ষিপ্ত আলোর বর্ণাঢ্যতা অসাধারণ উজ্জ্বল।
আলোর মধ্যেই যত রঙের খেলা। তাই আলোর পরিবর্তনের সঙ্গে রঙের পরিবর্তন ঘটে। তা ছাড়া একটি বস্তুকে এদিক-ওদিক নাড়লে রংও নড়াচড়া করে। এভাবে রঙের পরিবর্তনের সঙ্গে বস্তুর আকৃতিরও পরিবর্তন ঘটে।
রং নিজে কথা বলতে পারে না, তবে মানুষের গোপন অনুভূতিকে সহজে নাড়া দিয়ে থাকে।
আমাদের নবী পাক (সা.) অত্যন্ত রং-সচেতন ছিলেন। রাসুল (সা.)-এর জীবনের অনুপম চরিত্রমাধুরীর ওপর যুগে যুগে বহু গ্রন্থ লেখা হয়েছে। এর মধ্যে মুহাদ্দিস হাফিজ আবু মুহাম্মদ আবু শায়খ আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ জাফর ইবনে হায়্যান আনসারি ইসফাহানির আখলাকুন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়া আদাবিহি খুবই গ্রহণযোগ্য একটি গ্রন্থ। এ গ্রন্থে উদ্ধৃত নবীজির পোশাক-পরিচ্ছদসংক্রান্ত কিছু হাদিসের সূত্র থেকে জানা যায় তাঁর পছন্দের রং সম্পর্কে।
হজরত আবু হুজায়ফা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার নবী (সা.) বাইরে বের হলে তাঁর গায়ে লাল ডোরাবিশিষ্ট পোশাক ছিল এবং তা তাঁর পায়ের নলা পর্যন্ত ওঠানো ছিল।
আরেকটি হাদিসে বলা হচ্ছে, হজরত উরওয়া (রা.) বলেন, যে পোশাক পরিধান করে রাসুল (সা.) বহিরাগত প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করতেন, তা ছিল একখানা সবুজ চাদর ও জুব্বা। চাদরখানার দৈর্ঘ্য ছিল চার হাত এবং প্রস্থ ছিল দুই হাত ও এক বিঘত। নবীর সেই জুব্বা বরকত লাভের জন্য বর্তমানে খলিফাদের কাছে সংরক্ষিত। জুব্বাটি খুবই পুরোনো হয়ে গেছে। সংরক্ষণ ও সাবধানতার জন্য তাঁরা সেটিকে ভাঁজ করে আরেকটি কাপড়ের মধ্যে রেখেছেন। তাঁরা কেবল ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার সময় তা ব্যবহার করে থাকেন।
ইসমাইল ইবন আবদুল্লাহ ইবন জাফর (রা.) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-এর পবিত্র দেহে হলুদ রঙের দুখানা কাপড় দেখেছি।’
আনাস ইবন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.)-এর একটি হলুদ রঙের লেপ ছিল। তাঁর স্ত্রীগণ পালাক্রমে সেটি ব্যবহার করতেন।
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত যে একবার নবী (সা.) কালো রঙের ডোরাবিশিষ্ট চাদর পরিধান করলে হজরত আয়েশা (রা.) বললেন, ‘আপনার গায়ে এই কালো চাদরখানা কী সুন্দরই না মানিয়েছে! আপনার দেহের লাল-সাদামিশ্রিত রং চাদরের কালো রংকে অধিক ফুটিয়ে তুলছে এবং কালো রং আপনার শরীরের লাল-সাদামিশ্রিত বর্ণকে আরও দীপ্তিময় করে তুলছে।’
হজরত আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) কোনো কোনো সময় সাদা টুপি পরিধান করতেন।
ইসমাইল ইবন আবদুল্লাহ ইবন জাফর (রা.) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেছেন, ‘আমি নবী (সা.)-কে দুইখানা জাফরানি রঙের কাপড় পরিহিত অবস্থায় দেখেছি। কাপড় দুইখানার একখানা ছিল চাদর এবং অন্যখানা পাগড়ি।’
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.)-এর ছোট পতাকা ছিল সাদা এবং বড় পতাকা ছিল কাল। সেটি হজরত আয়েশা (রা.)-এর চাদর দিয়ে তৈরি ছিল এবং তার ওপর উটের পালান বা খাটনির নকশা ছিল।
এসব হাদিস থেকে একটা বিষয় খুবই পরিষ্কার, রাসুল (সা.) খুবই রং-সচেতন ছিলেন। তিনি তাঁর ব্যবহার্য জিনিসপত্রে সৌন্দর্যকে গুরুত্ব দিতেন বলেই তাঁর যাপিত জীবনে অনেক নমুনা পাওয়া যায়। মানুষের একঘেয়েমি জীবনে বিচিত্রতার জন্য অবশ্যই রঙের বাহারি ব্যবহারের প্রয়োজন রয়েছে। আর রং হলো মানুষের দর্শনসংক্রান্ত একটি চিরন্তন ধর্ম।
একটা কথা না বললে নয়, ইসলামে মনুষ্য এবং প্রাণিজ চিত্র নির্মাণ নিষিদ্ধ হলেও পারস্য এবং তুরস্কে ইসলামি চিত্রকলা একটি বিশেষ ব্যঞ্জনায় রূপ লাভ করেছে।
মুসলিম শিল্পীরা একটি নিরঙ্কুশ নিখুঁত সৌন্দর্য নির্মাণের প্রয়াস পেয়েছিলেন। তবে এ সৌন্দর্য গ্রিকদের মতো শরীরী সৌন্দর্য নয়, এ সৌন্দর্য ছিল আবহের সৌন্দর্য। তাই তারা বিভিন্ন রঙের সুচারু বিন্যাসে এবং জ্যামিতিক রেখাঙ্কনের অত্যন্ত দীপ্ত পরিমাপে এই আবহকে সৃষ্টি করেছিলেন। এই প্রভাব অনেকের ওপর ভর করেছিল, যেমনটি ঘটেছে আধুনিক শিল্পী মাতিসের ক্ষেত্রে। মুসলিম শিল্পীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাঁদের ব্যবহৃত নীল রংকে নতুন তাৎপর্যে ইউরোপের চিত্রকর্মে ব্যবহার করতে থাকেন।
ইসলামে শিল্পবৃত্তি অন্তরের প্রেরণায় অনুভূতির তাৎপর্যে বাইরের পৃথিবীতে দৃশ্যমানরূপে বিভিন্ন সৃজনশীলতায় চিহ্নিত হয়েছে। বিভিন্ন মুসলিম দেশের পতাকা, কাবার কালো পাথর, ঐতিহ্যবাহী মসজিদ, কাফনের সাদা কাপড় ব্যবহার, বেহেশতে সবুজ ইয়াকুত পাথরের বর্ণনা, কালো পাগড়ি ব্যবহার—এসব কিছু প্রমাণ করে রঙের বিচিত্রতায় সমৃদ্ধ এই ধর্ম। তবে মার্জিত, শান্ত ও স্নিগ্ধ প্রলেপের রঙের দিকেই ইসলামের অনুসারীদের মনোযোগ বেশি।
* মহিউদ্দীন মোহাম্মদ: কবি, আরবি সাহিত্যের গবেষক।