What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

লাইলাতুল মি‘রাজঃ করণীয় ও বর্জনীয় (2 Viewers)

arn43

Co-Admin
Staff member
Co-Admin
Joined
Mar 2, 2018
Threads
1,623
Messages
122,962
Credits
296,923
DVD
Whiskey
SanDisk Sansa
SanDisk Sansa
Computer
Glasses sunglasses
লাইলাতুল মি‘রাজ : করণীয় ও বর্জনীয়

হিজরী বর্ষের ৪টি মাস হারাম তথা মহা সম্মানিত এবং নিরাপত্তার মাস (তওবা ৩৬) আদিকাল হ’তে এ মাস সমূহের সম্মান ও গুরুত্ব চলে আসছে। এ মাস সমূহে আরবের কাফেররা পর্যন্ত যুদ্ধ-বিগ্রহ, ছিনতাই-লুটতরাজ, হত্যা-গুম ইত্যাদি বন্ধ রাখত। উক্ত মাস সমূহের অন্যতম মাস রজব। এমাসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবনের সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা ‘মি‘রাজ’ সংঘটিত হয়েছিল। মি‘রাজ ইসলামের ইতিহাসে এমনকি পুরা নবুওয়াতের ইতিহাসেও এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। কারণ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ) ছাড়া অন্য কোন নবী এই সৌভাগ্য লাভ করতে পারেননি। আর এ কারণেই মুহাম্মাদ (ছাঃ) শ্রেষ্ঠ নবী। এ মি‘রাজ রজনীতেই মানব জাতির শ্রেষ্ঠ ইবাদত পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয হয়। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে লাইলাতুল মি‘রাজের গুরুত্ব এবং এ রাতের করণীয় ও বর্জনীয় আলোচনা করা হ’ল-
মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, سُبْحَانَ الَّذِيْ أَسْرَىْ بِعَبْدِهِ لَيْلاً مِنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِيْ بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آَيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيْعُ الْبَصِيْرُ ‘পরম পবিত্র মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রিবেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আক্বছা পর্যন্ত। যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি। যাতে আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’
(ইসরা ১)
مِعْرَاجٌআরবী শব্দ, অর্থ সিঁড়ি। শারঈ অর্থে বায়তুল মুক্বাদ্দাস থেকে যে অলৌকিক সিঁড়ির মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে সপ্ত আসমানের উপরে আরশের নিকটে আল্লাহর সান্নিধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়, সেই সিঁড়িকে ‘মি‘রাজ’ বলা হয়। পারিভাষিক অর্থে হিজরতের পূর্বে একটি বিশেষ রাতের শেষ প্রহরে বায়তুল্লাহ হ’তে বায়তুল মুক্বাদ্দাস পর্যন্ত ‘বোরাক্বে’
(بُرَاقٌ আরবী শব্দ যাبَرْقٌ মূলধাতু হ’তে নির্গত। এর অর্থ বিদ্যুৎ। এটি বিদ্যুতের মত আশ্চর্যজনক দ্রুতগতিসম্পন্ন ডানাওয়ালা অশ্ব বিশেষ। খচ্চরের চেয়ে ছোট ও গাধার চেয়ে একটু বড়। কর্ণদ্বয় অতি চিকন এবং গায়ের রং ধবধবে সাদা। ) ভ্রমণ, অতঃপর সেখান থেকে অলৌকিক সিঁড়ির মাধ্যমে সপ্ত আসমান পেরিয়ে আরশে আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন ও পুনরায় বায়তুল মুক্বাদ্দাস হয়ে বোরাক্বে আরোহন করে প্রভাতের আগেই মক্কায় নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তনের ঘটনাকে ‘মি‘রাজ’ বলা হয়। (মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, মি‘রাজ, মাসিক আত-তাহরীক, ৭ম বর্ষ, ১২ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর-২০০৪, পৃঃ ৩।) اَسْرَىক্রিয়াটি اِسْرَاءٌমূলধাতু হ’তে উৎপন্ন। অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমণ। আয়াতে উল্লিখিত ‘ইসরা’ বা রাত্রিকালীন ভ্রমণ বলতে মি‘রাজের রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আক্বছা পর্যন্ত সফরকে বুঝানো হয়। অর্থাৎ ‘ইসরা’ হ’ল যমীন থেকে যমীনে ভ্রমণ। অনেকটা বিমান বন্দরের ‘রানওয়ে’র মত। প্রথমে একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে দ্রুত ছুটে চলা, অতঃপর ধীরে ধীরে ঊর্ধ্বে ওঠা। আর যমীন হ’তে ঊর্ধ্বলোকে ভ্রমণকে মি‘রাজ বলা হয়। কুরআন মাজীদের সূরা বানী ইসরাঈলের ১ম আয়াতে ‘ইসরা’ এবং সূরা নাজমের ১৩ থেকে ১৯ আয়াত পর্যন্ত ‘মিরাজে’র ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া ২৬-এর অধিক ছাহাবী কর্তৃক বুখারী, মুসলিম সহ প্রায় সকল হাদীছ গ্রন্থে মুতাওয়াতির পর্যায়ে মি‘রাজের ঘটনাবলী বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং মি‘রাজ অকাট্যভাবে প্রমাণিত একটি সত্য ঘটনা। যাতে সন্দেহ পোষণের কোন অবকাশ নেই।
 
মি‘রাজের সংক্ষিপ্ত ঘটনা :
একদা রাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কা‘বার হাতীমে, অন্য বর্ণনায় নিজ গৃহে (উম্মে হানীর) ঘুমিয়ে ছিলেন। রাতের শেষভাগে জিবরীল (আঃ) আল্লাহর নির্দেশমতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁকে বোরাকের পিঠে আরোহন করিয়ে বায়তুল্লাহ থেকে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে নিয়ে যান। সেখানে পৌঁছে তিনি বোরাক্বটিকে একটি পাথরের সাথে বেঁধে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করেন। অতঃপর তাঁর নিকট ঊর্ধ্বলোকে ভ্রমণের বিশেষ বাহন উপস্থিত করা হয়। মতান্তরে ঐ বোরাক্বের মাধ্যমে জিবরীল (আঃ) তাঁকে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ (سِدْرَةٌআরবী শব্দ, অর্থ কুলগাছ। المُنْتَهَىঅর্থ প্রান্তসীমা বা শেষ সীমা। সুতরাং ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ অর্থ প্রান্তস্থিত কুলবৃক্ষ। যা অতীব সুন্দর ও সুসজ্জিত। ফেরেশতাদের গমনাগমনের এটাই শেষ সীমা। এর উপরে আল্লাহর আরশ অবস্থিত। আল্লাহর বিধানাবলী আরশ থেকে প্রথমে এখানে নাযিল করা হয়। অতঃপর সেখান থেকে সংশ্লিষ্ট ফেরেশতাগণের মাধ্যমে দুনিয়াতে প্রেরিত হয়। অনুরূপভাবে বান্দাদের আমলনামা সমূহ প্রথমে এখানে নিয়ে আসা হয়। অতঃপর এখান থেকে আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। ফেরেশতা বা নবী-রাসূল কেউই এই স্থান অতিক্রম করতে পারেননি, মুহাম্মাদ (ছাঃ) ব্যতীত। ) পর্যন্ত নিয়ে যান। পথিমধ্যে প্রথম আসমানে আদম (আঃ), দ্বিতীয় আসমানে ইয়াহ্ইয়া ও ঈসা (আঃ), তৃতীয় আসমানে ইউসুফ (আঃ), চতুর্থ আসমানে ইদ্রীস (আঃ), পঞ্চম আসমানে হারূণ (আঃ), ষষ্ঠ আসমানে মূসা (আঃ) এবং সপ্ত আসমানে মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম (আঃ)-এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ও পরিচয় হয়। অতঃপর জান্নাত-জাহান্নাম ও ‘বায়তুল মা‘মূর’ (বায়তুল মা‘মূর : সপ্ত আসমানে অবস্থিত ফেরেশতাদের মসজিদ। যাকে আসমানের কা‘বা বলা হয়ে থাকে। দৈনিক সত্তর হাযার ফেরেশতা ইবাদতের জন্য সেখানে প্রবেশ করে এবং বের হয়ে যায়। ক্বিয়ামত পর্যন্ত সেখানে কারো দ্বিতীয়বার প্রবেশের সুযোগ আসবে না।) পরিদর্শন করেন। সিদরাতুল মুনতাহা পৌঁছে জিবরীল (আঃ) তাঁকে তথায় একা রেখে চলে যান। এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ‘রফরফ’ (رَفْرَفٌ আরবী শব্দ। যার অর্থ রেশমী কাপড়, বালিশ, চাদর, মাদুর ইত্যাদি। রফরফ হ’ল সবুজ রংয়ের গদি বিশিষ্ট পাল্কী বিশেষ, এক প্রকার বাহন, যার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সিদরাতুল মুনতাহা থেকে আরশে মু‘আল্লাকা গিয়েছিলেন। ) বাহন আরশে মু‘আল্লাকা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে এক টুকরা মেঘ আচ্ছাদিত করে ফেলে। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। এসময় মহান আল্লাহ তাঁর বান্দার অতীব নিকটে আসেন এবং তাঁর দিকে ঝুকে পড়েন। এসময় উভয়ের মাঝে দূরত্ব ছিল দুই ধনুক বা দুই গজেরও কম। তখন আল্লাহ তাঁকে অহী করেন-ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى- فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى- فَأَوْحَى إِلَى عَبْدِهِ مَا أَوْحَى- ‘অতঃপর নিকটবর্তী হ’ল এবং ঝুলে গেল। তখন দুই ধনুকের ব্যবধান ছিল বা তারও কম। তখন আল্লাহ স্বীয় বান্দার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করার তা করলেন’ (নাজম ৮-১০)
 
আল্লাহ পাক উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য ৫০ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর থেকে মেঘমালা সরে গেলে তিনি জিবরীল (আঃ)-এর সাথে দুনিয়াতে ফিরে আসার জন্য রওনা দিলেন। পথিমধ্যে ষষ্ঠ আসমানে মূসা (আঃ) তাঁকে মি‘রাজের প্রাপ্তি ও প্রত্যাদেশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁকে ৫০ ওয়াক্ত ছালাতের কথা বলেন। মূসা (আঃ) তাঁকে পুনরায় আল্লাহর নিকট ফিরে গিয়ে ছালাতের পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্য পরামর্শ দিলেন। মূসা (আঃ)-এর পীড়াপীড়িতে রাসূল (ছাঃ) কয়েকবার আল্লাহর নিকট যান এবং ছালাতের ওয়াক্তের পরিমাণ হ্রাস করার অনুরোধ করেন। ফলে আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় অনুগ্রহে ৫০ ওয়াক্ত ছালাতকে কমাতে কমাতে ৫ ওয়াক্ত করে দেন, যা ৫০ ওয়াক্তের ফযীলতের সমান। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বচক্ষে জান্নাত, জাহান্নাম, বায়তুল মা‘মূর, মাকামে মাহমূদ, হাউযে কাওছার ইত্যাদি পরিদর্শন করে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে ফিরে আসেন এবং বিভিন্ন আসমানে যে সকল আম্বিয়ায়ে কেরামের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল তারাও তাঁর সাথে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে অবতরণ করেন। অতঃপর তিনি আম্বিয়ায়ে কেরামকে সাথে নিয়ে সেখানে দু’রাক‘আত ছালাতের ইমামতি করেন। (কারো মতে সেটি ছিল ফজরের ছালাত)। ছালাত শেষে তাঁকে জাহান্নামের দারোগা ‘মালেক’ ফেরেশতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর বোরাক্বে আরোহন করে অন্ধকার থাকা অবস্থায় তিনি পুনরায় মক্কায় নিজ গৃহে ফিরে আসেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৮৬২-৬৬, ‘মি‘রাজ’ অধ্যায়; মাসিক আত-তাহরীক, সেপ্টেম্বর-২০০৪, পৃঃ ৫।)
 
মি‘রাজ সংঘটিত হওয়ার সময়কাল :

মি‘রাজ সংঘটিত হওয়ার সঠিক তারিখ বা দিনক্ষণ সম্পর্কে মুহাদ্দিছীন ও ওলামায়ে কেরামের মাঝে মত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আর-রাহীকুল মাখতূম-এর লেখক ছফীউর রহমান মুবারকপুরী (রহঃ) এ বিষয়ে ৬টি মতামত উল্লেখ করেছেন। যথা-
(১) নবুওয়াত প্রাপ্তির বছর,
(২) ৫ম নববী বর্ষে,
(৩) ১০ম নববী বর্ষের ২৭শে রজব রাতে,
(৪) কেউ বলেছেন, হিজরতের ১৬ মাস পূর্বে ১২ নববী বর্ষের রামাযান মাসে,
(৫) কেউ বলেছেন, হিজরতের ১৪ মাস পূর্বে ১৩ নববী বর্ষের মুহাররম মাসে এবং
(৬) কেউ বলেছেন, হিজরতের এক বছর পূর্বে ১৩ নববী বর্ষের রবীউল আউয়াল মাসে।
অতঃপর মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন, প্রথম তিনটি মত গ্রহণযোগ্য নয় একারণে যে, খাদীজা (রাঃ) ১০ম নববী বর্ষের রামাযান মাসে মারা গেছেন। আর তখনও পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয হয়নি। আর এ বিষয়ে সকলে একমত যে, ছালাত ফরয হয়েছে মি‘রাজের রাত্রিতে। বাকী তিনটি মত সম্পর্কে তিনি বলেন, এগুলোর কোনটিকে আমি অগ্রাধিকার দেব তা ভেবে পাইনা। তবে সূরা বনী ইসরাঈলে বর্ণিত আয়াতের পূর্বাপর সম্পর্ক এ বিষয়টি প্রমাণ করে যে, ‘ইসরা’র ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবনের একেবারে শেষের দিকে হয়েছিল।
(মাসিক আত-তাহরীক, সেপ্টেম্বর-২০০৪, পৃঃ ৭।) কারো মতে ৬২০ বা ৬২১ খৃষ্টাব্দে নবুওয়াতের দশম বছরের রজব মাসের ২৭ তারিখ রাতে মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছে। হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) খ্যাতনামা জ্যেষ্ঠ তাবেঈ ইবনু শিহাব যুহরীর বরাতে বলেন, হিজরতের একবছর পূর্বে মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছিল। (তদেব।) অতএব নির্দিষ্টভাবে ২৭শে রজব দিবাগত রাতে মি‘রাজ হয়েছিল বলে যে কথা পাক-ভারত উপমহাদেশে প্রচলিত আছে তা নিতান্তই দলীল বিহীন। (শিহাবুদ্দীন সুন্নী, মাহে রজব-হুরমত মাস, মাসিক আত-তাহরীক, ১ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, নভেম্বর-১৯৯৭, পৃঃ ৯।) অন্যান্য ধর্মের লোকের ন্যায় মুসলমানরাও যাতে ধর্মের নামে অহেতুক আনুষ্ঠানিকতায় বন্দী না হয়ে পড়ে সে কারণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্ম দিন, লাইলাতুল ক্বদর ইত্যাদির ন্যায় লাইলাতুল মি‘রাজের দিন-তারিখকেও ভুলিয়ে দেওয়ার মধ্যে মহান আল্লাহর পূর্ণ কৌশল নিহিত আছে বলে অনুমিত হয়।
 
মি‘রাজের প্রাপ্তি :

মি‘রাজে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে স্বীয় সান্নিধ্যে ডেকে নিয়ে উম্মতে মুহাম্মাদীকে পুরস্কার স্বরূপ তিনটি বিষয় প্রদান করেন। যথা-
(১)الصلوات الخمس বা পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত। যা ফযীলতের দিক দিয়ে ৫০ ওয়াক্তের সমান। সুতরাং ছালাত হ’ল উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য আল্লাহর দেওয়া সবচেয়ে বড় পুরস্কার। কারণ ছালাতের মাধ্যমেই মানুষের নৈতিক উন্নয়ন ঘটে। আর নৈতিক উন্নতিই হ’ল সকল উন্নতির চাবিকাঠি।
(২)خواةيم سورة البقرةতথা সূরা বাক্বারাহর শেষের কয়েকটি আয়াত (২৮৫-৮৬)। কারণ এ আয়াতগুলোতে উম্মতের প্রতি আল্লাহর অশেষ রহমত ও অনুগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে এবং
(৩)وغفر لمن لايشرك بالله من أمته شيئا والمقحمات উম্মতে মুহাম্মাদীর মধ্যে যারা কখনো শিরক করেনি, তাদেরকে ক্ষমা করার সুসংবাদ। কারণ শিরক হ’ল পাপসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় পাপ
(লোক্বমান ১৩) মহান আল্লাহ অন্য কোন পাপের কারণে সরাসরি জান্নাত হারাম ঘোষণা করেননি শিরক ব্যতীত (মায়েদাহ ৭২) আর একমাত্র শিরকের গোনাহ ছাড়া অন্যান্য গোনাসমূহ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দিবেন (নিসা ৪৮)
উল্লেখ্য যে, মিরক্বাত, রাদ্দুল মুহতার, মিসকুল খিতাম প্রভৃতি গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে যে, মি‘রাজে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘আত্তাহিইয়াতু’ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। অথচ একথার স্বপক্ষে কোন বিশুদ্ধ প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং এটি ছহীহ মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ)-এর সূত্রে বর্ণিত ছহীহ হাদীছের সরাসরি বিরোধী। অতএব ভিত্তিহীন এ সমস্ত বক্তব্য থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।
 
মি‘রাজের উদ্দেশ্য ও শিক্ষা :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মি‘রাজ তথা ঊর্ধ্বলোকে গমনের উদ্দেশ্য ব্যাপক। মহানবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নবুওয়াতী জীবনে মি‘রাজের মত এক মহিমান্বিত ও অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পেছনে যে কারণগুলো মুখ্য তা হ’ল-
(১) মহান আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্যে হাযির হওয়া,
(২) ঊর্ধ্বলোক সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন,
(৩) অদৃশ্য ভাগ্য সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান লাভ,
(৪) ইহকাল ও পরকাল সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন,
(৫) স্বচক্ষে জান্নাত-জাহান্নাম অবলোকন,
(৬) পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের সাথে সাক্ষাৎ ও পরিচিত হওয়া,
(৭) সুবিশাল নভোমন্ডল পরিভ্রমণ করা, এবং
(৮) সর্বোপরি এটিকে একটি অনন্য মু‘জিযা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা।
মি‘রাজের শিক্ষা সম্পর্কে ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে ‘আবদ’ বা দাস বলে সম্বোধন করেছেন। এর মর্মার্থ এই যে, বান্দার জন্য এর চেয়ে সম্মানিত কোন নাম আল্লাহর কাছে নেই, থাকলে অবশ্যই সে নামে রাসূল (ছাঃ)-কে সম্বোধন করে সম্মানিত করা হ’ত। আর মি‘রাজের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হ’ল সর্বপ্রকার গর্ব-অহংকার চূর্ণ করে আল্লাহর সবচেয়ে বড় দাস হওয়ার চেষ্টা করা। কারণ দাসত্বের মধ্যেই সর্বাধিক সম্মান ও মর্যাদা নিহিত রয়েছে। অতএব জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর দাসত্ব করা ও ছালাতের হেফাযত করাই হ’ল মি‘রাজের সবচেয়ে বড় এবং মূল শিক্ষা।
 
মি‘রাজ উপলক্ষে করণীয় ও বর্জনীয় :

আমাদের দেশে তথা ভারতীয় উপমহাদেশে মি‘রাজ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভা, দো‘আ, মীলাদ, ওয়াজ মাহফিল ইত্যাদি অনুষ্ঠানে শবে মি‘রাজের গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে বহু বানোয়াট কল্প-কাহিনী ও ভিত্তিহীন জাল-মওযূ‘ হাদীছের বর্ণনা শোনা যায়। যার দু’একটি নিম্নরূপ- আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘যেব্যক্তি রজব মাসের ২৭ তারিখ অর্থাৎ মি‘রাজ দিবসে ছিয়াম পালন করবে, তার আমলনামায় ৬০ মাসের ছিয়ামের নেকী লেখা হবে’। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলূল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ২৭রজব (অর্থাৎ মি‘রাজের রাত্রিতে) ইবাদত করবে, তার আমলনামায় একশ’ বছরের ইবাদতের ছওয়াব লেখা হবে’। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ (রহঃ) বলেন, রজব মাসের ২৭ তারিখের রাতের ছালাতের ব্যাপারে ওলামায়ে ইসলাম ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, এটি প্রমাণযোগ্য নয়। (গোলাম রহমান, মাহে মে‘রাজ, মাসিক আত-তাহরীক, ২য়বর্ষ, ২য় সংখ্যা, নভেম্বর-১৯৯৮, পৃঃ ২২।) মি‘রাজ উপলক্ষে রজব মাসের ফযীলত সম্পর্কে ও বহু জাল হাদীছ শোনা যায়। এ বিষয়ে নিম্নে কতিপয় জাল হাদীছ উদ্ধৃত হ’ল-
১. আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যেব্যক্তি রজবের প্রথম রজনীতে মাগরিবের ছালাতের পর বিশ রাক‘আত ছালাত আদায় করবে, যার প্রত্যেক রাক‘আতে সূরা ফাতিহা ও সূরা ইখলাছ পড়বে ...’। অতঃপর দীর্ঘ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। ইমাম ইবনুল জাউযী বলেন, হাদীছটি মওযূ।
(কিতাবুল মওযূ‘আত, ২য় খন্ড, পৃঃ ১২৩, বৈরুত ছাপা;মাসিক আত-তাহরীক,নভেম্বর-১৯৯৮, পৃঃ২৩।)
২. ইবনু আববাস (রাঃ)বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রজবের দিবসে ছিয়াম পালন করবে এবং চার রাক‘আত ছালাত আদায় করবে, যার প্রথম রাক‘আতে একশত বার আয়াতুল কুরসী পড়বে...’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ইমাম ইবনুল জাওযী বলেন, হাদীছটি মওযূ। এর অধিকাংশ বর্ণনা অন্ধকার। এর সনদে ওছমান নাম করাবী মুহাদ্দিছগণের দৃষ্টিতে পরিত্যক্ত।
(তদেব।)
 
৩. আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রজবের রজনীতে চৌদ্দ রাক‘আত ছালাত আদায় করবে, যার প্রত্যেক রাক‘আতে সূরা ফাতিহা একবার, কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ বিশবার, কুল আঊযু বিরবিবল ফালাক্ব তিনবার, কুল আঊযু বিরবিবন নাস তিনবার পড়বে। অতঃপর ছালাত হ’তে ফারেগ হয়ে দশবার দরূদ পড়বে... ’ ইত্যাদি। ইমাম ইবনুল জাওযী বলেন, হাদীছটি মওযূ। (তদেব।) আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর নামে বর্ণিত জাল হাদীছে আছে যে, রাসূল (ছাঃ) নাকি বলেছেন, ‘রজব মাস আল্লাহর মাস, শা‘বান মাস আমার মাস এবং রামাযান মাস উম্মতের মাস। অতএব যে ব্যক্তি ঈমানের অবস্থায় নেকীর আশায় রজবের ছিয়াম পালন করবে তার জন্য আল্লাহর মহা সন্তোষ অবধারিত হয়ে যায় এবং তাকে তিনি জান্নাতুল ফেরদৌসে স্থান দিবেন...। যে ব্যক্তি রজব মাসে ২ থেকে ১৫টি ছিয়াম পালন করবে, তার নেকী পাহাড়ের মত হবে... সে কুষ্ঠ, শ্বেত ও পাগলামী রোগ থেকে মুক্তি পাবে। ... জাহান্নামের সাতটি দরজা তার জন্য বন্ধ থাকবে। ...জান্নাতের আটটি দরজা তার জন্য খোলা থাকবে’। জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রহঃ) বলেন, হাদীছটি জাল। (মাসিক আত-তাহরীক, নভেম্বর-১৯৯৮, পৃঃ) অতএব রজব মাসের সম্মানে বিশেষ ছিয়াম পালন করা, ২৭ শে রজবের রাত্রিকে শবে মি‘রাজ ধারণা করে ঐ রাতকে ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করা, উক্ত উদ্দেশ্যে বিশেষ কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা, যিকির-আযকার, শাবীনা খতম ও দো‘আর অনুষ্ঠান করা, মীলাদ ও ওয়ায মাহফিল করা, ঐ রাতের ছওয়াব লাভের উদ্দেশ্যে সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা, সরকারী ছুটি ঘোষণা করা ও তার ফলে জাতীয় অর্থনীতির বিশাল অংকের ক্ষতি করা, ছহীহ হাদীছ বাদ দিয়ে মি‘রাজের নামে উদ্ভট সব গল্পবাজি করা, মি‘রাজকে বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণ করতে গিয়ে অনুমান ভিত্তিক কথা বলা, ঐ দিন আতশবাজি, আলোক সজ্জা, কবর যিয়ারত, দান-খয়রাত এবং এমাসের ফযীলত লাভের আশায় ওমরাহ পালন ইত্যাদি সবই বিদ‘আতের পর্যায়ভুক্ত। (মাসিক আত-তাহরীক, সেপ্টেম্বর-২০০৪, পৃঃ ৯।)

পরিশেষে বলা যায় যে, মি‘রাজ উপলক্ষে পালিত উল্লেখিত বিদ‘আত সমূহ বর্জন করে বরং আল্লাহর নির্দেশ মেনে এ দিনের ও মাসের সম্মানে মারামারি, খুনা-খুনি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম থেকে দূরে থাকাই বড় নেকীর কাজ। জাহেলী যুগের কাফেররাও এ মাসের সম্মানে আপোষে ঝগড়া-ফাসাদ ও যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ রাখত। অথচ মুসলমানরা আজ পর্যন্ত আল্লাহর হুকুম মেনে তাঁর সম্মানে আপোষে হানাহানি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম থেকে বিরত হ’তে পারেনি। যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। মহান আল্লাহ আমাদেরকে মি‘রাজের প্রকৃত শিক্ষা উপলব্ধি করে শিরক-বিদ‘আত সহ সর্বপ্রকার গর্হিত কাজ থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!
 

Users who are viewing this thread

Back
Top