ইসলাম ধর্মের প্রচারক মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। আরব দেশের প্রসিদ্ধ মক্কা নগরে প্রতিপত্তিশালী কুরাইশ বংশে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার জন্মগ্রহণ করেন। মক্কার নেতৃত্ব ও কাবা গৃহের হেফাজতের ভার বহুকাল কুরাইশদের হাতে ছিল। বাণিজ্য ছিল কুরাইশদের প্রধান অবলম্বন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) মাতৃগর্ভে থাকতেই তাঁর পিতা আবদুল্লাহ ব্যবসা উপলক্ষে ইয়াসরিব (মদিনা) নগরে মাতুলালয়ে যাওয়ার পর সেখানে মারা যান। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম হলে পিতামহ আবদুল মুত্তালিব এই শিশুর লালন–পালনের ভার গ্রহণ করেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাইফবাসিনী বিবি হালিমার গৃহে থেকে তাঁর স্তন্যপান করেন। চার বছর পর পিতামহের আশ্রয়ে ফিরে আসেন। মুহাম্মদ (সা.)-এর ছয় বছর বয়সে তাঁর মাতা আমিনা তাঁকে ও দাসী উম্মে আয়মানকে সঙ্গে নিয়ে মদিনায় তাঁর পিতার মাতুলালয়ে যান। সেখানে এক মাস থেকে মক্কা ফেরার পথে আবওয়া নামক স্থানে আমিনার মৃত্যু হয়। উম্মে আয়মান অসহায় শিশুকে নিয়ে পিতামহের গৃহে ফিরে আসেন।
পিতামহের স্নেহ তিনি বেশি দিন ভোগ করতে পারেননি। তার আট বছর বয়সের সময় পিতামহ তাঁর লালন-পালনের ভার চাচা আবু তালিবের ওপর অর্পণ করে মারা যান।
শিক্ষার সুযোগ তাঁর কখনো ঘটেনি। মাঠে মাঠে ছাগ বা মেষপাল চরানো তাঁর একটি কর্তব্য ছিল। প্রকৃতির কোলে অসীম আকাশ আর দিগন্তবিস্তৃত মরুভূমি ও পাহাড় তাঁর একমাত্র শিক্ষাগার ছিল। তাঁর বয়স যখন ১৩ বছর, তখন আবু তালিব ব্যবসা উপলক্ষে সিরিয়া গমন করলে তিনিও তাঁর সঙ্গী হন। ২০ বছর বয়সের সময় মুহাম্মদ (সা.) নিজ বংশের প্রথা অনুযায়ী ব্যবসা আরম্ভ করেন। তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততার জন্য মক্কাবাসী তাকে ‘আল-আমিন’ অর্থাৎ বিশ্বস্ত আখ্যা দিয়েছিলেন। মক্কার খাদিজা নাম্নী এক উচ্চমনা ধনবতী বিধবা তাঁর সততা ও কর্তব্যপরায়ণতা প্রভৃতি সদগুণের কথা শুনে তাঁকে তাঁর সঙ্গে ভাগে ব্যবসা করতে আহ্বান জানান। তিনি এই প্রস্তাবে সম্মত হয়ে বাণিজ্যযাত্রা করেন। এ ব্যবসায় প্রচুর লাভ হয় এবং তিনি তাঁর ভাগে যথেষ্ট অর্থ লাভ করেন। মুহাম্মদ (সা.)-এর গুণপনায় মুগ্ধ হয়ে বিবি খাদিজা তাঁকে বিয়ে করেন। এই সময় তাঁর বয়স ২৫ বছর ও বিবি খাদিজার বয়স ৪০ বছর। এই বিয়ের ফলে বিবি খাদিজা তিন পুত্র ও চার কন্যার জন্ম দেন। পুত্রসন্তানেরা শৈশবেই মারা যান।
কাবা গৃহ পুনর্নির্মাণের পর পবিত্র কৃষ্ণপ্রস্তর সংস্থাপনের মর্যাদা লাভের জন্য কুরাইশ গোত্রগুলোর মধ্যে ভীষণ বিবাদ চলতে থাকে। অবশেষে মুহাম্মদ (সা.)-কে সালিস মান্য করা হলে তিনি একটা চাদরের ওপর কৃষ্ণপ্রস্তর রেখে সব গোত্রের নেতাদের বিভিন্ন প্রান্ত ধরে তা যথাস্থানে বহন করার সুযোগ দেন এবং স্বহস্তে প্রাচীরগাত্রে তা স্থাপন করেন। এভাবে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে তিনি বিবাদ নিষ্পত্তি ও রক্তপাত বন্ধ করেন।
চার বছরব্যাপী রক্তক্ষয়ী ফিজার যুদ্ধের পর শান্তিরক্ষা, অত্যাচারীর শাসন নিবারণ ও নিপীড়িতের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মক্কায় হিলফুল ফুজুল নামে যে সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা সংগঠনে তিনি নেতৃস্থানীয়দের একজন ছিলেন।
মুহাম্মদ (সা.) বাল্যকাল থেকেই গভীর চিন্তাশীল ছিলেন। মূর্তিপূজা ও বর্বরোচিত মারামারি, মদ্যপান, জুয়াখেলা, অবিচার, ব্যভিচার প্রভৃতি অনাচার দেখে তাঁর মন তিক্ততায় ভরে যায়। তিনি বাড়ি ছেড়ে মক্কার দু-তিন মাইল দূরবর্তী পাহাড়ে চলে যান এবং গিরিগুহায় কয়েক দিন ধরে গভীর ধ্যান ও প্রার্থনায় মগ্ন হয়ে কাটান। এভাবে ধ্যান করতে করতে ৪০ বছর বয়সকালে তাঁর কাছে সত্য প্রকাশিত হয়। আল্লাহর দূত জিবরাইল (আ.) তাঁকে লক্ষ্য করে বলে যান যে একমাত্র আল্লাহই সারা জাহানের স্রষ্টা, তিনিই একমাত্র উপাস্য, অন্য কেউ নয়; আর তিনি নিজ আদেশ-উপদেশ শিক্ষা দেওয়ার জন্য মুহাম্মদ (সা.)-কে রাসুল হিসেবে মনোনীত করেছেন। গৃহে ফিরে তিনি স্ত্রীকে এসব কথা জানালেন। বিবি খাদিজা (রা.) তাঁর কথায় বিশ্বাস করে প্রথম মুসলিম হন। এরপর আল্লাহর তরফ থেকে জিবরাইল (আ.) মারফত মাঝেমধ্যে পবিত্র কোরআন মজিদের অংশবিশেষ তাঁর কাছে আসতে থাকে। তিনি গোপনে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে শুরু করেন। রিসালতের প্রথম তিন বছরে প্রায় ৩০ জন লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। আলী (রা.), উসমান (রা.) ও আবু উবাইদা তাঁদের অন্তর্গত। চতুর্থ বর্ষে তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার করতে শুরু করেন।
বস্তুত, তখন থেকেই ইসলামের ধর্মমত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। পাশাপাশি তাঁর ও তাঁর ধর্মানুসারীদের জীবন নানাভাবে বিপৎসংকুল হতে থাকে। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে নবুয়তের পঞ্চম বর্ষে একদল মুসলিম আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। মুহাম্মদ (সা.) নানারূপ প্রলোভন ও অকথ্য নির্যাতন নীরবে সহ্য করে মক্কায় থেকে প্রচারকাজ চালাতে থাকেন। নবুয়তের ষষ্ঠ বর্ষে রাসুল (সা.)-এর চাচা হামজা ও মক্কার প্রতিপত্তিশালী নেতা ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করলে মুসলমানদের মনে সাহসের সঞ্চার হয় এবং তাঁরা প্রকাশ্যে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করতে থাকেন। ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মুশরিকদের শত্রুতাও বৃদ্ধি পায়। তাঁদের নির্মম অত্যাচার ও অসহযোগের ফলে মুসলমানরা তিন বছরকাল একটি গিরিসংকটে অবরুদ্ধ থেকে খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে নিদারুণ কষ্টে অতিবাহিত করেন। অসহযোগ নীতিতে কোনো ধরনের সুফল না হওয়ায় নবুয়তের দশম বর্ষে তা পরিত্যক্ত হয়। এ সময় আবু তালিব ও খাদিজা (রা.)-এর মৃত্যুতে মুহাম্মদ (সা.) বিমর্ষ হয়ে পড়েন এবং মক্কা ছেড়ে তাইফে ইসলাম প্রচার করতে যান। কিন্তু প্রস্তরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মক্কায় ফিরে আসেন। নবুয়তের দ্বাদশ বর্ষে মিরাজ বা ঊর্ধ্বলোকে আরোহণ মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এদিকে মুশরিকদের অত্যাচার ক্রমেই বাড়তে থাকে। ফলে মুসলমানরা এ সময় ক্রমে ক্রমে পিছিয়ে যেতে থাকেন। এটা দেখে মুশরিকরা মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রাণবধ করতে দৃঢ়সংকল্প হয়। শত্রুদলকে নিরাশ করে তিনি রাতের বেলা আবুবকর (রা.)-কে সঙ্গে নিয়ে মদিনায় চলে যান। মদিনায় বহু অধিবাসী আগেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
মদিনাবাসী আনসাররা মক্কার মুহাজিরদের নিজ নিজ গৃহে স্থান দিয়ে তাঁদের সঙ্গে ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ হন। অল্প দিনের মধ্যেই ইহুদি ছাড়া প্রায় সব মদিনাবাসীই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তাঁরা রাসুল (সা.)-কে নগরে একমাত্র বিচারক ও শাসনকর্তা হিসেবে মেনে নেন।
তিনি একটি মিত্রতার চুক্তিপত্র সম্পাদনের মাধ্যমে মদিনার অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দান করে মুসলিমদের সঙ্গে এক জাতি গঠনের ভিত্তি স্থাপন করেন।
মুসলমানরা মক্কা ত্যাগ করলেও মক্কার কুরাইশরা তাদের শত্রুতা ছাড়েনি। মদিনার ইহুদিদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তারা মদিনা আক্রমণের আয়োজন করতে থাকে। হিজরি দ্বিতীয় (৬২৪ খ্রি.) বর্ষে মক্কার এক হাজার কুরাইশ অস্ত্রসজ্জিত হয়ে মদিনা আক্রমণ করতে আসে। মুহাম্মদ (সা.) মাত্র ৩১৩ জন সঙ্গী নিয়ে আক্রমণ প্রতিরোধ করতে অগ্রসর হন। বদর নামক স্থানে ভীষণ যুদ্ধ হয় এবং কুরাইশরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ১৩ জন মুসলিম শহীদ হন এবং মুশরিকদের পক্ষে ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন বন্দী হয়।
পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে হিজরি তৃতীয় বর্ষে (৬২৫ খ্রি.) আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ৩ হাজার কুরাইশ মদিনা আক্রমণ করতে আসে। মদিনার নিকটবর্তী ওহোদ পাহাড়ের পাদদেশে সাত শত মুসলিমের সঙ্গে তাদের ভীষণ যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে বহু মুসলিম শহীদ হন। মুহাম্মদ (সা.) স্বয়ং ভীষণভাবে আহত হন ও প্রস্তরাঘাতে তাঁর একটি দাঁত ভেঙে যায়। শত্রুপক্ষও ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। হিজরি চতুর্থ বর্ষে কুরাইশরা বিভিন্ন আরব গোত্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে মদিনা অবরোধ করে। মদিনার ইহুদিরাও তাদের সাহায্য করে। মুসলমানরা মদিনার চারপাশে খন্দক বা পরিখা খনন করে আত্মরক্ষা করেন। প্রবল ঝড়বৃষ্টি ও শিলাপাতের ফলে শত্রুপক্ষ ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধকে আহজাবের (দলগুলো) বা খন্দকের (পরিখা) যুদ্ধ বলা হয়। হিজরি ষষ্ঠ বর্ষে রাসুল (সা.) পবিত্র কাবা গৃহের ওমরা ব্রত পালন করার জন্য ১ হাজার ৫০০ সাহাবিসহ মক্কার উদ্দেশে রওনা হন। হুদায়বিয়া নামক স্থানে পৌঁছালে মক্কাবাসী তাঁদের বাধা দিয়ে সন্ধি দাবি করে। নিরাপত্তা স্থাপনের ফলে আরবের বিভিন্ন সম্প্রদায় অবাধে মুসলমানদের সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ পেয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। মদিনার ইহুদিরা নানাভাবে শত্রুতা ও বিশ্বাসঘাতকতার জন্য নির্বাসিত হলে খায়বার নামক স্থানে গিয়ে অন্য ক্ষমতাবান ইহুদিদের সঙ্গে মিলে মুসলিমদের ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। মুহাম্মদ (সা.) হিজরি সপ্তম বর্ষে খাইবার অভিযানে গিয়ে আটটি অজেয় দুর্গ দখল করেন।
হুদায়বিয়ার সন্ধি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। মক্কার মুশরিকরা মুসলিমদের এক মিত্রগোত্রকে আক্রমণ করে বহু লোককে হত্যা করে। সন্ধি ভঙ্গ হওয়ায় মুহাম্মদ (সা.) ১০ হাজার সৈন্য নিয়ে মক্কা বিজয়ে অগ্রসর হলে শত্রু দলপতি আবু সুফিয়ান তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে ইসলাম গ্রহণ করেন। এভাবে মক্কার সব নর-নারী দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। যখন সংবাদ এল পার্শ্ববর্তী তাইফ অঞ্চল থেকে মুশরিক সৈন্যরা মুসলমানদের আক্রমণ করতে আসছে, তখন মুহাম্মদ (সা.) ১৪ হাজার সৈন্যসহ হুনাইন নামক স্থানে এক ভীষণ যুদ্ধে শত্রুদলকে পরাস্ত করার পর তিনি মক্কার শাসনভার সেখানকার প্রতিনিধির ওপর ন্যস্ত করে মদিনায় ফিরে আসেন।
নবম ও দশম হিজরিতে বিভিন্ন এলাকার বহু প্রতিনিধিদল মদিনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করে নিজ নিজ অঞ্চলের সব লোককে ইসলাম ধর্ম শিক্ষা দিতে থাকেন। দশম হিজরিতে মুহাম্মদ (সা.) শেষবার হজব্রত পালন করেন। আরাফাত পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে তিনি মুসলমানদের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের পবিত্র কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। সব মুসলিম এক ভ্রাতৃসমাজ; নর-নারীর পরস্পরের ওপর সমান অধিকার; দাস-দাসীর প্রতি সদয় ব্যবহার; ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা; পৌত্তলিকতা, নরহত্যা, অত্যাচার, ব্যভিচার, চুরি ও সুদ বর্জন; আল্লাহর কিতাব ও সুন্নত অনুসরণ ও শেষ বিচারের দিনে যাবতীয় কৃতকর্মের হিসাব প্রভৃতি বিষয়ে তিনি উপদেশ দান করেন।
বিদায় হজ সম্পাদন করে মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় ফিরে আসেন। হিজরি একাদশ বর্ষে (৬৩২ খ্রি.) ৬৩ বছর বয়সে কয়েক দিন জ্বরভোগের পর ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন এক মহান চরিত্র এবং তাঁর অনুসারীদের জন্য এক উত্তম আদর্শ।
সূত্র: মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ‘যার যা ধর্ম’, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
* মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: প্রয়াত সাবেক প্রধান বিচারপতি, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা