০২.
টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়েই চলেছে আজ ছসাতদিন ধরে। শ্রাবণের মাঝামাঝি। একবার শুরু হলে আর থামতেই চায় না।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। Dienfa Workshop-এ অষ্টিন এইট ফিটি গাড়িটা অয়েলিং করবার জন্যে রেখে শহীদ পায়ে হেটে বাড়ি ফিরছে। ওয়াটারপ্রুফ পরা, পায়ে গাম -বুট, মাথায় টুপি। ভিজবার কোনও ভয় নেই। বৃষ্টিটা বেশ একটু চেপে এলো। শান্তিনগরের বিরাট পিচ ঢালা রাস্তাটা এমনিতেই খুব নির্জন থাকে। বৃষ্টির দিন, তাই লম্বা রাস্তাটা ধরে যতদূর দেখা যায়, জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই।
বেশ দূরে একজন লোককে হেঁটে আসতে দেখা গেল। ভিজে আসছে লোকটা। অনেকটা কাছে আসতেই শহীদ দেখলো, নিগ্রো একজন। ছ্যাৎ করে উঠলো তার বুকের ভিতরটা। গত কয়েকদিন ধরে জনকতক নিগ্রো তার ওপর নজর রাখছে। সে যেখানেই যায় ছায়ার মতো পিছু নেয় তাদের কেউ না কেউ। এ লোক তাদেরই দলের একজন।
কাছে এসে শহীদকে চিনতে পেরে সব কটা দাঁত বেরিয়ে গেল লোকটার। একটা মিষ্টি হাসি দিলো সে। শহীদের কাছে কিন্তু হাসিটা মােটেই মিষ্টি লাগলো না। নিকষ কালো মুখে চকচকে সাদা দাঁতগুলো ওকে যেন ভেংচি কাটলো। কী বীভৎস চেহারা!
শহীদ গম্ভীর মুখে এগিয়ে যায়। পকেটের মধ্যে রিভলবারটা শক্ত করে চেপে ধরেছে সে। শহীদ ভাবে, কেন এই লোকগুলো তার পিছন ধরেছে? কী এদের উদ্দেশ্য? এমন বিকট হাসিরই বা অর্থ কি? ঢাকার বুকে হঠাৎ এতগুলো নিগ্রো কোথা থেকে এসে হাজির হলো?
দ্রুত হাঁটছে শহীদ। মাঝে মাঝে পিছন ফিরে চায়। না, কেউ নেই আশেপাশে। প্রায় বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে সে। সামনে একটা মাঠ আর একটা বড় দীঘি বাঁ পাশে রেখে একটা কাঁকরের সরু পথ শহীদের সুন্দর একতলা বাড়িটার গেট পর্যন্ত চলে গেছে। বৈঠকখানার কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঘরের মধ্যে মহুয়া, কামাল আর লীনা বসে গল্প করছে। ওদের দেখে শহীদের বুকের ওপর থেকে একটা ভারি পাথর যেন সরে গেল। মনটা হালকা হয়ে গেল। ডান পাশে একটা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। জায়গাটা অন্ধকার মতো। তারপরেই কাঁকরের রাস্তায় পড়বে সে।
হঠাৎ পিছন থেকে কে একজন সাপটে ধরলো তাকে। শহীদ ছাড়াবার চেষ্টা করছে এমন সময় বাঁ পাশ থেকে প্রচণ্ড এক মুষ্ট্যাঘাত এসে পড়ল তার গালে। বোঁ করে ঘুরে উঠলো তার মাথাটা। কেমন যেন ঘোলাটে লাগছে। সামলে নেয়ার আগেই তার পকেট থেকে রিভলবার তুলে নিলো আক্রমণকারী। শহীদ ততোক্ষণে সামলে নিয়েছে অনেকটা। চেয়ে দেখলো তাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে চার-পাঁচজন নিগ্রো! তাদের মধ্যে সবচাইতে লম্বা লোকটা এগিয়ে এসে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললো, Dont shout. Otherwise you dead. Comes with me.
শহীদ চিন্তা করে দেখলো ওয়াটারপ্রুফ পরে, গামবুট পায়ে চার পাঁচজন ষন্ডামার্কা নিগ্রোর সাথে লাগতে যাওয়া পাগলামি ছাড়া কিছুই নয়। তাকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে তারা অর্ধেক তৈরি বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেল।
শহীদ শেষ বারের মতো তার বাড়ির দিকে চেয়ে দেখলো কামাল, মহুয়া, লীনা তেমনি গল্প করছে। গফুর চা নিয়ে এসে রাখছে টেবিলের ওপর। এতো কাছে রয়েছে ওরা তবু কেউ জানছে না শহীদের এখন কতো বড় বিপদ। ক্ষোভে দুঃখে শহীদের হাসি পেলো। ইশ! গকুর যদি একটু জানতে পারতো তার দাদামণি এখন কতো বড় বিপদে পড়েছে। গফুর আর শহীদ একসাথে থাকলে এই নিগ্রো কজন টের পেতে কার সাথে লাগতে গেছে ওরা।
ঘরের মধ্যে এনে শহীদকে একটা রশি দিয়ে পিছমােড়া করে বেঁধে ফেললো ও। তারপর হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে নিজেদের ভাষায় কি যেন বিড়বিড় করে বলতে লাগলো। শহীদ তার একবর্ণও বুঝলো না। মিনিট কয়েক ওরা সেইভাবে অনবরত বলেই গেল। তারপর একজন উঠে গিয়ে ঘরের কোণে রাখা একটা লম্বা বাক্সের ডালা খুলে ফেললো। সেই লম্বা লোকটা এবার তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বাক্সের দিকে চললো। শহীদের বুঝতে বাকি রইলো না, এবার তাকে বাক্সে পোরা হবে।
হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে ঝড়ের মতো একটা মূর্তি ঢুকলো ঘরে। কালো আলখাল্লা পরা, মুখে মুখোশ। কেউ ভালো করে কিছু বুঝবার আগেই সে পটাপট কয়েকটা ঘুসি চালিয়ে দিলো তিনজন কাফ্রির নাকের ওপর। কী প্রচণ্ড ঘুসি! যেমন বিরাট লম্বা চওড়া মূর্তি, তেমনি তার ঘুসির ওজন। নাকে হাত দিয়ে বসে পড়লো তিনজনই। সবচাইতে জোয়ান নিগ্রোটা শহীদকে ফেলে দিলে মাটিতে। তারপর ঘুসি বাগিয়ে প্রচণ্ড বেগে ছুটে গেল মূর্তিটার দিকে। সামান্য সরে গিয়ে কি যেন একটু করলো আগন্তুক। ছিটকে ওপাশের দেয়ালে অত্যন্ত জোরে ধাক্কা খেলো জোয়ান নিগ্রোটা।
মাথাটা ভীষণভাবে ঠুকে গেছে দেয়ালের গায়ে। টু শব্দটি না করে সে ঝুপ করে মাটিতে পড়ে গেল অজ্ঞান হয়ে। এদিকে বাকি তিনজনের একজন টলতে টলতে উঠে দাড়িয়েছে। তলপেটে প্রচণ্ড এক লাথি খেয়ে সে আবার মাটিতে ঘুরে পড়লো।
সর্দারের পকেট থেকে শহীদের রিভলভারটা বের করে নিলো আগন্তুক। এবার সে শহীদের দিকে এগিয়ে আসছে। পকেট থেকে একটা ছুরি বের করে শহীদের হাত পায়ের বাঁধন কেটে দিলো। তারপর পরিষ্কার বাংলায় বললো, চলো, তোমাকে কিছুদূর এগিয়ে। দিয়ে আসি।
শহীদ আগে আগে চলেছে, পিছনে আলখাল্লা ধারী। বাড়ির কাছাকাছি এসে শহীদ বললো, এসো বন্ধু, আজ মহুয়ার হাতের তৈরি চা খেয়ে যাও। তোমার এই উপকারের জন্যে কি বলে যে তোমায় ধন্যবাদ জানাবো ভেবেই পাচ্ছি না।
কোনো উত্তর নেই। শহীদ পিছন কিরে দেখলে কেউ নেই। তার অজান্তেই আগন্তুক কখন সরে পড়েছে।
শহীদের বুঝতে বাকি নেই, আলখাল্লাধারী কুয়াশা ছাড়া আর কেউ নয়। আর কারও এতো বড় বুকের বল নেই যে চারজন ষণ্ডামার্কা নিগ্রোর সাথে খালি হাতে একা লড়তে যাবে।
কিন্তু কুয়াশার তো তার ওপর প্রতিশোধ নেয়ার কথা। সে তাকে এমন অযাচিত ভাবে বিপদ থেকে উদ্ধার করবে কেন? সে তার বোনকে বিয়ে করেছে বলে? কিংবা ভালবাসা? শহীদ ঠিক বোঝে না। কুয়াশার প্রতি শ্রদ্ধায় তার মাথা নত হয়ে আসে।
কিন্তু এই নিগ্রোগুলো তাকে বন্দী করেছিল কেন? ওই বাক্সেতে পুরে ওকে কি পাচার করবার মতলবে ছিলো ওরা? কিন্তু কেন? কোথায়?
নানা প্রশ্ন তার মাথায় জট পাকায়। কোনটারই সমাধান পায় না সে।
২.
পরদিন বিকেল বেলা। বৃষ্টি পড়েই চলেছে। মাঝে মাঝে দুই এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে ঢুকছে শহীদের ড্রইংরুমের খোলা জানালা দিয়ে। বৃষ্টির কণাও কিছু কিছু এসে দামী পুরু কার্পেটের খানিকটা ভিজিয়ে দিয়েছে। বাতাসের ঝাপটার সাথে সাথে খুব সূক্ষ্ণ বৃষ্টির কণা এসে লাগছে চোখে মুখে।
লম্বা সোফাটায় শুটিসুটি মেরে শুয়ে শহীদ সঞ্চয়িতা পড়ছে আর মাঝে মাঝে বাইরে বৃষ্টির দিকে চেয়ে কি যেন ভাবছে। শহীদ দেখছে ভিজছে কার্পেটটা। ভিজুক, উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করতে ইচ্ছে করে না।
বাইরে রহস্যময় বিরাট বট গাছটা যেন তার মনের মধ্যে কতো কী গোপন করে নীরবে চেয়ে রয়েছে তার দিকে। যেন একটা বক। এক পায়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে মাছের অপেক্ষা করছে। না, না, বক না, একটা মস্তবড় হিংস্র জংলী হাতী। কী এক যাদুমন্ত্রে শান্ত হয়ে কেবল চেয়ে রয়েছে, আর ভিজছে।
আরও দূরে দৃষ্টি যায় শহীদের। দূরে একটা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। একটা লম্বা বাঁশের আগায় একটা ঝাড়ু আর টুকরি বাঁধা। বৃষ্টির দিন, তাই কাজ বন্ধ। আরেকটা বাঁশের মাথায় একটা কাক বসে বসে ভিজছে।
কি ভাবছো চুপচাপ? মহুয়া এসে ঢুকেছে কখন ঘরে, আরে বেশ তো তুমি, কার্পেটটা ভিজে যাচ্ছে আর নিশ্চিন্ত শুয়ে আছো। কাঁচের জানালা বন্ধ করে দিলো সে। তারপর কাছে এসে মাথার কাছে একটা সোফায় বসে শহীদের চুলের মধ্যে হাত চালিয়ে দিলো।
কামাল কই?
লীনাকে অঙ্ক বুঝিয়ে দিচ্ছে।
ওরা দুজনেই হাসলো। কামাল চিরকাল অঙ্কে লাড্ডু পেতো। লীনার ম্যাট্রিক পরীক্ষার আর মাত্র একমাস বাকি। তাই কামালকে আবার শহীদের কাছ থেকে অঙ্ক শিখে নিয়ে ওকে শেখাতে হচ্ছে। কামালের সদা চিন্তিত মুখ দেখলে মনে হয় পরীক্ষা যেন ওরই।
মুহু, কী যেন খেতে ইচ্ছে করছো, শহীদ আবদারের সুরে বলে।
গফুরকে বড়া ভাজতে দিয়ে এসেছি। হয়ে গেছে প্রায়।
না, বড়া না, কী যেন আরেকটা জিনিস! হাত বাড়ায় শহীদ।
ধেৎ, কেউ দেখে ফেলবে যে! এই, না, সত্যি…
গফুর একটু কাশি দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকলো। এক থালা ভর্তি বড়া। শহীদ সুবোধ বালকের মতো মিটমিট করে চেয়ে রইলো। টেবিলের ওপর থালাটা রেখে গফুর বললো, কামাল ভাই আর ছোটো আপাকে ডেকে দেবো দিদিমণি?
দাও।
গফুর চলে গেল। একটু পরে কামাল আর লীনা এসে ঢুকলো ঘরে। বড়া দেখেই কামাল পুলকিত হয়ে উঠলো। একটা বড় মুখে পুরে এক কামড় দিয়েই আর্তনাদ করে আবার হাতে নিলো। বড়ো গরম!
শহীদের মাথার কাছে বন্ধ করে রাখা সঞ্চয়িতা তুলে নিয়ে পাতা ওল্টাতে থাকলো লীনা। বোধকরি একটা কবিতা আবৃত্তি করবার ইচ্ছা আছে, ভালো কবিতা খুঁজছে। হঠাৎ একটা চার ভাঁজ করা কাগজ বই থেকে বের করে শহীদকে জিজ্ঞেস করলো, এটা কী দাদামণি? এটা তো এ বইয়ের মধ্যে ছিলো না?
ওটা বাবার একটা চিঠি। মার কাছে লেখা। আজ সকালে মার হাতবাক্স ঘাঁটতে, ঘাঁটতে পেয়ে গেলাম। কামালের দিকে ফিরে বললো, এই চিঠির দুএকটা জায়গা, পড়ছি। শুনে রাখ, পরে তোর সাথে আমার অনেক কথা আছে।
শহীদ হাত বাড়িয়ে লীনার কাছ থেকে চিঠিটা নিলো। অনেক দিনের পুরনো চিঠি, কাগজটা হলদে হয়ে গেছে। জায়গায় জায়গায় কালি চুপসে গেছে, পড়া যায় না। কিছুক্ষণ চিঠিটার ওপর চোখ বুলিয়ে শহীদ পড়তে শুরু করলোঃ
আমাদের স্টীমার এখন তেলাগোয়া উপসাগরের মধ্য দিয়া লরেঞ্জো মারকুইসের দিকে চলিয়াছে। আগামীকাল আমরা সেখানে পৌছাইব।
কতকগুলি সামুদ্রিক পাখি আজ দুপুর হইতে স্টীমারের চতুষ্পার্শ্বে ঘুরিতেছে। এখন সূর্য অস্ত যাইতেছে। কেবল ইঞ্জিনের ধিকি ধিকি শব্দ ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নাই। এই নিস্তব্ধতা বড় ভালো লাগিতেছে। ডেকের ওপর আমার পাশের চেয়ারে বসিয়া ইকবাল– সেও মুগ্ধ হইয়া বাহিরে চাহিয়া রহিয়াছে। মেঘগুলি সিদুরের মতো লাল হইয়া গিয়াছে। তাহার ছায়া আবার জলে পড়িয়াছে; ফলে চতুর্দিকে কেবল লাল আর লাল।
ডারব্যান হইতে কতকগুলি নিগ্রো আমাদের স্টীমারে উঠিয়াছে। আমার সহিত অত্যন্ত ভাব জমিয়া গিয়াছে। ইহারাও লিম্পোপো নদী দিয়া দক্ষিণ রোডেশিয়ায় যাইবে। ইহাদের ভাষা আমরা একেবারেই বুঝি না, তবু ইহাদের ভাবে ভঙ্গিতে বন্ধুত্ব করিবার ইচ্ছা দেখিয়া আমরা অত্যন্ত খুশি হইয়াছি। বিশেষ করিয়া আমাকে ইহারা অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। রোজ সন্ধ্যায় ইহারা আসিয়া আমার সামনে হাঁটু গাড়িয়া উহাদের নিজেদের ভাষায় কি কি সব উচ্চারণ করে। আমি একবর্ণও বুঝি না, কেবল মাথা নাড়ি।
এই নিগ্রোগুলি বান্টু শাখাভুক্ত। ইহারা যেমন সাহসী ও বলিষ্ঠ তেমনি হিংস্র। আমার সহিত স্টীমারের একজন খালাসী সামান্য দুর্ব্যবহার করিয়াছিল। আজ দুইদিন যাবৎ তাহাকে পাওয়া যাইতেছে না। আমার যতদূর বিশ্বাস এই নিগ্রোগুলি তাহাকে খুন করিয়া জলে ফেলিয়া দিয়াছে। কারণ আমার সহিত খালাসীর ঝগড়ার সময় তাহাদিগকে অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া উঠিতে দেখিয়াছিলাম।
এহেন হিংস্র, বলিষ্ঠ ও সাহসী পথপ্রদর্শক লইয়া আমাদের লিম্পোপোর কুমীর নিধনে বিশেষ সুবিধা হইবে। জার্মান গভর্নমেন্ট ইদানীং ঘোষণা করিয়াছে প্রতিটি কুমীরের জন্য এক পাউও করিয়া পুরস্কার দিবে…
তোমার নিকট হইতে আমি এখন সাড়ে চার হাজার মাইল দূরে কিন্তু বিশ্বাস করে৷ সানী, এক মুহূর্ত তোমাকে ভুলিয়া থাকিতে পারি না। অনেক রাতে যখন একফালি চাঁদ উঠে আকাশে, ভৌতিক চাঁদ-আবছা আলো, আবছা অন্ধকার-তখন জাগিয়া বসিয়া তোমার কথা ভাবি। তুমি যদি কাছে থাকিতে!…ইত্যাদি ইত্যাদি।
চাচাজান আর বাবা কি তাহলে কেবল শিকার করতে যাননি, টাকা পয়সার ব্যাপারও ছিলো? কামাল জিজ্ঞেস করলো।
টাকার কথা একটা আছে অবশ্যই, কিন্তু টাকা তাঁদের কম ছিলো না। আসলে গেছিলেন শিকার করতেই, সেই সাথে যদি কিছু টাকাও আসে তো মন্দ কি?
টাকা দেবে কে?
জার্মানী যখন গত মহাযুদ্ধে টাঙ্গাইনিকা দখল করে তখন ঘোষণা করে লিম্পোপো নদীর কুমীর শেষ করতে হবে। প্রতিটি মৃত কুমীরের জন্যে এক পাউণ্ড পুরস্কার। আমার বাবা আর তোমার বাবা গেছিলেন আসলে শিকার করতে। ওখানে গিয়ে যতদূর সম্ভব তাঁর পুরস্কারের কথা জানতে পারেন।
আচ্ছা, তোমরা ওদের মৃত্যু সংবাদ পেলে কি করে? মহুয়া প্রশ্ন করে।
লরেঞ্জো মারকুইস থেকে অ্যান্ডারসন বলে এক সাহেব, দয়া করে জানিয়েছিল।
শহীদ কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইলো। বেশ জোরে বৃষ্টি নেমেছে। গফুর কফি নিয়ে এলো চার কাপ।
কফিতে এক চুমুক দিয়ে কামাল বললো, একটা গান গাও তো মহয়াদি, শ্রাবণের গান
এই বিকেল বেলা কি ভালো লাগবে?
খুব ভালো লাগবে, গাও তো তুমি। আমি সাথে পিয়ানো বাজাবো।
কামাল উঠে গিয়ে পিয়ানোর সামনে বসলো। একটু কেশে নিয়ে শুরু করলো, মহুয়া।
আমি শ্রাবণ আকাশে ওই, দিয়াছি পাতি
মম জল ছল ছল আঁখি মেঘে মেঘে…
যেমন সুন্দর সুর, তেমনি গলা। কলির শেষে এতো সুন্দর করে মীড় টানে মহুয়া! সাথে কামালের পাকা হাতে পিয়ানো, সমস্ত আবহাওয়া একেবারে গম্ভীর করে দিয়েছিল। আজকের এই বাদলা দিন যেন সম্পূর্ণ সুন্দর হলো গানটা শুনে। সবাই অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো। মহুয়া উঠে দাঁড়িয়ে বললো, লীনা, ভুনিখিচুড়ি তৈরি করা শিখবে বলে, চলো আজ খিচুড়ি রাঁধবো।
মহুয়া আর লীনা চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। কামাল কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে বসে রইলো। তারপর শহীদকে বললো, কি কথা বলবি বলে?
হ্যাঁ, কাছে আয়।
কামাল কাছের একটা সোফায় এসে বসলো। শহীদ বললো, শোন, তোকে গোড়া থেকে ব্যাপারটা বলি। এই যে চিঠিটা দেখছিস পকেট থেকে একটা খাম বের করলো। শহীদ, এটা আজ সকালের ডাকে আফ্রিকা থেকে এসেছে। না, না, বাবা বা কাকা কারও লেখা নয়; কুফুয়া নামে একজন আফ্রিকান ব্যবসায়ীর কাছ থেকে এসেছে।
বাবা আর কাকা গেছিলেন সিম্পোপো নদীতে কুমীর শিকার করতে। জার্মেনী তখন ঘোষণা করেছে প্রতিটি কুমীরের জন্যে এক পাউণ্ড করে পুরস্কার দেবে। বাবা আর কাকা এই ব্যবসায়ী কুফুয়ার সাথে যোগ দিয়ে কয়েকশো লোক জোগাড় করে কেবল মাত্র নদীর এক মাইল ঘেরাও করেই সাড়ে নয় হাজার কুমীর একদিনে মারেন। পরে আরও অনেক কুমীর এদের হাতে মারা পড়ে। ঠিক ঠিক টাকা দেয় জার্মান গভর্নমেন্ট। কিন্তু তাদের কুমীর নির্বংশ করার plan বাতিল করে দেয়। তোর বাবা হঠাৎ একদিন বেকায়দায় কুমীরের পাল্লায় পড়ে বাবা আর কুফুয়ার চোখের সামনে তলিয়ে গেলেন লিষ্পেপোর মধ্যে। বাবা নাকি ভীষণ আঘাত পেয়ে পাগলের মতো হয়ে যান। রাইফেল কাঁধে লিস্পোপের ধারে ধারে দিন নেই রাত নেই পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতেন তিনি। কয়েকদিনের মধ্যে বহু কুমীর মারেন বাবা। তারপর একদিন তিনিও আর ফিরে এলেন না।
আমাদের ঠিকানা কুফুর কাছে ছিলো। সে জানতে আমাদের পরিবারে বড় আর কেউ নাই। তাই আজ সতেরো বছর পর আমরা যথেষ্ট বড় হয়েছি মনে করে চিঠি লিখেছে। আমার আর তোর সাত হাজার পাউণ্ড, অর্থাৎ প্রায় নব্বই হাজার টাকা কুফুয়ার কাছে জমা আছে। আমরা যেন সেখানে গিয়ে সে টাকার একটা ব্যবস্থা করে আসি, তার জন্যে সে আমাদের সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। লিখেছে, বাবারা, আমার প্রচুর টাকা আছে, বন্ধুর ছেলেদের টাকা আত্মসাৎ করে আমি স্বর্গে যেতে পারবো না। তোমাদের টাকা পয়সা তোমাদের বুঝিয়ে দিয়ে আমি শান্তিতে মরতে চাই। তোমরা যতো শিগগির পারো রওনা হয়ে যাও। নইলে এই বুড়ো বয়সে আমাকে আবার যেতে হবে তোমাদের দেশে।
অদ্ভুত ভালো বুড়ো তো! কিন্তু একটা কথা আমার মনে হচ্ছে। কিছু Conspiracy-ও থাকতে পারে। কয়েকদিন ধরে কয়েকজন নিগ্রোকে এই বাড়ির আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখছি কেন বলতো? ঢাকায় নিগ্রো, আফ্রিকা থেকে চিঠি, কেমন সন্দেহ হচ্ছে।
তোরও নজর পড়েছে দেখছি! শহীদ হাসলো। তারপর গত সন্ধ্যার ঘটনা সবিস্তারে বললো কামালকে। সবটুকু মন দিয়ে শুনে কামাল বললো, খুবই Serious বলে মনে হচ্ছে। ব্যাপার কিছু আঁচ করেছিস?
কিছু মাত্র না। আমি সকালে মার হাতবাক্স খুললাম। বাবার কোনও চিঠিপত্র থেকে কিছু বোঝা যায় কিনা দেখতে। একটা জায়গা একটু মিলেছে। চিঠিতে একখানে বাবা লিখেছেন কয়েকজন নিগ্রো স্টীমারে রোজ সাঁঝে তাঁর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বিড় বিড় করে কি মন্ত্র আওড়াত। কাল সাঁঝে আমাকে হাত পা বেধে ওরা আমার সামনেও হাঁটু গেড়ে বসে মন্ত্র আওড়েছিল। মনে হয় এই নিগ্রোগুলো সেই একই দলের লোক, অথবা একই উপজাতি বা শাখার লোক।
সে যাক। এখন কি ঠিক করলি? যাবি লিম্পোপো নদীতে?
তাই জিজ্ঞেস করতেই তো তোকে ডাকলাম। আমার তো পুরোপুরি যাবার ইচ্ছে আছে। কিন্তু তোর মা ভীষণ কান্নাকাটি করবেন তুই যেতে চাইলে।
কিছু না। তুই গিয়ে খালি একবার মাকে বলবি, ব্যাস আর কিছু লাগবে না। তোর সাথে মা আমাকে দোজখেও পাঠাতে রাজি হবে।
এদিকে আবার মহুয়াও কান্নাকাটি করবে। ও কিছুতেই যেতে দিতে চাইবে না।
মহুয়াদিকে সঙ্গে নিয়ে যাবি।
বাঃ! Good idea! আমার মাথায় এ কথা একেবারেই আসেনি! পাটিগণিত করে তোর বুদ্ধি খুলে গেছে। শহীদ খুশি হয়ে উঠলো।
কিন্তু আমি যে কামাল আহমেদ আর তুই যে শহীদ খান, তা প্রমাণ করবি কি করে? আফ্রিকায় গেলাম, তখন যদি কুফুয়া বলে তোমাদের পরিচয় প্রমাণ করো, তখন?
বারে। আমাদের পাসপোর্ট থাকবে না সাথে? পাসপোর্টেই তো ছবি থাকবে।
পাসপোর্ট করে কোথায় যাওয়া হচ্ছে তোমাদের? মহুয়া এসে ঢুকলো ঘরে। ঠোঁটের একটু ওপরে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মিষ্টি মুখটা আরও মিষ্টি লাগছে।
কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে শহীদ বললো, আফ্রিকা।
মহুয়া ভাবলো শহীদ ঠাট্টা করছে। হেসে কামালের দিকে চাইলো। কামালের গম্ভীর মুখ দেখে ওর বুকটা ছাঁৎ করে উঠলো।
আফ্রিকা? আফ্রিকা কেন?
লিম্পাপো নদীতে কুণীর শিকার করতে।
ধ্যাৎ, ঠাট্টা করছো।
না মুহ, ঠাট্টা না। সত্যিই যাচ্ছি।
কিছুতেই তোমাদের যাওয়া হতে পারে না।
যে কোনও অবস্থায় আমাদের যাওয়া চাই-ই, গম্ভীরভাবে বলে শহীদ।
আমার কথা শুনবে না? মহুয়ার চোখ ছল ছল করে।
দেখ, কামাল, মেয়ে মানুষের একমাত্র অস্ত্র তুলে নিয়েছে মহুয়া, আর একটু হলেই প্রয়োগ করবে।
মহুয়া হেসে ফেলে বললো, তাহলে বলো সত্যি সত্যিই আর যাচ্ছে না। বিয়ে করে, একটা মেয়ের ইহকাল পরকাল নষ্ট করে ওসব দেশে যাবার কথা ভাবতে হয় বুঝি?
সত্যি সত্যিই আমরা যাচ্ছি মহুয়াদি। তবে তুমি যদি কান্নাকাটি করো সেই ভয়ে তোমাকেও সাথে নেয়ার প্রস্তাব করেছি শহীদের কাছে। তাহলে রাজি আছে তো যেতে দিতে?
নাই বা গেলে অমন দেশে কামাল ভাই।
অনেক কারণ আছে যে যাবার।
কি কারণ?
শহীদ বললো, তোমাকে পরে সব বলবো মহুয়া। আমরা চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই চিটাগাং থেকে রওনা হবো। গফুরকে বললেই হবে, ওই সমস্ত জিনিসপত্র বেধেছেদে ঠিক করে ফেলবে।
লীনা এসে ঢুকলো। কোথায় যাবে তোমরা দাদামণি?
আফ্রিকা।
সত্যি?
মহয়াদিও?
হাঁ।
আমিও যাবো। আবদার ধরে লীনা।
তুই কি করে যাবি। তোর তো সামনে পরীক্ষা। তুই ততোদিন চাচী-আম্মার কাছে থাকবি, আমরা যতো শিগগির পারি ফিরে আসবো।
টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়েই চলেছে আজ ছসাতদিন ধরে। শ্রাবণের মাঝামাঝি। একবার শুরু হলে আর থামতেই চায় না।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। Dienfa Workshop-এ অষ্টিন এইট ফিটি গাড়িটা অয়েলিং করবার জন্যে রেখে শহীদ পায়ে হেটে বাড়ি ফিরছে। ওয়াটারপ্রুফ পরা, পায়ে গাম -বুট, মাথায় টুপি। ভিজবার কোনও ভয় নেই। বৃষ্টিটা বেশ একটু চেপে এলো। শান্তিনগরের বিরাট পিচ ঢালা রাস্তাটা এমনিতেই খুব নির্জন থাকে। বৃষ্টির দিন, তাই লম্বা রাস্তাটা ধরে যতদূর দেখা যায়, জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই।
বেশ দূরে একজন লোককে হেঁটে আসতে দেখা গেল। ভিজে আসছে লোকটা। অনেকটা কাছে আসতেই শহীদ দেখলো, নিগ্রো একজন। ছ্যাৎ করে উঠলো তার বুকের ভিতরটা। গত কয়েকদিন ধরে জনকতক নিগ্রো তার ওপর নজর রাখছে। সে যেখানেই যায় ছায়ার মতো পিছু নেয় তাদের কেউ না কেউ। এ লোক তাদেরই দলের একজন।
কাছে এসে শহীদকে চিনতে পেরে সব কটা দাঁত বেরিয়ে গেল লোকটার। একটা মিষ্টি হাসি দিলো সে। শহীদের কাছে কিন্তু হাসিটা মােটেই মিষ্টি লাগলো না। নিকষ কালো মুখে চকচকে সাদা দাঁতগুলো ওকে যেন ভেংচি কাটলো। কী বীভৎস চেহারা!
শহীদ গম্ভীর মুখে এগিয়ে যায়। পকেটের মধ্যে রিভলবারটা শক্ত করে চেপে ধরেছে সে। শহীদ ভাবে, কেন এই লোকগুলো তার পিছন ধরেছে? কী এদের উদ্দেশ্য? এমন বিকট হাসিরই বা অর্থ কি? ঢাকার বুকে হঠাৎ এতগুলো নিগ্রো কোথা থেকে এসে হাজির হলো?
দ্রুত হাঁটছে শহীদ। মাঝে মাঝে পিছন ফিরে চায়। না, কেউ নেই আশেপাশে। প্রায় বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে সে। সামনে একটা মাঠ আর একটা বড় দীঘি বাঁ পাশে রেখে একটা কাঁকরের সরু পথ শহীদের সুন্দর একতলা বাড়িটার গেট পর্যন্ত চলে গেছে। বৈঠকখানার কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঘরের মধ্যে মহুয়া, কামাল আর লীনা বসে গল্প করছে। ওদের দেখে শহীদের বুকের ওপর থেকে একটা ভারি পাথর যেন সরে গেল। মনটা হালকা হয়ে গেল। ডান পাশে একটা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। জায়গাটা অন্ধকার মতো। তারপরেই কাঁকরের রাস্তায় পড়বে সে।
হঠাৎ পিছন থেকে কে একজন সাপটে ধরলো তাকে। শহীদ ছাড়াবার চেষ্টা করছে এমন সময় বাঁ পাশ থেকে প্রচণ্ড এক মুষ্ট্যাঘাত এসে পড়ল তার গালে। বোঁ করে ঘুরে উঠলো তার মাথাটা। কেমন যেন ঘোলাটে লাগছে। সামলে নেয়ার আগেই তার পকেট থেকে রিভলবার তুলে নিলো আক্রমণকারী। শহীদ ততোক্ষণে সামলে নিয়েছে অনেকটা। চেয়ে দেখলো তাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে চার-পাঁচজন নিগ্রো! তাদের মধ্যে সবচাইতে লম্বা লোকটা এগিয়ে এসে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললো, Dont shout. Otherwise you dead. Comes with me.
শহীদ চিন্তা করে দেখলো ওয়াটারপ্রুফ পরে, গামবুট পায়ে চার পাঁচজন ষন্ডামার্কা নিগ্রোর সাথে লাগতে যাওয়া পাগলামি ছাড়া কিছুই নয়। তাকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে তারা অর্ধেক তৈরি বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেল।
শহীদ শেষ বারের মতো তার বাড়ির দিকে চেয়ে দেখলো কামাল, মহুয়া, লীনা তেমনি গল্প করছে। গফুর চা নিয়ে এসে রাখছে টেবিলের ওপর। এতো কাছে রয়েছে ওরা তবু কেউ জানছে না শহীদের এখন কতো বড় বিপদ। ক্ষোভে দুঃখে শহীদের হাসি পেলো। ইশ! গকুর যদি একটু জানতে পারতো তার দাদামণি এখন কতো বড় বিপদে পড়েছে। গফুর আর শহীদ একসাথে থাকলে এই নিগ্রো কজন টের পেতে কার সাথে লাগতে গেছে ওরা।
ঘরের মধ্যে এনে শহীদকে একটা রশি দিয়ে পিছমােড়া করে বেঁধে ফেললো ও। তারপর হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে নিজেদের ভাষায় কি যেন বিড়বিড় করে বলতে লাগলো। শহীদ তার একবর্ণও বুঝলো না। মিনিট কয়েক ওরা সেইভাবে অনবরত বলেই গেল। তারপর একজন উঠে গিয়ে ঘরের কোণে রাখা একটা লম্বা বাক্সের ডালা খুলে ফেললো। সেই লম্বা লোকটা এবার তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বাক্সের দিকে চললো। শহীদের বুঝতে বাকি রইলো না, এবার তাকে বাক্সে পোরা হবে।
হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে ঝড়ের মতো একটা মূর্তি ঢুকলো ঘরে। কালো আলখাল্লা পরা, মুখে মুখোশ। কেউ ভালো করে কিছু বুঝবার আগেই সে পটাপট কয়েকটা ঘুসি চালিয়ে দিলো তিনজন কাফ্রির নাকের ওপর। কী প্রচণ্ড ঘুসি! যেমন বিরাট লম্বা চওড়া মূর্তি, তেমনি তার ঘুসির ওজন। নাকে হাত দিয়ে বসে পড়লো তিনজনই। সবচাইতে জোয়ান নিগ্রোটা শহীদকে ফেলে দিলে মাটিতে। তারপর ঘুসি বাগিয়ে প্রচণ্ড বেগে ছুটে গেল মূর্তিটার দিকে। সামান্য সরে গিয়ে কি যেন একটু করলো আগন্তুক। ছিটকে ওপাশের দেয়ালে অত্যন্ত জোরে ধাক্কা খেলো জোয়ান নিগ্রোটা।
মাথাটা ভীষণভাবে ঠুকে গেছে দেয়ালের গায়ে। টু শব্দটি না করে সে ঝুপ করে মাটিতে পড়ে গেল অজ্ঞান হয়ে। এদিকে বাকি তিনজনের একজন টলতে টলতে উঠে দাড়িয়েছে। তলপেটে প্রচণ্ড এক লাথি খেয়ে সে আবার মাটিতে ঘুরে পড়লো।
সর্দারের পকেট থেকে শহীদের রিভলভারটা বের করে নিলো আগন্তুক। এবার সে শহীদের দিকে এগিয়ে আসছে। পকেট থেকে একটা ছুরি বের করে শহীদের হাত পায়ের বাঁধন কেটে দিলো। তারপর পরিষ্কার বাংলায় বললো, চলো, তোমাকে কিছুদূর এগিয়ে। দিয়ে আসি।
শহীদ আগে আগে চলেছে, পিছনে আলখাল্লা ধারী। বাড়ির কাছাকাছি এসে শহীদ বললো, এসো বন্ধু, আজ মহুয়ার হাতের তৈরি চা খেয়ে যাও। তোমার এই উপকারের জন্যে কি বলে যে তোমায় ধন্যবাদ জানাবো ভেবেই পাচ্ছি না।
কোনো উত্তর নেই। শহীদ পিছন কিরে দেখলে কেউ নেই। তার অজান্তেই আগন্তুক কখন সরে পড়েছে।
শহীদের বুঝতে বাকি নেই, আলখাল্লাধারী কুয়াশা ছাড়া আর কেউ নয়। আর কারও এতো বড় বুকের বল নেই যে চারজন ষণ্ডামার্কা নিগ্রোর সাথে খালি হাতে একা লড়তে যাবে।
কিন্তু কুয়াশার তো তার ওপর প্রতিশোধ নেয়ার কথা। সে তাকে এমন অযাচিত ভাবে বিপদ থেকে উদ্ধার করবে কেন? সে তার বোনকে বিয়ে করেছে বলে? কিংবা ভালবাসা? শহীদ ঠিক বোঝে না। কুয়াশার প্রতি শ্রদ্ধায় তার মাথা নত হয়ে আসে।
কিন্তু এই নিগ্রোগুলো তাকে বন্দী করেছিল কেন? ওই বাক্সেতে পুরে ওকে কি পাচার করবার মতলবে ছিলো ওরা? কিন্তু কেন? কোথায়?
নানা প্রশ্ন তার মাথায় জট পাকায়। কোনটারই সমাধান পায় না সে।
২.
পরদিন বিকেল বেলা। বৃষ্টি পড়েই চলেছে। মাঝে মাঝে দুই এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে ঢুকছে শহীদের ড্রইংরুমের খোলা জানালা দিয়ে। বৃষ্টির কণাও কিছু কিছু এসে দামী পুরু কার্পেটের খানিকটা ভিজিয়ে দিয়েছে। বাতাসের ঝাপটার সাথে সাথে খুব সূক্ষ্ণ বৃষ্টির কণা এসে লাগছে চোখে মুখে।
লম্বা সোফাটায় শুটিসুটি মেরে শুয়ে শহীদ সঞ্চয়িতা পড়ছে আর মাঝে মাঝে বাইরে বৃষ্টির দিকে চেয়ে কি যেন ভাবছে। শহীদ দেখছে ভিজছে কার্পেটটা। ভিজুক, উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করতে ইচ্ছে করে না।
বাইরে রহস্যময় বিরাট বট গাছটা যেন তার মনের মধ্যে কতো কী গোপন করে নীরবে চেয়ে রয়েছে তার দিকে। যেন একটা বক। এক পায়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে মাছের অপেক্ষা করছে। না, না, বক না, একটা মস্তবড় হিংস্র জংলী হাতী। কী এক যাদুমন্ত্রে শান্ত হয়ে কেবল চেয়ে রয়েছে, আর ভিজছে।
আরও দূরে দৃষ্টি যায় শহীদের। দূরে একটা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। একটা লম্বা বাঁশের আগায় একটা ঝাড়ু আর টুকরি বাঁধা। বৃষ্টির দিন, তাই কাজ বন্ধ। আরেকটা বাঁশের মাথায় একটা কাক বসে বসে ভিজছে।
কি ভাবছো চুপচাপ? মহুয়া এসে ঢুকেছে কখন ঘরে, আরে বেশ তো তুমি, কার্পেটটা ভিজে যাচ্ছে আর নিশ্চিন্ত শুয়ে আছো। কাঁচের জানালা বন্ধ করে দিলো সে। তারপর কাছে এসে মাথার কাছে একটা সোফায় বসে শহীদের চুলের মধ্যে হাত চালিয়ে দিলো।
কামাল কই?
লীনাকে অঙ্ক বুঝিয়ে দিচ্ছে।
ওরা দুজনেই হাসলো। কামাল চিরকাল অঙ্কে লাড্ডু পেতো। লীনার ম্যাট্রিক পরীক্ষার আর মাত্র একমাস বাকি। তাই কামালকে আবার শহীদের কাছ থেকে অঙ্ক শিখে নিয়ে ওকে শেখাতে হচ্ছে। কামালের সদা চিন্তিত মুখ দেখলে মনে হয় পরীক্ষা যেন ওরই।
মুহু, কী যেন খেতে ইচ্ছে করছো, শহীদ আবদারের সুরে বলে।
গফুরকে বড়া ভাজতে দিয়ে এসেছি। হয়ে গেছে প্রায়।
না, বড়া না, কী যেন আরেকটা জিনিস! হাত বাড়ায় শহীদ।
ধেৎ, কেউ দেখে ফেলবে যে! এই, না, সত্যি…
গফুর একটু কাশি দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকলো। এক থালা ভর্তি বড়া। শহীদ সুবোধ বালকের মতো মিটমিট করে চেয়ে রইলো। টেবিলের ওপর থালাটা রেখে গফুর বললো, কামাল ভাই আর ছোটো আপাকে ডেকে দেবো দিদিমণি?
দাও।
গফুর চলে গেল। একটু পরে কামাল আর লীনা এসে ঢুকলো ঘরে। বড়া দেখেই কামাল পুলকিত হয়ে উঠলো। একটা বড় মুখে পুরে এক কামড় দিয়েই আর্তনাদ করে আবার হাতে নিলো। বড়ো গরম!
শহীদের মাথার কাছে বন্ধ করে রাখা সঞ্চয়িতা তুলে নিয়ে পাতা ওল্টাতে থাকলো লীনা। বোধকরি একটা কবিতা আবৃত্তি করবার ইচ্ছা আছে, ভালো কবিতা খুঁজছে। হঠাৎ একটা চার ভাঁজ করা কাগজ বই থেকে বের করে শহীদকে জিজ্ঞেস করলো, এটা কী দাদামণি? এটা তো এ বইয়ের মধ্যে ছিলো না?
ওটা বাবার একটা চিঠি। মার কাছে লেখা। আজ সকালে মার হাতবাক্স ঘাঁটতে, ঘাঁটতে পেয়ে গেলাম। কামালের দিকে ফিরে বললো, এই চিঠির দুএকটা জায়গা, পড়ছি। শুনে রাখ, পরে তোর সাথে আমার অনেক কথা আছে।
শহীদ হাত বাড়িয়ে লীনার কাছ থেকে চিঠিটা নিলো। অনেক দিনের পুরনো চিঠি, কাগজটা হলদে হয়ে গেছে। জায়গায় জায়গায় কালি চুপসে গেছে, পড়া যায় না। কিছুক্ষণ চিঠিটার ওপর চোখ বুলিয়ে শহীদ পড়তে শুরু করলোঃ
আমাদের স্টীমার এখন তেলাগোয়া উপসাগরের মধ্য দিয়া লরেঞ্জো মারকুইসের দিকে চলিয়াছে। আগামীকাল আমরা সেখানে পৌছাইব।
কতকগুলি সামুদ্রিক পাখি আজ দুপুর হইতে স্টীমারের চতুষ্পার্শ্বে ঘুরিতেছে। এখন সূর্য অস্ত যাইতেছে। কেবল ইঞ্জিনের ধিকি ধিকি শব্দ ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নাই। এই নিস্তব্ধতা বড় ভালো লাগিতেছে। ডেকের ওপর আমার পাশের চেয়ারে বসিয়া ইকবাল– সেও মুগ্ধ হইয়া বাহিরে চাহিয়া রহিয়াছে। মেঘগুলি সিদুরের মতো লাল হইয়া গিয়াছে। তাহার ছায়া আবার জলে পড়িয়াছে; ফলে চতুর্দিকে কেবল লাল আর লাল।
ডারব্যান হইতে কতকগুলি নিগ্রো আমাদের স্টীমারে উঠিয়াছে। আমার সহিত অত্যন্ত ভাব জমিয়া গিয়াছে। ইহারাও লিম্পোপো নদী দিয়া দক্ষিণ রোডেশিয়ায় যাইবে। ইহাদের ভাষা আমরা একেবারেই বুঝি না, তবু ইহাদের ভাবে ভঙ্গিতে বন্ধুত্ব করিবার ইচ্ছা দেখিয়া আমরা অত্যন্ত খুশি হইয়াছি। বিশেষ করিয়া আমাকে ইহারা অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। রোজ সন্ধ্যায় ইহারা আসিয়া আমার সামনে হাঁটু গাড়িয়া উহাদের নিজেদের ভাষায় কি কি সব উচ্চারণ করে। আমি একবর্ণও বুঝি না, কেবল মাথা নাড়ি।
এই নিগ্রোগুলি বান্টু শাখাভুক্ত। ইহারা যেমন সাহসী ও বলিষ্ঠ তেমনি হিংস্র। আমার সহিত স্টীমারের একজন খালাসী সামান্য দুর্ব্যবহার করিয়াছিল। আজ দুইদিন যাবৎ তাহাকে পাওয়া যাইতেছে না। আমার যতদূর বিশ্বাস এই নিগ্রোগুলি তাহাকে খুন করিয়া জলে ফেলিয়া দিয়াছে। কারণ আমার সহিত খালাসীর ঝগড়ার সময় তাহাদিগকে অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া উঠিতে দেখিয়াছিলাম।
এহেন হিংস্র, বলিষ্ঠ ও সাহসী পথপ্রদর্শক লইয়া আমাদের লিম্পোপোর কুমীর নিধনে বিশেষ সুবিধা হইবে। জার্মান গভর্নমেন্ট ইদানীং ঘোষণা করিয়াছে প্রতিটি কুমীরের জন্য এক পাউও করিয়া পুরস্কার দিবে…
তোমার নিকট হইতে আমি এখন সাড়ে চার হাজার মাইল দূরে কিন্তু বিশ্বাস করে৷ সানী, এক মুহূর্ত তোমাকে ভুলিয়া থাকিতে পারি না। অনেক রাতে যখন একফালি চাঁদ উঠে আকাশে, ভৌতিক চাঁদ-আবছা আলো, আবছা অন্ধকার-তখন জাগিয়া বসিয়া তোমার কথা ভাবি। তুমি যদি কাছে থাকিতে!…ইত্যাদি ইত্যাদি।
চাচাজান আর বাবা কি তাহলে কেবল শিকার করতে যাননি, টাকা পয়সার ব্যাপারও ছিলো? কামাল জিজ্ঞেস করলো।
টাকার কথা একটা আছে অবশ্যই, কিন্তু টাকা তাঁদের কম ছিলো না। আসলে গেছিলেন শিকার করতেই, সেই সাথে যদি কিছু টাকাও আসে তো মন্দ কি?
টাকা দেবে কে?
জার্মানী যখন গত মহাযুদ্ধে টাঙ্গাইনিকা দখল করে তখন ঘোষণা করে লিম্পোপো নদীর কুমীর শেষ করতে হবে। প্রতিটি মৃত কুমীরের জন্যে এক পাউণ্ড পুরস্কার। আমার বাবা আর তোমার বাবা গেছিলেন আসলে শিকার করতে। ওখানে গিয়ে যতদূর সম্ভব তাঁর পুরস্কারের কথা জানতে পারেন।
আচ্ছা, তোমরা ওদের মৃত্যু সংবাদ পেলে কি করে? মহুয়া প্রশ্ন করে।
লরেঞ্জো মারকুইস থেকে অ্যান্ডারসন বলে এক সাহেব, দয়া করে জানিয়েছিল।
শহীদ কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইলো। বেশ জোরে বৃষ্টি নেমেছে। গফুর কফি নিয়ে এলো চার কাপ।
কফিতে এক চুমুক দিয়ে কামাল বললো, একটা গান গাও তো মহয়াদি, শ্রাবণের গান
এই বিকেল বেলা কি ভালো লাগবে?
খুব ভালো লাগবে, গাও তো তুমি। আমি সাথে পিয়ানো বাজাবো।
কামাল উঠে গিয়ে পিয়ানোর সামনে বসলো। একটু কেশে নিয়ে শুরু করলো, মহুয়া।
আমি শ্রাবণ আকাশে ওই, দিয়াছি পাতি
মম জল ছল ছল আঁখি মেঘে মেঘে…
যেমন সুন্দর সুর, তেমনি গলা। কলির শেষে এতো সুন্দর করে মীড় টানে মহুয়া! সাথে কামালের পাকা হাতে পিয়ানো, সমস্ত আবহাওয়া একেবারে গম্ভীর করে দিয়েছিল। আজকের এই বাদলা দিন যেন সম্পূর্ণ সুন্দর হলো গানটা শুনে। সবাই অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো। মহুয়া উঠে দাঁড়িয়ে বললো, লীনা, ভুনিখিচুড়ি তৈরি করা শিখবে বলে, চলো আজ খিচুড়ি রাঁধবো।
মহুয়া আর লীনা চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। কামাল কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে বসে রইলো। তারপর শহীদকে বললো, কি কথা বলবি বলে?
হ্যাঁ, কাছে আয়।
কামাল কাছের একটা সোফায় এসে বসলো। শহীদ বললো, শোন, তোকে গোড়া থেকে ব্যাপারটা বলি। এই যে চিঠিটা দেখছিস পকেট থেকে একটা খাম বের করলো। শহীদ, এটা আজ সকালের ডাকে আফ্রিকা থেকে এসেছে। না, না, বাবা বা কাকা কারও লেখা নয়; কুফুয়া নামে একজন আফ্রিকান ব্যবসায়ীর কাছ থেকে এসেছে।
বাবা আর কাকা গেছিলেন সিম্পোপো নদীতে কুমীর শিকার করতে। জার্মেনী তখন ঘোষণা করেছে প্রতিটি কুমীরের জন্যে এক পাউণ্ড করে পুরস্কার দেবে। বাবা আর কাকা এই ব্যবসায়ী কুফুয়ার সাথে যোগ দিয়ে কয়েকশো লোক জোগাড় করে কেবল মাত্র নদীর এক মাইল ঘেরাও করেই সাড়ে নয় হাজার কুমীর একদিনে মারেন। পরে আরও অনেক কুমীর এদের হাতে মারা পড়ে। ঠিক ঠিক টাকা দেয় জার্মান গভর্নমেন্ট। কিন্তু তাদের কুমীর নির্বংশ করার plan বাতিল করে দেয়। তোর বাবা হঠাৎ একদিন বেকায়দায় কুমীরের পাল্লায় পড়ে বাবা আর কুফুয়ার চোখের সামনে তলিয়ে গেলেন লিষ্পেপোর মধ্যে। বাবা নাকি ভীষণ আঘাত পেয়ে পাগলের মতো হয়ে যান। রাইফেল কাঁধে লিস্পোপের ধারে ধারে দিন নেই রাত নেই পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতেন তিনি। কয়েকদিনের মধ্যে বহু কুমীর মারেন বাবা। তারপর একদিন তিনিও আর ফিরে এলেন না।
আমাদের ঠিকানা কুফুর কাছে ছিলো। সে জানতে আমাদের পরিবারে বড় আর কেউ নাই। তাই আজ সতেরো বছর পর আমরা যথেষ্ট বড় হয়েছি মনে করে চিঠি লিখেছে। আমার আর তোর সাত হাজার পাউণ্ড, অর্থাৎ প্রায় নব্বই হাজার টাকা কুফুয়ার কাছে জমা আছে। আমরা যেন সেখানে গিয়ে সে টাকার একটা ব্যবস্থা করে আসি, তার জন্যে সে আমাদের সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। লিখেছে, বাবারা, আমার প্রচুর টাকা আছে, বন্ধুর ছেলেদের টাকা আত্মসাৎ করে আমি স্বর্গে যেতে পারবো না। তোমাদের টাকা পয়সা তোমাদের বুঝিয়ে দিয়ে আমি শান্তিতে মরতে চাই। তোমরা যতো শিগগির পারো রওনা হয়ে যাও। নইলে এই বুড়ো বয়সে আমাকে আবার যেতে হবে তোমাদের দেশে।
অদ্ভুত ভালো বুড়ো তো! কিন্তু একটা কথা আমার মনে হচ্ছে। কিছু Conspiracy-ও থাকতে পারে। কয়েকদিন ধরে কয়েকজন নিগ্রোকে এই বাড়ির আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখছি কেন বলতো? ঢাকায় নিগ্রো, আফ্রিকা থেকে চিঠি, কেমন সন্দেহ হচ্ছে।
তোরও নজর পড়েছে দেখছি! শহীদ হাসলো। তারপর গত সন্ধ্যার ঘটনা সবিস্তারে বললো কামালকে। সবটুকু মন দিয়ে শুনে কামাল বললো, খুবই Serious বলে মনে হচ্ছে। ব্যাপার কিছু আঁচ করেছিস?
কিছু মাত্র না। আমি সকালে মার হাতবাক্স খুললাম। বাবার কোনও চিঠিপত্র থেকে কিছু বোঝা যায় কিনা দেখতে। একটা জায়গা একটু মিলেছে। চিঠিতে একখানে বাবা লিখেছেন কয়েকজন নিগ্রো স্টীমারে রোজ সাঁঝে তাঁর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বিড় বিড় করে কি মন্ত্র আওড়াত। কাল সাঁঝে আমাকে হাত পা বেধে ওরা আমার সামনেও হাঁটু গেড়ে বসে মন্ত্র আওড়েছিল। মনে হয় এই নিগ্রোগুলো সেই একই দলের লোক, অথবা একই উপজাতি বা শাখার লোক।
সে যাক। এখন কি ঠিক করলি? যাবি লিম্পোপো নদীতে?
তাই জিজ্ঞেস করতেই তো তোকে ডাকলাম। আমার তো পুরোপুরি যাবার ইচ্ছে আছে। কিন্তু তোর মা ভীষণ কান্নাকাটি করবেন তুই যেতে চাইলে।
কিছু না। তুই গিয়ে খালি একবার মাকে বলবি, ব্যাস আর কিছু লাগবে না। তোর সাথে মা আমাকে দোজখেও পাঠাতে রাজি হবে।
এদিকে আবার মহুয়াও কান্নাকাটি করবে। ও কিছুতেই যেতে দিতে চাইবে না।
মহুয়াদিকে সঙ্গে নিয়ে যাবি।
বাঃ! Good idea! আমার মাথায় এ কথা একেবারেই আসেনি! পাটিগণিত করে তোর বুদ্ধি খুলে গেছে। শহীদ খুশি হয়ে উঠলো।
কিন্তু আমি যে কামাল আহমেদ আর তুই যে শহীদ খান, তা প্রমাণ করবি কি করে? আফ্রিকায় গেলাম, তখন যদি কুফুয়া বলে তোমাদের পরিচয় প্রমাণ করো, তখন?
বারে। আমাদের পাসপোর্ট থাকবে না সাথে? পাসপোর্টেই তো ছবি থাকবে।
পাসপোর্ট করে কোথায় যাওয়া হচ্ছে তোমাদের? মহুয়া এসে ঢুকলো ঘরে। ঠোঁটের একটু ওপরে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মিষ্টি মুখটা আরও মিষ্টি লাগছে।
কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে শহীদ বললো, আফ্রিকা।
মহুয়া ভাবলো শহীদ ঠাট্টা করছে। হেসে কামালের দিকে চাইলো। কামালের গম্ভীর মুখ দেখে ওর বুকটা ছাঁৎ করে উঠলো।
আফ্রিকা? আফ্রিকা কেন?
লিম্পাপো নদীতে কুণীর শিকার করতে।
ধ্যাৎ, ঠাট্টা করছো।
না মুহ, ঠাট্টা না। সত্যিই যাচ্ছি।
কিছুতেই তোমাদের যাওয়া হতে পারে না।
যে কোনও অবস্থায় আমাদের যাওয়া চাই-ই, গম্ভীরভাবে বলে শহীদ।
আমার কথা শুনবে না? মহুয়ার চোখ ছল ছল করে।
দেখ, কামাল, মেয়ে মানুষের একমাত্র অস্ত্র তুলে নিয়েছে মহুয়া, আর একটু হলেই প্রয়োগ করবে।
মহুয়া হেসে ফেলে বললো, তাহলে বলো সত্যি সত্যিই আর যাচ্ছে না। বিয়ে করে, একটা মেয়ের ইহকাল পরকাল নষ্ট করে ওসব দেশে যাবার কথা ভাবতে হয় বুঝি?
সত্যি সত্যিই আমরা যাচ্ছি মহুয়াদি। তবে তুমি যদি কান্নাকাটি করো সেই ভয়ে তোমাকেও সাথে নেয়ার প্রস্তাব করেছি শহীদের কাছে। তাহলে রাজি আছে তো যেতে দিতে?
নাই বা গেলে অমন দেশে কামাল ভাই।
অনেক কারণ আছে যে যাবার।
কি কারণ?
শহীদ বললো, তোমাকে পরে সব বলবো মহুয়া। আমরা চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই চিটাগাং থেকে রওনা হবো। গফুরকে বললেই হবে, ওই সমস্ত জিনিসপত্র বেধেছেদে ঠিক করে ফেলবে।
লীনা এসে ঢুকলো। কোথায় যাবে তোমরা দাদামণি?
আফ্রিকা।
সত্যি?
মহয়াদিও?
হাঁ।
আমিও যাবো। আবদার ধরে লীনা।
তুই কি করে যাবি। তোর তো সামনে পরীক্ষা। তুই ততোদিন চাচী-আম্মার কাছে থাকবি, আমরা যতো শিগগির পারি ফিরে আসবো।