০১.
প্ৰচন্ড শীত। মাঘের প্রথম। রাত দেড়টা। সেগুনবাগান।
সমস্ত এলাকাটা ঘুমে অচেতন। জন প্রাণীর সাড়াশব্দ নেই। কেবল টহলদার নাইট গার্ড টহল দিয়ে ফিরছে। মাঝে মাঝে হুইল বাজাচ্ছে, সাথে সাথেই দূর থেকে ক্ষীণ প্রত্যুত্তর আসছে ভেসে।
খট খট খট। টহলদারের লাঠির শব্দে রাত্রি আরও নিঝুম হয়ে আসে। রাস্তার পাশে সারি সারি লাইটপোস্টের আলোর চারধারে অনেকগুলো পোকা অনবরত ঘোরে।
এমনি সময় দেখা গেল একখানি কালো শেভ্রোলে গাড়ি সামনের বহুদূর পর্যন্ত আলোকিত করে দ্রুত এগিয়ে আসছে। গাড়িটা কাছে এলে নাম্বার প্লেটের দিকে নজর যেতেই টহলদারের শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল। সশব্দে জুতো ঠুকে স্যালুট করলো সে। সিটি এস. পি.-র গাড়ি। ভিতরটা অন্ধকার। কেউ মাথা নাড়লো কিনা বোঝা গেল না। গাড়ি সমান গতিতে এগিয়ে গোল সামনে।
গাড়িটা এসে থামলো একটা একতলা বাড়ির সামনে। এদিকটা অন্ধকার। মৃদু গর্জন করে এঞ্জিনটা বন্ধ হয়ে গেল। একজন ওভারকোট পরা লোক নামলো গাড়ি থেকে। নিঃশব্দে আগন্তুক এগিয়ে গেল বাড়িটার দিকে। হাতে তার ছোটো একটা বাক্স।
লোকালয় থেকে কিছু দূরে বাড়িটা। অনেকদিনের পুরোনো বাড়ি, কিন্তু এখনও বেশ মজবুত আছে। বাড়ির সামনে খানিকটা বাগান। এলোমেলো করে অনেক ফুলগাছ লাগানো। মাঝে মাঝে পেয়ারা, জামরুল আর আম-কাঠালের গাছ। সবটা মিলে জঙ্গল বলে বোধ হয়। তারকাটা দিয়ে ঘেরা বাগানটা। ছোট একটা লোহার গেট আছে বাড়িতে ঢুকবার জন্যে।
কোনও শব্দ না করে গেট খুললো লোকটা। একবার চারদিকে চাইলো, তারপর ঢুকে পড়লো বাগানের ভিতর। সোজা এগিয়ে গেল সে বাড়িটার দিকে। সব কটা দরজাই বন্ধ ভিতর থেকে। কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবলো আগন্তুক, তারপর একটা জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। মোটা শিক দেয়া জানালা। বেডরুম। সমস্ত ঘরটার মধ্যে কেবল এই জানালাই খোলা। হাতের বাক্স খুলে ফেললো লোকটা। ওটা কিসের যেন একটা যন্ত্র। ক্যামেরার মতো দেখতে। খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করে রেগুলেট করে নিয়ে যন্ত্রটার মুখ শিকের নিচের দিকে ধরে একটা বোতাম টিপতেই মুহুর্তে আশ্চর্যজনক ভাবে গলে তেল লোহার গরাদ। এইভাবে সব কটা গরাদই গলিয়ে ফেললো আগন্তুক। তারপর অবলীলাক্রমে একটা একটা করে সব শিক বাঁকিয়ে উপর দিকে তুলে দিলো।
এবার নিঃশব্দে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়লো লোকটা। দুজন মানুষ ঘুমিয়ে আছে মস্ত একটা খাটের উপর লেপ মুড়ি দিয়ে। স্বামী-স্ত্রী বলেই মনে হয়। খাটের তলে একটা হ্যারিকেন রাখা, আলো খুব কমানো। খাটের কাছে একটা দামী আয়রন সেফ। চাবি ঢোকাবার জায়গায় বোতাম টিপে যন্ত্রটা ধরতেই নাম করা কোম্পানীর আয়রন সেফ আলগা হয়ে গেল। কয়েক তোড়া নোট এবং গোটাকতক গিনি পকেটে পুরলো আগন্তুক। আরেকটা দেরাজে কয়েকটা দামী গহনা। হীরে সেট করা বহুমূল্য নেকলেসটা পকেটে ফেললো সে।
এবারে বারান্দার দিকের দরজা খুলে দিলো লোকটা। তারপর যন্ত্রটা খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করে নিয়ে থাটের পাশে এসে দাঁড়ালো। পুরুষ লোকটার গায়ের উপর থেকে লেপ খানিকটা সরিয়ে দিয়ে তার বুকের কাছে যন্ত্রটা নিয়ে বোতাম টিপে দিলো। ঘুমন্ত লোকটা আচমকা চোখ খুলে তাকালো। তারপর খোলা অবস্থাতেই স্থির হয়ে গেল।
নির্বিকারভাবে যন্ত্রটা বাক্সে পুরলো লোকটা। সন্তৰ্পণে মৃত ব্যক্তির শরীরের উপর থেকে সবটা লেপ সরিয়ে দিলো। তারপর পাঁজাকোলা করে ভারি মৃতদেহটা অনায়াসে তুলে নিলো বিছানা থেকে। খাটটা খচ মচ আওয়াজ করে উঠলো। স্ত্রী লোকটি পাশ। ফিরে লেপটা আরও টেনে নিয়ে শুলো। আততায়ী একটু চমকে উঠেছিল। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। গেটের কাছে এসে একবার তীর দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো, তারপর লাশটা পিছনের সিটে শুইয়ে দিয়ে স্টার্ট দিলো।
সেগুন বাগানের লম্বা রাস্তাটা দিয়ে কালো গাড়িটা জন্ত বেগে বেরিয়ে গেল। কেউ জানলো না এর মধ্যে কী কান্ড হয়ে গেল। ভোর পাঁচটা অবধি তেমনি হইসল বেজে চললো। পোকাগুলো লাইটপোস্টের চারধারে অনবরত ঘুরতেই থাকলো।
২.
প্ৰাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খানের ছোট্ট একতলা বাড়ির ড্রইংরুম। দামী পুরু কার্পেট বিছানো মেঝেতে। সোফা সেটটি অত্যন্ত রুচিসম্মত ভাবে সাজানো। দরজা দিয়ে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়ে দেয়ালে টাঙানো রবীন্দ্রনাথের বড় অয়েল পেইন্টিংটা। এক নজরে বোঝা যায় বাড়ির কর্তাটি অগাধ সম্পত্তির মালিক।
সকালবেলা স্নান সেরে একটা দামী কাশ্মীরী শাল গায়ে জড়িয়ে ড্রইংরুমে এসে বসেছে শহীদ। খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছে আর বার বার বাইরের দিকে তাকাচ্ছে। আজ ভোরে কামালের আসবার কথা। দু বন্ধু শিকারে যাবে সাত-গম্বুজের কাছে মাছরাঙা বিলে। আজকাল নাকি বেশ পাখি পড়ছে এ বিলে।
শহীদ ফিজিক্সে ফাস্টক্লাস পেয়ে পাস করেছে গেল বছর। কামাল এবার ইকনমিক্সে পাস করলো।
শহীদ কামাল দুজনেই অল্পবয়সে বাবাকে হারায়। ওদের বাবা দু জন ছিলেন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুজনেই ছিলেন অসীম সাহসী। তাঁরা আফ্রিকায় গিয়েছিলেন লিম্পোপো নদীর কুমীর শিকার করতে। সেখানেই দু জনের মৃত্যু হয়। বিস্তারিত ভাবে কিছুই জানা যায়নি, কেবল মৃত্যু সংবাদ এসে পৌঁছেছে ঢাকায়। সেদিন বাড়িতে যে কী কান্নার রোল উঠেছিল এখনও অস্পষ্ট ভাবে মনে পড়ে শহীদের। আজ পাঁচ বছর হয় মা-ও মারা গেছেন তার।
গফুর এসে দাড়ালো। ভারী পর্দা সরিয়ে জিজ্ঞেস করলো, দাদামণি চা এনে দেবো?
না। কামাল আসুক। আমরা একসাথেই নাস্তা করবো। প্রয়োজন হলে বাজার থেকে কিছু আনিয়ে নিস।
কিছু না বলে চলে গেল গফুর। ভাবটা যেন, সে কথা তুমি আমাকে শিখিয়ে দেবে? আমার আক্কেল নেই? মাসের প্রথম এক থোক টাকা গকুরের হাতে দিয়ে শহীদ নিশ্চিন্ত থাকে। আপাততঃ এই গার্জেনের উপর নিজের ভার ছেড়ে দিয়েছে সে। মা মারা যাওয়ার এক বছর আগে গফুর এসে ঢুকেছে এই বাড়িতে। এরই মধ্যে সে সমস্ত সংসারের তার নিজের মাথায় তুলে নিয়েছে। সংসার অরণ্য খুবই ছোটো, শহীদ আর তার ছোটো বোন লীনা। স্কুল ফাঁকি দিতে চাইলে বকাঝকা দিয়ে স্কুলে পাঠানো, কাঁচা কুল খেলে তম্বি করা; এসব কাজ শহীদ পারে না, গফুরকেই করতে হয়। যেমন প্রকান্ড তার শরীরের কাঠামো, তেমনি সরল এবং বিশ্বস্ত লোক এই গফুর।
অপরাধ বিজ্ঞানে শহীদের অসীম আগ্রহ। মাথা খুব পরিস্কার এবং অ্যাডভেঞ্চারের পাগল সে। তাই স্বভাবতই সে গোয়েন্দাগিরির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এরই মধ্যে কয়েকটা কেসে সে অদ্ভূত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। ওর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে বহুদূর পর্যন্ত। ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ ওকে হিংসে করতে আরম্ভ করেছে।
ইদানীং কামালও গোয়েন্দাগিরির দিকে ধীরে ধীরে ঝুকছে। আগে সে শহীদকে বকতো–তোর মাথায় কি টুকেছে রে? এসব ছাড়। গোয়েন্দাগিরি ভদ্রলোকের কাজ? কিন্তু এখন প্রায়ই সে শহীদকে এটা ওটা সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। নেশাটা ওকেও ধরেছে। ও এখন লুকিয়ে লুকিয়ে ক্রিমিনলজির বই পড়ে। কামাল কিছু দুর্বল প্রকৃতির লোক। শহীদের মতো অমন পেটা শরীরও তার নেই, অমন অসুরের মতো শক্তিও নেই। মাঝারি গোছের সুন্দর চেহারা। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। টানাটানা দুই চোখ।
ঠিক সাতটা বাজতে পাঁচ মিনিটে কামাল এসে ঢুকলো। হাতে একটা দোনলা বন্দুক। ওকে দেখেই শহীদ ফোস করে উঠলো, কিরে, এই তোর পাঁচটা?
কামাল কি যেন একটা জবাব দিতে যাচ্ছিলো। এমন সময় গফুর নাস্তা নিয়ে ঘরো ঢুকলো। টোস্ট, ডিম-পোচ এবং মোটা মোটা গোটা কয়েক অমৃতসাগর কলা।
শহীদ একটা কলার প্রায় অর্ধেকটা মুখের মধ্যে পুরে দিয়েছে, এমন সময় ক্রিং ক্রিং করে ফোন বেজে উঠলো। ফোনের দিকে আঙুল দিয়ে কামালকে ইশারা করতে কামাল ওর দুরবস্থা দেখে একটু হেসে ফোনের দিকে গেল।
হ্যালো..ইয়েস!..শহীদকে চাই ধরুন ডেকে দিচ্ছি।
শহীদ মুখের কলা শেষ করে ফোন ধরলো।
হ্যালো! কে?… হারুন?… কি বললে? পুলিসে খবর দিয়েছো?… দাওনি?… আমি বিশ মিনিটের মধ্যে আসছি, এর মধ্যে পুলিসে ফোন করো।
রিসিভার নামিয়ে রাখলো শহীদ। মুখটা চিন্তিত। কামালকে বললো, তুই বোস আমি কাপড় পরে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি। আজ আর শিকারে যাওয়া হবে না। হারুনের চাচাকে পাওয়া যাচ্ছে না, টাকা পয়সাও চুরি গেছে কাল রাতে। আমরা সেখানেই যাবো।
কিছুক্ষণ পর শহীদ বেরিয়ে এলে৷ ট্রপিক্যালের একটা দামী স্যুট পরে। চা ঠান্ডা হয়ে এসেছে, দুই ঢোকে শেষ করলো চা-টুকু। ইতিমধ্যে প্লেটের যাবতীয় সবকিছু কামাল আত্মসাৎ করে ফেলেছে।
শহীদের ছোট্ট মরিস মাইনর মাযহারুল হক সাহেবের বাসার সামনে এসে দাঁড়ালো। ঢাকার বিখ্যাত ধনী মাযহারুল হক। একটা জুয়েলারীর দোকান আছে নামপুরে, এছাড়া তিনটে বড় বড় হোটেলের মালিক। যুদ্ধের সময় কনটাক্টরী করে প্রচুর ধনসম্পত্তি করেছিলেন। ছেলেপুলে হয়নি। মৃত বড় ভাইয়ের একমাত্র পুত্র হারুনকে তিনি পিতৃস্নেহে মানুষ করেছেন। শহীদের সাধেই পদার্থবিজ্ঞানে ফাস্টক্লাস সেকেন্ড হয়ে পাস করেছে হারুন। রিসার্চ স্কলারশিপ পেয়ে সে এখন পি. এইচ. ডি.-র জন্যে রিসার্চ করছে।
গাড়ি থামতেই হারুন ছুটে এলো। তার সদা হাসিখুশি মুখ শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। শহীদ কোনও রকম সম্ভাষণ না করেই বললো, যে ঘরে চুরি হয়েছে, সে ঘরে আমাদের নিয়ে চলো। পুলিস এখনও আসেনি নিশ্চয়ই? তার আগেই আমি একবার ঘরটা পরীক্ষা করে দেখতে চাই।
বাগানের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে হারুন বললো, আমি একেবারে ভড়কে গেছি শহীদ। আইন-কানুন তো আমি কিছু বুঝি না, আমার ভয় হচ্ছে পুলিস আমাকে না সন্দেহ করে। আমিই তো কাকার বিপুল সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী। তাই তোমাকে আগেই ডেকে পাঠিয়েছি। তোমার উপরই আমি নির্ভর করছি পুরোপুরি। তুমি পারবে না ভাই আমাকে বাঁচাতে?
কেমন যেন জড়ানো জড়ানো গলায় সে কথাগুলো বললো। শেষটায় সে শহীদের দুই হাত ধরে ফেললো। বিস্মিত হয়ে শহীদ লক্ষ্য করলো কি ভয়ঙ্কর ভয় পেয়েছে হারুন। তাকে সান্তনা দেবার জন্যে বললো, তুমি এতো অস্থির হয়ো না, হারুন। চোর ধরা পড়বেই। তোমার ভয়ের কোনো কারণ নেই।
হারুন তাদের নিয়ে গেল একটা ঘরে। ঘরটার আসবাবপত্র খুবই কম, বেশ ছিমছাম। গরাদ বাকানো জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো শহীদ। ভালো করে লক্ষ্য করলো চৌকাঠের উপর কয়েক ফোটা গলা লোহা। কি করে এই লোহা গলানো সম্ভব তা কিছুতেই তার মাথায় এলো না। আয়রণ সেফটার কাছে এসে দাঁড়ালো, সেখানেও পরীক্ষা করলো কি ভাবে ষ্টীল গলে গিয়েছে। তার কপালে ভাজ পড়লো কয়েকটা। হারুনকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার কাকার সাথে এ ঘরে আর কে কে থাকেন?
চাচী আম্মা থাকেন।
ওকে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।
হারুন বাড়ির ভিতর চলে গেল। একটু পরেই তার সাথে এলেন এক প্রৌঢ়া মহিলা। শহীদ, কামাল দুজনেই তাকে আদাব দিলো। তিনিও আদাব জানিয়ে বললেন, বসো বাবারা। বলে নিজেই খাটের উপর বসে পড়লেন।
শহীদ জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা চাচী আম্মা, কাল আপনি কোনও কিছুর শব্দ শুনতে পাননি রাতের বেলা?
না বাবা। আমি হাঁপানিতে কষ্ট পাই, রাতে ঘুম হয় না। তাই আজ মাসখানেক ধরে ঘুমের ওষুধ খেয়ে বিছানায় শুই। ভোর ছটা৷ -সাড়ে ছটার আগে আর আমার ঘুম ভাঙে না।
এতগুলো কথা বলে তিনি হাঁপাতে লাগলেন। শহীদ বললো, আচ্ছা আয়রণ সেফে কি কি ছিলো বলতে পারবেন?
উনি কাল দুপুরে পঞ্চাশ হাজার নগদ টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে এনেছিলেন, সেই টাকা ছিলো, কিছু গহনা ছিলো, আর গিনি ছিলো কয়েকটা। সুন্দর সাজিয়ে কথাগুলো বলেন ভদ্রমহিলা।
সবই চুরি হয়ে গেছে?
গহনা বেশির ভাগই রয়েছে। একটা হীরে বসানো হার শুধু গেছে গহনা থেকে আর টাকা, গিনি সবই গেছে।
হীরে বসানো হারটার দাম কতো হবে?
পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে উনি ওটা তৈরি করেছিলেন হারুনের বউকে দেবার জন্যে। হারুনের বিয়ের কথাবার্তা চলছে কিনা।
কাকা যখন বিছানা থেকে উঠে যান, আপনি টের পাননি?
না বাবা।
আচ্ছা, চাচী আম্মা, আমরা এবার আসি।
শহীদ কামালের হাত ধরে এগিয়ে গেল। হারুন পিছন পিছন চললো। জিজ্ঞেস করলো, কিছু বুঝতে পারলে, শহীদ?
কিছুমাত্র না। তুমি কাউকে সন্দেহ করো এ ব্যাপারে?
আমি কিছু বুঝতে পারছি না। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ভৌতিক বলে বোধ হচ্ছে আমার কাছে। তাছাড়া আমি রিসার্চ নিয়ে থাকি, কাকার বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিত কারো সঙ্গে আমার বিশেষ চেনাশোনাও নেই। কাকে সন্দেহ করবো?
গাড়ির কাছে এসে হারুনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো শহীদ।
গুডবাই। রমনা থানাটা ঘুরে যাই একটু।
হারুন মিনতি ভরা কণ্ঠে বললো, দেখো ভাই, একটা কিছু সুরাহা তোমার করতেই হবে। তোমার যা খরচ পড়ে আমাকে বিল দিয়ো তক্ষুণি শোধ করে দেবো।
তুমি জানো আমি শখের গোয়েন্দা। যদি কিছু করি, কারো অনুরোধের অপেক্ষা রাখবো না। তাছাড়া টাকার প্রয়োজনও আমার পড়বে না।
এঞ্জিন স্টার্ট দিলো শহীদ। হারুন কি বলতে যাচ্ছিলো গাড়ি চলতে শুরু করায় থেমে গেল।
অনেক খোঁজ করে টহলদার নাইটগার্ডকে বের করে শহীদ জানতে পারলো যে রাত প্রায় দেড়টা-দুটোর সময় সিটি এস. পি.-র গাড়ি গিয়েছিল সেগুন বাগানে। আধঘন্টা পরেই আবার সে গাড়ি ফিরে যায়। ও জিজ্ঞেস করলো, এস. পি. সাহেবের গাড়ি চিনলে কি করে।
হুজুর, চিবারলেট গাড়ি আছিলো, পন্দ্রসও বাইশ নম্বর আছিলো।
আর কোনও গাড়ি যায়নি বেশি রাতে ওদিকে?
না, হুজুর।
কামাল বললো, পথে যাতে বাধা না পায় তার জন্যে শেভ্রোলে গাড়িতে প্রয়োজন মতো নম্বর লাগিয়ে নিতে পারে চোর বা চোরেরা।
হ্যাঁ, তা পারে। গম্ভীরভাবে উত্তর দিলো শহীদ। গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়েছে সে।
পরদিন কাগজে খবর বেরোলো, বিখ্যাত ব্যবসায়ী জনাব মাযহারুল হক নিখোঁজ। এরপর সবিস্তারে চুরির কথা লেখা হয়েছে। সব শেষে লিখেছে, বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গিয়াছে যে তীক্ষ্মধী শখের গোয়েন্দা মি. শহীদ খান এই ব্যাপারে তদন্ত করিতেছেন।
প্ৰচন্ড শীত। মাঘের প্রথম। রাত দেড়টা। সেগুনবাগান।
সমস্ত এলাকাটা ঘুমে অচেতন। জন প্রাণীর সাড়াশব্দ নেই। কেবল টহলদার নাইট গার্ড টহল দিয়ে ফিরছে। মাঝে মাঝে হুইল বাজাচ্ছে, সাথে সাথেই দূর থেকে ক্ষীণ প্রত্যুত্তর আসছে ভেসে।
খট খট খট। টহলদারের লাঠির শব্দে রাত্রি আরও নিঝুম হয়ে আসে। রাস্তার পাশে সারি সারি লাইটপোস্টের আলোর চারধারে অনেকগুলো পোকা অনবরত ঘোরে।
এমনি সময় দেখা গেল একখানি কালো শেভ্রোলে গাড়ি সামনের বহুদূর পর্যন্ত আলোকিত করে দ্রুত এগিয়ে আসছে। গাড়িটা কাছে এলে নাম্বার প্লেটের দিকে নজর যেতেই টহলদারের শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল। সশব্দে জুতো ঠুকে স্যালুট করলো সে। সিটি এস. পি.-র গাড়ি। ভিতরটা অন্ধকার। কেউ মাথা নাড়লো কিনা বোঝা গেল না। গাড়ি সমান গতিতে এগিয়ে গোল সামনে।
গাড়িটা এসে থামলো একটা একতলা বাড়ির সামনে। এদিকটা অন্ধকার। মৃদু গর্জন করে এঞ্জিনটা বন্ধ হয়ে গেল। একজন ওভারকোট পরা লোক নামলো গাড়ি থেকে। নিঃশব্দে আগন্তুক এগিয়ে গেল বাড়িটার দিকে। হাতে তার ছোটো একটা বাক্স।
লোকালয় থেকে কিছু দূরে বাড়িটা। অনেকদিনের পুরোনো বাড়ি, কিন্তু এখনও বেশ মজবুত আছে। বাড়ির সামনে খানিকটা বাগান। এলোমেলো করে অনেক ফুলগাছ লাগানো। মাঝে মাঝে পেয়ারা, জামরুল আর আম-কাঠালের গাছ। সবটা মিলে জঙ্গল বলে বোধ হয়। তারকাটা দিয়ে ঘেরা বাগানটা। ছোট একটা লোহার গেট আছে বাড়িতে ঢুকবার জন্যে।
কোনও শব্দ না করে গেট খুললো লোকটা। একবার চারদিকে চাইলো, তারপর ঢুকে পড়লো বাগানের ভিতর। সোজা এগিয়ে গেল সে বাড়িটার দিকে। সব কটা দরজাই বন্ধ ভিতর থেকে। কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবলো আগন্তুক, তারপর একটা জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। মোটা শিক দেয়া জানালা। বেডরুম। সমস্ত ঘরটার মধ্যে কেবল এই জানালাই খোলা। হাতের বাক্স খুলে ফেললো লোকটা। ওটা কিসের যেন একটা যন্ত্র। ক্যামেরার মতো দেখতে। খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করে রেগুলেট করে নিয়ে যন্ত্রটার মুখ শিকের নিচের দিকে ধরে একটা বোতাম টিপতেই মুহুর্তে আশ্চর্যজনক ভাবে গলে তেল লোহার গরাদ। এইভাবে সব কটা গরাদই গলিয়ে ফেললো আগন্তুক। তারপর অবলীলাক্রমে একটা একটা করে সব শিক বাঁকিয়ে উপর দিকে তুলে দিলো।
এবার নিঃশব্দে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়লো লোকটা। দুজন মানুষ ঘুমিয়ে আছে মস্ত একটা খাটের উপর লেপ মুড়ি দিয়ে। স্বামী-স্ত্রী বলেই মনে হয়। খাটের তলে একটা হ্যারিকেন রাখা, আলো খুব কমানো। খাটের কাছে একটা দামী আয়রন সেফ। চাবি ঢোকাবার জায়গায় বোতাম টিপে যন্ত্রটা ধরতেই নাম করা কোম্পানীর আয়রন সেফ আলগা হয়ে গেল। কয়েক তোড়া নোট এবং গোটাকতক গিনি পকেটে পুরলো আগন্তুক। আরেকটা দেরাজে কয়েকটা দামী গহনা। হীরে সেট করা বহুমূল্য নেকলেসটা পকেটে ফেললো সে।
এবারে বারান্দার দিকের দরজা খুলে দিলো লোকটা। তারপর যন্ত্রটা খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করে নিয়ে থাটের পাশে এসে দাঁড়ালো। পুরুষ লোকটার গায়ের উপর থেকে লেপ খানিকটা সরিয়ে দিয়ে তার বুকের কাছে যন্ত্রটা নিয়ে বোতাম টিপে দিলো। ঘুমন্ত লোকটা আচমকা চোখ খুলে তাকালো। তারপর খোলা অবস্থাতেই স্থির হয়ে গেল।
নির্বিকারভাবে যন্ত্রটা বাক্সে পুরলো লোকটা। সন্তৰ্পণে মৃত ব্যক্তির শরীরের উপর থেকে সবটা লেপ সরিয়ে দিলো। তারপর পাঁজাকোলা করে ভারি মৃতদেহটা অনায়াসে তুলে নিলো বিছানা থেকে। খাটটা খচ মচ আওয়াজ করে উঠলো। স্ত্রী লোকটি পাশ। ফিরে লেপটা আরও টেনে নিয়ে শুলো। আততায়ী একটু চমকে উঠেছিল। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। গেটের কাছে এসে একবার তীর দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো, তারপর লাশটা পিছনের সিটে শুইয়ে দিয়ে স্টার্ট দিলো।
সেগুন বাগানের লম্বা রাস্তাটা দিয়ে কালো গাড়িটা জন্ত বেগে বেরিয়ে গেল। কেউ জানলো না এর মধ্যে কী কান্ড হয়ে গেল। ভোর পাঁচটা অবধি তেমনি হইসল বেজে চললো। পোকাগুলো লাইটপোস্টের চারধারে অনবরত ঘুরতেই থাকলো।
২.
প্ৰাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খানের ছোট্ট একতলা বাড়ির ড্রইংরুম। দামী পুরু কার্পেট বিছানো মেঝেতে। সোফা সেটটি অত্যন্ত রুচিসম্মত ভাবে সাজানো। দরজা দিয়ে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়ে দেয়ালে টাঙানো রবীন্দ্রনাথের বড় অয়েল পেইন্টিংটা। এক নজরে বোঝা যায় বাড়ির কর্তাটি অগাধ সম্পত্তির মালিক।
সকালবেলা স্নান সেরে একটা দামী কাশ্মীরী শাল গায়ে জড়িয়ে ড্রইংরুমে এসে বসেছে শহীদ। খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছে আর বার বার বাইরের দিকে তাকাচ্ছে। আজ ভোরে কামালের আসবার কথা। দু বন্ধু শিকারে যাবে সাত-গম্বুজের কাছে মাছরাঙা বিলে। আজকাল নাকি বেশ পাখি পড়ছে এ বিলে।
শহীদ ফিজিক্সে ফাস্টক্লাস পেয়ে পাস করেছে গেল বছর। কামাল এবার ইকনমিক্সে পাস করলো।
শহীদ কামাল দুজনেই অল্পবয়সে বাবাকে হারায়। ওদের বাবা দু জন ছিলেন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুজনেই ছিলেন অসীম সাহসী। তাঁরা আফ্রিকায় গিয়েছিলেন লিম্পোপো নদীর কুমীর শিকার করতে। সেখানেই দু জনের মৃত্যু হয়। বিস্তারিত ভাবে কিছুই জানা যায়নি, কেবল মৃত্যু সংবাদ এসে পৌঁছেছে ঢাকায়। সেদিন বাড়িতে যে কী কান্নার রোল উঠেছিল এখনও অস্পষ্ট ভাবে মনে পড়ে শহীদের। আজ পাঁচ বছর হয় মা-ও মারা গেছেন তার।
গফুর এসে দাড়ালো। ভারী পর্দা সরিয়ে জিজ্ঞেস করলো, দাদামণি চা এনে দেবো?
না। কামাল আসুক। আমরা একসাথেই নাস্তা করবো। প্রয়োজন হলে বাজার থেকে কিছু আনিয়ে নিস।
কিছু না বলে চলে গেল গফুর। ভাবটা যেন, সে কথা তুমি আমাকে শিখিয়ে দেবে? আমার আক্কেল নেই? মাসের প্রথম এক থোক টাকা গকুরের হাতে দিয়ে শহীদ নিশ্চিন্ত থাকে। আপাততঃ এই গার্জেনের উপর নিজের ভার ছেড়ে দিয়েছে সে। মা মারা যাওয়ার এক বছর আগে গফুর এসে ঢুকেছে এই বাড়িতে। এরই মধ্যে সে সমস্ত সংসারের তার নিজের মাথায় তুলে নিয়েছে। সংসার অরণ্য খুবই ছোটো, শহীদ আর তার ছোটো বোন লীনা। স্কুল ফাঁকি দিতে চাইলে বকাঝকা দিয়ে স্কুলে পাঠানো, কাঁচা কুল খেলে তম্বি করা; এসব কাজ শহীদ পারে না, গফুরকেই করতে হয়। যেমন প্রকান্ড তার শরীরের কাঠামো, তেমনি সরল এবং বিশ্বস্ত লোক এই গফুর।
অপরাধ বিজ্ঞানে শহীদের অসীম আগ্রহ। মাথা খুব পরিস্কার এবং অ্যাডভেঞ্চারের পাগল সে। তাই স্বভাবতই সে গোয়েন্দাগিরির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এরই মধ্যে কয়েকটা কেসে সে অদ্ভূত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। ওর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে বহুদূর পর্যন্ত। ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ ওকে হিংসে করতে আরম্ভ করেছে।
ইদানীং কামালও গোয়েন্দাগিরির দিকে ধীরে ধীরে ঝুকছে। আগে সে শহীদকে বকতো–তোর মাথায় কি টুকেছে রে? এসব ছাড়। গোয়েন্দাগিরি ভদ্রলোকের কাজ? কিন্তু এখন প্রায়ই সে শহীদকে এটা ওটা সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। নেশাটা ওকেও ধরেছে। ও এখন লুকিয়ে লুকিয়ে ক্রিমিনলজির বই পড়ে। কামাল কিছু দুর্বল প্রকৃতির লোক। শহীদের মতো অমন পেটা শরীরও তার নেই, অমন অসুরের মতো শক্তিও নেই। মাঝারি গোছের সুন্দর চেহারা। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। টানাটানা দুই চোখ।
ঠিক সাতটা বাজতে পাঁচ মিনিটে কামাল এসে ঢুকলো। হাতে একটা দোনলা বন্দুক। ওকে দেখেই শহীদ ফোস করে উঠলো, কিরে, এই তোর পাঁচটা?
কামাল কি যেন একটা জবাব দিতে যাচ্ছিলো। এমন সময় গফুর নাস্তা নিয়ে ঘরো ঢুকলো। টোস্ট, ডিম-পোচ এবং মোটা মোটা গোটা কয়েক অমৃতসাগর কলা।
শহীদ একটা কলার প্রায় অর্ধেকটা মুখের মধ্যে পুরে দিয়েছে, এমন সময় ক্রিং ক্রিং করে ফোন বেজে উঠলো। ফোনের দিকে আঙুল দিয়ে কামালকে ইশারা করতে কামাল ওর দুরবস্থা দেখে একটু হেসে ফোনের দিকে গেল।
হ্যালো..ইয়েস!..শহীদকে চাই ধরুন ডেকে দিচ্ছি।
শহীদ মুখের কলা শেষ করে ফোন ধরলো।
হ্যালো! কে?… হারুন?… কি বললে? পুলিসে খবর দিয়েছো?… দাওনি?… আমি বিশ মিনিটের মধ্যে আসছি, এর মধ্যে পুলিসে ফোন করো।
রিসিভার নামিয়ে রাখলো শহীদ। মুখটা চিন্তিত। কামালকে বললো, তুই বোস আমি কাপড় পরে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি। আজ আর শিকারে যাওয়া হবে না। হারুনের চাচাকে পাওয়া যাচ্ছে না, টাকা পয়সাও চুরি গেছে কাল রাতে। আমরা সেখানেই যাবো।
কিছুক্ষণ পর শহীদ বেরিয়ে এলে৷ ট্রপিক্যালের একটা দামী স্যুট পরে। চা ঠান্ডা হয়ে এসেছে, দুই ঢোকে শেষ করলো চা-টুকু। ইতিমধ্যে প্লেটের যাবতীয় সবকিছু কামাল আত্মসাৎ করে ফেলেছে।
শহীদের ছোট্ট মরিস মাইনর মাযহারুল হক সাহেবের বাসার সামনে এসে দাঁড়ালো। ঢাকার বিখ্যাত ধনী মাযহারুল হক। একটা জুয়েলারীর দোকান আছে নামপুরে, এছাড়া তিনটে বড় বড় হোটেলের মালিক। যুদ্ধের সময় কনটাক্টরী করে প্রচুর ধনসম্পত্তি করেছিলেন। ছেলেপুলে হয়নি। মৃত বড় ভাইয়ের একমাত্র পুত্র হারুনকে তিনি পিতৃস্নেহে মানুষ করেছেন। শহীদের সাধেই পদার্থবিজ্ঞানে ফাস্টক্লাস সেকেন্ড হয়ে পাস করেছে হারুন। রিসার্চ স্কলারশিপ পেয়ে সে এখন পি. এইচ. ডি.-র জন্যে রিসার্চ করছে।
গাড়ি থামতেই হারুন ছুটে এলো। তার সদা হাসিখুশি মুখ শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। শহীদ কোনও রকম সম্ভাষণ না করেই বললো, যে ঘরে চুরি হয়েছে, সে ঘরে আমাদের নিয়ে চলো। পুলিস এখনও আসেনি নিশ্চয়ই? তার আগেই আমি একবার ঘরটা পরীক্ষা করে দেখতে চাই।
বাগানের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে হারুন বললো, আমি একেবারে ভড়কে গেছি শহীদ। আইন-কানুন তো আমি কিছু বুঝি না, আমার ভয় হচ্ছে পুলিস আমাকে না সন্দেহ করে। আমিই তো কাকার বিপুল সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী। তাই তোমাকে আগেই ডেকে পাঠিয়েছি। তোমার উপরই আমি নির্ভর করছি পুরোপুরি। তুমি পারবে না ভাই আমাকে বাঁচাতে?
কেমন যেন জড়ানো জড়ানো গলায় সে কথাগুলো বললো। শেষটায় সে শহীদের দুই হাত ধরে ফেললো। বিস্মিত হয়ে শহীদ লক্ষ্য করলো কি ভয়ঙ্কর ভয় পেয়েছে হারুন। তাকে সান্তনা দেবার জন্যে বললো, তুমি এতো অস্থির হয়ো না, হারুন। চোর ধরা পড়বেই। তোমার ভয়ের কোনো কারণ নেই।
হারুন তাদের নিয়ে গেল একটা ঘরে। ঘরটার আসবাবপত্র খুবই কম, বেশ ছিমছাম। গরাদ বাকানো জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো শহীদ। ভালো করে লক্ষ্য করলো চৌকাঠের উপর কয়েক ফোটা গলা লোহা। কি করে এই লোহা গলানো সম্ভব তা কিছুতেই তার মাথায় এলো না। আয়রণ সেফটার কাছে এসে দাঁড়ালো, সেখানেও পরীক্ষা করলো কি ভাবে ষ্টীল গলে গিয়েছে। তার কপালে ভাজ পড়লো কয়েকটা। হারুনকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার কাকার সাথে এ ঘরে আর কে কে থাকেন?
চাচী আম্মা থাকেন।
ওকে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।
হারুন বাড়ির ভিতর চলে গেল। একটু পরেই তার সাথে এলেন এক প্রৌঢ়া মহিলা। শহীদ, কামাল দুজনেই তাকে আদাব দিলো। তিনিও আদাব জানিয়ে বললেন, বসো বাবারা। বলে নিজেই খাটের উপর বসে পড়লেন।
শহীদ জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা চাচী আম্মা, কাল আপনি কোনও কিছুর শব্দ শুনতে পাননি রাতের বেলা?
না বাবা। আমি হাঁপানিতে কষ্ট পাই, রাতে ঘুম হয় না। তাই আজ মাসখানেক ধরে ঘুমের ওষুধ খেয়ে বিছানায় শুই। ভোর ছটা৷ -সাড়ে ছটার আগে আর আমার ঘুম ভাঙে না।
এতগুলো কথা বলে তিনি হাঁপাতে লাগলেন। শহীদ বললো, আচ্ছা আয়রণ সেফে কি কি ছিলো বলতে পারবেন?
উনি কাল দুপুরে পঞ্চাশ হাজার নগদ টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে এনেছিলেন, সেই টাকা ছিলো, কিছু গহনা ছিলো, আর গিনি ছিলো কয়েকটা। সুন্দর সাজিয়ে কথাগুলো বলেন ভদ্রমহিলা।
সবই চুরি হয়ে গেছে?
গহনা বেশির ভাগই রয়েছে। একটা হীরে বসানো হার শুধু গেছে গহনা থেকে আর টাকা, গিনি সবই গেছে।
হীরে বসানো হারটার দাম কতো হবে?
পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে উনি ওটা তৈরি করেছিলেন হারুনের বউকে দেবার জন্যে। হারুনের বিয়ের কথাবার্তা চলছে কিনা।
কাকা যখন বিছানা থেকে উঠে যান, আপনি টের পাননি?
না বাবা।
আচ্ছা, চাচী আম্মা, আমরা এবার আসি।
শহীদ কামালের হাত ধরে এগিয়ে গেল। হারুন পিছন পিছন চললো। জিজ্ঞেস করলো, কিছু বুঝতে পারলে, শহীদ?
কিছুমাত্র না। তুমি কাউকে সন্দেহ করো এ ব্যাপারে?
আমি কিছু বুঝতে পারছি না। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ভৌতিক বলে বোধ হচ্ছে আমার কাছে। তাছাড়া আমি রিসার্চ নিয়ে থাকি, কাকার বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিত কারো সঙ্গে আমার বিশেষ চেনাশোনাও নেই। কাকে সন্দেহ করবো?
গাড়ির কাছে এসে হারুনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো শহীদ।
গুডবাই। রমনা থানাটা ঘুরে যাই একটু।
হারুন মিনতি ভরা কণ্ঠে বললো, দেখো ভাই, একটা কিছু সুরাহা তোমার করতেই হবে। তোমার যা খরচ পড়ে আমাকে বিল দিয়ো তক্ষুণি শোধ করে দেবো।
তুমি জানো আমি শখের গোয়েন্দা। যদি কিছু করি, কারো অনুরোধের অপেক্ষা রাখবো না। তাছাড়া টাকার প্রয়োজনও আমার পড়বে না।
এঞ্জিন স্টার্ট দিলো শহীদ। হারুন কি বলতে যাচ্ছিলো গাড়ি চলতে শুরু করায় থেমে গেল।
অনেক খোঁজ করে টহলদার নাইটগার্ডকে বের করে শহীদ জানতে পারলো যে রাত প্রায় দেড়টা-দুটোর সময় সিটি এস. পি.-র গাড়ি গিয়েছিল সেগুন বাগানে। আধঘন্টা পরেই আবার সে গাড়ি ফিরে যায়। ও জিজ্ঞেস করলো, এস. পি. সাহেবের গাড়ি চিনলে কি করে।
হুজুর, চিবারলেট গাড়ি আছিলো, পন্দ্রসও বাইশ নম্বর আছিলো।
আর কোনও গাড়ি যায়নি বেশি রাতে ওদিকে?
না, হুজুর।
কামাল বললো, পথে যাতে বাধা না পায় তার জন্যে শেভ্রোলে গাড়িতে প্রয়োজন মতো নম্বর লাগিয়ে নিতে পারে চোর বা চোরেরা।
হ্যাঁ, তা পারে। গম্ভীরভাবে উত্তর দিলো শহীদ। গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়েছে সে।
পরদিন কাগজে খবর বেরোলো, বিখ্যাত ব্যবসায়ী জনাব মাযহারুল হক নিখোঁজ। এরপর সবিস্তারে চুরির কথা লেখা হয়েছে। সব শেষে লিখেছে, বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গিয়াছে যে তীক্ষ্মধী শখের গোয়েন্দা মি. শহীদ খান এই ব্যাপারে তদন্ত করিতেছেন।