What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কুয়াশা ( থ্রীলার সিরিজ) (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
324
Messages
5,988
Credits
44,826
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
০১.

প্ৰচন্ড শীত। মাঘের প্রথম। রাত দেড়টা। সেগুনবাগান।

সমস্ত এলাকাটা ঘুমে অচেতন। জন প্রাণীর সাড়াশব্দ নেই। কেবল টহলদার নাইট গার্ড টহল দিয়ে ফিরছে। মাঝে মাঝে হুইল বাজাচ্ছে, সাথে সাথেই দূর থেকে ক্ষীণ প্রত্যুত্তর আসছে ভেসে।

খট খট খট। টহলদারের লাঠির শব্দে রাত্রি আরও নিঝুম হয়ে আসে। রাস্তার পাশে সারি সারি লাইটপোস্টের আলোর চারধারে অনেকগুলো পোকা অনবরত ঘোরে।

এমনি সময় দেখা গেল একখানি কালো শেভ্রোলে গাড়ি সামনের বহুদূর পর্যন্ত আলোকিত করে দ্রুত এগিয়ে আসছে। গাড়িটা কাছে এলে নাম্বার প্লেটের দিকে নজর যেতেই টহলদারের শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল। সশব্দে জুতো ঠুকে স্যালুট করলো সে। সিটি এস. পি.-র গাড়ি। ভিতরটা অন্ধকার। কেউ মাথা নাড়লো কিনা বোঝা গেল না। গাড়ি সমান গতিতে এগিয়ে গোল সামনে।

গাড়িটা এসে থামলো একটা একতলা বাড়ির সামনে। এদিকটা অন্ধকার। মৃদু গর্জন করে এঞ্জিনটা বন্ধ হয়ে গেল। একজন ওভারকোট পরা লোক নামলো গাড়ি থেকে। নিঃশব্দে আগন্তুক এগিয়ে গেল বাড়িটার দিকে। হাতে তার ছোটো একটা বাক্স।

লোকালয় থেকে কিছু দূরে বাড়িটা। অনেকদিনের পুরোনো বাড়ি, কিন্তু এখনও বেশ মজবুত আছে। বাড়ির সামনে খানিকটা বাগান। এলোমেলো করে অনেক ফুলগাছ লাগানো। মাঝে মাঝে পেয়ারা, জামরুল আর আম-কাঠালের গাছ। সবটা মিলে জঙ্গল বলে বোধ হয়। তারকাটা দিয়ে ঘেরা বাগানটা। ছোট একটা লোহার গেট আছে বাড়িতে ঢুকবার জন্যে।

কোনও শব্দ না করে গেট খুললো লোকটা। একবার চারদিকে চাইলো, তারপর ঢুকে পড়লো বাগানের ভিতর। সোজা এগিয়ে গেল সে বাড়িটার দিকে। সব কটা দরজাই বন্ধ ভিতর থেকে। কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবলো আগন্তুক, তারপর একটা জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। মোটা শিক দেয়া জানালা। বেডরুম। সমস্ত ঘরটার মধ্যে কেবল এই জানালাই খোলা। হাতের বাক্স খুলে ফেললো লোকটা। ওটা কিসের যেন একটা যন্ত্র। ক্যামেরার মতো দেখতে। খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করে রেগুলেট করে নিয়ে যন্ত্রটার মুখ শিকের নিচের দিকে ধরে একটা বোতাম টিপতেই মুহুর্তে আশ্চর্যজনক ভাবে গলে তেল লোহার গরাদ। এইভাবে সব কটা গরাদই গলিয়ে ফেললো আগন্তুক। তারপর অবলীলাক্রমে একটা একটা করে সব শিক বাঁকিয়ে উপর দিকে তুলে দিলো।

এবার নিঃশব্দে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়লো লোকটা। দুজন মানুষ ঘুমিয়ে আছে মস্ত একটা খাটের উপর লেপ মুড়ি দিয়ে। স্বামী-স্ত্রী বলেই মনে হয়। খাটের তলে একটা হ্যারিকেন রাখা, আলো খুব কমানো। খাটের কাছে একটা দামী আয়রন সেফ। চাবি ঢোকাবার জায়গায় বোতাম টিপে যন্ত্রটা ধরতেই নাম করা কোম্পানীর আয়রন সেফ আলগা হয়ে গেল। কয়েক তোড়া নোট এবং গোটাকতক গিনি পকেটে পুরলো আগন্তুক। আরেকটা দেরাজে কয়েকটা দামী গহনা। হীরে সেট করা বহুমূল্য নেকলেসটা পকেটে ফেললো সে।

এবারে বারান্দার দিকের দরজা খুলে দিলো লোকটা। তারপর যন্ত্রটা খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করে নিয়ে থাটের পাশে এসে দাঁড়ালো। পুরুষ লোকটার গায়ের উপর থেকে লেপ খানিকটা সরিয়ে দিয়ে তার বুকের কাছে যন্ত্রটা নিয়ে বোতাম টিপে দিলো। ঘুমন্ত লোকটা আচমকা চোখ খুলে তাকালো। তারপর খোলা অবস্থাতেই স্থির হয়ে গেল।

নির্বিকারভাবে যন্ত্রটা বাক্সে পুরলো লোকটা। সন্তৰ্পণে মৃত ব্যক্তির শরীরের উপর থেকে সবটা লেপ সরিয়ে দিলো। তারপর পাঁজাকোলা করে ভারি মৃতদেহটা অনায়াসে তুলে নিলো বিছানা থেকে। খাটটা খচ মচ আওয়াজ করে উঠলো। স্ত্রী লোকটি পাশ। ফিরে লেপটা আরও টেনে নিয়ে শুলো। আততায়ী একটু চমকে উঠেছিল। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। গেটের কাছে এসে একবার তীর দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো, তারপর লাশটা পিছনের সিটে শুইয়ে দিয়ে স্টার্ট দিলো।

সেগুন বাগানের লম্বা রাস্তাটা দিয়ে কালো গাড়িটা জন্ত বেগে বেরিয়ে গেল। কেউ জানলো না এর মধ্যে কী কান্ড হয়ে গেল। ভোর পাঁচটা অবধি তেমনি হইসল বেজে চললো। পোকাগুলো লাইটপোস্টের চারধারে অনবরত ঘুরতেই থাকলো।

২.

প্ৰাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খানের ছোট্ট একতলা বাড়ির ড্রইংরুম। দামী পুরু কার্পেট বিছানো মেঝেতে। সোফা সেটটি অত্যন্ত রুচিসম্মত ভাবে সাজানো। দরজা দিয়ে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়ে দেয়ালে টাঙানো রবীন্দ্রনাথের বড় অয়েল পেইন্টিংটা। এক নজরে বোঝা যায় বাড়ির কর্তাটি অগাধ সম্পত্তির মালিক।

সকালবেলা স্নান সেরে একটা দামী কাশ্মীরী শাল গায়ে জড়িয়ে ড্রইংরুমে এসে বসেছে শহীদ। খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছে আর বার বার বাইরের দিকে তাকাচ্ছে। আজ ভোরে কামালের আসবার কথা। দু বন্ধু শিকারে যাবে সাত-গম্বুজের কাছে মাছরাঙা বিলে। আজকাল নাকি বেশ পাখি পড়ছে এ বিলে।

শহীদ ফিজিক্সে ফাস্টক্লাস পেয়ে পাস করেছে গেল বছর। কামাল এবার ইকনমিক্সে পাস করলো।

শহীদ কামাল দুজনেই অল্পবয়সে বাবাকে হারায়। ওদের বাবা দু জন ছিলেন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুজনেই ছিলেন অসীম সাহসী। তাঁরা আফ্রিকায় গিয়েছিলেন লিম্পোপো নদীর কুমীর শিকার করতে। সেখানেই দু জনের মৃত্যু হয়। বিস্তারিত ভাবে কিছুই জানা যায়নি, কেবল মৃত্যু সংবাদ এসে পৌঁছেছে ঢাকায়। সেদিন বাড়িতে যে কী কান্নার রোল উঠেছিল এখনও অস্পষ্ট ভাবে মনে পড়ে শহীদের। আজ পাঁচ বছর হয় মা-ও মারা গেছেন তার।

গফুর এসে দাড়ালো। ভারী পর্দা সরিয়ে জিজ্ঞেস করলো, দাদামণি চা এনে দেবো?

না। কামাল আসুক। আমরা একসাথেই নাস্তা করবো। প্রয়োজন হলে বাজার থেকে কিছু আনিয়ে নিস।

কিছু না বলে চলে গেল গফুর। ভাবটা যেন, সে কথা তুমি আমাকে শিখিয়ে দেবে? আমার আক্কেল নেই? মাসের প্রথম এক থোক টাকা গকুরের হাতে দিয়ে শহীদ নিশ্চিন্ত থাকে। আপাততঃ এই গার্জেনের উপর নিজের ভার ছেড়ে দিয়েছে সে। মা মারা যাওয়ার এক বছর আগে গফুর এসে ঢুকেছে এই বাড়িতে। এরই মধ্যে সে সমস্ত সংসারের তার নিজের মাথায় তুলে নিয়েছে। সংসার অরণ্য খুবই ছোটো, শহীদ আর তার ছোটো বোন লীনা। স্কুল ফাঁকি দিতে চাইলে বকাঝকা দিয়ে স্কুলে পাঠানো, কাঁচা কুল খেলে তম্বি করা; এসব কাজ শহীদ পারে না, গফুরকেই করতে হয়। যেমন প্রকান্ড তার শরীরের কাঠামো, তেমনি সরল এবং বিশ্বস্ত লোক এই গফুর।

অপরাধ বিজ্ঞানে শহীদের অসীম আগ্রহ। মাথা খুব পরিস্কার এবং অ্যাডভেঞ্চারের পাগল সে। তাই স্বভাবতই সে গোয়েন্দাগিরির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এরই মধ্যে কয়েকটা কেসে সে অদ্ভূত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। ওর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে বহুদূর পর্যন্ত। ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ ওকে হিংসে করতে আরম্ভ করেছে।

ইদানীং কামালও গোয়েন্দাগিরির দিকে ধীরে ধীরে ঝুকছে। আগে সে শহীদকে বকতো–তোর মাথায় কি টুকেছে রে? এসব ছাড়। গোয়েন্দাগিরি ভদ্রলোকের কাজ? কিন্তু এখন প্রায়ই সে শহীদকে এটা ওটা সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। নেশাটা ওকেও ধরেছে। ও এখন লুকিয়ে লুকিয়ে ক্রিমিনলজির বই পড়ে। কামাল কিছু দুর্বল প্রকৃতির লোক। শহীদের মতো অমন পেটা শরীরও তার নেই, অমন অসুরের মতো শক্তিও নেই। মাঝারি গোছের সুন্দর চেহারা। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। টানাটানা দুই চোখ।

ঠিক সাতটা বাজতে পাঁচ মিনিটে কামাল এসে ঢুকলো। হাতে একটা দোনলা বন্দুক। ওকে দেখেই শহীদ ফোস করে উঠলো, কিরে, এই তোর পাঁচটা?

কামাল কি যেন একটা জবাব দিতে যাচ্ছিলো। এমন সময় গফুর নাস্তা নিয়ে ঘরো ঢুকলো। টোস্ট, ডিম-পোচ এবং মোটা মোটা গোটা কয়েক অমৃতসাগর কলা।

শহীদ একটা কলার প্রায় অর্ধেকটা মুখের মধ্যে পুরে দিয়েছে, এমন সময় ক্রিং ক্রিং করে ফোন বেজে উঠলো। ফোনের দিকে আঙুল দিয়ে কামালকে ইশারা করতে কামাল ওর দুরবস্থা দেখে একটু হেসে ফোনের দিকে গেল।

হ্যালো..ইয়েস!..শহীদকে চাই ধরুন ডেকে দিচ্ছি।

শহীদ মুখের কলা শেষ করে ফোন ধরলো।

হ্যালো! কে?… হারুন?… কি বললে? পুলিসে খবর দিয়েছো?… দাওনি?… আমি বিশ মিনিটের মধ্যে আসছি, এর মধ্যে পুলিসে ফোন করো।

রিসিভার নামিয়ে রাখলো শহীদ। মুখটা চিন্তিত। কামালকে বললো, তুই বোস আমি কাপড় পরে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি। আজ আর শিকারে যাওয়া হবে না। হারুনের চাচাকে পাওয়া যাচ্ছে না, টাকা পয়সাও চুরি গেছে কাল রাতে। আমরা সেখানেই যাবো।

কিছুক্ষণ পর শহীদ বেরিয়ে এলে৷ ট্রপিক্যালের একটা দামী স্যুট পরে। চা ঠান্ডা হয়ে এসেছে, দুই ঢোকে শেষ করলো চা-টুকু। ইতিমধ্যে প্লেটের যাবতীয় সবকিছু কামাল আত্মসাৎ করে ফেলেছে।

শহীদের ছোট্ট মরিস মাইনর মাযহারুল হক সাহেবের বাসার সামনে এসে দাঁড়ালো। ঢাকার বিখ্যাত ধনী মাযহারুল হক। একটা জুয়েলারীর দোকান আছে নামপুরে, এছাড়া তিনটে বড় বড় হোটেলের মালিক। যুদ্ধের সময় কনটাক্টরী করে প্রচুর ধনসম্পত্তি করেছিলেন। ছেলেপুলে হয়নি। মৃত বড় ভাইয়ের একমাত্র পুত্র হারুনকে তিনি পিতৃস্নেহে মানুষ করেছেন। শহীদের সাধেই পদার্থবিজ্ঞানে ফাস্টক্লাস সেকেন্ড হয়ে পাস করেছে হারুন। রিসার্চ স্কলারশিপ পেয়ে সে এখন পি. এইচ. ডি.-র জন্যে রিসার্চ করছে।

গাড়ি থামতেই হারুন ছুটে এলো। তার সদা হাসিখুশি মুখ শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। শহীদ কোনও রকম সম্ভাষণ না করেই বললো, যে ঘরে চুরি হয়েছে, সে ঘরে আমাদের নিয়ে চলো। পুলিস এখনও আসেনি নিশ্চয়ই? তার আগেই আমি একবার ঘরটা পরীক্ষা করে দেখতে চাই।

বাগানের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে হারুন বললো, আমি একেবারে ভড়কে গেছি শহীদ। আইন-কানুন তো আমি কিছু বুঝি না, আমার ভয় হচ্ছে পুলিস আমাকে না সন্দেহ করে। আমিই তো কাকার বিপুল সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী। তাই তোমাকে আগেই ডেকে পাঠিয়েছি। তোমার উপরই আমি নির্ভর করছি পুরোপুরি। তুমি পারবে না ভাই আমাকে বাঁচাতে?

কেমন যেন জড়ানো জড়ানো গলায় সে কথাগুলো বললো। শেষটায় সে শহীদের দুই হাত ধরে ফেললো। বিস্মিত হয়ে শহীদ লক্ষ্য করলো কি ভয়ঙ্কর ভয় পেয়েছে হারুন। তাকে সান্তনা দেবার জন্যে বললো, তুমি এতো অস্থির হয়ো না, হারুন। চোর ধরা পড়বেই। তোমার ভয়ের কোনো কারণ নেই।

হারুন তাদের নিয়ে গেল একটা ঘরে। ঘরটার আসবাবপত্র খুবই কম, বেশ ছিমছাম। গরাদ বাকানো জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো শহীদ। ভালো করে লক্ষ্য করলো চৌকাঠের উপর কয়েক ফোটা গলা লোহা। কি করে এই লোহা গলানো সম্ভব তা কিছুতেই তার মাথায় এলো না। আয়রণ সেফটার কাছে এসে দাঁড়ালো, সেখানেও পরীক্ষা করলো কি ভাবে ষ্টীল গলে গিয়েছে। তার কপালে ভাজ পড়লো কয়েকটা। হারুনকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার কাকার সাথে এ ঘরে আর কে কে থাকেন?

চাচী আম্মা থাকেন।

ওকে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।

হারুন বাড়ির ভিতর চলে গেল। একটু পরেই তার সাথে এলেন এক প্রৌঢ়া মহিলা। শহীদ, কামাল দুজনেই তাকে আদাব দিলো। তিনিও আদাব জানিয়ে বললেন, বসো বাবারা। বলে নিজেই খাটের উপর বসে পড়লেন।

শহীদ জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা চাচী আম্মা, কাল আপনি কোনও কিছুর শব্দ শুনতে পাননি রাতের বেলা?

না বাবা। আমি হাঁপানিতে কষ্ট পাই, রাতে ঘুম হয় না। তাই আজ মাসখানেক ধরে ঘুমের ওষুধ খেয়ে বিছানায় শুই। ভোর ছটা৷ -সাড়ে ছটার আগে আর আমার ঘুম ভাঙে না।

এতগুলো কথা বলে তিনি হাঁপাতে লাগলেন। শহীদ বললো, আচ্ছা আয়রণ সেফে কি কি ছিলো বলতে পারবেন?

উনি কাল দুপুরে পঞ্চাশ হাজার নগদ টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে এনেছিলেন, সেই টাকা ছিলো, কিছু গহনা ছিলো, আর গিনি ছিলো কয়েকটা। সুন্দর সাজিয়ে কথাগুলো বলেন ভদ্রমহিলা।

সবই চুরি হয়ে গেছে?

গহনা বেশির ভাগই রয়েছে। একটা হীরে বসানো হার শুধু গেছে গহনা থেকে আর টাকা, গিনি সবই গেছে।

হীরে বসানো হারটার দাম কতো হবে?

পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে উনি ওটা তৈরি করেছিলেন হারুনের বউকে দেবার জন্যে। হারুনের বিয়ের কথাবার্তা চলছে কিনা।

কাকা যখন বিছানা থেকে উঠে যান, আপনি টের পাননি?

না বাবা।

আচ্ছা, চাচী আম্মা, আমরা এবার আসি।

শহীদ কামালের হাত ধরে এগিয়ে গেল। হারুন পিছন পিছন চললো। জিজ্ঞেস করলো, কিছু বুঝতে পারলে, শহীদ?

কিছুমাত্র না। তুমি কাউকে সন্দেহ করো এ ব্যাপারে?

আমি কিছু বুঝতে পারছি না। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ভৌতিক বলে বোধ হচ্ছে আমার কাছে। তাছাড়া আমি রিসার্চ নিয়ে থাকি, কাকার বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিত কারো সঙ্গে আমার বিশেষ চেনাশোনাও নেই। কাকে সন্দেহ করবো?

গাড়ির কাছে এসে হারুনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো শহীদ।

গুডবাই। রমনা থানাটা ঘুরে যাই একটু।

হারুন মিনতি ভরা কণ্ঠে বললো, দেখো ভাই, একটা কিছু সুরাহা তোমার করতেই হবে। তোমার যা খরচ পড়ে আমাকে বিল দিয়ো তক্ষুণি শোধ করে দেবো।

তুমি জানো আমি শখের গোয়েন্দা। যদি কিছু করি, কারো অনুরোধের অপেক্ষা রাখবো না। তাছাড়া টাকার প্রয়োজনও আমার পড়বে না।

এঞ্জিন স্টার্ট দিলো শহীদ। হারুন কি বলতে যাচ্ছিলো গাড়ি চলতে শুরু করায় থেমে গেল।

অনেক খোঁজ করে টহলদার নাইটগার্ডকে বের করে শহীদ জানতে পারলো যে রাত প্রায় দেড়টা-দুটোর সময় সিটি এস. পি.-র গাড়ি গিয়েছিল সেগুন বাগানে। আধঘন্টা পরেই আবার সে গাড়ি ফিরে যায়। ও জিজ্ঞেস করলো, এস. পি. সাহেবের গাড়ি চিনলে কি করে।

হুজুর, চিবারলেট গাড়ি আছিলো, পন্দ্রসও বাইশ নম্বর আছিলো।

আর কোনও গাড়ি যায়নি বেশি রাতে ওদিকে?

না, হুজুর।

কামাল বললো, পথে যাতে বাধা না পায় তার জন্যে শেভ্রোলে গাড়িতে প্রয়োজন মতো নম্বর লাগিয়ে নিতে পারে চোর বা চোরেরা।

হ্যাঁ, তা পারে। গম্ভীরভাবে উত্তর দিলো শহীদ। গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়েছে সে।

পরদিন কাগজে খবর বেরোলো, বিখ্যাত ব্যবসায়ী জনাব মাযহারুল হক নিখোঁজ। এরপর সবিস্তারে চুরির কথা লেখা হয়েছে। সব শেষে লিখেছে, বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গিয়াছে যে তীক্ষ্মধী শখের গোয়েন্দা মি. শহীদ খান এই ব্যাপারে তদন্ত করিতেছেন।
 
৩.

তিনদিন পর খবরের কাগজের মফঃস্বল সংবাদ বিভাগে ছোট্ট করে একটা খবর বেরোলো। গোয়ালন্দ স্টীমার ঘাটের নিকট নদীতে একটি লাশ ভাসিয়া যাইতেছিল। স্থানীয় ধীবররা উহা পাইয়া নিকটস্থ থানায় পৌঁছাইয়া দিয়াছে। মৃতদেহটি সম্পূর্ণ উলঙ্গ ছিলো। তাহার শরীরের সহিত একটি ভারি পাথর বাধা ছিলো। মুখে অনেকগুলো ছুরিকাঘাতের চিহ্ন থাকায় মৃতদেহ সনাক্ত করা যায় নাই। ময়না তদন্তের জন্য লাশ রাজবাড়িতে পাঠানো হইয়াছে।

খবরটা কারো নজরে পড়লো, কেউবা দেখলোই না। অনেকের মতো শহীদও পড়লো খবরটা।

ঠিক যেদিন খবরটা বেরোলো তার পরদিন আবার বড় বড় হরফে খবরঃ

গতরাতে লক্ষপতি অক্ষয় ব্যানার্জির বাড়িতে চুরি। সেই সঙ্গে অক্ষয় ব্যানার্জি নিখোঁজ। বহুমূল্য অলঙ্কারাদি এবং নগদ পচিশ হাজার টাকা লইয়া৷ চোরের নিরাপদে পলায়ন… ইত্যাদি।

শহীদ ভাবছিল, এ ব্যাপারটা তাকে না জানাবার কারণ কি? তবে কি পুলিস তাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছে। পত্রিকা অফিসেও রাতের বেলাই জানানো হয়েছে, অথচ…।

ঠিক সেই সময়ই টেলিফোন বেজে উঠলো।

হ্যালো!… লোকমান সাহেব?… এক্ষুণি আসতে হবে…. আচ্ছা, আসছি পনেরো মিনিটের মধ্যে।

রিসিভার নামিয়ে পিছনে ঘুরতেই শহীদ দেখলো কামাল দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। কামাল বললো, যাক, পেয়ে গেলাম তোকে। আমি খবরটা দেখেই এক দৌড়ে চলে এসেছি। ভাবছিলাম তুই হয়তো এতক্ষণে বেরিয়ে পরেছিস।

তুই একটু বোস, আমি কাপড়টা পরে আসি। এখনই থানায় যেতে হবে। তুইও চল আমার সঙ্গে।

শহীদের গাড়িটা রমনা থানার সামনে এসে দাঁড়ালো। লোকমান সাহেব এগিয়ে এলেন। সালাম বিনিময়ের পর শহীদ আর কামালকে নিয়ে অফিস ঘরে বসালেন লোকমান সাহেব। ইনিই রমনা থানার ও. সি.। মানুষটা খুবই আলাপী হাসিখুশি। শহীদের সাথে তাঁর অনেকদিনের পরিচয়। গত কয়েকটা কেসে এই লোকমান সাহেব অনেক সাহায্য করেছেন শহীদকে।

নিজের চেয়ারটায় বসে লোকমান সাহেব বললেন, মি. শহীদ, প্রথমেই কাজের কথা বলি। পর পর দুটো ঘটনা ঘটে গেল সেগুন বাগান আর পুরোনো পল্টনে। কাজেই পুলিস বিভাগ অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই দেখুন আই. জি. সাহেবের চিঠি। আপনার উপর তার অত্যন্ত আস্থা আছে, তাই তিনি প্রাইভেটলি এই ব্যাপারে আপনাকে এনগেজ করবার নির্দেশ দিয়েছেন। আপনার যা কিছু সাহায্যের প্রয়োজন হয়, তা আমাদের করতে হকুম দিয়েছেন।

শহীদ আগাগোড়া চিঠিটা পড়ে বললো, আপনাদের সাহায্য পাওয়া আমার পক্ষে মস্ত সৌভাগ্যের ব্যাপার। এজন্য ধন্যবাদ।

এখন আপনার জন্যে কি করতে পারি?

আপাততঃ অক্ষয় ব্যানার্জির বাড়িটা ঘুরে ফিরে দেখবার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

এক্ষুণি স্লিপ দিয়ে দিচ্ছি। খশ খশ করে লিখতে লাগলেন লোকমান সাহেব। চিঠিটা নিয়ে শহীদ উঠতেই লোকমান সাহেব ব্যস্ত হয়ে বললেন, সে কী উঠছেন যে? চা আনতে বলেছি তো! একটু বসুন, চা খেয়ে যাবেন। এ… সিপাই, জলদি চায়ে লাগাও।

মাফ করুন, মি. লোকমান। আজ নয়, অন্যদিন এসে খেয়ে যাবো–উঠে পড়ে শহীদ।

শহীদের মরীস মাইনর যখন রাস্তায় চলে, তখন বাইরে না চাইলে বোঝাই যায় না চলছে কি দাঁড়িয়ে আছে। পুরোনো পল্টনে অক্ষয় বাবুর বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামলো। দুজন সেন্ট্রি হোটের সামনে দাঁড়ানো। স্লিপটা আর তার উপরকার সিলটা দেখে সেলাম ঢুকে পথ ছেড়ে দিলো তারা।

দোতলার উপর তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এলো একজন সেন্ট্রি। সুন্দর করে সাজানো গোছানো ঘরটা। অক্ষয় বাবুর আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই। আজ বিশ বছর হয় তার স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি আর বিয়ে করেননি। ছেলেপুলে নেই, টাকা পয়সা আছে প্রচুর। একটা হাসপাতাল খুলেছেন তিনি বছর তিনেক হলো—সেখানে বিনামূল্যে প্রায় পাঁচশো রোগীর থাকার ব্যবস্থা আছে। এছাড়া অনেক স্কুল কলেজে তিনি প্রতি বছর মোটা টাকা দান করেন।

অক্ষয় বাবুর ঘরটার সাথেই পশ্চিম দিকে একটা ঝোলানো বারান্দা আছে। সেখানে একটা ইজিচেয়ার রাখা। বিকেলের পড়ন্ত রোদে গা-টা একটু গরম করবার জন্য অক্ষয় বাবু এখানে এসে বসতেন। ঘরের মধ্যে খোলা হাঁ করা রয়েছে একটা দেয়াল সিন্দুক। বিছানার কাছে একটা ছোটো টেবিলে কিছু বই-পত্র আর কয়েকটা মলমের কৌটো। বারান্দার দিকের একটা জানালার গরাদ বাঁকিয়ে উপর দিকে তোলা।

শহীদ আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলো, মযহারুল হক সাহেবের বাড়িতে যেভাবে লোহা গলানো হয়েছিল, ঠিক সেই একই পদ্ধতিতে এখানকার লোহাও গলানো হয়েছে।

পুলিস রাতে চাকরের ফোন পেয়ে এসে এ ঘরের দরজা ভেঙেছে। একজন চাকরের কাজ রাত তিনটের সময় অক্ষয় বাবুর জন্যে এক কাপ কফি করে তাকে ডেকে তোলা-তিনি তখন থেকে বাকি রাতটুকু পড়াশোনা করতেন। কিন্তু কাল অনেক ডাকাডাকি করেও তাকে ঘুম থেকে ওঠাতে না পেরে চাকর আর সবাইকে ডেকে তোলে। তারা অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কাধাকি করে পুলিসে ফোন করে। পুলিস এসে দরজা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে।

শহীদ এতসব বৃত্তান্ত একটা চাকরের কাছ থেকে মনোযোগ দিয়ে শুনলো। তাহলে অক্ষয় বাবু কোন পথে নিখোজ হলেনঃ একমাত্র পথ হচ্ছে বারান্দা। কেউ তাকে পিঠে বেঁধে নিয়ে রশি বেয়ে নিচে নেমে গেছে কিংবা তাঁকে রশিতে ঝুলিয়ে আগে মাটিতে নামিয়ে তারপর নিজে নেমে গেছে। তবে কি তাকে অজ্ঞান করে নিয়েছিল আগেই, নাকি খুন করা হয়েছিল।

আরও কয়েকজনের সাথে কথা বলে দেখলো শহীদ। কেউ নতুন কিছু বলতে পারলো না। চিন্তাক্লিষ্ট মুখে শহীদ নেমে গেল সিড়ি বেয়ে। পিছনে কামাল। কোনো কথা নেই কারো মুখে। আকাশ পাতাল কতো কি ভাবছে তারা। কোনও চিহ্নই পিছনে ফেলে যায়নি চোর।

৪.

চার পাঁচ দিন পার হয়ে গেছে। শহীদের শোবার ঘরে পা থেকে গলা পর্যন্ত ভালো করে আলোয়ান মুড়ি দিয়ে শহীদ আর কামাল রেডিয়ো শুনছে। কলকাতায় তানসেন সঙ্গীত সম্মেলন হচ্ছে-তারই রীলে শুনছে দুজন। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনবার অত্যন্ত আগ্ৰহ উভয়েরই। মনের এই দিকটায় দুজনের অস্তৃত মিল। রবিশঙ্করের সেতার হচ্ছে। ললিত রাগে আলাপ চলছে। অপূর্ব সুন্দর বাজাচ্ছে। ঠিক মনের কথাটা সুর হয়ে বেরিয়ে আসছে যেন। শহীদ মনে মনে আওড়ায় তড়পত হু য্যয়সে জল বিন মীন। তন্ময় হয়ে গিয়েছে দুজন।

রাত সাড়ে-বারোটার দিকে বাজনা প্রায় শেষ হয়ে এলো। অতি দ্রুত লয়ে ঝালা চলছে, ঝালার মধ্যে ছোটো ছোটো গমক তান। তবলা প্ৰাণপণে বাজাচ্ছে, এ-ও যে সে নয়, চতুরলাল তবলুচি।

ঠিক এমনি সময়ে ক্রিং ক্রিং করে ড্রইংরুমে ফোন বেজে উঠলো। সমস্ত মুখটা বিরক্তিতে বিকৃত করে শহীদ উঠে গেল। ফোন বেজেই চলেছে। রাগ লাগে শহীদের।

শহীদ যখন ফিরে এলো তখন একটা লম্বা তেহাই দিয়ে শেষ হলো বাজনা। রেডিয়ো বন্ধ করে দিয়ে কামাল জিজ্ঞেস করলো, কিসের ফোন রে?

লোকমান সাহেব ফোন করেছিলেন। আবার আরেকখানে চুরি। মানুষও একজন গায়েব। ব্যাটারা পেলো কি বল দেখি? আমাকে যেতে বলছিলেন লোকমান সাহেব-আমি বলে দিলাম যাবো না।

যাবি না কেন?

কোনও লাভ নেই। কোনও সূত্র পাওয়া যাবে না সেখানে গিয়ে। শুধু শুধু হয়রানি এই শীতের রাতে।

কার বাড়িতে হামলা হলো এবার?

রোকনপুরের ডক্টর ইখতিয়ার আহমেদের বাড়িতে। ভদ্রলোক এম. আর. সি.পি.। ঠিক একই ভাবে শিক বাকিয়ে চোর ঢুকেছিল। নিখোঁজ হয়েছে ডাক্তারের বারো বছরের ছেলে।

কিন্তু কি আশ্চর্য! বার বার চোর অবলীলাক্রমে নিজের কাজ সারছে, কোনওকিছুই করা যাচ্ছে না। এর কি কোনও প্রতিকার নেই?

কি জানি। কিছুই তো বুঝতে পারছি না।

আমার কিন্তু একটা ব্যাপারে সন্দেহ হয়। তোকে এতোদিন বলিনি। একটা ক্ষীণ আশার রেখা হয়তো পাবি। এই দেখ দুইটা দিনের খবরের কাটিং। প্ৰথম নিখোঁজের ঠিক তিন দিন পর এটা বেরিয়েছিল। আর দ্বিতীয় নিখোঁজের তিনদিন পর এই-টা। একই ভাবে দুদুটো মৃতদেহ পাওয়া যাওয়ায় গোয়ালন্দে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এবার তিনদিন পর যদি আরেকটা মৃত্যু সংবাদ পাওয়া যায় তাহলেই নিশ্চিন্ত মনে আমরা কোয়ালন্দ রওনা হতে পারি, কি বলিস?

কামালের গভীর চিন্তানিত মুখের দিকে তাকিয়ে শহীদ হেসে ফেললো। বললো, আমরা রওনা হতে পারি মানে? আমি গোয়েন্দা মানুষ আমি যেতে পারি, কিন্তু তুই যাবি কোন দুঃখে?

ব্যঙ্গ করছিস, না দর্প করছিস বুঝতে পারছি না। কি ভেবেছিস? তোর পিছন পিছন খামোকাই ঘুরছি নাকি? আমি যাবো না মানে? একশো বার যাবো, যাবোই তো।

না, তুই আবার এসব গোয়েন্দাগিরি তেমন পছন্দ করিস না কিনা তাই বলছিলাম। যাকগে, যে খবরটার কথা তুই বলছিস, সেটা আমারও নজরে পড়েছে। আমি হক সাহেব আর অক্ষয় ব্যানার্জীর শরীরে কি কি চিহ্ন ছিলো, প্রথমে তাই জেনেছি। তারপর রাজবাড়ি হাসপাতালে ট্রাঙ্ককল করেছি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, জানতে পেলাম প্রথম জনের ডান হাতের বুড়ো আঙুল কেটে ফেলা হয়েছিল, আর দ্বিতীয় জনের ডান পায়ের হাঁটুর কাছ থেকে খানিকটা মাংস কাটা ছিলো। হারুনের কাছ থেকে জানতে পারি তার কাকার ডান হাতের বুড়ো আঙুলের উপর মন্ত এক আঁচিল ছিলো। আর অক্ষয় বাবুর চাকরের কাছ থেকে জানতে পারি, প্রায় দেড় বছর যাবত তিনি হাঁটুর কাছে একটা দাদ হওয়ায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। অনেক পয়সা খরচ করেও সেটা সারানো যাচ্ছিলো না। এখন বুঝতেই পারছিস, আমাদের সন্দেহ শতকরা নম্বই ভাগ যুক্তিযুক্ত হয়েছে।

তাহলে চল না, আমরা গোয়ালন্দ রওনা হয়ে যাই।

দেখা যাক। আয় আপাততঃ শুয়ে পড়ি, রাত অনেক হয়েছে।

দুজনেই বিছানায় ঢুকে পড়েছে, এমন সময় কামালের চোখে পড়লো মাথার দিককার জানলার গরাদ ধরে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। সার্সির ওপারে লোকটার মুখ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। চমকে লাফিয়ে উঠে বসলো কামাল। চিৎকার করে উঠলো, কে ওখানে?

স্যাৎ করে সরে গেল মুখটা। বালিশের তলা থেকে রিভলবারটা নিয়ে বিদ্যুৎগতিতে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো শহীদ। জানালাটা খুলতেই দড়াম করে একটা পাথর এসে লাগলো শহীদের কপালে। উঃ করে একটা আর্তনাদ–শহীদ ঘুরে পড়ে গেল মাটিতে। কামাল ছুটে এসে ধরলো শহীদকে। বাইরে একটা মোটর স্টার্ট নেয়ার শব্দ পাওয়া গেল। কামাল চেয়ে দেখলো একটা গাড়ির পিছনের লালবাতি দুটো দ্রুত বেগে চলে গেল বড় রাস্তার দিকে।
 
৫.

সকাল বেলা কামাল ঘুম থেকে উঠে দেখলো শহীদ আলোয়ান জড়িয়ে গুটিদুটি মেরে বসে আছে চেয়ারে। চোখ বন্ধ। গভীর ভাবে কি যেন ভাবছে। মুখে জ্বলন্ত সিগারেট। প্রকান্ড একটা হাই তুলে কামাল বললো, উঠলাম।

একটু চমকে উঠলো শহীদ। তারপর একটা খাম ওর দিকে ছুড়ে দিলো। বিছানার কাছে মাটিতে পড়লো খামটা। কুড়িয়ে নিয়ে খুলে ফেললো কামাল। ছোট এক টুকরো কাগজ। তাতে স্পষ্ট হস্তাক্ষরে লেখাঃ

শহীদ খান,

তুমি আমার পেছনে লাগতে এসো না। আমি জানি, যদি কেউ কখনও আমার কাজে বাধা দিতে পারে, সে হচ্ছো তুমি। পুলিস বা তাদের ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ -এর সাধ্য নেই আমার কেশাগ্র স্পর্শ করে। আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, তুমি আমাকে বাঁধা দিয়ো না। যে টাকা আমি চুরি করেছি সে সমস্তই মানব-কল্যাণের উদ্দেশ্যে ব্যয় করা হচ্ছে। আর যে সব মানুষ আমি চুরি করেছি, তাদের লাগিয়েছি আমার গবেষণার কাজে। আর কদিন পর যখন পৃথিবী আশ্চর্য হয়ে যাবে আমার আবিষ্কার দেখে, যখন পৃথিবীর মানুষ প্রভূত উপকার পাবে সেই আবিষ্কার থেকে, তখন বুঝবে সামান্য কিছু টাকা আর কয়েকজন মানুষের প্রাণের বিনিময়ে আমি কতো বড় দান দিয়ে গেলাম পৃথিবীটাকে। ইতি–

কুয়াশা

কামাল চিঠিটা শেষ করে দেখলো শহীদ আবার চোখ বন্ধ করে সিগারেট টানছে। সে বললো, চিঠিটা পেলি কোথায়?

আমাদের মশারীর উপর।

কি ঠিক করলি?

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে শহীদ বললো, একটা কথা জানিস, এই ধরনের লোকদের ওপর আমার বড় একটা দুর্বলতা আছে। আমি জানি, এমন কিছু বিষয় আছে যা নিয়ে গবেষণা করতে গেলে মানুষ খুন করতে হয়। অথচ সেটা বেআইনী। সামান্য একটু বেআইনী কাজ করলে হয়তো পৃথিবীর মস্ত বড় উপকার হয়, তবু তা করা যাবে না। যারা বিজ্ঞান-পাগল, তারা কোনও আইন মানে না। প্রয়োজন মতো মানুষ খুন করা এদের কাছে অতি সাধারণ কাজ।

কামাল কি যেন বলতে যাচ্ছিলো। শহীদ তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, তাই বলে মনে করিস না আমি এই মানুষ খুন আর টাকা চুরির ব্যাপারে হাত গুটিয়ে বসে থাকবো। আমি এই পাগল বৈজ্ঞানিকের বিরুদ্ধে আমার সব শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বো।

একটানা এতগুলো কথা বলে। শহীদ চুপ করলো। কামাল বললো, আমিও তাই বুঝি। যে করে হোক এই লোককে ধরিয়ে দিতেই হবে পুলিশের হাতে।

নারায়ণগঞ্জ-গোয়ালন্দ ষ্টীমার চাঁদপুর ঘুরে যায়। বড়ো বেশি সময় লাগে তাতে। বেলা দুটোর সময় ষ্টীমারে উঠলে গোয়ালন্দ পৌছায় ভোর পাঁচটায়। সারাদিন হৈচৈ। টং টং করে নোঙর ফেলবার সময় শিকলের শব্দ। নানা রকম ফেরিওয়ালার ডাক। কলা, সন্দেশ, দৈ, রসগোল্লা, চানাচুর। অনেক রাতে স্টীমার একটু চুপ হয়। কেবল এঞ্জিনের একটানা শব্দ। মাঝে মাঝে কারো কোলের বাচ্চা কেঁদে ওঠে।

শহীদ আর কামাল সেকেন্ড ক্লাশ কেবিনে শুয়ে। বিকেলে স্টীমারের সামনের ডেকে চেয়ার পেতে বসেছিল ওরা। তাতে কামালের সর্দি করেছে। সে ঘুমোবার চেষ্টা করছে, আর শহীদ কি একটা মোটা ইংরেজি বই পড়ছে কম্বলটা দিয়ে পিঠ পর্যন্ত ঢেকে নিয়ে। এমন সময় কেবিনের দরজায় টোকা পড়লো। শহীদ দরজা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলো, কিরে গফুর?

তোমরা কিছু খাবে, দাদামণি?

এতো রাতে আবার কি খাওয়াতে চাস? অবাক হয় শহীদ।

ককি বানিয়ে দেব?

কফি বানাবি মানে? কোথায় বানাবি? কি করে বানাবি?

গফুর গম্ভীর ভাবে বলে, সব কিছুই আমি সাথে করে এনেছি।

সাবাস গফুর, এতো গোলমালের মধ্যেও তোর ছোটোখাট কথা মনে থাকে!

প্রশংসায় কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে গফুর বললো, তোমার একলার জন্যে বানাবো, না কামাল ভাইও খাবে?

ওকে আর জাগাস না। বেচারার সর্দি লেগে গেছে। এখন একটু ঘুমোচ্ছে ঘুমিয়ে নিক।

এই কথা বলতেই পাশ ফিরে গফুরের দিকে চেয়ে একটা মনোরম হাসি দিয়ে কামাল আবার ঘুরে শুলো।

আর কোনো কথা না বলে গফুর নিজের কাজে লেগে গেল।

বছর কয়েক ধরে দাদামণির মাথায় যে কি ভূত চেপেছে, তাই নিয়ে গফুরের খুবই চিন্তা হয়। গম্ভীর ভাবে সে গত দুবছর ধরে দাদামণির কার্যকলাপ লক্ষ্য করে আসছে। তাতে চিন্তা তার বাড়ছে বই কমছে না। কিছুদিন যাবত সে শহীদকে চোখে চোখে রাখছে। গোয়ালন্দ যাবার কথা কিছুই শহীদ বলেনি গফুরকে। যেদিন রওনা হবে সেদিন গফুরকে একটু ব্যস্ত দেখা গেল। গোটা নয়েকের দিকে গম্ভীরভাবে শহীদকে বললো, ছোটো আপাকে কামাল ভাইদের বাড়ি রেখে এলাম।

আশ্চর্য হয়ে শহীদ জিজ্ঞেস করলো, কেন রে।

ছোটো আপা তো একা বাড়িতে থাকতে পারবেন না!

আরও আশ্চর্য হয়ে যায় শহীদ। কেন, তাকে একলা থাকতে হবে কেন?

গম্ভীরভাবে গফুর ঘোষণা করলো, আমি তোমাদের সাথে যাচ্ছি। এই কথা বলে আর কোনও কথা উঠতে না দিয়ে সে সরে গেল সামনে থেকে। শহীদ হাঁ করে খানিকক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো।

দুজনকে দুকাপ কফি দিয়ে গফুর চলে গেল। কামাল উঠে দরজা বন্ধ করে এলো। এমন সময় ঠক করে দরজায় একটা শব্দ হলো। দরজা আবার খুলতে যাচ্ছিলো কামাল। শহীদ লাফিয়ে উঠে ওকে ধরলো। তারপর বেশ জোরে ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করলো, কে!

কোনও জবাব নেই। আবার টোকার শব্দ হলো। আরও জোরে শহীদ জিজ্ঞেস করলো, কে?-এবারও কোনও জবাব নেই। কামাল একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল। তাকে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে শহীদ প্রথমে নিঃশব্দে বন্টুটা খুললো, তারপর একটা কপাটের আড়ালে দাঁড়িয়ে আরেকটা খুলে ফেললো। সাথে সাথেই ঘরের ভিতর কাঠের দেয়ালে খট করে আওয়াজ হলো। ছোট্ট একটা তীর বিঁধে আছে দেয়ালে। দরজাতেও দুটো একই রকমের তীর বিঁধে আছে। বাইরে চাইলো শহীদ। কেউ কোথাও নেই, কেবল সামনে কিছু দূরে স্টীমার-ক্যান্টিনে একটা বেঞ্চির উপর একজন লোক আপাদমস্তক কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে।

তীর দুটো খুলে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো শহীদ। ঘরের দেয়ালে যে তীরটা বিঁধে ছিলো সেটাও খুলে আনলো।

ছ ইঞ্চি লম্বা। পিছনে অনেকগুলো নরম পালক। পালকের কাছটাতে একটা ছোট্ট চিঠি। শহীদের ঘাড়ের পাশ দিয়ে ঝুকে পড়লো কামাল চিঠিটার উপর। তাতে স্পষ্ট হস্তাক্ষরে লেখাঃ

শহীদ খান,

তোমাকে আমি অনুরোধ করেছিলাম আমার কাজে বাধা দিয়ো না। তবু তুমি আমার পিছনে লেগেই রয়েছো। আমার শক্তি সম্বন্ধে ওয়াকেফহাল করবার জন্যে এটুকু করলাম। এ তীর চিঠি বয়ে নিয়ে গিয়ে তোমার বুকে একটু বিধেছে, যদি পটাশিয়াম সায়ানাইড বয়ে নিয়ে এটুকু বিধতো তবে কেমন হতো? আমার পক্ষে তা অসম্ভব নয়। অতএব, বন্ধু, ঘরে ফিরে যাও। নইলে পরে এমন বহু সুযোগই আমি পাবো যখন তোমাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে কিছুমাত্র দ্বিধাবোধ করবো না। তোমার মতো বুদ্ধিমান ব্যক্তিকে এর বেশি বলা বাহুল্য মনে করছি। ইতি–

কুয়াশা

শহীদ ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো চিঠিটা পড়ে।

কামাল বললো, কী সাংঘাতিক লোক দেখেছিস।

দেখলাম। বন্ধু একটু ভুল করেছে। মনে করেছে তীর সোজা এসে আমার বুকে বিধেছে।

বিধতোই তো! আমি তো মনে করেছিলাম দরজায় টোকা পড়ছে, গফুর এসেছে বুঝি। তুই বুঝলি কি করে, এ টোকায় সন্দেহ করবার কিছু আছে?

টোকার আওয়াজ শুনলেই চেনা যায়। একটা টোকার ফলে দরজায় কখনও ঘরর শব্দ হয় না।

তুই বাইরে কাউকে দেখলি না?

একজন লোক বেঞ্চির উপর শুয়ে ছিলো কষল মুড়ি দিয়ে।

ও-ই বোধকরি তীর মেরেছে।

বোধকরি কেন, আমার স্থির বিশ্বাস ও-ই মেরেছে।

তাহলে তাড়া করে ধরলি না কেন? চল ব্যাটাকে ধরে পুলিশে দিই।

এখন কোনো লাভ নেই গিয়ে। দরজা খুলে দেখ কেউ নেই ওখানে।

কামাল দরজা খুলেই দেখলো সত্যিই কেউ নেই। শহীদ বললো, আমি দরজা খুলেই ওর কাছে ছুটে যেতে পারতাম। কিন্তু তাতে আহত হওয়া ছাড়া আর কোনো ফল হতো না। ওদের আরও লোক নিশ্চয়ই ছিলো কাছাকাছি নল হাতে করে। আমরা এগোলেই ঝাঁকে ঝাঁকে ঐ রকম ছোটে তীর এসে লাগতো।

নল হাতে থাকবে কেন?

এই তীরগুলো ধনুক থেকে ছোড়া হয়নি। বর্ষায় পাখি শিকারের জন্যে এই রকম তীর ব্যবহার করা হয়।

টেকনাফ অঞ্চলে মগদের মধ্যেও এর ব্যবহার আছে। সরু একটা নলের মধ্যে এই তীর ভরে অন্যদিকে মুখ লাগিয়ে ফুঁ দিতে হয়। অনায়াসে তিরিশ চল্লিশ হাত দূরে এই তীর ফেলা যায় ফুঁ দিয়ে। অভ্যেস হয়ে গেলে পঞ্চাশ ষাট গজ পর্যন্ত যায়। তীরের আগায় থামোফোনের পিনের মতো একটা চোখা লোহা থাকে, পিছনে থাকে পালক। তাতে করে খুব ভালো সই হয়।

অদ্ভুত পদ্ধতি তো। লোহাটার আগায় সামান্য একটু বিষ মাখিয়ে নিলেই একটা মানুষকে অনায়াসে সাবাড় করে দেয়া যায়। কোনো শব্দ নেই। বন্দুকের চেয়ে মারাত্বক!

ওসব চিন্তা এখন রাখ তো। কাল সারাদিন অনেক কাজ আছে, এখন একটু ঘুমিয়ে নে।

এই বলে দুই ঢোকে কফিটুকু শেষ করে শহীদ খাটের তলায় রেখে দিলো কাপটা। তারপর বিছানায় শুয়ে কল টেনে দিলো গলা পর্যন্ত। কামালও তার বিছানায় ঢুকলো। অনেকক্ষণ পর্যন্ত কারো চোখে ঘুম এলো না।

৬.

গোয়ালন্দ থানার দারোগা কামালের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। শহীদ আর গফুরকে নিয়ে অসঙ্কোচে তার বাড়িতে গিয়ে উঠলো কামাল। তমিজউদ্দিন মোল্লা অত্যন্ত অমায়িক লোক। খুব খাতির করলেন ওদের। দারোগা হিসেবে এখানে খুব হাঁক ডাক আছে। মাছ, দুধ, ঘি, ফল ইত্যাদি বিনা পয়সায় প্রচুর পরিমাণে তার বাড়িতে আসে; টাকা পয়সা তিনি মোটেই নেন না, সেটা হারাম। স্টীমার ঘাট থেকে বাড়িটা সিকি মাইল মতো হবে।

বেলা বারোটার দিকে স্টীমার ঘাটে একটা গোলমাল শোনা গেল। তমিজ সাহেবের মুখটা সহসা গম্ভীর হয়ে গেল। কামাল ও শহীদ আশ্চর্য হয়ে গেল তাঁর এই পরিবর্তন দেখে। কামাল প্রশ্ন করলো, গোলমাল কিসের?

তমিজ সাহেব কুচকে বললেন, কি জানি? আবার হয়তো লাশ পাওয়া গেছে নদীতে। কিছুদিন যাবত কয়েকদিন পর পর লাশ পাওয়া যাচ্ছে নদীতে। এমন আর এই এলাকায় হয়নি। বড্ডো ঝঞ্ঝাটে পড়েছি। এখন লাশ আবার পাঠাতে হবে রাজবাড়ি, পোষ্ট মর্টেমের জন্যে। সাথে আবার তার পুলিশ দাও। এই এলাকায় একেবারে প্যানিক সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। মাঝখান থেকে আমার অবস্থা কাহিল। ওপরআলা চাপ দিচ্ছে ইনভেস্টিগেশন করো। আরে বাবা, ইনভেস্টিগেশন কি পানির তলায় করবো? নদীর কোন জায়গায় ইনভেস্টিগেশন করা যায় বলেন তো, শহীদ সাহেব!

এমন সময় কয়েকজন লোক একটা লাশ এনে দারোগা সাহেবের উঠানে ফেললো। লাশ দেখেই কামাল শহীদের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। শহীদ নির্বিকার ভাবে এগিয়ে গেল মড়ার কাছে।

একটা বারো-চোদ্দ বছরের ছেলে। মুখটা এমনভাবে কোনও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কাটাকুটি করা যে সনাক্ত করা অসম্ভব।

তমিজ সাহেবের দিকে ফিরে শহীদ বললো, মি. তমিজউদ্দিন, আপনি পোস্ট মর্টেমের কোনো রিপোর্ট পেয়েছেন? আগের লোকগুলো কিভাবে খুন হয়েছে বলে ডাক্তার রিপোর্ট দিয়েছে?

দুটো লোকই এক আশ্চর্য উপায়ে খুন হয়েছে। বললে বিশ্বাস করবেন না, লাশ দুটোর হার্ট গলিয়ে ফেলা হয়েছে। শরীরের উপরে বুকের কাছে কোনও কাটাকুটির চিহ্ন নেই। শরীরের ভেতর থেকে আর কিছুই পাওয়া যায়নি। বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা? শরীরের ওপর কোনো ক্ষত নেই অথচ হার্টটা বেমালুম গলে গেল।

রিপোর্টটা পেলেন কবে?

আজই সকালে। আমি একেবারে তাজ্জব হয়ে গেছি রিপোর্ট পড়ে। এগুলো কিন্তু টপ সিক্রেট ব্যাপার। আপনি দয়া করে এগুলো বাইরে প্রকাশ করবেন না। তাহলে আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি আরম্ভ হবে।

সত্যি কথা বলতে কি তমিজ সাহেব, আমি এই কেসটা নিয়েই ঢাকা থেকে এসেছি। আমার সঙ্গে আই. জি. সাহেবের চিঠি আছে। আপনি যদি দয়া করে আমাকে রিপোর্টটা দেখতে দেন তো বড় ভালো হয়।

আচ্ছা! -আশ্চর্য হয়ে যান তমিজ সাহেব।–আপনারা তা হলে এই ব্যাপারেই এসেছেন! ওপরআলাদের নজর ভালো মতোই পড়েছে এই দিকে! এবার আমার চাকরিটা গেল বুঝি।

না মি. তমিজ, আমরা অন্য কেসে এসেছি-নানা অবস্থায় শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে আমাদের আসামী আর আপনার আসামী একই ব্যক্তি। আপনার ভয়ের কোনো কারণই নেই। ওপর-ওয়ালারা জানেই না যে এই দুই কেসের আসামী একই লোক।

তাদের জানবার আগেই কেসটার একটা সমাধান করে ফেলুন না?

তার জন্যে আপনার সহযোগিতা আমার একান্ত প্রয়োজন।

আপনার সব রকম সাহায্যের জন্যেই আমি প্রস্তুত বলুন, কি সাহায্যের দরকার?

আপাততঃ পোস্ট মর্টেমের রিপোর্টটা দেখাতে হবে।

তমিজ সাহেব একজন সেপাইকে ডেকে অফিস থেকে রিপোর্টের ফাইলন্টা আনতে হুকুম করলেন। শহীদ জিজ্ঞেস করলো, এ লাশ কখন পাঠাবেন রাজবাড়ী?

দেড়টার সময় একটা মিক্সড ট্রেন আছে। আর ঘন্টাখানেক বাকি।

আমি ছদ্মবেশে সাথে যাবো। আমাকে একটা পুলিশের ইউনিফরম দিতে হবে।

ঘরে ফিরে এসে শহীদ কামালকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললো, আমি আপাততঃ রাজবাড়ী যাচ্ছি। আমি যেখান থেকেই চিঠি বা টেলিগ্রামে খবর দিই, সটান ছদ্মবেশে সেখানে চলে যাবি। আর আমি যে এখানে নেই তা যেন কেউ যুণাক্ষরেও টের না পায় গফুরকে আমার মতো করে সাজিয়ে মাঝে মাঝে গোয়ালন্দের আশেপাশে ঘুরে বেড়াবি খুব চিন্তিত মুখে। মাঝে মাঝে নদীতে নৌকো করে যাবি। মাঝিদের জিজ্ঞেস করবি কোথায় লাশ পাওয়া গিয়েছিল। খেয়াল রাখবি, আমি যে নেই তা যেন কেউ লক্ষ্য না করে। ভোর চারপাশে অনেক ছায়া দেখবি-বুঝেও বুঝতে চাইবি না যে তুই ওদের স্পাইং টের পেয়েছিস।

আধঘণ্টা পর কয়েকজন পুলিশ লাশ নিয়ে সোজা স্টেশনের দিকে চলে গেল।
 
৭.

কুষ্টিয়া কোর্ট।

লাল স্টেশন ঘরটার গায়ে বড় বড় সাদা হরফে লেখা। সন্ধ্যা একটু ঘনিয়ে এসেছে। ট্রেন এসে থামলো। কয়েকজন যাত্রী নামলো। এদিকটা নিরালা-এরই মধ্যে সব নিঝুম হয়ে এসেছে। ছোটো স্টেশন ঘরটার পাশেই একটা চায়ের স্টল। বাতি জ্বলছে। কয়েকজন লোক বসে আছে বেঞ্চির উপর। কেউ বেঞ্চির উপর পা তুলে চাদর মুড়ি দিয়ে একেবারে জমে বসেছে। দোকানদার ঠক ঠক করে তাদের সামনে চায়ের গেলাস রাখছে।

ইন্টার ক্লাস থেকে একজন বাঙালী হিন্দু ভদ্রলোক নামলো। একটা চামড়ার বাক্স কুলির মাথায় তুলে দিয়ে এগিয়ে গেল ভদ্রলোক টিকেট চেকারের দিকে।

প্ৰথম দৃটিতেই বোঝা যায় সৌখিন লোক। দামী আদির পাঞ্জাবীর হাতা কিছুটা গোটানো। বোতামগুলো সোনার, চকচক করছে। একটু কুজো হয়ে হাঁটছে ভদ্রলোক। কিন্তু হাতের পেশী দেখে বোঝা যায় কি অসাধারণ শক্তি ছিলো তার যৌবনে। এখনও দুতিনজন ষন্ডামার্কা লোক তার সাথে লাগতে গেলে যথেষ্ট চিন্তা করে নেবে। টিকেট দেখিয়ে ভদ্রলোক বাইরে এসে একটা রিক্সায় চাপলো। বললো, আদর্শ হিন্দু হোটেল।

বাবু, তিনটে আছে হিন্দু হোটেল। কোনটায় যাবো?

গড়াই নদীর পাড়েরটায়।

রিক্সাওয়ালা বুঝলো এ লোক নতুন নয়। সে সোজা রিক্সা টেনে চললো। সেখান থেকে মিনিট দশেকের পথ। দোতলা হোটেল। একটা সাইনবোর্ড টাঙানো, তাতে লেখাঃ আদর্শ হিন্দু হোটেল ও রেন্টুরেন্ট।

হোটেলের ম্যানেজার সাগ্রহে এগিয়ে এলো। দোতলায় নদীর ধারের বেশ বড় একটা ঘর ঠিক হলো। সাথে বাথরুমও আছে অ্যাটাচ্ড্। একটা ডবল বেড খাট ঘরটার প্ৰায় আধখান জুড়ে। আসবাবের মধ্যে একটা টেবিল, তার চারধারে চারটে চেয়ার পাতা। ঘরের কোণে একটা মাঝারি আকারের ডেসিং টেবিল। পূর্বদিকে একটা ছোটে ব্যালকনি। সেখানে দুটো ইজিচেয়ার পাতা নদীর দিকে মুখ করে। বেশ পছন্দ হয়েছে এ ঘরটা বোঝা গেল ভদ্রলোকের মুখ দেখে। ম্যানেজার একটা খাতা খুলে জিজ্ঞেস করলো, মশায়ের নাম কি লিখবো?

লিখুন অনাথ চক্রবর্তী।

পেশা?

জমিদারী।

আজ্ঞে কি কারণে আগমন? সবিনয়ে জিজ্ঞেস করে ম্যানেজার।

এখানে একটা জায়গা কেনার ইচ্ছে আছে।

কি যেন লিখলো খাতায় ম্যানেজার। তারপর সই করিয়ে নিয়ে খাতা বন্ধ করে ভালো করে চাইলো অনাথ চক্রবর্তীর দিকে। বললো, আজ্ঞে, খাওয়া সম্বন্ধে চিন্তাও করবেন না। আমাদের পাচক ব্রাহ্মণ। আপনার কোনো অসুবিধে হবে না। এখানে এই হোটেলই সব চাইতে ভালো। বড় বড় লোক সবাই এখানেই পদধূলি দান করেন। আপনার কোনও কিছুর প্রয়োজন হলেই আমাকে খবর দেবেন। আমার নাম আজ্ঞে, দিবাকর শর্মা।

এ শহরে বছর দশেক আগে একবার এসেছিলাম। এখন দেখছি অনেক পরিবর্তন।

আজ্ঞে হয়েছেই তো! আমূল পরিবর্তন হয়েছে। আগে তো ভয়ানক নির্জন ছিলো এসব জায়গা। লোকালয় ছিলো ঐ মোহিনী মিলের কাছটাতেই। এখন এদিকেও কতো নতুন বাড়ি উঠলো আরও কতো হচ্ছে। আমি আজ্ঞে প্রায় বিশ বছর হলো এখানে এসেছি। আমার বাড়ি হলো গিয়ে কেশনগর।

ও। আচ্ছা আপনি আমার খাবার পাঠিয়ে দিন, আমি স্নান সেরে নিই। কলে জল আছে না?

আজ্ঞে আমাদের কলে সব সময়ই জল থাকে। আমরা পাম্প করে সাধারণ ব্যবহারের জল ট্যাঙ্কে তুলে রাখি। কিন্তু আজ্ঞে, নতুন জল, স্নান আজ অবেলায় না করলেই পারতেন।

দেখুন আমি খুব ক্লান্ত। স্নান করে কিছু মুখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। আপনি তাড়াতাড়ি আমার খাবার বন্দোবস্ত করুন। আমার এমন স্নান করা অভ্যেস আছে, কোনও ক্ষতি হবে না।

বাথরুমে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক একটু মুচকি হাসলো। ভদ্ৰলোক আর কেউ নয়, আমাদের শহীদ খান।

স্নান সেরে আবার অনাথ চক্রবর্তী সেজে সে বেরিয়ে এলো। টেবিলে তার খাবার সাজানো রয়েছে। তাই খেয়ে কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করছে, এমন সময় দরজায় টোকা পড়লো। বাইরে থেকে আওয়াজ এলো, এটো বাসন নিতে এয়েছি কত্তা।

দরজা খুলে দিতেই একজন খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা ছুঁচোমুখো কুঁজো বেঁটে লোক একটা ট্রে হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। পরিপাটি করে গুছিয়ে বাসন পেয়ালা তুলে সে অনাথ বাবুকে একটা নমস্কার করে চলে গেল। দরজা বন্ধ করে শহীদ খাটে এসে শুয়ে পড়ল।

নানান কথা মনে ঘুরপাক খেতে লাগলো। ট্রেনের সেই লোকটাকে খুঁজে বের করে তার উপর নজর রাখতে হবে। নদীর উপর নজর রাখতে হবে। কুয়াশাকে খুঁজে বের করার সূত্র সে পেয়েছে, তাই ধরে সে এগিয়ে যাবে। বেশ কিছুদিন থাকতে হবে তার এখানে। জেদ চেপে গেছে শহীদের, যে করে হোক ধরতেই হবে খুনীকে। যতো বড় ধুরন্ধরই সে হোক না কেন, অন্যায় শেষ পর্যন্ত ধরা পড়বেই। শহীদ হাসলো। কুয়াশার অনুচর ভাববে শহীদ আর কামাল এখনও গোয়ালন্দেই আছে।-এই শেষের লাশটারও হার্ট পাওয়া যায়নি। এমন অদ্ভুত ব্যাপার শহীদ আর কখনো শোনেনি। এক্স-রে দিয়ে ফটো তুলে ভেতরের খবর জানতে পারা আজ সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু উপরের চামড়ায় আঁচড়টুকু না দিয়ে হার্টটা কি করে গলিয়ে ফেলা যায়? অদ্ভুত বুদ্ধিমান এই খুনী। বুদ্ধির পরিচয় এর প্রতিটা কাজেই পাওয়া যাচ্ছে। দলবলও আছে লোকটার।

এসব নানান কথা এলোমেলো ভাবে তার মনে হতে লাগলো। সারারাত ভালো ঘুম হলো না। কানের কাছে মশার গুঞ্জন, মনে নানারকম চিন্তা নিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে রইলো শহীদ।

অনেক বেলা করে পরদিন ঘুম ভাঙলো তার। চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লো সে। পোস্ট অফিস থেকে গোটাকতক খাম কিনলো। তারপর থানার দিকে হাঁটতে থাকলো।

কুষ্টিয়ার রাস্তাঘাট বেশ ভালো। চিনতে কষ্ট হয় না। সবগুলোই সোজা সোজা। মেইন রোড থেকে অনেকগুলো রাস্তা লম্বাভাবে বেরিয়ে গিয়ে নদীতে পড়েছে। বাড়িগুলো রাস্তার পাশে সাজানো। মফঃস্বল টাউন। একটা গ্রাম্য পরিবেশের ছোয়া পাওয়া যায়। টাউনটা খুবই ছোটো, কিন্তু কিছুরই অভাব নেই। ষ্টেশন দুটো, একটা কুষ্টিয়া অপরটা কুষ্টিয়া কোর্ট, মাইল খানেকের তফাত। জজ কোর্ট, কোর্ট স্টেশনের সাথেই লাগানো। তার উত্তরে পুলিশ ব্যারাক। স্টেশনের পশ্চিমে কুষ্টিয়া কলেজ। তার সাথে লাগা কলেজ ফুটবল গ্রাউন্ড। হাসপাতালটা হচ্ছে গার্লস স্কুলের পাশেই, তার উত্তরে বয়েজ স্কুল। দুইটা সিনেমা হল রয়েছে এইটুকু শহরে।

থানার ঠিক উল্টো দিকেই তার এক বন্ধুর বাড়ি। জানা দরকার সে এখানেই আছে না ঢাকায় গেছে। সে থাকলে বড় উপকার হবে। সোজা গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লো শহীদ। বেরিয়ে এলো একজন যুবক। দেখতে অত্যন্ত রোগা পটকা। তাই বয়স খুব কম বলে মনে হয়। চোখে চশমা, হাতে একটা বই। জিজ্ঞেস করলো, কাকে চান?

প্রফেসার আশরাফ চৌধুরী আছেন?

আমিই আশরাফ চৌধুরী। আপনার কি দরকার, ভিতরে আসুন না।

আমার নাম অনাথ চক্রবর্তী। রায়পুরার জমিদার। ঢাকার ইসলাম খান সাহেবের ছেলে শহীদ খান আমাকে আপনার সাথে আলাপ করতে উপদেশ দিয়েছেন।

আপনি বসুন না, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? তা কেমন আছে শহীদ। প্রায় বছর খানেক হলো ওর সাথে আমার দেখা নেই। মাঝে শুনেছিলাম গোয়েন্দাগিরি করছে, এখনও তাই?

হ্যাঁ, এখনও তাই। গোয়েন্দাগিরি করতেই সে এখন কুষ্টিয়ায় এসেছে এবং তোমার সামনের চেয়ারে বসে আছে হাঁদারাম!

এ্যাঁ। আপনি? মানে তুমি? আমি চিনতেই পারিনি।ভালো৷ ছদ্মবেশ ধরেছো তো হে, উঠেছে৷ কোথায়?

আদর্শ হিন্দু হোটেল।

বাদ দাও তোমার হোটেল। চলো এখনই জিনিসপত্র নিয়ে আসি আমার এখানে। কুষ্টিয়ায় এলে অথচ আমার বাসায় উঠলে না, আমি ভীষণ অসন্তুষ্টি হয়েছি।

দেখো ভাই বিশেষ কাজে খুনী তাড়া করে এসেছি, তাই হোটেলে উঠতে বাধ্য হয়েছি। নইলে তোমার এখানেই উঠতাম। আপাততঃ আমাকে হিন্দু জমিদার হয়ে থাকতে হবে। তুমি কিছু মনে করো না।

বেশ তো, এখন থাকো। কিন্তু কাজ হয়ে গেলে আমার এখানে কদিন বেড়িয়ে না গেলে আমি অত্যন্ত রাগ করবো।

আচ্ছা, আচ্ছা। আপাততঃ তুমি আমাকে কিছু খবর দাও দেখি। এখানে বিক্রি হবে এমন জমিটমি আছে?

খুব আছে। আমরাই তো কিছু জমি বিক্রি করবো। কেন কিনবে নাকি?

না, কিনবার-ভান করবো। আমি তো হিন্দু জমিদার। জমি কিনতে এসেছি। তোমাদের জমি থাকায় ভালোই হলো। তুমি মাঝে মাঝে জমির দলিল, নক্সা, পরচা ইত্যাদি নিয়ে আমার ওখানে যেতে পারবে, আমিও পারবো আসতে। তোমার কাছ থেকে অনেক খবর জানবার প্রয়োজন হবে। এখন চলি।

তুমি ঠিকানা দিয়ে যাও, আমি যাবো।

শহীদ একটা কাগজে নাম ঠিকানা লিখে আশরাফ চৌধুরীর হাতে দিলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো, তুমি কাল বিকেলের দিকে একবার যেও আমার ওখানে।

এখনি উঠছো নাকি? চা-টা খাবে না?

না ভাই, আর বসবো না। কতকগুলো কাজ পড়ে রয়েছে।

হোটেলে ফিরে চিঠি লিখতে বসলো শহীদ। লীনাকে লিখলো যেন কিছুমাত্র চিন্তা না করে। সে, কামাল ভাই, গফুর সবাই খুব ফুর্তিতে রয়েছে। দিন পনেরোর মধ্যে ফিরবে।

কামালকে লিখলো, আমি যখনই টেলিগ্রাম করবো তখুনি তুই গফুরকে নিয়ে ছদ্মবেগে চলে আসবি কুষ্টিয়ায়। হিন্দু সেজে আসবি। আমি এখন রায়পুরার জমিদার অনাথ চক্রবর্তী। তুই আমার নায়েব অবিনাশ সেরেস্তাদার আর গফুর পেয়াদা। ওকে সব বুঝিয়ে দিবি আগে ভালো করে। কুষ্টিয়া আদর্শ হিন্দু হোটেল, গড়াই নদীর পাড়…

সেই বেটে চাকরটার হাতে চিঠি দুটো দিয়ে একটা আধুলী গুজে দিলো শহীদ। সে জিজ্ঞেস করলো, বাবু, লাল বাক্সে ফেলাবো, না নীল বাক্সে?

লাল বাক্সে ফেলে দাও। এখুনি যাও। জরুরী চিঠি।

সে চলে গেল চিঠি নিয়ে। শহীদ ভাবতে লাগলো, আজকের মতো কাজ শেষ। বিকেল বেলা নদীর পাড় ধরে গিয়ে যতদূর সম্ভব দেখে আসতে হবে।

দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে অর্ধেক পড়া ইংরেজি উপন্যাসটা নিয়ে ব্যালকনির একটা ইজিচেয়ারে গিয়ে বসলো শহীদ। উত্তর দিক থেকে ফুরফুরে একটা ঠান্ডা বাতাস আসছে। বেশ ভালো লাগে। মনটা কিছুতেই বইয়ে বসতে চায় না। বই বন্ধ করে সে সামনের দিকে চেয়ে রইলো।

নদীর জল অনেক শুকিয়ে গেছে। পাড় খুব উচু— যেন চোয়ালের হাড় বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু এই জলেও অনায়াসে স্টীমার চলতে পারে। ছোটো বড় হরেক রকম নৌকো চলছে। কারও পাল তোলা, কেউ বা দাঁড় টানছে। অনেক দূরের পাল তোলা গয়না নৌকো দেখলেই মনটা উদাস হয়ে যায়। দূরের টান– মাঝিদের অলস কথাবার্তা–জলের একটানা শব্দ- হালের বিলম্বিত ক্যাচ-কুচ শব্দ– খরা-আমেজ -দুপুর-সবটা মিলিয়ে স্বপ্ন মনে হয়।

বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো শহীদ। সেখান থেকে বাইরের দিকে চেয়ে রইলো চুপচাপ। আকাশে একবিন্দু মেঘ নেই। কয়েকটা চিল অনেক উচুতে উড়ে বেড়াচ্ছে। চারিদিকে একটা নিঝুমতা। দূরে কোনও একটা বাড়ির ছাত পেটানো হচ্ছে। সেই একটানা শব্দ দুপুরকে আরও গম্ভীর করে তোলে। হঠাৎ একটা কাক কর্কশ স্বরে ডেকে ওঠে। খান খান হয়ে যায় নিস্তব্ধতা। আবার জমে ওঠে আমেজ। ঝিমিয়ে আসে শহীদ। দুপুর এতো সুন্দর হতে পারে তার ধারণাই ছিলো না। একটা মধুর আমেজ তার বুদ্ধিক ছেয়ে ফেলে। এ দুপুরকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়, বুদ্ধি দিয়ে নয়।

বিকেল বেলা একটা শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল শহীদের। হরিদাস চা নিয়ে এসে রাখলো। চোখ কচলে উঠে বসলো শহীদ। ঘুমিয়ে পড়েছিল ভাবতে তার লজ্জাই লাগছে। দুপুরে ঘুমোনো ওর অভ্যেস নেই। দিবা-নিদ্ৰাকে রীতিমত ঘৃণাই করে সে। আর আজ নিজেই পাকা তিনঘন্টা দিবা-নিদ্রা দিয়ে উঠলো। কিন্তু এ অপরাধের জন্য তার গ্লানি নেই। শরীর মন বড় চাঙা বোধ হচ্ছে।

চা খেয়ে সে বেরিয়ে পড়লো নদীর পাড়ে বেড়াতে। সরু একটা রাস্ত৷ বরাবর নদীর পাশ দিয়ে চলে গেছে। বিকেলে আজকাল কেউ বড় একটা এদিকে আসে না। সবাই যায় পুলিশ গ্রাউন্ড কিম্বা কলেজ গ্রাউন্ডে হকি ক্রিকেট খেলা দেখতে। দুচারজন অতি-বৃদ্ধকে দেখা গেল নদীর নির্মল বায়ু সেবন করছেন। কেউ কেউ কোনও পাথরের পর কি গাছের গুড়িতে বসে আছেন। পথ ধরে কিছু উত্তরে গিয়ে শহীদ দেখলো একজন যুবক একটা পাথরের উপর বসে ওপারের চড়ার দিকে চেয়ে রয়েছে। কাছে যেতেই তার দিকে ফিরে চাইলো। তারপর আবার দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো ওপারে। শহীদ দেখলো, অদ্ভুত সুন্দর দুটি চোখ। নিস্পাপ, নিষ্কলঙ্ক। চোখের দিকে চাইলে মনে হয় কতো গভীর যেন মানুষটি, যেন সাগর। কতো কি তার অতল তলে আছে লুকোনো। কবি হওয়া এরই সাজে। মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল। পরনে জিনসের সাদা প্যান্ট আর হালকা গোলাপী রঙের শার্ট। বড়ো মানিয়েছে এই পড়ত বেলায় লোকটাকে এই কাপড়ে। বয়স ঠিক আঁচ করা যায় না- বোধ হয় তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে হবে। লম্বা-চওড়া শরীরের গড়ন। চওড়া উচু বুক শার্টের উপর দিয়েও স্পষ্ট অনুভব করা যায়।

শহীদ এগিয়ে যাচ্ছিলো, এমন সময় পিছন থেকে কে ডাকলো, অনাথ বাবু।

চমকে ফিরে তাকালো শহীদ। দেখলো ট্রেনের সেই লোকটা দ্রুত গতিতে তার দিকে আসছে। হাতে একটা অ্যাটাচি কেস। লোকটা কাছে এসেই বললো, দেখুন তো, পেছন থেকেও ঠিক চিনতে পেরেছি কেমন। হাওয়া খাচ্ছেন বুঝি?

হ্যাঁ, এই একটু ঘুরে বেড়াচ্ছি। লোকটার নামটা কিছুতেই মনে আনতে পারছে না শহীদ। ট্রেনে কি যেন একটা নাম বললো? একটু থেমে শহীদ আবার বললো, ত৷ আপনি এদিকে চললেন কোথায়? খুব তাড়া বুঝি?

এই তো, এই পথে আর একটু এগোলেই আমার বাসা। চাকরি করি সেই মোহিনী কটন মিলে। সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরতে হলে একটু তাড়াতাড়ি হাটতে হয় বৈকি। বাসায় স্ত্রী আছেন কিনা, বুঝলেন না, তার হুকুমেই, মানে সাঁঝের আগেই ফিরতে হয়। চলুন না আমার বাসায় একটু চা খাবেন। গল্প-সল্প করা যাবে।

সন্ধ্যা হয়ে এলো। এখন হোটেলে ফিরবো। আরেকদিন আপনার বাসায় চা খাওয়া যাবে, আজ আসি। শহীদ এক পা বাড়ালো।

ও, ভালো কথা, আপনার জমি কিনবার কি হলো? খোঁজ খবর পেলেন কিছু?

এই একটু আধটু খোঁজ পেয়েছি। আশরাফ চৌধুরী আছেন না, এখানকার কলেজের প্রফেসার, তিনি নাকি কিছু জমি বিক্রি করছেন। দেখি কথাবার্তা দামদর করে কি দাঁড়ায়।

ইংরেজির প্রফেসার আশরাফ চৌধুরী তো? উনি লোক খুব ভালো। তাঁর সাথে কারবারে আপনি ঠকবেন না। আচ্ছা, আজ আসি, আবার দেখা হবে।

দুজন দুদিকে চলে যায়। সেই লোকটি তখনও পাথরের উপরে বসে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে ওপারের দিকে। সন্ধ্যা নামছে। আবছা হয়ে আসছে ওদিকের পাড়টা। কুয়াশা পড়ছে। দূরে একটা মন্দিরে ঘন্টা ধ্বনি হচ্ছে। কয়েকটা বাদুড় মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। নৌকোগুলোর কোনও কোনোটাতে আলো জ্বলছে। জলে তার প্রতিবিম্ব। কোনো এক বাড়িতে মশা তাড়াবার জন্যে ধূপ পোড়াচ্ছে, তার সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। মন্দিরে ঘন্টা পড়ছে টং টং। হোটেলে ফিরে এলো শহীদ। এতোক্ষণে মনে পড়েছে। লোকটার নাম সিরাজুল হক।

৮.

রাত দেড়টা। দুপুরে ঘুমিয়েছে তাই কিছুতেই শহীদের চোখে ঘুম আসছে না। ইংরেজি বইটা শেষ করে সুইচ টিপে বাতি নিভিয়ে দিলো। বিছানায় ঢুকে মশারীর চারিধারটা ভালো করে গুজে নিয়ে সে ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগলো।

হঠাৎ তার অত্যন্ত কান সজাগ হয়ে উঠলো। সরোদের আওয়াজ! এতো রাতে তো কোনও রেডিও- ষ্টেশন ধরবার কথা নয়। কোনও সঙ্গীত সম্মেলনও হতে পারে না। তার চোখ এড়িয়ে সম্মেলন হবার জো নেই। আর এতো রাতে সঙ্গীত সম্মেলন ছাড়া আর কোনও কারণেই রেডিও খুলবে না কেউ। হাত ঘড়িটার দিকে তাকায় শহীদ -রেডিয়াম দেয়া ঘড়ি-দেড়টা বাজে।

ধীরে ধীরে আলাপ হচ্ছে। বড় ভালো বাজাচ্ছে তো! কি বোল্ড টোকা! কি মিষ্টি। এক আলী আকবর খান ছাড়া আর কারও হাত দিয়ে এ টোকা বেরোবার কথা নয়। বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে এলো শহীদ। জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। উঃ, অদ্ভুত সুন্দর বাগেশ্রী বাজাচ্ছে। এক টান দিয়ে দামী আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ঘরের দরজা ভিড়িয়ে বেরিয়ে এলো সে হোটেল থেকে। দেখতেই হবে এই মফঃস্বল শহরে কে এতোবড় শিল্পী।

আওয়াজ অনুসরণ করে এগিয়ে গেল শহীদ। নদীর পারের দোতলাটা থেকে শব্দ আসছে। সে গিয়ে দাঁড়ালো বাড়িটার কাছে। উচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়িটা। লোহার একটা গেট আছে। সটান গেট খুলে ভিতরে ঢুকে পড়লো শহীদ। দোতলায় বসে কে যেন বাজাচ্ছে। নিচে বারান্দায় উঠবার সিঁড়ির উপর বসে পড়লো শহীদ।

বেজে চলেছে সরোদ। কি অদ্ভুত মিষ্টি! স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গেল শহীদ। বুঁদ হয়ে বসে রইলো সিঁড়ির উপর। তার মনে হলো বাগেশ্রী যেন হেমন্ত কালের রাগ। সেই যে তার কিশোর বয়সে বিকেল বেলা সে আর কামাল পুরানা পল্টনের এক বাসায় ব্যাডমিন্টন খেলতে যেতো। সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময় সরু একটা পায়ে-হাঁটা পথ দিয়ে বাড়ি ফিরতো তারা। আশে পাশে ছোটখাটো ঝোপ, মাঝে মাঝে ঘন। মস্ত বড় বড় শাল গাছগুলোর তলায় আঁধার হয়ে এসেছে। পথের একধারে ছিলো একটা পুকুর। অজস্র লাল শাপলা ফুটে থাকতো তাতে। কুয়াশা পড়তো। ডোম-পাড়া থেকে ঘুটে পোড়ানোর গন্ধ আসতো। শিউলীর গভীর ভারি গন্ধটা নেশা ধরাতো। একটা দুটো করে বাতি জ্বলে উঠতো। সেই পুরোনো স্মৃতি জেগে উঠলো শহীদের মনে। তাদের গায়ে থাকতো হাতে বোনা সোয়েটার-প্রথম বের করা হয়েছে টাঙ্ক থেকে, তাতে ন্যাপথালিনের গন্ধ জড়ানো। শহীদের মনে হলো এখনও যেন সেই গন্ধ পাচ্ছে। সেই কিশোর বয়স। পৃথিবীটা কতো ছোটো তার কাছে তখন। মনটা তখন ঠিক কচি একটা গোলাপের কুঁড়ির মতো। বড় ভালো লাগে শহীদের। সাথে সাথে কষ্টও লাগে। ছোটকালের শহীদটাকে আদর করে দিতে ইচ্ছে করে তার।

তন্ময় হয়ে শোনে শহীদ। আলাপ ছেড়ে গৎ ধরলো বাদক। বড় সুন্দর অস্থায়ী অন্তরা। ষ্টাইল আছে, গায়কী আছে। খানদানী ঢং আছে।

কিন্তু তবলা নেই। কিছুক্ষণ বাজিয়ে বোধকরি বিরক্ত হয়েই থেমে গেল বাদক।

শহীদও বিরক্ত হয়েছে। ফিরে যাচ্ছে সে। গেটের কাছে যেই এসেছে এমন সময় উপর থেকে গভীর গলায় আওয়াজ এলো, কে?

চমকে উঠলে শহীদ। উঃ, কী ভারি গলা?

আমি অনাথ চক্রবর্তী, রায়পুরার জমিদার। আমি এই পাশের হোটেলে উঠেছি। আপনার বাজনা শুনে এসেছিলাম ভালো করে শুনতে। অনধিকার প্রবেশের জন্যে ক্ষমা চাইছি।

আপনি উপরে আসুন আমি দরজা খুলে দিচ্ছি।

বাইরের দিকে একটা বাতি জ্বলে উঠলো। শহীদ দাঁড়িয়ে রইলো। একবার ভাবলো চলে যাবে কিনা কিন্তু আবার কৌতুহল হলো, দেখেই যাই লোকটাকে। এতোক্ষণে তার একটু শীত শীত বোধ হচ্ছে। রাত বোধহয় তিনটের কম না। দরজা খুলে যে লোকটা বেরিয়ে এলো, তাকে দেখেই শহীদ চিনতে পারলো। একেই সে দেখেছে আজ বিকেলে নদীর ধারে পাথরের উপর বসে থাকতে। লোকটা অত্যন্ত ভদ্র ভাবে বললো, আপনি আমার সাথে উপরে আসুন। শহীদ তার পিছন পিছন দোতলায় উঠে এলো।

শহীদকে একটা চেয়ারে বসতে অনুরোধ করে সে একটা ইলেকট্রিক স্টোভে এক কেটলি জল চড়িয়ে দিলো। তারপর ভালো করে শহীদের দিকে চেয়ে বললো, বাইরে শীতে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়েছে আপনার? আমাকে ডাকলেই পারতেন, মিছিমিছি এতো কষ্ট পেলেন অনাথ বাবু।

এখন মনে হচ্ছে কষ্ট লাগাই স্বাভাবিক ছিলো, কিন্তু তখন আপনার বাজনা শুনতে শুনতে ভুলেই গিয়েছিলাম কষ্টের কথা। বাগেশ্রীর ওপর এতো সুন্দর আলাপ জীবনে আর কখনও আমি শুনিনি। এর মধ্যে আপনাকে ডেকে বিরক্ত করি কি করে বলুন তো।

প্রশংসা শুনে মিষ্টি করে হাসলো ভদ্রলোক। চমৎকার ঝকঝকে দাঁত দেখা গেল।

আমার নাম রফিকুল ইসলাম। Businessman, ব্যস্ত মানুষ, সময় পাই না সাধবার। মাঝে মাঝে সারোদটা নিয়ে একটু বসি। কিন্তু তবলচি নেই এখানে ভালো–বড়ো অসুবিধা হয়। কিছুই বাজানো যায় না।

আমি অল-সল্প তবলা জানি। তবে আপনার সাথে সঙ্গতের মতো নয়।

আপনি জানেন বাজাতে? উজ্জ্বল হয়ে উঠলো শিল্পীর মুখ। আলমারির উপর থেকে এক জোড়া বাঁয়াতবলা পেড়ে বিছানার উপর রাখলো। তারপর বললো, আগে কফি খেয়ে নিই এক কাপ, তারপর কিছু একটা চেষ্টা করা যাবে, কি বলেন?

এক কাপ কফি এগিয়ে দিলো সে শহীদের দিকে, আরেক কাপ নিজে নিলো। কফি খেতে খেতে শহীদ তবলাটা বেঁধে নিলো। রফিকুল ইসলাম বললো, এই সময়টায় কোন রাগ শুনতে ইচ্ছে করছে আপনার বলুন তো?

ঝিঝিট ঠুমরী। একটু ভেবে উত্তর দেয় শহীদ।

ঠিক বলেছেন।

মিনিট কুড়ি ঝিঝিট চললো। উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলে শহীদ। বড় মিষ্টি হাত। অদ্ভুত সুরজ্ঞান রফিকুল ইসলামের বাজনা শেষ হতেই শহীদ বললো, উঃ! আপনাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। আপনি গুণী। কোথায় শিখেছেন এমন পাগল করা বাজনা?

আমি কারো কাছে শিখিনি। যেটুকু পেরেছি শুনে শুনে শিখেছি। ওস্তাদের পিছনে পিছনে ঘুরে বেড়াবার সময় আমার ছিলো না। আপনি সত্যিকার সমঝদার, তাই আপনার কাছে ভালো লাগছে। আর কারো কাছে আমার বাজনা ভালো লাগবে না। আমি ওদের গ্রামার অনুসরণ কার না।

আমি তা বুঝেছি। কিন্তু পান্ডিত্য আর শিল্প দুটো আলাদা জিনিস। যা ভালো লাগে। যা মনকে মাতায় তাকে গ্রামার দিয়ে জবাই করা অন্যায়। আমার তো ধারণা ছিলো আবদুল করিম খাঁ সাহেবের বিঝিটের পরে আর কিছু সৃষ্টি হবে না। এইমাত্র আমার সে ভুল আমি শুধরে নিলাম।

রফিকুল ইসলাম দেরাজ টেনে একটা বোতল বের করলো। বললো, আপনার অভ্যেস নেই, তাই না?

Then excuse me. ছিপি খুলে চক চক করে কিছু বিলিতি raw gin গলায় ঢেলে বোতলের ছিপিটা বন্ধ করলো রফিকুল ইসলাম।

শহীদের সাথে তার আলাপ জমে উঠেছে। এরকম আলাপ আরও অনেকক্ষণ চলতে পারতো। শহীদের এতে ক্লান্তি নেই। আর অপর পক্ষেও যে নেই তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। এমন সময় দেয়াল ঘড়িতে টং টং করে রাত চারটে বাজলো। উঠে দাঁড়ালো শহীদ, আবার আপনার বাজনা শুনতে আসবো রফিক সাহেব, আজ আসি। আমার আবার সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। এখানে একটা জমি কিনবার ইচ্ছেয় এসেছি। একজন প্রফেসার কিছু জমি বিক্রি করছে, তার সাথে দরদস্তুর করতে হবে। আচ্ছা, আজ আসি।

গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলো রফিকুল ইসলাম। অনাথ চক্রবর্তী লোকটা বেশ। তবলায় বেশ হাত আছে লোকটার। লয়জ্ঞানও ভালো, ছোটো খাটো রেলা বড় চমৎকার বাজায়। মনটাও বড় সুন্দর। তাছাড়া সমঝদার।
 
৯.

বিছানায় শুয়ে শহীদ ভাবতে লাগলো রফিকুল ইসলামের কথা। ভদ্রলোক যে রকম সরোদ বাজায় সে স্ট্যান্ডার্ডে উঠতে হলে অন্ততঃ দশ বছরের কঠোর সাধনা চাই। একজন লোক, এতো যার সাধনা, সে আত্মপ্রকাশ করে না কেন? এতোবড় সাধক, মানুষের চোখে পড়লো না! কতো বড় প্রতিভাবান হলে কারো কাছে না শিখে এমন বাজানো সম্ভব! পৃথিবীতে কেউ জানবে না কতো বড় একজন শিল্পী অপ্রকাশিত রইলো।

বেলা প্রায় এগারোটায় শহীদের ঘুম ভাঙলো। মাঝে হরিদাস একবার দরজায় টোকা দিয়েছিল। ওকে বিরক্ত করতে মানা করে দিয়ে আবার ঘুমিয়েছে।

বিকেলে আশরাফ চৌধুরী এলো। সাথে সাথেই রফিকুল ইসলাম এসে ঢুকলো ঘরে। ওদের বসিয়ে সে চাকরকে ডেকে চা-বিস্কিট আনতে হকুম দিলো।

আশরাফ চৌধুরী অতি সাবধানে। দলিল, পরচা, নক্সা, ইত্যাদি বের করে টেবিলের উপর রাখলো। অতি বিচক্ষণের মতো শহীদ সে সব পরীক্ষা করে নানান রকম বৈষয়িক প্রশ্ন করলো। টুকে নিলো খাজনা কতো, টাকা বাকি আছে কিনা, জমি বরগা দিয়েছে কিনা, দাগ নম্বর কতো ইত্যাদি আরও কতো কি তথ্য। রফিকুল ইসলাম টেবিল থেকে একটা বই তুলে নিয়ে পাতা উল্টাতে লাগলো। শহীদ মনে মনে বললো, ভাগ্যিস বইটাতে নাম লিখিনি এখন পর্যন্ত!

আশরাফ সাহেবের দিকে ফিরে শহীদ বললো, আমার নায়েবকে চিঠি লিখে দেবো সে টাকা নিয়ে আসবে তারপর যা হয় একটা ব্যবস্থা করবো। আপনি এর মধ্যে চিন্তা করে দেখুন কিছু কমাতে পারেন কি না। আর আমিও এদিক ওদিক আরও কিছু খোঁজখবর করে দেখি কোথায় সুবিধা হয়।

তা তো বটেই। এখন পর্যন্ত জায়গাটা আপনি দেখেনইনি। এখনই আপনার কাছ থেকে কোনো মতামত আশা করা যায় না।

এমন সময় রফিকুল ইসলাম বললো, কতখানি জমি কিনছেন আপনি? আমি কয়েকটা জমির খোঁজ দিতে পারি। ঐ তো মদনপুরের রহিমুদ্দিন ভূইয়া জমি বিক্রি করবে। এখানকার জমিদার নারাণ বাবু তার এষ্টেট গোটাই বিক্রি করে ইঙিয়া চলে যাবেন। গড়াই নদীর ওপারে কয়েকজন…

আপনি নাম ঠিকানাগুলো আমাকে লিখে দিন দয়া করে, নইলে আমার মনে থাকবে না বাধা দিয়ে বলে শহীদ। বলে বাক্স থেকে একটা নোটবুক বের করে দিলো রফিক সাহেবের হাতে। নাম-ঠিকানা কয়টা লিখে নোট বইটা শহীদের হাতে দিয়ে বললো, এদের সবার কাছেই আমার নাম বললে এরা খুব খাতির করবেন, দামের দিক দিয়েও হয়তো সুবিধা হতে পারে।

লেখাটার উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে শহীদ বললো, আমি এদের সাথে দেখা করবো। সম্ভব হলে কালই।

আশরাফ চৌধুরী চা খেয়েই উঠে গেলেন শহীদের একটা গোপন ইঙ্গিতে। শহীদ রফিক সাহেবকে বললো, চলুন না নদীর ধারে একটু বেড়িয়ে আসি? আমার পেটে আবার একটু গ্যাসট্রিক গোছের আছে কিনা, নদীর বাতাসটায় খুব উপকার হয়।

চলুন। উঠে দাঁড়ায় রফিকুল ইসলাম।

দুজনে একটা পাথরের উপর গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে রফিকুল ইসলাম বললো, রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ এখান থেকে কতদূর জানেন?

না। কত দূর?

মাত্র চার পাঁচ মাইল।

তাই নাকি, চলুন না, একদিন দেখে আসি?

চলুন কাল পরশু কোনো একদিন। আমার একটা লঞ্চ আছে, তাতেই যাওয়া যাবে, কি বলেন?

আপনার লঞ্চ আছে নাকি? কোথায়?

এখন সেটা গোয়ালন্দে, কাল এসে পৌঁছবে। এই সামনেই সেটা নোঙ্গর করে রাখি। আমার বিজনেসের জন্যে খুবই কাজে লাগে।

কিসের ব্যবসা করেন আপনি? জিজ্ঞেস করে শহীদ।

কিছু জামি আছে, তাতে আখ চাষ করি। আখের কল আছে তাতে গুড় তৈরি করি। অনেক আখ বাইরে থেকেও কিনতে হয়। সে গুড় ঢাকায় চালান করি। এছাড়া আরো কতগুলো প্রাইভেট বিজনেসও আছে—পারমিটের ব্যাপার।

গুড়ের ব্যবসায়ে লাভ কি রকম?

প্রচুর লাভ। ইনভেষ্টমেন্টের দ্বিগুণ। আপনাদের ওদিকে আখ কেমন হয় বলুন। তো? আমাদের ওদিকে আখের চাষ বিশেষ নেই, কিন্তু জমি আখের জন্যে খুব suitable. আর সস্তাও খুব, দুশ করে বিঘা আবাদী জমি। মাঝে মাঝে একশোও হয়, পঞ্চাশেও নামে।

বাঃ খুব সস্তা তো। ওদিকে ছেড়ে এদিকে জমি কিনতে চান কেন?

একটু রহস্যময় হাসি হেসে শহীদ বললো, ব্যাপার কি জানেন, আমি আসলে নারায়ণ বাবুর এস্টেট বিক্রির খবর পেয়েই এসেছি। কাউকে বলিনি। জানেনই তো, আমাদের সাথে সাথেই টাকা থাকে, ব্যাঙ্কে কিছু রাখি না, এই বিদেশ বিভূঁহয়ে চোর ডাকাত পড়তে কতক্ষণ?

আপনি সাথে করে সব টাকা এনেছেন বুঝি?

আপনি খেপেছেন। তাই সম্ভব? একটা বন্দোবস্ত হলে নায়েবকে টেলিগ্রাম করবো। সে-ই নিয়ে আসবে সব টাকা।

আপনার স্ত্রী কি রায়পুরাতেই আছেন নাকি অন্য কোথাও?

মুখটা গভীর হয়ে গেল শহীদের। বললো, আমি আজ দশ বছর ধরে বিপত্নীক। আর বিয়ে-থা করিনি। একটা৷ মেয়ে ছিলো, দুবছর হলো বিয়ে দিয়েছিলাম, সে-ও মাস ছয়েক হলো একটা বাচ্চা রেখে মারা গেছে।

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। শহীদ বললো, আপনি বিয়ে করেননি বুঝি এখনও?

না। ইচ্ছেও নেই।

আপনি কি মনে করেন না জীবনটা ফুরিয়ে যাবার আগে ভোগ করে নেয়াই সমীচীন?

নিশ্চয়ই। জোরের সাথেই বলে রফিকুল ইসলাম, আপনার কথা ঠিক। কিন্তু সবার ভোগ তো সমান নয় অনাথ বাবু। আমিও ভোগ করছি জীবনটা। নইলে বাচি কি করে; তবে আমার ভোগে নারীর দরকার হয় না।

শহীদ আর কথা বাড়ায় না। তার কোন একটু শীত শীত করছে। সে বললো, এখন ওঠা যাক, রফিক সাহেব।

আপনি যান। আমি সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরবো। এই আমার নিয়ম। রোজ বিকেলে বসি, সঙ্ক্যের পর উঠি। পকেট থেকে একটা বোতল বের করে কিছু হুইস্কি গলায় ঢাললো সে। আসবেন আজ?

আসবো। আপনি বিরক্ত না হলে ঠিকই হাজিরা দেবো আপনার বাসায়।

১০.

কামালের চিঠি এলো। সে তার কথামতো কাজ করছে।

রফিকুল ইসলাম সম্বন্ধে আশরাফ চৌধুরীর কাছে অনেক কিছু জানতে পারলো শহীদ। আশরাফ অকুণ্ঠ প্ৰশংসা করেছে এই মানুষটার। বছর তিন হলো কুষ্টিয়ায় ব্যবসা করছে। অতি ভদ্রলোক। প্রচুর টাকা করেছে ব্যবসা করে।

রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ দেখে এসেছে শহীদ রফিকুলের সঙ্গে আজ দুদিন হলো। রোজ রাতে আসর বসে। রফিকুল ইসলামের বাড়ির উপরতলার একটা অংশ একেবারে তালা বন্ধ থাকে। শহীদ জিজ্ঞেস করায় রফিক হেসে বললো, একা মানুষ, কে থাকবে এতো বড় বাড়িতে চাকর আছে একটা, সে একতলার সম্পূর্ণটা জুড়ে থাকে। আমি অনেক চেষ্টা করেও এই তিনখানা ঘরের বেশি জুড়তে পারিনি। ওদিকটা খালিই পড়ে থাকে, তাই বন্ধ করে দিয়েছি।

ভাড়া দিলেই পারো। শহীদ বলে।

মফঃস্বল শহর, কে ভাড়া নেবে। তাছাড়া আমার সঙ্গীতের ধাকায় দুদিনেই ভাড়াটে পালাবে।

দুজনে হাসে। এতো কম সময়ে তাদের এতো গভীর বন্ধুত্ব জমে উঠবে কে, ভাবতে পেরেছিল? শহীদ কামালকে লিখেছে তার বন্ধুর কথা। লিখেছে, যেদিন শুনবি বাজনা, কেবল মাত্র সেদিনই বুঝবি, কী অদ্ভুত ভালো বাজায়।

সেদিন রাত দশটায় হোটেলে ফিরে আসছে শহীদ। হোটেলের দরজার কাছে আসতেই একজন লোক ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল পাশ কাটিয়ে। একবার তার দিকে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে শহীদ উপরে উঠে গেল। তার ঘরের দরজা খোলা। আশ্চর্য হয়ে গেল শহীদ ঘরে ঢুকে। সমস্ত ঘরে তার জিনিসপত্র ছড়ানো। কে যেন তার বাক্স ঘেঁটেছে লন্ড ভন্ড করে। প্রায় সবকিছুই বের করে মাটিতে টাল দেয়া। এক জোড়া স্যুট, কয়েকটা শার্ট, পাজামা, ধূতি, পাঞ্জাবী, সব মাটিতে বের করা রয়েছে। মেকআপ করবার জন্যে যে সব পরচুলা, পেইন্ট তার বাক্সে ছিলো, সবগুলোই মাটিতে নামানো। শহীদ লক্ষ্য করে দেখলো কিছুই চুরি যায়নি। টাকা আর রিভলবার তার সাথেই ছিলো।

মহা ভাবনায় পড়লো শহীদ। তাহলে কি কুয়াশার দৃষ্টি পড়েছে তার উপর। নাকি বেটা ছিচকে চোর? কিন্তু তাহলে জিনিস কিছুই চুরি হলো না কেন? দেখা যাক কি হয়, শহীদ ভাবে। তবে সাবধানে থাকতে হবে। পুলিসে খবর দিয়ে লাভ নেই, শুধু শুধু হাঙ্গামা করবে পুলিস এসে। হয়তো হরিদাসকে ধরেই মারতে লেগে যাবে। একবার ভাবলো রফিকের বাসায় উঠে যাবে কিনা।

জিনিসপত্র তুলে যথাস্থানে সাজিয়ে রাখলো শহীদ। কাউকে কিছু জানালো না। কিছুক্ষণ পর হরিদাস এসে বললো, বাবু আপনাকে একজন খুঁজতে এসেছিল সোন্দোর পর।

তার নাম বলে গেছে?

আজ্ঞে না। আমি জিজ্ঞাসা করেছেলাম। বুললো না। আমি বুললাম আপনি রফিক সাহেবের বাসায় যেয়েছেন। সে নোক অনেকক্ষণ নিচের রেস্টুরেন্টে বইসেছেল আপনার জন্যি। তারপর কখন যে উইঠে চইলে গেল দেখিনি। আপনার সাথে দেখা হোইনি বাবু?

না হয়নি। আবার কখন আসবে লোকটা বলে গেছে?

না বাবু।

কি রকম দেখতে লোকটা?

বাইটে মতোন। মোটাসোট। হাতে একটা ছোট বাক্স ছেলো। সাদা শার্ট আর পাজামা পইরে ছেলো।

শহীদ খেয়াল করে দেখলো আজ হোটেলে ঢুকবার সময় পিছন থেকে যাকে দেখেছে তার সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে ওর বর্ণনা। একটা টাকা বের করে হরিদাসের হাতে দিয়ে বললো, আচ্ছা, তুমি এখন যাও হরিদাস। এরপর কেউ আমাকে খোঁজ করলে তাকে বসিয়ে রেখে আমাকে খবর দেবে।

হরিদাস চলে যাচ্ছে, তাকে আবার ডেকে শহীদ বললো, এখন চা পাওয়া যাবে না হরিদাস?

আজ্ঞে রাত বারোটা পর্যন্ত পাবেন।

কফি নেই।

আজ্ঞে, তাও আছে।

বাঃ। শহীদ খুশি হয়—এক কাপ কফি ভালো করে বানিয়ে আনে৷ তো।

ব্যালকনিতে বসে অনেকক্ষণ ধরে ধীরে ধীরে কফিটুকু খেলো শহীদ। তার মাথার মধ্যে জট পাকাচ্ছে একসাথে বহু চিন্তা। সে এখানে এসেছে খুনীর অনুসন্ধানে আজ পাঁচ ছয় দিন। কিন্তু কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছে সে? আজ হয়তো সে কুয়াশার তীক্ষ দৃষ্টিতে ধরা পড়ে গেছে।

পর পর অনেকগুলো সিগারেট ধ্বংস করলো শহীদ গভীর চিন্তামগ্ন অবস্থায়। তার মুখে একটা দুর্বোধ্য রহস্যময় হাসি ফুটে উঠলো ধীরে ধীরে।

পরদিন নারাণ বাবুর সাথে দেখা করলো শহীদ রফিকুল ইসলামের সাথে গিয়ে। আরও কয়েকখানে গেল। আশরাফ চৌধুরীর বাড়িতেও একবার গিয়ে ঢু মেরে এলো। পথে ট্রেনের সেই সিরাজুল হকের সাথে দেখা। আদাব বিনিময় হলো। রফিক জিজ্ঞেস করলো, এই ভদ্ৰলোক, কে?

আমার সাথে ট্রেনে পরিচয়। বড্ডো গায়ে পড়ে আলাপ করছিল তাই প্রথমে আমার খারাপ লোক বলে সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু পরে আবার নদীর ধারে দেখা। মোহিনী মিলে কি একটা কাজ করে যেন বললো।

মোহিনী মিলে? অসম্ভব। আমি নানান ব্যাপারে প্রায়ই যাই মোহিনী মিলে। ওখানকার সব লোক আমার চেনা। এ লোক নিশ্চয়ই নতুন এসেছে কুষ্টিয়ায়। ছোট শহর এটা। এখানকার স্থায়ী বাসিন্দাদের সবাই সবাইকে চেনে। তোমার কাছে মিছে কথা বলেছে লোকটা।

গতরাতের ঘটনা মনে পড়লো শহীদের। রফিকুল ইসলামকে বললো ব্যাপারটা। রফিক চিন্তিত হয়ে বললো, তাই তো। তোমার পেছনে চোর ছাচ্চোর লেগেছে বলে মনে হচ্ছে। well planned বলেই বোধ হচ্ছে, সেই ট্রেন থেকে follow করেছে তোমাকে। তুমি একটু সাবধানে থেকো। আর আপাততঃ চলো সোজা মোহিনী মিলে যাই। ওদের attendance register দেখলেই বোঝা যাবে সিরাজুল হক বলে কেউ ওখানে কাজ করে কিনা সত্যি সত্যিই।

রিক্সা ঘুরিয়ে ওরা মোহিনী মিলে গিয়ে উপস্থিত হলো। কর্মচারীদের অনেকেই রফিকুল ইসলামকে সসম্মানে সালাম দিলো। ম্যানেজার কি কাজে অফিস থেকে বাইরে এসে রফিককে দেখে হৈচৈ করে ডাকাডাকি শুরু করলেন। এ জায়গায় রফিকুল ইসলামের খুবই প্রতিপত্তি আছে বোঝা গেল। সেটা হয়েছে ম্যানেজারের সাথে বন্ধুত্বের পর থেকে।

খোঁজ করে দুজন সিরাজুল হক বেরোলো। ম্যানেজারের হকুমে তারা সামনে এসে দাঁড়ালো। আর কোনও সিরাজুল হক নেই। শহীদ আর রফিক অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা হোটেলে ফিরে এলো। কেউ লক্ষ্য করলো না, একজন লোক ম্যানেজারের অফিসের অদূরেই একটা গাছের আড়াল থেকে সব দেখলো। তারপর ধীর পদে বাজারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
 
১১.

কামালকে টেলিগ্রাম করলো শহীদ। সেদিনই বিকেলে কামাল আর গফুর এসে পৌঁছলো। সুন্দর মেকআপ হয়েছে কামালের। গফুরকেও চেনা যায় না।

সন্ধ্যের দিকে রফিকুল ইসলাম এসে বসলো শহীদের ঘরে। অনেক রকম কথা হচ্ছিলো। গফুরের প্রকান্ড কাঠামোর দিকে চেয়ে সে বললো, বাঃ, অদ্ভুত জিনিস পেয়েছো তো, অনাথ বাবু। তোমার নাম কি হে?

আজ্ঞে আমার নাম পেল্লয় বাগদী।

কিল মেরে কটা মানুষের মাথা একসাথে ভাঙতে পারো?

ও গোটা দুই পাঠান বা সাহেবকে চড় মেরে ঘুরিয়ে ফেলে দিতে পারে। শহীদ হেসে বললো।

গফুর সিধে রফিকের দিকে চেয়ে বললো, আজ্ঞে, দাদামণিকেও কিছু কম মনে করবেন না। আমার চাইতে তিনগুণ বেশি শক্তি আছে ওনার গায়ে। অনেকবার সে পরীক্ষা হয়ে গেছে।

শহীদ দেখলো, গফুর স্থান-কাল-পাত্র ভুলে যাচ্ছে। দাদামণির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ও এখনি বেফাঁস কথা বলে বসবে। রফিককে এড়িয়ে কয়েকবার চোখ টিপলো সে। গফুর দেখেই না। সে বলেই চলেছে, ঢাকায় বছর খানেক আগে একবার আমাদের বাড়ির সামনে কয়েকজন গুন্ডা ধরেছিল দাদামণিকে। সেই যে, প্ৰথম প্রথম দাদামণির মাথায়…

বাথরুম থেকে আওয়াজ এলো, প্রলয়। আমার তোয়ালেটা দে তো বাক্স থেকে বের করে, ফেলে এসেছি।

গফুর সচেতন হয়ে গেল। সে বাক্স খুঁজে বললো, নেই তো বাবু আপনার তোয়ালে বাক্সের মধ্যে।

ওহ-হো। এই তো কাপড়ের তলায় ছিলো। লাগবে না যা, পাওয়া গেছে।

গফুর নিচে গেল। রফিকুল ইসলাম বললো, ঢাকায় তোমার বাড়ি আছে বুঝি?

ছিলো। এখন ভাড়া দিয়ে দিয়েছি। আমি এখন রায়পুরাতেই থাকি।

হঠাৎ রফিকুল ইসলাম উঠে দাঁড়ালো। আমাকে এখুনি যেতে হচ্ছে, অনাথ বাবু। আমার মনেই ছিলো না একখানে এনগেজমেন্ট আছে। তুমি এগারোটার সময় অবিনাশ বাবুকে নিয়ে আমার বাসায় এসো।

ত্ৰস্ত পদে বেরিয়ে গেল রফিকুল ইসলাম। এইমাত্র কোথা থেকে যেন একটা টেলিগ্রাম এসেছে। সেটা পড়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ভুলে টেবিলের উপর ফেলে গেছে সে। সেটা খুলে একবার চোখ বুলালো শহীদ, তারপর আবার যথাস্থানে বন্ধ করে রেখে দিলো।

কিছুক্ষণ পরই রফিকুল ইসলাম ফিরে এলো। টেলিগ্রামটা ভুলে রেখে গেছিলাম, বলে সেটা উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল।

খাওয়া দাওয়ার পর কামাল বললো, কোনো সূত্র পেলি এতদিনে?

কিছু কিছু পেয়েছি, কিন্তু আরও বড় প্রমাণ চাই।

কাকে তোর সন্দেহ হয়?

সে পরে শুনিস। এখন তোকে আমি একটা কাজ দেবো। চটপট তৈরি হয়ে নে।

কি কাজ?

আমার পেছনে একজন লোক ঘুরছে কদিন ধরে। তার ওপর তোর নজর রাখতে হবে। জানালা দিয়ে চেয়ে দেখ, ঐ যে লোকটা দেখা যাচ্ছে পান কিনছে মোড়ের দোকানে, ভালো করে চিনে রাখ ওকে। আজ রাতে একটা দুর্ঘটনা ঘটবে। আমাকে বাইরে যেতে হবে তার জন্যে। আমার পেছনে এ লোকটা লেগে থাকবে। তুই শুধু খেয়াল রাখবি যেন লোকটা আমাকে বেকায়দায় না পায়। দরকার হলে রিভলবার ছুড়বি। মেরে ফেলিস নে আবার। জখম করবি শুধু।

কি ব্যাপার আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, শহীদ। কোথায় দুর্ঘটনা ঘটবে? এই লোকটাই বা কে?

বোঝাবার সময় নেই! এখন নয়টা বাজে। আর সময় নেই। আমি তৈরি হয়ে নিই, তুইও একটা কিছু পরে নে। আমার পাঁচ মিনিট পর তুইও বেরিয়ে যাবি হোটেল থেকে। খবরদার, লোকটাকে চোখের আড়াল করবি না। তাহলে তুই আর মজমপুর চিনবি না। আমি খুব বিপদে পড়তে পারি।

ঠিক হ্যায়। আমি ঠিক নজর রাখবো। ঐ ব্যাটা ঘোতকাকে আর আমার চোখ এড়াতে হচ্ছে না।

কালো স্যুট পরা একজন দীর্ঘাকৃতি যুবক আদর্শ হিন্দ হোটেল থেকে বেরিয়ে গেল। ম্যানেজার একবার তাকালো তারপর নিজের কাজে মন দিলো। লোকটা বোধহয় জমিদার বাবুর কাছে এসেছিল।

তার মিনিট পাঁচেক পর একজন অতি বৃদ্ধ ভিক লাঠি হাতে, একটা ছেড়া থলে গলায় ঝুলিয়ে হোটেলের পিছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। শীতে তার হাত পা কাঁপছে। অতি অপরিষ্কার ছেড়া কাপড় দিয়ে যতোটা সম্ভব শীত থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করছে।

থানাপাড়ার রাস্তা ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে যুবক। রাস্তার একপাশে সারি সারি বন্ধ দোকান। এদিকটা এমনিতেই নির্জন তার উপর আজ রবিবার-সারাদিনই দোকান-পাট বন্ধ। পথিকের জুতোর শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দোকানগুলোর বদ্ধ দরজায়। লাইট পোস্টের নিচে তার ছায়াটা ছোট হয়ে আসে, আবার বড় হতে হতে মিলিয়ে যায়। আরেকটা পোস্টের কাছে এসে ধীর অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে বরাবর হেঁটে এসে দাঁড়ালো সে একটা মোড়ের কাছে। ডান দিকে একটা কাঁচা রাস্তা। মেইন রোডটা বা দিকে ঘুরে রেল লাইন পেরিয়ে চলে গেছে পশ্চিম দিকে। কোনও দিকে না তাকিয়ে এই কাঁচা রাস্তা ধরে এগিয়ে চললো সে। এক হাঁটু ধুলো রাস্তায়। বরাবর কিছুদর এগিয়ে একটা একতলা বাড়ির ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো যুবক। একেবারে নির্জন এলাকায় বাড়িটা, আশে পাশে আর কোনো বাড়ি নেই। আর সিকি মাইলটাক পুবে এগোলেই গড়াই নদী। বাড়িটার উল্টো দিকে রাখার ওপাশে বেশ বড় একটা মাঠ। তারও দক্ষিণে কয়েকটা বাড়ির পিছন দিক। মাঠটা জঙ্গল হয়ে আছে আগাছায়। ছোট ছোট ঝোপ। মাঝে মাঝে বড় বড় গাছও আছে। রাস্তাটার ডান ধারে লাইন করা কতকগুলো জিগে গাছ। লোকটা ঢুকে পড়লো জঙ্গলে। বাড়িটার উপর ভালো নজর রাখা যায় এমন একটা জায়গা বেছে নিয়ে সে স্থির হয়ে দাঁড়ালো।

বাড়িটার দক্ষিণ দিকে একটা জানালা খোলা। একটা ক্ষীণ আলো জ্বলছে ঘরের ভিতর। আশে পাশে কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই। ঘড়িটার দিকে চাইলো যুবক! দশটা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি। পকেট থেকে কি একটা শাখের মতো জিনিস বের করে মুখে লাগিয়ে ফু দিলো। ঘেউ করে একটা শব্দ হলো জোরে। ঠিক যেন অ্যালসেশিয়ান কুকুরের ডাক। সাথে সাথেই ঘরের ভিতরের আলোটা নিভে গেল।

চুপ করে দাড়িয়ে আছে যুবক। মাঝে মাঝে মুখের সামনে হাত নাড়ছে। বড্ডো বেশি মশা।

হঠাৎ ঘাড়ের কাছে ঠান্ডা একটা শক্ত জিনিসের স্পর্শ পেলো সে। চমকে ঘুরে দাঁড়ায় যুবক। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। শুধু একটা ছায়ামূর্তি তার সামনে দাড়িয়ে আছে বোঝা যায়।

হ্যান্ডস আপ। চাপা অথচ গভীর গলায় আওয়াজ এলো।

যুবক দুহাত উপরে তুলে দাঁড়ায়।

বাছাধন। ভেবেছো ছদ্মবেশ পরে খুব ফাকি দিলে। এইবার তোমার সব জারিজুরি বের করবো। যুবকের পকেটে হাত দিয়ে রিভলবারটা বের করতে গেল আগন্তুক। মুখে তার ক্রুর হাসি।

হঠাৎ কি হতে কি হয়ে গেল। খট করে একটা শব্দ হলো। আগন্তুকের হাত থেকে ছিটকে রিভলবার মাটিতে পড়লো। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে লোকটা। আরেকটা শব্দ, খট। কিছু-মাত্র শব্দ না করে লোকটা জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। এবার যুবক কথা বললো, ঠিক সময়ে এসে পড়েছিলি, কামাল! জব্বর মার মেরেছিস, এখন নে, রুমালটা ব্যাটার মুখে পুরে দে, আর এইটা দিয়ে ভালো করে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেল। আমি মোটেই টের পাইনি ব্যাটা আমার এতো কাছে ছিলো।

একটা রুমাল আর একগাছা সিল্কের দড়ি বের করে দিলো শহীদ। তারপর মাটি থেকে রিভলবারটা তুলে নিলো।

ঠিক সোয়া দশটার সময় দূর থেকে একটা ঘোড়ার গাড়ির শব্দ শোনা গেল। কামাল বললো, গলির মুখে এসে শব্দটা থেমে গেল বলে মনে হচ্ছে।

হা। থামবে। সময় উপস্থিত। ফিসফিস করে বলে শহীদ। রিভলবার হাতে করে দাঁড়া। ওকি কাপছিস কেন? ভয় লাগছে?

গায়ে কাপড় নেই, শীত করছে।

শহীদ তার গায়ের কোটটা খুলে কামালের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলো। স্নেহের সুরে বললো, গাধা। ভিক্ষার থলেতে একটা আলোয়ান আনতে পারিসনি?

কামাল কি যেন বলতে যাচ্ছিলো। তার মুখ চেপে ধরে শহীদ ফিসফিস করে বলে, চুপ! ঐ দেখ আসছে। ওরই নাম কুয়াশা! সামান্যতম আওয়াজ হলেই ও টের পেয়ে যাবে। একদম চুপ।

কাছে এলে গুলি করবো?

খবরদার। আমার আদেশ ছাড়া কিছু করবি না৷

একটা ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে। যেমন লম্বা, তেমনি চওড়া। পায়ের তালে তালে কেবল একটা হাত দুলছে। আরেকটা হাত স্থির। শহীদ একটু অবাক হয়। না, আরেকটা হাতও আছে – সে হাতে একটা বাক্স মতো কি ঝোলানো।

সন্তৰ্পণে এগিয়ে আসছে কুয়াশা। কামালের বুকটা হিম হয়ে আসে। এই লোকটাই অবলীলাক্রমে মানুষ খুন করে বেড়াচ্ছে। এই যে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে লোকটা, সে একজন খুনী, ফাঁসির আসামী।

ওদের ঝোপের থেকে রাস্তা হাত পাঁচেক দূরে। ঠিক ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো কুয়াশা। চারদিকে সন্তৰ্পণে একবার চাইলো। তারপর বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। খোলা জানালার সামনে এসে দাঁড়ালো কুয়াশা। বাক্সটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলো। তারপর জানালার একটা শিকের ওপর ধরলো বাক্সটা।

শহীদ পকেট থেকে কি একটা বের করে তাতে ফুঁ দিলো৷ দুবার। ঘেউ। ঘেউ। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দুবার ডেকে উঠলো একটা কুকুর। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বন্দুকের প্রচন্ড এক আওয়াজ। ধ্বনি প্ৰতিধ্বনি তুলে অনেকক্ষণ ধরে শব্দটা এ বাড়ি ওবাড়ির দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরতে লাগলো। স্যাৎ করে সরে গেল কুয়াশা জানালার ধার থেকে। একটা অন্ধকার জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর দ্রুতগতিতে বেরিয়ে এলো রাস্তায়। উদভ্রান্তের মতো কামাল রিভলবার তুললো। শহীদ চেপে ধরলো তার হাত। কয়েক সেকেন্ড একটা গাছের এপারে বাড়িটা থেকে আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো কুয়াশা। তারপর দৌড় দিলো বড় রাস্তার দিকে। একটু পরেই আবার ঘোড়াগাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। ধীরে মিলিয়ে গেল শব্দটা।

আবার শিঙাটা নিয়ে শহীদ তিনবার কুকুরের ডাক ডাকলো। ঘরের ভিতর একটা আলো দেখা গেল একটু পরেই। দরজা খুলে হ্যারিকেন হাতে একটা মেয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। আপনি কোথায়, শহীদ ভাই? মেয়েটি জোরে ডাকে।

এই তো এখানে। হ্যারিকেনটা নিয়ে এই দিকে আসুন।

আলোটা এগিয়ে এলো। মেয়েটি ব্যগ্ৰ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, সে এসেছিল শহীদ ভাই? ওখানে কি পড়ে রয়েছে? আরে অনেক রক্ত যে? মেয়েটির গলা কেঁপে ওঠে।

লোকটা তখনও জ্ঞান ফিরে পায়নি। শহীদ ওকে অনায়াসে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলো। তারপর মেয়েটিকে বললো, আপনি আলো ধরুন সামনে। হ্যাঁ, এখন চলুন বাসার দিকে। এর জ্ঞান আগে ফিরিয়ে আনি, তারপর একটা কিছু ব্যবস্থা করা যাবে। আপনার বাবা সুস্থ আছেন তো?

হ্যা। বাবা মোটেও ভয় পাননি। বাব্বা, আমার কী ভয় যে করছিল।

বৈঠকখানার দরজা খুলে দিলো মেয়েটি। ঘরের মধ্যেখানে লোকটাকে শুইয়ে দিয়ে শহীদ বললো, আপনি একটা ন্যাড়া ভিজিয়ে আনুন তো শিগগির।

মেয়েটি বেরিয়ে গেল দ্রুত পায়ে। ফিরে এসে ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে লোকটার মুখের রক্ত মুছে দিলো। মাথার একটা জায়গা বেশ অনেকখানি কেটে গেছে, রক্ত বন্ধ হয়েছে অনেকক্ষণ। লোকটার মুখে চোখে জল ছিটাতে লাগলো সে।

কামাল আর শহীদ বাইরে এসে জানালার সামনে দাঁড়ালো। এইখানেই দাঁড়িয়েছিল কুয়াশা। একটা শিকের নিচের দিকটা গলে গেছে। কয়েক ফোটা গলা লোহা পড়ে রয়েছে। কামাল শহীদের দিকে চাইলো, শহীদও কামালের দিকে চাইলো। কেউ কোনও কথা বললো না। ঘরে ঢুকে একটা চেয়ারে বসে কামাল হঠাৎ উত্তেজিত কণ্ঠে বললো, তোর জন্যে শহীদ, কেবল তোর জন্যে আজ কুয়াশা পালিয়ে যেতে পারলো। নইলে আমি ওর বুকের মধ্যে বুলেট ঢুকিয়ে টের পাইয়ে দিতাম খুন করবার মজা।

উত্তেজিত হোস না কামাল। মাথা ঠান্ডা কর। ওকে খুন করলে পুলিস তোকে ধরতো খুনের দায়ে। কিছুতেই তুই প্রমাণ করতে পারতিস না যে ও-ই কুয়াশা। ওর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই।

অন্তত ওকে আহত করে বন্দী করা তো অসম্ভব ছিলো না।

অসম্ভবই ছিলো, কামাল। ওর হাতে একটা বাক্স দেখেছিস না? ওটা আমাদের দিকে ধরে একটা বোতাম টিপলে আমাদের ভবের লীলা সাঙ্গ হতে এক সেকেন্ডও লাগতো না। ওকে আহত করবার অর্থ নিজের মৃত্যু নিজে ডেকে আনা।

শহীদের কথায় বিশেষ সন্তুষ্ট হলো না কামাল। অন্য দিকে মুখ ফুরিয়ে বসে রইলো। হঠাৎ একটা কথা মনে হওয়াতে শহীদ মেয়েটির কাছে কাগজ কলম চাইলো। খশ খশ করে কি কি সব লিখলো। তারপর ভাঁজ করে মেয়েটির হাতে দিয়ে বললো, আমাদের খুব জরুরী কাজ আছে। আমরা এখুনি চলে যাচ্ছি। লোকটার জ্ঞান হলে এ চিঠিটা ওকে দেবেন, আর এই যে ওর রিভলবার, এটাও। বলে শহীদ চিঠি আর রিভলবার দিলো মেয়েটির হাতে।

কামালের মুখটা হাঁ হয়ে গেছিলো। সামলে নিয়ে অতি কষ্টে রাগ চেপে মেয়েটির দিকে চেয়ে বললো, আর আমাদের ঠিকানা দিয়ে যাচ্ছি, ওকে বলবেন যদি কিছু মনে না করে তাহলে যেন দয়া করে গিয়ে কামাল আহমেদ আর শহীদ খানের বুকে দুটো বুলেট ঢুকিয়ে দিয়ে আসে।

এর এই চাপা রাগ দেখে শহীদ হেসে ফেললো। আরও রেগে গিয়ে কামাল বললো, তোমার তামাশা আমি বুঝি না শহীদ। লোকটাকে হাতে পেয়ে ছেড়ে দেয়ার কি অর্থ হতে পারে? তুমি তো মরতে বসেছিলে ওর হাতে। এখন আবার অতো দয়া কেন?

রেগে গেলে সে শহীদকে তুমি করে বলে। শহীদ ওর কাঁধে হাত রেখে বললো, আয় কামাল, পথে যেতে যেতে সব বুঝিয়ে দেবো। এখন আয়, দেরি করিস না, আমাদের জরুরী কাজ আছে।

হোটেলে ফিরে এলো ওরা নিরাপদেই। গফুর মাটিতে একটা বিছানা পেতে কাঁথা জড়িয়ে বসে পুঁথি পড়ছিল, হরিদাস বসে শুনছিল। অপরিচিত লোক দেখে হরিদাস একটু আশ্চর্য হলো। এতো রাতে আবার কোনো ভদ্ৰলোক কারও সাথে দেখা করতে আসে? নিচে চলে গেল ও।

বেশ বদল করে ওরা রফিকুল ইসলামের বাড়ি গিয়ে হাজির হলো। খাটের উপর বসলো শহীদ, কামাল বসলো একটা চেয়ারে। যন্ত্রে ইতিমধ্যেই সুর মিলিয়ে রেখেছে রফিক। রাত প্রায় দেড়টায় আসর ভাঙলো। কামাল ঝিম হয়ে রয়েছে। দরবারী বাজালো আজ রফিক। এগিয়ে এসে কামাল হঠাৎ রফিকুল ইসলামের পায়ের ধুলো নিলো। সসব্যস্ত হয়ে উঠলো রফিকুল ইসলাম। লজ্জা পেয়ে বললো, ও কি করেন। আপনি আমার চাইতে বয়সে অনেক বড়। ছি, ছি!

যখন কামাল উঠে দাঁড়ালো তখন তার চোখে জল। রফিকের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর মৃদুস্বরে বললো, গুণী। শিল্পী! আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি নাও।

কামালকে জড়িয়ে ধরলো রফিক। বললো, আমায় যে বোঝে সে আমার চাইতে কোনো দিক দিয়ে ছোটো নয় আবিনাশ বাবু। আপনারা আমার বিশ্বাস ভেঙে দিচ্ছেন দুজন মিলে। আমি কোনোদিন ভাবতে পারিনি যে কেউ আমার গান বুঝবে, অনুভব করবে। সঙ্গীত বুঝতে হলে চাই উদার মন। আপনাকে কি করে যে আমার ভালোবাসা জানাবো বুঝতেই পারছি না, অবিনাশ বাবু।

কামাল রফিকের বাহুপাশ থেকে ছুটে বললো, কাল আবার আসতে পারবো তো?

নিশ্চয়ই। কাল এগারোটার সময় আসবেন। আজ কিন্তু আপনারা বেশ দেরি করে এসেছিলেন।

কাল ঠিক সময়ে আমরা পৌঁছোবো, রফিক সাহেব। শহীদ বলে। আর এখন আমরা আসি।

চাকরটাকে কফি আনতে বলেছিলাম। ও বোধহয় আমাদের disturb হবে ভেবে এতক্ষণ আনেনি। একটু বসো, কফি খেয়ে যাও।

কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই রফিকের মিশমিশে কালো চাকরটা এসে ঢুকলো ঘরে। একটা ট্রেতে করে ককি আর কয়েকটা বিস্কিট এনেছে।

একটা বোতল খুলে কিছু raw gin গলায় ঢেলে দিলো রফিক। বড় সুন্দর দেখাচ্ছে আজ রফিককে। একমাথা কোঁকড়ানো চুল। অপূর্ব সুন্দর চোখ দুটোতে আজ যেন একটা স্বপ্নের আবেশ। বড় ভালো লাগছে ওকে। একটা গাঢ় চকোলেট রঙের আলোয়ান গায়ে জড়িয়ে বসেছে ও। মিষ্টি হেসে বললো, জানো, আজ আমার জন্মদিন।

তাই নাকি? আগে বলোনি কেন? শহীদ বললো।

কেন, কিছু প্রেজেন্ট করতে বুঝি? আমি প্রেজেন্টেশন নিতে ভালবাসি না।

ভালো কথা।

আচ্ছা, আপনি বিটোফেনের সুর ভালবাসেন, অবিনাশ বাবু?

হাঁ। অবশ্য ভালো বুঝি না। কিন্তু মন্দ লাগে না।

কাল এসো, তোমাদের কয়েকটা জার্মান সুর বাজিয়ে শোনাবো। হ্যাঁ, হ্যাঁ, সরোদেই, আর কিছু আমি জানি না বাজাতে। শহীদের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে হেসে বলে রফিকুল ইসলাম।

আপনি ওদেশের সঙ্গীতও জানেন? জিজ্ঞেস করে কামাল।

এই সামান্য কিছু। আমি পনেরো বছর জার্মানীতে ছিলাম।

জার্মানীতে? বিস্মিত হয় শহীদ, কামাল।

হ্যা। সে অনেক কথা। আরেকদিন শুনবেন। আজ না, কেমন? কয়েক ঢোক মদ খায় রফিকুল ইসলাম।

পরদিন সকালে শহীদ আর কামাল চা খাচ্ছে, এমন সময় চিঠি হাতে একটা বাচ্চা ছেলে এসে দাঁড়ালো দরজার সামনে। বললো, আপা চিঠিটা দিলেন, বুললেন খুব জরুরী।

চিঠিটা পড়ে শহীদের ভ্রু কুঁচকে গেল। কামালের হাতে দিলো চিঠিটা। কালকের সেই মেয়েটির লেখা। লিখেছেঃ

শহীদ ভাই,

কাল মাঝরাত থেকে বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না। রাত তিনটের দিকে গরম জল নিয়ে দেখি গিয়ে বাবা বিছানায় নেই-জানালার সব কটা গরাদ বাঁকানো এখনো পুলিসে খবর দিইনি। বড় বিপদে পড়েছি। আপনি শিগগির একবার আসুন।

ইতি—মহুয়া

এক মিনিটের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে ওরা বেরিয়ে পড়লো। রিক্সায় কামাল জিজ্ঞেস করলো, মেয়েটা হিন্দু নাকি রে!

না। মুসলমান। ওর বাবার নাম হেকমত আলী। কুষ্টিয়া মিউনিসিপ্যাল স্কুলের হেড মাস্টার ছিলেন। বছর পাঁচেক থাইসিসে ভুগছেন-বিছানায় পড়ে আছেন। মেয়েটি বি.এ. পড়ছে। গার্লস স্কুলে মাস্টারি করে আর পড়ে। সংসারও সেই চালায়।

রিক্সা এসে থামলো বাড়িটার সামনে। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ওরা এগিয়ে গেল। বাইরে থেকেই দেখা গেল জানালার সব কটা গরাদ বাকানো। মহুয়া বেরিয়ে এলো। মুখটা শুকিয়ে গেছে সারারাত্রির চিন্তায়। কিন্তু বড় সুন্দর দেখাচ্ছে। কামাল লক্ষ্য করলো মেয়েটি অদ্ভুত সুন্দরী। বয়স আঠারো কুড়ির মধ্যে। চমৎকার গড়ন, রঙটা উজ্জ্বল গৌর। মুখ দেখে কেউ বুঝবে না ঐ মেয়ে কঠোর সংগ্রাম করছে বেঁচে থাকবার জন্যে। টানাটানা চোখগুলো বড় গভীর। সমস্ত মুখটায় একটা নিস্পাপ সারল্য আছে।

আপনি বাবাকে ফিরিয়ে এনে দেন, শহীদ ভাই।

আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। আজ এখানে আমার আসবার কোনও প্রয়োজন ছিলো না, কেবল আপনাকে বলতে এলাম, ভয় পাবেন না, আজই আপনার বাবাকে ফিরিয়ে এনে দেবো। এখন যাই, একটু থানায় যেতে হবে।

আমি আসবো সঙ্গে?

না, দরকার হবে না। পুলিস আসবে না। আপনার এখানে। আপনি নিশ্চিন্ত মনে রান্না করে খাওয়া দাওয়া করুন। বাড়ি ছেড়ে কোথাও বেরোবেন না আজ।

শহীদ আর কামাল বেরিয়ে গেল। শহীদের কপালে চিন্তার রেখা। থানার দিকে এগোলো ওরা।
 
১২.

ফুটফুটে অন্ধকার ঘরটা। জ্ঞান ফিরে পেলেন হেকমত আলী। কেমন যেন ঘোলা লাগছে সব কিছু। ধীরে ধীরে সব কথা মনে পড়লো তাঁর। একটা খশ খশ শব্দ শুনে জেগে যান তিনি। প্রায় সারারাত জেগে থেকে কাশেন, তাই ঘুম অত্যন্ত পাতলা তাঁর। জেগে গিয়ে তিনি ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কে?

একটা রুমাল দিয়ে তার নাক মুখ চেপে ধরলো যেন কে। একটু ধস্তাধস্তি করেন হেকমত আলী। তাঁর দুর্বল শরীর নির্জীব হয়ে আসে। একটা মিষ্টি গন্ধ, কেমন আবেশ মাখানো। ধীরে ধীরে জ্ঞান হারিয়ে গেল তাঁর। আর কিছুই মনে পড়ছে না।

ঐতো। সেই কালো মূর্তিটারাতে যার সাথে ধস্তাধস্তি করেছেন হেকমত আলী। উঠে বসবার চেষ্টা করলেন তিনি, কিন্তু পারলেন না। খাটের সাথে তাঁকে বেল্ট দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়েছে। একটা ভেন্টিলেটার দিয়ে সামান্য আলো আসছে সেই ঘরে—সেদিকে তাকিয়ে বুঝলেন, এখন দিন। একটা অন্ধকার ঘরে তাঁকে আটকে রাখা হয়েছে।

ততক্ষণে মূর্তিটা বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

আমাকে কেন আটকে রেখেছো? আমার টাকা পয়সা নেই, রুগী মানুষ, ছেড়ে দাও আমাকে।

টাকা পয়সা আমার অনেক আছে, হেকমত সাহেব। আপনার কাছে চাই না।

তবে? আর কি চাও আমার কাছে?

ঘরের মধ্যে বাতি জ্বলে উঠলো। কালো আলখেল্লা পরা একজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে ঘরের মধ্যে। কেমন যেন চেনা ঠেকছে চেহারাটা। লোকটা বললো, আপাততঃ আপনার জ্ঞান ফিরে আসাটা চাইছিলাম।

ঘরের এক কোণে আর একজন লোককে দেখা গেল। নিকষ কালো তার গায়ের রঙ। একটা হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি পরনে। খুব রোগা লোকটা। একটা টেবিলের ওপর নানান আকারের কতগুলো যন্ত্রপাতি সাজিয়ে রাখছিল সে। আলখেল্লা পরা লোকটার দিকে ফিরে বললো, সব ঠিক আছে, হুজুর। মাইক্রোস্কোপটা আমি পাশের ঘর থেকে নিয়ে আসছি।

পাশের ঘরে চলে গেল সে। আলখেল্লা পরা লোকটা এবার ঠেলা দিয়ে খাটটা টেবিলের কাছে নিয়ে গেল। খাটের পায়াতে রবারের চাকা লাগানো। নিঃশব্দে সেটা গড়িয়ে চলে এলো। একটা যন্ত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলো লোকটা।

আমাকে নিয়ে কি করতে চাও? হেকমত আলী সভয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

করতে চাই। যন্ত্রটা নামিয়ে রাখলো লোকটা টেবিলের উপর। অনেক কিছুই করতে চাই, হেকমত সাহেব। আজ আমার সারা জীবনের সাধনার হয় ফল লাভ করবো, নয়তো চিরকালের জন্যে শেষ হয়ে যাবো। আজ ছয় ঘণ্টার মধ্যে আপনি হয় যক্ষ্মার হাত থেকে বেঁচে যাবেন, নয়তো মৃত্যুবরণ করবেন। ও কি, চমকে উঠবেন না। মরতে তো আপনাকে হবেই, আজ যদি একটা মহৎ উদ্দেশ্যে আপনি মারা যান তাহলে কি আপনার মৃত্যু মহিমামন্ডিত হয়ে উঠবে না? আর যদি successful হই, তবে পৃথিবী থেকে ক্ষয় রোগ চিরকালের জন্যে দূর হয়ে যাবে।

আমাকে ছেড়ে দাও। আমি আরোগ্য চাই না। যে কটা দিন পারি, সে ক টা দিন আমি বাঁচতে চাই।

আপনি চাইলেও আপনাকে ছাড়া হবে না। আমার পরীক্ষা আমি করবোই। কারও সাধ্য নেই তা ঠেকাবার। আমাকে বাঁধা দেবার জন্যে গুলিও ছুড়েছিলেন, পেরেছেন আটকাতে। এই গবেষণার জন্যে আমি কতো মানুষ খুন করেছি-ডাকাতি করে টাকা যোগাড় করেছি। এখন আপনার অনিচ্ছায় সবকিছু আমি ভেস্তে দেবো বলতে চান, হেকমত সাহেব?

মাইক্রোকোপ নিয়ে কালো লোকটা ফিরে এলো। সাবধানে টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলো যন্ধটা। প্যান্টের দু পকেট থেকে দু বোতল স্কচ হুইস্কি বের করে টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখলো। আলখেল্লাধারী বললো, হেকমত সাহেবের গায়ের জামা সব খুলে ফেলো তো। আরে, ও কি করছো? কেবল শার্ট আর গেঞ্জি, পাজামা থাক।

হেকমত সাহেবের গা থেকে শার্ট আর গেঞ্জি খুলে ফেললো কালো লোকটা। সব কটা হাড় দেখা যায়। ভয়ে তার মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। টেবিলের উপর যন্ধটা বসিয়ে তার মুখটা এদিকে ওদিকে ঘুরিয়ে ঠিক হেকমত আলীর বুকের দিকে ফিরিয়ে আলখেল্লাধারী একটা সুইচ টিপে দিলো। তারপর বললো, এখন থেকে ছ ঘন্টা পর আমার গবেষণার ফল জানতে পারবো। আপনার শরীর খুব দুর্বল তাই খুব কম পরিমাণে sound পাঠাতে হচ্ছে। আরও তাড়াতাড়ি কাজ সারা যেতো যদি পয়েন্ট জিরো ওয়ান কিলোসাইকলসে সেটা পাঠাতে পারতাম।

হেকমত সাহেব কিছুই বুঝলেন না। কেমন যেন বিম বিম করছে মাথাটা। আড়ষ্ট

কষ্ঠে বললেন, তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।

আলখেল্লাধারী একটা বোতল তুলে নিয়েছিপি খুলে বেশ অনেকখানি তরল পদার্থ গলায় ঢাললো। তারপর একটু কেশে গলা পরিস্কার করে বললো, বুঝতে পারছেন না? আপনি আল্টা সোনিক্স সম্বন্ধে কিছু জানেন?

নাম শুনেছি। অতি শব্দ। যে শব্দ শোনা যায় না।

ঠিক ধরেছেন। কিন্তু হয়তো জানেন না, এই আলা সোনিক্স দিয়ে কতো বড় বড় কাজ করা যায়। আমি এটা নিয়ে গবেষণা করেছি সুদীর্ঘ পনেরো বছর। এই যে যন্ত্রটা দেখছেন আপনার বুকের দিকে তাকিয়ে আছে, এটা অনবরত অতি সূক্ষ্ম শব্দ তরঙ্গ পাঠাচ্ছে আপনার বুকের দিকে। ফলে ক্ষয় রোগের যতো জীবাণু আসছে হার্টে, আর যতো বীজানু বহুদিন থেকে বাসা বেঁধেছে লাংসে, সব মারা পড়ছে। ছ ঘন্টার মধ্যে সব মরে ভূত হয়ে যাবে, যদি আমার হিসেব ঠিক হয়ে থাকে। তারপর আপনি ভালো খাওয়া দাওয়া করলে তিন মাসের মধ্যে আবার আগের স্বাস্থ্য ফিরে পাবেন।

হেকমত আলীর মাথাটা বিমঝিম করছে। ঠিকমত কিছুই চিন্তা করতে পারছেন না। বললেন, বুঝেছি, আপনি বৈজ্ঞানিক। আমিও সাইন্স পড়েছি। আমি বিজ্ঞানের মর্যাদা বুঝি। আপনার গবেষণার ফলে আমার যদি প্ৰাণ যায় তবু আপনার বিরুদ্ধে আমার কোনও অভিযোগ থাকবে না।

এই তো চাই, হেকমত সাহেব।

বলা তো যায় না-আমি হয়তো যে কোনো মুহুর্তে মারা যেতে পারি। আপনি নিরাপদ হবার জন্যে আমার স্বীকারোক্তি লিখে নেন।

তার দরকার হবে না। প্রথম কথা, আপনি মারা যাবেন না। দ্বিতীয় কথা, যদি আপনি মারাও যান, কাল গোয়ালন্দে নদীর মধ্যে আপনার লাশ পাওয়া যাবে। এ রকম আরও বহু লোককে আমি খুন করেছি। আমারই নাম কুয়াশা।

কালো লোকটাকে কুয়াশা বললো, তুমি এখানে থাকো। উনি পানি খেতে চাইলে দিও। এখন বেলা বাজে চারটা, আমি সাড়ে নয়টায় আসবো আবার। তার মধ্যে কিছু ঘটলে তক্ষুণি আমাকে জানাবে।

একটা বোতল টেবিলের উপর থেকে তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছিলো কুয়াশা, হেকমত আলী বাধা দিলেন। বললেন, আপনার পরীক্ষা শেষ হবে ছ ঘন্টা পর, তার মধ্যেই আপনি পুলিসের হাতে ধরা পড়ে যাবেন।

পুলিসের নামে চমকিত হলো কুয়াশা। বললো, পুলিস?

আপনি জানেন না, আপনাকে ধরবার জন্যে ঢাকার প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান কুষ্টিয়ায় এসেছেন।

আশ্চর্য হয়ে গেল কুয়াশা। সামলে নিয়ে বললো, আপনি জানলেন কি করে?

সে তো আমাদের বাসায় গিয়েছিল। সে-ই তো আমার মেয়ের কাছে একটা বন্দুক রেখে গেছিলো। আমাদের তো বন্দুক নেই। তার বন্দুক দিয়েই কাল রাতে প্রথমবার আপনাকে তাড়ানো হয়েছিল।

আচ্ছা, বন্দুকের রহস্য তবে এই! ভেবেই পাচ্ছিলাম না আপনাদের কাছে বন্দুক.এলো কি করে। তাহলে আপনি বলতে চান শহীদ খান আমাকে চেনে? সে জানলো কি করে যে কাল আপনার বাড়িতে হানা দেবো? ব্যাপারটা ঘোরালো ঠেকছে। তবে কি ধরা পড়ে গেলাম! স্বগতোক্তির মতো বলে কুয়াশা।

সে এখনো আদর্শ হিন্দু হোটেলে অনাথ চক্রবর্তী নাম নিয়ে রয়েছে।

এ্যাঁ! কি বললেন? অনাথ চক্রবর্তী চমকে উঠলো কুয়াশা। কপালে অনেকগুলো কুঞ্চন রেখা পড়লো।

হেকমত আলীর চিন্তা ক্রমেই আড়ষ্ট হয়ে আসছে। কি বলছেন নিজেই বুঝতে পারছেন না ভালো করে। একবার তাঁর মনে হলো, যা বলছেন হয়তো ঠিক হচ্ছে না বলা। আবার ভাবছেন, বলেই ফেলি, কি আর হবে। তার মুখের দিকে চেয়ে কুয়াশা এগিয়ে এলো। আপনার কষ্ট হচ্ছে? মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে কেন?

কি জানি। কেমন যেন লাগছে। কিছুই ভাবতে পারছি না। একটু পানি!

লোকটাকে ইশারা করতেই সে এক গ্লাস পানি আনতে গেল। যন্ত্রটা বন্ধ করে দিলো কুয়াশা। পানি খেয়ে কিছুটা সুস্থ হয়ে চিৎকার করে উঠলেন হেকমত আলী, ছেড়ে দাও আমাকে। আর কষ্ট দিয়ো না।

কুয়াশা মুচকে হাসলো, তারপর যন্ত্রটা আবার চালু করে দিলো।

আপনি পালিয়ে যান বৈজ্ঞানিক। শহীদ খান আপনাকে ধরবে।

সে চেনে আমাকে? আমিই যে কুয়াশা তা সে জানে?

হ্যাঁ, বলেছিল তো চেনে, কেবল প্রমাণের অভাবে ধরতে পারছে না। শান্ত গলা হেকমত আলীর।

তার সাধ্য নেই এইখানে আসবার। কালু তুই এই যন্ত্রটা নিয়ে ছাতে চলে যা। কেউ বাড়ির ভেতর ঢুতে চেষ্টা করলেই এই বোতাম টিপবি। আজ দরকার হলে আমি হাজার হাজার মানুষ খুন করবে, তবু আমার গবেষণা রেখে পালিয়ে যাবো না।

হেকমত সাহেব ঝিমিয়ে এসেছেন। তাঁকে দিয়ে এখন যা খুশি বলিয়ে নেয়া যায়। কুয়াশা হাসে। ভাবে, আর কিছু না হোক, এ যন্ত্র দিয়ে আসামীর স্বীকারোক্তি বের করা যাবে। পৃথিবীকে সে কতো বড় একটা জিনিস দান করছে, অথচ পৃথিবীর মানুষই তাকে বাঁধা দেয়ার জন্যে কেমন আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

শহীদের সাথে আর কে আছে, হেকমত সাহেব? কুয়াশা জিজ্ঞেস করে।

তার বন্ধু কামাল আহমেদ। সে অবিনাশ সেরেস্তাদার নাম নিয়ে ওর সাথে আছে।

কুয়াশা বুঝলো হেকমত আলী ভুল বকছেন না। প্রকৃতিস্থ তিনি সত্যিই নেই। কিন্তু যা বলছেন তা সত্য। তার ইচ্ছের বিরুদ্ধেও সত্যি কথা বলছেন তিনি

একটা রাইটিং প্যাড নিয়ে এসে টেবিলে বসে কি সব লিখতে আরম্ভ করলো কুয়াশা। হেমত আলী চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। কয়েক ঢোক মদ খেয়ে নেয় কুয়াশা।

দু ঘন্টা পর চোখ খুলে পানি চাইলেন হেকমত আলী। যন্ত্র বন্ধ করে খানিকটা ব্রান্ডি ঢেলে দিলো কুয়াশা তার গলায়।

আমাকে মেরে ফেলো। আর পারি না। আমাকে মেরে ফেলো।

আবার শুরু হলো শব্দ-তরঙ্গ। ঝিমিয়ে এলেন হেকমত আলী। কুয়াশা লিখে চলেছে একমনে। মাঝে মাঝে কলম উঁচু করে অনেকক্ষণ ধরে কি যেন ভাবছে।
 
১৩.

রাত সাড়ে নয়টা। দোতলা একটা বাড়ির চারদিকে অনেকগুলো একশো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। ছাতের উপর একটা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার হাতে কিসের একটা বাক্স। ছাত্রের কার্নিশ ধরে অনবরত ঘুরে চলেছে লোকটা বাড়িটার চারদিকে দেয়ালের ওপর তীক্ষ্ম দৃষ্টি রেখে। চারজন কনেষ্টবল, একজন দারোগা, শহীদ আর কামাল এগিয়ে আসছে বাড়িটার দিকে। দূর থেকেই শহীদের নজর গেল ছাতের ওপর। থেমে গেল সে।

ঐ দেখুন, ছাতের ওপর যন্ত্র হাতে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে একজন লোক।

এখান থেকে গুলি করি, বললেন দারোগা সাহেব।

না, ও এখনও টের পায়নি। গুলি মিস করলে এক সেকেন্ডে আল্লার কাছে চলে যাবো আমরা।

আমার গুলি কোনদিন মিস হয় না। দারোগা রিভলবার তুললেন।

আহ! পাগলামি করবেন না, দারোগ৷ সাহেব। আরও যন্ত্র এবং আরও লোক নেই তা কে বললো আপনাকে আপনার দোষে কুয়াশাকে তো হারাবই, প্ৰাণটাও যাবে। আমার কথা শুনুন। যতক্ষণ না বাড়ির ভেতর ঢুকবার চেষ্টা করছি আমরা ততক্ষণ কেউ কিছু বলবে না। আমরা কেউ তো ইউনিফর্ম পরে নেই। আমি আর কামাল বাড়িটার পেছন দিকে চলে যাই। আপনারা সামনে দিয়ে ঘোরাফেরা করতে থাকুন। লোকটার দৃষ্টি যখন আপনাদের দিকে যাবে তখন ও সেদিকেই নজর রাখবে বেশি। আমর৷ সেই সুযোগে পেছন দিয়ে ভেতরে ঢুকবো।

দুদলে ভাগ হয়ে গেল তারা। শহীদ আর কামাল অনেকটা ঘুরে জঙ্গল আর আবর্জনা পেরিয়ে বাড়িটার পিছনে গিয়ে উপস্থিত হলো। পাঁচিলটা বেশ উচু। একজনের পক্ষে খালি হাতে বেয়ে ওঠা অসম্ভব। কামালের কাঁধে পা দিয়ে দাড়িয়ে দেয়ালের উপরটা ধরলো শহীদ, তারপর এক হাত দিয়ে কামালকে টেনে তুললো। দু জনে হাত দিয়ে দেয়াল ধরে ঝুলে রয়েছে। মাঝে মাঝে মাথা উঁচু করে দেখে শহীদ লোকটা ঘুরেই চলছে অনবরত। এক জায়গায় গিয়ে সে অদৃশ্য হয়ে যায়, আবার আধ মিনিট পর সম্পূর্ণ ছাতটা ঘুরে আসে। কিন্তু এই আধ মিনিটের মধ্যে দেয়াল টপকে দৌড়ে গিয়ে বাড়ির গা ঘেষে দাঁড়ানো অসম্ভব-মাঝের জায়গাটা বেশ বড়, ধরা পড়ে যাবে।

হাতটা ব্যথা হয়ে আসে কামালের। এবার আধ মিনিট পার হয়ে গেল, লোকটা আসছে না। প্রায় মিনিট দুয়েক পর এসে ঘুরে গেল। অমনি শহীদ দেয়াল টপকে ওপাশে লাফিয়ে পড়লো। কামালও এলো। শহীদ বললো, আমার পেছন পেছন দৌড় দে। প্ৰাণপণে ছুটলো দুজন বাড়িটার দিকে। বেশ বড় কম্পাউন্ড। মাঠ পার হয়ে বাড়িটার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো ওরা। ফিসফিস করে শহীদ বললো, বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। ব্যাটা এখন পুলিসদের ওপর খুব কড়া নজর রাখছে।

বাড়িটার মধ্যে কোনও প্রাণের সাড়া পাওয়া গেল না। অতি সন্তৰ্পণে নিঝুম বাড়ির ছাতের সিড়ির কাছে এসে দাড়ালো ওরা। সিড়িটা অন্ধকার পা টিপে টিপে শহীদ আর কামাল উঠে এলো সিড়ি বেয়ে। লোকটাকে দেখা গেল। ব্যস্ত পদে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছাতের উপর বাক্স হাতে। বাড়ির সামনের দিকটায় তার নজর বেশি। সামনের দিকে ঝুঁকে মাঝে মাঝে কি যেন ভালো করে লক্ষ্য করে দেখছে ও। এই যে, চারদিকটা একবার ঘুরে এসে আবার ঝুঁকলো লোকটা। কামালের গা টিপে তাকে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে ইশারা করে শহীদ বাঘের মতো দ্রুত অথচ নিঃশব্দ গতিতে এগিয়ে গেল তার দিকে। লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যেই ঘুরেছে অমনি প্রচও এক মুষ্টাঘাত এসে পড়লো তার নাকের উপর। চারদিকে সর্ষে ফুল দেখতে লাগলো লোকটা। এবার একটু পিছিয়ে এসে স্টেপ নিয়ে একটা পুরো নক-আউট পাঞ্চ কাষালো শহীদ। ঘুরে পড়ে গেল লোকটা। ঠক করে যন্ত্রটা তার হাত থেকে ছিটকে নিচে পড়লো।

কামাল এসে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে। একটা রুমাল লোকটার মুখের মধ্যে গুঁজে দিয়ে সিল্কের দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেললো তাকে কামাল। লোকটাকে সেইখানেই ফেলে রেখে কামাল আর শহীদ সাবধানে সিড়ি বেয়ে নেমে এলো আবার।

দশটা বাজতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। কুয়াশা কলম বন্ধ করে ঘড়ির দিকে চাইলো। হেকমত আলীর পাশে এসে দাঁড়ালো সে। আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে তার গবেষণার ফল জানতে পারা যাবে। দীর্ঘ পনেরো বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম। হয় আজ সাফল্য, নয় পরাজয়।

ঠিক দশটার সময়ে যন্ত্রটা বন্ধ করে দিলো সে। অল্প অল্প করে বেশ খানিকটা ব্রান্ডি খাওয়ালো হেকমত আলীকে। তারপর বাঁধন খুলে দিলো তার। খুব সাবধানে উঠিয়ে বসালো তাকে। বললো, একটু কেশে খানিকটা কফ বের করুন তো হেকমত সাহেব। হ্যাঁ, এই কাচটার ওপর ফেলুন। এবার শুয়ে পড়ুন।

মাইক্রোস্কোপের কাছে সরে এলো কুয়াশা। তার মুখ অত্যন্ত গম্ভীর। হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠলো, ইউরেকা, ইউরেকা! Successful!

আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো কুয়াশার মুখ। হেকমত আলীর দিকে ফিরে বললো, আপনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ হেকমত সাহেব। এখনও আপনার লাংসে কিছু ক্ষত আছে, তবে সেটা সেরে যেতে পনেরো দিনের বেশি লাগবে না। আপনি বাড়ি ফিরে আপনার সব পুরনো জামা কাপড় পুড়িয়ে ফেলবেন। নইলে আবার ধরবার সম্ভাবনা আছে। একটু ভালো diet খেলে তিনমাসের মধ্যে আপনি আপনার আগের স্বাস্থ্য ফিরে পাবেন। আপনার শরীরে এখন একটিও জীবিত যক্ষ্মা বীজাণু নেই, হেকমত সাহেব।

ফ্যালফ্যাল করে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন হেকমত সাহেব। তারপর হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন, মেরে ফেলো আমাকে। আর কষ্ট দিও না! মেরে ফেলো, তোমার পায়ে পড়ি মেরে ফেলে!

চমকে ফিরে তাকায় কুয়াশা। হেকমত আলীর চোখ দুটো রক্ত জবার মতো লাল টকটকে। পাগল হয়ে গিয়েছেন হেকমত আলী। চিৎকার করে বললেন, পানি, পানি দাও।

কয়েক চামচ ব্রান্ডি ঢেলে দিলো কুয়াশা তাঁর গলায়।

মেরে, কোলো। উঃ! তোমার পায়ে পড়ি মেরে ফেলো। আবার চিৎকার।

ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে কুয়াশা। টেবিলের উপর কনুই রেখে কপালের দু ধার টিপে ধরে সে। আর অপেক্ষা করা চলে না। শহীদ খান এতক্ষণে নিশ্চয়ই বাড়িতে ঢুকবার চেষ্টায় ক্ষ্যাপা কুকুর হয়ে গেছে। এক্ষুণি এখান থেকে সরে পড়তে হবে।

উঠে দাঁড়ালো কুয়াশা। কিন্তু একর, এতো বড় পাষন্ড, তার চোখে জল। হেকমত সাহেবের দিকে ফিরে কুয়াশা বললো, আমি চললাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে। আমি নিজ হাতে আপনার এই দশা করলাম। উঃ! তার গলা ভেঙে আসে।

যাওয়ার আগে আমাকে খুন করে যাও! আর পারি না! পায়ে পড়ি তোমার!

দু হাত দিয়ে মুখ ঢাকে কুয়াশা। তারপর ঘুরে দাঁড়ায়।

ঠিক এমনি সময় শহীদ আর কামাল এসে ঢুকলো ঘরে। দুজনের হাতেই উদ্যত রিভলবার।

মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়াও, কুয়াশা।

চমকে উঠলো কুয়াশা। তারপর বিদ্যুৎগতিতে টেবিলের উপর থেকে যন্ত্রটা তুলে নিলো হাতে। সাথে সাথেই গর্জে উঠলো শহীদের রিভলবার। ক্যামেরার চোখের মতো একটা চোখ ছিলো যন্ত্ৰটার। সেই কাঁচের চোখটা গুড়ো করে দিয়ে শহীদের অব্যর্থ বুলেট প্রবেশ করলে৷ যন্ত্রটার মধ্যে। ঝন ঝন করে একটা শব্দ হলো। বিকল হয়ে গেল যন্ত্র।

করলে কি শহীদ। আমার সারা জীবনের সাধনা নষ্ট করে দিলে। বিকৃত হয়ে গেল কুয়াশার মুখ। গভীর বেদনার ছাপ ফুটে উঠলো তাতে। আরো কি যেন বলতে চেষ্টা করলো কুয়াশা; তার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেছে। কেবল ঠোঁট নড়লো, কথা বেরোলো না।

এমন সময় পিছন থেকে বড় কণ্ঠে আওয়াজ এলো, হ্যান্ডস আপ।

ঘুরে দাঁড়ালো ওরা দুজন। সামনে কেউ নেই। আবার আওয়াজ এলো, হাত থেকে রিভলব্যর ফেলে দাও, নইলে খুলি ফুটো করে দেবো। আমি দরজার আড়ালেই রয়েছি!

দুজনেই ফেলে দিলো রিভলবার।

এবার মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়াও।

শহীদ, কামাল মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়ালো। একমিনিট, দুইমিনিট। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ওরা। কেউ আসে না আর সামনে। কোনো কথাও নেই। ওরা পরস্পরের দিকে ফিরে তাকালো। শহীদ পিছন ফিরে দেখলো কুয়াশা অদৃশ্য হয়ে গেছে পিছন। থেকে। মূহুর্তে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল শহীদের কাছে। মাটি থেকে রিভলবারটা কুড়িয়ে নিয়ে শহীদ ছুটে গেল পাশের ঘরে। সেখানেও নেই কুয়াশা। ঘরের এক কোণে একটা গৰ্ত মতো জায়গা পাওয়া গেল। সিড়ি নেমে গেছে নিচে। একটা চৌকোণা পাথর চাপা ছিলো গর্তের মুখে। পাথরটা এখন সরানো।

নেমে গোল শহীদ সিড়ি বেয়ে। কামালও নামলো পিছন পিছন। ঘন অন্ধকার ভিতরে। নিজের হাত পর্যন্ত দেখা যায় না। সাবধানে যতোটা সম্ভব তাড়াতাড়ি নেমে শহীদ হোঁচট খেলো। সিড়ি শেষ হয়ে গেছে সে টের পায়নি। সামলে নিয়ে চারদিকে হাত বাড়ালো শহীদ। একটা দিক ছাড়া সব দিকই বন্ধ। এগিয়ে গেল শহীদ খোলা পথটা ধরে। পুরো পাঁচ মিনিট চলার পর পথটা শেষ হলো। কয়েক ধাপ সিড়ি দিয়ে উঠে একটা পাথর ঠেকলো হাতে। বেশ ভারি পাথর। প্রাণপণ শক্তিতে ঠেলা দিয়ে পাথরটা সরিয়ে ফেললো শহীদ। লাফিয়ে বেরিয়ে এলো ওরা। খোলা আকাশ, তারা মিটমিট কাছে। সামনে গড়াই নদী। একটা লঞ্চ দাড়িয়ে আছে ঘাট থেকে বেশ অনেকটা দূরে।

হঠাৎ শহীদের খুব কাছে থেকে শব্দ এলো, শহীদ খান, আমার সারা জীবনের সাধনা তুমি নষ্ট করে দিয়েছো। প্রস্তুত থেকো, আমি নির্মম প্রতিশোধ নেবো।

কামাল চারদিকে তাকাচ্ছে, কে কথা বলে? শহীদ বললো, কাকে খুজছিস কামাল। কুয়াশা এখন লঞ্চের মধ্যে।

বলতে না বলতেই মৃদু গর্জন করে লঞ্চ ষ্টার্চ দিলো। চলতে আরম্ভ করেছে লঞ্চটা। কামাল রিভলবার ছুঁড়লো লঞ্চ লক্ষ্য করে। দূর থেকে একটা অট্টহাসি শোনা গেল। অনেকক্ষণ ধরে সে হাসি নদীর পারের বাড়িগুলোতে প্রতিধ্বনি তুললো। শহীদ একটা দীর্থ নিঃশ্বাস ফেললো। পাশ থেকে কে বলে উঠলো, পালিয়ে গেল, না?

শহীদ চেয়ে দেখলো দারোগা সাহেব কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

আবার তারা তিনজন সুড়ঙ্গ দিয়ে ফিরে এলো কুয়াশার পরিত্যক্ত বাড়িতে। হেকমত আলী তেমনি শুয়ে আছেন। কিছুক্ষণ নির্জীব হয়ে পড়ে থাকেন, তারপর হঠাৎ চমকে ওঠেন আতঙ্কিত হয়ে। চিৎকার করে ওঠেন, মেরে ফেলো! পায়ে পড়ি, মেরে ফেলো!

ঘরের মধ্যে কুয়াশার যন্ত্রটা পড়ে আছে। আরও কয়েকটা অদ্ভুত আকারের যন্ত্র টেবিলের উপর রাখা। টেবিলের উপর একটা প্যাডের দিকে শহীদের নজর গেল। একটা চিঠি লেখা রয়েছে। সম্বোধনটা পড়ে আশ্চর্য হোলো শহীদ, তাকেই লেখা। দারোগা সাহেবের দিকে তাকিয়ে শহীদ বললো, তিনতলার উপর একজন লোক হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। তাকে হাজতে পাঠিয়ে দিন। আর হেকমত আলী সাহেবকে তার বাড়িতে পৌছাবার একটা ব্যবস্থা করে দিন।

একটা চেয়ার টেনে নিয়ে চিঠিটা পড়তে শুরু করে শহীদঃ

শহীদ খান,

তুমি যখন এ ঘরে উপস্থিত হবে তখন আমি বহুদূরে। আজ আমার শেষ পরীক্ষা। যদি সফল হই, পৃথিবী আমায় পুজো করবে। আর যদি সফল হতে না পারি, চিরকালের জন্যে আমার প্রতিভার পরিসমাপ্তি ঘটবে। সে ক্ষেত্রেও আমায় চলে যেতে হবে এখান থেকে। কারণ, তুমি আমায় চিনে ফেলেছো।

তোমায় আমি বন্ধু হিসেবে নিয়েছিলাম-সত্যিই তুমি তার যোগ্য। পৃথিবীতে কেউ যদি আমায় বুঝে থাকে, সে হচ্ছো তুমি। কার্ল ব্র্যান্ডে নবাৰ্গও আমাকে বোঝেননি। আমি তারই হাতে মানুষ, তিনিই আমাকে সবরকম শিক্ষা দীক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু যেদিন তিনি আমায় জোর করে জার্মানীতে আটকে রেখে আমার গবেষণার ফল ভোগ করতে চেষ্টা করেছিলেন, সেদিন তাকে নির্মমভাবে হত্যা করতে আমার কিছুমাত্র বাধেনি। আমি বাঙালী। আমি বাঙলা থেকে আমার পরীক্ষার ফল পৃথিবীকে জানাবো। জার্মানী থেকে পালিয়ে আসতে হয় আমাকে পুলিসের ভয়ে। কিন্তু এ দেশে এসে কি পেলাম? পুলিসের তাড়া। কিন্তু তোমার কাছ থেকেও কি আমি সহানুভূতি আশা করতে পারি না? পারি না একটু মায়া, একটু ভালবাসার দাবি করতে?

আরও আগে থেকে বলি, নইলে ভালো করে বুঝতে পারবে না।

আমার academic qualification-এর কথা শুনলে আশ্চর্য হবে। আমি ম্যাট্রিক পাস। ছোটকাল থেকেই আমার সঙ্গীতের প্রতি ঝোঁক ছিলো। একটা সারোদ কিনেছিলাম। বাবাই কিনে দিয়েছিলেন। পড়াশোনাতে আমি খুবই ভালো ছিলাম।

কিন্তু ম্যাটিক পাস করবার পর আমি সরোদ নিয়েই অতিরিক্ত মেতে উঠি। ফলে। I..S.C.-তে ফেল করলাম। বাবা খুবই আঘাত পেয়েছিলেন, কিন্তু কিছুই বলেননি আমায়। আমি তখন অন্য ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত। একটা তারে টোকা দিলে একটা সুর বাজে, তারপর আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়। আমার চিন্তা হলো, মিলিয়ে যায় কোথায়? জানতাম সেকেন্ডে কতবার থেকে কতবার কাঁপলে তারের শব্দ মানুষ শুনতে পায়। কিন্তু তার বেশি বা কম যদি কাপে? তাহলে? শোনা না গেলেও তো সে কাঁপন বাতাসে থেকে যায়। জানবার খুব আগ্ৰহ হলো। ঠিক এই সময়ে একটা বই পেয়ে গেলাম আলট্রা সোনিক্স সম্বন্ধে। সেটা পড়ে আগ্রহ আরও বাড়লো। আরও কতগুলো কিনলাম। এদিকে বাবা ক্রমেই বিরক্ত হয়ে উঠছেন। শেষে যখন পড়াশোনা একেবারে ছেড়ে দিয়ে আলাট্রা সোনিক্সের experiment শুরু করলাম, তখন একদিন ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দেন বাবা। আমি বাবার দোষ দিই না। তিনি অনেক সহ্য করেছিলেন।

আমি কলকাতায় চলে গেলাম। খেয়ে না খেয়ে দুবছর সেখানে কাটালাম। কাল ব্যান্ডে নবার্গ নামে একজন জার্মান বৈজ্ঞানিক তখন কলকাতায় এসেছিলেন। ইউনিভারসিটির আমন্ত্রণে। আমি সোজা তার কাছে গিয়ে বললাম, আপনি বৈজ্ঞানিক, আপনি আমার ব্যকুলতা বুঝবেন, আপনি আমাকে সাহায্য করুন। আমি তাকে impress করতে পেরেছিলাম। তিনি আমাকে জার্মানীতে নিয়ে গেলেন সাথে করে। সেখানে পনেরো বছর কাটিয়েছি আমি।

সতেরো আঠারো বছর বয়সে আমি বাঙলা ছেড়েছিলাম। এই কুষ্টিয়ায় আমার বাড়ি। ছোট দুবছরের বোনটিকে খুব মনে পড়তো। ওকে দেখবার জন্য সুদূর জার্মানীতে বসে অনেক ছটফট করেছি। কতো বিনিদ্র রাত আমার কেটেছে মায়ের জন্যে বুক ভাসিয়ে কেঁদে।

যখন দেশে ফিরে এলাম তথন সকলের আগে ছুটে এলাম কুষ্টিয়ায়। মা অনেকদিন হলো মারা গেছেন। বাবা যক্ষ্মা হয়ে বিছানা ধরেছেন। ছোটো বোনটা কতবড় হয়েছে। সে ম্যাটিক পাস করে তখন মাষ্টারি করছে স্কুলে, আর সেই সঙ্গে কলেজেও ভর্তি হয়েছে। তুমি ঠিকই সন্দেহ করছো শহীদ, হেকমত আলী সাহেবই আমার বাবা, মহুয়া আমার ছোটো বোন। আমিই শখ করে তার নাম রেখেছিলাম মহুয়া। আমার নাম মনসুর আলী।

আমি নিজের পরিচয় দিলাম না। ঢাকায় গিয়ে আমি আমার গবেষণার জন্যে সরকারের সাহায্য চাইলাম। আমার কোনও qualification নেই। কেউ আমার কথা কানেই তুললো না। অনেক তদবির করলাম, ইউনিভারসিটিতে চেষ্টা করলাম, কোথাও কিছু হলো না। কয়েকজন ধনী লোকের কাছে গেলাম। তারা হাঁকিয়ে দিলো। তখন আমি কপর্দকশূন্য। সেই সময়ই আমি প্রথম ডাকাতি করি। তোমার হয়তো খেয়াল থাকতে পারে, আজ থেকে তিন বৎসর আগে ব্যাঙ্ক থেকে কয়েক হাজার টাকা চুরি গিয়েছিল। কি ভাবে চুরি হলো তা অনেক চেষ্টা করেও পুলিসের Intelligence Branch ধরতে পারেনি। সে টাকা আমিই চুরি করি। তারপর সে টাকা দিয়ে এখানে established হই ভেবেছিলাম ধীরে ধীরে ব্যবসায় উন্নতি করে টাকা পয়সা করে। নিজের গবেষণা চালিয়ে যাবো। কিন্তু তা আর হলো না। অনেক চেষ্টা করেও আমি মহুয়াকে অর্থ সাহায্য করতে পারিনি। বড় একরোখা মেয়ে। এদিকে চিকিৎসার অভাবে বাবার শরীর একেবারে ভেঙে পড়েছে। আমি দেরি করলে হয়তো তিনি আর বাঁচবেন না। তাই আমাকে যতো শিগগির সব টাকা জোগাড় করতে হয়, experiment করবার জন্যে মানুষ খুন করতে হয়।

আজ আমার সামনে একটা খাটের উপর শুয়ে আছেন আমার বাবা। আর কিছুক্ষণ পর তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন। তারপর আমি চলে যাবো অনেক দূরে। কোনদিন বাবার কাছে নিজের পরিচয় দেবো না-তার যে ছেলেকে তিনি ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন একদিন, সে মরে গেছে, কোনও দিন আর ফিরে আসবে না। আমার বুঝি অভিমান নেই?

কিন্তু বলিহারী তোমার বুদ্ধিকে। তোমায় এক ফোঁটাও সন্দেহ করতে পারিনি আমি। অথচ তুমি দিনের পর দিন আমার কার্যকলাপ লক্ষ্য করেছো। এখন মনে পড়ছে, আমি নিঃসন্দেহে তোমাকে কতকগুলো ঠিকানা লিখে দিয়েছি। উহ, কি বোকা আমি। আমি প্রত্যেকদিন টেলিগ্রাম পেয়েছি আমার লোক মারফত গোয়ালন্দ থেকে, they are here.

আমার সময় শেষ হয়ে এসেছে। যে কদিন তুমি আমাকে তোমার বন্ধুত্ব উপহার দিয়েছিলে তার জন্যে তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ। তোমায় বন্ধু বলে স্বীকার করেছি বলেই অনাথ চক্রবর্তী আমার হাত থেকে রেহাই পেয়েছে। আমি বন্ধুত্বের মর্যাদা রেখেছি। তুমিন না হয়ে যদি আর কেউ হতো, তার কাছে অনেক টাকা পয়সা নিয়ে নায়েব এসেছে জানতে পারলে আমি সে টাকা ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করতে কসুর করতাম না। আমি তোমায় চিরকাল বন্ধু বলেই জানবো। আমার পেছনে অনেক ঘুরেও শেষ পর্যন্ত আমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না তুমি।

বিদায় বন্ধু! আর হয়তো তোমার সাথে দেখা হবে না কোনও দিন। আমার বাজনাও আর শুনতে পাবে না তুমি। আমার ছন্নছাড়া জীবনে একজনই পেয়েছিলাম, তাকেও বাধ্য হয়ে হারাতে হচ্ছে আজ।

ফোঁস করে একটা দীর্ষনিঃশ্বাস ফেললো শহীদ। দারোগা সাহেব এসে ঢুকলেন ঘরে। বললেন, ব্যাটাকে হাতড়া পরিয়ে দুজন পুলিশ দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম হাজতে। এখন ঘোড়াগাড়ির জন্যে লোক পাঠিয়েছি। গাড়ি এলে হেকমত সাহেবকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে তবে আমার ছুটি।

আমরাও যাবে। আপনার সাথে। পথে একজন ভালো ডাক্তারকে তুলে নিয়ে যেতে হবে।
 
১৪.

হেকমত আলীর বাসা। রাত প্রায় এগারোটা। হেকমত আলীকে কিছুক্ষণ হলো নিয়ে এসেছে শহীদরা। তার ঘরে ডাক্তার বসে রয়েছেন। কামাল, শহীদ, আর দারোগা সাহেব বৈঠকখানায় বসে আছে। ঘরটায় আসবাবপত্র একেবারেই নেই। শুধু একটা কাঠের খটখটে চারকোণা টেবিল আর তার চারধারে কতগুলো চেয়ার।

আপনি চললেন, দারোগা সাহেব? শহীদ জিজ্ঞেস করলো।

না। ডাক্তার যখন বলছে অবস্থা খারাপ, তখন দেখেই যাই কি হয়। সারাদিন ধকল গেছে- আর একটু না হয় সহ্য করি।

মহুয়া এসে দাঁড়ালো। সে একবার বাবার পাশে যাচ্ছে। আবার বৈঠকখানায় এসে দাঁড়াচ্ছে। সে বললো, আপনারা কেউ এখন যাবেন না কিন্তু, পানি চড়িয়ে দিয়েছি, চা খেয়ে তারপর যাবেন।

তুমি এতো রাতে আবার কষ্ট করতে হলে কেন মহুয়া। শহীদ বলে।

আপনারা কতো বিপদ মাথায় নিয়ে, কতো কষ্ট করে বাবাকে উদ্ধার করে আনলেন, আর আমাকে সামান্য চা করবার কষ্টও সহ্য করতে দেবেন না? মিষ্টি গলায় বলে মহুয়া।

এমন সময় একজন বেঁটে, গাঁট্টা-গোট্টা লোক এসে ঢুকলো ঘরে। পরনে কালো স্যুট, মাথায় ফেস্ট হ্যাট, হাতে একটা বর্মা চুরুট। ঘরে ঢুকেই সে বললো, আমার জন্যেও এক কাপ, মিস মহুয়া।

সবাই তার দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকালো। সে হঠাৎ মাথার টুপি খুলে মাথাটা সামনে বুকালো। মুহুর্তে শহীদ, কামাল আর মহুয়া তাকে চিনতে পারলো। তার মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। কালকের সেই লোকটা।

বসুন, মি. জাকারিয়া। শহীদ সহাস্যে বলে। জাকারিয়াও একটু হেসে একটা চেয়ারে বসে পড়লো

আমি আপনাদের খোঁজে হোটেলে গিয়েছিলাম। আপনার চাকর বললো আপনারা এ বাড়িতে। তাই সটান চলে এলাম। আমার কতকগুলো প্রশ্ন আছে, সেগুলোর উত্তর আপনার কাছ থেকে জেনে না নিলে কিছুতেই শান্তি হচ্ছে না।

এমন সময় পাশের ঘর থেকে চিৎকার শোনা গেল, মেরে ফেলে, পায়ে পড়ি, আমায় মেরে ফেলো।…

চমকে উঠে জাকারিয়া জিজ্ঞেস করে, কে, কে চিৎকার করে?

দারোগা সাহেব তার কানে কানে বললো, হেকমত আলী পাগল হয়ে গেছেন, বোধহয় বাঁচবেন না।

কেন? হঠাৎ? কি ব্যাপার?

দারোগা সাহেব সংক্ষেপে বললো ওকে সেদিনকার সব ঘটনা। শহীদ সব শেষে বললো হেকমত আলীর পাগল হওয়ার কথা।

So sad চুরুটে টান দেয় জাকারিয়া। তাহলে আসল culprit পালিয়েছে। আপনিও পেলেন না শহীদ সাহেব, আমিও পেলাম না, মুচকে হাসে সে।

আচ্ছা, মিঃ জাকারিয়া, আপনি কেন মিছিমিছি আমার পেছনে লেগেছিলেন বলুন তো?

আমি রাজবাড়ীর সরকারী গোয়েন্দা। এই কেসটার investigation আমিই করছিলাম।

বাঁধা দিয়ে শহীদ বললো, সে সব জানি। আপনি বলুন পৃথিবীতে এতো মন্দ লোক থাকতে আমাকে আপনার সন্দেহ হলো কেন?

চুরুটে সুদীর্ঘ একটা টান দিয়ে জাকারিয়া বললোগোয়ালন্দ থেকে একটা বাচ্চার লাশ এলো রাজবাড়ীতে। কিন্তু পাহারাদার পুলিসের একজন চুপিচুপি একটা বাক্স স্টেশন মাস্টারের ঘরে রেখে এলো তা আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। তারপর দেখলাম, হাসপাতালের ডাক্তারের সাথে সে পুলিসের কি গল্প। একবার লাশটা ওজন করে, একবার পাথরটা ওজন করে! খুব সন্দেহ হলো আমার। পরে যখন পুলিসটা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে স্টেশনের দিকে হাটা শুরু করলো তখন আমি ডাক্তারের কাছে গিয়ে পুলিসটার পরিচয় জানবার দাবি করলাম। তিনি সোজা আমাকে খেদিয়ে দিলেন। বললেন যে তিনি চেনেন না পুলিসটাকে, তার সাথে একটা কথাও বলেননি তিনি। আমি বেশি বাড়াবাড়ি করলে পুলিসে ফোন করবেন।

অগত্যা আমি স্টেশনে গেলাম। দেখি বাক্সটা নিয়ে আপার ক্লাস ওয়েটিং রুমে ঢুকলো পুলিসটা। কিছুক্ষণ পর দেখি একজন প্রৌঢ় হিন্দু ভদ্রলোক বেরিয়ে এলো ওয়েটিং রুম থেকে। তারপর কুলি ডেকে সেই বাক্সটা গাড়িতে ওঠালো। আমি চট করে ওয়েটিং রুমের ভেতরটা এক চক্কর দেখে এলাম, কোনও পুলিসের পাত্তা নেই। অতএব সন্দেহ দৃঢ়তর হলো। বুঝলাম হয় এই ব্যাটাই খুনী নয় খুনীর নিযুক্ত কর্মচারী। ডাক্তারের সঙ্গে এদের সায় আছে।

বাস পিছন ধরলাম। তারপর কুষ্টিয়ায় এসে সন্দেহ উত্তরোত্তর বেড়েই চললো। প্রমাণের অভাবে ধরতে পারছি না। একদিন হোটেলে হানা দিয়ে পরচুলা, পেইন্ট সব দেখে এলাম। বুঝতে পারছেন না, আমি over sure. এই ব্যাটা খুনী না হয়ে যায় না।

খুব একচোট হাসলো জাকারিয়া। তারপর নিভে যাওয়া চুরুটটা ধরিয়ে নিলো।

মহুয়া চা নিয়ে এলো। চায়ে এক চুমুক দিয়ে কামাল শহীদকে বললো, আমার কিন্তু কতকগুলো ব্যাপারে খটকা আছে। এখন একটু পরিষ্কার করে দে তো ভাই। তুই জানলি কি করে কুষ্টিয়াতেই কুয়াশা রয়েছেঃ রফিক সাহেবকে তোর সন্দেহ হলো কি করে? এই বাড়িতে কাল কুয়াশা আসবে কি করে বুঝলি?

মহুয়া গুনবার জন্যে একটা চেয়ারে বসে পড়লো। শহীদ একটা সিগারেট ধরালো, দারোগা সাহেবের দিকে প্যাকেট বাড়ালো। তিনি খান না। কামাল একটা তুলে নিলো।

রাজবাড়ীতে সত্যিই আমি পাথর ও লাশ ওজন করেছিলাম। ছেলেটির স্বাস্থ্য যে রকম, তাতে তার স্বাভাবিক ওজন কতো ছিলো তা ডাক্তার আন্দাজ করে বলেছিলেন। আমি অঙ্ক কষে বের করলাম পাথরটা নিয়ে ভেসে উঠতে লাশের কতখানি ফুলতে হয়েছিল, অর্থাৎ ছেলেটির ভাসবার ক্ষমতা কতখানি হয়েছিল। নদীর কারেন্ট ঘন্টায় কয় মাইল, ষ্টীমারে জেনে নিয়েছিলাম। খুব সহজেই বেরিয়ে পড়লো গোয়ালন্দের কতখানি উজানে লাশ জলে ফেলা হয়েছিল। একটু অঙ্ক জানলেই তা বের করা যায়। তারপর হাসপাতাল থেকে গোয়ালন্দ স্টীমার ঘাটে ফোন করে জানলাম সেখান থেকে উত্তরে নদীপথে বিশ থেকে ষাট মাইলের মধ্যে কেবল একটাই শহর আছে। সেটা কুষ্টিয়া। অতএব আমি সোজা কুষ্টিয়ার টিকিট কাটলাম।

আমি হাসপাতাল থেকে ক্টেশনে যাবার পথেই ভেবে নিয়েছিলাম। খুনী নিশ্চয়ই নদীর পারে থাকে। তার কারণ সেখান থেকে লাশ নদীতে ভাসানোর সুবিধা। তাছাড়া আমি জানতাম হয় খুনীর একটা লঞ্চ আছে, নয় সে আর কারও লঞ্চ ব্যবহার করে। কারণ মানুষ চুরির তিনদিন পর খবরের কাগজে গোয়ালন্দে লাশ প্রাপ্তির খবর বেরোয়। ঢাকা থেকে রাতের বেলা মানুষ চুরি যায়; রাতে স্টীমার নেই। বেলা দুটোর সময় রওনা হয়ে কুষ্টিয়া পৌঁছে বেলা দশটার দিকে; দিনের বেলা লাশ জলে ফেলা সম্ভব না। রাতের বেলা ফেলতে হয়। তারপর ধরো ছসাত ঘণ্টা মানুষের উপর experiment করা হলো; লাশ গোয়ালন্দে পৌঁছতে একদিন লাগে। খবরের কাগজে খবর ছাপাতে একদিন লাগে, কারণ কাগজে সবসময় একদিন আগের ঘটনা বেরোয়। সেদিনের ঘটনা বেরোয় না। সুতরাং খেয়াল করে দেখো, দিন অনেক বেশি লেগে যাচ্ছে। তাছাড়া ষ্টীমারে আনতে অনেক অসুবিধাও আছে। অতএব সে একটা লঞ্চে করে এসে মানুষ আর টাকা পয়সা চুরি করে সেই রাতেই রওনা হয়ে যায় কুষ্টিয়ার দিকে তা স্পষ্টই বোঝা যায়। লঞ্চে ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া আসতে দশ বারো ঘন্টার বেশি লাগে না।

আমি অনেকটা নিশ্চিন্ত ছিলাম-কুয়াশাকে আমি খুজে বের করতে পারবই। মফঃস্বল টাউনে শতো শতো লঞ্চের মালিক থাকতে পারে না। তাই আমি নদীর পাড়ের আদর্শ হিন্দ হোটেলে হিন্দু সেজে উঠলাম। আমি কেবল চাইছিলাম, আমাকে যেন কুয়াশা খুজে বের করতে না পারে। তাই আমি তোকে নির্দেশ দিয়েছিলাম গফুরকে আমার মতো করে সাজিয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে। আমি জানতাম তোরা একটু সাবধান হলেই কুয়াশার স্পাই বুঝতে পারবে না গফুরের ছদ্মবেশ। কারণ ও লোকটা সত্যিই ছিলো কিছু বোকা; আমি ওকে গোয়ালন্দে যে কোনো মুহুর্তে ধরতে পারতাম। তোরাও খুব সুন্দর অভিনয় করেছিলি। আমি এদিক দিয়ে নিরাপদ রইলাম।

আমাকে কিন্তু বেশি ঘোরাঘুরি করতে হয়নি। রফিকুল ইসলামের সাথে পরিচয় হয়ে গেল বাজনার ব্যাপার নিয়ে। তার একটা লঞ্চ আছে শুনে চমকে উঠলাম। কেমন সন্দেহ হলো।

একদিন নদীর পারে বসে অনেক তত্ত্বালোচনা হচ্ছিলো। আমি হঠাৎ তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, কুয়াশা। তার মুখ কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল। আমার যা দেখবার দেখে নিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে গলায় অত্যন্ত ভাব এনে বললাম, কুয়াশায় আমার চারিটা পাশ ঘন হয়ে আসছে, রকিক সাহেব। আমি যেন মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পাই। যতো বয়স বাড়ছে ততোই আচ্ছন্ন হয়ে আসছি। বড় ভয় করে মাঝে মাঝে।

কুয়াশা ততোক্ষণে সামলে নিয়েছে, কিন্তু সেদিন আর বেশি জমলো না। আমি হোটেলে ফিরে এসে কুয়াশার চিঠি বের করলাম; তারপর আগের দিন রফিক সাহেব আমাকে কতগুলো ঠিকানা লিখে দিয়েছিল একটা নোট বইতে, সেটা বের করলাম। মিলিয়ে দেখলাম সম্পূর্ণ এক। আগে আমি লক্ষ্যই করিনি রকিক সাহেবের লেখা।

তার পরদিন gastric pain-এর অজুহাতে রাতে আর তার বাসায় যাবো না বলে দিলাম। রফিক সাহেব একমনে সরোদ বাজাচ্ছে, তখন আমি চুপি চুপি তার বাসায় ঢুকলাম। আমি বাড়ির সবকিছুই চিনতাম। সোজা দোতলায় উঠে যে অংশট বন্ধ ছিলো তার তালায় একগোছা চাবি try করা শুরু করলাম। একটা চাবি লেগে গেল ভাগ্যক্রমে। আমার কোনও সন্দেহ নেই তখন, রফিকুল ইসলামই কুয়াশা। কিন্তু প্রমাণ কই? কোনও প্রমাণ ছিলো না আমার হাতে। যে সব যন্ত্রপাতি সেই ঘরে ছিলো তাতে কিছুই প্রমাণ করা যার না। একটা দেরাজের মধ্যে অনেকগুলো টেলিগ্রাম পেলাম। সবগুলোতে লেখা THEY ARE HERE. সব কটা গোয়ালন্দ থেকে করা। দেরাজের মধ্যে ডায়রী পেলাম একটা। হাতে যেন স্বর্গ পেলাম। তার থেকেই জানতে পারি কুয়াশার পরবর্তী শিকার কে।

আর দিনক্ষণ বুঝতে পারি গতকাল। সন্ধ্যায় টেলিগ্রামটা কিছুক্ষণের জন্যে ফেলে গেছিলো রফিকুল ইসলাম আমার ঘরে টেবিলের উপর। আমি চুরি করে সেটা পড়লাম। তাতে লেখা THEY ARE LOST.

আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। কুয়াশার লোক গফুর আর তোর ওপর কড়া নজর রেখেছিল। সে গফুরের ছদ্মবেশ ধরতে না পেরে, মনে করেছিল আমি আর তুই গোয়ালন্দে আছি। বেচারার চোখকে ফাকি দিয়ে যখন তোরা চলে এলি তখন সে মনিবের কাছে টেলিগ্রাম করলো THEY ARE LOST.

আমি বুঝলাম, নিশ্চয় কুয়াশা চিন্তায় পড়ে গেছে। সে শহীদ খানকে ভয় করতো দস্তুর মতো। সে যতো তাড়াতাড়ি কাজ সারা যায় তারই চেষ্টা করবে। আর তাই হয়েছিল দেখতে পেয়েছিস।

শহীদ থামলো। দীর্ঘক্ষণ একটানা কথা বলে সে হাঁপিয়ে গেছে।

কামাল শহীদের দিকে ফিরে বললো, কিন্তু আজ আমরা যখন কুয়াশাকে নিরস্ত্র অবস্থায় পেলাম, তখন আমাদের হাত তুলে দাঁড়াতে বললো কে?

ও নিজেই বলেছিল।

কিন্তু শব্দটা তো আমাদের পেছন থেকে এলো?

শহীদ হেসে বললো, ওটা ventriloquism. আমিও প্ৰথম বুঝতে পারিনি, আমরা ওর ventriloquism-এর মায়াজালে পড়লাম বলেই তো ও পালাতে পারলো অমন ধোঁকা দিয়ে। ventriloquism যে জানে সে ইচ্ছা করলে কাছ থেকেও এমন করে কথা বলতে পারে, মনে হবে যেন বহুদূর থেকে কেউ বলছে। আবার দুর থেকে বললে মনে হবে একদম কানের পাশ থেকে বলছে।

বড় অদ্ভুত জিনিস তো।

জাকারিয়া চলে গেল বিদায় নিয়ে। রাত দুটো বেজে গেছে।

জানেন শহীদ ভাই, আমার একজন বড় ভাই ছিলেন, মহুয়া বললো।

তাই নাকি? কোথায় তিনি?

আমি তার কথা আর কোনদিন শুনিনি। বাব৷ কখনও বলেননি। বোধকরি তার ওপর বাবার খুব রাগ ছিলো। আপনি যেদিন আমাদের বাসায় প্রথম এলেন কি কি সব ভৌতিক খবর নিয়ে সেদিন বাবা প্রথম বলেন তার কথা। আপনার চেহারার কোথায় বলে তার সাথে খুব মিল আছে। তিনি যদি এখনও বেঁচে থাকেন তাহলে নাকি আপনারই মতো লম্বা চওড়া হয়েছেন।

তার সাথে আমার চেহারার কি মিল আছে জানি না। কিন্তু মনের মিল খুবই আছে।

আপনি চেনেন আমার দাদাকে?

হা চিনি। তার নাম মনসুর আলী ওরকে রফিকুল ইসলাম, ওরফে কুয়াশা।

বিস্মিত মহুয়ার মুখ থেকে কেবল বেরোলো, কী বললেন? কুয়াশা! অবাক চোখে চেয়ে রইলো সে শহীদের মুখের পানে।

শহীদ কুয়াশার চিঠিটা মহয়ার হাতে তুলে দিলো।

চিঠিটা পড়ে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো মহুয়ার চোখ থেকে।

দাদা বললেই পারতো! পরিচয় দিলেই পারতো! মহুয়ার চোখের জল আর বাঁধা মানে না। বড় সুন্দর লাগছে ওকে। শহীদ চেয়ে দেখে। এতো শক্ত মেয়েটার চোখে জল। কেমন যেন লাগে। কামাল কারও চোখের জল সহ্য করতে পারে না। তারও চোখে জল টলমল করতে লাগলো। দারোগা সাহেব খুটির মতো বসে আছেন শক্ত হয়ে। তার কোনও পরিবর্তন নেই।

হঠাৎ একজন লোক বাইরে থেকে ছুটে এসে দারোগা সাহেবের পায়ে পড়লো। সবাই চমকে তার দিকে ফিরে তাকলো। একজন পুলিশ। মাথায় তার ব্যান্ডেজ বাঁধা।

হাজুর। ডাকু ভাগ গিয়া। ঠান্ডা মিয়া খুন হো গিয়া। হাসপিটাল মে হ্যায়। মেরা ইয়ে৷ হালাত। নৌকরী তো নেহী যায়গী হাজুর! আপ বাঁচাইয়ে হাজর!

তার কাছ থেকে যে বিবরণ পাওয়া গেল তা সংক্ষেপে হচ্ছে- সে আর ঠান্ডা মিয়া হাতকড়া পরানো লোকটাকে নিয়ে নদীর পার ধরে থানার দিকে যাচ্ছিলো। হঠাৎ একজন কালো কাপড় পরা ভীষণাকৃতি মানুষ পিছন থেকে ঠান্ডা মিয়ার মাথায় ডান্ডা মারে। ঠান্ডা মিয়া মাটিতে পড়ে যায়। তখন সে রুখে দাঁড়ায়। কিন্তু সে লোক তাকেও প্রহার করে। শেষ পর্যন্ত সে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তখন একটা নৌকায় বন্দী লোকটাকে উঠিয়ে নিয়ে সেই দেও চলে যায়। সে আরও লোকের সাহায্যে ঠান্ডা মিয়াকে হসপিটালে নিয়ে যায়। ঠান্ডা মিয়া সেখানেই মারা যায়। অনেক খুঁজে সে এখানে এসেছে সব খবর বড় সাবকে জানাতে।

কামাল বললো, উঃ! কী ferocious!

পাশের ঘর থেকে আওয়াজ এলো, মেরে ফেলো!…

গলাটা অনেক ক্ষীণ হয়ে এসেছে। মহুয়া ছুটে গেল সে ঘরে।

ডাক্তার বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। শহীদ, কামাল তার দিকে এগিয়ে গেল। তিনি গম্ভীর ভাবে বললেন, Dead।

দারোগা সাহেব চলে গেল ডাক্তারের সাথে। মৃতদেহ আগলে বসে রইলো শহীদ, কামাল আর মহুয়া।

অঝোরে কাঁদছে মহুয়া। আপন বলতে আমার আর কেউ রইলো না, শহীদ ভাই। শহীদ কোনও ভাষা পায় না সান্ত্বনা দেবার। ধীরে ধীরে মহুয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top