What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কিশোর গল্প (হুমায়ুন আহমেদ) (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
325
Messages
5,984
Credits
44,713
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
গোবর বাবু


নীলগঞ্জ হাইস্কুলের ড্রিল স্যারের নাম ইয়াকুব আলি। বয়স পঞ্চাশের উপর। বেঁটে-খাটো মানুষ। সাধারণত ড্রিল স্যারদের স্বাস্থ্য খুব ভালো হয়ে থাকে। ইয়াকুব আলি সাহেব ব্যতিক্রম। ভয়ংকর রোগা। বছরের বেশিরভাগ সময় পেটের অসুখে ভুগেন। যে ঋতুতে সে অসুখটা হওয়ার কথা তাঁর তা হয়। বসন্তকালে চিকেন পক্স কিংবা হাম হয়, বর্ষাকালে ভয়াবহ ধরনের ডায়রিয়া হয়। সারা শীতকাল খকখক করে কাশেন, এই সময় তার হাঁপানির টান ওঠে।

ভদ্রলোক নিতান্তই ভালমানুষ।

জগতের সমস্ত ভালোমানুষরা সরল ধরনের হয়ে থাকেন। ইয়াকুব সাহেব একটু বেশিমাত্রায় সরল। তার মাথায় স্বাস্থ্যরক্ষা অর্থাৎ ব্যায়াম ছাড়া কিছুই ঢুকে না। তিনি দুটি বই লিখেছেন–হাসতে হাসতে ব্যায়াম শিক্ষা এবং ছোটদের সহজ ব্যায়াম। টাকার অভাবে বই দুটি ছাপাতে পারছেন না।

তার বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এঁদের কোনো ছবি নেই। তিনটি বাঁধানো ছবি আছে–একটি গামা পালোয়ানের, একটি শ্যামাকান্তের, অন্যটি ভীম ভবানীর। এ ছাড়াও তার শোবার ঘরে একটা সূচিকর্ম আছে। চারদিকে লতা, ফুল, পাতা, মাঝখানে লেখা, স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। সূচিকর্ম তার স্ত্রীর করা। বিয়ের দ্বিতীয় বছরে ভদ্রমহিলা মারা যান। ইয়াকুব সাহেব দ্বিতীয়বার আর বিয়ে করেন নি।

ড্রিল ক্লাসে তিনি ছাত্রদের ব্যায়াম করান কবিতায়। এইসব কবিতা তাঁর নিজের লেখা। গানের মতো সুরে তিন মাত্রায় পড়তে হয়, সেই সঙ্গে ব্যায়াম করতে হয়। একেক ক্লাসের জন্য একেক ধরনের কবিতা। প্রাইমারি সেকশনের জন্য লেখা তার ব্যায়াম কবিতাটা এই রকম,

বায়ু বহে ভীম বেগে শব্দ শন শন।
এইবার দাও দেখি পাঁচ বুক ডন।।

[এইখানে ছাত্ররা পাঁচটা বুক ডন দেবে। বুক ডন শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলবে–]

দেখো দেখো উড়ে যায় সাদা সাদা বক
এইবার দাও দেখি দশ বৈঠক।।

[দশটা বৈঠক দিতে হবে। অতি দ্রুত।]

পাল তুলে চেয়ে দেখ চলে ছোট নাও।
কোমরে হাত রেখে সোজা দৌড়াও।।

[দৌড়ে স্কুলের মাঠে দুটা চক্কর দিতে হবে।]

ইয়াকুব আলি সাহেব নিতান্তই দরিদ্র ব্যক্তি। ড্রিল টিচার হিসেবে স্কুল থেকে সামান্যই বেতন পান। একা মানুষ বলে কষ্টেসৃষ্টে কোনোরকমে চলে যায়। শারীরিক কষ্ট। তার গায়ে লাগে না। তবে কেউ যখন ব্যায়াম বিষয়ে আজেবাজে কথা বলে তখন তার মনটা খুব খারাপ হয়।

আজ তাঁর মনটা খারাপ। শুধু খারাপ বললে কম বলা হবে, খুবই খারাপ। কারণ নীলগঞ্জ স্কুলের হেড স্যার ব্যায়াম নিয়ে তাকে কিছু কটু কথা বলেছেন। অথচ কটু কথা বলার মতো কিছুই তিনি করেন নি। ব্যাপারটা এরকম–তিনি টিচার্স কমন রুমে বসে লিখছিলেন। হেড স্যার ঘরে ঢুকে বললেন, ইয়াকুব সাহেব কি করছেন?

তিনি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, লিখছি স্যার।

কি লিখছেন?

স্যার, একটা গ্রন্থ রচনা করছি–ব্যায়ামের অ আ ক খ।।

হেডস্যার সঙ্গে সঙ্গে মুখ এমন করলেন যেন ব্যায়ামের অ আ ক খ লেখা খুব অন্যায়। তিনি খড়খড়ে গলায় বললেন, ক্লাস থ্রিতে একটু যান তো। ওদের অংক স্যার আসেন নি। ছাত্ররা খুব হৈচৈ করছে। গোটা কয়েক ভাগ অংক দিয়ে বসিয়ে দিন। পারবেন তো?

অবশ্যই পারব, স্যার।

ইয়াকুব সাহেব ক্লাসে গেলেন। রোল কল করে বোর্ডের কাছে চলে গেলেন। বোর্ডে বড় বড় করে লিখলেন–অংক। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, অংক জিনিসটা কি বলো তো?

কেউ বলতে পারল না। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, সামান্য জিনিস বলতে পারছিস না? অংক হচ্ছে মাথার ব্যায়াম। তাহলে ব্যায়াম কত রকমের হলোর দুরকম। শরীরের ব্যায়াম এবং মাথার ব্যায়াম। শরীরের ব্যায়ম ক ধরনের হয় তোরা জানিস? তোদের ক্লাসে ফার্স্ট বয় কে উঠে দাঁড়া দেখি?

ফার্স্ট বয় উঠে দাঁড়াল। ইয়াকুব সাহেব হতাশ গলায় বললেন, ও-কি, এমন বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়েছিস কেন? সোজা হয়ে দাঁড়া। বুক টান করে দাঁড়া। বুক টান করে দাঁড়ানোও এক ধরনের এক্সারসাইজ।

ভাগ অংক কিছুই করা হলো না। পুরো এক ঘণ্টা চলে গেল। ইয়াকুব স্যার জলের মতো বুঝিয়ে দিলেন বুকটান করে দাঁড়ানোর কি উপকারিতা। এতে ফুসফুসের কি হয়-এই সব।

ক্লাসের শেষে তিনি কমন রুমে এসে বসেছেন, হেডস্যার ডেকে পাঠালেন। থমথমে গলায় বললেন, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আপনার পড়ানো শুনছিলাম। এক সময় শুনি আপনি গান গাচ্ছেন। এর মানে কি?

ইয়াকুব সাহেব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, গান না স্যার। যোগ ব্যায়াম নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলাম। ছাত্রদের পড়ে শুনালাম। এই কবিতাটা গানের সুরে পড়তে হয়। তাই নিয়ম।

অংকের ক্লাসে আপনি যোগ ব্যায়ামের কবিতা পড়াচ্ছেন, এর মানে কি?

ইয়াকুব সাহেব মাথা চুলকাতে লাগলেন। হেড স্যার কঠিন স্বরে বললেন, আমার তো ধারণা আপনার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে।

খারাপ হয় নি, স্যার।

আপনি বললে তো হবে না, আমরা দশজন যা দেখছি তাতে আমাদের ধারণা হয়েছে, আপনার মাথা পুরো এলোমলো অবস্থায় আছে। সবাই আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করে এটা জানেন?

জি না।

তা তো জানবেনই না। আপনাকে নিয়ে যে হাসি-তামাশা হয় তা বোঝার মতো বুদ্ধিও তো আপনার নেই। শুনছি ইদানীং না-কি ঘাস খাচ্ছেন। এটা কি সত্যি?

ইয়াকুব সাহেব জবাব দিলেন না। চুপ করে রইলেন। তাঁর নীরবতার কারণ হচ্ছে ঘাস খাওয়ার ব্যাপারটা সত্যি। তার ধারণা হয়েছে ঘাসে প্রচুর ভিটামিন। সেই ভিটামিন কাজে লাগানো যায় কি-না তা পরীক্ষা করে দেখছেন। আধাসের কচি ঘাসে এক তোলা সোডা দিয়ে ঘন্টা খানিক জ্বাল দিয়েছেন। থকথকে সবুজ জেলির মতো একটা বস্তু তৈরি হয়েছে। রোজ বিকেলে চিনি দিয়ে তিনি সেই বস্তু দুচামচ করে খান।

কি, কথা বলছেন না কেন? ঘাস খাচ্ছেন না-কি?

জি স্যার, খাচ্ছি?

খেতে কেমন?

খেতে ভালো না, তবে বলকারক।

হেডস্যার থমথমে গলায় বললেন, লোকে যখন জানবে এই স্কুলের একজন প্রবীণ শিক্ষক রোজ ঘাস খাচ্ছেন তখন স্কুল সম্পর্কে তাদের কি ধারণা হবে বলুন দেখি?

আপনি যদি নিষেধ করেন তাহলে আর খাব না।

na, আমি নিষেধ করব না। আপনার ইচ্ছা হলে ঘাস খাবেন, কাঁঠাল পাতা খাবেন, কচুরিপানা খাবেন। আপনি খাবেন রুচিমত–আমি সেখানে বলার কে? তবে ঢাকঢোল পিটিয়ে খাবেন না। গোপনে খাবেন।

জি আচ্ছা।

শুধু একটা কথা আপনাকে বলি–ব্যায়াম নিয়ে হৈচৈ করবেন না। স্কুল পড়াশোনার জায়গা। কুস্তির আখড়া না। ব্যায়াম প্রসঙ্গে একটি কথাও যেন আর না শুনি।

বই কি লিখতে পারব স্যার?

কি বই?

ছোটদের ব্যায়ামের অ আ ক খ।

আপনি আমার সামনে থেকে যান।

তিনি বিষণ্ণ মুখে বের হয়ে এলেন। তাঁর মনটা ভেঙে গেল। রোজ যথানিয়মে স্কুলে যান। টিচার্স কমন রুমে চুপচাপ বসে থাকেন। বিকেলে বাসায় ফিরে আসেন। তাঁকে কোনো ক্লাস দেয়া হয় না। এমনকি পিটি ক্লাসও না। ব্যায়ামের বইটা লেখার চেষ্টা করেন। লেখা তেমন আগায় না। মন ভার না থাকলে লেখা আসে না।

দেখতে দেখতে ম্যাট্রিক পরীক্ষা এসে গেল। কোচিং ক্লাস শুরু হয়েছে। রোজ তিন ঘণ্টার কোচিং-ইংরেজি, অংক, ইলেকটিভ অংক, বিজ্ঞান। স্কুলের গত বছরের রেজাল্ট খারাপ হয়েছে, এবার যেন খারাপ না হয়।

এই সময় ইয়াকুব সাহেব এক কাণ্ড করলেন। এক সকালে হেড স্যারের ঘরে উঁকি। দিয়ে বললেন, স্যার আসব?

জরুরি কিছু না থাকলে আসবেন না। কাজ করছি।

খুব জরুরি।

আসুন। বলুন কি ব্যাপার?

ইয়াকুব সাহেব হড়বড় করে বললেন–ম্যাট্রিকের ছাত্রদের তো কোচিং হচ্ছে। আমি ভাবছিলাম এই সঙ্গে এক ঘণ্টা ব্যায়ামের কোচিং দিয়ে দিলে খুব ভালো হয়।

হেডস্যার হতভম্ব হয়ে বললেন, ব্যায়ামের কোচিং মানে? কি বলছেন আপনি?

ছাত্রদের এক ঘন্টা করে ব্যায়াম করা। ফ্রি হ্যাঁন্ড এক্সারসাইজ, বৈঠক, বুকডন আর যোগ ব্যায়াম। যোগ ব্যায়ামের মধ্যে থাকবে–প্রাণায়াম এবং কুম্ভক। সব লিখে এনেছি।

ইয়াকুব আলি সাহেব খাতাটা এগিয়ে দিলেন। খাতায় ছক টেনে সবকিছু লেখা। কোন বারে কি ব্যায়াম, কতক্ষণের ব্যায়াম সব সাজানো আছে।

একেবারে সিলেবাস বানিয়ে নিয়ে এসেছেন?

জি স্যার।

কেন এটা করেছেন জানতে পারি?

পরীক্ষার আগে আগে স্বাস্থ্যটা ঠিক রাখা খুবই জরুরি। স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে একটু কঠিন প্রশ্ন দেখলেই মাথা ঘুরে পড়ে যাবে এবং পরীক্ষার আগের রাতে একশ তিন জ্বর এসে যাবে। এতদিনের পরিশ্রম সব গেল।

হেড স্যার হিমশীতল গলায় বললেন, আপনি কি আমার সঙ্গে ফাজলামি করছেন না–কি?

জি না স্যার, ফাজলামি করব কেন?

আমার তো আপনার কথাবার্তা শুনে সে রকমই ধারণা হচ্ছে।

আপনি যদি উত্তেজিত না হয়ে আমার খাতার ছকগুলি একটু পরীক্ষা করে দেখেন, খুব যত্ন নিয়ে করেছি। প্রচুর মেধা ব্যয় করেছি।

শুনুন ইয়াকুব আলি সাহেব, আপনি আর স্কুলে আসবেন না।

কি বললেন স্যার?

আপনি আর স্কুলে আসবেন না। আমার ধারণা আপনার ব্রেইন ডিফেক্ট হয়ে গেছে। আপনার স্কুলে আসা মানে স্কুলের জন্য সমস্যা। আমি স্কুল কমিটিতে বিষয়টি তুলব। তারা যা সিদ্ধান্ত নেয় নেবে।

স্কুলে না এসে আমি করবটা কি স্যার?

বাড়িতে বসে ব্যায়াম-কবিতা লিখবেন এবং ঘাসের চাটনি খাবেন। এখন আমার সামনে থেকে যান। এ কি, খাতা না নিয়ে চলে যাচ্ছেন কেন? খাতা নিয়ে যান।

তিনি বাড়িতে চলে এলেন। মন অসম্ভব খারাপ। বয়স কম হলে চিৎকার করে কাঁদতেন। এই বয়সে চিৎকার করে কাঁদা মানায় না বলে কাঁদতেও পারছেন না। সত্যি সত্যি চাকরি চলে গেলে গভীর সমুদ্রে পড়তে হবে। খাবেন কি?

ঘাসের চাটনি জিনিসটা বলকারক হলে অতি অখাদ্য। কষটা তিতকুটে ভাব আছে। মুখে নিলেই বমি ভাব হয়, নাড়িভুড়ি উল্টে আসে। এই বস্তু খেয়ে জীবনধারণ করা নিতান্তই অসম্ভব। প্রাইভেট টিউশানিও যে করবেন সে উপায় নেই। কে আর ব্যায়ামের জন্যে প্রাইভেট টিউটর রাখবে?

তিনি দুপুরে কিছু খেলেন না। রাতেও কিছু খাবেন না বলে ঠিক করে রেখেছিলেন। শেষমেশ ক্ষিদের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে খিচুড়ি রাঁধতে বসলেন। ভোলা উনুনে রান্না হচ্ছে। তিনি দরজার দিকে পেছনে ফিরে বসেছেন, হঠাৎ মনে হলো কে যেন দরজার পাশে এসে দাঁড়াল। চিকন গলায় বলল, জনাব আপনার সঙ্গে কি একটা কথা বলব?

ইয়াকুব আলি বললেন, কে?

আমাকে তো জনাব চিনবেন না। যদিও আমি আপনার প্রতিবেশী।

খিচুড়ি ধরে গিয়েছে। চামচ দিয়ে প্রবল বেগে নাড়তে হচ্ছে বলে ইয়াকুব সাহেব দরজার দিকে তাকাতে পারছেন না। খিচুড়ি নাড়তে নাড়তে বললেন, কোন বাড়িতে থাকেন, বলুন। বললেই চিনব। আমি তো জনাব কোনো বাড়িতে থাকি না, আম গাছে থাকি। আপনার বাসার পেছনে যে আমগাছ আছে ঐ আমগাছে থাকি।

আম গাছে থাকেন মানে? আপনি কে?

আমি স্যার একজন ভূত।

ইয়াকুব সাহেবের মনে হলো তিনি কানে ভুল শুনেছেন। ভূত আবার কি? ভূত প্রেত থাকে বাচ্চাদের রূপকথার বই-এ। নিশ্চয়ই কোনো দুষ্ট ছেলে ফাজলামি করছে। তিনি খিচুড়ির হাঁড়ি চুলা থেকে নামিয়ে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালেন। চারদিকে ফকফক চাঁদের আলো। কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। এটা কি স্বপ্ন স্বপ্ন হওয়া তো সম্ভব না। স্বপ্নে গন্ধ পাওয়া যায় না। তিনি খিচুড়ির গন্ধ পাচ্ছেন। খিচুড়ি ধরে গেছে। সেই ধরা খিচুড়ির পোড়া পোড়া গন্ধ।

ইয়াকুব সাহেব ভূতে বিশ্বাস করেন না, তবু তার গা ছমছম করতে লাগল। এসব কি হচ্ছে? তিনি কাঁপা গলায় বললেন, কে? কে কথা বলছিল?

জি জনাব, আমি। আপনার পাশেই আছি। অদৃশ্য হয়ে আছি তো, এই জন্যে দেখতে পাচ্ছেন না। বড় আশা করে আপনার কাছে এসেছি, জনাব। অধীনকে নিরাশ করবেন না।

বাতাসের সঙ্গে কথা বলার কোনো মানে হয় না। তার যা করা উচিত তা হচ্ছে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে খেতে বসা। তবু তিনি নিজের অজান্তেই বলে ফেললেন, আমার কাছে কি ব্যাপার?

আমার সন্তানটাকে আপনার দরবারে নিয়ে এসেছি জনাব। বড় আশা করে এনেছি।

কি জন্যে এনেছেন?

ওর স্বাস্থ্যটা খুবই খারাপ। যদি দয়া করে তার শরীরটা ঠিক করে দেন। ব্যায়াম ট্যায়াম করান। এই বিষয়ে আপনার চেয়ে ভালো তো কেউ জানে না। আপনি হচ্ছেন বিশেষজ্ঞ অতি ওস্তাদলোক।

ইয়াকুব সাহেব মনে মনে খুশি হলেন। যা ঘটছে তা স্বপ্ন না চোখের ভুল তিনি জানেন না। তবু তো তাকে ব্যায়াম বিষয়ে কিছু ভাল কথা বলছে। এইটাইবা কে বলে?

স্যার, একটু দয়া করুন, মা-হারা সন্তান।

তিনি চমকে উঠলেন। ভূতদেরও মৃত্যু হয়। মানুষ মরে ভূত হয় শুনেছেন, ভূত মরে কি হয়?

ইয়াকুব সাহেব গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন, এই ছেলের মাতা কি গত হয়েছেন?

জি না স্যার, পালিয়ে গেছে। দুর্বল পাতলা ছেলে দেশে মনের দুঃখে দেশান্তরী হয়েছে। ভূত-সমাজে এরকম ছেলে জন্মে দিলে মার অপমান। সবাই ছিঃ ছিঃ করে। এখন যদি স্যার আপনি আপনার চরণ কমলে অধীনের সন্তানকে ঠাঁই দেন–মনটা শান্ত হয়। আমি ছেলের মার সন্ধানে যেতে পারি। ছেলেকে নিয়ে আপনার কোনো চিন্তা করতে হবে না স্যার। ছেলে নম্র-ভদ্র। আপনার খাটের নিচে শুয়ে থাকবে। ছোটখাটো কাজকর্ম করে দেবে।

কি কাজকর্ম করে দেবে?

এই ধরুন এক গ্লাস পানি আনা, থালা-বাসন ধোয়া। ভারী কাজ পারবে না স্যার। শরীর দুর্বল।

শরীর দুর্বল হলো কেন?

খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত করে না। না খেলে শরীরে বল হয়? স্যার আপনি বিচক্ষণ ব্যক্তি, আপনি বলুন। এই বিষয়ে আপনার চেয়ে বেশি কে জানে? এই যে রোজ বিকেলে দুচামচ করে ঘাসের চাটনি খাচ্ছেন, কি জন্যে খাচ্ছেন? শরীর ঠিক রাখার জন্যই তো খাচ্ছেন। জিনিসটা যে খেতে কি খারাপ সে তো খাবার সময় আপনার মুখ দেখেই বুঝতে পারি। ছেলেকে কত বার বলেছি এই লোকটাকে দেখে শেখ–স্বাস্থ্যের জন্য কত কষ্ট করতে হয়।

ইয়াকুব সাহেব ইতস্তত করে বললেন, ভূতদের খাদ্য কি?

আমাদের খাদ্য হলো স্যার-আলো। চাঁদের আলো। সূর্যের আলোও খাওয়া যায় তবে সহজে হজম হয় না। তারার আলো, মোমবাতির আলো–এইগুলো খুব ভালো। খেতে স্বাদ আছে। সহজে হজম হয়। বিশেষ করে মোমবাতির আলো তো খুবই উপকারী। তা স্যার মোমবাতির আলো তো আজকাল পাওয়াই যায় না। সব জায়গায় ইলেকট্রিক বাতি।

ইলেকট্রিক বাতির আলো খাওয়া যায় না?

আমরা খাই না। কেউ কেউ খায়। একেবারেই টেস্ট নেই। খেলে এল্যার্জির মতো হয়। হাত-পা ফুলে যায়। তবে স্যার জিনিসটার মধ্যে ভাইটামিন আছে।

ইয়াকুব সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, খাওয়া নিয়ে এত বাছবিচার করলে তো চলবে না। সব জিনিস খেতে হবে। এটা খাব ওটা খাব না করলে তো চলবে না।

এটা স্যার আপনি বুঝবেন। সন্তান আপনার হাতে তুলে দিয়েছে। যা করলে ভালো হয় করবেন। প্রয়োজনে শাসন করবেন। ওর স্বাস্থ্য ঠিক না হলে আমার আত্মহত্যা ছাড়া পথ থাকবে না। পানিতে ডুবে মরতে হবে। একজন ভূতের কাছে পানিতে ডুবে মৃত্যুর চেয়ে অপমানের মৃত্যু আর কিছুতেই হয় না।

ইয়াকুব সাহেব ভূতের কথায় খুব আনন্দ পেলেন। সন্তানের স্বাস্থ্য নিয়ে এই উদ্বেগ যদি মানুষদের মধ্যে থাকত তাহলে কত ভালো হতো। বাচ্চাদের পড়াশোনা নিয়ে বাবা মার যত চিন্তা তার একশ ভাগের এক ভাগ চিন্তাও স্বাস্থ্য নিয়ে নেই। ইংরেজি, অংকের জন্যে প্রাইভেট মাস্টার রাখে অথচ স্বাস্থ্যের জন্যে প্রাইভেট মাস্টার নেই। কি অন্যায়!

জনাব, যদি অনুমতি দেন তাহলে যাই।

যাবেন?

আমাকে তুমি করে বলবেন স্যার। আপনি বলে অধমকে লজ্জা দেবেন না।

ভূতের বিনয়ও তাঁর ভালো লাগল। বিনয় নামক ব্যাপারটা তো দেশ থেকে উঠেই যাচ্ছে। এটাও দুঃখের কথা। তবে পুরো ব্যাপারটা স্বপ্ন কিনা তাও তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। স্বপ্ন হতে পারে, আবার উত্তেজিত মস্তিষ্কের কল্পনাও হতে পারে। ইয়াকুব সাহেব গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন, আচ্ছা, ছেলেকে রেখে যাও, দেখি কি করতে পারি।

স্যার, আপনার অসীম দয়া। মনে বড় শান্তি পেলাম। ছেলেটাকে আরও আগেই আপনার কাছে আনা উচিত ছিল। আগে আনলে স্বাস্থ্যটা ইতোমধ্যে অনেকখানি ভালো হতো। মানুষজনকে ভয় দেখাতে শুরু করতে পারত।

ইয়াকুব সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ভয় দেখানো মানে?

ভূতের প্রধান কাজই তো ভয় দেখানো। আমরা করি কি স্যার সুযোগ পেলেই মানুষকে ভয় দেখাই। তা আমার ছেলে ভয় দেখাবে কি-সে নিজেই ভয়ে অস্থির। কি লজ্জার কথা ভেবে দেখুন। ভূতের ছেলে অথচ ভয় দেখাতে পারছে না। ঐদিন কি হলো শুনুন। রাত দশটার মতো বাজে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার টুপটাপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আপনাদের স্কুলের হেডস্যার ছাতা মাথায় দিয়ে বাজারে যাচ্ছেন। আমি ছেলেকে বললাম, বাপধন, একটা কাজ কর তো, পেছন থেকে গিয়ে হেডস্যারের ছাতাটা টেনে ধর। দেখ, উনি কেমন ভয় পান। তা ছেলে এই কাজ করবে না। তার সাহস নেই। বুক নাকি ধড়ফড় করে। কি লজ্জার কথা! আমার ছেলের এই হল সাহসের নমুনা।

তোমার বুঝি খুব সাহস?

নিজের কথা নিজের মুখে বলা ঠিক না, আত্মপ্রশংসা হয়। তবে স্যার আপনাদের দশজনের দোয়ায় হাজার হাজার মানুষকে ভয় দেখিয়েছি। নীলগঞ্জ থানার ওসি সাহেবকে কি আপনার মনে আছে? ইয়া জোয়ান। ভূত-প্রেত কিছুই বিশ্বাস করেন না। অসীম সাহস। এমন ভয় দেখিয়েছি তাঁকে যে একেবারে হার্ট অ্যাটাকের মতো হয়ে গিয়েছিল। ঘটনাটা আপনাকে সংক্ষেপে বলি–ওসি সাহেব রাত একটার সময় দলবল নিয়ে আসামি ধরতে যাচ্ছেন, সাহসী লোক তো–আগে আগে যাচ্ছেন। আমি করলাম কি, ঠিক তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, কেমন আছেন ওসি সাহেব?

ওসি সাহেব চমকে উঠে বললেন, কে, কে? কে কথা বলল?

আমি তখন তার অন্য কানের কাছে মুখ নিয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো আদুরে গলায় বললাম, এই খোকাবাবু গু খাবে?

ওসি সাহেব সঙ্গে সঙ্গে ফিট। সেটা একটা দেখার মতো দৃশ্য। হা হা হা। মনে হলেই আনন্দ হয়।

ইয়াকুব সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, কাজটা কি ঠিক হলো? এটা তো অদ্রতা। শুধু অদ্ৰতা না অসভ্যতাও। আমার কাছে থাকলে তো এসব চলবে না। আচার ব্যবহারও শিখতে হবে।

আপনি যা বলবেন তাই। আপনি দয়াপরবশ হয়ে আপনার চরণ কমলে আমার ছেলেটাকে আশ্রয় দিয়েছেন-এই যথেষ্ট। আপনার হাতে ছেড়ে দিয়েছি। এখন তাহলে স্যার যাই। যাবার আগে একটা কথা নিবেদন করতে চাই স্যার।

নিবেদন করো।

আমার সন্তানকে চরণে আশ্রয় দিয়েছেন এই জন্যে সামান্য উপহার দিতে চাই।

কি উপহার?

এক কলসি সোনার মোহর। বাদশাহ জাহাঙ্গীর আমলের। কলসিটা কোথায় তা আছে আপনাকে দেখিয়ে দেব, আপনি তুলে নেবেন।

এইসব লাগবে না। সামান্য কাজের জন্য আমি অর্থ গ্রহণ করি না।

আপনি এই কথা বলবেন আমি জানতাম। যাই স্যার।

আমগাছের ডালে একটা প্রবল ঝাঁকুনি হলো। তারপর চারদিকে নিঃশব্দ। ইয়াকুব সাহেব বললেন, কেউ আছে?

কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।

এই যে ভূতের ছেলে, তুমি কি আছ? তোমার নাম তো জানা হলো না?

কোনো উত্তর নেই। তিনি নিশ্চিত হলেন যে এতক্ষণ যা ঘটেছে সবই কল্পনা। কল্পনা ছাড়া কিছুই না। মাথা গরম হয়েছিল তাই এইসব দেখেছেন।

তিনি ঘরে ঢুকে খেতে বসলেন। তখনই ঘটনাটা ঘটল। তিনি দেখলেন পানি ভর্তি একটা গ্লাস ভাসতে ভাসতে তার দিকে আসছে। তার থালার পাশে এসে গ্লাসটা আপনাআপনি থেমে গেল। সুন্দর করে বসে গেল থালার পাশে। ইয়াকুব সাহেবের গা খানিকটা কেঁপে উঠল। বুক ধকধক করতে লাগল। এই জাতীয় দৃশ্য আগে দেখেন নি। কখনো দেখবেন তাও ভাবেন নি। ভূতের বাচ্চাটা তাহলে যায় নি। আছে। ঘরেই আছে। তিনি চাপা গলায় বললেন, তুমি আছ?

হুঁ

হুঁ না, বলো জি। এটা হলো দ্রতা। দ্রতা শিখতে হবে। খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?

না।

এ তো কোনো কাজের কথা না। এখনো জ্যোৎস্না আছে, যাও খেয়ে আসো।

ক্ষিদে নেই।

ক্ষিদে নেই বললে শুনব না। স্বাস্থ্য রক্ষার প্রধান নিয়ম হলো সময়মত খাওয়া দাওয়া করা। যাও বললাম, একটা মোড়া নিয়ে উঠানে গিয়ে বসো। আরাম করে চাঁদের আলো খাও। তোমাদের খাওয়ার নিয়ম-কানুন তো আমি ঠিক জানি না। চাঁদের আলো কেমন করে খাও? চিবিয়ে খাও না গিলে ফেলো?

সবাই চিবিয়ে খায়। আমি কুঁৎ করে গিলে ফেলি। ভালো লাগে না তো, এই জন্যে।

অসম্ভব, এখন থেকে গেলা চলবে না। একগাল করে চাঁদের আলো মুখে নেবে, বত্রিশ বার করে চিবুবে। এতে হজম ভালো হয়। বুঝলে?

হুঁ।

আবার হুঁ? বলো জি।

জি।

নাম কি তোমার?

ৎৎঘুঁৎ!

এই নাম তো উচ্চারণ করা সম্ভব না। তোমার নাম আমি দিলাম গোবর।

গোবর?

শুনেই আঁৎকে উঠলে। বিখ্যাত কুস্তিগীর গোবার পালোয়নের নামে তোমার নাম দিলাম। গোবার বাবু ১৯২০ সনে কুস্তিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ান হয়েছিলেন। বাঙালি ছেলে। ইংল্যান্ড, আমেরিকার সব বাঘা বাঘা কুস্তিগীরকে কুপোকাৎ করেছিলেন। তোমাকেও তাই হতে হবে। তুমি হবে ভূত-সমাজের গোবর বাবু। বুঝলে?

গোবর বাবু হতে চাই না।

চাইলেও হতে হবে। তোমাকে আমি গোবর বানিয়ে ছাড়ব। বুঝলে?

জি।

ব্যায়াম শুরু হবে কাল সকাল থেকে। চার্ট করে দেব। রুটিন দেখে দেখে ব্যায়াম হবে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটা নিয়েও আমি চিন্তা করব। কোন খাবারটা তোমার সবচে প্রিয়?

জোনাকি পোকার আলো।

আচ্ছা, জোনাকি পোকা কয়েকটা ধরে আনার চেষ্টা করব। আর শোনো, খাটের নিচে শোয়ার দরকার নেই। আমার সঙ্গেই ঘুমুবে। খাট বড় আছে, অসুবিধা হবে না। তোমরা কি দাঁত মাজ?

অন্যরা মাজে। আমি মাজি না, ভালো লাগে না।

তোমাকে দাঁত মাজতে হবে। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে একবার, ঘুম থেকে উঠার পর একবার।

জি আচ্ছা।

ইয়াকুব সাহেব রাতে ঘুমুতে গেলেন। ঘুম খুব ভালো হলো না। তার পাশে একটা ভূতের বাচ্চা শুয়ে আছে। তাকে দেখা যাচ্ছে না তবে সে যে আছে তা বোঝা যাচ্ছে। ভূতদের ব্যায়াম কিভাবে করতে হয় তিনি জানেন না। আস্তে আস্তে জানবেন। একটা বই লেখার চিন্তাও মাথায় ঘুরতে লাগল। বইটার নাম হবে–ভূতদের সহজ ব্যায়াম শিক্ষা।

স্কুল কমিটির বৈঠকে হেড স্যার খুব জোরালো বক্তব্য রাখলেন। বক্তব্যের বিষয়বস্তু হচ্ছে, একজন পাগল শিক্ষককে স্কুলে রাখার কোনো মানে হয় না। সে স্কুলের প্রতি হুমকি স্বরূপ। তাকে অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য করা উচিত। ইত্যাদি।

স্কুলের সেক্রেটারি আজমল সাহেব বললেন, ইয়াকুব স্যারকে তো আমি চিনি। আমার শিক্ষক ছিলেন। অতি ভালো মানুষ। তাকে পাগল বলছেন কেন? কি পাগলামি উনি করেছেন?

উনি ঘাস খাচ্ছেন।

ঘাস খেতে যদি উনার ভালো লাগে, খাবেন। শাকসবজি আমরা খাই না? কাঁচা লেটুস পাতা খাই, কি-খাই না? উনি হয়তো খোঁজ পেয়েছেন যে ঘাসে কোন নতুন ভাইটামিন আছে যা অন্য কিছুতে নেই। এতে পাগলামির কি দেখলেন? তেমন কোনো ভিটামিনের সন্ধান পাওয়া গেলে আমার তো মনে হয় আমাদের সবারই ঘাস খাওয়া উচিত।

হেডস্যার বললেন, ঘাস খাওয়া ছাড়াও সারাক্ষণ ব্যায়াম ব্যায়াম করেন।

তা তো করবেনই। তিনি হচ্ছেন ব্যায়ামের শিক্ষক। উনি ব্যায়াম ব্যায়াম করবেন? যিনি অংকের শিক্ষক তিনি করবেন অংক অংক। যিনি গানের শিক্ষক তিনি গান নিয়ে মাতামাতি করবেন। এ ছাড়া উনি আর কি করেছেন যার থেকে আপনার ধারণা হয়েছে উনি পাগল?

এস. এস. সি. পরীক্ষার কোচিং হচ্ছিল, উনি বললেন ব্যায়ামেরও কোচিং দরকার।

আমার তো মনে হয় অতি উত্তম কথা বলেছেন। পড়াশোনার প্রচণ্ড চাপের মধ্যে শরীরটা ঠিক রাখতে হবে। রুগ্‌ণ শরীর পড়াশোনার চাপ সহ্য করতে পারবে না। আপনি উনাকে বলুন ব্যায়ামের কোচিং শুরু করতে।

হেড স্যার বিমর্ষ গলায় বললেন, জি আচ্ছা, বলব।

আর শুনুন, চট করে একজনকে পাগল বলবেন না। এটা ঠিক না।

হেডস্যার শুকনো মুখে বের হয়ে এলেন। তার মেজাজ খুব খারাপ। বাসায় ফিরছেন। বাসা অনেকখানি দূর। মাইল খানিকেরও বেশি। পোস্টাফিসের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালেন। অন্ধকারে একটা লোক ঝোঁপের পাশে বসে আছে। হেডস্যার বললেন, কে ওখানে? কে?

স্যার আমি। আমি ইয়াকুব।

ওখানে কি করছেন?

জোনাকি পোকা ধরছি স্যার।

জোনাকি পোকা ধরছেন কেন?

ইয়াকুব সাহেব চুপ করে রইলেন। জবাব দিলেন না। খুকখুক করে দুবার কাশলেন।

কি ব্যাপার, জোনাকি পোকা কেন ধরছেন? খাবেন না-কি?

জি স্যার। তবে পোকা খাওয়া হবে না। পোকার আলো খাওয়া হবে।

কে খাবে, আপনি?

জি না, আমার এক ছাত্র।

ও আচ্ছা। আপনার ছাত্র? তা আলোটা কিভাবে খাবে?

গিলে ফেলা যায়, আবার চিবিয়েও খাওয়া যায়। আমি চিবিয়ে খেতে বলেছি। এতে হজমের সুবিধা। মুখে জারক রসের সঙ্গে আলোটা ভালো করে মিশতে পারে।

নাম কি আপনার ছাত্রের?

ওর নাম গোবর।

হেড স্যার বিস্মিত হয়ে বললেন, গোবর! বাপ-মা নাম রেখেছে গোবর?

জি না, বাপ-মা অন্য নাম রেখেছে। আমি নাম দিয়েছি গোবর।

ভালো করেছেন। খুব ভালো করেছেন। সুন্দর নাম। বিষ্টা হলে আরও ভালো হতো। তা গোবর নামও খারাপ না।

হেডস্যার আর দাঁড়ালেন না। একজন উন্মাদের সঙ্গে বেশি সময় থাকা ঠিক না। মাথার ঠিক নেই কখন কি করে বসবে। স্কুলের সেক্রেটারিকে এই ঘটনার কথা বলতে হবে। তারপরেও যদি উনি মনে করেন ইয়াকুব সাহেব মানসিকভাবে সুস্থ তাহলে ভিন্ন কথা। হেডস্যার আবার সেক্রেটারি সাহেবের বাসায় ফিরে গেলেন। দেরি করে লাভ নেই। আজই বলা যাক।

সেক্রেটারি সাহেব সব শুনে হাসতে হাসতে বললেন, ইয়াকুব সাহেব আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করেছেন।

ঠাট্টা?

অবশ্যই ঠাট্টা। আপনি উনাকে পাগল ভাবেন, এই জন্যেই পাগলের মতো কথাবার্তা বলে উনি আপনাকে ভড়কে দিয়েছেন। জোনাকি পোকার আলো খাচ্ছে তার ছাত্র–এই সব তো ঠাট্টার কথা, এটও বুঝেন না? আমার কি মনে হয় জানেন? আমার মনে হয়, আপনি এক ধরনের স্নায়বিক উত্তেজনায় ভুগছেন। এই কথা বলায় কিছু মনে করবেন না।

জি না, কিছু মনে করছি না।

আপনি ইয়াকুব সাহেবকে খবর দিয়ে স্কুলে আনুন। উনাকে আগের মতো ক্লাস নিতে দিন। দেখবেন উনি আর ঠাট্টা-তামাশা করছেন না।

জি আচ্ছা।

হেডস্যার ইয়াকুব সাহেবকে খবর দিয়ে স্কুলে আনলেন। যথারীতি ক্লাস নিতে বললেন। একবার ভাবলেন জোনাকি পোকার আলো খাওয়ার ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করবেন। শেষটায় বাদ দিলেন। দরকার কি ঝামেলায়। বরং দুএকটা সামাজিক দ্রতার কথা বলাই ভালো। হেডস্যার বললেন, ইয়াকুব সাহেব, আছেন কেমন?

জি ভালো আছি। তবে খুব ব্যস্ত।

ব্যস্ত কেন?

ছাত্র একটা আছে, ব্যায়াম শেখাচ্ছি।

কোন ছাত্র? গোবর যার নাম?

জি। একটা বইও লিখছি।

ব্যায়ামের বই?

বইয়ের কি নাম?

ভূতদের সহজ ব্যায়াম শিক্ষা।

কি বললেন–ভূতদের সহজ ব্যায়াম শিক্ষা?

জি। আমাদের জীবনে যেমন ব্যায়ামের প্রয়োজন আছে, ভূতদেরও আছে।

তা তো বটেই। আপনার ধারণা-এই বই পড়ে ভূতরা সব ব্যায়াম শিখবে?

তা শিখবে। ওদের শেখার আগ্রহ খুব বেশি।

হেডস্যার অস্বস্তিবোধ করতে লাগলেন। একজন বৃদ্ধ উন্মাদের সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলা উচিত না। কি থেকে কি হয়ে যায় কে জানে। হঠাৎ খ্যাক করে কামড়ে ধরতে পারে। এদের কাছ থেকে যতটা দূরে থাকা যায় ততই ভালো।

.

গোবরের ব্যায়াম শিক্ষা পুরোদমে চলছে। ফ্রি হ্যাঁন্ড এক্সারসাইজ, যোগ ব্যায়ম কোনোটাই বাদ যাচ্ছে না। ইয়াকুব সাহেব ঘরে রিং টানিয়ে দিয়েছেন। রিং-এর খেলাও হয়। জানা গেছে গোবর লম্বায় একটু খাটো। রিং টানাটানিতে যদি খানিকটা লম্বা হয়।

খাওয়া-দাওয়ার দিকে তিনি খুব লক্ষ রাখছেন। নানান ধরনের আলোর ব্যবস্থা করেছেন–মোমবাতির আলো, ঘিয়ের প্রদীপের আলো, তিসির তেলের আলো, জোনাকির আলো। টর্চ লাইটের আলো আছে। তবে এই আলো গোবরের সহ্য হয় না। খাওয়া মাত্র বমি হয়ে যায়।

গোবরের স্বাস্থ্য কতটা ভালো হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। ওজন বাড়ল কি-না ধরতে পারছেন না, কারণ ভূতদের ওজন নেই। হাত-পা মোটা মোটা হলো কি-না তাও বোঝা যাচ্ছে না। কারণ ভূতদের দেখা যায় না।

একদিন সন্ধ্যার কথা। ইয়াকুব সাহেব ভূতদের সহজ ব্যায়াম শিক্ষা বইটার সেকেন্ড ট্যাপ্টার লিখছেন–গোবর এসে তার পা ছুঁয়ে সালাম করে দাঁড়াল। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, কি ব্যাপার?

গোবার ফিসফিস করে বলল, আমার স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে স্যার।

ইয়াকুব সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে কি করে বুঝলে?

গোবর ক্ষীণ স্বরে বলল, এখন মানুষকে ভয় দেখাতে পারি।

সে কি! কাকে ভয় দেখালে?

হেডস্যারকে।

ইয়াকুব সাহেব মহাবিরক্ত হয়ে বললেন, তাকে কিভাবে ভয় দেখিয়েছ?

গোবর মিনমিন করে বলল, তাকে একটা সুপারি গাছের মাথায় বসিয়ে রেখেছি। গাছে বসে তিনি চিৎকার করছেন।

ইয়াকুব সাহেব স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। থমথমে গলায় বললেন, কখন করলে এই কাজ?

কিছুক্ষণ আগে।

আর কখনো এই কাজ করবে না। কখনো না। হেড মাস্টার সাহেব বিশিষ্ট ভ ভদ্রলোক। স্কুলঅন্তপ্রাণ। তাকে ভয় দেখানো অমার্জনীয় অপরাধ হয়েছে। আমি খুব রাগ করেছি। সেই সঙ্গে ব্যথিত হয়েছি।

গোবর কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, মানুষদের ভয় দেখাতেই হয়। এটা ভূতদের নিয়ম।

ভয় যদি দেখাতেই হয় দুষ্টু লোকদের ভয় দেখাবে। ধরো, ডাকাত এসেছে গ্রামে, ডাকাতদের ভয় দেখাও। চোর এসেছে, চোরদের ভয় দেখাও। দেশে দুষ্ট মানুষের তো অভাব নেই।

আর করব না স্যার।

শুধু স্বাস্থ্য ভালো করলে তো চলবে না। স্বাস্থ্যের সঙ্গে ন্যায়-নীতি শিখতে হবে। আদব-কায়দা শিখতে হবে। আমি তো ঠিক করেছি হেডস্যারকে বলে তোমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব। আজ যা কাণ্ড করেছ তাতে হেডস্যার রাজি হবেন কিনা কে জানে। দুষ্টু ছাত্ৰ হেডস্যারের চোখের বিষ। তোমাকে ক্ষমা চাইতে হবে, বুঝলে?

জি স্যার, বুঝেছি।

কোন্ গাছে হেডস্যারকে বসিয়ে রেখেছে? চলো যাই উনাকে নামিয়ে নিয়ে আসি। একা একা নামতে পারবে না। সুপারি গাছ থেকে নামা কঠিন ব্যাপার।

স্কুল সেক্রেটারির বাসার ঠিক সামনের সুপারি গাছের মাথায় হেডস্যার বসে আছেন। কিছুক্ষণ পরপর চিৎকার করছেন–বাঁচাও, বাঁচাও।

সেক্রেটারি সাহেব দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হলেন। অবাক হয়ে বললেন, গাছে কে?

আমি নীলগঞ্জ হাইস্কুলের হেডমাস্টার।

গাছে বসে কি করছেন?

কিছু করছি না, শুধু বসে আছি।

গাছে উঠলেন কিভাবে?

জানি না।

জানি না মানে?

গাছে উঠেছেন, তারপর বলছেন জানেন না কিভাবে উঠেছেন?

রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি গাছে বসে আছি।

নেমে আসুন। আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।

নামতে পারছি না। কি করে নামতে হয় জানি না।

আপনার যে মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে বুঝতে পারছেন?

পারছি।

আপনি শিক্ষক হিসেবে খুবই ভালো। কিন্তু বুঝতেই তো পারছেন বিকৃতমস্তিষ্ক শিক্ষক রাখা সম্ভব না।

বুঝতে পারছি। আমি রেজিগনেশন লেটার দিয়ে কাল সকালে দেশে চলে যাব। দয়া করে আমাকে গাছ থেকে নামানোর ব্যবস্থা করুন।

কথাবার্তার এই পর্যায়ে ইয়াকুব সাহেব এসে পড়লেন।

ততক্ষণে আরও বহু লোক জড়ো হয়েছে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা চলে এসেছে।

বেজায় হৈচৈ।

ইয়াকুব সাহেব বললেন, আমার ছাত্র গোবরের কারণে এই লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেছে। সে তার জন্যে সকলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। এক্ষুনি সে হেডস্যারকে গাছ থেকে নামাবে।

সবাই হতভম্ব হয়ে দেখল হেডস্যার পাখির পালকের মতো খুব ধীরে ভাসতে ভাসতে নিচে নেমে আসছেন। সেক্রেটারি সাহেব এই দৃশ্য সহ্য করতে পারলেন না। মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন।

এমন অস্বাভাবিক ঘটনা কিভাবে ঘটছে কেউ কিছু বুঝতে পারল না। ব্যাপারটা বুঝতে ইয়াকুব সাহেবের সপ্তাহখানেক সময় লাগল। একটা ভূতের বাচ্চা তার সঙ্গে বাস করছে এবং ব্যায়াম শিখছে এটা চট করে বিশ্বাস করার কথাও না আবার কাণ্ডকারখানা চোখের সামনে ঘটতে দেখা যাচ্ছে। শুরুতে গোবরকে সবাই ভয়ে ভয়ে দেখত-শেষে অভ্যস্ত হয়ে গেল। এক রবিবার সকালে ইয়াকুব সাহেব তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন।

পড়াশোনায় গোবর তেমন ভাল ছিল না, তবে ম্যাট্রিক এক চান্সেই পাস করল। যদিও পরীক্ষার সময় বেশ সমস্যা হয়েছিল। ইনভিজিলেটর এসে দেখেন একজন পরীক্ষার্থীর খাতায় আপনা-আপনি কলম দিয়ে লেখা হচ্ছে কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তিনি কিছুক্ষণ দৃশ্যটি দেখলেন, তার পরেই মাথা ঘুরে নিচে পড়ে গেলেন। মাথায় পানি ঢেলে তাকে সুস্থ করা হলো। ধারণা করা হয়েছিল বিষয়টা নিয়ে তিনি খুব হৈচৈ করবেন। তা করলেন না। কোনো প্রশ্নও করলেন না।

গোবরের খুব শখ ছিল কলেজে পড়বে। হেডমাস্টার সাহেব চেষ্টাও করেছিলেন। নিজে সঙ্গে গিয়ে অনেক কলেজে যোরাঘুরি করেছেন। সব কলেজের প্রিন্সিপালরা যেই শুনেছেন তিনি একটা ভূতকে কলেজে ভর্তি করাতে চান ওমি হেডমাস্টার সাহেবকে বের করে দিয়েছেন। তাঁর কোনো কথাই শুনতে চান নি। গোবর মনে খুব কষ্ট পেল। মনের কষ্ট আরও বাড়ল যখন ইয়াকুব সাহেব মারা গেলেন। তিনদিনের জ্বরে হঠাৎ মৃত্যু। চিকিৎসা করার সুযোগও ছিল না। ইয়াকুব সাহেবের মৃত্যুর পর গোবর বেচারা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ল। দিনরাত আমগাছে পা ঝুলিয়ে বসে থাকত। তার বাবা-মার সঙ্গেও গোবরের বনে নি। তারা ফিরে এসেছিলেন–গোবরের ম্যাট্রিক পাস করা নিয়ে অসম্ভব বিরক্ত হলেন। তুই ভূত সমাজের কলংক-এই বলে তারা অনেক দূরে কোথাও চলে গেলেন।

নীলগঞ্জের মানুষজন গোবরের কারণে খুব সুখে দিন কাটাত। চোর-ডাকাতের কোনো উপদ্রব ছিল না। নীলগঞ্জ থানার বড় দারোগা সাহেবের কাজের অভাবে কোমরে বাত হয়ে গেল। একবার চেয়ারে বসলে উঠতে পারেন না। উঠলে বসতে পারেন না এমন অবস্থা। চোর-ডাকাত ভুলেও নীলগঞ্জে আসে না। হঠাৎ একজন মনের ভুলে চলে সে। গোবর তখন তাকে ধরে খুব উঁচু কোনো সুপারি গাছে বসিয়ে ওসি সাহেবকে খবর দেয়। ওসি সাহেব বিরস মুখে বলেন, কে, গোবর?

জি।

আবার ধরেছিস?

জি।

সুপারি গাছের মাথায় রেখে দিয়েছিস?

জি।

এই কাণ্ডটা তুই কেন করিস বল তো? বর্ষার দিন, স্লিপ কেটে যদি সুপারি গাছ থেকে পড়ে কোমর ভাঙে তাহলে তো তুই বিপদে পড়বি। তিনশ দুই ধারায় কেইস হয়ে যাবে। তোকে কোমরে দড়ি বেঁধে কোর্টে চালান করতে হবে। আইনের চোখে ভূত-প্রেত সব সমান বুঝলি?

আর করব না স্যার।

ওসি সাহেব মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলেন, তুই বড় যন্ত্রণা করিস। তোকে স্নেহ করি বলে কিছু বলি না। এখন না বলে পারছি না। সাবধান হয়ে যা।

.

গোবর এখনো বেঁচে আছে। তবে বুড়ো হয়ে গেছে। আগের মতো শক্তি-সামর্থ্য নেই। আমগাছে বসে দিনরাত ঝিমায়। মাঝেমাঝে আফসোসের সঙ্গে বলে–এই যুগের পড়াশোনার মান খুব নিচে নেমে গেছে। সামান্য সমাস তাও পারে না। রসগোল্লার ব্যাসবাক্য কি–রসের গোল্লা না রসে ডুবানো গোল্লা তাও জানে না। বড়ই পরিতাপের বিষয়। বড়ই আফসোস। সামান্য একটা দরখাস্ত সেটাও ইংরেজিতে লিখতে পারে না। আফসোস। বড়ই আফসোস।

আমের সময় ছোট ছোট বাচ্চারা গাছের নিচে ভিড় করে। তারা খুব ঘ্যানঘ্যান করে–গোবর চাচা, গোবর চাচা, আম পেড়ে দাও না।

গোবর প্রচণ্ড ধমক দেয়–ভাগ, ঘুমের সময় বিরক্ত করিস না। মারব থাপ্পড়।

বাচ্চারা তারপরেও বিরক্ত করে, তারা জানে গোবর চাচা কখনো তাদের থাপ্পড় মারবে না। এক সময় আম পেড়ে দেবে। কারণ গোবর চাচা তো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভূত।
 
নিউটনের ভুল সূত্র



রূপেশ্বর নিউ মডেল হাইস্কুলের সায়েন্স টিচার হচ্ছেন অমর বাবু।

অমর নাথ পাল, বি.এসসি. (অনার্স, গোল্ড মেডাল)।

খুব সিরিয়াস ধরনের শিক্ষক। স্কুলের স্যারদের আসল নামের বাইরে একটা নকল নাম থাকে। ছাত্র মহলে সেই নামেই তাঁরা পরিচিত হন। অমর বাবু স্কুলে ঘড়ি স্যার নামে পরিচিত। তাঁর বুক পকেটে একটা গোল ঘড়ি আছে। ক্লাসে ঢোকার আগে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘড়িতে সময় দেখে নেন। ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়ামাত্র আবার ঘড়ি বের করে সময় দেখেন। তখন যদি তাঁর ভুরু কুচকে যায় তাহলে বুঝতে হবে ঘণ্টা ঠিকমতো পড়েনি। দুএক মিনিট এদিক-ওদিক হয়েছে।

তার ক্লাসে নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকতে হবে। হাসা যাবে না, পেনসিল দিয়ে পাশের ছেলের পিঠে খোঁচা দেয়া চলবে না, খাতায় কাটাকুটি খেলা চলবে না। মনের ভুলেও যদি কেউ হেসে ফেলে তিনি হতভম্ব চোখে তার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলবেন, সায়েন্স ছেলেখেলা নয়। হাসাহাসির কোনো ব্যাপার এর মধ্যে নেইৗয়েন্স পড়াবার সময় তুমি হেসেছ, তার মানে বিজ্ঞানকে তুমি উপহাস করেছ। মহা অন্যায় করেছ। তার জন্যে শাস্তি হবে। আজ ক্লাস শেষ হবার প্রবাড়ি যাবে না। পাটীগণিতের সাত প্রশ্নমালার ১৭, ১৮, ১৯ এই তিনটি অঙ্ক করে বাড়ি যাবে। ইজ ইট ক্লিয়ার?

অপরাধী শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। তার লাঞ্ছনা দেখে অন্য কেউ হয়তো ফিক করে হেসে ফেলল। অমর স্যার থমথমে গলায় বলবেন, ও-কি! তুমি হাসছ কেন? হাস্যকর কিছু কি বলেছি? তুমি উঠে দাঁড়াও। অকারণে হাসার জন্যে শাস্তি হিসেবে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকবে।

অমর বাবু পকেট থেকে ঘড়ি বের করবেন। পাঁচ মিনিট তিনি একদৃষ্টিতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইবেন। ছাত্ররা মূর্তির মতো বসে থাকবে।

.

অমর বাবুর বয়স পঞ্চাশ। স্ত্রী, দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে–এই নিয়ে তাঁর সংসার। দুটি ছেলেই বড় হয়েছে–রূপেশ্বর বাজারে একজনের কাপড়ের ব্যবসা, অন্যজনের ফার্মেসি আছে। ভালো টাকা রোজগার করে। একটি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। অন্য মেয়েটির বিয়ের কথা হচ্ছে। এদের কারোর সঙ্গেই তাঁর বনে না। স্ত্রী এবং পুত্র-কন্যাদের তিনি সহ্য করতে পারেন না। অনেক দিন হলো বাড়িতেও থাকেন না। স্কুলের দোতলায় একটা খালি ঘরে বাস করেন। সেখানে বিছানা বালিশ আছে। একটা স্টোভ আছে। গভীর রাতে স্টোভে চা বানিয়ে খান।

রূপেশ্বর স্কুলের হেড স্যার তাঁকে বলেছিলেন, আপনার ঘর-সংসার থাকতে আপনি স্কুলে থাকেন, এটা কেমন কথা?

অমর বাবু গম্ভীর গলায় বললেন, রাত জেগে পড়াশোনা করি, একা থাকতেই ভালো লাগে। তা ছাড়া ওদের সঙ্গে আমার বনে না। তবে স্কুলে রাত্রিযাপন করে যদি আপনাদের অসুবিধার কারণ ঘটিয়ে থাকি তাহলে আমাকে সরাসরি বলুন, আমি ভিন্ন ব্যবস্থা দেখি।

হেড স্যার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আরে না–এই কথা হচ্ছে না। আপনার যেখানে ভালো লাগবে আপনি সেখানে থাকবেন।

তিনি অমর বাবুকে ঘটালেন না। কারণ, অমর বাবু অসম্ভব ভালো শিক্ষক। অঙ্কের ডুবোজাহাজ! ডুবোজাহাজ বলার অর্থ তাকে দেখে মনে হয় না তিনি অঙ্ক জানেন। ভাবুক ভাবুক ভাব আছে। ক্লাসে কোনো অঙ্ক তাকে করতে দিলে এমন ভাব করেন যেন অঙ্কটা মাথাতেই ঢুকছে না। তারপর পকেট থেকে গোল ঘড়ি বের করে ঘড়ির দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে, চোখ বন্ধ করে মুখেমুখে অঙ্কটা করে দেন। স্কুলের অনেক ছাত্রের ধারণা এই ঘড়িতে রহস্য আছে। ঘড়ি অঙ্ক করে দেয়। ব্যাপার তা নয়। তাঁর ঘড়ির সেকেণ্ডের কাটাটায় গণ্ডগোল আছে। কখনো দ্রুত যায় কখনো আস্তে তবে গড়ে সমান থাকে। এইটাই তিনি মাঝে মাঝে পরীক্ষা করেন।

অমর বাবুকে ভালো মানুষ বলা যেতে পারে তবে তিনি অমিশুক, কথাবার্তা প্রায় বলেন না বললেই হয়। কারোর সাতে-পাঁচেও থাকেন না। টিচার্স কমন রুমে জানালার পাশের চেয়ারটায় চুপচাপ বসে থাকেন। ঘণ্টা পড়লে ক্লাসে রওনা হন। স্কুলের আরবি শিক্ষক মৌলানা ইদরিস আলি তাঁকে নিয়ে মাঝেমধ্যে ঠাট্টা-তামাশা করার চেষ্টা করেন। বিশেষ লাভ হয় না। তিনি ঠাট্টাতামাশা পছন্দ করেন না। কেউ ঠাট্টা করলে কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকেন।

আজ বৃহস্পতিবার, হাফ স্কুল। আগামী কাল ছুটি। ছাত্র-শিক্ষক সবার মধ্যেই একটা ছুটি ছুটি ভাব চলে এসেছে। থার্ড পিরিয়ডে অমর বাবুর ক্লাস নেই। তিনি জানালার কাছের চেয়ারে চুপচাপ বসে আছেন। ইদরিস সাহেব তার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, তারপর অমর বাবু, আপনার সায়েন্সের কী খবর?

অমর বাবু কিছু বললেন না, তবে চোখ তুলে তাকালেন। মনে-মনে রসিকতার জন্যে প্রস্তুত হলেন। বিজ্ঞান নিয়ে এই লোকটি কঠিন রসিকতা করে যা তিনি একেবারেই সহ্য করতে পারেন না।

ইদরিস সাহেব পানের কৌটা থেকে পান বের করতে করতে বললেন, অনেকদিন থেকে আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরছে। রোজই ভাবি আপনাকে জিজ্ঞেস করব।

জিজ্ঞেস করলেই পারেন।

ভরসা হয় না। আপনি তো আবার প্রশ্ন করলে রেগে যান।

বিজ্ঞান নিয়ে রসিকতা করলে রাগি। এমনিতে রাগী না–আপনার প্রশ্নটা কী?

ইদরিস সাহেব পান চিবুতে চিবুতে বললেন, পৃথিবী যে ঘুরছে এই নিয়ে প্রশ্ন। পৃথিবী তো ঘুরছে, তাই না?

জি। পৃথিবীর দুরকম গতি–নিজের অক্ষের উপর ঘুরছে, আবার সূর্যের চারদিকে ঘুরছে।

বাঁই বাঁই করে ঘুরছে?

জি?

তাই যদি হয় তাহলে আমাদের মাথা কেন ঘুরে না? মাথা ঘোরা উচিত ছিল না? এমনিতে তো মাঠে দুটা চক্কর দিলে মাথা ঘুরতে থাকে। ওকি, এ-রকম করে তাকাচ্ছেন কেন? রাগ করছেন না-কি?

বিজ্ঞান নিয়ে রসিকতা আমি পছন্দ করি না।

রসিকতা কি করলাম?

অমর বাবু মোর চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। ঘণ্টা পড়বার আগেই ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। এই তার নিয়ম। পৃথিবী কোনো কারণে হঠাৎ উল্টে গেলেও নিয়মের ব্যতিক্রম হবে না।

আজ পড়ার বিষয়বস্তু হলো আলো। আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণ। বড় চমৎকার বিষয়। আলো হচ্ছে একই সঙ্গে তরঙ্গ ও বস্তু। কী অসাধারণ ব্যাপার। ক্লাস টেনের ছেলেগুলি অবিশ্যি এসব বুঝবে না। তবে বড় হয়ে যখন পড়বে তখন চমৎকৃত হবে।

অমর বাবু ক্লাসে ঢুকেই বললেন, আলোর গতিবেগ কত— কে বলতে পার? সাতজন ছেলে হাত তুলল। তাঁর মন খারাপ হয়ে গেল। তার ধারণা ছিল সবাই হাত তুলবে। ছেলেগুলি কি সায়েন্সে মজা পাচ্ছে না? তা কি করে হয়? পৃথিবীতে মজার বিষয় তো একটাই। সায়েন্স।

তুমি বল, আলোর গতিবেগ কত?

প্রতি সেকেণ্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল।

ভেরি গুড। এখন তুমি বল, আলোর গতি কি এর চেয়ে বেশি হতে পারে?

জ্বি-না স্যার।

কেন পারে না?

এটাই স্যার নিয়ম। প্রকৃতির নিয়ম।

ভেরি গুড। ভেরি ভেরি গুড। প্রকৃতির কিছু নিয়ম আছে যে নিয়মের কখনো ব্যতিক্রম হবে না। হতে পারে না। যেমন মাধ্যাকর্ষণ। একটা আম যদি গাছ থেকে পড়ে তাহলে তা মাটিতেই পড়বে, আকাশে উড়ে যাবে না। ইজ ইট ক্লিয়ার?।

জি-স্যার।

মাধ্যাকর্ষণ শক্তির জনক কে?

নিউটন।

নামটা তুমি এইভাবে বললে যেন নিউটন হলেন একজন রাম-শ্যাম, যদু-মধু, রহিম-করিম। নাম উচ্চারণে কোনো শ্রদ্ধা নাই–বল মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটন।

ছাত্রটি কাঁচুমাচু মুখে বলল, মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটন।

একজন অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানীর নাম অশ্রদ্ধার সঙ্গে বলার জন্যে তোমার শাস্তি হবে। ক্লাস শেষ হলে বাড়ি যাবে না, পাটীগণিতের বার নম্বর প্রশ্নমালার একুশ আর বাইশ এই দুটি অঙ্ক করে তারপর যাবে। ইজ ইট ক্লিয়ার?

ছেলেটির মুখ আরো শুকিয়ে গেল।

অমর বাবুর মনটাই খারাপ হয়ে গেল। ছেলেগুলি তার মন খারাপ করিয়ে দিচ্ছে। বিজ্ঞান অবহেলা করছে। অশ্রদ্ধার সঙ্গে পড়ছে। খুবই দুঃখের কথা।

সন্ধ্যার পর তিনি স্কুল লাইব্রেরিতে খানিকক্ষণ পড়াশোনা করলেন। বিজ্ঞানী নিউটনের জীবনকৰ্থা। মনের অশান্ত ভাব একটু কমল। তিনি স্কুলের দোতলায় নিজের ঘরে ফিরে এলেন। তার ছোট ছেলে রতন টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার নিয়ে এসেছে। মুখ কাঁচুমাচু করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সে তার বাবাকে স্কুলের ছাত্রদের চেয়েও বেশি ভয় করে।

রতন কিছু বলবি?

মা বলছিলেন, অনেকদিন আপনি বাড়িতে যান না।

তাতে অসুবিধা তো কিছু হচ্ছে না।

মার শরীরটা ভালো না। জ্বর।

ডাক্তার ডেকে নিয়ে যা। আমাকে বলছিস কেন? আমি কি ডাক্তার?

রতন মাথা নিচু করে চলে গেল। অমর বাবুর মনে হলো আরেকটু ভালো ব্যবহার করলেই হতো। এতটা কঠিন হবার প্রয়োজন ছিল না। কঠিন না হয়েই বা কি করবেন–গাধা ছেলে, মেট্রিকটা তিনবারেও পাস করতে পারেনি। জগতের আনন্দময় বৈজ্ঞানিক সূত্রগুলি কিছুই জানল না— আলো কী সেই সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। আলো কী জিজ্ঞেস করলে নির্ঘাৎ বলবে—— এক ধরনের তরকারি, ভর্তা করেও খাওয়া যায়। ছিঃ ছিঃ!

ঘড়ি ধরে ঠিক নটায় তিনি রাতের খাবার শেষ করলেন। খাওয়া শেষ করতেই কেঁপে বৃষ্টি নামল। খোলা জানালা দিয়ে হু-হু করে হাওয়া আসতে লাগল। মেঘ ডাকতে লাগল। অমর বাবু দরজা-জানালা বন্ধ করে বিছানায় এসে বসলেন। তাঁর ঘুমুতে যাবার সময় বাঁধা আছে রাত দশটা কুড়ি। এখনো অনেক বাকি আছে। এই সময়টা তিনি চুপচাপ বসে নানা বিষয় ভাবেন। ভাবতে ভালো লাগে। আগে পড়াশোনা করতেন। এখন চোখের কারণে হারিকেনের আলোয় বেশিক্ষণ পড়তে পারেন না। মাথার যন্ত্রণা হয়। ঢাকায় গিয়ে ভালো ডাক্তার দিয়ে চোখ দেখান দরকার।

তিনি বিছানায় পা তুলে উঠে বসলেন। শীত শীত লাগছিল, গায়ে একটা চাদর জড়াবেন কি-না যখন ভাবছেন তখন হঠাৎ শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠল। তিনি খানিকটা নড়ে উঠলেন। আর তখন অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার হলো— তিনি লক্ষ করলেন বিছানা ছেড়ে তিনি উপরে উঠে যাচ্ছেন। প্রায় হাত তিনেক উঠে গেলেন এবং সেখানেই স্থির হরে গেলেন। চোখের ভুল? অবশ্যই চোখের ভুল। মহাবিজ্ঞানী নিউটনের সূত্র অনুযায়ী এটা হতে পারে না। হতে পারে না। হতে পারে না। নিতান্তই অসম্ভব। সূর্য পশ্চিম দিকে উঠা যেমন অসম্ভব, এটাও তেমনি অসম্ভব। এ হতেই পারে না।

কিন্তু হয়েছে। তিনি খাট থেকে তিন হাত উপরে স্থির হয়ে আছেন। ঘরের সবকিছু আগের মতো আছে, শুধু তিনি শূন্যে ভাসছেন। অমর বাবু চোখ বন্ধ করে মনে-মনে বললেন, হে ঈশ্বর। দয়া কর। দয়া কর। শরীরে কেমন যেন অনুভূতি হলো। হয়তো এবার নিচে নেমেছেন। তিনি চোখ খুললেন, না আগের জায়গাতেই আছেন। এটা কী করে হয়?

প্রচণ্ড শব্দে বিদ্যুৎ চমকাল আর তার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ধপ করে নিচে পড়লেন। খানিকটা ব্যথাও পেলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। চাদর দিয়ে সারা শরীর ঢেকে দিলেন। কী ঘটেছে তা নিয়ে তিনি আর ভাবতে চান না। ঘুমুতে চান। নিশ্চিন্ত ঘুম। ঘুম ভেঙে যাবার পর হয়তো সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

রাতে তাঁর ভালো ঘুম হলো। শেষ রাতের দিকে তিনি একবার জেগে উঠে বাথরুমে যান। আজ তাও গেলেন না, এক ঘুমে রাত পার করে দিলেন। যখন ঘুম ভাঙল—— তখন চারদিকে দিনের কড়া আলো, রোদ উঠে গেছে। তাঁর দীর্ঘ জীবনে এই প্রথম সূর্য উঠার পর ঘুম ভাঙল। রাতে কী ঘটেছিল তা মনে করে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। দুঃস্বপ্ন, নিশ্চয়ই দুঃস্বপ্ন। বদহজম হয়েছিল। বদহজমের কারণে দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এরকম হয়। মানুষ খুব ক্লান্ত থাকলে বসে বসে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। ঘুমের মধ্যেই স্বপ্ন দেখেছেন। দীর্ঘ স্বপ্নের স্থায়িত্বকাল হয় খুব কম। হয়তো এক সেকেণ্ডের একটা স্বপ্ন দেখেছেন। এই হবে— এ ছাড়া আর কী? স্বপ্ন, অবশ্যই স্বপ্ন। অমর বাবুর মন একটু হালকা হলো।

পরের দিনের কথা। প্রথম পিরিয়ডে অমর বাবুর ক্লাস নেই। টিচার্স কমন রুমে চুপচাপ বসে আছেন। ইদরিস সাহেব যথারীতি তার পাশে এসে বসলেন। পানের কৌটা বের করতে করতে বললেন, অমর বাবুর শরীর খারাপ না-কি?

জ্বি-না।

দেখে কেমন-কেমন জানি লাগছে। মনে হচ্ছে অসুস্থ। গায়ে কি জ্বর আছে?

জ্বি-না।

রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল?

না, তবে দুঃস্বপ্ন দেখেছি।

কী দুঃস্বপ্ন দেখেছেন?

অমর বাবু ইতস্তত করে বললেন, দেখলাম শূন্যে ভাসছি।

আরে ভাই এটা কি দুঃস্বপ্ন? শূন্যে ভাসা, আকাশে উড়ে যাওয়া–এইসব স্বপ্ন তো আমি রোজই দেখি। মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি অনেক উঁচু থেকে ধুপ করে মাটিতে পড়ে গেছি, খুজব টেনশানের স্বপ্ন।

অমর বাবু নিচু গলায় বললেন, ঠিক স্বপ্ন না, মনে হয় জাগ্রত অবস্থায় দেখেছি।

কী বললেন? জাগ্রত অবস্থায়? জেগে জেগে দেখলেন আপনি শূন্যে ভাসছেন?

জি।

জাগ্রত অবস্থায় দেখলেন শূন্যে ভাসছেন?

অমর বাবু জবাব দিলেন না। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলেন। ইদরিস সাহেব বললেন, রাত-দিন সায়েন্স সায়েন্স করে আপনার মাথা ইয়ে হয়ে গেছে। বিশ্রাম দরকার। আপনি এক কাজ করুন— ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যান। আজ ক্লাস নেয়ার দরকার নেই। আমি হেড স্যারকে বলে আসি?

না না, আমার শরীর ঠিকই আছে।

অমর বাবু যথারীতি ক্লাসে গেলেন। তাঁর পড়াবার কথা আলোর ধর্ম। তিনি শুরু করলেন মাধ্যাকর্ষণ।

দুটি বস্তু আছে। একটির ভর m; অন্যটির ভর m; তাদের মধ্যে দূরত্ব হচ্ছে তাহলে মাধ্যাকর্ষণ বলের পরিমাণ হবে

(m1m2)/r

এটি একটি বৈজ্ঞানিক সত্য। স্যার আইজাক নিউটনের বিখ্যাত সূত্র। এর কোনো নড়চড় হবে না। হতে পারে না। বাবারা বুঝতে পারছ?

ছেলেরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। আজ পড়াবার কথা আলোর ধর্ম, প্রতিফলন, প্রতিসরণ; স্যার মাধ্যাকর্ষণ পড়াচ্ছেন কেন?

বাবারা কি বলছি বুঝতে পারছ?

ছাত্ররা জবাব দিল না।

যদি কেউ বুঝতে না পার হাত তোল।

কেউ হাত তুলল না। একসময় ঘণ্টা পড়ে গেল। কোনোদিনও যা হয় না তাই হলো। অমর বাবু ঘণ্টা পড়ার পরেও চুপচাপ বসে রইলেন। পকেট থেকে ঘড়ি বের করে সময় দেখলেন না বা উঠেও গেলেন না। চোখ বন্ধ করে মূর্তির মতো বসে রইলেন। ছাত্রদের বিস্ময়ের কোনো সীমা রইল না।

.

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অমর বাবু স্কুল লাইব্রেরিতে বসে আছেন। হাতে একটা বই। নাম– মৌমাছিদের বিচিত্র জীবন। পড়তে বড় ভালো লাগছে। কত ক্ষুদ্র প্রাণী অথচ কী অসম্ভব বুদ্ধি! কী অসম্ভব জ্ঞান! মৌচাকের ভেতরের তাপমাত্রা তারা একটা নির্দিষ্ট স্থানে স্থির করে রাখে। বাড়তেও দেয় না, কমতেও দেয় না। এই কাজটা তারা করে অতি দ্রুত পাখা কাঁপিয়ে। তাপমাত্রা এক হাজার ভাগের এক ভাগ বেশ-কম হয় না। মানুষের পক্ষেও যা বেশ কঠিন।

তিনি রাত আটটার দিকে নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। শরীরটা ভালো লাগছে না। একটু জ্বর জ্বর লাগছে। টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার দিয়ে গেছে। তিনি কিছু খাবেন না বলে ঠিক করলেন। না খাওয়াই ভালো হবে। অনেক সময় পেটের গণ্ডগোল থেকে মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়। তাতে আজেবাজে স্বপ্ন দেখার ব্যাপারটা ঘটতে পারে। না খেলে তা হবে না। লেবুর শরবত বানিয়ে এক গ্লাস শরবত খেয়ে সকাল সকাল শুয়ে পড়লেন।

কাল শীত শীত লাগছিল, আজ আবার গরম লাগছে। জানালা খোলা, সামান্য বাতাস আসছে। সেই বাতাস মশারির ভেতর ঢুকছে না। তিনি মশারি খুলে ফেললেন। মশা কামড়াবে। কামড়াক। গরমের চেয়ে মশার কামড় খাওয়া ভালো।

মশারি খুলে ফেলে বিছানায় শোয়া মাত্র আবার গত রাতের মতো হলো। তিনি ধীরে ধীরে শূন্যে উঠে যেতে লাগলেন। দেখতে-দেখতে তার মাথা ঘরের ছাদ স্পর্শ করল।

তিনি হাত দিয়ে সেই ছাদে ধাক্কা দেয়া মাত্র খানিকটা নিচে নেমে আবার উপরে উঠতে লাগলেন। একী অদ্ভুত কাণ্ড! আবারো কি স্বপ্ন? না, স্বপ্ন না। আজকেরটা স্বপ্ন না। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তার উপর কাজ করছে না। পৃথিবীর ভর যদি হয় m1 তিনি যদি হন m2 এবং তাঁর ভর m2 যদি হয় শূন্য তাহলে মাধ্যাকর্ষণ বল হবে শূন্য। তাঁর ভর কি এখন শূন্য? তিনি পাশ ফিরলেন, শরীরটা চমৎকারভাবে ঘুরে গেল। সাঁতার কাটার মতো করলেন। তেমন লাভ হলো না। যেখানে ছিলেন সেখানেই রইলেন। এটাই স্বাভাবিক, বাতাস অতি হালকা। হালকা বাতাসে সাঁতার কাটা যাবে না।

ব্যাখ্যা কী? এর ব্যাখ্যা কী? একটা মানুষের ভর হঠাৎ শূন্য হয়ে যেতে পারে না। নিচে নামার উপায় কী? মনে-মনে আমি যদি চিন্তা করি নিচে নামব তাহলে কি নিচে নামতে পারব? তিনি মনে-মনে চিন্তা করলেন— নেমে যাচ্ছি, দ্রুত নেমে যাচ্ছি। লাভ হলো না। যেখানে ছিলে সেখানেই রইলেন।

আচ্ছা তিনি যদি থুথু ফেলেন তাহলে থুথুটার কী হবে? মাটিতে পড়ে যাবে না শূন্যে ঝুলতে থাকবে? তিনি থুথু ফেললেন। খুব স্বাভাবিকভাবে থুথু মাটিতে পড়ল। গায়ের পাঞ্জাবিটা খুলে ছেড়ে দিলে সেটিও কি শূন্যে ভাসতে থাকবে? না-কি নিচে পড়ে যাবে? অতি সহজেই এই পরীক্ষা করা যায়। তিনি গায়ের পাঞ্জাবি খুলে ফেললেন। ছেড়ে দিতেই দ্রুত তা নিচে নেমে গেল। তার মানে এই অদ্ভুত ব্যাপাটির সঙ্গে শুধুমাত্র তিনিই জড়িত। তার গায়ের পোশাকের সঙ্গে এর কোনো যোগ নেই। তিনি চোখ বন্ধ করে চিন্তা করছেন মাধ্যাকর্ষণ বল যদি হয় F তাহলে–

F=(m1m2)/ r^2

m1 পৃথিবীর ভর। m2 তাঁর নিজের ভর। r হচ্ছে তাঁর সঙ্গে পৃথিবীর দূরত্ব। m2 যদি ‘0’ হয়, F হবে শূন্য। কিংবা r যদি হয় অসীম তাহলেও F হবে ‘0’ কোনো বিচিত্রি কারণে কি তাঁর সঙ্গে পৃথিবীর দূরত্ব অসীম হয়ে যাচ্ছে? ভাবতে ভাবতে অমর বাবুর ঘুম পেয়ে গেল। একসময় মাটি থেকে ছফুট উঁচুতে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়লেন। গভীর ঘুম। তার নাকও ডাকতে লাগল। ঘুমের মধ্যেই তিনি পাশ ফিরে শুলেন। কোনো রকম অসুবিধা হলো না।

ঘুম ভাঙলো ভোরবেলা।

অনেক বেলা হয়েছে। ঘরে রোদ ঢুকেছে। তিনি পড়ে আছেন মেঝেতে। কখন মাটিতে নেমে এসেছেন তিনি জানেন না। গায়ে কোনো ব্যথ্যা বোধ নেই, কাজেই ধপ করে পড়েন নি— আস্তে-আস্তে নেমে এসেছেন।

অমর বাবু স্বাভাবিক মানুষের মতো হাত-মুখ ধুলেন। মুড়ি গুড় দিয়ে সকালের নাশতা সারলেন। পুকুর থেকে গোসল শেষ করে যথাসময়ে স্কুলে গেলেন। আজ প্রথম পিরিয়ডেই তার ক্লাস। তিনি ক্লাস না নিয়ে নিজের চেয়ারে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলেন। মনে হলো ঘুমুচ্ছেন। আসলে ঘুমুচ্ছিলেন না, ভাবার চেষ্টা করেছিলেন–তার জীবনে এসব কী ঘটছে?

ব্যাপারটা শুধু রাতেই ঘটছে। দিনে ঘটছে না। আচ্ছা তিনি যদি তার নিজের ঘরে না ঘুমিয়ে অন্য কোথাও থাকেন তাহলেও কি এই ব্যাপার ঘটবে? রাতে খোলা মাঠে যদি ঘুমিয়ে থাকনে তাহলে কি ভাসতে ভাসতে মহাশূন্যে চলে যাবেন? মঙ্গলগ্রহের কাছাকাছি বা সূর্যের কাছাকাছি? কিংবা আরো দূরে এন্ড্রোমিড়া নক্ষত্রপুঞ্জে… সুদূর কোনো ছায়াপথে…?

স্যার।

অমর বাবু চমকে তাকালেন। দপ্তরি কালিপদ দাঁড়িয়ে আছে।

হেড স্যার আপনারে বুলায়।

হেড স্যার তাকে কেন ডেকে পাঠালেন তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। ইদরিস সাহেব কি হেড স্যারকে কিছু বলেছেন? বলতেও পারেন। পেট পাতলা মানুষ। বলাটাই স্বাভাবিক। আচ্ছা ব্যাপারটা কি তিনি নিজে গুছিয়ে হেড স্যারকে বলবেন? বলা যেতে পারে। মানুষ ভালো। শুরুতেই অবিশ্বাসের হাসি হাসবেন না।

হেড স্যার বললেন, কেমন আছেন অমর বাবু?

জি ভালো।

দেখে তো ভালো মনে হচ্ছে না। বসুন। চা খাবেন?

চা তোর স্যার আমি খাই না।

এক-আধবার খেলে কিছু হয় না। খান। কালিপদকে চা দিতে বলেছি।

কালিপদ চা দিয়ে থার্ড পিরিয়ডের ঘণ্টা দিতে গেল। হেড স্যার বললেন, শুনলাম গত কাল ক্লাস নেননি। আজও ফাস্ট পিরিয়ড মিস গেছে।

ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে স্যার।

ও আচ্ছা। আপনার তো সব ঘড়ি-ধরা। ঘুম ভাঙতে দেরি হলো কেন?

অমর বাবু চুপ করে রইলেন।

পারিবারিক কোনো সমস্যা যাচ্ছে না-কি?

জি-না।

আপনার মেয়ে গত কাল আমার কাছে এসেছিল। খুব কান্নাকাটি করল। আপনি বাড়িতে থাকেন না। এই নিয়ে বেচারির মনে খুব দুঃখ। দুঃখ হওয়াটাই স্বাভাবিক।

আমি একা থাকতেই পছন্দ করি।

নিজের পছন্দকে সব সময় খুব বেশি গুরুত্ব দিতে নেই। অন্যদের কথাও ভাবতে হয়। আমরা সামাজিক জীব…

স্যার উঠি?

বসুন খানিকক্ষণ। গল্প করি— অমর বাবু আমি বলি কি যদি অসুবিধা না থাকে তা হলে, আপনার সমস্যাটা আমাকে বলুন। ইদরিস সাহেব স্বপ্নের কথা কি সব বলছিলেন—

অমর বাবু ইতস্তত করে বললেন, বিজ্ঞানের সূত্র মিলছে না স্যার।

হেডমাস্টার সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কোন সূত্র মিলছে না?

স্যার আইজ্যাক নিউটনের সূত্র–মধ্যাকর্ষণ সূত্র।

আপনার ধারণা সূত্রটা ভুল?

অমর বাবু জবাব দিলেন না। হেডমাস্টার সাহেব বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। একসময় বললেন, আচ্ছা আপনি বরং বাড়িতে চলে যান। আপনাকে দশ দিনের ছুটি দিয়ে দিলাম। বিশ্রাম করুন। বিশ্রাম দরকার। অতিরিক্ত পরিশ্রমে মাঝে মাঝে মানুষের মাথা এলোমেলো হয়ে যায়।

স্যার, আমার মাথা ঠিকই আছে।

অবশ্যই ঠিক আছে। কথার কথা বললাম। যান, বাসায় চলে যান… বাড়ির সবাই অস্থির হয়ে আছে।

অমর বাবু বাড়ি গেলেন না। কমন রুমে নিজের চেয়ারে এসে বসলেন। হাতে একটা ফুল স্ক্যাপ কাগজ। সেই কাগজে নিউটনের সূত্র নতুনভাবে লিখলেন—

F = k.[(m1m2)/r^2]

এখানে k-এর মান ১ তবে মাঝে মাঝে ‘k’ এর মান হচ্ছে শূন্য। যেমন তার ক্ষেত্রে হচ্ছে। একসময় কলম দিয়ে নির্মমভাবে সব কেটেও ফেললেন। নিউটন যে সূত্র দিয়ে গেছেন–তার মতো সামান্য মানুষ সেই সূত্র পাল্টাতে পারেন না।

অমর বাবু টিফিন পিরিয়ডে অনেক সময় নিয়ে ইংরেজিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠির বাংলা অনুবাদ অনেকটা এই রকম—

জনাব,

আমি রূপেশ্বর হাইস্কুলের বিজ্ঞানের একজন শিক্ষক। নিতান্ত অনন্যোপায় হইয়া আপনাকে পত্র দিতেছি। সম্প্রতি আমার জীবনে এমন এক ঘটনা ঘটিতেছে যাহার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমি খুঁজিয়া না পাইয়া আপনার দ্বারস্থ হইলাম। আমি শূন্যে ভাসিতে পারি। আপনার নিকট খুব অদ্ভুত মনে হইলেও ইহা সত্য। আমি ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়া বলিতেছি–আপনাকে যাহা বলিলাম সবই সত্য। কোনো রকম চেষ্টা ছাড়াই আমি শুন্যে উঠিতে পারি এবং ভাসমান অবস্থায় দীর্ঘ সময় কাটাইতে পারি। জনাব, বিষয়টি কী, বুঝিবার ব্যাপারে আপনি যদি আমাকে সাহায্য করেন তাহা হইলে এই অধম আপনার নিকট চিরকৃতজ্ঞ থাকিবে। আপনি বলিলেই ঢাকায় আসিয়া আমি আপনাকে শূন্যে ভাসার ব্যাপারটি চাক্ষুষ দেখাইব। জনাব, আপনি আমার প্রতি দয়া করুন— বিষয়টি বুঝিতে আমাকে সাহায্য করুন।

বিনীত
অমর দাস পাল
B.Sc. (Hons)

দশ দিনের পুরোটাই তিনি নিজের ঘরে কাটালেন— বাড়িতে গেলেন না। তাঁকে নিতে তাঁর ছোট মেয়ে অতসী এসেছিল। তাকে ধমকে বিদায় করলেন। এই মেয়েটা পড়াশোনায় ভালো ছিল– তাকে এত করে বললেন সায়েন্স পড়তে, সে ভর্তি হল আর্টস-এ। কোনো মানে হয়? তাকে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সূত্র কী জিজ্ঞেস করলে সে হা করে তাকিয়ে থাকবে। কী দুঃখের কথা!

অতসীকে ধমকে ঘর থেকে বের করে দিলেও সে গেল না। বারান্দায় পঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল। তিনি বাইরে এসে বিরক্ত গলায় বললেন, কাঁদছিস কেন?

সে ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলল, তোমার শরীর খারাপ বাবা। তুমি বাড়িতে চল।

শরীর খারাপ তোকে কে বলল?

সবাই বলাবলি করছে। তুমি না-কি কি সব স্বপ্ন-টপ্ন দেখ।

কোনো স্বপ্ন দেখি না। আমি ভালো আছি। নির্জনে একটা পরীক্ষা করছি। পরীক্ষা শেষ হোক— তোদের সঙ্গে এসে কয়েক দিন থাকব।

কীসের পরীক্ষা।

কীসের পরীক্ষা বললে তো তুই বুঝবি না। হা করে তাকিয়ে থাকবি। এত করে বললাম সায়েন্স পড়তে।

অঙ্ক পারি না যে।

অঙ্ক না পারার কী আছে! যোগ, বিয়েগ, গুণ, ভাগ— অঙ্ক তো এর বাইরে না। কাঁদিস না। বাসায় যা। আমি ভালো আছি।

তিনি যে ভালো আছেন তা কিন্তু না।

রোজ রাতে একই ব্যাপার ঘটছে। খেয়ে-দেয়ে ঘুমুতে যান— মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে দেখেন শূন্যে ভাসছেন। তখন আতঙ্কে অস্থির হওয়া ছাড়া পথ থাকে না। তিনি ইচ্ছে করলেই নিচে নামতে পারেন না।

নিচে কীভাবে নামেন তাও জানেন না। রাতটা তার অঘুমেই কাটে। তিনি ঘুমুতে যান দিনে। এমন যদি হত তিনি দিনরাত সারাক্ষণই শূন্যে ভাসছেন তাহলেও একটা কথা ছিল। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারতেন যে, কোনো-এক অদ্ভুত প্রক্রিয়ায় তাঁর ভর শূন্য হয়ে গেছে। ব্যাপারটা সে রকম না। এমন কেউ এখানে নেই যে তিনি সাহায্যের জন্যে তাঁর কাছে যাবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার চেয়ারম্যান সাহেবও কিছু লিখছেন না। হয়তো ভেবেছেন পাগলের চিঠি। কে আর কষ্ট করে পাগলের চিঠির জবাব দেয়?

ন দিনের মাথায় অমর বাবু চিঠির জবাব পেলেন। অতি ভদ্র চিঠি। চেয়ারম্যান সাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডে লিখেছেন—

জনাব,

আপনার চিঠি কৌতূহল নিয়ে পড়লাম। আপনি বিজ্ঞানের শিক্ষক। কাজেই বুঝতে পারছেন আপনি যে বিষয়ের অবতারণা করেছেন ঐ বিজ্ঞান স্বীকার করে না। আপনি যদি আমার অফিসে এসে শূন্যে ভাসতে থাকেন তাহলেও আমি বিশ্বাস করব না। ভাবব এর পেছনে ম্যাজিকের কোনো কৌশল কাজ করছে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন জাদুকররা শূন্যে ভাসার খেলা সব সময়ই দেখায়।

যাই হোক, আপনার চিঠি পড়ে আমার ধারণা হয়েছে যে আপনার সমস্যাটি মানসিক। আপনি মনে-মনে ভাবছেন— শূন্যে ভাসছেন। আসলে ভাসছেন না। সবচেয়ে ভালো হয় যদি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করেন। একমাত্র তিনি আপনাকে সাহায্য করতে পারেন। আমি আপনাকে কোনো রকম সাহায্য করতে পারছি না বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করে শেষ করছি।

বিনীত
এস. আলি
M.Sc. Ph.D., F.R.S.

অমর বাবু মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাবার ব্যাপারে কোনো গুরুত্ব দিলেন না। কারণ, তিনি জানেন বিষয়টা সত্যি। তিনি দু-একটা ছোটখাট পরীক্ষা করে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। যেমন স্কুল থেকে লাল রঙের চক নিয়ে এসেছিলেন। শূন্যে উঠে যাবার পর সেই লাল রঙের চক দিয়ে ছাদে বড় বড় করে লিখলেন,

হে পরম পিতা ঈশ্বর, তুমি আমাকে দয়া কর।
তোমার অপার রহস্যের খানিকটা আমাকে দেখতে দাও।
আমি অন্ধ, তুমি আমাকে পথ দেখাও।
জ্ঞানের আলো আমার হৃদয়ে প্রজ্বলিত কর।
পথ দেখাও পরম পিতা।

আরো অনেক কিছু লেখার ইচ্ছা ছিল, চক ফুরিয়ে যাওয়ায় লেখা হলো না। এই লেখাটা ছাদে আছে। তিনি তাকালেই দেখতে পান। এমন যদি হতো লেখাটা তিনি একা দেখতে পাচ্ছেন তাহলেও বোঝা যেত সমস্যাটা মনে। কিন্তু তা তো না। অন্যরাও লেখা পড়তে পারছে। গত কাল বিকেলে হেড মাস্টার সাহেব তাঁকে দেখতে এসে হঠাৎ করেই বিস্মিত গলায় বললেন, ছাদে এইসব কী লেখা?

অমর বাবু নিচু গলায় বলেন, প্রার্থনা সংগীত।

প্রার্থনা সংগীত ছাদে লিখলেন কেন?

শুয়ে শুয়ে যাতে পড়তে পারি এইজন্যে।

লিখলেন কীভাবে? মই দিয়ে উঠেছিলেন না-কি?

অমর বাবু জবাব দিলেন না। হেড মাস্টার সাহেব জবাবের জন্যে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বললেন, আপনার ছুটি তো শেষ হয়ে গেল, আপনি কি ছুটি আরো বাড়াতে চান?

জ্বি-না।

আপনি বরং আরো কিছুদিন ছুটি নিন। শরীরটা এখনো সেরেছে বলে মনে হয় না। আপনাকে খুব দুর্বল লাগছে।

আমার শরীর যা আছে তা-ই থাকবে স্যার। আর ভালো হবে না।

এইসব কী ধরনের কথা! কোনো ডাক্তারকে কি দেখিয়েছেন?

জ্বি-না।

ডাক্তার দেখাতে হবে। ডাক্তার না দেখালে কীভাবে হবে? বিধু বাবুকে দেখান। বিধু বাবু এল.এম.এফ. হলেও ভালো ডাক্তার। যে কোনো বড় ডাক্তারের কান কেটে নিতে পারে। বিধু বাবুকে দেখানোর কথা মনে থাকবে?

জি স্যার, থাকবে।

না আপনার মনে থাকবে না। আমি বরং নিয়ে আসব। আমার ছোট মেয়েটার জ্বর। বিধু বাবুকে বাসায় আসতে বলেছি। এলে, আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব।

জি-আচ্ছা।

এখন তাহলে উঠি অমর বাবু?

একটু বসুন স্যার।

হেড মাস্টার সাহেব উঠতে গিয়েও বসে পড়লেন। তিনি খানিকটা বিস্মিত, কারণ অমর বাবু একদৃষ্টিতে ছাদের লেখাগুলির দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁকে অসম্ভব চিন্তিত মনে হচ্ছে। অমর বাবু নিচু গলায় বললেন, আপনাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছি স্যার–যদি কিছু মনে না করেন।

বলুন কী বলবেন। মনে কড়াকড়ির কী আছে?

অমর বাবু প্রায় ফিসফিস করে বললেন, আমি শুন্যে ভাসতে পারি।

বুঝতে পারলাম না কী বলছেন।

আমি আপনা-আপনি শূন্যে উঠে যেতে পারি।

ও আচ্ছা।

হেড মাস্টার সাহেব ‘ও আচ্ছা’ এমন ভঙ্গিতে বললেন যেন শূন্যে ভেসে থাকবার ব্যাপারটা রোজই ঘটছে। তবে তার চোখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি খুব চিন্তিত বোধ করছেন।

ছাদের লেখাগুলি শূন্যে ভাসতে ভাসতে লেখা।

ও আচ্ছা।

আপনার কি আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?

হেড মাস্টার সাহেব জবাব দিলেন না। অমর বাবু বললেন, আমি স্যার এই জীবনে কখনো মিথ্যা কথা বলিনি। ছেলেবেলায় হয়তো বলেছি, জ্ঞান হবার পর থেকে বলিনি।

আমি বিধু বাবুকে পাঠিয়ে দেব।

জি আচ্ছা।

হেড মাস্টার সাহেব ইতস্তত করে বললেন, উনাকে শূন্যে ভাসার ব্যাপারটা বলার দরকার নেই। জানাজানি হবে। ইয়ে মানে–লোকজন হাসাহাসি করতে পারে।

আমি আপনাকেই খোলাখুলি বলেছি। আর কাউকে বলিনি।

ভালো করেছেন। খুব ভালো করেছেন।

বিধু বাবু এসে খানিকক্ষণ গল্পটল্প করে যাবার সময় ঘুমের অষুধ দিয়ে গেলেন। বললেন, দুঃস্বপ্ন না দেখার একটাই পথ। গভীর নিদ্রা। নিদ্রা পাতলা হলেই মানুষ দুঃস্বপ্ন দেখে। আমি ফোনোবারবিটন ট্যাবলেট দিয়ে যাচ্ছি। শোবার আগে দুটা করে খাবেন।

অমরবাবু দুটো ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমুতে গেলেন। তবে ঘুমুতে যাবার আগে এক কাণ্ড করলেন–কালিপদকে বললেন, লম্বা একগাছি দড়ি নিয়ে তাঁকে খুব ভালো করে চৌকির সঙ্গে বেঁধে রাখতে।

কালিপদ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল।

অমর বাবু বিরক্ত মুখে বললেন, আমার মাথা খারাপ হয়নি, মাথা ঠিক আছে। তোমাকে যা করতে বলেছি কর। ব্যাপারটা কি পরে বুঝিয়ে বলব। লম্বা। দেখে একগাছি দড়ি আন। শক্ত করে আমাকে চৌকির সঙ্গে বাঁধ।

কালিপদ তাই করল। তবে করল খুব অনিচ্ছার সঙ্গে।

অমর বাবু ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের ট্যাবলেটের কারণে তার গাঢ় নিদ্রা হলো। ঘুম ভাঙল বেলা উঠার পর। তিনি দেখলেন–এখনো চৌকির সঙ্গে বাঁধা আছেন তবে চৌকি আগের জায়গায় নেই, ঘরের মাঝামাঝি চলে এসেছে। তার একটিই মানে— চৌকি নিয়েই তিনি শূন্যে ভেসেছেন। নামার সময় চৌকি আগের জায়গায় নামেনি। স্থান পরিবর্তন হয়েছে।

তিনি সেদিনই বিছানাপত্র দিয়ে বাড়িতে চলে এলেন। অতসী তাঁকে দেখে কেঁদে ফেলল। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, নাকে কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে?

অতসী কাঁদতে কাঁদতেই বলল, তোমার শরীর এত খারাপ হয়েছে কেন বাবা? কী ভয়ঙ্কর রোগা হয়ে গেছো!

ভালো ঘুম হচ্ছে না, এইজন্যে শরীর খারাপ হয়েছে, এতে নাকে কাঁদার কী হলো?

সবাই বলাবলি করছে তোমার না-কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কালিপদ নাকি রোজ রাতে দড়ি দিয়ে তোমাকে বেঁধে রাখে।

কী যন্ত্রণা! একবারই বাঁধতে বলেছিলাম— এর মধ্যে এই গল্প ছড়িয়ে গেছে?

তোমার কী হয়েছে বাবা বল?

কিছু হয়নি।

অমর বাবু ছদিন বাড়িতে থাকলেন। এই ছদিনে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করলেন। শূন্যে ভাসার ব্যাপারটা তিনি একা একা থাকার সময়ই ঘটে। অন্য কেউ তার সঙ্গে ঘুমুলে ঘটে না। যে করাত তাঁর স্ত্রী তার সঙ্গে ঘুমিয়েছেন সে করাত তিনি শূন্যে ভাসেননি। দুরাত ছিলেন একা একা, দুরাতেই শূন্যে উঠে গেছেন।

পূজার ছুটির পর স্কুল নিয়মিত শুরু হলো। তিনি স্কুলে গেলেন না। লম্বা ছুটির দরখাস্ত করলেন। আবার বাড়ি ছেড়ে বাস করতে শুরু করলেন স্কুলের ঘরে। দীর্ঘদিন বাড়িতে থাকতে তার ভালো লাগে না।

শূন্যে ভাসার ব্যাপারটা রোজ ঘটতে লাগল। আগের চেয়ে অনেক বেশি ঘটতে লাগল। এখন বিছানায় শোয়ামাত্র শূন্যে উঠে যান। সারারাত সেখানেই কাটে। শেষ রাতের দিকে নিচে নেমে আসেন। ব্যাপারটা ঘটে শুধু রাতে, দিনে ঘটে না। কখনো না। এবং অন্য কোনো ব্যক্তির সামনেও ঘটে না।

হেড স্যার এবং ইদরিস স্যার পরপর দুরাত অমর বাবুর ঘরে জেগে বসে ছিলেন। দেখার জন্যে ব্যাপারটা কী। তাঁরা মুহূর্তের জন্যেও চোখের পাতা এক করেননি। লাভ হয়নি, কিছুই দেখেননি। হেড স্যার বললেন, ব্যাপারটা পুরোপুরি মানসিক।

অমর বাবু দুঃখিত গলায় বললেন, আপনার কি ধারণা আমি পাগল হয়ে গেছি?

না, তা না। পাগল হবেন কেন? তবু আমার ধারণা ব্যাপারটা আপনার মনে ঘটছে। একবার ঢাকায় চলুন না, একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলি।

না।

ক্ষতি তো কিছু নেই। চলুন না।

আমি যেতে চাচ্ছি না স্যার, কারণ আমি জানি ব্যাপারটা সত্যি। সত্যি না হলে ছাদে এই লেখাগুলি আমি কীজ্ঞকে লিখলাম। দেখেছেন তো ঘরে কোনো মই নেই।

হেড স্যার চুপ করে রইলেন। অমর বাবু বললেন, আপনারা ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়ান, আমি আবার শূন্যে উঠে ছাদে একটা লেখা লিখব।

হেড স্যার বললেন, তার দরকার নেই কিন্তু কথা হচ্ছে আপনি আমাদের সামনে ব্যাপারটা পারছেন না কেন?

আমি জানি না। জানলে বলতাম। জানার চেষ্টা করছি, দিন-রাত এটা নিয়েই ভাবছি।

এত ভাবাভাবির দরকার নেই, আপনি আমার সঙ্গে ঢাকা চলুন। দুদিনের ব্যাপার। যাব, ডাক্তার দেখাব, চলে আসব। আমার একটা অনুরোধ রাখুন। প্লিজ। আপনার হয়তো লাভ হবে না কিন্তু ক্ষতি তো কিছু হবে না।

.

অমর বাবু ঢাকায় গেলেন।

একজন অতি বিখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দীর্ঘ সময় ধরে তাকে নানান প্রশ্ন করলেন। পরপর কয়েক দিন তাঁর কাছে যেতে হলো। শেষ দিনে বিশেষজ্ঞ ভদ্রলোক বললেন, আপনার যা হয়েছে তা একটা রোগ। এর উৎপত্তি হচ্ছে অবসেসনে। বিজ্ঞানের প্রতি আপনার তীব্র অনুরাগ। সেই অনুরাগ রূপান্তরিত হয়েছে অবসেসনে। কেউ যখন বিজ্ঞানকে অবহেলা করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কথা বলে তখন আপনি তীব্র আঘাত পান। এই আঘাত আপনি পেয়েছেন আপনার অতি নিকটজনের কাছ থেকে। যেমন ধরুন আপনার কন্যা। সে বিজ্ঞান পড়েনি। আর্টস পড়ছে। এই তীব্র আঘাত আপনার মন গ্রহণ করতে পারেনি। আপনার অবচেতন মন ভাবতে শুরু করেছে–বিজ্ঞানের সূত্র অভ্রান্ত নয়। ভুল সূত্রও আছে। মাধ্যাকর্ষণ সূত্রও ভুল। একসময় অবচেতন মনের ধারণা সঞ্চারিত হয়েছে চেতন মনে। বুঝতে পারছেন?

জি না, বুঝতে পারছি না।

মোদ্দা কথা হলো, আপনার রোগটা মনে।

না— আমি নিজে বিজ্ঞানের শিক্ষক। আমি খুব ঠাণ্ডা মাথায় বিচারবিবেচনা করেছি। আমি যে শূন্যে উঠতে পারি এটা ভুল না। পরীক্ষিত সত্য।

মোটেও পরীক্ষিত সত্য নয়। আপনি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি দেখেনি যে আপনি শূন্যে ভাসছেন। দেখলেও কথা ছিল, কেউ কি দেখেছে?

জ্বি-না।

আমি ট্রাংকুলাইজার জাতীয় কিছু অষুধ দিচ্ছি। নিয়মিত খাবেন, ব্যায়াম করবেন। মন প্রফুল্ল রাখবেন। বিজ্ঞান নিয়ে কোনো পড়াশোনা করবেন না।

অমর বাবু দুঃখিত গলায় বললেন, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেননি কিন্তু আমি যা বলছি সত্য বলছি–।

ব্যাপারটা হয়তো আপনার কাছে সত্যি। কিন্তু সবার কাছে নয়। আপনি খুব ঠাণ্ডা মাথায় বিচার করলেওই সিদ্ধান্তে আসবেন।

অমর বাবু ভগ্নহৃদয়ে রূপেশ্বরে ফিরে এলেন। স্কুলে যোগ দিলেন না। কিছুদিনের মধ্যেই মাথা খারাপের সব লক্ষণ তার মধ্যে একে-একে দেখা দিতে লাগল। বিড়বিড় করে কথা বলেন, একা একা হাঁটেন। হাঁটার সময় দৃষ্টি থাকে আকাশের দিকে নিতান্ত অপরিচিত কাউকে দেখলে থমকে দাঁড়িয়ে যান, শান্ত গলায় বলেন, কিছু মনে করবেন না। আপনি কি নিউটনের গতিসূত্র জানেন?

পাগলের অনেক রকম চিকিৎসা করানো হলো। কোনো লাভ হলো না। বরং লক্ষণগুলি আরো প্রকট হওয়া শুরু করল। গভীর রতে ছাত্রদের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে উঁচু গলায় ডাকেন, জব্বার, ও জব্বার, উঠে আয় তো বাবা। খুব দরকার।

জব্বার উঠে এলে তিনি কারণ গলায় বলেন, নিউটনের সূত্র মনে আছে? ভালো করে পড়। এস.এস.সি তে আসবে। সাথে অঙ্ক থাকবে— ভূমি থেকে দশ ফুট উচ্চতায় ১ গ্রাম ভর বিশিষ্ট একটি আপেল ছাড়িয়া দিলে তার গতিবেগ পাঁচ ফুট উচ্চতায় কত হইবে? অঙ্কটা চট করে কর। মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ কত মনে আছে তো?

আমাদের সমাজ পাগলদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে। অমর বাবুর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। বছরখানিক না ঘুরতেই দেখা ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাকে দেখে বলছে— নিউটনের সূত্রটা কি যেন? অমর বাবু দাঁত-মুখ খিচিয়ে এদের তাড়া করছেন। তারা মজা পেয়ে খুব হাসছে। কারণ, তারা জানে পাগলরা শিশুদের তাড়া করে ঠিকই কখনো আক্রমণ করে না।

.

পৌষের শুরু। জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। এই শীতেও খালি গায়ে শুধুমাত্র একটা ধুতি কোমরে পেঁচিয়ে অমর বাবু রাস্তায় রাস্তায় হাঁটেন। নিউটনের সূত্র মনে আছে কি-না এই প্রশ্ন তিনি এখন আর কোনো মানুষকে করেন না। পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গদের করেন। তারা প্রশ্নের উত্তর সংগত কারণেই দেয় না। তিনি তখন ক্ষেপে যান।

.

রাত দশটার মতো বাজে। কনকনে শীত।

অমর বাবু দাঁড়িয়ে আছেন একটা কাঁঠাল গাছের নিচে। কাঁঠাল গাছের অলে কয়েকটা বাদুড় ঝুলছে। তিনি বাদুড়গুলিকে নিউটনের সূত্র সম্পর্ক বলছেন। তখনই দেখা গেল— হারিকেন হাতে হেড স্যার আসছেন। কাঁঠাল গাছের কাছে এসে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। অমর বাবুর দিকে তাকিয়ে দুঃখিত গলায় বললেন, কে অমর?

জি স্যার।

কী করেছেন?

বাদুরগুলির সঙ্গে কথা বলিছিলাম স্যার।

ও আচ্ছা।

এদের সঙ্গে কথা বললে মনটা হালকা হয়। ওদের নিউটনের সূত্রগুলি বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম।

এই শীতে বাইরে ঘুরছেন। বাসায় গিয়ে ঘুমান।

ঘুম আসে না স্যার।

হেড মাস্টার সাহেব ইতস্তত করে বললেন, ইয়ে অমর বাবু, এখনো কি আপনি শূন্যে ভাসেন?

জ্বি-না। ঢাকা থেকে আসার পর আর ভাসিনি। যদি আবার কখনো ভাসতে পারি–আপনাকে বলব। আমার এখানে থাকতে ইচ্ছে করে না। ভাসতে ভাসতে দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করে।

দূরে কোথায়?

মহাশূন্যে অসীম দূরত্বে। চন্দ্র সূর্য গ্রহ নক্ষত্র সব ছাড়িয়ে…

ও আচ্ছা।

যাবার আগে আমি আপনাকে খবর দিয়ে যাব।

আচ্ছা।

.

শীত কেটে গিয়ে বর্ষা এসে গেল। অমর বাবু লোকালয় প্রায় ত্যাগ করলেন। বেশির ভাগ সময় বনে-জঙ্গলে থাকেন। রূপেশ্বরের পাশের গ্রাম হলদিয়ায় ঘন বন আছে। এখন ঐ বনেই তাঁর আস্তানা। তাঁর মেয়ে অতসী প্রায়ই তাকে খুঁজতে আসে। পায় না। মেয়েটা বনে বনে ঘুরে এবং কাঁদে। তিনি চার-পাঁচদিন পরপর একবার বের হয়ে আসেন। তাঁকে দেখে আগের অমর বাবু বলে চেনার কোনো উপায় নেই। যেন মানুষ না–প্রেত বিশেষ। মাথাভর্তি বিরাট চুল, বড় বড় দাড়ি। হাতের নখগুলি বড় হতে হতে পাখির ঠোঁটের মতো বেঁকে গেছে। স্বভাব-চরিত্র হয়েছে ভয়ঙ্কর। মানুষ দেখলে কামড়াতে আসেন। ইট-পাথর ছুঁড়েন। একবার স্থানীয় পোস্টমাস্টারকে গলা টিপে প্রায় মেরে ফেলতে বসেছিলেন। সবাই তাকে এড়িয়ে চলে। অতসীর বিয়ে হয়ে গেছে, সেও এখন আর বাবার খোঁজ আসে না।

.

দেখতে-দেখতে এক বছর পার হয়ে গেল। কার্তিক মাস। অল্প অল্প শীত পড়ছে। এগারোটার মতো বাজে। হেড স্যার খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়েছেন, হঠাৎ শুনলেন উঠান থেকে অমর বাবু ডাকছেন স্যার! স্যার! স্যার জেগে আছেন?

কে?

স্যার আমি অমর। একটু বাইরে আসবেন?

হেড স্যার অবাক হয়ে বিছানায় উঠে বসলেন। তাঁর স্ত্রী বললেন, খবর্দার, তুমি বেরুতে পারবে না। পাগল মানুষ– কি না কি করে বসে। ঘুমাও।

অমর বাবু আবার কাতর গলায় বললেন, একটু বাইরে আসুন স্যার! খুব দরকার। খুব বেশি দরকার।

হেড স্যার ভয়ে ভয়ে বাইরে এলেন। বিস্মিত হয়ে দেখলেন তাঁর বাড়ির সামনের আমগাছের সমান উচ্চতায় অমর বাবু ভাসছেন। অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় দৃশ্য। একটা মানুষ অবলীলায় শূন্যে ভাসছে। তার জন্যে পাখিদের মতো তাঁকে ডানা ঝাপ্টাতে হচ্ছে না।

স্যার দেখুন আমি ভাসছি।

হেড স্যার জবাব দিতে পারছেন না। প্রথম কয়েক মুহূর্ত মনে হচ্ছিল চোখের ভুল। এখন তা মনে হচ্ছে না। ফকফকা চাঁদের আলো। দিনের আলোর মতো সব দেখা যাচ্ছে। তিনি পরিষ্কার দেখছেন— অমর বাবু শূন্যে : ভাসছেন। এই তো ভাসতে ভাসতে খানিকটা এগিয়ে এলেন। সাঁতার কাটার মতো অবস্থায় মানুষটা শুয়ে আছে। কী আশ্চর্য!

স্যার দেখতে পাচ্ছেন?

হ্যাঁ।

আজ হঠাৎ করে শূন্যে উঠে গেলাম। বন থেকে বের হয়ে রূপেশ্বরের দিকে আসছি হঠাৎ শরীরটা হালকা হয়ে গেল। দেখতে-দেখতে দশ-বারো ফুট উঠে গেলাম। প্রথমেই ভাবলাম আপনাকে দেখিয়ে আসি। ভাসতে ভাসতে আসলাম।

আর কেউ দেখেনি?

না। কয়েকটা কুকুর দেখেছে। ওরা ভয় পেয়ে খুব চিৎকার করছিল। এরকম দেখে তো অভ্যাস নেই। আপনার কি বিশ্বাস হচ্ছে স্যার?

হ্যাঁ, হচ্ছে।

আমি ঠিক করেছি— ভাসতে ভাসতে মহাশূন্যে মিলিয়ে যাব।

ও আচ্ছা।

আমার মাথাটা বোধহয় খারাপ হয়ে গিয়েছিল— সারাক্ষণ ব্যথা করত। এখন ব্যথাও নেই। আগে কাউকে চিনতে পারতাম না। এখন পারছি।

শুনে ভালো লাগছে অমর বাবু।

অন্য একটা কারণেও মনে খুব শান্তি পাচ্ছি। কারণটা বলি–মহাশূন্যে ভাসার রহস্যটাও ধরতে পেরেছি।

হেড মাস্টার সাহেব আগ্রহের সঙ্গে বললেন, রহস্যটা কী?

রহস্যটা খুব সাধারণ। এতদিন কেন ধরতে পারিনি কে জানে। তবে স্যার আপনাকে রহস্যটা বলব না। বললে আপনি শিখে যাবেন। তখন দেখা যাবে সবাই শূন্যে ভাসছে। এটা ঠিক না। প্রকৃতি-চায় না। স্যার যাই?

অমর বাবু উপরে উঠতে লাগলেন। অনেক অনেক উঁচুতে। একসময় তাকে কালো বিন্দুর মতো দেখাতে লাগল।

হেড স্যারের স্ত্রী হারিকেন হাতে বারান্দায় এসে ভীত গলায় বললেন, কী ব্যাপার? পাগলটা কোথায়?

চলে গেছে।

তুমি বাইরে কেন? ভেতরে এসে ঘুমাও।

তিনি ঘরে এঙ্গে শুয়ে পড়লেন।

.

অমর বাবুকে এর পর আর কেউ এই অঞ্চলে দেখেনি। হেড স্যার সেই রাতের কথা কাউকেই বলেননি। কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না। সবাই পাগল ভাববে। আর একবার পাগল ভাবতে শুরু করলে শেষ পর্যন্ত পাগল হতেই হয়–এটা তো তিনি নিজের চোখেই দেখেছেন।
 
মিরখাইয়ের অটোগ্রাফ


নীলগঞ্জ হাই স্কুলের হেড মাস্টার জাহেদুর রহমান সাহেব নীতুর বড় মামা। বড় মামাকে নীতুর খুব পছন্দ। তিনি অন্যসব হেড মাস্টারের মতো না পড়া ধরেন না, গম্ভীর হয়ে থাকেন না, একটু হাসাহাসি করলেই বিরক্ত হন না। গল্প বলতে বললে গল্প শুরু করেন। সুন্দর সুন্দর গল্প, তবে নীতুর ধারণা, বানানো গল্প।

বানানো গল্প শুনতে নীতুর ভালো লাগে না। তার সঙ্গি গল্প শুনতে ইচ্ছে করে। সে গল্প শুনতে চায় কিন্তু প্রথমেই বলে নেয়— সত্যি গল্প বলতে হবে।

আজ নীতুর মামা জাহেদুর রহমান সাহেব একটা ভূতের গল্প শুরু করেছেন। তাঁর সামনে এক বাটি মুড়ি। বড় চায়ের কাপে এক কাপ চা। তিনি মুড়ি খাচ্ছেন এবং চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। নীতু তার সামনেই উপুড় হয়ে আছে। দুহাত দিয়ে মাথা তুলে রেখেছে। খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে এবং বোঝার চেষ্টা করছে মামা সত্যি গল্প বলছেন না মিথ্যা গল্প বলছেন। মিথ্যা গল্প হলে সে শুনবে না।

নীতুর বয়স বেশি না। এবার ক্লাস থ্রিতে উঠেছে। তবে তার খুব বুদ্ধি। গল্পের সত্যি-মিথ্যা সে চট করে ধরে ফেলে। ঐ তো সেদিন কাজের বুয়া তাকে গল্প বলেছে—

একদেশে ছিল একটা বাঘ। মাঘ মাসের শীতে বাঘ হইছে কাহিল।

কাপড়ের দোকানে গিয়ে বলছে, মিয়া ভাই, আমারে একখানা গরম চাদ্দর দেন। শীতে কষ্ট পাইতাছি…

নীতু বুয়াকে কড়া করে ধমক দিয়েছে। সে কঠিন গলায় বলেছে, মিথ্যা গল্প বলতে নিষেধ করেছি। এটা তো মিথ্যা গল্প।

বুয়া অবাক হয়ে বলেছে, কোনটা মিথ্যা?

বাঘ কি কথা বলতে পারে? বাঘ কি দোকানে যেতে পারে?

কথা তো সত্য বলছেন আফা… কিন্তু…

থাক বুয়া, তোমাকে গল্প বলতে হবে না।

নীতু খুব সাবধানী। কেউ তাকে ঠকাতে পারে না। বড় মামাও পারবেন না, চেষ্টা করলেও না। সে ঠিক ধরে ফেলবে।

নীতু বলল, কই বড় মামা, তারপর কী হলো বলো।

জাহেদুর রহমান সাহেব বলবেন, মুড়ি খেয়ে নিই।

উঁহুঁ, তুমি খেতে খেতে বলো।

জাহেদ সাহেব চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে বললেন, তখন আমার যুবক বয়স। চাকরির সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। খবর পেলাম, চিটাগাং পোর্টের স্কুলে একজন…

মামা, মিথ্যা গল্প না তো?

অসম্ভব। আমি মিথ্যা গল্প বলি কীভাবে? স্কুলের হেড মাস্টার মিথ্যা বলে কখনো শুনেছিস?

আচ্ছা বেশ, বলো?

কতদূর বলেছি? তোমার তখন যুবক বয়স…

ও হ্যাঁ, খবর পেলাম, চিটাগাং পোর্টের স্কুলে ইংরেজি একজন শিক্ষক নেবে…

মামা, তুমি কিন্তু একটু আগে বলেছ অঙ্কের শিক্ষক। তুমি মিথ্যা গল্প শুরু করেছ।

আরে না, ওরা একজন শিক্ষক নেবে। তাকে অঙ্ক-ইংরেজি দুটো পড়াতে হবে। এখন বুঝলি?

হুঁ।

ইন্টারভিউ দিলাম। চাকরি হয়ে গেল। ভালো বেতন। কর্ণফুলি নদীর ওপর বিরাট বাসা ভাড়া করলাম। তখন বাড়ি-ভাড়া ছিল সস্তা। দু শ-তিন শ টাকায় আলিশান বাড়ি পাওয়া যেত।

আলিশান বাড়ি মানে কী মামা?

আলিশান বাড়ি মানে রাজপ্রাসাদ।

তুমি রাজপ্রাসাদে থাকতে?

গরিবের রাজপ্রাসাদ বলতে পারিস। দুটা শোবার ঘর। বসার ঘর। টানা বারান্দা। দোতলা বাড়ি। একতলায় ট্যাক্স অফিস। দোতলায় আমি থাকি। আলো-হাওয়া খুব আসে। সমুদ্রের ওপর বাড়ি হলে যা হয়।

মামা, তুমি একটু আগে বলেছ নদীর ওপর বাড়ি।

কর্ণফুলি নদী সেখানে সমুদ্রে পড়েছে। কাজেই নদীর ওপর বললে যেমন ভুল হয় না, সমুদ্রের ওপর বাড়ি বললেও ভুল হয় না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দক্ষিণে তাকালে সমুদ্র দেখা যায়, আবার পশ্চিমে তাকালেই নদী। এখন বুঝেছিস?

হুঁ। তারপর কী হয়েছে বলো।

বাড়িটা ছিল লোকালয়ের বাইরে। দিনের বেলায় একতলার অফিসে কাজকর্ম হতো। লোকজনে গমগম করত। সন্ধ্যাবেলা সব সুনশান।

সুনশান কী মামা?

সুনশান হলো কোনো শব্দ নেই। নীরব। ভয়ঙ্কর নীরব।

তারপর?

তারপর একদিন কী হয়েছে শোনো–কাজে আটকা পড়েছিলাম, অফিস থেকে ফিরতে অনেক দেরি হলো…

অফিস বলছ কেন মামা-তুমি না স্কুলে মাস্টারি কর!

বাবারে, স্কুলেও তো অফিস আছে। ছাত্র পড়ানো শেষ করে সেই অফিসে হেড মাস্টারের সঙ্গে মিটিং করতে গিয়ে দেরি। এইজন্যেই অফিস বলছি।

ও আচ্ছা।

আমি দুপুরে বাইরে খেয়ে নিই। রাতে নিজে বেঁধে খাই। চারটা চাল ফুটাই, আলুভর্তা করি, একটা ডিম ভাজি। গাওয়া ঘি গরম ভাতের ওপর ছড়িয়ে আলুভর্তা দিয়ে ভাত খাওয়ার মজাই অন্য…।

আমার আলুভর্তা আর গাওয়া ঘি দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে মামা।

এখন খাবি?

হুঁ।

একটু আগেই তো খেলি। খাওয়ার কথা শুনে ক্ষিদে পাওয়া, ভূতের কথা শুনে ভয় পাওয়া— এসব তো ভালো লক্ষণ না। এসব হলো জটিল এক রোগের লক্ষণ। রোগটার নাম হচ্ছে শোনা রোগ। এই রোগ হলে শোনা কথায় আক্কেল গুডুম হয়…।

তুমি গল্প বাদ দিয়ে অন্য কথা বলছ…

আমি অন্য কথা বলতে চাইনি, তুই-ই তো অন্য কথা নিয়ে এলি। যাই হোক, গল্প শুরু করি–কী যেন বলছিলাম, ও হ্যাঁ, আমার বাসা যে এলাকায় সে এলাকাটা সন্ধ্যার পর সুনশান নীরব হয়ে যায়। সেদিনই বাসাটা ছিল অন্যদিনের চেয়েও নীরব। হোটেলে ভাত খেয়ে যখন ফিরছি—

মামা, তুমি এক্ষুনি বললে আলুভর্তা দিয়ে গাওয়া ঘি দিয়ে ভাত খেলে?

তোকে গল্প বলাই এক যন্ত্রণা! সবটা না শুনেই জেরা শুরু করিস। পুরোটা শুনে তার পরে জেরা করবি। ঠিক করেছিলাম, বাসাতেই বেঁধে খাব। রাঁধতে গিয়ে দেখি চুলা ধরানো যাচ্ছে না। এক ফোঁটা কেরোসিন নেই। বাধ্য হয়ে হোটেলে খেতে গেলাম।

ও আচ্ছা।

হোটেলটা আবার অনেকখানি দূরে। তিন কিলোমিটার হবে। যেতে লাগে এক ঘণ্টা। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ফিরছি। রাত নটার মতো বাজে। নির্জন রাস্তা। খুব হাওয়া দিচ্ছে—শীত শীত লাগছে। চাদর গায়ে ছিল। চাদর দিয়ে নিজেকে মুড়িয়ে নিয়ে এগুচ্ছি–হঠাৎ মনে হলো, কে যেন চাদরের খুট ধরে আমার সঙ্গে সঙ্গে এগুচ্ছে। তাকিয়ে দেখি কেউ না। নিশ্চয়ই মনের ভুল। কিন্তু আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম, যখন আমি হাঁটি কে যেন চাদরের খুট ধরে সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে। দাঁড়ালেই চাদরের খুট ছেড়ে দেয়। আমি হতভম্ব। ব্যাপারটা কী? চাদরে কোনো সমস্যা আছে নাকি? আমি গা থেকে চাদর খুলে ভাজ করে ছোট করলাম। ফেলে দিলাম কাঁধে। শীত লাগলে লাগুক। চাদরের খুট ধরে তো আর কেউ এখন টানাটানি করবে না। আবার হাঁটা ধরতেই ভয়ঙ্কর এক চমক খেলাম। কে যেন এখন আমার বাঁ হাতের কড়ে আঙুল ধরে হাঁটছে। অথচ কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

নীতু ভীতু গলায় বলল, মামা, কে তোমার কড়ে আঙুল ধরে হাঁটছে?

কিছুই বুঝতে পারিনি। তবে যে হাঁটছে সে শক্ত হাতে আমার আঙুল চেপে ধরে আছে। মনে হচ্ছে, অল্প বয়স্ক কোনো বাচ্চা। তুলতুলে হাত। নরম আর ঠাণ্ডা। আমি ঝাকি দিয়ে হাত সরিয়ে নিলাম। দুপা এগুতেই আবার আঙুল চেপে ধরল।

নীতু কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, মামা, আমার ভয় লাগছে। জাহেদুর রহমান সাহেব বললেন–তোর আর কি ভয় লাগছে? আমার ভয় যা লাগছিল তার সীমা-পরিসীমা ছিল না। শরীর ঘেমে গেল বুক ধুকধক করতে লাগল। একবার ইচ্ছা করল উঠে দৌড় দেই।

তুমি কী করলে? দৌড় দিলে?

না, দৌড় দিলাম না। কারণ, স্যান্ডেল পুরনো, স্যান্ডেলের ফিতা নরম হয়ে আছে। দৌড় দিলেই ফিতা ছিঁড়ে যাবে। আমি সিগারেট ধরালাম।

সিগারেট ধরালে কেন মামা?

সিগারেটে আগুন আছে। আগুন থাকলে ভূত-প্রেত কাছে ভিড়ে না।

ওটা কি ভূত ছিল মামা?

না, ভূত ছিল না। ওটা ছিল টুতের বাচ্চা।

নীতু অবাক হয়ে বলল, টুতের বাচ্চা আবার কী?

জাহেদুর রহমান সাহেব বললেন, আমরা সব সময় বলি না বাঘ-টাগ, ভূত-টুত? বাঘের যেমন বাচ্ছা আছে, সেরকম আছে টাগের বাচ্চা। আবার ভূতের বাচ্চার মতো আছে টুতের বাচ্চা।

ওরা কেমন মামা?

ভয়ঙ্কর। ভূতরাই ওদের ভয়ে অস্থির, মানুষের কথা ছেড়ে দে। একটা টুতের বাচ্চা থাকলে তার ত্রিসীমানায় কোনো ভূতের দেখা পাবি না।

ওরা দেখতে কেমন?

দেখতে কেমন কী করে বলব? ওদের তো আর চোখে দেখা যায় না।

হাত দিলে বুঝা যায়?

অবশ্যই যায়।

তারপর কী হলো মামা বলো।

আমি তো ভয়ে আঁতকে উঠলাম। তবে চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললাম, কে? কে?

ধমক দিলে কেন মামা?

ভয় কাটানোর জন্যে দিলাম। খুব বেশি ভয় পেলে ধমক দিতে হয়। ধমকের জোর যত বেশি হয় ভয়ও তত কমে।

তোমার ধমকের জোর খুব বেশি ছিল?

ভয়ঙ্কর ছিল। নিজের ধমকে নিজেই ভয় পেয়ে গেলাম। আর তখন শুনলাম মিনমিন করে কে যেন কথা বলল। কথা পরিষ্কার না, একটু জড়ানো। আমি বললাম, কথা কে বলছে?

আমি?

আমিটা কে? নাম কী?

আমার নাম মিরখাই।

তুই কে? ভূত নাকি?

জি না, আমি ভূত না, আমি টুত।

তুই আমার আঙুল ধরে আছিস কেন? ভয় দেখাবার চেষ্টা করছিস?

হুঁ।

কেন?

ভূতের বাচ্চা হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। আমি বললাম, ব্যাপারটা কী? কাঁদছিস কেন? কোনো জবাব নেই–কান্না আরো বেড়ে গেল। আমার মায়াই লাগল; ব্যাপার কিছু বুঝছি না। কেন কাঁদছে জানা দরকার।

মামা, ওর কি পেটে ব্যথা?

তখনও জানি নাআ–তবে পেটে ব্যথা হতে পারে। পেটে ব্যথার কারণে কাঁদাটা অস্বাভাবিক না। আবার অন্য কারণও থাকতে পারে হয়তো পথ হারিয়ে ফেলেছে। খুব অল্প বয়স যাদের ওরা মাঝে মাঝে পথ হারিয়ে ফেলে— তখন কান্নাকাটি শুরু করে আমি বললাম, কী রে তুই পথ হারিয়ে ফেলেছিস?

না।

পেটে ব্যথা?

না।

কেউ মারধর করেছে?

না।

তাহলে ব্যাপারটা কী খুলে বল। কান্না বন্ধ করে বল হয়েছে কী।

টুতের বাচ্চা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, পরীক্ষায় ফেল করেছি।

বলিস কি?

নীতু বলল, মামা, টুতের বাচ্চাদের স্কুল আছে?

অবশ্যই আছে। প্রাইমারি এডুকেশন এদের জন্যে কম্পলসারি।

ওদের কী কী পড়ানো হয়?

সবই পড়ানো হয়— অঙ্ক, ভূগোল, ইতিহাস, ধর্ম…

ও কীসে ফেল করেছে?

ও ফেল করেছে ভয় দেখানো বিষয়ে।

সেটা কী?

সব ভূত-টুতের বাচ্চাদের ১০০ নম্বরের একটা পরীক্ষা দিতে হয়— ভয় দেখানো পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় এরা মানুষকে ভয় দেখায়। যে ভয় দেখাতে পারে না সে ফেল করে। ভয় দেখানো পরীক্ষায় ফেল মানে ভয়াবহ ব্যাপার। এই বিষয়ের ফেলের অর্থ হলো সব বিষয়ে ফেল। মিরখাই কাউকে ভয় দেখাতে পারে না। পরপর দুবার ফেল করেছে।

নীতু বলল, আহা বেচারা!

আজ তার পরীক্ষা। সে আমাকে ভয় দেখাবে। আমি যদি ভয় পাই তাহলে পাস করবে। ভয় না পেলে আবার ফেল। আজ ফেল করলে পরপর তিনবার ফেল হবে— তাকে স্কুল থেকে বের করে দেবে।

কী ভয়ঙ্কর!

ভয়ঙ্কর মানে মহাভয়ঙ্কর!

তুমি ভয় পাচ্ছ না কেন মামা? একটু ভয় পেলে কী হয়?

আমি নিজেও তাই ঠিক করলাম— ভাবলাম, এমন ভয় পাব যে টুত সমাজে হইচই পড়ে যাবে। মিরখাই শুধু যে পরীক্ষায় পাস করবে তাই না, মুন-মার্ক পেয়ে পাশ করবে

মুন-মার্কটা কী?

একশতে আশি নম্বরের ওপর পেলে হয় স্টার মার্ক। একশতে ৯০ নম্বরের ওপর পেলে হয় মুন-মার্ক। যাই হোক, আমি বললাম, মিরখাই, তোর পরীক্ষা শুরু হবে কখন?

মিরখাই বলল, রাত বারোটার পর। হেড স্যার আসবেন–অন্য স্যাররাও আসবেন। তখন আমি আপনাকে ভয় দেখাব। যদি ভয় পান তাহলে আমি পাশ করব। আর যদি না পান তাহলে…

মিরখাই ডাক ছেড়ে কাঁদতে লাগল। আমি বললাম, কান্না বন্ধ কর মিরখাই। কোনো কান্না না। আজ তোকে আমি পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেব–এমন ভয় পাব যে তাদেরই আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবে।

সত্যি?

হ্যাঁ সত্যি। তুই আসিস সবাইকে নিয়ে। চোখ মোছ। এত কাঁদবি না। যা, বাসায় যা।

তারপর কী হলো মামা?

আজ থাক। বাকিটা কাল বললে কেমন হয় রে নীতু!

খুব খারাপ হয়। তোমাকে আজই বলতে হবে। এক্ষুনি বলতে হবে। ওরা কী করল— এলো তোমার কাছে?

হুঁ।

রাত বারোটায়?

বাবোটা এক মিনিটে। বিরাট টুতের দল নিয়ে মিরখাই উপস্থিত। সেই দলে টুতের বাবা-মাও আছেন। তারা দেখতে এসেছেন টুত পরীক্ষা পাস করতে পারে কিনা।

তুমি তখন কী করছ?

আমি ঘুমের ভান করে পড়ে আছি। নাক ডাকার মতো আওয়াজও করছি যাতে কেউ বুঝতে না পারে এটা আমার নকল ঘুম। কিন্তু আমার কান খুব সজাগ— কী হচ্ছে সব বুঝতে পারছি। জানালা দিয়ে টুত ঢুকল, সেটা বুঝলাম। টুতের স্যাররা যে জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছেন সেটাও টের পেলাম…। টুত এসে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, মামা, আমি এসেছি।

ও তোমাকে মামা ডাকে?

আগে কিছু ডাকত না। হঠাৎ ডাকা শুরু করল।

আমার মনে হয় ও তোমাকে পছন্দ করেছে বলেই মামা ডাকছে।

হতে পারে। তারপর কী হলো শোন–টুত বলল, মামা, আমি আপনাকে ভয় দেখাতে এসেছি।

আমি বললাম, ভেরি গুড। ভয় দেখানো শুরু কর।

টুত বলল, কীভাবে ভয় দেখাব মামা?

আমি বললাম, প্রথমে টান দিয়ে গা থেকে লেপটা সরিয়ে দে। তারপর আমার পায়ের পাতায় সুড়সুড়ি দে। সুড়সুড়ি দিতেই আমি চিৎকার করে উঠব। আমার চিৎকার শুনে তুই খিকখিক করে হাসবি। তারপর জানালাটা বন্ধ করবি। খুলবি। বন্ধ করবি। খুলবি। আমি তখন বাতি জ্বালাব। বাতি জ্বালালেই তুই নিভিয়ে দিবি। যতবার জ্বালাব ততবার তুই নিভিয়ে দিবি। বাতি নিভিয়ে খিকখিক করে হাসবি।

টুত বলল, আচ্ছা। বলেই সে করল কি–টান দিয়ে আমার গা থেকে লেপ সরিয়ে দিল।

আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। সে আমার পায়ে সুড়সুড়ি দিতে শুরু করল। আমি চেঁচিয়ে বললাম, কে কে! কে আমার পায়ে সুড়সুড়ি দেয়? কে কে?

আর তখন খিকখিক হাসির শব্দ শোনা যেতে লাগল। আমি ভয়ে আঁ আঁ করতে লাগলাম।

নীতু বলল, মামা, এটা তো সত্যি ভয় না, মিথ্যা ভয়। তাই না?

হ্যাঁ মিথ্যা ভয়। কিন্তু কার সাধ্য সেটা বুঝে। আমি আঁ আঁ করে চিৎকার করছি আর তখন জানালা বন্ধ হচ্ছে আর খুলছে। আমি চিকন স্বরে চেঁচাতে লাগলাম— ভূত ভূত ভূত। আমাকে বাঁচাও! আমাকে বাঁচাও! কে কোথায় আছে? আমাকে বাঁচাও। ভূত আমাকে মেরে ফেলল! ভূত আমাকে মেরে ফেলল!

আমার চিৎকার হইচই শুনে টুত নিজেই ভয় পেয়ে গেল। সে আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, মামা, আপনি কি সত্যি সত্যি ভয় পাচ্ছেন?

আমি বললাম, কথা বলে সময় নষ্ট করিস না–তুই এখন টেবিল থেকে জিনিসপত্র মাটিতে ফেলতে থাক। কাচের জিনিস ফেলবি না। ভাঙা কাচে পা কাটতে পারে। বই-খাতা শব্দ করে মাটিতে ফেল।

ধুম ধুম শব্দে বই-খাতা মাটিতে পড়তে লাগল। আমি তখন চড়কির মতো সারা ঘরে ঘুর পাক খাচ্ছি আর বলছি–এসব কী হচ্ছে! এসব কী হচ্ছে? ভূত আমাকে মেরে ফেলল! আমাকে বাঁচাও! কে কোথায় আছে আমাকে বাঁচাও!

সুইস টিপে বাতি জ্বালালাম। মিরখাই সঙ্গে সঙ্গে বাতি নিভিয়ে ফেলল। আমি চিৎকার করে বললাম, এসব কী হচ্ছে! বাতি নিভে যাচ্ছে কেন? বলে আবার বাতি জ্বালালাম। মিরখাই আবার বাতি নিভিয়ে ফেলল। আমি একটা বিকট চিৎকার করে গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে মেঝেতে পড়ে গেলাম।

মিরখাইয়ের স্কুলের হেড মাস্টার সাহেব বললেন, থাক থাক, আর লাগবে, আর লাগবে না। বাদ দাও, শেষে মরেটরে যাবে। দেখে মনে হচ্ছে হার্ট এটাক হয়ে গেছে। মিরখাই, তুমি পাস করেছ। শুধু পাস না, মুন-মার্ক পেয়ে পাস করেছ। ভেরি গুড। ভেরি গুড। চল যাওয়া যাক।

মিরখাই আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, মামা যাই।

আমি বললাম, আচ্ছা যা, আর শোন, ভালোমতো পড়াশোনা করিস।

নীতু বলল, মামা, গল্প কি শেষ হয়ে গেল?

হ্যাঁ।

এটি কি সত্যি গল্প মামা?

অবশ্যই সত্য গল্প।

মিরখাইয়ের সঙ্গে কি এখনো দেখা হয়?

হয়। আসে মাঝেমধ্যে।

এখন মিরখাই কী করে?

ও এখন ভূত এবং টুত সমাজে বিরাট ব্যক্তিত্ব। টুত ইউনিভার্সিটিতে মাস্টারি করে। এসোসিয়েট প্রফেসর। চারটা বই লিখেছে। বিরাট নাম করেছে বই লিখে।

কী বই লিখেছে?

মানুষকে কী করে ভয় দেখাতে হয় সেই বিষয়ে বই। মানুষকে ভয় দেখানোতে সে খুব নাম করেছে তো, সে জন্যে ঐ বিষয়ে শেষ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে, গবেষণা করেছে। পিএইচ.ডি ডিগ্রি নিয়েছে। টুত সমাজে মানুষকে ভয় দেখানোর কৌশল এখন তার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। সে খুবই জ্ঞানী ব্যক্তি।

সত্যি, মামা?

হ্যাঁ সত্যি। তার একটা বই আছে, টুত ইউনিভার্সিটিতে পাঠ্য–মানুষকে ভয় দেখানোর সহজ, জটিল ও মিশ্র পদ্ধতি, আরেকটা বই আছে যেটা নানা ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। খুবই কঠিন বই, নাম হল–ভয়ের রূপরেখা।

উনি বাচ্চাদের জন্যে বই লিখেননি?

নিচু ক্লাসের ছাত্রদের জন্যেও তার বই আছে— খেলতে খেলতে ভয় দেখানো। মিরখাইয়ের সঙ্গে আলাপ করতে চাস? চাইলে একদিন আসতে বলি।

না মামা, আসতে বলার দরকার নেই।

তোর অটোগ্রাফ লাগবে? অটোগ্রাফ লাগলে অটোগ্রাফের খাতাটা দিয়ে দিস। অটোগ্রাফ এনে দেব।

জাহেদুর রহমান সাহেব নীতুর অটোগ্রাফের খাতায় মিরখাইয়ের অটোগ্রাফ এনে দিয়েছেন। নীতু খাতা দেখে বলল, কোনো তো লেখা দেখছি না মামা।

জাহেদ সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, দেখবি কী করে? মিরখাই নিজে যেমন অদৃশ্য তার হাতের লেখাও অদৃশ্য।

এখানে কী লেখা আছে মামা?।

এখানে লেখা— স্নেহের নীতুকে। নীতু, ভয়কে জয় কর, মিরখাই। খাতাটা যত্ন করে রাখিস মা। টুতের অটোগ্রাফ পাওয়া সহজ ব্যাপার না।

নীতু তার অটোগ্রাফের খাতা খুব যত্ন করে তুলে রেখেছে। কেউ এলেই সে মিরখাইয়ের অটোগ্রাফ খুব আগ্রহ করে দেখায়।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top